#নিকুঞ্জ_কানন
#নুজহাত_আদিবা
[পর্ব ১৪]
রুমি আর শোভা সকাল সকালই বাড়ির পথে রওনা দিয়েছে। আজ আহসান বাড়ি নেই; সে শহরে চাকরির পরীক্ষা দিতে গেছে। তরীও কলেজে গেছে;মাজদাক সারোয়ারও বাড়ি নেই। মধুবিবি বাড়িতে একা বলে তাগিদটা এত বেশি। এলাকায় ঢোকার পথে শোভাকে কেউ শব্দ করে সালাম দিলো। রুমি আর শোভা উভয়ই পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখলো রঙ্গন দাঁড়িয়ে। শোভাকে সালাম দিয়ে সে বললো,
” কেমন আছেন খালাম্মা? কতদিন পর দেখলাম আপনাকে। কোথায় গিয়েছিলেন?
শোভা হেসে রঙ্গনের সালামের জবাব দিয়ে কথা বললো। রুমি লক্ষ্য করলে রঙ্গন আঁড়চোখে তাঁরই দিকে তাকিয়ে। রুমিও কটমট করতে করতে রঙ্গনের দিকে তাকালো। এই বিটকেলটাকে তাঁর সহ্য হয় না! মনে মনে সে রঙ্গনকে উদ্দেশ্য করে বললো,
” ব’দমাশ হত’চ্ছাড়া! তোর কপালে চৌরাস্তার মোড়ের পাগল জুটবে দেখিস!”
★
তরী কলেজে গিয়ে আজ বড় ফাঁ’সা ফেঁসেছে। টিফিন ব্রেকে স্ক্রসবেল ঠিক করার সময় মেয়েদের; চোখে তরীর গলায় ঘাড়ে থাকা লালচে দাগগুলো জ্বলজ্বল করে উঠলো। নাতাশা আর সুহা তরীকে এসে খামচে ধরে বললো,
” কীরে তরী! বরের সাথে দেখছি ভাব-ভালোবাসা উপচে পরছে। দুলাভাইয়ের সঙ্গে ইন্টুপিন্টু হয়েছে তোর তাই না? এত তাগড়া শরীরের ঝড় সামলাতে পারলি তরী? উফ! লাভবাইট’স!
মাঝে সোহাগী এসে বললো,
” হেলমেট পড়ে মাঠে নেমেছিলে বান্ধবী? পরে ওয়াওয়া চলে আসলে কিন্তু ঝামেলা। শিশুর কোলে শিশু হিহি!”
তরী লজ্জায় মাথা ঘুরিয়ে উঠলো। সকলের অগোচরে কোথায় যে গিয়ে পালালো সে। কে জানে? তবে, নাতাশা তরীকে ঠিকই খুঁজে বের করলো। দুই বান্ধবীর গল্পের মাঝে তরী বলে উঠলো,
” একটা বিরাট ঝামেলায় পড়েছি জানিস?”
নাতাশার হাতে কাঁচা আম। কলেজের পেছনের গাছে ইটের টুকরো দিয়ে ঢিল মে’রে সে আম পেরেছে। আমে শক্ত কামড় বসিয়ে সে বললো,
” কী হয়েছে দোস্ত? কোনো সমস্যা? ”
তরী গাল ফুলিয়ে বললো,
” আজকাল একটা বেয়া’রা মেয়ে তোর দুলাভাইকে ফোন দিয়ে বিরক্ত করে। এমন ভাবে কথা বলে যেন সে আহসানকে খুব করে চেনে। আহসানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। আহসান জানেই না মেয়েটাকে। খুব বাজে বাজে দুষ্ট কথা বলে মেয়েটা।”
নাতাশা ভ্রু কুঁচকে বললো,
” মেয়েটার নম্বর আছে তোর কাছে? ”
তরী দ্রুত নোট খাতাটা বের করে নাম্বারটা নাতাশার কাছে দিলো। নাম্বারটা কাল রাতে সে আহসানের ফোন থেকে টুকে রেখেছিল। গতরাতে ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে মেয়েটা আহসানকে আবার কল করেছিল। তখনই লিখে রেখেছিল নম্বরটা তরী। নাতাশা গোপনে ব্যাগ থেকে বাটন ফোনটা বের করলো। বাসা দূরে বিধায় নিরাপত্তার জন্য ফোনটা কাছে রাখে সে। তবে, নাম্বারটা ডায়াল করার সময়ই বড়সড় একখানা বিপত্তি ঘটলো। নাম্বারটা নাতাশার ফোনে আগে থেকেই সেভ করাই আছে। নাম্বারটা স্বয়ং ঝুমুরের! ঝুমুরের সঙ্গে একই ব্যাচে আলতাফ স্যারের কাছে পড়ে নাতাশা। সেকারণেই ঝুমুরের নম্বরটা ফোনে সেভ করা ছিল। কিন্তু, ঝুমুর এমনটা কেন করবে? এতে তাঁর লাভটা কী? নাতাশা বিস্ফোরিত কণ্ঠে তরীকে বললো,
” তরী!”
