#আমিই_সেই_তন্নি
#Nadia_Afrin
১৫
আলিফ অর্নি সেদিন কোনো উত্তর দেয়নি।
বাবাকে নিয়ে চলে গেছে।আমিও বাধা দেইনি কোনো প্রকার।গিয়েছে যাক।ওদের ভাগ্য নিয়ে ওরা গেছে।
আগে চেষ্টা করেছিলাম আটকানোর।ওরা যেহেতু বুঝলোই না,তাই আমার আর দায় থাকে না কোনো।
মাঝখানে একটা দিন পার হয়েছে।
স্যারের মা-বাবা আজকে আসবেন তার বাড়ি।
রান্নার ধুম আয়োজন চলছে।আজ রান্নার সব দায়িত্ব আমার।আমার বাড়িতেই আয়োজন করছি।উনাদের আমি নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াতে চাই।
হরেকরকম পদ করেছি।
কিচেনে ব্যস্ত হাতে আমি।স্যার এলেন এমন সময়।ঘেমে একাকার আমি।
টেনে নিয়ে ফ্যানের নিচে বসালেন।হাতে ট্যিসু দিয়ে বললেন,”শুধু রাধলেই হবে?নিজের খেয়াল কে রাখবে?ঘেমে কী হয়েছেন?
ফ্যানের নিচে বসুন আমি আসছি।”
সে কোথায় যেন গেল।
মিনিট দুয়েক পর ফিরে এলো হাতে ঠান্ডা পানির শরবত নিয়ে।গ্লাস হাতে দিয়ে বলল,”এটা খান দেখি।”
খেলাম।গলাটা জুড়িয়ে গেল।
সামান্য হেসে বললাম,”ধন্যবাদ আপনাকে।ভালো লাগছে ভীষণ।সত্যিই ভীষণ গরম লাগছিল আমার।এবার ঠিক আছি।
এখন সরুন বাকি রান্নাটা সেরে ফেলি।উনারা চলে আসবে।”
একপ্রকার জোর করেই কিচেনে এলাম।রান্নায় মনোযোগী হলাম।
প্রায় ঘন্টা দুয়েক পর রান্না শেষ হলো আমার।স্যার গেছেন উনাদের রিসিভ করতে।ভাবিকে বললাম টেবিল গোছাতে।
এক দৌড়ে বাথরুমে গেলাম আমি।গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নিলাম।
স্যারের মা-বাবা এলেন।সালাম দিয়ে বসতে বললাম।তারা আমায় দেখলো।আমার সঙ্গে কথা বলল।স্যারের মা মানুষটা অমায়িক।প্রথম দেখাতেই আমায় এসে জড়িয়ে ধরেছেন তিনি।যেন কতো দিনের চেনা!
আমার তিলের নাড়ু ভীষণ পছন্দ।স্যারকে কথায় কথায় একদিন বলেছিলাম।উনি আমার জন্য এক বক্স ভর্তি তিলের নাড়ু করে এনেছেন।
তাদের ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছি আমি।
গরমের মাঝে এসেছে।ফ্রেশ হয়ে আগে খেতে বললাম।
তারা ফ্রেশ হয়ে এসে খেতে বসলো।পাতে পাতে খাবার বেড়ে দিয়ে সাইটে দাঁড়িয়ে আছি আমি।
স্যারের মা টেনে আমায় তার পাশে বসায়।কিছুতেই খাবোনা আমি।তাদের খাওয়া শেষ হলে খাবো।
তা তারা মানতে নারাজ।জোর করে বসিয়ে মুখে খাবার তুলে দিয়েছে।
এই প্রথম মা তূল্য কেউ আমায় খাইয়ে দিয়েছে।চোখ দিয়ে পানি চলে এসেছে আমার।
হুহু করে কেঁদে উঠেছি।স্যারের মা বোঝেননি বিষয়টি।ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন আমার ও স্যারের দিকে।
স্যার বলেন,”আসলে উনার মা ছোট বেলাতেই মারা গেছেন। আজ তোমার হাতে খেয়ে হয়ত মায়ের কথা মনে পড়েছে।”
স্যারের মা আমায় বুকে আগলে বলেন,”কাঁদছো কেন বোকা মেয়ে?
