১৫ বছর বয়সী মা পর্ব-২৯+৩০

0
24

#১৫_বছর_বয়সী_মা (২৯)
#সোফিয়া_সাফা

“বাইরে গিয়ে দেখে আসুন আশেপাশে মোট কতোজন আছে।”

নোমান রুম থেকে বেরিয়ে গেলো ১৫ মিনিট পর সবকিছু চেক করে অলির কাছে ফিরে এলো।
“বাইরে বেশি গার্ডস নেই। সবাই ঘুমিয়ে গেছে। কিন্তু মেইন গেটে কয়েকজন গার্ডস আছে।”

অলি ঠোঁট চেপে কিছু একটা ভেবে বললো,
“আপনি কোনোভাবে ওনাদের গেইট থেকে ১মিনিটের জন্য সরাতে পারলেই আমি বেরিয়ে যেতে পারবো”

নোমান চিন্তিত কন্ঠে বলে,
“কিন্তু কোথায় যাবে তুমি?”

“আমি মায়ের কাছে যেতে চাই। আমি নিখোঁজ হওয়ার পর না জানি তাদের কি অবস্থা। আমি প্রথমে বাড়িতে যাবো। সেখানে তাদের না পেলে হসপিটালে যাবো”

নোমান একটা শ্বাস ফেলে বললো,
“তোমার এখন সেখানে যাওয়া উচিৎ হবেনা। তোমাকে না পেলেই এখানের লোকেরা হন্যে হয়ে খোজা শুরু করবে। মির্জা ভিলা এখান থেকে ২০ মিনিটের রাস্তা। তুমি বরং সেখানেই যাও। তাসনীম মির্জার সাথে থাকাটাই তোমার জন্য এখন বেশি সেইফ হবে।”

অলি অবাক চোখে তাকায়,
“আপনি মির্জা ভিলা কিভাবে চেনেন?”

“ডিভোর্স লেটার টা আনার জন্য আমি আজকে সকালেই সেখানে গিয়েছিলাম”

“ডিভোর্স লেটার ওই বাড়ি থেকে এনেছেন?”

নোমান হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ায়,
“কে দিয়েছিলো?”

“আমি জানিনা কে দিয়েছে। আমাকে শুধু লোকেশন দিয়ে বলা হয়েছিলো যে মির্জা ভিলার সামনে থাকা দাড়োয়ানের কাছ থেকে একটা লেটার আনতে হবে। ব্যস আমি শুধু তাদের অর্ডার ফলো করেছি।”

“আপনি তারাতাড়ি যান। আমাদের হাতে বেশি সময় নেই।”

নোমান একটু ইতস্তত করে বলল,
“অলি টাকাগুলো কখন দেবে? দেখো আমার কিন্তু টাকা গুলো অনেক প্রয়োজন।”

“আমি যে করেই হোক ২দিনের মধ্যে আপনার সাথে কন্টাক্ট করবো। তাছাড়া আপনার ফোনে তো আমার নম্বর আছেই।”

“তুমি আমার নম্বর ব্লক করে রেখেছো।”

অলি বেশ বিরক্ত হলো। এখন এসব কথা বলার জন্য তার হাতে সময় নেই।
“আপনাকে বললাম তো আমি নিজে থেকেই আপনার সাথে কন্টাক্ট করবো। বিশ্বাস করুন আমাকে।”

নোমান একটা শ্বাস ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নেবে কিন্তু তার আগেই ফিরে এসে অলির দিকে কিছু টাকা এগিয়ে দেয়। অলি একবার টাকাগুলোর দিকে তাকিয়ে পুনরায় নোমানের দিকে তাকায়। নোমান অন্যদিকে তাকিয়ে বলে,
“এখানে পাচশো টাকা আছে। নিজের কাছে রাখো। আর রাতের আধারে রাস্তা হারিয়ে ফেলোনা যেন। কোথাও লুকিয়ে থেকো। কারণ সকাল হওয়ার আগে কেউ তোমার পালিয়ে যাবার বিষয়ে জানতে পারবেনা। তবে সকাল হতেই একটা ট্যাক্সি নিয়ে মির্জা ভিলায় চলে যেও। আর আমার মনে হয় ওই বাড়িতেও তোমার শত্রু আছে তাই সবসময় চোখ কান খোলা রেখো।”

অলি মাথা নেড়ে টাকাটা নিলো। নোমান সামনের দিকে ঘুরে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। অলিও তাকে অনুসরণ করে হাটা ধরলো। পথিমধ্যেই ২ জন গার্ড সামনে এসে পড়ে। তাদেরকে দেখে অলি দরজার আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। নোমান তাদেরকে অন্য দিকে নিয়ে বলে,
“তোমরা এখানে কি করছো? আমি তো আছি তাইনা। তোমরা নিশ্চিন্তে গিয়ে ঘুমাও। একটা মেয়েকে পাহাড়া দিতে এতোজন লাগে নাকি? তাছাড়া মেয়েটা ঘুমিয়ে গেছে।”

নোমানের কথা শুনে গার্ডস দুটো মাথা নেড়ে চলে যায়। অলির বুকের ভেতর ধুকপুক ধুকপুক করছে। নোমান পেছনে ফিরে ইশারা করতেই অলি আবারও নোমানকে অনুসরণ করতে লাগলো। নোমান দরজার সামনে এসে দেখলো গার্ডসগুলো ভীষণ সতর্কতার সাথেই দরজা পাহাড়া দিচ্ছে। নোমান এগিয়ে গেলো সেইদিকে,
“হ্যালো গাইস। তোমরা পারোও বাবা। একটা মেয়ের জন্য এতো কড়া গার্ডের কি আছে?”

৩জনের মধ্যে একজন বলল,
“আমরা নিজেদের কাজ নিয়ে অনেক সতর্ক। সেখানে বন্দি ছেলে নাকি মেয়ে বা তারা সংখ্যায় কয়জন সেটা আমাদের দেখার বিষয় নয়।”

নোমান বুঝতে পারল শুকনো কথায় চিড়ে ভিজবেনা। সে পকেট থেকে একসেট তা*স বের করলো। যেগুলো মূলত সে স্টোর রুমে পেয়েছিল।
“আমি একা একা বোর হচ্ছি ঘুমও আসছেনা। চলোনা আমরা তা*স খেলি”

নোমানের কথা শুনে ৩জন গার্ডসই একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে।
“আরে ভয় পেওনা মেয়েটাকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া ওর দরজা টাও বাইরে থেকেই লক করা।”

নোমানের কথা শুনে ৩ জনই রাজি হয়ে যায়। সেই ফাকেই নোমান পেছনে ফিরে অলিকে ইশারায় চলে যেতে বলে। অলিও ইশারা বুঝতে পেরে সন্তর্পণে সেখান থেকে বেরিয়ে যায়।

অলি চলে গেছে কিন্তু বেচারা নোমান ফেসে গেছে। সে তো তাসের ‘ত’ ও জানেনা। খেলবে কিভাবে?
“তুমি তো খেলতেই পারছোনা।”

নোমান মিথ্যা মিথ্যা ঘুম আসার বাহানা করে বলে,
“আরে ভাই, আমার তো ঘুম আসছে। সেই জন্যই খেলতে পারছিনা। আপনারা খেলুন আমি বরং ঘুমাতে চলে যাই।”

নোমান কোনো রকম বাহানা দিয়ে ভেতরে চলে গেল।
“এখন নিজে বাচার জন্যও কিছু তো করতে হবে। নইলে ওরা আমাকেই সবার আগে সন্দেহ করবে। কিন্তু কি করবো আমি?”