তরী পাশ থেকে জবাব দিলো,
” কী হয়েছে? পেলি মেয়েটাকে? কিছু বলেছে ওই মেয়েটা?”
নাতাশা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বললো,
” নম্বরটা কার জানিস তরী?”
তরী প্রশ্ন করলো,
” কার?”
নাতাশা ভয়ে ভয়ে বললো,
” আমাদের ক্লাসে একটা মেয়ে আছে না ঝুমুর? ঝুমুরেরই নাম্বার ওটা।”
তরীর তৎক্ষনাৎ স্মরণে এলো মাস কয়েক আগে; কলেজ আগে আগে ছুটি হয়েছিল। আহসানের আসতে দেরি হয়েছিল বিধায় তরী তাঁকে ঝুমুরের ফোন থেকে কল করেছিল। তবে কী ঝুমুর? তরী আর এক মিনিটও সেখানে দাঁড়ালো না। যে মেয়ে কারো সঙ্গে চোখ তুলে উঁচু স্বরে কথা অবধি বলতো না। সে আজ রণচণ্ডী হয়ে উঠলো। ক্ষুদ্ধতা, রাগ যেন চুইয়ে চুইয়ে পরছে তাঁর শরীর হতে। তরী এক দৌড়ে ক্লাসে গেল। বেঞ্চের প্রতিটি কোনে কোনে, পুরো ফ্লোর জুড়ে ঝুমুরকে খুঁজলো। ঝুমুরের ঘনিষ্ঠ বান্ধবীরা জানালো ঝুমুর ঝালমুড়ি কিনতে ক্যান্টিনে গেছে। তরী আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করলো না। দ্রুত ক্যান্টিনে গেল। ঝুমুর তখন ক্যান্টিনের বসার বেঞ্চগুলোতে বসে বসে ঝালমুড়ি খাচ্ছে। তরী তাঁকে গিয়ে বললো,
” তোমার সমস্যা কী ঝুমুর? ”
ঝুমুর কেমন থতমত খেয়ে উঠলো। কৃত্রিম অবাক হওয়ার ভান করে বললো,
” কী হয়েছে? কী করেছি আমি?”
তরী তেতে উঠে বললো,
” তুমি জানো না কী করেছো? তুমি কেন আমার বরকে কল দাও? অন্যের বরের সঙ্গে এত কী কথা তোমার? কালও মাঝরাতে কল দিয়েছিলে। পেয়েছো-টা কী হ্যাঁ?”
প্রবাদে আছে চোরের মায়ের বড় গলা। ঝুমুরের ক্ষেত্রে যেন তাই হলো। ঝুমুর চোখ কপালে তুলে বললো,
” আমি? আমি কাকে কল দিয়েছি? যেনতেন মানুষকে ঝুমুর কল দেয় না! আর তোমার বর নিয়ে যেন কী বললে? আমি কেন আহসানকে কল দিতে যাবো?”
তরী দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
” তুমি যদি উনাকে কল না-ই দিয়ে থাকো। তবে, ওনার নাম জানলে কী করে? আমি তো তোমাকে একবারও নামটা বলিনি! তুমি আসলেই একটা চরিত্রহীন, লম্পট মেয়ে। অন্যের বরের সঙ্গে ফস্টিনস্টি করো!”
ঝুমুর রা’গে বিক্ষিপ্ত হয়ে তরীর ইউনিফর্মের কলার ধরে টান দিলো। শরীরে হাত পরায় তরীও ক্রোধে ঝুমুরের বুকে ধাক্কা দিয়ে তাঁকে ঠেলে সরালো। ঝুমুর প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে তরীর বিনুনিতে হাত রাখলো। তরী বেজায় ক্ষেপে ঝুমুরের বিনুনি টেনে ধরলো। মোদ্দা কথা ক্যান্টিনের সামনে এক ভয়াল যুদ্ধ সংঘটিত হলো সেদিন। যাকে বলে চুল চেরা যুদ্ধ! তরী হুট করে কারো গায়ে হাত তোলার মতো মেয়ে নয়। তরী শান্ত হয়েই সমঝোতায় আসতে চেয়েছিল। তবে, ঝুমুর তা শোনেনি। নিজের নির্বুদ্ধিতায় সে বিপদ ডেকে এনেছে। কী প্রয়োজন ছিল তরীর গায়ে হাত তোলার? ক্যান্টিনের ব্যাপারটা সেদিন সাংঘাতিক পর্যায় গড়ালো। নাতাশা অনেকভাবে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করলো। তবে, সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলো! কথায় আছে, মন্দ কথা বাতাসের আগেও ছড়িয়ে পড়ে। ঠিক তেমনটাই যেন তরীর বেলাতেও হলো।পুরো কলেজেই এক প্রকার রটিয়ে গেল। কলেজের অধ্যক্ষ ডেকে পাঠালেন তরী আর ঝুমুরকে। উভয়ই ভয়ে, লজ্জায় কাঁচুমাচু হয়ে অধ্যক্ষের কক্ষে গেল। অধ্যক্ষ যখন উভয়ের কলহ কোন্দলের কারণ জানতে চাইলো তরী কিংবা ঝুমুর কেউই কোনো উত্তর দিতে পারলো না। অতঃপর অধ্যক্ষ আবুল কাসেম ঝুমুর এবং তরীর উভয়ের অভিভাবককে ডেকে পাঠালেন।
★
রঙ্গনের আজ মাথা ঠিক নেই। এমনিতেও সে আধ-পাগলা! রুমি-ঝুমিকে দেখলে তাঁর মাথা আরো ঠিক থাকে না। গিয়েছিল সে ব্যাংকে আজ। বাবা মা’রা যাওয়ার পর থেকে বাবার পেনশনের টাকায় তাঁদের সংসার চলে। ব্যাংক একাউন্টে কী যেন একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে সেটা ঠিক করতে। পথিমধ্যে রুমি-ঝুমির সঙ্গে দেখা। কী বেজায় মিষ্টি চাঁদপানা মুখ তাঁর! রঙ্গনকে দেখলেই মেয়েটা কেন যে মুখখানা ওভাবে ঘুরিয়ে ফেলে কে জানে! রঙ্গন বাড়িতে ঢুকেই রান্নাঘরে গিয়ে দাঁড়ালো। তাঁর মা নাহার বেগম মনোযোগ সহকারে কী যেন রাঁধছে। রঙ্গনের এতসব জেনে কাজ নেই। সে মায়ের আঁচল চেপে ধরে বললো,
” ও আম্মা একটা কথা শুনো।”
নাহার বেগম ছেলেকে সরিয়ে দিয়ে বললেন,
” যা বলার বইলা ফালা। সকাল সকাল জ্বালাইস না বাপ!”