তোমার মা নেই তো কী হয়েছে?
আমি কী তোমার মা নই?এমনিতেই কদিন পর থেকে আমিই তোমার মা হবো।তুমি বরং আজ থেকেই আমায় মা ডাকা শুরু করে দাও।আমার পেটের কোনো মেয়ে নেই।ইয়াসির আমার একমাত্র সন্তান।বরাবরই এক মেয়ের ইচ্ছে ছিল।বিধাতা দেয়নি।ভেবেছিলাম ছেলে দিয়ে মেয়ে আনবো একটা।সে ভাগ্যও হলোনা।ছেলে আমার এক অপয়া মেয়ের কাছে প্রতারিত হয়ে জীবনের ছন্দ হারায়।বিয়ে বা সম্পর্ক থেকে পিছিয়ে আসে।বহু বুঝিয়েও লাভ হয়নি।এরপর হঠাৎ সেদিন ইয়াসির তোমার কথা বলল।আমি আর ওর বাবাতো খুশিতে গদগদ।সঙ্গে সঙ্গে চলে এলাম তোমায় দেখতে।তোমার অতীত বিষয়ে ইয়াসির আমায় সবটাই বলেছে।শুনে বড্ড মায়া হয়েছে।তুমি কতো মিষ্টি একটা মেয়ে,অথচ তোমার জীবনটা কী এলোমেলো।তবে চিন্তা করোনা।এবার তোমার এলোমেলো জীবন আমরা গুছিয়ে দেব যত্ন করে।তোমার অতীত নিয়ে আমাদের কোনো সমস্যা নেই।
তোমায় আমার বড্ড পছন্দ হয়েছে তন্নি।
কথা দিচ্ছি,আমার কাছে গিয়ে তোমার কোনো অসুবিধা হবেনা।নিজের মন মতো থাকবে।ইচ্ছে মতো চলবে।তোমায় বাধা দেওয়ার কেউ নেই।
আমরা তোমায় বউমা করে নয়,মেয়ে করে নেব।
একজন মা পাবে তুমি।যে তোমার বন্ধু হবে।বাবা পাবে একটা,যে কিনা তোমার সব ইচ্ছা পূরণ করবে।
সবচেয়ে বড়ো কথা একটা যোগ্য,সৎ, বিনয়ী জীবনসঙ্গী পাবে।আমার ছেলে তোমায় তার মাথার তাজ করে রাখবে।
তোমায় সে ভীষণ ভালোবাসে তন্নি।মা হয়ে একথা বলছি আমি।”
আমি লজ্জা পেলাম ভীষণ।মাথা নিচু করে রইলাম।স্যারতো রীতিমতো লজ্জায় লাল হয়ে গেছে।
ভাবি এসে বলল,”ঠিক বলেছেন আপনি।ওরা দুজনই দুজনকে ভীষণ ভালোবাসে।শুধু প্রকাশ করেনা।”
ভাবিকে চুপ করতে বললাম আমি।
তিনি বললেন,”লজ্জা পেতে হবেনা আর।আজ বাদে কাল বিয়ে।ওতো লজ্জা পেয়ে কী হবে।বিয়ে তো তোমার এবার করতেই হবে।”
স্যারকে দেখলাম মাথা নিচু করে মুচকি মুচকি হাসছেন।
এভাবেই কথার মধ্য দিয়ে খাওয়ার পালা শেষ হলো।স্যারের মায়ের নাকি খুবই ভালো লেগেছে আমার রান্না।
খাওয়া শেষে তাদের আমার বাড়িটা ঘুরে দেখালাম।
আমার এতিমখানাতে নিয়েও ঘুরে এসেছি।সেদিন সারাটাদিন চললো ঘোরাফেরার মধ্য দিয়েই।চেনা পরিচিত অনেক জায়গাই তাদের দেখিয়েছি।স্যার যায়নি।তার নাকি কাজ ছিল।
রাতে বাড়ি ফিরেছি।ঘরে ঢুকতেই স্যার বলেন,”অবশেষে ফিরলেন তাহলে আপনারা।আমি তো ভাবলাম আজ ফিরবেনই না।
আর মা-বাবা তোমরা কতো জায়গায় ঘুরে এলে।আমার কথা মনে পড়লো না একবারো?”