নোমান কিছুক্ষণ ভাবনা চিন্তা করে ড্রয়ার থেকে একটা ইঞ্জেকশন বের করলো। মূলত এটা ঘুমের ইঞ্জেকশন। অলিকে দেওয়ার জন্যই আনানো হয়েছিল,
“বাচার জন্য এটা করতেই হবে।”

নোমান একটা বড় শ্বাস টেনে নিজের হাতেই ইঞ্জেকশন পুশ করে নিলো।

রিফাত ড্রিংকস করে টাল হয়ে পড়ে আছে। তার সামনে বসে আছে একটা লোক। লোকটাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে সে রিফাতের উপর ভীষণ ক্ষেপে আছে।
“ওই সারাক্ষণ তো খালি এসব গিলেই টাল হয়ে পড়ে থাকিস। কাজের কাজ তো সব আমাকেই করতে হচ্ছে। তুই আছিস কি শুধু আমার কাজে ব্যাগড়া দিতে?”

রিফাত মাতাল কন্ঠেই বলল,
“তুই তুকারি করছিস কেনো?”

“তো তোকে কি বলবো শুনি? তুই মেয়েটাকে অতো কথা বলতে গেলি কেনো হুম? ওকে ওসব জানানোর তো কোনো প্রয়োজন ছিলোনা।”

রিফাত হেসে উঠলো,
“আরে তুই বুঝবিনা। আমি ওকে ওসব বলে মজা পেয়েছি। তাছাড়া কালকেই তো ওর শেষ দিন। বেচারির তো এসব জানার অধিকার আছে তাইনা? এভি তো এতোদিনেও নিজে থেকে মেয়েটাকে কিছুই বলতে পারলোনা। আমি জানি বাকি জীবনেও ও পারতোনা। হাহ সবার সামনে ও হচ্ছে লায়ন বাট ওই মেয়েটার সামনে ভেজা বিড়াল। দেখ, বন্ধু হিসেবে আমার একটা দায়িত্ব আছেনা? আমি ছাড়া ওর সাহায্য আর কে করবে বলতো? এভি এটা জানলে খুশি হবে যে ওর বউটা ম*রার আগে অন্তত সব সত্যিটা জেনেছিলো।”

সামনে বসে থাকা লোকটা রিফাতের কথাগুলো শুনে ভীষণ রেগে যায়,
“দেখ লাস্ট বারের মতো সাবধান করছি তোকে। এভির কখনো যদি সন্দেহ হয়, ও কিন্তু সবার প্রথমে তোকেই সন্দেহ করবে। আর ও যদি কোনোভাবে তুই অবধি পৌঁছে যায় তাহলে তোকে কিন্তু আমরা আমাদের প্ল্যান থেকে বাদ দিয়ে দেবো।”

কথাটা শুনে রিফাত হাসি থামিয়ে দিলো, সামনে থাকা লোকটার দিকে তাকিয়ে বাজখাঁই কন্ঠে বলল,
“ভুলে যাসনা আমিই তোকে নিজেদের দলে নিয়েছিলাম। তোর হাতে আমাকে বাদ দেওয়ার কোনো ক্ষমতাই নেই”

“আমার হাতে নেই তো কি হয়েছে? যার হাতে আছে সেই তোকে বাদ দিয়ে দেবে। কারণ টা তুই ভালো করেই জানিস। ওনার কাছে বর্তমানে তোর থেকে আমার মূল্যটা বেশি”

রিফাতের মুখটা চুপসে গেল। সে জানে যে লোকটা সঠিক কথাই বলেছে। লোকটা কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করে বলে,
“অলি তোকে চিনতে পেরেছে নাকি?”

রিফাত নিশ্চিন্তমনে বলে,
“নাহ, ও আমাকে চিনবে কিভাবে? আমি তো ওকে নিজের পরিচয় দেইনি। তাছাড়া ওর সাথে আমার শুধু একবারই সামনা সামনি কথা হয়েছিল।”

“যাক ভালো হয়েছে। এমনিতেও কালকে তো ওর আখেরি দিন। ও উপরে চলে যাওয়া মাত্রই আমার রাস্তা ক্লিয়ার”

অলি যতই সামনে এগোচ্ছে তার ভেতরে থাকা ভয়টা ততই বাড়ছে। চারদিকের ঘুটঘুটে অন্ধকারে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। অলি কিছুটা দূরে একটা বাড়ি দেখতে পায়। বাড়িটায় আলো জ্বলছে। কিন্তু অলি সেই বাড়ির দিকে না গিয়ে উল্টো দিকে হাটা ধরে।
“পৃথিবীতে সবচাইতে ভয়ঙ্কর নির্দয় প্রানী হচ্ছে মানুষ। ওই বাড়িতে খারাপ লোকও তো থাকতে পারে। সেখানে গেলে উল্টো বিপদে পড়তে পারি।”

অলি আরও কিছুক্ষণ হাঁটল। পা এখনো এগোতে চাইছে, অথচ শরীর বারণ করছে। একসময় সে এসে দাঁড়াল এক ফাঁকা রাস্তার ধারে। চারপাশে নিস্তব্ধতা, মাথার ওপর উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দু’পাশের ল্যাম্পপোস্টগুলো—হালকা কমলা আলো ছড়িয়ে দিয়েছে রাস্তার পিচ ঢালা বুকজুড়ে।

রাস্তার ওপাশে চোখ পড়তেই অলি থমকে গেল।
একটা মসজিদ।
নির্জন রাতে দাঁড়িয়ে থাকা একটুকরো শান্তির কেল্লা যেন।

ওর পা যেন মুহূর্তেই অবশ হয়ে এল। ক্লান্তিতে বা ভয়ে না। হয়তো ভেতরের সেই দম বন্ধ করে আসা চাপ থেকে। আর এক পা-ও যেন তোলা যাচ্ছে না। তবুও, ধীরে ধীরে এগোতে লাগল সে—সেই মসজিদের দিকে। মসজিদের পাশে গিয়ে জানালার পর্দাটা একটু সরিয়ে উঁকি দিল। ভেতরে আলো কম, কিন্তু জ্যোৎস্নার মতো এক শান্ত আভা ছড়িয়ে আছে।একজন বৃদ্ধ লোক কিবলার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন—তাহাজ্জুদের নামাজে নিমগ্ন। তাঁর কপাল মাটিতে, ঠোঁটে নিঃশব্দ কোরআনের আয়াত। এই দৃশ্য দেখে অলির বুক থেকে যেন ভার নেমে গেল। সে ধীরে এক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মনে হলো, অনেকদিন পর বাতাসে একটু অক্সিজেন আছে।
“আর যাই হোক, খারাপ লোকেরা মসজিদের ধারে কাছেও আসবে না। এই ব্যাপারে আমি নিশ্চিন্ত,”