রঙ্গন মেয়েদের মতো লজ্জা পাবার ভান করে বললো,
” আম্মা আপনার কী একা একা লাগে না? আব্বা মা’রা যাওয়ার আপনি একা হইয়া গেসেন। আপনার একটা সঙ্গী দরকার। ”
নাহার বেগম রঙ্গনের কথায় সন্দেহের ঘ্রান পেলেন। সোজা কথা সোজা ভাষায় বলার মতো ছেলে তাঁর নয়। খুন্তি হাতে পাশ ফিরে বললেন,
” কী বলবি তাড়াতাড়ি বল বাপ। আমার তরকারি পুইড়া যাইতাসে।”
রঙ্গন লজ্জামাখা গলায় বললো,
” আমার বিয়া করতে মন চায় আম্মা। আপনের যা মন চায় করেন। দরকার হইলে আমারে ত্যাজ্যপুত্র কইরা দেন। জিন্দেগিতে আমার চেহারা দেইখেন না। তাও আমারে রুমিরে আইনা দেন। আমার রুমিরে ভাল্লাগে। আমি রুমির সঙ্গে সংসার করতে চাই।”
নাহার বেগম যেন আকাশ ফেরেফুরে মাটিতে এসে পড়লেন। ছেলে বলে কী তাঁর! শেষ পর্যন্ত রুমি? নাহার বেগম রঙ্গনের দিকে খুন্তি তাক করে বললেন,
” এই বেলাজ! তোর মধ্যে লজ্জাশরম হায়া নাই রে? নিজের বিয়ার কথা কেমনে ছড়ছড়ায়া বইলা দিলি?”
রঙ্গন হাই তুলে বললো,
” তো বিয়াশাদী কী আমারে দিবা না আম্মা? কই এই বয়সে পাঁচ ছয়টা নাতি-নাতনি নিয়া ছেলের বউয়ের ঘর করবা! তুমি এখনও রসুইঘরে খুন্তি ঘুরাও! কপালও আমার এক্কেবারে সিলমা’রা!”
নাহার বেগম আর কিছু বললেন না। খুন্তি হাতে রঙ্গনের পিছু ছুটলেন। রঙ্গন সব ছেড়ে ছুঁড়ে নারকেলগাছ বেয়ে ওপরে উঠে গেল। নীচে থেকে নাহার বেগম চিৎকার করেই যাচ্ছেন। রঙ্গনের সে-সব শোনার সময় নেই। সে নারকেলগাছের ওপরে বসেই মাকে ভেংচি কাটছে! বিয়ে সে রুমিকেই করবে। মা ঘরে জায়গা না দিলে নারকেলগাছেই রুমিকে নিয়ে সংসার পাতবে। লোকমুখে ছড়িয়ে যাবে তাঁদের নাম। সকলে তাঁদের চিনবে নারকেলগাছ দম্পতি নামে!
★
তরী আজ ভয়াবহ আতংকে জড়জড়িত! আহসানকে কী করে সে আজকের ক্যান্টিনের কথাটা বলবে? কাল কলেজে অভিভাবক ছাড়া ঢুকতেই দেবে না তরীকে। আহসান যদি সব শুনে বকা দেয়? আবার যদি মা’রে? ভয়ে আতংকে তরীর মুখ শুকিয়ে গেল। দুপুরে টেবিলে বসে ভাত নাড়াচাড়া করে গেল সে। সেভাবে কিছুই খেলো না। মধুবিবি তরীকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
” খাও না কেন মাইয়া? খালি ভাত লারতাসো! ঠিকমতো না খাইলে স্বামীর আদর সোহাগ সহ্য করবা কেমনে? এমনেই যা খুঁটির মতোন শরীল! আমার নাতী জাইত্তা ধরলে তো চটকাইয়া ফেলবো। শরীল দেখসো তাঁর? পাডার মতো তাগড়া শরীল। চাইপ্পা ধরলে দম আটকাইয়া ভসকায়া থাকবা!”
