#১৫_বছর_বয়সী_মা (২২)
#সোফিয়া_সাফা
(মহাপর্ব—আগন্তুকের আগমন)
আলভী কলটা কেটে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো হলরুম পেরিয়ে এসে দাড়ালো রূপসার রুমের সামনে। হাত উচিয়ে ২বার নক করতেই রূপসা এসে দরজা খুলে দেয়। আলভী রূপসার দিকে না তাকিয়েই গলা ফাটিয়ে অলিকে ডাক দেয়,
“অলিইইই”
আলভীর হুংকারে খাটের উপরে বসে থাকা অলি দ্রুতপায়ে রূপসার পেছনে এসে দাঁড়ায়,
“অলি তুমি এখানে এসেছো কেনো?”
অলিকে কিছু বলতে না দিয়েই রূপসা বলে ওঠে,
“ভাইয়া আসলে অলির সাথে আমার কথা বলা হয়ে ওঠেনি। আমি ওর সাথে দেখা করতেই গিয়েছিলাম। ও নাকি একা একা ঘুমাতেও পারেনা। সেটা আমি আগেই শুনেছিলাম এতোদিন ইশা ছিলো বলে আমি আর ওর সাথে ঘুমাতে যাইনি। এখন যেহেতু ইশা নেই,,,”
“স্টপ রূপ, ফালতু বকিস না। ও একা ঘুমাতে না পারলে আমি ওর হাজব্যান্ড তো আছিই তাইনা। তোকে এই ব্যাপার টা নিয়ে ভাবতে হবেনা। অলি কাম উইথ মি”
অলি একটা শুষ্ক ঢোক গিলে মিনমিনিয়ে বলে ওঠে,
“আমি রূপসা আপুর সাথে ঘুমাতে পারবো তো। উনি হাতপা ছোড়াছুড়িও করেনা। আপনি গিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারেন”
আলভী প্রচন্ড বিরক্তিতে বিড়বিড় করে বলে,
“ডাম্ব”
অলি কথাটা না শুনলেও রূপসা শুনেছে। সে আলভীর উদ্দেশ্যে বলে,
“ভাইয়া অলি বাচ্চা মেয়ে।”
আলভী রাগে গজগজ করে ওঠে, রাগে যেন মাথা ফেটে যাচ্ছে তবুও নিজেকে কন্ট্রোল করে রেখেছে, আলভী দাঁতে দাঁত চেপে নিম্নস্বরে বললো,
“ও বাচ্চা মেয়ে নয়। ও একটা ষ্টুপিড, ডাম্ব আর ইডিয়ট। ও আমার ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিচ্ছে। ওকে বের কর রুম থেকে নইলে টেনে বের করে নিয়ে যাবো”
আলভীর কন্ঠ শুনে অলির শরীর শিউরে উঠছে সে উপায়ন্তর না পেয়ে রূপসার সাথে সিটিয়ে দাড়ালো। সে জানে রূপসা তাকে খুব একটা পছন্দ করেনা তবে এই রকম পরিস্থিতিতে রূপসাই তার একমাত্র আশ্রয়।
“ভাইয়া তুমি ওকে জোর করে বিয়ে করেছো। সেই হিসেবে ওকে একটু টাইম তো দেবে নাকি নিজেকে সবকিছুর সাথে মানিয়ে নিতে?”
আলভী কিছু বলতে চাইলেও বলতে পারেনা রূপসার জায়গায় ঊর্মিলা হলে নিঃসন্দেহে দুটো থাপ্পড় দিয়ে অলিকে টানতে টানতে নিয়ে যেতো কিন্তু রূপসাকে সে কিছুই বলতে পারবেনা।
“অলি লাস্ট বারের মতো বলছি চলো আমার সাথে”
অলি একটা ঢোক গিলে বলে উঠলো,
“আমি যাবোনা। আপনাকে দেখলে আমার ভয় করে আপনি যান এখান থেকে”
আলভী এবার নিজের ক্রোতকে আর কন্ট্রোল করতে না পেরে দরজার পাশে থাকা কাচের ফ্লাওয়ার ভ্যাস টা ছুড়ে ফেলে দিলো। যার শব্দে অলি কেপে ওঠে রূপসার হাত খামচে ধরে। ফলস্বরূপ রূপসা রাগীচোখে অলির দিকে তাকায়। মেয়েটাকে তার অসহ্য লাগে। শুধু মাত্র আলভী আর অলির একরুমে থাকার ব্যাপারটা মেনে নিতে পারবেনা বলেই মেয়েটাকে সহ্য করতে হচ্ছে।
“ইউ হ্যাভ টু পে ফর এভ্রিথিং অলি। ইউ হ্যাভ টু পে”
কথাটা বিড়বিড় করতে করতেই আলভী হনহনিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। অলি যেনো হাফ ছেড়ে বাচলো। রূপসা অলির হাত সরিয়ে দিয়ে বললো,
“এভিকে এতো বেশি ভয় পেলে চলে যাওনা বাপের বাড়িতে।”
রূপসার কথার ধরন টা অলির ভালো লাগেনি। উপায় না পেয়েই রূপসার সাথে এসেছিলো সে। নয়তো এই রূপ নামে রূঢ় মেয়েটার সাথে সে কক্ষনো আসতোনা।
★
আলভী রুমে এসে হাসফাস করতে লাগলো, ভীষণ অস্থির লাগছে। অলির উপর তার ভীষণ রাগ উঠছে। সেই সাথে রিফাতের উপরেও, রিফাতের জন্যই তাকে এইরকম পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। সে এসব আর নিতে পারছেনা, আলভী বেডসাইড ড্রয়ার থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করে—সেখান থেকে একটা সিগারেট বের করে একপ্রান্তে আগুন জ্বালিয়ে অন্যপ্রান্ত ঠোঁটে চেপে ধরে। এই মূহুর্তে এই জিনিসটাই যদি তার অস্থিরতা কিছুটা কমাতে পারে,
সকালের আলো ফুটেছে ধরনীর বুকে, জানালার স্বচ্ছ কাচ ভেদ করে সকালের স্নিগ্ধ আলো রুমের প্রতিটি কোনে ছড়িয়ে পড়েছে।
“এইযে নবাবজাদী। খাটটা আমি তোমার নামে লিখে দেইনি”
রূপসার রূঢ়ভাবে বলা বাক্যটা কানে পৌছাতেই অলির ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে তড়িঘড়ি করে উঠে বসলো।
“কি হয়েছে আপু?”
“কি হয়নি বলো। সারারাত তোমার জন্য ঘুমাতে পারিনি আমি,,,
রূপসা আরো কিছু কথা বলতে চেয়েও নিজেকে সামলে নেয়। আলভীর জন্য এই মেয়েটাকে তাকে সহ্য করতেই হবে। যে করেই হোক এই আপদটাকে তো সে বিদেয় করবেই করবে।
“কি করেছি আমি?”
রূপসা মুখে হাসি ঝুলিয়ে বললো,
“না না কিচ্ছু না। তুমি এবার নিজের রুমে যাও। আমাকে ভার্সিটির জন্য রেডি হতে হবে।”
অলি মাথা নাড়িয়ে চলে আসতেই নেবে তার আগেই রূপসা হাসিমুখে বলে ওঠে,
“অলি আমরা তো বন্ধু হতেই পারি তাইনা?”
অলি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে বলে,
“আমি তো প্রথম থেকেই আপনার বন্ধু হতে চেয়েছিলাম। ঊর্মিলা আপুর মতো। কিন্তু আপনিই তো আমাকে এড়িয়ে গেছেন। আচ্ছা আপনি আমাকে দেখতে পারতেন না কেনো?”
রূপসা কি বলবে খুঁজে পেলোনা।
“আসলে তুমি ভুল ভাবছো। আমি তো এরকমই, সবার সাথে এভাবেই কথা বলি। তুমি প্লিজ কিছু মনে কোরোনা। আর আমাকে আপনি করেও বলতে হবেনা। উই আর ফ্রেন্ডস রাইট?”
