#তোতাপাখি_আমার
নামিহা নিশি
০১.
‘কল্প ভাই তোকে ডাকছেন।’ ব্যস এতটুকু কথাই যথেষ্ট ছিল ঘুঙুরের হার্টবিট ছলকে দেওয়ার জন্য। মানুষটা গত কয়েকদিন ধরে ডেকেই চলেছে কিন্তু ঘুঙুর লাপাত্তা। রোজই সে এটা ওটা অজুহাত দিয়ে পাড় পেয়ে যাচ্ছে। আজও তেমনটাই ইচ্ছে নিয়ে মুখ খুলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই তাকে থামিয়ে দিল বৃষ্টি। বলল,
“পেছনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। তুই যদি আজও কোনো রং-ঢং করিস বলেছেন তবে সরাসরি বাড়িতে চলে আসবেন। এখন ভেবে দেখ কী করবি। আমি গেলাম।”
বৃষ্টি মুখ ঘুরিয়ে চলে যাচ্ছিল উদ্বিগ্ন কন্ঠে তাকে থামিয়ে দিল ঘুঙুর,
“তুই চলে যাচ্ছিস মানে? আমাকে বা’ঘের খপ্পরে ফেলে তুই পালিয়ে যাবি?”
বৃষ্টি বিস্মিত কন্ঠে বলল,
“তোকে বা’ঘের খপ্পরে ফেললাম মানে? তুই নিজেই বা’ঘের কথা অমান্য করে এই দিন ডেকে এনেছিস। এখন আমার দোষ দিচ্ছিস? আজব!”
ঘুঙুর জোর গলায় বলল,
“হ্যাঁ তোর’ই তো দোষ। তোর কথায় সেদিন পূবের চরে গিয়ে আজ আমি ফেঁসে গেছি। এখন তুইও আমার সঙ্গে যাবি, ব্যস্।”
বৃষ্টি মুখ ভেঙিয়ে বলল,
“সেটা তো পরের বিষয় আগে এই কয়েকদিন যে নটাংকি করলি সেই জবাবদিহি কর গিয়ে।”
ঘুঙুরের কন্ঠ নরম হল। বৃষ্টির হাতখানা চেপে ধরে বলল,
“চল না দোস্ত। ওই খাটাশের সামনে আমি একা কীভাবে যাবো? গিলে খাবে আমায়।”
বৃষ্টি বিরক্ত হয়ে বলল,
“কী জানি কল্প ভাইয়ের মতো অমন সুপুরুষকে দেখে কেন ভ’য় আসে তোর? আমার তো তার গোটাটাই ভাল্লাগে। কখনও বা’ঘ, কখনও খাটাশ এসব মনে হয় না।”
ঘুঙুর মুখ ভেঙিয়ে বলল,
“এত্ত ভালো লাগা তো গলায় ঝুলে পর না। ঝুলে পরে আমাকে রেহাই দে।”
“হ্যাঁ,, সে পাত্তা দিলে তো? তাকে তো শুধু দেখি তোর পেছনে ধাওয়া করতে। এদিকে তুই করিস পালাই পালাই। ঠিক যেন টম এন্ড জেরি। ছোট্ট জেরি আকাম করে পালাচ্ছে টম তার পিছু পিছু ছুটছে।”
“হয়েছে থাম। এক্সামপল বাদ দিয়ে এখন আমার সঙ্গে চল। জান নিয়ে ফিরতে পারলে কাল তোর জন্য এক প্লেট ফুচকা ফ্রী।”
ফুচকার কথা শুনে খুশিতে চকচক করে উঠল বৃষ্টির চোখ। সে লাফিয়ে উঠে ঘুঙুরের কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলল,
“সত্যি? আমার তো এখনই জিভে পানি এসে গেছে। চল চল তাড়াতাড়ি চল। আজ তোর যত্ত রকম হেল্প লাগবে করে দেবো।”
ঘুঙুর ওর পেটে গুঁতা দিয়ে বলল,
“রা-ক্ষ-সী। ফুচকার কথা শুনে মুহুর্তেই রূপ বদলে গেছে।”
বৃষ্টি দাঁত কেলিয়ে হাসল।
–