তরী বিষম খেয়ে এদিক ওদিক তাকালো। বুবুর কী সব বাজে কথা! ছি ছি লজ্জা লজ্জা! তবে, ঘটনা আংশিক সত্য। আহসান ওভাবে রাতে তাঁকে চেপে ধরলে সত্যি তাঁর দম আঁটকে আসে। ভয় আতংকের মাঝেও তরী আরেকদফা লাজে লাল হলো। যাকে বলে লালবতী!
রাতে আহসান যখন বাড়ি ফিরলো; তরী ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আঁচল ঘোরাতে ঘোরাতে আহসানকে বললো,
” আপনাকে কাল একবার আমার সঙ্গে কলেজে যেতে হবে।”
আহসান জিজ্ঞাসুক কন্ঠে বললো,
” কেন? প্যারেন্টস মিটিং?”
তরী কোনো জবাব দিলো না। সেই বিষয়ে কোনো কথা বললো না। সারারাত ভয়ে তাঁর ঘুম উবে গেল। আহসান তাঁকে কাল নিশ্চিত কাঁচা চিবিয়ে খাবে। যদি বাড়ি থেকে বের করে দেয়? কোথায় যাবে তরী? এসব চুলোচুলি কারবারের কথা শুনলে মনোয়ারাও তাঁকে বাড়িতে জায়গা দেবে না।
সকালে তরীর সঙ্গে আহসান স্বাভাবিকভাবেই কলেজে গেল। অধ্যক্ষের রুমে গিয়ে বসতেই তিনি ক্যান্টিনের; বিস্তারিত বর্ননা আহসানের নিকট তুলে ধরলেন। তরী ভয়ে জমে গেল। আহসানের তখন আক্কেলগুড়ুম অবস্থা! তরীর মতো শান্ত মেয়ে এমনটা কেন করবে? আহসান তরীকে তখন কিছুই বললো না। কোনো প্রশ্নও করলো না। কলেজের পরিবেশ বিঘ্নিত করার দায়ে তরীর পক্ষ থেকে নিজেই ক্ষমা প্রার্থনা করলো।
অধ্যক্ষের কক্ষ হতে আহসান বেরুতেই তরী তাঁর পিছু পিছু এলো। আহসানের হাত দুটো ধরে কেঁদে উঠে বললো,
” বিশ্বাস করুন আমি আগে ওর গায়ে হাত তুলিনি। আমি শুধু কথা বলতে গিয়েছিলাম। ও আমার কলারে হাত দিলো। আমি তারপর ওকে সরাতে ওর বুকে ধাক্কা দিয়েছি। আমি ওকে আগে মা’রিনি সত্যি বলছি!”
আহসান হতাশাজড়িত কন্ঠে বললো,
” তোমার থেকে এমন কিছু আশা করিনি তরী। পরিস্থিতি সবসময় একরকম থাকে না। পরিস্থিতি হাতের বাইরে গেলে সর্বদা শান্ত থাকতে হয়। একসঙ্গে থাকলে কথা কা’টাকাটি মনোমালিন্য অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাই, বলে এতদূর কেন গড়াবে এসব?”
তরী কোনো উত্তর দিতেই পারলো না। তাঁর মুখে কোনো জবাব এলোই না। আহসান মাজদাক সারোয়ারের ফোন পেয়ে কলেজ থেকে কাজে চলে গেল।
★
সেদিন দুপুরে আহসান বাড়িতে এলো না। একেবারে সন্ধ্যায় এলো। কারণটা কী কাজের বাড়তি চাপ নাকি তরীর প্রতি ক্রোধ তা কেউ জানে না। তরী আহসানের পিছু পিছু ঘরে এলো। তবে, আগ বাড়িয়ে আহসানের সঙ্গে কথা বলবার মতো সাহস তাঁর হলো না। ভয়ে গুটিশুটি মে’রে বসে রইলো। মুখে কোনো ‘রা’ অবধি নেই। আহসান নিজের কাজে ব্যস্ত। তরীর দিকে একবার ফিরেও চাইছে না। তরী এবার নিজেই উঠে দাঁড়ালো। হুট করে কী যে হলো তাঁর! আহসানকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো সে। জুবুথুবু হয়ে আহসানের পিঠে কেমন লেপ্টে রইলো। আহসান দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মেয়েটা তাঁকে ঘায়েল করার মন্ত্র জেনে গেছে! আহসানই নীরবতা ভেঙে সুধালো,
” মেয়েটার সঙ্গে ঝগড়া হলো কেন?”