মসজিদের উঠানে পা রাখতেই এক অদ্ভুত শীতলতা ছড়িয়ে পড়ল অলির সমস্ত শরীর জুড়ে। যেন পায়ের নিচের টাইলসে জমে থাকা রাতের শিশির সরাসরি ওর হৃদয় ছুঁয়ে গেল। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত অলি ধীরে ধীরে একটা দেয়ালের পাশে গিয়ে বসে পড়ল। আকাশ তখনো জেগে আছে। তারাগুলো নিঃশব্দে তাকিয়ে, যেন কোনো অজানা রহস্যের সাক্ষী হতে এসেছে। দূরে কোথাও একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠলো, আবার নীরবতা। মসজিদের দেয়াল ঘেঁষে বসে অলি চুপচাপ শুনতে থাকল নামাজের সুর। বৃদ্ধ লোকটি এখন রুকুতে গিয়েছে। সেই কোমল, নিরবধি গতি—কোনো তাড়াহুড়ো নেই, কোনো চাঞ্চল্য নেই। যেন তাঁর প্রতিটি সিজদা একেকটা নিঃশব্দ আর্তি। অলি চোখ বন্ধ করল।
আজ বহুদিন পর কোনো ভয় না পেয়ে চোখ বন্ধ করল সে।পেছন থেকে একটা হালকা বাতাস বইল, ওর ওড়নাটা একটু দুলে উঠলো। অলি তবুও স্থির। এই নির্জন সাহানেই সে একবিন্দু আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে, যতক্ষণ না সকাল হয়, যতক্ষণ না আবার বাস্তব তাকে টেনে নিয়ে যায় অন্য এক অন্ধকারে।

ভোর হতেই নামাজ আদায় করে কিচেনে চলে এসেছে শাহানাজ বেগম। তার সাথে রুনা খাতুন আর নূরজাহানও আছেন। শাহানাজ বেগম সার্ভেন্টদের রান্নার মেন্যু বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন।
“বড় ভাবী, আমি আর রূপসা নিজেদের বাড়িতে চলে যাবো ভাবছি। মা মোটামুটি এখন সুস্থই আছে। তাছাড়া আগামী কালকে রূপসার বাবা দেশে ফিরবেন”

রুনা খাতুনের কথা শুনে শাহানাজ বেগম একটা শ্বাস ফেলে বললেন,
“আমি জানি রুনা এভির কাজকর্মে তোমরা অনেক বেশিই ব্যথিত হয়েছো। কিন্তু এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো যে ওই মেয়েটাই আমার ছেলেকে ফাসিয়েছিল। না জানি কোথা থেকে পেট বাধিয়ে সেই দায়ভার আমার ছেলের উপর চাপিয়ে দিয়েছে।”

শাহানাজের কথা শুনে নূরনাহারের একটু খারাপ লাগলেও সবকিছু জানার পর সেও আর অলিকে ভালো মেয়ে বলে মনে করতে পারছেন না। রুনা খাতুন সুযোগ পেয়ে বলে ওঠেন,
“ভাবী আমরা সবাই-ই বুঝতে পেরেছি যে মেয়েটাই আমাদের এভি বাবাকে ফাসিয়েছে কিন্তু এতোকিছুর পরেও তো এভি বাবা মেয়েটার জন্যই পা*গল হয়ে যাচ্ছে।”

“কিসব বলছো তুমি? আমার ছেলে ওর জন্য পা*গল হচ্ছেনা রুনা। আমার ছেলে তো নিজের করা ভুলের জন্য আফসোস করছে। ভাবছি ছেলেটা কিছুটা স্বাভাবিক হলেই একটা ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে দেবো”

“তুমি কি রূপসাকে আর নিজের ছেলের বউ বানাতে চাইছো না ভাবী?”

শাহানাজ বেগম খুশি হয়ে বললেন,
“এতোকিছুর পরেও সেটা আমি কিভাবে চাইতে পারি বলো তো। তুমিই কি আর রূপসাকে এভির সাথে বিয়ে দিতে রাজি হবে?”

“দেখো ভাবী। এভির সাথে মেয়েটা চিটিং করেছে। তাছাড়া আমরা সবাই জানি যে এভি আর মেয়েটা আলাদা রুমে থাকতো। আমার তো রূপসাকে এভির সাথে বিয়ে দিতে কোনো আপত্তি নেই”

শাহানাজ বেগম যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছেন। এতোকিছুর পরেও রুনা খাতুন যে রূপসাকে এভির সাথে বিয়ে দিতে রাজি হবেন সেটা নিয়ে তার মনে একটু সন্দেহ ছিলো। সেটাই সে ক্লিয়ার করে নিয়েছেন।
“তাহলে আর কি, রূপসাকে বিয়ের জন্য তৈরী হতে বলো”
,
সকাল আটটা নাগাদ সবাই এক এক করে ডাইনিং টেবিলে এসে বসে। শাহানাজ বেগম সবার দিকে তাকিয়ে একটা ছোট্ট শ্বাস ফেললেন, ঊর্মিলার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তোর ভাইকে ডেকে নিয়ে আয়।”

ঊর্মিলা কপাল কুচকে মায়ের দিকে তাকায়,
“মা তুমিই যাওনা। জানোই তো ভাইয়াকে ডাকতে গেলেই ভাইয়া রেগে যায়। তাও বারবার কেনো আমাকেই যেতে বলো?”

“মামনি আমি ডেকে আনছি,”

বলেই রূপসা উঠে দাড়ালো। তখনই কলিংবেল বেজে ওঠে। একজন সার্ভেন্ট ব্যস্ত পায়ে দরজা খোলার উদ্দেশ্যে এগিয়ে গেল। বাকি সবাই একসাথে দরজার দিকেই তাকিয়ে আছে। মূলত এই সময়ে কে এসেছে সেটাই তাদেরকে ভাবিয়ে তুলেছে। অবশ্য রূপসা সেদিকে খেয়াল না করেই আলভীকে ডাকতে চলে গেছে।

দরজা খুলে দিতেই অলি হন্তদন্ত হয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ে। এই সাত সকালে অলিকে আসতে দেখে উপস্থিত সবাই চমকে গেল। অলি আশেপাশে না তাকিয়ে সিড়িবেয়ে উপরে যেতে নেবে তখনই শাহানাজ বেগম বাধ সাধলেন।
“এই মেয়ে কোথা থেকে এসোছো? বলা নেই কওয়া নেই হন্যে হয়ে কোথায় যাচ্ছো শুনি?”

শাহানাজ বেগমের কথা শুনে অলি থমকে দাড়ায়। বউ হয়ে আসার পর এই প্রথম শাহানাজ বেগম অলির সাথে কথা বলেছেন। অলি মাথার ওড়নাটা আরেকটু টেনে শাহানাজ বেগমের দিকে তাকালো। অলির চেহারার অবস্থা দেখে উপস্থিত সবাই অবাক হলেও কোনোকিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন বোধ করলোনা।
“আমার পরীক্ষা শেষ তাই আমি ফিরে এসেছি। নিজের রুমেই যাচ্ছিলাম”

অলির কথা শুনে শাহানাজ বেগম তেড়ে এলেন,
“এই মেয়ে বেশি ন্যাকামো করবেনা বলে দিলাম। এতোদিন অনেক সহ্য করেছি কিন্তু এবার আর সহ্য করবোনা। না*ঙের তো অভাব নেই। যাওনা তাদের সাথেই ফুর্তি করো। নাকি সেইসব না*ঙ তোমার চাহিদা ঠিকঠাক ভাবে পূরণ করতে পারছেনা?”

অলি ছলছল চোখে শাহানাজ বেগমের দিকে তাকালো,
“আম্মা আপনারা আমাকে ভুল বুঝবেন না দয়া করে আমার পুরো কথাটা শুনুন”

“একদম চুপ। আম্মা বলে ডাকবে না আমাকে। তোমার মতো মেয়ের চেহারা দেখলেও ঘেন্না লাগে আমার। কি ভেবেছিলে তুমি হ্যাঁ? তুমি যা ইচ্ছা তাই করে যাবে আর আমার ছেলে তোমাকে কিছুই বলবেনা?”