মাথায় ওড়না টেনে গুটিগুটি পায়ে পেছনের রাস্তা ধরে খানিক সামনে এগিয়ে গেল ঘুঙুর। ওই তো কল্পকে দেখা যাচ্ছে। ব্ল্যাক গেঞ্জি, ডেনিম জিন্স, ব্ল্যাক স্নিকার্স। বেশ ভালোই ভাবে আছে। বাইকের সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে। ঘুঙুরের গলা শুকিয়ে কাঠ। লাগছে এমন এখনই পানির প্রয়োজন। দূরুদূরু বক্ষে এগিয়ে গেল সে গন্তব্যে। তাকে দেখে সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে ফিল্টারটা পা দিয়ে পিষে ফেলল কল্প। অতঃপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঘুঙুরের আপাদমস্তক পরোখ করে নিল একবার। ঘুঙুরের অস্বস্তি এতেই বেড়ে গেল আরও কয়েকশো গুন। পায়ের আঙুল শক্ত করে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইল সে।
“বৃষ্টি বাড়ি যাও।”
শীতল কন্ঠের আদেশ শুনে বৃষ্টি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। ফুচকার আশা ভুলে সুরসুর পায়ে প্রস্থান করল বান্ধবীকে ফেলে। ঘুঙুর কোণা চোখে একপল দেখে নিল ওকে। মনে মনে গালি দিল কয়েকটা। ভাবল কাল হাতের কাছে পেলে আচ্ছা মতো কেলাবে। চুল ছিড়ে দেবে একদম। আর ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে তিন প্লেট ফুচকা একা খাবে।
“উঠে বস।”
ঘুঙুরের আকাশ-কুসুম ভাবনার মাঝে কল্পের আরেকটি আদেশ শোনা গেল। এতেই রুহ্ কেঁপে উঠল ঘুঙুরের। চোখ তুলে দেখল কল্প বসে বাইকে। তাকে পেছনে বসার জন্য বলছে। ঘুঙুর এতক্ষণে বহু কষ্টে কম্পিত কণ্ঠে কিছু শব্দ বের করল,
“ক কোথায় যাবো? মা খুঁজবেন। বাড়িতে কেউ জানে না আমি বাইরে।”
কল্প ধমকে উঠল ততক্ষণাৎ। যেন আকাশ গর্জে বাজ পরল।
“উঠতে বলেছি না।”
ঘুঙুর আর দ্বিতীয় কোনো কথা বলার সাহস পেল না। পিলপিল পায়ে উঠে বসল চুপচাপ। তার খুব দূর্বল লাগছে। একদিকে এই লোকের ভ’য় আরেকদিকে বাড়ির চিন্তা একসঙ্গে জেঁকে ধরেছে তাকে। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কে জানে। বাড়িতে ফিরে কী জবাব দেবে সে?
–
পূবের বালুচর! এখানেই এসে কল্প বাইক থামিয়েছে। ঘুঙুর এক কোণে গুটিসুটি মেরে দাঁড়াল। কিছুটা দূরে ঠিক সেদিনের মতো করেই কল্পের সাঙ্গপাঙ্গরা দলবেঁধে আড্ডা দিচ্ছে। ওদের দেখে একেকটা আবার কী কী বলে হাসাহাসিও করছে। সেদিনের কথা মনে হতেই শুকনো ঢোক গিলল ঘুঙুর। বৃষ্টির প্ররোচনায় স্কুল ফাঁকি দিয়ে বাড়ি থেকে এতদূরে কাউকে কিছু না জানিয়েই ঘুরতে চলে এসেছিল। তখন কী আর জানত স্বয়ং রা’ক্ষ’সের আস্তানা এটা? ইশ্ তিন বছর আগের জীবনটা বড্ড মিস করে ঘুঙুর। তখন তো আর তার ওপর খবরদারি করার কেউ ছিল না। বিলেতি ডিগ্রি নিয়ে গ্রামে ফিরেই ঘুঙুরের পিছে পড়ে গেছে এই লৌহমানব। তখন থেকেই ধমকে ধমকে ঘুঙুরের পরানটা আঙুলের ডগায় তুলে নিয়েছে। কীসের এক অদৃশ্য টানে ঘুঙুর সর্বদা তটস্থ থাকে এই মানুষটার ওপর। নয়তো তার ঠেকা পরেছে এর কথা মেনে চলতে? একে ভ’য় পেতে?