তরী অপরাধীর সূরে বললো,
” রোজ রোজ কল দিয়ে কেন বিরক্ত করে আপনাকে? ওই মেয়েটাই আপনাকে কল করে আজেবাজে কথা বলে। আমি যখনই জিজ্ঞেস করতে গেলাম আমার কলার চেপে ধরলো। বললো সে নাকি কিছুই জানে না। আমি আজ অবধি ওই মেয়েটাকে আপনার নাম বলিনি। কিন্তু সে আপনার নাম জানে। আপনাকে কল না করলে সে কী করে আপনার নাম জানলো। পাজি মেয়ে!”
আহসান মনে মনে বেজায় হাসলো। কিন্তু, তরীর সামনে তা প্রকাশ করলো না। এসব বিষয়ে প্রশ্রয় দেওয়া মানে বেয়াদবিকে প্রশ্রয় দেওয়া। তরীকে ক্ষ্যাপানোর জন্য ফের সুধালো,
” একটু কল-ই নাহয় দিয়েছে তাই বলে এভাবে ঝগড়াঝাটি করতে হবে? বান্ধবীর বরকে কল দিয়ে একটু ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করাই যায়। এটা আর এমন কী!”
তরীর বেজায় রাগ হলো। আহসানকে আরো জোরেশোরে চেপে ধরে সে বললো,
” উহুম! কেউ কল করবে না আপনাকে। আপনাকে ওই মেয়েটা বাজে দৃষ্টিতে দেখে। আপনি বোকা মানুষ তাই বোঝেন না। মনে মনে সে আপনাকে কিছু-মিছু করে।”
আহসান মুচকি হেসে বললো,
” তা তুমিও কী আমাকে কিছু-মিছু করো নাকি তুলতুল?”
তরী সেই প্রশ্নের জবাব দিতে পারলো না। সে সত্যিই আহসানকে কিছু-মিছু করে কী? কে জানে!
চলবে…
#নিকুঞ্জ_কানন
#নুজহাত_আদিবা
[পর্ব ১৫]
তরীর অবস্থা বর্তমানে শোচনীয়! দীর্ঘ দুইমাস সময় নিয়ে টেস্ট পরীক্ষা শেষ হয়েছে তাঁর। পরীক্ষা শেষে একটু আরাম-আয়েশ করবে ভেবেছিল সে। সেটি আর হচ্ছে কোথায়? আহসান রোজ ভোরে ডেকে তুলে তরীকে পড়তে বসায়। ঘুমের ঘোরে আলুথালু হয়ে তরী ঝিমুতে ঝিমুতে পড়া শেষ করে। রুমিকে দেখে বর্তমানে খুব হিংসে হয় তরীর। কয়েকদিন আগেই রুমির বোর্ড পরীক্ষা শেষ হয়েছে। সারাদিন মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ায় সে। আহা! কী সুন্দর জীবন! তরীর জীবনে এত সুন্দর কাল কবে আসবে?
★
আহসানের সঙ্গে আজ এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটলো। সৌম্য আজ তাঁর মালের গোডাউনে এসেছে। সৌম্য সচারাচর ছুটির দিন ব্যাতীত কখনোই দিনে অবসরে থাকে না। অফিস ছুটি হয় তাঁর বিকেল সাড়ে পাঁচটায়। তবে, আজ কী হলো? এই ভর দুপুরে সৌম্য কী করছে এখানে? আহসান কাজ গুছিয়ে দ্রুত বের হলো। সৌম্যকে দেখে সে নিতান্তই অবাক ব্যাতীত আর কিছু হয়নি। আহসানকে দেখে সৌম্য কেমন ম্লান হাসলো। আহসান অনুভব করতে পারলো সেই হাসিতে কোনো প্রাণ নেই। বাবার মৃত্যুর পর সৌম্য একেবারেই ভেঙ্গে গেছে ভেতর থেকে। আগের মতো চাঞ্চল্যতা আর নেই। আহসানও সৌম্যকে দেখে মুচকি হাসলো। চেয়ার টেনে বসার সুযোগ করে দিলো। সৌম্য কেমন সটানভাবে বসলো চেয়ারটায়। যেন দেহে প্রাণের অস্তিত্বই নেই! আহসান খুব নরম সূরে বললো,
” কী হয়েছে বন্ধু? আজ অফিসে যাসনি?”
সৌম্য কেমন ভঙ্গুর কণ্ঠে বললো,
” নাহ! আসলে মনটা ভালো নেই। আজকে ছুটি নিয়েছি।”
আহসান সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বললো,
” বন্ধু, ভালো খারাপ নিয়েই জীবন। জানি তোর কষ্টটা হয়তো আমি কোনোদিনই বুঝতে পারবো না। কিন্তু, এভাবে আর কয়দিন? নিজেকে একটু সামলা বন্ধু। তোর ভাইটার তুই ছাড়া কেউ নেই। এভাবে ভেঙ্গে পড়লে ওর কী হবে?”