অলি অসহায় চোখে শাহানাজ বেগমের দিকে তাকিয়ে রইলো। তখনই রুনা খাতুন এগিয়ে এসে বললেন,
“কোন সাহসে এই বাড়িতে পা রেখেছিস বলতো? লজ্জা করলোনা একটুও। ওহহো লজ্জা থাকলে তো করবে। তোর মতো মেয়েরা তো লাজলজ্জা সব সস্তা দামে বাজারে বিক্রি করে দিস। নিশ্চয়ই তোর নতুন প্রেমিকের শখ মিটে গেছে? সেই জন্যই কি আবার চান্স খুজতে এই বাড়িতে এসেছিস?”

কথাগুলো শুনে অলির মাথা ঘুরতে লাগলো। সে জানে এখানে থাকাটা তার জন্য সেইফ হবেনা। সুযোগ পেয়ে এখন সবাই মিলে তাকে আক্রমণ করবে। অলি মুখে কিছু না বলে উল্টো দিকে ঘুরে দ্রুতপায়ে সিড়ি ডিঙিয়ে আলভীর রুমের দিকে ছুট লাগালো। আচমকা অলির কান্ডে বাকি সবাই হকচকিয়ে যায়।
“এই মেয়েটা আবারও গিয়ে আমার ছেলের ব্রেইন ওয়াশ করবে। কিন্তু সেটা আমি আর কিছুতেই হতে দেবোনা।”

বিড়বিড় করে কথাগুলো বলে শাহানাজ বেগমও অলির পিছু নিলেন। বাকি সবাইও খাওয়া দাওয়া বাদ দিয়ে আলভীর রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।
,
রূপসা বেশ কিছুক্ষণ ধরে আলভীর রুমের দরজায় নীরব উদ্বেগে কড়া নাড়ছিল। বারবার নক করলেও ভেতর থেকে কোনো সাড়া আসছিল না। ঠিক এমন সময় রূপসার দৃষ্টি গেল দূরের হলরুমে—দ্রুতপায়ে ছুটে আসছে অলি। তার চোখেমুখে আতঙ্ক আর অস্থিরতার ছাপ, যেন কোনো অজানা শঙ্কা তাকে তাড়া করে ফিরছে। অলি একটিবারও রূপসার দিকে না তাকিয়ে সোজা গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিতে লাগল, যেন তার নিঃশেষিত প্রাণ শক্তিটুকু দিয়ে সে এই বন্ধ রুমের ভিতর পৌঁছাতে চায়।
“শুনছেন, দরজা খুলুন। দরজা খুলুন প্লিজ—” অলি কেঁপে উঠল, কণ্ঠস্বর থরথর করে উঠল কান্নায়। বাধা দিয়ে আর রাখতে পারল না নিজেকে। চোখের জল গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে।

রূপসা থমকে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইল। মুখে বিস্ময়, চোখে অবিশ্বাস—
“এই মেয়ে, এই, তুমি এই বাড়িতে আসলে কিভাবে?”

তার কণ্ঠে ছিল হতচকিত রাগ। কিন্তু অলি কোনো উত্তর দিল না। সে যেন শুনছেই না। কেবল একটানা দরজায় ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে—কখনো হাত দিয়ে, কখনো কাঁধ ঠেকিয়ে। শরীরের প্রতিটা কোষ থেকে সে আকুতি ছুঁড়ে দিচ্ছে।
“আল্লাহর দোহাই লাগে, দরজাটা খুলুন”

হঠাৎ করেই অপ্রত্যাশিতভাবে দরজাটা খুলে গেল। অলি কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই সামনের দিকে ছিটকে গিয়ে সোজা আলভীর বুকের সাথে ধাক্কা খেল। তার সমস্ত ক্লান্তি, আতঙ্ক আর স্বস্তি যেন সেই একমুহূর্তে গলে গিয়ে আলভীর শরীরে ভর করল।
আলভী হতচকিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। চোখে এখনও ঘোলাটে দৃষ্টি। গতরাতে ড্রিংক করতে করতে সে জ্ঞান হারিয়েছিল। কিছুক্ষণ আগেই অলির করুণ আর্তিতে তার জ্ঞান ফিরেছে। রুমটা পুরোপুরি সাউন্ডপ্রুফ হলেও, দরজায় এমন ধাক্কাধাক্কির শব্দ প্রবেশ করেছে ভেতরে। এখনও তার শরীর থেকে এলকোহলের তীব্র গন্ধ বের হচ্ছে, চোখ লালচে, মুখ বিবর্ণ। অথচ অলি সেসব কিছুই অনুভব করছে না—সে কেবল বাঁচার আকুতিতে আলভীর শরীর আঁকড়ে ধরে আছে।
“প্লিজ আমাকে ভুল বুঝবেন না। আপনি যা দেখেছেন, যা শুনেছেন সব মিথ্যা ছিলো। আমি ইচ্ছা করে কিছুই করিনি। সবকিছুই আপনার বন্ধু রিফাতের প্ল্যান। সেই আমাকে আটকে রেখে এইসব কিছু করতে বাধ্য করেছে”

অলির কণ্ঠস্বর কাঁপছে, আলভী কিছু না বলে তাকিয়ে আছে অন্যদিকে—চোখে ঘোর, ভেতরে অস্বস্তি। তবে অলির মুখের ভীত প্রার্থনা যেন তাকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে।
“ওরা আমাকে মে*রে ফেলবে। আমাকে বাঁচান প্লিজ…”

আলভী ধীরে ধীরে তাকাল দরজার বাইরে। সেখানে বাড়ির প্রায় সবাই দাঁড়িয়ে—নিস্তব্ধ, থমথমে এক পরিবেশে। অলি আর আলভীকে এই অবস্থায় দেখে রূপসা প্রচন্ড রেগে গেছে। ক্রোধের বশে তার হাত পা ও কাপছে।

“এভি এই মেয়েটাকে এক্ষুনি বাড়ি থেকে বের কর। এর জন্য আমাদের পুরো বাড়িটা একেবারে অপবিত্র হয়ে গেলো।”
শাহানাজ বেগমের কথা শুনে আলভী ভ্রু কুচকে তাকায়। তার নে*শা এখনো পুরোপুরি ভাবে কাটেনি। মনে হচ্ছে সে এখনো কোনো ঘোরের মাঝেই আছে।

আলভী মুখে কিছু না বলে অলির থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। কিন্তু অলি ঘুরে গিয়ে আলভীর পেছনে লুকিয়ে পড়লো।
“এভি ওকে বের কর।”

কথাটা বলতে বলতেই শাহানাজ বেগম এগিয়ে এলেন আলভীর দিকে কিন্তু রুম থেকে আসা এলকোহলের উটকো গন্ধে সে অলিকে টেনে নিয়ে যেতে পারলেন না। শাহানাজ বেগম অবিশ্বাসের সুরে প্রশ্ন ছুড়লেন,
“এভি তুই বাড়িতে ম*দ এনেছিস?”