অলি হাল্কা হেসে উপরনিচ মাথা নাড়ালো।
“আ,,, অলি তুমি প্রতিরাতেই আমার সাথে ঘুমাতে পারো। আমি কিছুই মনে করবোনা।”
অলি বিছানা থেকে নেমে গিয়ে বললো,
“ধন্যবাদ আপু, তবে কয়েকদিন পর থেকে আমার টেস্ট পরিক্ষা শুরু হয়ে যাবে। আমার এবার বাড়িতে ফিরে যাওয়া উচিৎ। ভাবছি আজই চলে যাবো”
কথাটা শুনে রূপসার চোখদুটো চকচক করে উঠলো। সে তো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি পেয়ে গেছে। এই মেয়ে তো নিজে থেকেই চলে যাবে বলছে। রূপসার থেকে প্রতিউত্তর না পেয়ে অলি রূপসার রুম থেকে বেরিয়ে যায়। ধীরপায়ে নিজের রুমে প্রবেশ করতেই থমকে গেলো অলি—আলভী নিশ্চিন্তমনে অলির রুমেই ঘুমিয়ে আছে। অলি একটা ঢোক গিলে আলভীর ঘুমে ব্যাঘাত না ঘটিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।
,
ডাইনিং টেবিলে আলভী বাদে সবাই উপস্থিত। শাহানাজ বেগম সবার ব্রেকফাস্ট সার্ভ করে দিয়ে ঊর্মিলার উদ্দেশ্যে বললেন,
“ঊর্মি তোর ভাইকে ডেকে নিয়ে আয়”
অলি চুপচাপ ড্রইংরুমেই বসে আছে। প্রতিদিন আলভী আসার পরে অলিকে সাথে নিয়ে ব্রেকফাস্ট করে। সেইজন্যই অলি আলভীর আশাতেই বসে আছে। তাছাড়া শাহানাজ বেগম তাকে দেখলেই চোখমুখ কুচকে ফেলে যেনো অলির গায়ে নোংরা কিছু লেগে আছে। আলভী আশেপাশে থাকলে অবশ্য এরকমটা করেননা। ঊর্মিলা ডাকতে যাবে তার আগেই আলভী এলোমেলো পা ফেলে কোনোদিকে না তাকিয়ে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসলো,
“মা তারাতাড়ি করো লেইট হয়ে যাচ্ছি।”
আলভীর দিকে তাকিয়ে সবাই চমকে যায়। আলভী একহাতে ফোন চাপছে আরেকহাতে নিজের চুল টানছে,
“ভাইয়া কি হয়েছে তোমার?”
ঊর্মিলার কথা শুনেও যেনো শুনলোনা আলভী।
“তারাতাড়ি খাবার দেও নয়তো বাইরে থেকেই খেয়ে নেবো। সময় নেই আমার হাতে”
শাহানাজ বেগম দ্রুত হাতে আলভীর প্লেটে খাবার বেড়ে দিলেন। আলভী ফোনের দিকে তাকিয়েই খাবার খাচ্ছে। এ যেনো পুরোনো আলভীকে দেখছে সবাই—সেই পুরোনো আলভী তাসনীম মির্জা। অলি সোফায় বসে থাকা অবস্থাতেই আলভীকে দেখছে আর অবাক হচ্ছে,
“লোকটা আজকে আমাকে ছাড়াই খাবার খাচ্ছে? উফস আমার তো অনেক ক্ষুধা লেগেছে”
অলি থাকতে না পেরে ডাইনিং টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলো। আলভী সেইদিকে কোনোপ্রকার ভ্রুক্ষেপ করলোনা। তার সমস্ত খেয়াল ফোনে ছিলো। অলি ধীরপায়ে আলভীর পাশের চেয়ারে বসতেই আলভী একনজর অলির দিকে তাকিয়ে আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। প্রতিদিন আলভী অলিকে নিজহাতে খাবার বেড়ে দেয় কিন্তু আজকে আলভী যেনো অন্য জগতে আছে। কিছু একটা ঠিক নেই বুঝতে পেরে নূরনাহার এগিয়ে এসে অলির প্লেটে খাবার বেড়ে দিলেন।
খাবার খাওয়া শেষ হতেই আলভী নিজের রুমে চলে যায়। আজকে তাকে অফিসে যেতে হবে। আলভী রেডি হচ্ছিলো তখনই অলি আলগোছে দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় আলভী অলির প্রতিবিম্ব দেখতে পেয়েছে কিন্তু সে আগ বাড়িয়ে কিছুই বললোনা।
“শুনছেন?”
আলভী উত্তর না দিয়ে ঘড়ি পড়তে লাগলো। অলি ভ্রু কুচকে আলভীর দিকে তাকিয়ে একটু উচ্চস্বরেই ডাক দেয়,
“এই যে শুনুন না”
আলভী এবার ঘাড় ঘুরিয়ে অলির দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়, অলি দরজা ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
“আসলে আগামী সপ্তাহেই আমার টেস্ট পরিক্ষা শুরু হয়ে যাবে। বাড়িতে যাওয়াটা অনেক বেশিই গুরুত্বপূর্ণ।”
আলভী পুরোপুরি ভাবে অলির দিকে ঘুরে দাড়ালো ফলস্বরূপ অলি একটা শুষ্ক ঢোক গিললো। রাতের ব্যাপারটার জন্য আলভী তাকে তুলে আছাড় মারবে নাকি সেটা ভেবেই তার ভয় করছে। পরক্ষণেই মনে পড়লো সেতো প্রেগন্যান্ট। আলভী তাকে মার*ধর করবেনা নিশ্চয়ই,
“বাড়িতে যেতে চাইছো? তো কয়দিনের জন্য যাবে শুনি?”
আলভীর কন্ঠে যেনো প্রাণ নেই। অলি আলভীর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে কিছুক্ষণ ভেবে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,
“পরিক্ষা তো ১ সপ্তাহ পর থেকেই শুরু হবে। শেষ হতে হতে ২ সপ্তাহের মতো টাইম লাগবে। সবমিলিয়ে ১ মাসের মতো তো থাকতেই হবে”
আলভী স্বাভাবিক ভাবেই বললো,
“রেডি হয়ে নেও। ড্রাইভারকে বলে দেবো সে তোমাকে দিয়ে আসবে।”
কথাটা বলেই আলভী অফিস ব্যাগটা হাতে তুলে নিলো তারপর বিনাবাক্যে অলিকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। অলি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর খুশিমনে নিজের কক্ষে গিয়ে ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিতে লাগলো।
বিকেলের দিকে সূর্য নিস্তেজ হয়ে এসেছে। ঊর্মিলা, ইয়াদ আর রূপসা কিছুক্ষণ আগেই ভার্সিটি থেকে ফিরেছে। ঊর্মিলার মনটা আজকে বেশ ভালো দিহান এসেছিলো কলেজে। এতোদিন লজ্জায় দিহানের সাথে কথা বলতে পারেনি। কিন্তু আজকে দিহানের সাথে সামনা-সামনি দেখা হওয়ায় কিছুটা সহজ হতে পেরেছে। সেইসাথে দিহান উত্তর জানার জন্যও চাপ দেয়নি। অলি ঊর্মিলার রুমে গিয়ে বললো,
“আপু আমি আজকে বাড়িতে চলে যাবো”
ঊর্মিলা সবেমাত্র ফ্রেশ হয়ে বের হয়েছিলো। অলির কথা শুনে সে অবাক চোখে তাকায়,
“ভাইয়া যেতে বলেছে?”
অলি হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ায়।
“তাহলে তো ভালোই যাও গিয়ে ঘুরে এসো। বেশিদিন থেকোনা কিন্তু আমার ভাইয়ের আবার ধৈর্য্য কম। তাছাড়া দূরুত্ব বাড়িয়ে দিলে কিন্তু গুরুত্ব টাও কমে যায়।”
অলি বেশি ভাবলোনা। সেতো শর্ত টর্ত দিয়েই দিয়েছে। আলভীকে নিয়ে তার মাঝে আর কোনোপ্রকার ভয় নেই।
অলি বাড়ির সবার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে চড়ে বসলো। ইয়াদ অলির ব্যাগপত্র সব গাড়িতে তুলে দিয়েছে। অলির চলে যাওয়াতে সবচাইতে বেশি খুশি হয়েছেন শাহানাজ বেগম আর রূপসা। রুনা খাতুনও কম খুশি হননি। তার মেয়ে যে আলভীকে ভালোবাসে সে সেটা জানে। মেয়ে খুশি মানে সেও খুশি।
সন্ধ্যাবেলা।
পুরো একসপ্তাহ পর অলিকে দেখে আসমা বানু আবেগ আপ্লূত হয়ে পড়ে। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরেই সে শান্তি অনূভব করে।
“জামাই আসেনি?”
লিয়াকত হোসাইনের কথা শুনে অলি নাবোধক মাথা নাড়ায়,
“সেকি অলি তুই জামাইকে বলে আসিস নি?”
“হুম এসেছি তো মা। বলেই এসেছি”
আসমা বানু পুনরায় শুধালেন,
“তাহলে তাকে আসতে বলিস নি?”