সৌম্য কোনো উত্তর দিলো না। কেমন ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য আহসানই ফের বললো,
” তাছাড়া এখন তোর বয়স হয়েছে বন্ধু। এবার অন্তত নিজের দিকটা ভেবে দেখ। একটা বিয়ে-শাদি কর। মনটা অন্যদিকে ঘুরে যাবে। সংসারের মাঝে ঢুকে গেলে এতটা একাকিত্ব বোধ হবে না।”
সৌম্য ছলছল চোখেই হেসে ফেললো। কেমন নিবিড়ভাবে বললো,
” আর বিয়ে! জীবনে একবার এক ফাঁদে পড়লাম। এরপর আর অন্য কোনো মেয়ের দিকে ঘুরে তাকাবার সুযোগই পেলাম না। মা জীবিত থাকাকালীন কত মেয়ে দেখলো। কারোর দিকে চোখ তুলে তাকাতে অবধি ইচ্ছে হয়নি। এক ঝড়ে এতটা ক্ষতি হয়েছে যে আর সামলে উঠতে পারিনি। সংসার জীবন আমার জন্য নয়। তাছাড়া আমি কখনো স্ত্রীর জায়গায় ওকে ছাড়া আর কাউকে কল্পনাই করতে পারিনি। ও আমার জীবন চলে গেল। ব্যস! বিয়ের স্বপ্ন ও আর কখনো দেখিনি।”
সৌম্য আর বসলো না। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আহসানকে বিদায় জানিয়ে চলে গেল। আহসান হতাশ চোখে সৌম্যর চলে যাওয়া দেখলো। চোখ বন্ধ করে বহুপূর্বের স্মৃতিতে ফিরে গেল। ভার্সিটির প্রথম বর্ষে পড়াকালীন আহসানদের ক্লাসে একটা মেয়ে ছিল। বেশ লাজুক! সবসময় মুখ লুকিয়ে চলতো। নাম তাঁর দিলশান হায়াত। শুরুতে আহসান সেভাবে তাঁকে চিনতো না। তবে, ঘটনার সূত্রপাত ঘটে সৌম্যর দ্বারা। কাঠখোট্টা সৌম্য কখন, কীভাবে যে দিলশানকে নিজের অন্তর, অস্তিত্ব সবটুকু দিয়ে ফেলেছিল কে জানে! সংবেদনশীল পরিবারের মেয়ে দিলশানের সঙ্গে কখনো সৌম্যের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে না উঠলেও; একে অপরের প্রতি তাঁরা যে দূর্বল তা কারোরই চোখ এড়ায়নি। কিন্তু, দূর্ভাগ্য! দিলশানের বিয়ে হয়ে যায় তৃতীয় বর্ষে পড়াকালীন। সৌম্য তখনও ছাত্র বিধায় চাইলেও সে কিছু করতে পারেনি। তখন তাঁর কাছে না ছিল অর্থসম্পদ না ছিল প্রাচুর্য্যবহুল চাকুরী। দিলশানের বিয়ের পর সৌম্য তাঁকে আর কখনোই বিরক্ত করেনি। আবার মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াতেও পারেনি। সৌম্যর বাবা-মা বেঁচে থাকাকালীন খুব চেষ্টা করেছিলেন ছেলের বিয়ে দিয়ে যাওয়ার। সৌম্যই সেসব অবহেলায় এড়িয়ে গেছে। মনে একজনকে রেখে আরেকজনের সঙ্গে কী করে সংসার করতো সে? অলিখিত প্রতারণা হতো না সেটা?
★
” আম্মা এমন করেন কেন? রুমিরে আইনা দেন না আম্মা!”
রঙ্গনের কথা শুনে নাহার বেগম চোখ কুঁচকে তাঁর দিকে তাকালেন। রঙ্গনের কোনো হেলদোল নেই সেদিকে। সে রুমির স্বপ্নে বিভোর! নাহার বেগম দৌড়ে দিয়ে গাট্টা মা’রলেন ছেলের মাথায়। রঙ্গন অকস্মাৎ গাট্টা খেয়ে চেঁচিয়ে বললো,
” মা’রলেন কেন আম্মা? পোলা বড় হইসে বয়স হইসে। বিয়া দিবেন না? আমার কী মন চায় না সংসার কইরা আব্বা ডাক শুনতে?”
নাহার বেগম দরজার পেছন থেকে ঝাড়ুখানা বের করলেন। রঙ্গনের দিকে তা তাক করে বললেন,
“বিয়া করতে চাস? বউ খাওয়াবি কী? আমার মাথা নাকি তোর কইলজা?”
রঙ্গন কোমরে হাত দিয়ে বললো,
” এমন কইরা কন কেন? আমার চিকনা চাকনা বউ। কতটুকুই বা খাইবো? আপনার কিডনি-কুডনি নিয়া গয়নাকাটি যা আছে। তা দিয়া আমার আর ওর হইয়া যাইবো।এত গয়না দিয়া করবেন কী”
নাহার বেগম ঝাড়ু নিয়ে তেড়ে এসে বললেন,
” খবি’সের বাচ্চা! তোর কত বড় সাহস! বাপের মতো খালি আমার গয়নার দিকে নজর দেস! আমি মইরা গেলে গয়না আমার কবরে দিয়া দিবি। আমার গয়না আমি যা মন চায় করুম। তোর কী?”