প্রশ্নটা শুনে অলি চোখ বড়বড় করে আলভীর দিকে তাকায়। কিন্তু আলভীর মাঝে কোনো ভাবাবেগ নেই। সে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল,
“সকাল সকাল নাটক শুরু করেছো কেনো? সবাই বের হও আমার রুম থেকে।”

আলভী উল্টো দিকে ঘুরে ওয়াশরুমের দিকে চলে যেতে নিলে অলি পেছন থেকে আলভীর শার্টের অনেকটা অংশ খামচে ধরে। আলভী বেশ বিরক্ত হয়ে অলির দিকে তাকায়,
“কি সমস্যা? বের হ আমার রুম থেকে”

অলি একটা ঢোক গিলে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলো—শাহানাজ বেগম, রূপসা আর রুনা খাতুন জ্বলন্ত চোখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে,
“প্লিজ আমাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলার সুযোগ টুকু দিন। সবকিছু শোনার পর আপনি আমাকে বের করে দিলে আমি নীরবে বের হয়ে যাবো। প্লিজ”

আলভীর ঘোর কিছুতেই কাটছেনা। শাওয়ার নেওয়া জরুরী। সে অলির হাতটা ছাড়াতে গেলে অলি আরও শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরে। এরকম দৃশ্য দেখে ইয়ামিন মির্জা, নূরনাহার আর উসমান মির্জা কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে ব্যস্ত পায়ে নিজেদের রুমে চলে যায়। আলভী খিটখিটে মেজাজে বলল,
“আমাকে ফ্রেশ হয়ে আসতে তো দিবি নাকি?”

অলি মাথা নাড়িয়ে না বললো।

চলবে,,,

শব্দসংখ্যা- ২৬৫০+

#১৫_বছর_বয়সী_মা (৩০)
#সোফিয়া_সাফা

“আমাকে ফ্রেশ হয়ে আসতে তো দিবি নাকি?”

অলি মাথা নাড়িয়ে না বললো। আলভী ভীষণ অবাক হয়ে গেলো অলির ব্যবহারে। যেই মেয়েটা তাকে দেখলেই পিছিয়ে যায় সেই মেয়েটাই কেনো আজকে নিজে থেকে তার দিকে এগিয়ে এসেছে?

“আলভী তুই মেয়েটাকে এখনো সহ্য করছিস কিভাবে ওকে ধাক্কা দিয়ে বের করছিস না কেনো?”
জবাবে আলভী মায়ের দিকে তাকিয়ে শান্তস্বরে বললো,
“তোমরা যাও আমি দেখছি”

আলভীর কথা শুনে রূপসাসহ বাকি দুজনেও তাজ্জব বনে গেলো। রুনা খাতুন বলে উঠলেন,
“এভি বাবা তুমি কি দেখবে? আর কি দেখার বাকি আছে? এই মেয়েটা যা যা করেছে তাতো আমরা সবাই দেখেই নিয়েছি তাইনা?”

আলভী একবার অলির দিকে তাকিয়ে পুনরায় রুনা খাতুনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি কি দেখবো না দেখবো সেটা জানাটা কি তোমাদের জন্য খুব বেশিই জরুরী? না মানে, আমার তো অনেক কিছুই দেখার থাকতে পারে তাইনা?”

রুনা খাতুন আলভীর কথার মানে বুঝলেন না। কিন্তু ঊর্মিলা, রূপসা আর সবার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ইয়াদ আলভীর কথার মানে বুঝতে পেরেছে। রুনা খাতুন আরও কিছু বলতে যাবে তার আগেই ঊর্মিলা এগিয়ে এসে বলে,
“প্লিজ ফুপি তুমি আর কিছু বলোনা তো। ভাইয়া নে*শা করেছে। তার কথার ধরন দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে নে*শা পুরোপুরি কাটেনি। তুমি সোজাভাবে কথা বললেও ভাইয়া উল্টো পাল্টা ভাবে উত্তর দিয়ে বসবে যেটা তোমাদের জন্যই লজ্জাজনক হবে”

কথাটা বলেই ঊর্মিলা চলে যায়। ইয়াদ বাকিদের উদ্দেশ্যে বলে,
“ভাইয়ার মাথা ঠিক হয়ে নিক। তোমরা বরং যাও এখান থেকে”

ইয়াদের কথা শুনে রূপসা আর রুনা খাতুন চলে গেলেন। সবশেষে শাহানাজ বেগম অলির দিকে একবার তীক্ষ্ণ চাহনি নিক্ষেপ করে রুম থেকে বেরিয়ে যান।
“ছাড়ো এখন, চলে গেছে সবাই।”

আলভীর কণ্ঠে একধরনের শীতল তীক্ষ্ণতা ছিল—যা অলির বুকের ভেতরটাকে হঠাৎ করেই খালি করে দিল। ধীরে ধীরে সে তার বুক থেকে নিজের শরীরটা সরিয়ে নেয়। তীব্র এক অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়ে গা জুড়ে। সে তো ইচ্ছা করে আলভীকে জড়িয়ে ধরেনি। পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে তাকে বাধ্য হয়ে এমনটা করতেই হয়েছিল। আলভী একবার অলির দিকে তাকিয়ে মুখে কিছু না বলে সোজা ওয়াশরুমের দিকে চলে যায়। তার চলার ভঙ্গিতে ক্লান্তি আর একরাশ বিতৃষ্ণা লেগে ছিল। অলি ধীরেপায়ে রুমের দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে এসে বিছানার এক কোনায় বসে পড়ে। খানিকটা নিঃশ্বাস নেয়ার সুযোগ পেয়ে যেন একটু স্বস্তি ফিরে আসে। কিন্তু সেই স্বস্তি বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। হঠাৎ করেই তার নাকে এক তীব্র, ঝাঁঝালো গন্ধ এসে আঘাত করে। এল’কোহলের গন্ধ। মাথার ভেতরটা যেন ঘুরে ওঠে। এতক্ষণ ভয়ের কারণে অলি গন্ধটা টেরই পায়নি, কিন্তু এখন…তার বমি পাচ্ছে।

গর্ভবতী শরীর এমনিতেই সংবেদনশীল, তার উপর এমন তীব্র গন্ধ—এক মুহূর্তও সহ্য করতে না পেরে অলি মুখ চেপে ধরে ওয়াশরুমের দিকে ছুটে গেল। কিন্তু আলভী তো ওয়াশরুমে তখন শাওয়ার নিচ্ছিলো। অলি ওয়াশরুমের দরজায় একবার কড়া নেড়ে কাঁপতে কাঁপতে বলে ওঠে,
“দ…দরজা খুলুন… ও…য়াক”

তার গলা ধরে আসছে, পেটের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠে আসছে গলা অবধি। কিন্তু ভেতরে থাকা আলভী দরজা খুললোনা। খুলবেই বা কিভাবে? তার সারা শরীরে যে সাবানের ফেনা,
অলি এবার প্রায় কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলে,
“প্লি…জ… দ…রজা খুলুন… আর পা…রছিনা!”

আলভী একমুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে বুঝতে পারল, পরিস্থিতি আর ধীরস্থিরভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। কী করবে বুঝতে না পেরে তাড়াহুড়ো করে শাওয়ারের কলটা জোরে ঘুরিয়ে দিল। ঠান্ডা পানির ধারায় সাবানের ফেনাগুলো যেন মুহূর্তেই গলে গেল তার শরীর থেকে। চটজলদি কোমরে টাওয়েল পেঁচিয়ে, ভেজা পায়ের শব্দ তুলে দ্রুত দরজার দিকে এগিয়ে গেল সে।
দরজাটা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই ঘটল অঘটন। অলি আর নিজেকে সামলাতে পারল না। ঝাপসা দৃষ্টিতে সে আলভীর মুখটাও ভালোভাবে দেখতে পায়নি। অলি নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে আলভীর উন্মুক্ত বুকের উপরেই গলগল করে বমি করে দিলো। অলির পেটে তেমন কিছুই ছিলোনা। শুধু স্বচ্ছ পানি বমির ন্যায়ে বেরিয়ে এসেছে, অলি ভারসাম্য হারিয়ে আলভীর গায়েই ঢলে পড়ে। পায়ের নিচে শক্তি নেই, চোখ বুঁজে এসেছে। কান্না চাপা দিতে গিয়ে গলার ভিতর থেকে হাঁপ ধরা শব্দ বের হচ্ছে। আলভী প্রথমে ভড়কে গেলেও অলির চাপা কান্নার আওয়াজ কানে আসতেই সে একহাতে অলিকে সামলে নিল। অন্য হাত দিয়ে আলতো করে অলির পিঠে হাত বুলিয়ে দিল। অলি যতটা না কষ্টে কান্না করছে তার চাইতেও বেশি কান্না করছে আলভীর গায়ের উপরেই বমি করে দেওয়ার জন্য। আলভী গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠে,
“কান্না থামাও”