“না।একদমই মনে পড়েনি।আমার তো মনেই ছিল না আমার একটা ছেলে আছে।
মনে হচ্ছিলো মেয়ে নিয়ে ঘুরছি আমি।”
স্যার মুখ গোমড়া করলেন।আমরা সবাই হাসলাম।
ভাবিকে রান্নার কথা বলে ফ্রেশ হতে গেলাম।ফ্রেশ হয়ে হাতে চায়ের কাপ নিয়ে নিজের বারান্দায় গিয়ে বসলাম।
স্যার নক করলেন বাইরে থেকে।ভেতরে আসতে বললাম।
তিনি এসে আমার সামনের চেয়ারে বসলেন।
কিছুপল চুপ থেকে বললেন,”সারাদিন কতো ব্যস্ততায় কাঁটালেন।ঘুরলেনও।
আমায় মিস করেননি?”
বললাম,”না একদমই না।”
স্যার মুখ কালো করে বললেন,”ওহ তন্নি আপনার থেকে এমন কথা আশা করিনি আমি।
আপনিও মায়ের মতো বলছেন।”
আমি হাসলাম শুধু।স্যার উঠে দাঁড়ালেন।
বারান্দার এক কোণে দাঁড়িয়ে বললেন,”জানেন তন্নি,জীবনটা আমার কাছে আজ স্বপ্নের মতো লাগছে।আমি কখনো ভাবতে পারিনি,আপনার মতো একজন নারীকে আমি আমার জীবনসঙ্গী হিসেবে পাবো।
আপনি আমার কাছে ঐ দূর আকাশের চাঁদের মতো ছিলেন।আমার ভাগ্য সহায়,তাই চাঁদকে আমি আমার হাতের মুঠোয় পাচ্ছি।
জোসনার আলো হয়ে আপনি আমার জীবনে এসেছেন তন্নি।আমার অন্ধকার জীবনকে আলোকিত করেছেন।
ফুলের মতো স্নিগ্ধ ও নমনীয় হয়ে আপনি ধরা দিয়েছেন।আমার মনকে প্রসন্ন করেছেন।
আপনার হৃদয়ের কোমলতা আমার হৃদয়কে স্পর্শ করেছে তন্নি।
আপনাকে আমি ভীষণ ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি।”
উনার মুখ থেকে এই প্রথম ভালোবাসার কথা শুনছি আমি।অন্যরকম লাগে আমার।
ভালোবাসায় নতুন-পুরোনো নেই।প্রকৃত ভালোবাসা যেই বয়সেই হোকনা কেন,মনকে দোলা দেবে অবশ্যই।শিহরণ জাগবে।প্রশান্তি অনুভব হবে।নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হবে।
এই প্রতিটি বিষয় বর্তমানে আমার সঙ্গে হচ্ছে।
হয়ত এতোদিনে পেয়েছি আমি আমার প্রকৃত মনের মানুষকে।আমার ভালোবাসাকে।
আমি শিতল দৃষ্টিতে তাকালাম তার দিকে।
সে হাসলো।আমি লজ্জা পেলাম।সরে আসতে নিলাম।তিনি পেছন থেকে বলল,”উত্তর পেলাম না যে!”