রঙ্গন আর কথা বললো না। লুঙ্গিটাকে গুটিয়ে গামছা হাতে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,
” থাকেন তাইলে আপনে আপনার সংসার নিয়া। আমি গেলাম! কিছু হইলেই খাওনের খোটা এখন আবার গয়নার খোটা! লাগবো না আপনার জিনিস। থাকেন আপনি আপনার সম্পত্তি সাজাইয়া। আমার না হওয়া বউরেও খোটা দিতে ছাড়েন নাই। থাকলাম না আপনার সংসারে। খাইলাম না আপনেরটা!”
নাহার বেগম ফিরেও তাকালেন না। এই নিয়ে দশ পনেরো বার রঙ্গন বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। আধ-পাগলা ছেলে যখন মন চায় বের হয়ে যায়। এরপর সন্ধ্যার আগেই আবার ফিরে আসে। খামোখা সন্ন্যাসী সাজার ভং!
নাহার বেগমের ধারণা সত্যি সত্যি সঠিক হলো। সন্ধ্যায় মশার কামড় খেয়ে রঙ্গন পা চুলকাতে চুলকাতে ঘরে ফিরলো। ফিরেই নাহার বেগমের পা জড়িয়ে ধরে বললো,
” আমারে ক্ষমা কইরা দেন আম্মা! গরমকালে মাথামুথা কেমন ঝাঁকি মা’রে জানেন? চান্দি গরম হইয়া যায়। আমার মাথা ঘূর্ণা মা’রসিলো আম্মা। পানি ঢালতে গেসিলাম; আর যামু না আপনারে রাইখা! রুমিরে আইনা দেন না আম্মা! আপনে যা কইবেন তাই করুম। ও আম্মা এমন করেন কেন? রুমিরে চাইয়া আনেন না আমার লাইগা!”
নাহার বেগম তৎক্ষনাৎ বললেন,
“যা কমু তাই করবি?”
রঙ্গন মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বোঝাতেই নাহার বেগম বললেন,
” একটা সরকারি চাকরি পাইয়া দেখা। তোর বাপ, দাদা, চাচা চৌদ্দ গুষ্টি সরকারি চাকরি কইরা খাইসে। তুইও সরকারি চাকরি করবি। যদি তুই সরকারি চাকরি পাইয়া দেখাইতে পারোস! তো আমি নাহার তোরে ওয়াদা দিলাম। রুমির বাপের পা ধইরা হইলেও রুমিরে চাইয়া আনুম।”
রঙ্গন দাঁত ক্যালাতে ক্যালাতে বললো,
” কী কইলেন আম্মা? সত্যি? আচ্ছা যান! আপনে সরকারি চাকরি কইসেন। কোন চাকরি তা তো কন নাই। আমি পিওন হমু। সরকারি পিওন! চলবো না আম্মা?”
নাহার বেগম মাথায় হাত দিয়ে বসে পরলেন! খোদা তায়ালা কোন পাগলের পাল্লায় তাঁকে এনে ফেললো?
★
আহসান জোর করে ধরে বেঁধে তরীকে পড়তে বসিয়েছে। তরী ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকালো। এই সময় স্টার জলসায় একটা সিরিয়াল হয়। নায়কটা হেব্বি সুন্দর! রুমি এখন রিমোট হাতে সেই সিরিয়ালটাই দেখছে। কী যে হবে আজকের পর্বে কে জানে! কাল তো নায়িকা সিঁড়ি বেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে নিচে পড়ে গিয়ে স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছিল। আজ যে কী হয়! নায়িকার স্মৃতি ঠিকঠাক মনে থাকলেই হয়। গত চার পর্ব যাবত নায়িকার স্মৃতি হারিয়ে ফেলার পর্বই চলছে। রুমির কী আরাম! পরীক্ষা শেষ বিধায় সিরিয়াল দেখতে পারে মনের সুখে। তরীর কবে শেষ হবে পরীক্ষা? আর ভালো লাগে না কিছু। কলম চিবোতে চিবোতে তরী আহসানের দিকে তাকালো। আহসানও বই খাতে তরীর পাশে বসে বসে পড়ছে। আহসান না থাকলে তরী এখনই উঠে গিয়ে রুমির পাশে বসে বসে টিভি দেখতো। তরীর যে আর ভালো লাগছে না। আহসান কী বুঝতে পারছে না? তরী এবার সাহস করে বলেই ফেললো,
” আজ না পড়াগুলো থাক। কাল সকাল সকাল উঠে পড়াগুলো করে ফেলবো। এখন যাই হ্যাঁ!”
তরী উঠে গিয়ে পালানোর আগেই আহসান তাঁকে আঁটকে ফেললো। আদেশ দিয়ে বললো,
” কোথায় যাওয়া হচ্ছে? রোজকার পড়া রোজ শেষ করে ফেলতে হবে তরী। এসব ফাঁকিবাজি কাজকর্ম কোথা থেকে শিখেছো? এক্ষুনি বই খুলে টেবিলে এসো।”
তরী মিনমিন করে বললো,
” যাই না একটু? একটু টিভি দেখেই চলে আসবো। এই একটু!”