“এখান থেকে বাড়ির রাস্তা ঠিক কত কিলোমিটার তোর ধারণা?”
সহসা ঠান্ডা কন্ঠে পিলে চমকে ওঠার মতো করে কেঁপে উঠল ঘুঙুর। কল্প দাঁড়িয়ে তার থেকে কিছুটা দূরে উত্তরের অপেক্ষায়। ঘুঙুর একটু ভেবে বলল,
“১০ কিলোমিটার তো হবেই।”
কল্প এবারেও ঠান্ডা ভাবে বলল,
“তো ১০ কিলোমিটার রাস্তা তোরা দুটো মেয়ে মানুষ কাউকে কিছু না জানিয়েই চলে এলি? হুমম, খুবব সাহস।”
কল্প নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো বিজ্ঞদের মতোন। ঘুঙুর মিনমিনে স্বরে বলল,
“আ আর হবে না।”
ব্যস্ এতটুকুতেই আগুনে ঘি ঢালার মতোন তেঁতে উঠল কল্প। হাত উঠিয়ে বলল,
“ইচ্ছে করছে ঠাটিয়ে একটা দেই। এসব নির্জন জায়গায় কতটা বিপদ লুকিয়ে থাকতে পারে কোনো ধারণা আছে তোদের? সাহস দেখে অবাক না হয়ে উপায় নেই। ক্লাস টেন এ উঠে গেলি অথচ বুদ্ধি এখনও হাঁটুর নিচে।”
ঘুঙুর কেঁদে ফেলবে প্রায়। চিবুক একেবারে গলার নিচে ঠেকিয়ে বলল,
“ব ব বৃষ্টি বলেছে ত…তাই।”
“একজন বললেই চলে আসতে হবে? তোর কোনো আক্কেল নেই? বৃষ্টি আর তুই এক হলি?”
ঘুঙুর একটু সাহস নিয়ে বলল,
“আলাদা কিসে? আমরা দু’জনেই মেয়ে। তো?”
“ভিন্নতা আছে। আর সেটা চোখের সামনেই প্রকাশ্য। বৃষ্টি যথেষ্ট চতুর একটা মেয়ে আর তুই… একটা আস্ত গাঁধি।”
ঘুঙুরের অকস্মাৎ অভিমানে ভেতরটা ছেঁয়ে যেতে লাগল। তার মনে হল তাকে অপমান করে বৃষ্টিকে প্রাধান্য দিচ্ছে কল্প। গাল ফুলিয়ে বলল,
“আমি কী করেছি?”
কল্প নিজের চুল দু-হাতে টেনে ধরে নিজেকে শান্ত করার প্রয়াস করল। পরপর ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বলল,
“তুই কিছুই করিস নি। যা করার এখন করব আমি।”
ঘুঙুর অধির আগ্রহে বলল,
“কী করবেন আপনি?”
“শাস্তি দেবো।”
শাস্তির কথা শুনে মুহুর্তেই মুখের রং বদলে গেল ঘুঙুরের। তুতলে বলল
“শ শা’স্তি?”
কল্প দায়সারা ভাবে বলল,
“হুমম। তবে তোকে নয়। তোর শাস্তি দেবো তোর বাপকে।”
ঘুঙুর চমকে উঠল,
“বাবাকে মানে? বাবা কী ক্ষতি করেছে আপনার?”