অলি কিছুক্ষণ ভেবে বললো,
“না, আমি তো তাকে আসতে বলিনি”
অলির কথা শুনে আসমা বানু খুশি না হলেও মেয়েকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন।
সপ্তাহ খানেক কেটে যায়। আজকে থেকে অলির পরিক্ষা শুরু হবে। আসমা বানু অলির জন্য খাবার বেড়ে দিচ্ছিলেন।
“তুই বলেছিস জামাই নাকি তোকে অনেক যত্নে রেখেছে, এই তার নমুনা? এই বাড়িতে এসেছিস এক সপ্তাহ হয়ে গেলো। তারমধ্যে তো কখনো দেখলাম না কল দিতে।”
অলি এক টুকরো পরোটা মুখে নিয়ে চিবোতে লাগলো,
“সে হয়তো ব্যস্ত আছে।”
“ব্যস্ত থাকলেও কিভাবে একবারও কল না দিয়ে পারলো? তুই প্রেগন্যান্ট অবস্থায় পরিক্ষা দিতে যাবি। সেটা নিয়েও কি ওনার বিন্দুমাত্র চিন্তা নেই?”
অলি চুপ করে রইলো। ব্যাপারটা নিয়ে তারও বেশ মন খারাপ হয়েছে। আলভী নিজে থেকে কোনো কল দেয়নি। আর সেও দ্বিধায় থাকাতে আলভীকে কল দেয়নি,
“হ্যাঁ রে জামাইয়ের সাথে ঝগড়া করে এসেছিস নাকি?”
উত্তরে অলি নাবোধক মাথা নাড়ায়। আসমা বানুর কাজে যাওয়ার সময় হয়ে যাচ্ছিলো। সেই জন্য সে আর কথা বাড়ালেন না,
“শোন রিলাক্সে পরিক্ষা দিবি। এই অবস্থায় বেশি চাপ নেওয়ার প্রয়োজন নেই।”
“হুম মা। তুমি চিন্তা কোরোনা”
আসমা বানু কাজে চলে গেলেন। অলিও কিছুটা খাবার খেয়ে রেডি হতে নিজের রুমে আসে। সকাল বেলা সে বেশি খাবার খেতে পারেনা। যতটুকু পেরেছে ততোটুকুই খেয়েছে। অলি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হিজাব বাধছিলো। পুরো ১৭ দিন পর সে আজকে স্কুলে যাচ্ছে তাও আবার পরিক্ষা দিতে। অলি একদৃষ্টিতে আয়নায় থাকা নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে আছে—পেটের অংশটা একটু উঁচু উঁচু লাগছে। যদিও খুব একটা বোঝা যাচ্ছেনা। হয়তো বোরকা পড়লে এটুকুও বোঝা যেতোনা কিন্তু স্কুল ড্রেস ছাড়া স্কুলে ঢুকতেই দেবেনা। অলি একটা শ্বাস ফেলে শায়লাকে কল দিলো। শায়লায় নিজস্ব ফোন নেই এটা তার মায়ের নম্বর। আগে অলি নিজের মায়ের ফোন দিয়ে শায়লার মায়ের ফোনে কল দিয়েই শায়লার সাথে কথা বলতো।
“ক্লাসে তো ফোন নিয়ে ঢুকতে দেবেনা তাইনা?”
অপর পাশ থেকে শায়লা বললো,
“না, তুই ফোন বাড়িতেই রেখে আয়। আমি স্কুলের বাইরে তোর জন্য অপেক্ষা করবো। তুই আসলে একসাথে ক্লাসে ঢুকবো”
“আচ্ছা, আমি বের হচ্ছি”
অলি কল কেটে দিয়ে একটা শ্বাস ছাড়লো। সে জানে আজকে স্কুলে গেলেই শায়লা জানতে চাইবে সে এতোদিন কেনো স্কুলে যায়নি। যদিও ফোনে সে ব্যাপারটা এড়িয়ে গেছে কিন্তু সামনা-সামনি হলে তাকে বলতেই হবে।
,
পরিক্ষা শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই,
“কিহ! তোর বিয়ে হয়ে গেছে?”
শায়লা চিৎকার দিয়ে উঠলো। অলি মাথা নাড়িয়ে বললো,
“হুম”
“কি বলিস—কখন কিভাবে বিয়ে হলো? আমাকে জানালি না? এই তোর বন্ধুত্ব?”
অলি ঠোঁট চেপে কিছুক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর একটা শ্বাস ফেলে বললো,
“সবকিছু হঠাৎ করেই হয়ে গেছে তাই তোকে জানানোর সময় পাইনি।”
“দুলাভাই কই? তাকে আসতে বল। পরিচিত হয়ে নেই, যতই হোক আমি তার শালিকা সেইসূত্রে একটা ট্রিট তো পাই নাকি?”
“সে আসেনি। পরিক্ষার জন্য আমি একাই বাড়িতে এসেছি।”
কথাটা শুনে শায়লার মন খারাপ হয়ে গেলো।
“দুলাভাই তোকে একাই পাঠিয়ে দিয়েছে? এটা কিন্তু সে মোটেও ঠিক করেনি।”
অলি উত্তর দিলোনা সে ভীষণ ক্লান্ত। কিন্তু হঠাৎ কিছু একটা মনে হতেই সে বলে ওঠে,
“আচ্ছা তুই তোর ভাইয়ের ফোন থেকে আমার ছবি ডিলিট করে দিয়েছিলি তো?”
শায়লা ভ্রু কুচকে বলে,
“সেদিনই তো করে দিয়েছিলাম এতোদিন পরে হঠাৎ এই প্রশ্ন করছিস কেনো?”
“trash bin থেকে করেছিলি?”
শায়লা চমকে তাকিয়ে বলে,
“সেটা আবার কি বে?”
অলি বুঝে যায় শায়লা সেখান থেকে ডিলিট করেনি। অলি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে ওঠে,
“তোর ভাই বাড়িতে আছে?”
শায়লা মাথা নাড়িয়ে না বললো। তারপর ঠাট্টার স্বরেই বললো,
“অই তুই আমার ভাইয়ের কথা কেনো জিজ্ঞেস করছিস? তোর তো বিয়েও হয়ে গেছে”
“আরে বললা,”
শায়লা না বোধক মাথা নাড়িয়ে বলে,
“আমার ভাইয়া কি আমাদের সাথে থাকে নাকি? সে তো মাঝেমধ্যে আসে। তবে প্রায় ৩ মাসের মধ্যে সে একবারও আসেনি।”
অলি চমকে তাকালো,
“তোদের সাথে কোনো যোগাযোগ নেই?”
“আছে কয়েকদিন পরপর কল দিয়ে খোঁজ খবর নেয়। কিন্তু কোথায় আছে সেটা সঠিকভাবে জানিনা। ওর নাকি সেখানে একটা ভালো জব হয়েছে। মাসে মাসে আমাদেরকে টাকাও পাঠায়।”
অলি কৌতুহল বশত জিজ্ঞেস করেই ফেলে,
“তোর ভাইয়ের নামটা জানো কি?”
“বাব্বাহ আজকে তো দেখছি আমার ভাইয়ের বিষয়ে নিজে থেকেই জানতে চাইছিস। অন্য সময় আমি বলতে চাইলেও তো শুনতে চাইতিনা। ব্যাপার টা কি হুম? দুলাভাই কি কম ভালোবাসে নাকি?”
অলি রেগেমেগে শায়লার পিঠে চাপড় মেরে বলে,
“এসব কি বলছিস? আমি তো এমনিতেই জানতে চাইলাম”
“হুম সেটাই ভালো। আগে ভেবেছিলাম তোকে ভাবী বানাবো কিন্তু তুই তো বিয়ে করবিনা বলে আমার ভাইয়ের বিষয়ে কিছু শুনতেই চাইতিনা। এখন সেই তুই-ই কলেজে ওঠার আগে বিয়ে করে বসে আছিস।”
“বললাম তো সবকিছু হঠাৎ করেই হয়ে গেছে”
“এই দাড়া তোর মা বাবা কি তোকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে নাকি?”
অলি ভীষণ বিরক্ত হলো। মাথা নাড়িয়ে না বললো,
“আমি নিজে থেকেই বিয়ে করেছি।”
“বিশ্বাস হচ্ছেনা”
“না হলে নাই। তোর ভাইয়ের নামটা বলবি কিনা বল?”
শায়লা মুখে হাসি টেনে বললো,
“অবশ্যই বলবো। দেরিতে হলেও যে তুই আমার ভাইয়ের সম্পর্কে জানতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিস সেটাই অনেক। আমার ভাইয়ের নাম হলো শায়িফুল রহমান রিফাত”
নামটা শুনে অলি কিছুক্ষণ ঠায় বসে রইলো। কয়েক সেকেন্ড পার হতেই সে বার কয়েক নামটা আওড়ালো,
“রিফাত?”
