#তোতাপাখি_আমার
০৭.
ঘুঙুরকে রান্নাঘরের দিকে ছুটতে দেখে কুহু ডেকে উঠল পেছন থেকে,
“এই ঘুঙুর আপু কি হয়েছে তোর? ওভাবে দৌড়াচ্ছিস কেন? শরীর বেশি খারাপ করছে?”
কুহুর চিৎকারে কল্পে দৃষ্টি এদিকে ঘুরলো। ততক্ষণে ঘুঙুরের ওড়নার কোণটুকু দেখা গেল শুধু। কল্প উঠে গেল পিছু পিছু। জেনি পেছন থেকে বলল,
“তুমি চললে কোথায়? খালামনি দেখে নেবে।”
জেনির কথা কানেও তুলল না কল্প। যেন সে কিছু শুনতেই পায়নি। জোর পায়ে হেঁটে কিচেনের ডোর দিয়ে ঢুকে গেল। কুহু জেনির উদ্দেশ্যে ছোট্ট করে বলল,
“কাকে আটকাতে চাইছ তুমি? ভাইয়া তো বরাবরের মতোই ঘুঙুর আপুর ছায়া সঙ্গী। শুধু ভান করে এমন যেন তারা দু’জন দু’জনের থেকে বহু দূরত্বের।”
কুহুর কথাটুকু দাঁতে দাঁত চেপে হজম করে নিল জেনি। কটমটে দৃষ্টি ফেলে সে ও ছুটল কিচেনের দিকে। গুলফা বেগম অতশত ভাবলেন না। বয়স হয়েছে মাথায় চাপ পড়ে। অনেকক্ষণ নাতি-নাতনীর সেবা করে তিনি এখন ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিলেন সোফায়। কুশন মাথার নিচে দিয়ে আরামে চোখ বুজে নিলেন।
–
কিচেনে ঢুকে জেনির চক্ষু চড়কগাছ। কল্প ঘুঙুরের পাশে বসে পানি খাইয়ে দিচ্ছে। চোখে মুখে তার রাজ্যের উৎকন্ঠা। কুহুকে ডাকল চিল্লিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে কুহু এসে উপস্থিত। বলল,
“ওকে নিয়ে তোর ঘরে শুইয়ে দে। আমি ডাক্তার ডেকে আনি।”
কুহু ‘ঠিক আছে’ বললেও বাঁধ সাধল ঘুঙুর। অস্থির কন্ঠে বলল,
“না না ডাক্তার লাগবে না। আমি বাড়ি যাব।”
কল্প ধমকে উঠল,
“এক চড়ে সব দাঁত ফেলে দেবো, বেয়াদব। চুপচাপ কুহুর সঙ্গে যা। বাকিটা আমি বুঝে নেব।”
ঘুঙুর অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো খাদিজা বেগমের দিকে। তিনি ইশারায় আশ্বাস দিলেন। পরপর গলা ঝেড়ে ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন,
“ডাক্তার ডাকতে হবে না। ও ঠিক হয়ে যাবে। তুই একটু শান্ত হয়ে বোস।”
কল্পের বিস্ময়ে লোচন ঝুলে পড়ে।
“তুমি বলছ এই কথা, মা? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।”
খাদিজা বেগম বিতৃষ্ণ স্বরে বললেন,
“করতে হবে না বিশ্বাস। এখন যা তো সামনে থেকে।”
কল্প তেজ দেখিয়ে উঠে দাঁড়াল। বলল,
“ঠিক আছে যাচ্ছি। কিন্তু দেখো পরে আবার বিপদ বাড়লে আমাকেই ডাকতে না হয়।”
ঘুঙুরের দিকে একপল গরম চাহনি নিক্ষেপ করে বসারঘরে চলে গেল কল্প। ওর পেছন পেছন মিটিমিটি হাসতে হাসতে জেনেও গেল। কুহু ঘুঙুরকে ধরে নিজের ঘরে নিয়ে গেল। ঘুঙুরের একটু স্বস্তি লাগছে। ইশ্ কল্পের সামনে সবটা উন্মুক্ত হয়ে গেলে ভীষণ লজ্জায় পরতে হত তাকে। বালিশে ঠেক দিয়ে আলতো ভাবে চোখ বুজে রইল সে। মনের ঘরে কড়া নাড়ল একটু আগের সেই কল্পকে। যে তার অসুস্থতায় পরম যত্নে আগলে নিয়েছিল, নিজ হাতে মুখ ধুতে সাহায্য করেছে, পানি খাইয়েছে, উদ্বিগ্ন হয়েছে আবার ডাক্তার ডাকার জন্য একতরফা রাগারাগিও করেছে। অধর কোণে একরাশ ঝিলমিলি হাসি ফুটে উঠল তার। তন্মধ্যে ঘরে ঢুকলেন খাদিজা বেগম। হাতে তার হট ওয়াটার ব্যাগ। সেটা নিয়ে ঘুঙুরের পেটের ওপর রাখলেন তিনি। ঘুঙুর চোখ মেলে দেখল। বলল,
“এত কষ্ট করতে হবে না তোমার। শুধু আমাকে বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দাও।”
খাদিজা ঘুঙুরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বললেন,
“এভাবে থাক ভালো লাগবে। সুস্থ হ পিঠা খেয়ে বাড়ি যাবি। কল্প দিয়ে আসবে।”
ঘুঙুর বলল,
“না। আমাকে বকবে, জেরা করবে। তখন কি বলব আমি?”