“সব কথার উত্তর তৎক্ষণাৎ দিতে নেই স্যার।কিছু উত্তর পেতে ধৈর্যের পরিক্ষা দিতে হয়।মনে করুন আপনিও তেমন পরিক্ষা দিচ্ছেন।”
“আর কতো পরিক্ষা নেবেন আমার তন্নি?এবার তো বলে ফেলুন ভালোবাসি।”
দু-পাশে মাথা ঝাকালাম।ঘর ছেড়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেলাম।ধাক্কা লাগলো ভাবির সঙ্গে।
আমায় ধরে নেয় ভাবি।সুক্ষ চোখে তাকিয়ে থাকে।থুতনি উচিয়ে বলে,”এ হাসি ভালোবাসার লক্ষণ।তুমি তো গেলে তন্নি।এবার আর নিস্তার নেই।একেবারে প্রেম সাগরে গিয়ে পড়েছো।এবার দেখি ওঠো কী করে।”
“আমি সাঁতার জানি ভাবি।”
“সাগর সাঁতরে পার হওয়া যায়না বোন।ভেসে যাও।ভাসিয়ে দাও নিজেকে।দেখবে কেউ একজন এসে ঠিক উঠিয়ে নেবে তোমায়।”
নিচ থেকে ডাক ভেসে আসে স্যারের মায়ের।
‘আসছি’ বলে নিচে এলাম আমি।
তিনি সোফাতে বসা।আমায় তার পাশে বসালেন।স্যার ও এলো।সামনের সোফায় বসলো।
স্যারের মা তার ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে একটি বাক্স বের করলো।
বলল,”এখানে এক সেট গহনা আছে।ইয়াসিরের বিয়ের জন্য তার দাদি রেখে গিয়েছিল।
আমিও যত্ন করে নিজের কাছে রেখেছিলাম এতোকাল।এবার সময় এসেছে এটাকে কাছ ছাড়া করার।এর যোগ্য মানুষের হাতে তুলে দেওয়ার।”
উনি নিজ হাতে আমার গলায় হাড়টি পড়িয়ে দিলেন।ভীষণ সুন্দর সেটি।আগের আমলের সুক্ষ ডিজাইনের।
আগেকার গহনা-গাটি গুলো আমার খুবই পছন্দের।পেলে সংগ্রহে রাখি।
ম্যাচিং কানের দুল আছে।সেটিও পড়িয়ে দিলেন।
সঙ্গে একটি হাতের বালা পড়িয়ে দিয়ে বললেন,”নাও তোমায় আমরা বুকিং করে নিলাম।
এবার থেকে তুমি আমাদের।
আমার ছেলের আমানত হিসেবে তোমায় রেখে গেলাম।যদি সব ঠিক থাকে,দুদিন পরই চারহাত এক করে দেব।
আমরা আর দেরি করতে চাইনা।যতো তাড়াতাড়ি তুমি আমাদের ঘরে যাবে,ততোই ভালো।”
কখনো ভাবিনি আমার জীবনে এতো সুখ আসবে।স্যারের মতো আমারও স্বপ্ন লাগছে সব।
বরাবরই নিজেকে অভাগী মনে করেছি আমি।ভেবেছি সুখ হয়ত আমার জন্য না।
কিন্তু স্যার মানুষটা আমার ধারণা বদলে দিয়েছে।আমার জীবনে এসে তিনি প্রমাণ করে দিয়েছে আমিও হতে পারি সুখী।
সারাটাজীবন একটা সুন্দর পরিবার চেয়েছি।মায়ের মতো শাশুড়ি পেতে চেয়েছি।একজন সৎ স্বামী চেয়েছি।দেরি করে হলেও এবং দ্বিতীয়বার হলেও পেয়েছি আমি।
নিজেকে এখন সত্যিই আমার ভাগ্যবতী মনে হয়।
কাঙ্খিত সেই সুখ পেয়েছি আমি।তবে আফসোস!