মুহূর্তেই চারপাশের শব্দ, আলো, বাতাস—সব যেন স্থবির হয়ে গেলো। অলির মনের মাঝে এক গভীর স্তব্ধতা নেমে এলো। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে ভাবলো—নাম একই হলেও মানুষ তো আলাদা হতেই পারে। নিশ্চিত না হয়ে কিছু ভাবা ঠিক না। অলির ভাবনার মাঝেই শায়লা অলির বাহু ঝাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কিরে স্ট্যাচু হয়ে গেলি কেনো? বাড়িতে যাবিনা?”
অলির কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সে বাম হাতে কপাল মুছে চারপাশে তাকালো। দুপুরের রোদ জানালার ফাঁক গলে কমন রুমের এক কোণে ছড়িয়ে পড়েছে। অলি সমস্ত চিন্তা এক পাশে সরিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
“শায়লা আগামী কালকে দেখা হবে আমি বাড়িতে গেলাম কেমন?”
শায়লা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। অলি দ্রুতপায়ে স্কুল থেকে বেরিয়ে বাড়ির পথে হাটা ধরলো। স্কুল থেকে বাড়ির দুরত্ব বেশি নয়। তাই সে হেটেই যাতায়াত করে। কয়েকদিন আগে আসমা বানু স্কুলে এসে একবার অলির অসুস্থতার কথা জানিয়ে গিয়েছিলেন। সেইজন্য স্যার ম্যাডামেরা অলির অনুপস্থিতির কারণ জানতে চায়নি আর অলিও শায়লাকে ছাড়া আর কাউকেই বিয়ের ব্যাপারে কিছুই বলেনি। অলি আনমনে হাটছে তার মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, এমন সময় সে উচ্চস্বরে গাড়ির সাইরেন শুনতে পেলো। অলি ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই রেড লাইটের তীক্ষ্ণ আলোয় তার চোখ বন্ধ হয়ে যায়। ঘটনার আকষ্মিকতায় অলি নিজের জায়গা থেকে নড়তেও ভুলে গেছে।
“আ,,,,হহহহহ”
তৎক্ষনাৎ সে কারো উষ্ণ আলিঙ্গন অনুভব করলো। একজোড়া পেশিবহুল শক্ত হাত তাকে জড়িয়ে ধরে রাস্তার অন্যপ্রান্তে এনে দাড় করালো। অলি তো এখনো চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে রেখেছে,
“চোখ মেলুন মিস, আপনি সম্পূর্ণভাবে সুরক্ষিত আছেন।”
অলি পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়, সামনে থাকা পুরুষটি তীর্যক হেসে বলে ওঠে,
“হ্যালো মিস?”
অলি পুরোপুরি ভাবে চোখ মেলে তাকালো। সে কিছুটা আনকম্ফোর্টেবল ফিল করছে। তবে ভদ্রতার খাতিরে হাল্কা হেসে মাথা খানিকটা ঝুকিয়ে বললো,
“আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমাকে বাচানোর জন্য”
“ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম, তবে এরপর থেকে রাস্তাঘাটে একটু সাবধানে চলাফেরা করবেন।”
অলি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো। তখনই সামনে থাকা লোকটার ফোন বেজে ওঠে, লোকটি ব্যস্ত হাতে পকেট থেকে ফোনটা বের করলো। স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নম্বরটির দিকে চোখ বুলিয়ে একটা বিরক্তির শ্বাস ফেলে অলির দিকে তাকালো। অলি লোকটির ঘাড়ে থাকা একটা ফ্লাওয়ার ট্যাটুর দিকে তাকিয়ে ছিলো ট্যাটুটা একটু অদ্ভুত টাইপের দেখতে তবে সুন্দর।
“এক্সকিউজ মি”
অলির ধ্যান ভাঙ্গে—একটু সরে দাড়াতেই লোকটা অলিকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। অলি নিজের উপর ভীষণ রেগে গেছে। আজকাল সে ঠিকভাবে চলাফেরাও করতে পারেনা। বিপদ যেনো তাকে তাড়া করে বেড়ায়।
“নাহ আমার একটু কেয়ারফুলি ওয়াক করা উচিৎ”
কথাটা মনে মনে আওড়াতেই আলভীর কথা মনে পড়ে যায়, মূহুর্তেই অলির মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আলভীর কেয়ারিং গুলোকে সে বড্ড মিস করছে, এই সময় আলভী থাকলে নিশ্চয়ই বলতো,
“অলি ইউ আর প্রেগন্যান্ট কান্ট ইউ ওয়াক কেয়ারফুলি?”
অলি ঠোঁট চেপে নিচের দিকে তাকাতেই কিছু একটা পড়ে থাকতে দেখলো। অলি কৌতুহল বশত সেটা কুড়িয়ে নিলো।
“এটা আবার কি?”
অলি হাতে থাকা বস্তুটির দিকে ভালো করে চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারলো এটা একটা স্টুডেন্ট আইডি কার্ড।
“আরে লোকটা তো নিজের আইডি কার্ড ফেলেই চলে গেছে”
অলি লোকটার খোঁজে পেছনে ফিরে তাকালো কিন্তু রাস্তা তখন প্রায় ফাঁকা—লোকটার কোনো চিহ্নও নেই সেখানে।
“ধ্যাত লোকটা তো চলেই গেছে”
অলি আবারও কার্ডটায় চোখ রাখে। ধীরে ধীরে ঠোঁট নাড়ায়, কার্ডে লেখা নামটা অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করে—
“এনামুল হক নোমান”
চলবে,,,
শব্দসংখ্যা- ২৬৫০+
#১৫_বছর_বয়সী_মা (২৩ ও ২৪)
#সোফিয়া_সাফা
যত দূরে যেতে চাও
ভেসে চলে যাও এই মনেরি ছায়ায়
রবে তোমাকে ঘিরে তুমি আসবেই ফিরে
এই মনেরি মায়ায়
এত কিছু বোঝো আর মন বোঝো না
কত কিছু তুমি খোজো—আমায় তো খোজো না
হুম আমি দুহাত বারিয়ে আছি দারিয়ে
বিরহী প্রতিক্ষন
তুমি রাঙা চরনে আমার সিথানে
এসে দাড়াও কখন
এত কিছু বোঝো আর মন বোঝো না
কত কিছু তুমি খোজো—আমায় তো খোজো না
ফোনের স্ক্রিনের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে গান গাইছে আলভী, একহাতে ফোন আরেক হাতে অলির সেই নূপুরটা। চুলগুলো এলোমেলো চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ, সে তাকিয়ে আছে অলির ছবির দিকে যেগুলো গত কালকেই ক্যামেরাম্যান তাকে সেন্ড করেছে। তার ফোনের স্ক্রিনের অবস্থা খারাপ গত একসপ্তাহে অগণিত বার সে ফোনটাকে আছাড় মে*রেছে।
“কেনো যে আমার কথা ওর মনে পড়েনা সেটাই বুঝিনা। আর আমারই বা ওর কথা এতোবেশি কেনো মনে পড়ে? সব বোঝে শুধু আমাকেই বোঝেনা।”
আলভী অন্য জগতে ছিলো ঠিক তখনই কেউ তার দরজায় নক করে। আলভীর বিরক্তিটা যেন আরো বেড়ে গেলো। অনবরত কেউ দরজা ধাকাচ্ছে, অগত্যা আলভী উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলো।
দরজা খুলে রূপসাকে দেখে আলভী একটা তপ্ত শ্বাস ছাড়লো। গত একসপ্তাহ ধরে রূপসা একটু বেশিই তার রুমে আসে। কখনো খাবার খেতে ডাকতে তো কখনো পড়া বুঝে নিতে,
“ভাইয়া আসলে আমি একটা চ্যাপ্টার বুঝতে পারছিনা”
রূপসা জিওগ্রাফির বইটা আলভীর দিকে এগিয়ে দিতেই আলভী বলে ওঠে,
“রূপ তুই হয়তো ভুলে যাচ্ছিস যে আমি সাইন্স নিয়ে পড়েছি”
আলভীর নিরস প্রাণহীন কন্ঠে রূপসা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো সে ইংরেজি বই আনতে গিয়ে ভুল করে জিওগ্রাফি বইটা নিয়েই চলে এসেছে। তবুও কিছু তো একটা বলতে হবে,
“তুমি একটু দেখোনা। আমার এই সাবজেক্টেই প্রবলেম হচ্ছে”
আলভী কিছুক্ষণ ভেবে বললো,
“তুই হেল্পের জন্য ইয়াদের কাছে যেতে পারিস। ও আর তুই তো একই ডিপার্টমেন্টে, ও স্টাডিতেও অনেক ভালো”
রূপসা একটা বিরক্তি সূচক শব্দ উচ্চারণ করে বললো,
“ও বাড়িতে নেই। বন্ধুদের সাথে ক্যারাম খেলতে গেছে”
আলভী আর কি বলবে? সে দরজা থেকে সরে দাড়াতেই রূপসা দ্রুতপায়ে রুমের মধ্যে ঢুকে যায়। আলভী দরজা পুরোপুরি খোলা রেখে স্টাডি টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলো। ধূসর ফ্রেমের চশমাটা চোখে দিয়ে বইটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কোনটা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে?”