খাদিজা বললেন,
“ওকে এত ভয় পাওয়ার কি আছে? বলে দিস কিছু একটা। আচ্ছা তুই রেস্ট নে। আমি যাই কাজগুলো সেরে ফেলি।”
খাদিজা বেগমের হাতে হট ওয়াটার দেখে কিছুটা ভাবুক হল কল্প। তার পাশে তখন জেনি বসা প্রফুল্লমনে। কল্পকে স্থির হয়ে বসে থাকতে দেখে সে একটা ডেভিল হাসি দিল। মনে মনে ভাবল এটাই সুযোগ লুফে নেওয়ার। সে মতেই সুর সুর করে কল্পের আরেকটু কাছে এগিয়ে বলল,
“কি দরকার ছিল আগ বাড়িয়ে সাহায্য করতে যাওয়ার? এখন তোমাকেই অপমান হতে হল। খালামনিও বুঝল না তোমাকে।”
কল্প ধপ করে ঘুরে তাকাল জেনির দিকে। আচমকা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ভড়কে গেল জেনি। আমতা আমতা করে একটু দূরে সরে বসল সে। কল্প গরম চোখে তাকিয়ে চাপা কিন্তু শক্ত কন্ঠে বলল,
“আমাকে কেউ কোনো অপমান করেনি। ওরা সবাই আমার নিজের লোক। মা ও আমার, ঘুঙুরও আমার। ওরা আমাকে যা খুশি তাই বলতেই পারে। সেই রাইট ওদের আছে। আর আমি কাউকে সাহায্য করতে যাইনি, গিয়েছি দ্বায়িত্ব পালন করতে। নিজেকে শান্ত করতে। হতেই পারে সবসময় সবকিছু আমার জানা ঠিক নয় সেজন্য মা আমাকে সরে যেতে বলেছে। এটা নিয়ে এমন বিরূপ ধারণার কোনো মানে হয় না।”
কল্প উঠে চলে নিজের ঘরের দিকে। জেনি রাগে ফুঁসছে শুধু। কল্পের একটা কথা তার মস্তিষ্কে গভীর ভাবে প্রভাব ফেলছে -‘মা ও আমার, ঘুঙুরও আমার।’
–
বাড়ি ফেরার অনুমতি পেতে পেতে রাত নয়টা বেজে গেল। ঘুঙুর কাচুমাচু হয়ে দরজার কোণে দাঁড়িয়ে। কল্প গায়ে শার্ট জড়াচ্ছে। খাদিজা একটা বড় টিফিনবক্স কল্পের হাতে ধরিয়ে দিলেন। এটার মধ্যে ও বাড়ির সবার জন্য খাবার দেওয়া। তিনি আরও চেঁচালেন ঘুঙুরের ওপর,
“কি খেলি? কিচ্ছুই তো খেলি না। এজন্যই কি তোকে আটকে রাখলাম? তাহলে রাখার দরকারটা কি ছিল?”
ঘুঙুর মিনমিন করে বলল,
“খেয়েছি তো।”
খাদিজা বললেন,
“কচু খেয়েছ। বাড়িতে গিয়ে রিল্যাক্স হয়ে আরও খাবি। এখানে বেশি করে দিয়ে দিয়েছি।”
ঘুঙুর একটু মাথা নাড়ল। কল্প বিনাবাক্যে বেড়িয়ে হাঁটা শুরু করল। ছোট্ট করে বলল, “আয়।”
ঘুঙুর খাদিজার থেকে বিদায় নিয়ে চলল ওর পেছন পেছন। তন্মধ্যে সদর দরজায় এসে দাঁড়াল জেনি। একপ্রকার ছুটেই এসেছে সে। হাঁপাতে হাঁপাতে তড়িৎ কন্ঠে বলল,
“আমিও সঙ্গে যাব। আমাকেও নিয়ে চলো।”
কল্প ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। ওকে এভাবে দেখে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“একদম না। অনেক রাত হয়েছে ভেতরে যা।”
জেনি শুনল না। কল্পের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“তাতে কি। আমাকে সঙ্গে নাও ফিরতে পথে তোমাকে আর একা ফিরতে হবে না। সঙ্গী হব আমি।”
কল্পের কাঠকাঠ কন্ঠ,
“দরকার নেই। তুই ঘরে যা।”
কল্প হাঁটা ধরল। জেনি ঘুঙুরের দিকে তাকিয়ে মুখটা কেমন করে আবার কল্পের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কল্প বিরক্ত হল এবার। কিঞ্চিৎ ধমকে বলল,
“কি শুরু করলি?”