আলভী অলিকে নিয়ে বেসিনের সামনে দাড় করালো। কল ছেড়ে বললো,
“চোখেমুখে পানি দেও”

অলি কোনো কথা না বলে মাথা ঝাঁকায়। কাঁপা হাতে পানির ছিটা দেয় চোখে মুখে। পায়ের নিচে এখনও মাটি নেই তার। শরীরটা যেন এক ফালি তুলোর মতো—বমি করার পর শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। অলি রয়েসয়ে মুখ তুলে আলভীর দিকে তাকায়। চোখ দুটি জলে টইটম্বুর, লজ্জা আর অপরাধবোধে সে আড়ষ্ট হয়ে আছে। ঠোঁট দুটোও অনবরত কাপছে।
“স্যরি…”

আলভী কিছুক্ষণ চুপ করে অলির চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মুখে তেমন কোনো আবেগ নেই, কেবল একটা শ্বাস ফেলে বলে,
“তুমি নিজের রুমে চলে যাও। আমাকে আবারও শাওয়ার নিতে হবে।”

অলি মাথা নাড়িয়ে না বললো। আলভী বিরক্তির স্বরে বলে ওঠে,
“কি সমস্যা? আমার বাড়ির লোকেরা কি তোমাকে খেয়ে ফেলবে নাকি? অদ্ভুত বিহেভ কেনো করছো?”

অলি চোখ সরিয়ে দরজার দিকে তাকায়। মৃদুস্বরে বলে ওঠে,
“আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন। তারপর বলছি।”

অলি ধীরপায়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো। রুমের ভেতরে ঢুকতেই আবার সেই তীব্র উটকো গন্ধ! অলি ওড়না দ্বারা মুখ চেপে ধরে ছুটে যায় জানালার দিকে। পর্দাটা একটানে সরিয়ে জানালাটা খুলে দেয়। সাথে সাথেই বাতাসের ঝাপ্টা এসে রুমের ভেতর প্রবেশ করে। অলি বড়বড় কয়েকটা শ্বাস নিলো। হঠাৎ তার চোখ পড়ে টেবিলের উপর রাখা কয়েকটি এল’কোহলের বোতলে। কিছু বোতলের মুখ খোলা, কিছু উপুড় হয়ে আছে। অলি একটা শুষ্ক ঢোক গিলে সেদিকে এগিয়ে গেলো। তারপর টিস্যু বক্স থেকে কতগুলো টিস্যু বের করে, সেই টিস্যুতে বোতলগুলো জড়িয়ে ধরল—যেন সরাসরি হাতের সংস্পর্শে না আসে। অলি ধীরে ধীরে রুমের এক কোণে রাখা ডাস্টবিনে সব বোতল ফেলে দেয়। সবশেষে ড্রেসিং টেবিল থেকে এয়ার ফ্রেশনারটা তুলে নেয় সে। হাতের কাঁপা আঙুলে ফ্রেশনারের মুখ চেপে ধরে, পুরো রুমে ছড়িয়ে দেয় সুগন্ধি কণার মৃদু বৃষ্টি। রুমটা ধীরে ধীরে একটু সহনীয় হয়ে ওঠে।

১০ মিনিট যেতেই আলভী ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে। অলি একবার আলভীর দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। আলভী মাথা মুছতে মুছতে এগিয়ে যায় কাভার্ডের দিকে। একটা শার্ট আর একটা প্যান্ট বের করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাড়ালো। তারপর কিছু একটা ভেবে অলির দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে কাপড় গুলো নিয়ে আবারও ওয়াশরুমে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর আলভী রেডি হয়ে বেরিয়ে আসে,
“কেনো এসেছো এই বাড়িতে? ডিভোর্সের কাগজ নিয়ে এসেছো নাকি?”

আলভীর প্রশ্ন শুনে অলি আলভীর দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনি বিশ্বাস করুন আমি কখনোই আপনাকে ডিভোর্স দিতে চাইনি। আপনার বন্ধু রিফাতই আমাকে বাধ্য করেছিলো আপনাকে ওসব বলতে”

আলভী একটা শ্বাস ফেলে অলির সামনে এসে বসলো। সোজাসাপ্টা বলল,
“তার মানে তুমি তখন অভিনয় করেছিলে? তুমি বলতে চাইছো রিফাত তোমাকে ওই ছেলেটার হাতে কিস করে আই লাভ ইউ বলতেও ফোর্স করেছিলো?”

অলি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো। আলভী অবিশ্বাসের সুরে বলল,
“বাহঃ খুব ভালো। তোমার কি মনে হয় তুমি যা বলবে আমি তাই বিশ্বাস করে নেবো?”

অলি অসহায় চোখে আলভীর দিকে তাকায়,
“ওভাবে তাকাবে না, একদম। আমাকে ইমোশনালি অ্যাটাক করবেনা। আমি কিভাবে বিশ্বাস করবো যে তুমি তখন অভিনয় করেছিলে আর এখন একদম সত্যি কথাই বলছো?”

অলি একটা শুষ্ক ঢোক গিলে বলল,
“আমার কাছে আপাতত কোনো প্রমাণ নেই। কিন্তু বিশ্বাস করুন আপনার বন্ধু নোমান ভাইয়াকে দিয়ে আমাকে কিডন্যাপ করিয়েছিল”

“ওয়েট ওয়েট, নো-ম্যান তোমার ভাইয়া হলো কবে থেকে?”

নোমান কে নো-ম্যান বলাতে অলি চকিত নয়নে আলভীর দিকে তাকায়।
“উনি বয়সে আমার থেকে বড়, সেই জন্যই ভাইয়া বলেছি”

“কিন্তু ও তো তোমার বয়ফ্রেন্ড তাইনা? তোমাকে নাকি ও বিয়েও করবে? ভেরি ব্যাড, ভেরি ব্যাড। হবু বরকে কেউ ভাইয়া বলে ডাকে নাকি?”

“বললাম তো আপনার বন্ধু রিফাত আমাদেরকে ওগুলো করতে বাধ্য করেছিলো। আপনি বুঝতে চাইছেন না কেনো?”

আলভী বুকের উপর হাত বেধে অলির দিকে তাকালো। ভেজা চুলে আলভীকে স্নিগ্ধ লাগছে কিন্তু তার চোখদুটো এখনো লালবর্ণ। অলিকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আলভী ঠাট্টার স্বরে বলে ওঠে,
“কি ভাবছো?”

অলি নাবোধক মাথা নাড়ে,
“আমি জানি তুমি কি ভাবছো”
অলি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আলভীর দিকে তাকাতেই আলভী বাকা হেসে বলে ওঠে,
“এটাই তো ভাবছো যে আমি তোমার ওই নো-ম্যানের থেকে দেখতে শুনতে ভালো। আমাকে ছেড়ে গিয়ে তোমার আফসোস হচ্ছিলো তাইনা? সেই জন্যই কি ফিরে এসেছো?”