রূপসা আলভীর দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমি AV রেডিয়েশন সম্পর্কে বুঝতে পারছিনা”
রূপসার কথা শুনে আলভী ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো।
“হোয়াট ডু ইউ মিন বায় AV রেডিয়েশন?”
রূপসা কিছুটা ভড়কে গেলো,
“স্যরি UV radiation না বলে AV radiation বলে ফেলেছি”
“ওহ আমি একমূহুর্তের জন্য ভাবলাম তুই হয়তো AV রেডিয়েশন থেরাপির কথা বলছিস”
“সেটা আবার কি?”
আলভী বইটা টেবিলের উপর রেখে সিরিয়াস ভঙ্গিমায় বললো,
“AV রেডিয়েশন একটা থেরাপি যেটা AVM—মানে Arteriovenous Malformation-এর চিকিৎসায় ব্যবহার হয়। এটা একধরনের জন্মগত সমস্যা, যেখানে মস্তিষ্ক বা শরীরের অন্য কোথাও ধমনী আর শিরার সংযোগটা স্বাভাবিক না হয়ে জট পাকিয়ে যায়। ফলে রক্তপ্রবাহ ঠিকমতো হয় না, এমনকি রক্তক্ষরণ বা স্ট্রোকের মতো বিপদও হতে পারে।”
আলভী থামে, রূপসার গলা শুকিয়ে এলো। রূপসার চোখমুখের অভিব্যক্তি দেখে আলভী আবারও বলে ওঠে,
“এই সমস্যার চিকিৎসায় কখনো কখনো অস্ত্রোপচার করা হয়, আবার কিছু ক্ষেত্রে এমন জায়গায় হলে—যেখানে অপারেশন ঝুঁকিপূর্ণ—তখন সেই AVM-এ খুব নির্দিষ্টভাবে রেডিয়েশন পাঠানো হয়। একে বলে স্টেরিওট্যাকটিক রেডিওসার্জারি। এই রেডিয়েশন ধীরে ধীরে অস্বাভাবিক রক্তনালিটাকে শুকিয়ে দেয় বা ব্লক করে ফেলে।”
রূপসা ফ্যালফ্যাল চোখে আলভীর দিকেই তাকিয়ে আছে, আলভী পুনরায় বইটা হাতে নিয়ে বললো,
“বুঝলি? তবে এই টার্মটা খুব সাধারণ নয়, তাই তুই বলাতে আমি একটু থমকে গিয়েছিলাম।”
রূপসা একটা ঢোক গিলে বললো,
“এসব তুমি আমাকে শোনাচ্ছো কেনো? এসব জেনে আমি কি করবো?”
“কারণ তোর UV radiation কে ভুল করে AV radiation বলাটা তো কো-ইনসিডেন্স নাও হতে পারে। আমার তো মনে হচ্ছে তোর একজন নিউরোলজিস্টের কাছে যাওয়া উচিৎ তোর AVM আছে কিনা একবার টেস্ট করিয়ে আসবি”
রূপসা হতভম্ব হয়ে গেছে। আলভী শান্তকন্ঠে বলে ওঠে,
“আমার বিয়ে হয়ে গেছে রূপ এই কথাটা যত তারাতাড়ি মেনে নিতে পারবি ততোই তোর জন্য ভালো হবে। কিছুদিন পর ফুপি হতে চলেছিস সেটা অন্তত মাথায় রাখ অবশ্য তোর AVM রোগটা থাকলে তোর মাথায় রাখতে সমস্যা হবে। যদি সেরকম সমস্যা হয় আমাকে বলিস আমি তোর জন্য একজন ভালো নিউরোলজিস্ট সাজেস্ট করে দেবো”
আলভীর খাপছাড়া কথাটা শুনে রূপসা বসা থেকে উঠে দাড়ালো।
“তার মানে,,,
রূপসা নিজের কন্ঠে কম্পন অনুভব করলো। নিজেকে ধাতস্থ করে বলতে লাগলো,
“তার মানে তুমি আমার ফিলিংস সম্পর্কে জানো?”
“হুইচ ফিলিং আর ইউ টকিং এবাউট?”
রূপসার চোখদুটো ছলছল করে উঠলো,
“ভাইয়ের প্রতি সেসব ফিলিংস থাকবেই বা কেনো তোর? ছোটবেলা থেকে এইপর্যন্ত তোকে আর ঊর্মিলাকে কখনো আলাদা করে ভাবিনি আমি”
আলভীর সোজাসাপ্টা কথা শুনে রূপসার চোখ বেয়ে একফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পড়লো—ভাঙ্গাকন্ঠে বললো,
“কিন্তু এভি,,,তুমি তো আমার আপন ভাই নও।”
আলভী বিস্মিত চোখে রূপসার দিকে তাকালো,
“আপন ভাই নই তো কি হয়েছে? ক্লিয়ার করে বলছি—তোর প্রতি বোন ব্যতিত আমার অন্য কোনো ফিলিংস নেই। আজ এইমূহুর্ত থেকে আমাকে নিজের আপন ভাই ভাববি।”
রূপসা দুপা পিছিয়ে গেলো, আলভী এখনো পূর্বের ন্যায়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে আছে।
“আমি তোমাকে কক্ষনো নিজের আপন ভাই ভাবতে পারবোনা এভি”
“স্টপ রূপ, বড় ভাই হই তোর। AV বলে ডাকছিস কেনো? তুই যা এখান থেকে। আমার হেডেক বাড়াস না এমনিতেই মন মেজাজ ভালো নেই”
“তুমি আমার ফিলিংস সম্পর্কে জেনেও এতোদিন পর্যন্ত আমাকে ইগনোর করে গেছো?”
আলভী একটা শ্বাস ফেলে বললো,
“সত্যি বলতে আমি আগে থেকে জানতাম না। তবে তোর আচরণ গুলো বরাবরই আমার কাছে অদ্ভুত আর বিরক্তিকর লাগতো। তবুও বোন ভেবে কিছুই বলিনি। সেদিন—যেদিন মা তোর আর আমার বিয়ের ইচ্ছাটা সবাইকে জানিয়েছিলো সেদিনই আমি আমার প্রতি তোর ফিলিংস সম্পর্কে সিওর হয়েছি। তবে বিশ্বাস কর এই সম্পর্কে জেনে আমি অনেক পিস্’ড হয়েছি। সত্যি বলতে আমি এখনো তোর ফিলিংস গুলোকে ইমাজিন ও করতে চাইনা।”
ঊর্মিলা হঠাৎ চোখ মুছে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
“আসলে কি জানোতো কেউ খুব সহজে কিছু পেয়ে গেলে সেটার মূল্যায়ন করেনা।,,,
রূপসা আচমকা আলভীর দিকে এগিয়ে গেলো,
“তুমি ইমাজিন ও করতে পারবেনা ভার্সিটিতে আমার পেছনে কতোগুলো ছেলে ঘুরঘুর করে। শুধুমাত্র আমার একটা ইশারার অপেক্ষায় আছে। সেখানে আমি একজন বিবাহিত পুরুষের প্রতি ভালোবাসা অনুভব করছি এটাকে তুমি কি বলবে? হাহ তুমি সত্যিই আমার ভালোবাসাটা কে ইমাজিন করতে চাইলেও—পারবেনা এভি”
রূপসার চোখদুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। আলভী বসা থেকে দাঁড়িয়ে শান্তকন্ঠে বললো,
“প্লিজ রূপ এসব বলে আমাকে দ্বিধায় ফেলিস না। আমার ভালো লাগেনা এসব শুনতে।”
রূপসা চিল্লিয়ে ওঠে,
“হাহ আমার ফিলিংসের কথা শুনতে তোমার ভালো লাগেনা? কি ভালো লাগে তোমার—ওই অলি নামের থার্ড ক্লাস মেয়েটার বকবক শুনতে ভালো লাগে? ওর ন্যাকামি গুলো দেখতে খুব ভালো লাগে তাইনা? সত্যি বলতে তোমার পছন্দ যে এতো সস্তা আর নিম্নমানের সেটা আমিও ইমাজিন করতে,,,
রূপসার কথা শেষ হওয়ার আগেই আলভী রূপসাকে থাপ্পড় মারতে উদ্যত হয়। ফলস্বরূপ রূপসা চোখ খিচে বন্ধ করে নেয় কিন্তু আলভীর হাত রূপসার গাল স্পর্শ করার আগেই কেউ একজন আলভীর হাত ধরে ফেলে। আলভী ঘাড় ঘুরিয়ে ইয়াদকে দেখলো, আলভীর মাথা ঠিক নেই। রূপসার কথাগুলো তাকে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য বানিয়ে দিয়েছে,
“হাত ছাড় ইয়াদ ওর সাহস হয় কি করে আমার বউকে নিয়ে আজেবাজে মন্তব্য করার”
আলভী রাগে ফুসছে, ফর্সা চেহারা রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। ইয়াদ আলভীর হাতটা ছেড়ে দিলো তারপর রূপসার দিকে একবার রাগীদৃষ্টি নিক্ষেপ করে আলভীর উদ্দেশ্যে বললো,
“ভাইয়া ও পা*গল হয়ে গেছে, ওর কথা ধরোনা প্লিজ। ফুপি আপনার মেয়েকে নিয়ে যান এখান থেকে”
ইয়াদের কথা শুনে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রুনা খাতুন আর শাহানাজ বেগম রুমের ভেতর প্রবেশ করলেন। আলভী একবার শান্তচোখে তাদের দিকে তাকায় কিন্তু মুখে কিছুই বলেনা। রাগে তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে, দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সংবরণ করার পুরোপুরি চেষ্টা করছে। রুনা খাতুন বিনাবাক্যে রূপসাকে নিয়ে রুম থেকে প্রস্থান করলেন। এখন রুমে শুধু আলভী, ইয়াদ আর শাহানাজ বেগম আছে।
“এটা তুই ঠিক করিসনি এভি, রূপ তো ভুল কিছু বলেনি। মেয়েটার মধ্যে কি এমন দেখেছিস যে,,,
“স্টপ মা। তোমার জন্যই রূপসা আজকে আমার সামনে দাঁড়িয়ে এতকিছু বলার সাহস পেয়েছে।”
“হুম ঠিকই বলেছিস সত্য কথা বলতে অনেক সাহসের প্রয়োজন। রূপ আজকে অনেক সাহস দেখিয়ে ফেলেছে”
“মাহ,,,তোমরা কেনো এভাবে বলছো?”