“তোর মতো গাঁধিকে জন্ম দিয়ে চরম ভুল করেছে। সঠিক শিক্ষাদীক্ষাও দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলস্বরূপ আমাকে জ্বালিয়ে খাচ্ছিস তুই। তাই এই সমস্ত দায়ভার তোর বাপের। এখন শাস্তি সে ই পাবে। আমি তার চেয়ার কেড়ে নেবো।”
ঘুঙুরের চোয়াল ঝুলে গেল,
“চেয়ার কেড়ে নেবেন মানে?”
“মানে তোর বাপের থেকে চেয়ারম্যানি পদ কেড়ে নেবো। তোর বাপের চেয়ারে বসবো আমি। নওয়াব কল্প চৌধুরী। বেশ হবে ব্যাপারটা। কী বলিস?”
কল্প ভ্রু তুলে প্রশ্ন করল। ঘুঙুরের এতক্ষণের ভ’য়, অভিমান, দ্বিধা সব কেমন ধূলিসাৎ হয়ে সেখানে ভিড় জমালো ক্ষীণ রাগ। যেটা সে চেয়েও এই মুহুর্তে প্রকাশ করতে অক্ষম। তবু পুরোপুরি দমে রইল না সে। শক্ত কন্ঠে বলল,
“একদমই ভালো হবে না ব্যাপারটা। জঘন্য লেভেলের জঘন্য কিছু হবে।”
“আর এই জঘন্য ব্যাপারটাই তোদের বাপ-বেটির শাস্তি। আহ কী শান্তি লাগছে। আমি তো এখনই তোর বাপের ভোঁতা মুখখানা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। তোর মতো গাঁধি জন্ম দিয়ে আমাকে বিপাকে ফেলা, নাও এবার বোঝো ঠেলা।”
ঘুঙুর ভাবল এই ত্যাদোর ছেলেকে রাগ দেখিয়ে কিছুই হবে না। তাই নরম কন্ঠে বলল,
“দেখুন ভুল আমার শাস্তি আমায় দেন খামোখা বাবাকে কেন টানছেন?”
“বাব্বাহ বাপের জন্য কত্ত দরদ। তোর বুঝি শাস্তিটা পছন্দ হয়নি। তাহলে সেকেন্ড অপশন আছে তো। এখনই তোর বাপের কাছে চল, তার ভদ্র-শান্ত মেয়েটার এমন অধঃপতনের গানটা শুনিয়েই আসি তাকে। বেচারা তখন এমনিতেই খুশির চোটে সন্ন্যাসধর্ম গ্রহণ করে চেয়ারম্যানি গদি ছেড়ে দেবে আমায়। কী চাস এটাই তো? হুহ?”
ঘুঙুরের চোখ দিয়ে টপটপিয়ে পানি পরা শুরু হয়ে গেছে। কল্প সেই পানি নিজের আঙুলের ডগায় তুলে এনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কী সব যেন পর্যবেক্ষণ করে বলল,
“ইশশশশ্ চোখের পানিতেও বাপের জন্য কত্তোওওওও দরদ লেখা আছে। এর একবিন্দু যদি আমার জন্য থাকতো!”
কান্নারত কন্ঠেই ঘুঙুর মিনমিন করে বলল,
“আপনার জন্য কেন থাকবে? কে হন আপনি আমার?”
কথাটা যেন খুবই হাস্যরসাত্নক ছিল। যেটা শুনে কিয়ৎক্ষণ ওর দিকে কেমন শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কল্প। পরপর তীব্র আওয়াজ তুলে হাসলো। ঘুঙুর একধ্যানে চেয়ে রইল শুধু। তার মনে হল ওই হাসিতে শুধু আওয়াজই আছে, কোনো প্রাণ নেই। নিষ্প্রভ হাসি। কোনো নিখুঁত অভিনেতার হাসি। হবেই তো! অভিনেতা না হোক নেতা তো হবেই, আজ না হয় কাল। বলেছে যখন তখন হয়েই ছাড়বে।
চলবে,
® নামিহা নিশি