আমার সবচেয়ে প্রিয় দুটি মানুষ আমার এই সুখেতে নেই।আমার সন্তানেরা আমার পাশে নেই।ওরা এখন আমার সঙ্গে থাকলে আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হতাম।
ভাবতেও অবাক লাগে,ওদের সুখের জন্য এতোকাল নিজের সুখের কথা ভাবিনি আমি।অথচ আজ যখন আমি একটু সুখের ছোঁয়া পাবো,ওরা আমায় ফেলে চলে গেল।
দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে ভেতর থেকে।
আনমনে এসব ভাবতে ভাবতে ঘরে গেলাম।দুটো ঘর গুছিয়ে দিলাম সুন্দর করে।
স্যারের মা-বাবা ও স্যার থাকবেন এ দুটো ঘরে।
স্যারের বাড়িতেই থাকতে পারতেন তারা।
কিন্তু স্যারের বাড়িতে যে কটা ঘর আছে তার মাঝে স্যারের ঘরটাই শুধু একটু গোছালো বা পরিপাটি।বাকিঘরগুলো তেমন গোছালো বা পরিষ্কার নয়। আধাআধি পরিষ্কার যাকে বলে।এককথায় বয়স্ক দুটো মানুষের থাকার উপযোগী নয়।
নতুন শিফ্ট হয়েছে স্যার।সব গুছিয়ে নিতে একটু সময় লাগবে স্বাভাবিক।
আর আমার বাড়িতো প্রায় খালিই থাকে।এজন্য আমার বাড়িতেই থাকতে বলেছি তাদের।যদিও স্যার বলেছিলেন তিনি তার বাড়ি গিয়েই থাকতে চান।
কিন্তু তার মা-বাবা বলেছে আজকের রাতটা তাদের সঙ্গেই থাকতে।তারা কালই চলে যাবে।একমাত্র ছেলে,এতোদিন পর দেখা।তাই হয়ত ছেলেকে ছাড়তে চাচ্ছেন না।বাধ্য হয়ে স্যার ও রাজি হয়ে যান।
এরা আজ ঘুমোবে কম গল্প করবে বেশি।
রাতের খাবার খেয়ে সবাই একঘরে সমবেত হলাম।
নানান গল্প শুরু হলো।বেশির ভাগই স্যারের ছোট বেলার মজার কাহিনী।আমি আর ভাবি হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছি একপ্রকার।স্যার বারবার থামতে বলছে তার মাকে।আমরা উৎসাহ দিচ্ছি আরো বলতে।
গল্পগুজব চললো রাত প্রায় বারোটা পর্যন্ত।
এবার আমি তাড়া দিয়ে বললাম,”বাকি গল্প অন্য একদিন হবে।আজ আপনারা ঘুমিয়ে যান।অনেক রাত হয়েছে।জার্নি করে এসেছেন।ক্লান্ত নিশ্চয়।এসেছেন থেকে বিশ্রাম হয়নি।
আবার বলছেন কালই চলে যাবেন।থাকতে বলছি শুনছেন না।”
“না মা।একমাত্র ছেলের বিয়ে।অনেক কাজ আছে।গ্রামে গিয়ে আত্মীয়স্বজনদের জানাতে হবে।
সব জোগাড়যন্ত্র করে বিয়ের আগের দিন রাতেই চলে আসবো।চিন্তা করোনা।”
“তাহলে এবার লক্ষিটি হয়ে ঘুমিয়ে যান।”
“হ্যা মা।তন্নি ঠিকই বলেছে।রেস্ট করো এখন।কাল আবার জার্নি করবে।এখন রেস্টের প্রয়োজন।”
তাদের বিদায় জানিয়ে ঘর ছাড়লাম সকলে।
ভাবি হাই তুলতে তুলতে নিজের ঘরে গেল।