আহসান তরীর কথা শুনলোই না। উল্টো পড়ার ঘরের দরজাই ভেতর থেকে লাগিয়ে দিলো। তরীকে নিয়ে ঠিকই পড়তে বসালো। তরী চোখ মুছতে মুছতে পড়াগুলো শেষ করলো। আজই শেষ! আর কথা নেই আহসানের সঙ্গে। সারাদিন শুধু বকে আর পড়তে বসায়। জীবনে কী সাধ-আহ্লাদ নেই তরীর? শুধু পড়া পড়া আর পড়া। এত পড়তে কার ভালো লাগে? পড়া শেষ করে তরী মাথা নিচু করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো। ততক্ষণে সিরিয়ালটা শেষ হয়ে গিয়েছে। তরী রুমিকে গিয়ে কৌতুহলের সহিত বললো,
” কী হলো আজ টিভিতে? নায়িকার স্মৃতি ফিরেছে?”
রুমি রিমোট হাতে বললো,
” আরে নাহ! এত তাড়াতাড়ি নায়িকার স্মৃতি ফিরবে না ভাবী। আজ একটা নতুন নায়ক এসেছে ভাবী। এত সুন্দর দেখতে! আগের যে নায়ক ছিলো না? তাঁর চেয়েও সুন্দর। ইয়া ধবধবে ফর্সা আর চোংগা মুখ। সানগ্লাস আর কোর্ট পড়ে এন্ট্রি নিয়েছিল। নায়িকা আর নতুন নায়ক দাঁড়িয়ে ছিল। এমন সময় দুজনের গায়ে একসঙ্গে ফুলের পাপড়ি ঝরে পড়েছে উপর থেকে। ওখানেই নতুন নায়ক আর নায়িকার প্রথমবার দেখা হয়েছে। ”
তরী গালে হাত দিয়ে মন খারাপ করে বসে পড়লো। কী চমৎকার ব্যাপার-স্যাপার! আহসানের জন্য সিরিয়ালের পর্বটা দেখা হলো না। সকালে একবার রিপিট টেলিকাস্ট হয়। তখনও আহসানের জন্য তাঁর শান্তি নেই। আহসান তখনও পড়ার টেবিল থেকে তাঁকে উঠতে দেয় না। আহসান না থাকলে শোভা নজরদারি করে তাঁর ওপরে। এই বাড়ির সবাই উঠে পড়ে তাঁর পেছনে আদা-জল খেয়ে পড়েছে। সিরিয়াল দেখা নিয়ে এত কীসের অসুবিধে?
খেয়েদেয়ে তরী বিছানায় গিয়ে চুপটি করে শুয়ে পড়লো। আহসানের একেবারে ঠিক অপর প্রান্তে। আজ ফিরেও তাকাবে না সে আহসানের দিকে। যা খুশি হোক! বাজে লোক তাঁকে টিভি দেখতে দেয় না। সবকিছুতে শুধু গন্ডগোল করে। পঁচা! আহসান পায়চারী করতে করতে ঘরে এলো। তরী আজ এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পরেছে? সূর্য আজ কোনদিকে উদয় হলো? আহসান ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তরীকে কয়েকবার দেখলো। দুষ্টু মেয়ে ঘুমিয়ে পড়ার ভান করে মুখ লুকিয়ে রেখেছে। আহসান বিছানায় উঠে বসলো। তরীকে পেছন থেকে কয়েকবার ডাকলো। তরী ফিরেও তাকালো না সাড়াও দিলো না। আহসান এবার মিটমিট করে হেসে তরীর পিঠে সুরসুরি কাটতেই তরী লাফ দিয়ে উঠে বসলো! কী হলো এটা? ভ্রু কুঁচকে আহসানের দিকে তাকাতেই আহসান আদুরে গলায় বলল,
” ওপাশ ফিরে শুয়ে ছিলে কেন?”
তরী নিজের ঠোঁট কামড়ে অভিমানীর মতো মুখ লুকিয়ে রাখলো। আহসান এগিয়ে এসে তরীর মাথা হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
” শোনো, পরীক্ষার কয়েকটা মাস হলো সাধনার মাস। তুমি যেমন কর্ম করবে তেমনই ফল পাবে। এখন যদি তুমি না পড়ে শুধু টিভি দেখে সময় নষ্ট করো; তাহলে পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট আসবে কী করে? কিছু পেতে গেলে কিছু হারাতে হয়। এখন মনোযোগ দিয়ে পড়ো। যেন পরীক্ষার পর আফসোস না হয়। বুঝেছো?”
তরী মাথা দুলিয়ে বললো,
” হু। কিন্তু, মাঝে মাঝে একটু একটু দেখবো। এই একটু! বেশি না!”
আহসান ফের প্রশ্ন করলো,
” রাগ করেছো তরী?”
তরী মাথা দুলিয়ে না বোঝালো। সরল উত্তর দিয়ে বললো,
” উহুম। মা বলেছে শাসনের অধিকার তাঁরই সোহাগ করে যে। আমি দুষ্টুমি করেছি তাই বকেছেন। আমি মন খারাপ করিনি।”
আহসান গালে হাত রেখে বললো,
” হুম বুঝলাম। তা বলো তো তুলতুল। আমি সত্যি সত্যি তোমায় সোহাগ করি নাকি? বলো বলো!”
তরী লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেললো। লোকটা তাঁকে সোহাগ করে কী? করে করে!
চলবে….