কথাটা শুনে যেন অলির চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। অলি ফট করে দাঁড়িয়ে যায়। আলভীর দিকে খানিকটা ঝুকে গিয়ে নিজের চেহারাটা দেখিয়ে বলে,
“আপনার কি মনে হয়? আমার চেহারার এই অবস্থা আমি নিজেই করেছি?”

“না আমার তো মনে হয় মেক-আপ। আমি জানি মেয়েরা মেক-আপ করতে পছন্দ করে। তুমিও করো নিশ্চয়ই? তো তোমার এই মেক-আপ গুলো কি তুমি নিজেই করেছো নাকি কোনো বিউটিশিয়ানকে দিয়ে করিয়েছো?”

আলভী বসা থেকে উঠে দাড়ালো। হঠাৎ করেই অলির গালজোড়া চেপে ধরে সূক্ষ্ম দৃষ্টি বুলিয়ে বলল,
“বাহঃ অনেক ভালো মেক-আপ করেছো তো, একদম রিয়েলিস্টিক লাগছে। আচ্ছা কোন বিউটিশিয়ান এতো ভালো মেক-আপ করে দিলো? আমাকে বলো, আমি তাকে টিপস দিতে চাই। মানতেই হবে সে অনেক এক্সপার্ট।”

আলভীর কথায় অলি স্তব্ধ হয়ে গেলো। আলভীর থেকে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ছটফট করতে লাগলো। কিন্তু ফলস্বরূপ আলভী আরেক হাতে অলির চুল টেনে ধরলো। দাতে দাত চেপে রুক্ষ কন্ঠে বলে উঠলো,
“ম*রতে এসেছিস আমার কাছে? তুই যদি ভেবে থাকিস যে বারবার আমি তোকে ছেড়ে দেবো, তাহলে তুই ভুল ভাবছিস পয়জনবি। আমার সম্পর্কে তোর কোনো ধারণাই নেই। এই আলভী তাসনীম মির্জা এতোটাও ভালো নয় যে বারবার তোর মতো চিটার আর ছলনাময়ীকে ছেড়ে দেবে”

আলভীর কথা শুনে অলির চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। তার মনে হচ্ছে গালদুটো এবার ঘষেই পড়বে।
“ছেড়ে দিন প্লিজ। আমি ব্যা…থা পাচ্ছি”

আলভী হঠাৎ করেই অলিকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে। অলি কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্থির হয়ে যায়। আলভী অলির মাথাটা প্রচন্ড শক্ত করে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরেছে।
“আমিও ব্যাথা পাচ্ছি। অনেক বেশিই ব্যাথা পাচ্ছি। তুই আমাকে ব্যাথা দিচ্ছিস। কেনো দিচ্ছিস? আমি তো তোকে নিজের সবকিছু দিয়ে দিয়েছিলাম তারপরেও কেনো লয়্যাল থাকতে পারলিনা? কিচ্ছু চাইনি তোর থেকে। উল্টো তুই যা চেয়েছিস তাই দিয়েছি। তারপরও কেনো বিশ্বাস ঘাতকতা করলি? বেঈমান কোথাকার”

আলভী অলিকে মুক্ত করে দিতেই অলি ঠোঁট চেপে কেদে ওঠে।
“আপনি কেনো বিশ্বাস করছেন না?”

“কারণ তুই ছলনাময়ী, প্রতারক তুই বেঈমান। আমি তোকে বিশ্বাস করতে পারছিনা।”

আলভী দরজার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল,
“তোর হাতে ৫ মিনিট সময় আছে। লাস্ট বারের মতো তোকে পালিয়ে যাবার সুযোগ দিলাম। বেরিয়ে যা এই বাড়ি থেকে। নয়তো এই আলভী তাসনীম মির্জা তোকে শাস্তি দেবে। চরম শাস্তি দেবে—তার সাথে প্রতারণা করার জন্য।”

অলি নিজের চোখজোড়া মুছে ধপ করে বিছানার উপর বসে পড়লো। আলভীর দিকে তাকিয়ে বললো,
“হাহ, সুযোগ আমাকে দেবেন ঠিক আছে কিন্তু সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করবে সুবিধাবাদী কিছু সংখ্যক লোক? সেটা আমি আর হতে দিচ্ছিনা। আমার সংসারে ভাঙ্গন ধরানোর জন্য—আমি আর কাউকে এক চুল পরিমাণও সুযোগ দেবোনা। তাতে যদি আপনি আমাকে মে*রেও ফেলেন। আমার কোনো আপত্তি নেই।”

অলির মুখ থেকে উক্ত কথাগুলো শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা আলভী। সে চমকে তাকালো অলির দিকে। অলি ওড়না দ্বারা নিজের এলোমেলো চুলগুলো ঢেকে নিলো। আলভী অলির দিকে তাকিয়ে সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“তোমার কি টাকাপয়সা লাগবে? নাকি আমার সম্পত্তি ভোগ করার জন্য আমাকে মা*রতে এসেছো? কোনটা?”

অলি ভ্রু কুচকে তাকায়,
“বারবার মা*রার কথা কেনো বলেন? আমি আপনাকে কেনো মা*রতে চাইবো?”

“কারণ তোমার সেই ফালতু শর্ত মোতাবেক তো আমি ম*রে গেলে তুমিই আমার সব সম্পত্তির মালিক হবে তাইনা? আচ্ছা আমি ম*রে গেলে তুমি কি ওই নো-ম্যানকেই বিয়ে করবে নাকি আরও কেউ আছে?”

আলভীর কথাগুলো শুনে অলি মাথা নিচু করে নিলো। সে বুঝে উঠতেই পারছেনা যে ঠিক কিভাবে সে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করবে। অলি নিম্নস্বরে বলে ওঠে,
“আমার আপনার সম্পত্তি নয় আপনাকেই লাগবে। আমার বাবুকে নিয়ে আমি আপনার সাথে বাচতে চাই। আমার আর কিচ্ছু লাগবেনা।”

আলভী অলির দিকে তাকিয়ে বলল,
“বাহঃ ভালো কথাই তো শিখেছো দেখছি। তো এই কথাগুলো কি ওই নো-ম্যান শিখিয়েছে নাকি আমার জার’জ শত্রু রিফাত শিখিয়েছে? আচ্ছা রিফাতকে তুমি খুব ভালো করেই চেনো তাইনা? সেদিন কি রিফাত তোমাকে জোর করে আমার রুমে আটকে দিয়েছিলো নাকি তুমি ওর সাথে হাত মিলিয়ে নিজে থেকেই আমার রুমে এসেছিলে?”

অলি ফোস করে একটা শ্বাস ফেলে আলভীর দিকে তাকালো,
“আমাকে কিছুদিন সময় দিন আমি কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা প্রমাণ করে দেবো”

“একটা কারণ দেখাও যার ভিত্তিতে আমি তোমাকে সময় দেবো।”

অলি ভ্রু কুচকে আলভীর দিকে তাকায়। আলভী মৃদু হেসে বলে ওঠে,
“একটা এমন কারণ দেখাও যার জন্য আমার তোমাকে সময় দেওয়া উচিৎ”

“অনেক গুলো কারণ আছে। প্রথমত আমি আপনার বউ দ্বিতীয়ত আপনার অনাগত সন্তানের মা। আর পরিশেষে আপনি আমাকে ভালোবাসেন।”

শেষের কথাটা শুনে আলভী চমকে তাকালো। এই কথাটা তো সে অলিকে কখনো বলেনি। তাহলে অলি জানলো কিভাবে?
“কে বলেছে যে আমি তোমার মতো মেয়েকে ভালোবাসি?”