জেনি আহ্লাদী স্বরে বলল,
“নিয়ে চলো প্লিজজজজ।”
কল্প বলল,
“না। এভাবে রাত-বিরেতে যুবক-যুবতী গ্রামের রাস্তায় হাঁটা যায় না। লোকে উল্টোপাল্টা ভাববে।”
জেনির বলতে ইচ্ছে হলো ‘বললে বলবে। ভালোই তো লাগবে শুনতে।’ কিন্তু মুখে বলল,
“তা তো ঘুঙুর সঙ্গে থাকলেও বলবে। কি বলবে না?”
কল্প থমকে গেল যেন। গভীর মনোযোগে ঘুঙুরের নত মুখের দিকে দেখল একপল। সময় নিয়ে জবাব দিল,
“সেটা আমি বুঝে নেব।”
জেনির ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেল। সে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,
“ওর সব বিষয়ে তোমার কেন বুঝতে হয়? ওর বাবা-মা কি করে? মেয়ের প্রতি কোনো দ্বায়িত্ব নেই নাকি? এত রাত হয়ে গেল একটাবার কেউ খবর পর্যন্ত নিল না!”
ঘুঙুরের মুখটা ছোট হয়ে এলো। জেনি এসব কি বলছে? তার বাবা-মা কখনোই দায়সারা নয়। শুধুমাত্র বাড়িতে বলে তারা নিশ্চিন্ত নয়তো এর বাইরে ঘুঙুরের কোথাও যাওয়ারও অনুমতি নেই। ইচ্ছে করল জেনির মুখের ওপর কিছু শুনিয়ে দিতে। কিন্তু চাচির আত্নীয় বলে চেপে গেল। তার হয়ে জবাবটা কল্পই দিয়ে দিল। এবারে সরাসরি চিৎকার করে ধমকে উঠে বলল,
“ওর বাবা-মা অন্তত এতটুকু জানে যে ঘুঙুর তার আরেকটা বাড়িতে আছে। সেখানে খবর নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এখানে ওর কোনো অযত্ন হবে না। আর ওর সবকিছুতেই নওয়াব কল্প চৌধুরী থেকেছে, থাকছে আর আগামীতেও থাকবে। এটা নিয়ে কারো কোনো সমস্যা নেই। না আমার বাবা মার, না ওর বাবা-মার। মাঝখান থেকে তোর এত মাথা ব্যথা কিসের? দুদিনের অতিথি দুদিন থেকে চলে যাবি। সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখ। এভাবে যেঁচে পড়ে দূরত্ব কেন বাড়াচ্ছিস?”
ঘুঙুরের সামনে এভাবে বলায় অপমানে মুখটা থমথমে হয়ে উঠল জেনির। সে গটগট পায়ে ভেতরে চলে গেল ততক্ষণাৎ। ভেতরে ভেতরে রাগে ফেটে পরছে একেবারে। কল্প হাঁপ ছেড়ে বাঁচল ওর চলে যাওয়ায়। ঘুঙুরকে আরেকবার ডাকল, “কাছে আয়।”
ঘুঙুরের মনে তখন সাতরঙা প্রজাপতির উড়াউড়ি। মনের মধ্যে অদ্ভুত প্রশান্তি। কল্পের কথাগুলো স্বস্তি দিচ্ছে বেশ। সেই সঙ্গে জেনির অপমানিত মুখ জাস্ট দেখার মতো ছিল। এরই মধ্যে কল্পের ‘কাছে আয়’ কথাটি অনুভূতির সাদামাটা পৃষ্ঠাটি রঙে রঙে রঙিন করে তুলল। সহসা অসুস্থতা ভুলে সে চঞ্চলা পাখির ন্যায় ফুরুত ফুরুত উড়তে শুরু করল কল্পের পাশে পাশে।
চলবে,
®নামিহা নিশি