শাহানাজ বেগম মুখে কিছু না বলে নিজের ফোনটা বের করে কিছু একটা খুঁজতে লাগলেন, ইয়াদ চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আলভী ইয়াদকে জিজ্ঞেস করলো,
“তুই নাকি বন্ধুদের সাথে ক্যারাম খেলতে গিয়েছিস,”
ইয়াদ নিচুস্বরে বললো,
“গিয়েছিলাম কিন্তু,,,কিন্তু কিছুটা দূর যেতেই ফিরে আসতে হলো,”
আলভী আরও কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে তার আগেই শাহানাজ বেগম একটা ছবি বের করে আলভীর সামনে ধরলো। ছবিটা দেখামাত্রই আলভী থমকে গেছে, দ্রুতহাতে ফোনটা হাতে নিয়ে সে ছবিটা ভালো করে দেখতে লাগলো,
“দেখ তোর প্রানপ্রিয় বউ পরীক্ষা দেওয়ার নাম করে বাপের বাড়িতে গিয়ে প্রেমিকের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে! ছ্যাহ! এই মেয়ের মতো ধড়িবাজ মেয়ে আমি জীবনে দেখিনি। স্বামী সংসার রেখে পরপুরুষের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে—এমন মেয়েরা সমাজের কলঙ্ক।”
কথাগুলো যেন আলভীর কর্ণগহ্বরে পৌছালো না। ছবিগুলো দেখা মাত্রই তার চারপাশের সবকিছু স্তব্ধ হয়ে গেছে। ছবিতে পরিষ্কার ভাবে দেখা যাচ্ছে যে একটা ছেলে অলির কোমড় চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আর অলিও ছেলেটির শার্টের পেছনের অংশ খামচে ধরে আছে। আলভীর গলা শুকিয়ে এলো তাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শাহানাজ বেগম আলভীর হাত থেকে ফোনটা নিয়ে আরও ২টো ছবি বের করে দেখালো, একটা ছবিতে—অলি মাথা নিচু করে ছেলেটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আর ছেলেটা গভীর চোখে অলিকে দেখছে। অন্যটাতে অলি হাসিমুখে ছেলেটাকে কিছু বলছে আর ছেলেটার ঠোঁটের কোণেও হাসি লেগে আছে। কি সুন্দর ফটোগ্রাফি যেন অলি আর ছেলেটা কোনো দক্ষ ফটোগ্রাফার দ্বারা ছবিগুলো তুলিয়েছে। নীরবতা ভেঙ্গে আলভী প্রশ্ন ছুড়লো,
“ছবিগুলো কে পাঠিয়েছে?”
আলভীর কথার ধরন দেখেই ইয়াদ আর শাহানাজ বেগম বুঝতে পারলো যে কিছুক্ষণ পরই আলভীর রাগ বিস্ফোরিত হবে। ইয়াদ একটা শুষ্ক ঢোক গিলে বললো,
“জানিনা ভাইয়া কে পাঠিয়েছে, আমি বাড়ি থেকে বের হওয়া মাত্রই একটা আননোন নম্বর থেকে হোয়াটসঅ্যাপে ছবিগুলো পাঠিয়েছে। আমি সেই নম্বরে সাথে সাথেই কল দিয়েছিলাম কিন্তু নট রিচেবেল বলেছে। আমি তৎক্ষনাৎ বাড়িতে ফিরে আসি আর এসে দেখি বাড়ির প্রত্যেকের ফোনেই ছবিগুলো পাঠানো হয়ে গেছে”
“এই মেয়ে কোথায় কোথায় যে আকাম করে বেরিয়েছে কে জানে। আমি বুঝতেই পারছিনা এইটুকুন একটা মেয়ে কিভাবে পারে এতো গুলো ছেলেকে নিয়ন্ত্রণ করতে? আলভী তুই সিওর তো যে ওই চরিত্রহীনার পেটে তোর সন্তান?”
কথাটা যেনো ধনুক থেকে ছোরা তীরের ন্যায়ে আলভীর বক্ষে বিধে যায়। সে অগ্নি ঝরা কন্ঠে বলে ওঠে,
“ইফ এনিওয়ান ইভেন থিংকস অ্যাবাউট সেইং দ্যাট অ্যাগেইন, দে’ইল রিগ্রেট ইট। মাইন্ড ইট”
এই প্রথম আলভী নিজের মায়ের সাথে এই টোনে কথা বলেছে—শাহানাজ বেগম হতভম্ব হয়ে গেলেন। তখনই ঊর্মিলা ফোন হাতে রুমে ঢোকে কিছুক্ষণ আগেই সে ফোনটা হাতে নিয়েছিলো। অলির ছবিগুলো তার ফোনেও পাঠানো হয়েছে,
“ভাইয়া অলির সাথের ছেলেটা কে?”