আমিও ঘরে যেতে নেব এমন সময় স্যার পেছন ডাকেন।বলেন,”শুভ রাত্রি আমার হবু স্ত্রী।
খুব শিগ্রই আমি আপনাকে শুধু স্ত্রী করে নেব।”
“শুভ রাত্রি।”
এ কথা বলে ঘরে চলে এলাম আমি।
দেখি জানালা খোলা।
জানালা বন্ধ করতে নেব এমন সময় লক্ষ্য করলাম আকাশে ভারী মেঘ করেছে।হয়ত বৃষ্টি হবে আজো।
ইদানিং প্রায়ই মাঝরাতে বৃষ্টি হয়।
আমি আবার ভীষণ শিতকাতুরে।বৃষ্টি হলে ঠান্ডা নামবে।আগাম প্রস্তুতি হিসেবে কাঁথা বের করতে হবে।ড্রয়ার খুলে কাঁথা বের করে ঝাকি দিয়েছি।ভাঝ থেকে একটা কাগজ পড়ে মেঝেতে।
ভ্রু কুচকে উঠাই সেটি।এটাতো সেই চিঠি।আমার পারভীন আপার চিঠি। মূহুর্তেই চোখে পানি জমে আমার।আজ বহুদিন হলো চিঠিটা পড়া হয়না।ছেলে-মেয়ের অশান্তিতে মনেই থাকেনা কিছু আমার।
আপা তাহলে আমার সুখেতে অংশ নিতে চলেই এলো।
চিঠিটা খুলে বিছানায় বসলাম।আজো এই চিঠির ভাজ থেকে আপার গায়ের ঘ্রাণ পাই আমি।
এই চিঠি আমি বহুবার পড়েছি।যতোবারই পড়ি,নতুনত্ব কিছু খুঁজে পাই।
পড়তে লাগলাম মন দিয়ে।কখন যে গাল গড়িয়ে অশ্রু নেমেছে জানিনা।
পড়া শেষ করে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরলাম সেটি।আপার লেখা শেষ কথাটি মনে মনে ভাসছে আমার।
‘তুমি আকাশ পানে তাকিয়ে ‘আপা’ বলে চিৎকার করে ডেকো আমায়।
আমি মেঘের আড়াল থেকে তোমায় দেখে মুচকি হাসবো।’
আজ আমি আপাকে সত্যি সত্যি ডাকবো।আজ তার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।আমি নতুন জীবনে পা রাখতে চলেছি।যা আপা বরাবরই চাইতো।
চিঠিটা স্বযত্নে রেখে দিলাম।
ধীর পায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছি।স্যারের ঘরের সামনে দিয়ে এসেছি আমি।উনি আমায় পেছন ডেকেছে।কিন্তু শুনিনি আমি।আমি আছি অন্য ধ্যানে।
ধীরে ধীরে হেঁটে ছাদে গিয়েছি।
ছাদের এককোণে দাঁড়িয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে আকাশ পানে তাকিয়ে চিৎকার করে বললাম,”আপা এই আপা।শুনছেন আমার কথা?
দেখুন আপনার তন্নি এসেছে।
আপনি তো বলেছিলেন আকাশ পানে তাকিয়ে আপনায় ডাকতে।আপনি মেঘের আড়াল থেকে আমায় দেখে হাসবেন।
আজ আকাশে ঘন মেঘ করেছে।কিন্তু আপনি কোথায় আপা?
আজ আপনার তন্নির এক নতুন জীবনের সূচনা হলো আপা।
আমি পেয়েছি বিশ্বস্ত কাউকে।জীবনকে নতুন রুপে সাজাতে চলেছি আমি আপা।
আপনি এ সময় আমার পাশে নেই।এর চেয়ে দুঃখের আর কী হতে পারে?