অলি ভ্রু নাচিয়ে বলে ওঠে,
“আপনিই বলুন—ভালোবাসেন না?”

“নাহ”

“মিথ্যা বলছেন। আমি ছলনাময়ী, প্রতারক, বেঈমান। আর আপনি হলেন মিথ্যাবাদী।”

আলভী উত্তর না দিয়ে কাভার্ড থেকে একটা ওভারকোট বের করলো। অলির সাথে কথা বলতে বলতে তার অফিস টাইম হয়ে গেছে। অফিস শেষে বিকেলের দিকে তাকে হসপিটালেও যেতে হবে। আলভীকে রেডি হতে দেখে অলি বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়,
“কোথায় যাচ্ছেন?”

“বেকার বলে মনে করো নাকি?”

অলি কিছুই বললোনা। সে বুঝে গেছে আলভী হয়তো অফিসে নয়তো হসপিটালে যাচ্ছে। আলভী রেডি হয়ে রুমের দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে নিলে অলিও তাকে অনুসরণ করতে লাগলো। আলভী তাকে পাত্তা না দিয়ে সোজা নিচে নেমে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসলো। অলিও তার পিছুপিছু তার পাশের চেয়ারে বসে পড়লো। শাহানাজ বেগম একবার অলির দিকে তাকিয়ে আলভীর দিকে তাকালেন।
“এভি তুই এই মেয়েটাকে ডিভোর্স দিবি কবে?”

আলভী একটুকরো রুটি মুখে নিয়ে বললো,
“কখনোই না”

কথাটা শুনে অলির ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে ওঠে কিন্তু আলভীর বলা পরের কথাটা শুনেই হাসিটা মিলিয়ে যায়।
“মা আমি ওকে কখনোই ডিভোর্স দেবোনা। কারণ আমার হাতে তো ডিভোর্স দেওয়ার ক্ষমতাই নেই। তবে ও আমাকে খুব শীঘ্রই ডিভোর্স দিয়ে দেবে।”

রূপসা আজকে ভার্সিটিতে যায়নি। আলভীকে টেবিলের দিকে যেতে দেখে সেও টেবিলের সামনে এসেই দাড়িয়েছিল। আলভীর কথা শুনে রূপসা বলে ওঠে,
“কেনো? তুমি কেনো ওকে ডিভোর্স দিতে পারবেনা?”

আলভী একবার রূপসার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ও বিয়ের আগে শর্ত দিয়েছিলো যে ডিভোর্স দেওয়ার ক্ষমতা শুধুমাত্র ওর হাতেই থাকবে।”

শাহানাজ বেগম অবাক স্বরে বলেন,
“কিহ? আর তুই সেই শর্ত মেনেও নিয়েছিলি?”

আলভী হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লো। রূপসা ক্রোধের বশে বলে উঠল,
“কি বলছো? তুমি এতো বোকা? আগে জানতাম না”

কথাটা আস্তে বললেও আলভী শুনতে পেয়েছে।
“সেদিনের থাপ্পড় টা জায়গা মতো পড়লে এইসব ভাবনা আর মাথায় আসতো না।”

আলভীর কথা শুনে রূপসা একবার অলির দিকে রাগী চাহনি নিক্ষেপ করে চলে যায়। শাহানাজ বেগম বলে ওঠেন,
“তুই রূপের সাথে এভাবে কথা বলিস কেনো? তুই কি বুঝিস না যে রূপ তোকে ভালোবাসে? এভি ভালো করে শুনে রাখ এই আপদটা এই বাড়ি থেকে বিদেয় হওয়া মাত্রই আমি রূপকে তোর বউ বানাবো”

কথাটা শুনে অলি চমকিত নয়নে শাহানাজ বেগমের দিকে তাকালো। আলভী আড়চোখে একবার অলির দিকে তাকিয়ে খাবার খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। অলি অবিশ্বাসের সুরে প্রশ্ন করলো,
“আম্মা এসব কি বলছেন?”

শাহানাজ বেগম মুখ বাকিয়ে বললেন,
“সঠিক বলেছি। তুমি তারাতাড়ি আমার ছেলের ঘাড় থেকে নামো।”

অলি বসা থেকে উঠে দাড়ালো,
“আম্মা আপনি ভুলে যাবেন না আমি ওনার বাচ্চার মা হতে চলেছি। এই অবস্থায় উনি কি করে আমাকে ছেড়ে আরেকটা বিয়ে করতে পারেন?”

শাহানাজ বেগম ভীষণ চটে গেলেন।
“একদম ভাওতাবাজি করবেনা। কোথাকার কোন পাপ পেটে ধরে সেই পাপের বোঝা আমার ছেলের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চাইছো। এই মেয়ে শুনে রাখো তোমাদের ডিভোর্স খুব শীগ্রই হবে। আর তারপর আমার ছেলেকে আমি আবারও বিয়ে করাবো।”

এতোক্ষণ চুপ করে থাকলেও আলভী এবার আর চুপ করে থাকতে পারলোনা।
“মাহ, আমি তোমাকে আগেও সতর্ক করেছিলাম—এই কথাটা কক্ষনো মুখ দিয়ে উচ্চারণ করার মতো ভুল করবেনা। তারপরেও তুমি আবারও এই কথাটা কেনো বললে?”

অলি ঠোঁট চেপে কেদে উঠলো। এই কথাটা সত্যিই অনেক ভারী। তাকে গা*লাগা*লি করলেও সে এতোটা কষ্ট পায়না কিন্তু এই কথাটা শুনলেই তার ম*রে যেতে ইচ্ছা করে।

“একশোবার বলবো। কি করবি তুই? আমার গায়ে হাত তুলবি? নাকি আবারও নিরুদ্দেশ হয়ে যাবি? কোনটা করবি? শুনে রাখ, তুই যতই এই মেয়েকে বাচানোর চেষ্টা করিস না কেনো, মিথ্যা কখনো সত্যি হয়ে যাবেনা। আমি নিশ্চিত যে এই মেয়ের পেটে থাকা বাচ্চাটার বাবা তুই না। এটা নিশ্চয়ই অন্য কারো অবৈধ সন্তান।”

আলভী নিজেও আর সহ্য করতে পারছেনা। তার চেহারা রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। প্রচন্ড রাগে শরীর কেপে উঠছে। শাহানাজ বেগমের চিল্লানোর আওয়াজে নূরনাহার আর রুনা খাতুনও ড্রইংরুমে এসে উপস্থিত হলেন। শাহানাজ বেগম তাদের উদ্দেশ্যে বলে ওঠেন,
“রুনা আর নূরনাহার তোমরা সত্যি করে বলোতো, তোমাদের কি মনে হয় যে ওই চরিত্রহীনার পেটে থাকা সন্তান টা আদৌ মির্জা বংশের সন্তান?”

লজ্জায় অলির ইচ্ছা করছে মাটির সাথে মিশে যেতে। এহেন প্রশ্নে নূরনাহার খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেও রুনা খাতুন বলে ওঠেন,
“আমি তো একদম নিশ্চিত যে বাচ্চাটার বাবা এভি নয়। এই মেয়েটা এভিকে ফাদে ফেলার জন্যই বাচ্চাটাকে এভির বলে চালিয়ে দিতে চাইছে। আমার তো মনে হয় এই বারো-ভা’তারী নিজেও হয়তো জানেনা যে এটা কার বাচ্চা”

“একদম চুপ”
আলভীর জোরালো কন্ঠে পুরো বাড়িটাই যেনো কেপে উঠলো,

চলবে,,,

শব্দসংখ্যা- ২৫৫০+