“জাস্ট শাট আপ। এখান থেকে যাও সবাই”
শাহানাজ বেগম মুখ ভার করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। ইয়াদ সান্ত্বনা দিতে এগিয়ে আসলে আলভী হাত উচিয়ে না বলে। রাগে তার ইচ্ছা করছে আগুন জ্বালিয়ে দিতে—আলভী আশেপাশে তাকিয়ে ভাঙ্গার জন্য কিছু খুজতে লাগলো কিন্তু কিছুই পেলোনা একসপ্তাহ যাবত ভাঙ্গচুর করার কারণে এখন আর তার রুমে ফার্নিচার ছাড়া ভাঙ্গার মতো কিছুই অবশিষ্ট নেই। আলভী রাগ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নিজের চুল টানতে লাগলো ঊর্মিলা দুপা এগিয়ে এসে বললো,
“ভাইয়া প্লিজ তুই না জেনেই অলিকে অবিশ্বাস করিসনা। লোকটা অলির পরিচিত বা আত্মীয় ও তো হতে,,,
ইয়াদও ঊর্মিলার সাথে তাল মিলিয়ে বললো,
“হুম ঊর্মি একদম ঠিক বলেছে। তুমি আগে সিওর হয়ে নেও। ছেলেটা ভাবীর বন্ধুও তো হতে পারে, এখনকার দিনে ছেলেমেয়ের মধ্যেও বন্ধুত্ব হয় ভাইয়া এসব এখন কমন ব্যাপার”
ইয়াদ তো অন্যদিকে তাকিয়েই কথাগুলো বলছিলো ঊর্মিলা ইশারায় ইয়াদকে চুপ করতে বলে কিন্তু ইয়াদ তো ননস্টপ বলেই যাচ্ছে হঠাৎ করেই আলভী ইয়াদের শার্টের কলার খামচে ধরে হিসহিসিয়ে বললো,
“এই সমস্ত কথা দ্বিতীয়বার বললে আমি ভুলে যাবো যে তোর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক আছে। শি’জ মাইন অ্যান্ড মাইন অনলি। ইফ এনিওয়ান ইভেন ট্রাইজ টু কাম বিটুইন আস, আই’ল ডেস্ট্রয় দেম।”
আলভী অনেক শক্ত করেই ইয়াদের কলার ধরেছে ইয়াদ ছাড়ানোর চেষ্টা করলেও আলভী ছাড়েনা। শেষমেষ ঊর্মিলা এগিয়ে আসে ইয়াদকে ছাড়াতে,
“ভাইয়া ইয়াদ ভাইয়াকে ছাড় প্লিজ। ও ভুল করে বলে ফেলেছে, ও উল্টো পাল্টা কিছু মিন করেনি। প্লিজ ছাড় ওকে”
আলভী ছেড়ে দিতেই ইয়াদ মাথা নিচু করে বলে ওঠে,
“স্যরি ভাইয়া”
কথাটা বলেই ইয়াদ রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। ইয়াদের পিছুপিছু ঊর্মিলাও চলে যায়।
আলভী একমূহুর্ত দাড়িয়ে থেকে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। দরজা টা লক করে দিয়ে দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেলো বেডের দিকে,
“মাই লিটল হানি’বি, এসব যদি সত্যি হয়না আমি তোকে নিজের হাতে খু*ন করবো”
আলভী বেড থেকে ফোনটা তুলে তার পিএ সোহেলকে কল দিলো। কয়েকবার রিং হতেই সোহেল কল রিসিভ করে,
“হ্যালো সোহেল কিছু ফটো সেন্ড করছি একজন ফটোগ্রাফার স্পেশালিষ্টকে দিয়ে ছবিগুলো পর্যবেক্ষণ করাবে। আর একটা কথা ছবিগুলো যেনো কোনোভাবে লিক না হয়”
“জ্বি স্যার, আপনি ছবিগুলো পাঠিয়ে দিন”
(২৪)
রাত্রী ১০ টা অলি ডিনার করে সবেমাত্র রুমে এসেছে। আগামী কালকে তার ম্যাথ পরিক্ষা। অলি এগিয়ে গেলো পড়ার টেবিলের দিকে উদ্দেশ্য সূত্রগুলো একটু রিভিশন দেবে, অলি হাত বাড়িয়ে বইটা নিতে যাবে তখনই সেই স্টুডেন্ট আইডি কার্ডটা তার নজরে আসে,
“উফস আমি তো এটার কথা একেবারে ভুলেই গিয়েছিলাম। লোকটা হয়তো এটা খুঁজে না পেয়ে অনেক দুশ্চিন্তায় আছে।”
অলি আইডি কার্ডটা হাতে নিয়ে ফোন নম্বর খুজতে লাগলো একসময় পেয়েও গেলো,
“আবারও ভুলে যাওয়ার আগে লোকটাকে কল করে বলে দেই যে এটা আমি কুড়িয়ে এনেছি”
অলি টেবিলের সাইডে রাখা ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে নম্বরটা ডায়াল করলো। কিছুক্ষণ যেতেই অপরপ্রান্ত থেকে কল রিসিভ হলো,
“হ্যালো আসসালামু আলাইকুম”
অপরপ্রান্ত থেকে ভেসে এলো একটা গম্ভীর পুরুষালী কন্ঠ,
“ওয়ালাইকুম আসসালাম, কে বলছেন?”
অলি কিছু সময় চুপ থেকে বললো,
“আপনি কি এনামুল হক নোমান বলছেন?”
“জ্বি আমিই নোমান বলছি। আপনি কে বলছেন?”
“আ,,,আসলে আজকে দুপুরবেলা আপনি আমাকে সাহায্য করেছিলেন।”
অপরপ্রান্ত থেকে কোনো উত্তর এলোনা। কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করার পর নোমান বললো,
“আপনি আমার নম্বর কোথায় পেলেন মিস?”
“আপনার স্টুডেন্ট আইডি কার্ডটা আপনি ভুলবশত ফেলে গিয়েছিলেন আমি কুড়িয়ে নিয়েছিলাম। ভাবলাম আপনার জন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে তাই সেখান থেকে নম্বর নিয়েই কল করেছি।”
কথাটা শুনে নোমান বেশ খুশি হলো বলেই মনে হচ্ছে,
“থ্যাংকস গড, আপনি ভাবতেও পারবেন না ওটা আমার জন্য কতো বেশি ইম্পোর্ট্যান্ট কোথায় কোথায় খুজিনি আমি। আহ থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ”
অলি খুশিই হলো যাক লোকটার একটু উপকার সেও করতে পেরেছে। এটা ভেবেই ভালো লাগছে,
“আমি আগামীকালকে এক্সাম শেষে সেই জায়গাতেই অপেক্ষা করবো আপনি এসে নিয়ে যাইয়েন।”
নোমানের হাসি থেমে গেলো। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল,
“আসলে মিস আমি তো শহরের বাইরে একটা কাজে এসেছি। আপনি কি কষ্ট করে কয়েকটা দিন কার্ডটা নিজের কাছেই রাখতে পারবেন?”
অলি কিছু বলার আগেই নোমান আবারও বলে ওঠে,
“আসলে আমার নানু মা’রা যাওয়াতে আমি গ্রামে এসেছি। সেইজন্যই বলছিলাম আরকি। তবে আপনার প্রবলেম হলে আমাকে কষ্ট করে হলেও আসতেই হবে”
অলি ভদ্রভাবেই বললো,
“না না সমস্যা হবেনা। আমি বেশ কয়েকটা দিনই আছি এখানে। আপনার নানু মা’রা গিয়েছে তাই আপনার সেখানেই থাকা উচিৎ। আর চিন্তা করবেন না আমি না থাকলেও আমার বাবার কাছে এটা রেখে যাবো সে আপনাকে দিয়ে দেবে”
অলির কথায় লোকটা হাল্কা হাসলো।
“থ্যাঙ্ক ইউ মিস ইউ আর সো সুইট। আ,,,যদি কিছু মনে না করেন আপনার নামটা জানতে পারি?”
অলি এবার কিছুটা আনকম্ফোর্টেবল ফিল করলো। তার কি নাম বলা উচিৎ নাকি উচিৎ নয়? লোকটা তাকে আর তার বেবিকে বাচিয়েছে সেই হিসেবে নাম বলাই যায় তাইনা?
“আমার নাম অলি”
“বাহঃ নামটা অনেক সুন্দর আর আনকমন। বাই দ্য ওয়ে অলি কি ফ্লাওয়ার লাইক করে?”
অলি উত্তর দিতে যাবে তার আগেই আসমা বানু অলির রুমে আসে। মাকে আসতে দেখে অলি কলটা কেটে দিলো।
“কার সাথে কথা বলছিলি অলি, জামাই নাকি?”
“আরে না মা, তোমাকে তো বলাই হয়নি। আজকে কি হয়েছিলো জানো?”
আসমা বানু বিছানায় বসে জিজ্ঞেস করলেন,
“না বললে কিভাবে জানবো?”
“আমার তো মনেই ছিলোনা,,,
এরপর অলি বাড়িতে ফেরার পথের সব ঘটনা মাকে খুলে বললো,
“হ্যাঁ রে অলি দেখেশুনে হাটবি তো নাকি? এতোটা বেখেয়ালি হলে কিভাবে চলবে? এই কথা শোনার পর তো আমি তোকে একা বের হতে দিতে সাহসই পাবোনা”
অলি উঠে গিয়ে মায়ের পাশে বসলো,
“চিন্তা কোরোনা মা। আমি এখন থেকে সাবধানেই চলাফেরা করবো।”
“সবসময় মনে রাখবি তোর সাথে আরেকটা জীবন জড়িয়ে আছে, মা হওয়া এতো সহজ নয় অলি। একটা সন্তানকে নিরাপদ রাখা ভালোভাবে বড় করা, ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা একজন মায়ের দায়িত্ব। একজন সন্তানের জীবনে মা হচ্ছে সসর্বপ্রথম শিক্ষিকা আর রক্ষিকা।”
কথাগুলো শুনে অলির ভালো লাগলো সে মাথা রাখলো মায়ের কোলে,
“আচ্ছা মা আমি তোমার কোলে মাথা রাখলে যতটা শান্তি পাই আমার বাবুটাও কি আমার কোলে মাথা রাখলে ততোটাই শান্তি পাবে?”