আসুন না আপা।আমায় একটু দেখে যান।”
মুখে দু-হাত চেপে কাঁদলাম আমি।
স্যার পেছন থেকে আমার কাধে হাত রাখলেন।তাকে দেখে কান্না থামাই।চুপ থাকি।আকাশ পানে তাকিয়ে রই।
স্যার আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন।
প্রায় মিনিট পাঁচেক চলে যায় এভাবেই।স্যার কাশেন হালকা।আমার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন।
আমি তখনও আকাশ পানে চেয়ে।
তিনি বলেন,”জানিনা আপনি কাকে খুঁজছেন।অথবা কোন উদ্দেশ্যে খুঁজছেন।শুধু একটা বিষয়ই বুঝছি,যাকেই খুঁজছেন সে আপনার ভীষণ প্রিয় ছিল।
এই গভীর রাতে আকাশ পানে তাকিয়ে মানুষ আপন কাউকেই খোঁজে।
জন্ম যার হবে,মৃত্যু তার বরণ করতেই হবে।এটাই প্রকৃতির নিয়ম।এটা মেনে নিয়েই চলতে হয় আমাদের।
যে চলে যায় তার জন্য আবেগ,বিবেগ কিছুই কাজ করেনা।
আপনি যদি তাকে মন থেকে ভালোবেসে থাকেন তাহলে দোয়া করতে পারেন তার জন্য।”
“জানেন স্যার আমি খুব কমই ভালো মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি।এর মাঝে অন্যতম ছিল পারভীন আপা। আমার নিজের বোনের চেয়েও বেশি ছিল তিনি।এইযে আমি আজ এই পর্যায়ে।সবই তার জন্য।সে এক নতুন তন্নির জন্ম দিয়েছিল একসময়।
আমার সফলতা,অর্থবিত্ত সবই তার জন্যে।সে নিজ হাতে গড়েছিল একসময় আমায়।
আজ সেই মানুষটা আমার পাশে নেই।আকাশের তারা হয়ে গেছে।
ইনি খুব করে চাইতো আমি সব ভুলে নতুন জীবন শুরু করি।আজ সত্যি সত্যি নতুন জীবন শুরু করছি আমি।কিন্তু পারভীন আপা নেই।
আমার খুব ইচ্ছে করছে তাকে জড়িয়ে ধরে নিজের মনের আনন্দ প্রকাশ করতে।
কিন্তু সে যে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।”
আবারো কাঁদলাম আমি।স্যার শুধু আমায় স্বান্তনা দিলেন।
রাত অনেক হয়ে এলো।সে আমায় ছেড়ে গেল না।আকাশ পানে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে মনটা হালকা হয় আমায়।ছাদ থেকে একসঙ্গে নেমে আসি।যে যার ঘরে যাই।
ভোরে পারুল ভাবির ডাকে ঘুম ভাঙে আমার।
বাইরে আসি দ্রুত।ফ্রেশ হয়ে রান্নায় লেগে পড়ি ভাবির সঙ্গে।
স্যারের মা আসেন আমাদের হেল্প করতে।তাকে একটা চেয়ার টেনে বসিয়ে নিজেরাই সবটা করি।
এরপর একসঙ্গে খাবার খাই।উনারা বিদায় নেবে এবার।
আমিও তাদের এগিয়ে দিয়ে আসতে চাই স্যারের সঙ্গে।তাদের আমি সত্যি সত্যিই মা-বাবার আসনে বসিয়েছি।মানুষগুলো যে বড্ড ভালো।
গাড়িতে করে এগিয়ে দিয়ে আসি।
স্যারের মা-বাবা গাড়ি থেকে নামেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,”খুব শিগ্রই দেখা হচ্ছে মা।নিজে ভালো থেকো।এবং আমার ছেলেটাকেও দেখে রেখো।
দুজনের মাঝে কখনো ত্বিতীয় ব্যাক্তি আসতে দিওনা।ভালোবাসাকে অটুট রেখো।বিশ্বাসকে মজবুত করো।প্রতিটা সম্পর্কের প্রধান খুটি হলো একে অপরে বিশ্বাস।”
উনারা বিদায় নেয়।আমার মনটা খারাপ হয়ে যায়।এই একটা দিন আমার কাছে অনেকটা স্পেশাল ছিল।
স্যার ও আমি গাড়িতে উঠি।আমার মন খারাপ দেখে ঐদিনের সেই ধাবাতে খেতে যাওয়ার কথা বলেন তিনি।
আমিও রাজি হয়ে গেলাম।
রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলতে লাগে।একটা রোমান্টিক গান চলছে গাড়িতে।আমি সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে শুনছি তা।
হঠাৎ স্যার ব্রেক কসলেন।ঝুকে গেলাম সামনের দিকে।
স্যার ভয়ার্ত কন্ঠে বললেন,”গাড়ির সামনে কে যেন চলে এসেছে।”
দুরুদুরু বুক নিয়ে দ্রুতই নামলাম গাড়ি থেকে।
ওমা!নেমে দেখি আকাশ দিব্যি দাঁড়িয়ে গাড়ির সামনে।
আমাদের দেখে এগিয়ে এসে বলে,”তুমি তন্নি একাজ করতে পারোনা।আমি থাকতে তুমি কিছুতেই উনাকে বিয়ে করতে পারোনা।”
বললাম,”আমি তো বিয়ে উনাকেই করবো।রাস্তার মাঝখানে নাটক না করে সরে যাও।”
আমার কাছে পাত্তা না পেয়ে আকাশ এবার ছুটলো স্যারের কাছে।
বলল,”আপনি ওকে বিয়ে করবেন না প্লিজ।ও মেয়ে ভালো না।ভালো মেয়েদের কখনো ডিভোর্স হয়না।একহাতে তালি বাজেনা।ওর ও দোষ ছিল।ওর চরিত্র খারাপ ছিল।আপনি ওকে বিয়ে করলে আপনার জীবন নষ্ট হবে।
আমি দীর্ঘদিন ওর সঙ্গে সংসার করেছি।আমি ভালো জানি ও কেমন মেয়ে।
তাই বলছি,ওকে বিয়ে করবেন না।দুনিয়াতে অনেক মেয়ে আছে।অনেক ভালো মেয়ে আছে।”
“অনেককে চাইনা আমার।তন্নি হলেই চলবে আমার।আমি কাপুরুষ নই যে অন্যের কথায় নাচবো।আমার নিজের বিচার বুদ্ধি আছে।আমার হবু বউয়ের সার্টিফিকেট আপনার মতো দুশ্চরিত্র পুরুষের থেকে নিতে হবেনা আমার।
আমি জানি তন্নি কেমন।ফুলের মতোই পবিত্র সে।ফুল হিসেবেই বরণ করে নিতে চাই আমি তাকে।”
আমার হাত ধরলেন স্যার।গাড়িতে এনে বসালেন।নিজেও বসলেন।জানালা দিয়ে মাথা বের করে বললেন,” নেক্সট টাইম থেকে আমার বউয়ের বিষয়ে বাজে কথা বলার আগে দু-বার ভাববেন।আজ ছেড়ে দিয়েছি বলে বারবার ছাড় পাবেন না।”
আকাশকে ক্রস করে গাড়ি নিয়ে চলে স্যার।
আমি চুপচাপ বসে আমি।দীর্ঘসময় কোনো কথা বলিনা।
অবস্থা বুঝে স্যার আমার হাতে হাত রাখেন।
চোখের দিকে তাকিয়ে বলেন,”একটা সম্পর্কের প্রধান খুটি হলো বিশ্বাস। যেটা আমি আপনায় মন প্রাণ দিয়ে করি।
ওর মতো দশটা আকাশও সেই বিশ্বাস ভাঙতে পারবেন না।”
মনে প্রশান্তি পাই।একটু হাসি।বন্ধ হওয়া গানটি নিজেই অন করি আবার।
এই হলো জীবন।আমার রঙিন জীবন।যা পুরোটাই ভালোবাসাময়।
ইবই,,,ওর রুপ আমায় মুগ্ধ করেছে। ওর চোখের পানি আমার আগুন হৃদয়কে শান্ত করেছে। ওর অসহায় দৃষ্টি আমার বুকে ঢেউ তুলেছে। ওর কন্ঠ আমায় পাগল করেছে। ওর রেশমি কালো চুল আমার মন কেড়েছে। ওর নমনীয়তা আমায় ধ্বংস করেছে ফাহিম। ভালোবাসার জন্য আর কী চাই বল?”
চলবে।