অলির এহেন প্রশ্নে আসমা বানু মৃদু হাসলেন।
“হ্যাঁ নিশ্চয়ই পাবে”
আসমা বানু অলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। অলি শান্তিতে চোখজোড়া বন্ধ করে নিলো,
“তোর কি নিজের স্বামীর কথা মনেই পড়েনা? নিজেও তো কল দিতে পারিস নাকি? শুধু মা হলেই চলবে? স্ত্রী হতে হবেনা?”
অলি একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে চোখ মেলে তাকালো,
“আমি বিয়ে করতে চাইনি মা। বাবুর জন্যই বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছি।”
“তুই নাহয় বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছিস ছেলেটা কিন্তু তোকে বাধ্য হয়ে বিয়ে করেনি।”
মায়ের কথায় অলি সোজা হয়ে বসলো। ভ্রু কুচকে শুধালো,
“মানে?”
“মানে ও মন থেকেই তোকে বিয়ে করেছিলো। তুই তো জানিসই যে আমরা আইনের সাহায্যে তাদের কিছুই করতে পারতাম না। তোর কি মনে হয় ছেলেটা সেটা জানতো না?”
“আমি এই বিষয়ে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম উত্তরে সে আমাকে বলেছিলো যে বাবুটার জন্যই নাকি বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলো আমাকে। আর অতোগুলো টাকাও নাকি সেই জন্যই দিয়েছে”
আসমা বানু চমকিত নয়নে তাকায়,
“ও কি সত্যিই বাচ্চাটার জন্যই বিয়ে করতে চেয়েছিলো?”
প্রশ্নটা শুনে অলি ভাবতে লাগলো। তার মনে আছে আলভী একবার তাকে এবোরশন করে নিতেও বলেছিলো। তবে সেই কথাটা অলি আর মাকে বললোনা,
“বাদ দেও মা।”
“অলি এটা বাদ দেওয়ার মতো বিষয় নয়। এভাবে যোগাযোগ বন্ধ রাখলে সম্পর্কে ফাটল ধরবে”
“মা আমি তোমাকে কিভাবে বোঝাবো তার আর আমার মাঝে নামেমাত্র সম্পর্ক আছে, যেটা সে চাইলেও ভাঙ্গতে পারবেনা।”
অলি মনে মনে কথাটা ভাবলো কিন্তু মুখে বললো,
“ভাঙ্গলে ভাঙ্গুক। আমার কিছুই যায় আসেনা। এখন তো আর কেউ আমার বাবুকে অবৈধ বলতে পারবেনা তাইনা?”
আসমা বানু মেয়ের কথায় ভারী অসন্তুষ্ট হলেন,
“তুই তোর স্বামীর পাশে অন্য মেয়েকে সহ্য করতে পারবি? সে অন্য মেয়ের সাথে হাসবে, অন্য মেয়েকে জড়িয়ে ধরবে, অন্য মেয়েকে নিয়ে ভাববে এসব তুই পারবি তো সহ্য করতে?”
কথাটা শুনে একমূহুর্তের জন্য অলি থমকে যায়, কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে সে। হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠলো আলভীর সাথে একটা কাল্পনিক নারী চরিত্র।
“নাহ”
অলি চিৎকার দিয়ে ওঠে,
“নাহ, নাহ, নাহ। উনি পারবেনা উনি পারবেনা। আমি ওনার নামে মা*মলা করবো।”
একমূহুর্ত থেমে নিম্নস্বরে বললো,
“এখন আমার কাছে টাকাও আছে।”
আসমা বানু মৃদু হেসে বললেন,
“মা*মলা করে কি আর স্বামীর মন থেকে সেই নারীকে মুছে ফেলতে পারবি?”
অলি অসহায় চোখে মায়ের দিকে তাকায়।
“আলভী ছেলেটা পূর্বে কেমন ছিলো সেটা আমি জানিনা কিন্তু বর্তমানে সে তোর স্বামী। তোর উচিৎ তাকে সঠিক পথে আনার চেষ্টা করা।”
আসমা বানু কিছুক্ষণ চুপ থেকে অলির মাথায় হাত রাখলেন তার মনে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। তবে সে অলির মা হিসেবে সেই প্রশ্নটা করতে পারছেন না একধরনের জড়তা কাজ করছে কিন্তু তার সেই বিষয়ে জিজ্ঞেস করা উচিৎ,
“অলি আলভী কি তোর সাথে কখনো জোরাজুরি করেছে?”
অলি প্রথমে না বুঝলেও যখন বুঝতে পারে—সে সাথেসাথেই না বোধক মাথা নাড়ে।
“তোর ব্যাবহার দেখে তো মনে হচ্ছে সে তোর সাথে জোরাজুরি করেছে। দেখ সেরকম কিছু হলে বল আমাকে। আগের ঘটনার মতো লুকিয়ে রাখিসনা।”
অলি ফট করেই বলে ফেলে,
“সে আমার সাথে তেমন কিছু কিভাবে করবে মা? আমি তো তার সাথে কখনো একরুমে থাকিই নি”
“কিহ!”
অলি উপরনিচ মাথা নাড়ায়,
“হ্যাঁ মা আমি তাকে বিয়ের আগেই শর্ত দিয়েছিলাম যে আমি আলাদা রুমে থাকবো”
“আর সে তোর সেই শর্ত মেনেও নিলো?”
“হ্যাঁ”
আসমা বানু কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে বলে উঠলেন,
“এতো কিছুর পরেও তোর স্বামীর কথা মনে পড়েনা? সে তোর যত্ন নিয়েছে। তোর উদ্ভট শর্ত মেনে নিয়েছে। কাবিনের কতগুলো টাকা পরিশোধ করেছে। আলভী খারাপ ছেলে হলে কি কক্ষনো এতোকিছু করতো?”
অলি মাথা নিচু করে নিলো। তার মা সত্যিই বলেছে। উল্টো সেই সবসময় আলভীকে আজেবাজে কথা শুনিয়েছে। আসমা বানু যদি বাকি শর্ত গুলোর ব্যাপারে জানতে পারে তাহলে হয়তো তাকে মে*রেই ফেলবে,
“আচ্ছা তুই কখনো এরকম কিছু করেছিস যার জন্য আলভীর তোকে মনে পড়বে?”
অলি নাবোধক মাথা নাড়ায়। আসমা বানু একটা শ্বাস ছেড়ে বললেন,
“বাহ ভালো। ও কতোকিছু করার পরেও তোর ওর কথা মনে পড়ছেনা তোর কি মনে হয় তুই কিছু না করার পরেও ওর তোর কথা মনে পড়বে? আমি নিশ্চিত যে ও তোর কথা ভুলে গেছে, আর সত্যি বলতে মনে রাখার তো কোনো কারণই নেই”
আসমা বানু আর কথা বাড়ালেন না। অলির উপর সে বেশ নারাজ হয়েছেন। আলভী তো চেয়েছিলো ভুল গুলো শুধরে নিতে কিন্তু অলি সেই ভুলগুলোকেই মনের ভেতর আকড়ে ধরে বসে আছে। আলভীকে একটাবার সুযোগও দিয়ে দেখেনি। আসমা বানু শুয়ে পরতেই অলি ফোনটা হাতে তুলে নিলো। মন বলছে আলভীকে কল দিতে, সত্যিই কি আলভী তাকে ভুলে গেছে? অলি মনে প্রচুর সাহস জুগিয়ে কম্পিত হস্তে আলভীর নম্বরটি ডায়াল করলো। তবে তার সমস্ত আশা নিরাশা করে দিয়ে অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এলো নারীকন্ঠ,
**দ্য নাম্বার ইউ হ্যাভ ডায়াল্ড ইজ কারেন্টলি আনরিচেবেল। প্লিজ ট্রাই এগেইন লেটার। থ্যাঙ্ক ইউ।**
এই বিরক্তিকর আওয়াজ টা অলির হার্টবিট বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিলো। তার মনে হচ্ছে খুব খারাপ কিছু হতে চলেছে, বাড়ির অন্য কারো নম্বরও নেই তার কাছে।
,
অন্যদিকে আলভী নিজের হাতে ব্যান্ডেজ প্যাচাচ্ছে। তার সামনেই কাচের টুকরো গুলো মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। রুমের এককোণে পড়ে আছে কিছুক্ষণ আগেই আলভীর রাগের শিকার হয়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাওয়া ফোনটি। আলভী ড্রেসিং টেবিলের ভাঙ্গা আয়নার দিকে তাকিয়ে বললো,
“ইউ হ্যাভ টু পে ফর দিস—পয়জন বি। ইউ’আর নট মাই হানিবি এনিমোর। ফ্রম নাউ অন…ইউ’আর মাই পয়জন বি।”
চলবে,,,
শব্দসংখ্যা- ৩২৫০+