#১৫_বছর_বয়সী_মা (৪৩)
#সোফিয়া_সাফা
ভোরের নরম আলো কেবিনের জানালা দিয়ে ঢুকে পড়েছে। সারা রাত ব্যথা আর অস্বস্তিতে তেমন ঘুম হয়নি অলির। হঠাৎ করেই সে ভেতরে প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছে, কিন্তু আলভীকে বলার সাহস পাচ্ছে না। লজ্জা আর অসহায়ত্ব মিলে মিশে বুকের ভেতর কেমন যেন এক গুমোট পরিবেশ তৈরি করেছে। সে বারবার চোখ বন্ধ করে চাপ সামলানোর চেষ্টা করছে, ঠোঁট কামড়ে কষ্ট লুকোচ্ছে, কিন্তু মিনিট কয়েকের মধ্যেই বুঝতে পারল আর সহ্য করা সম্ভব নয়। অবশেষে ধীরে, খুব নিচু স্বরে আলভীকে ডাকল,
“শুনছেন… আমার… আমার ওয়াশরুমে যেতে হবে…”
কথাগুলো বলতে গিয়ে অলির ভীষণ কান্না পাচ্ছে। সে জানেনা আলভী কিভাবে কি করবে। কিন্তু তার পক্ষে আর সহ্য করা সম্ভব নয়। এতে বাচ্চার উপরেও প্রেশার পড়বে। তবে অলির কথাটা শুনেও আলভী খুব একটা বিচলিত হলোনা। সাথে সাথেই সোফা থেকে উঠে দাঁড়াল, তারপর তাড়াতাড়ি নার্সকে ডাকল। কিছুক্ষণের মধ্যেই নার্স চাকা লাগানো মোবাইল কমোড চেয়ার নিয়ে এলো। চাকা লাগানো সেই চেয়ারের পাশে ধাতব হাতল, বসার জায়গায় নরম কুশন, আর নিচে সরাসরি কমোড বাটি।
নার্স আর আলভী মিলে তাকে ধীরে ধীরে বিছানা থেকে তুলতে উদ্যত হলো, আলভী আলতো ভাবে অলির বাম হাতের নিচে নিজের হাত ঢুকিয়ে তাকে সাপোর্ট দিল। ডান হাত ও পায়ের প্লাস্টারের ওজন সামলাতে গিয়ে অলি কেঁপে উঠল, মুখ বিকৃত হলো ব্যথায়। চোখের কোণ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে চাইলেও সে ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকাতে লাগল। এসবের মাঝেও সে একধরনের স্বস্তি অনুভব করছে। এবার অন্তত আর সেই কষ্ট সহ্য করতে হবেনা। নার্স ধীরে ধীরে অলিকে কমোড চেয়ারে বসিয়ে দিলো, আলভী পুরো সময় তার বাম হাত আর কাঁধ শক্ত করে ধরে রাখল।
ছোট চাকার মৃদু ঘর্ষণের শব্দে কমোড চেয়ারটি ওয়াশরুমের দিকে এগোতে লাগল। এরইমাঝে আলভী মাথা নিচু করে বলল, “তুমি ঠিক আছো তো?”
অলি হালকা মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলল, যদিও গাল বেয়ে নেমে যাওয়া লজ্জার উষ্ণতা সে লুকাতে পারল না।
আলভী পুনরায় নিচু স্বরে বলল,
“অস্বস্তি বোধ কোরোনা প্লিজ।”
দরজার কাছে পৌঁছালে আলভী একপাশে সরে দাঁড়াল, ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ হয়ে গেলে কেবিনে নীরবতা নেমে এলো। বাইরে দাঁড়িয়ে আলভী মনে মনে আওড়ালো,
“আমি এখন থেকে তোমার পাশেই থাকবো। কাজকাম সব বাদ। আমার কাছে তুমি আগে তারপর বাকি সব।”
ওয়াশরুম থেকে ফেরার পর আলভী যখন অলিকে বিছানায় শুইয়ে দিল, তখন তার চোখে-মুখে ছিল ক্লান্তি, কিন্তু হাত দুটো এখনও দৃঢ়ভাবে অলিকে আগলে রেখেছে। অলি শুধু একদৃষ্টিতে আলভীর দিকে তাকিয়ে রইলো। এই মানুষটা শুধু শারীরিক কষ্টতেই নয়, লজ্জা-অসহায়ত্বের মতো সূক্ষ্ম মুহূর্তেও একবারও বিরক্ত হয়নি। বরং সবকিছু এমনভাবে সামলাচ্ছে, যেন সে সবসময় এমনটাই করবে। অলি চোখ বন্ধ করল, ঠোঁটের কোণে একফোঁটা নীরব হাসি ফুটে উঠল। আলভী বিছানার পাশে চুপচাপ বসে ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।
বিকেলের সোনালি রোদ হাসপাতালের জানালা দিয়ে ঢুকে অলির বিছানার পাশের ফ্লোরে লম্বা ছায়া ফেলেছে। দিহান চেকআপ শেষ করে বলল,
“ভাবীকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়াই ভালো হবে। যদিও তার পুরোপুরি সুস্থ হতে দেড় থেকে দুই মাস সময় লাগবে।”
কথাটা শুনে অলি অবাক চোখে দিহানের দিকে তাকায়। পুরোপুরি সুস্থ বলতে দিহান কি বোঝাতে চাইছে? অলি নিজের শুষ্ক ঠোঁট জোড়া জিভ দিয়ে ভিজিয়ে বলে ওঠে,
“আমি শুধু জানতে চাই আমার হাত পায়ের এই ব্যান্ডেজ গুলো কবে খোলা হবে? এই ব্যান্ডেজ গুলো অনেক ভারী আমি হাত পা নাড়াতেই পারছিনা। আপনারা এই ব্যান্ডেজ গুলো খোলার ব্যবস্থা করুন। আমি তাহলেই হাটতে পারবো।”
অলির কথা শুনে দিহান মাথা নিচু করে নিলো। সে কিভাবে বলবে যে এই কাস্ট গুলো দেড় মাসের আগে খোলাই যাবেনা আর হাটাচলা তো দূরের কথা।
“আমরা তো আর কিছুক্ষণ পরেই বাড়িতে ফিরে যাবো তাইনা? বলুন।”
আলভী মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলতেই অলি দিহানের উদ্দেশ্যে বলল, “বাড়িতে ফেরার আগে আমি এই শক্ত আর ভারী ব্যান্ডেজ গুলো খুলে ফেলতে চাই ভাইয়া। আপনি কাউকে বলুন, এসে যেন এগুলো খুলে দিয়ে যায়।”
দিহান কিছু বলতে চাইলে আলভী ইশারায় তাকে চুপ থাকতে বলে। দিহানও আর কিছু না বলেই কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। অলি ভ্রু কুচকে সেদিকেই তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণ যেতেই নার্স একটা হুইলচেয়ার নিয়ে কেবিনে এলো। আলভী খুব সাবধানে অলিকে সেটাতে বসিয়ে দিতে লাগলো, বিছানা ছাড়ার সময় অলি কপাল কুঁচকে ব্যথায় হালকা,
“আহ…” শব্দটা উচ্চারণ করে ওঠে। আলভী তৎক্ষনাৎ সামনে ঝুঁকে ধীর গলায় বলে ওঠে,
“ব্যথা পেয়েছো? স্যরি আমি… এখন থেকে আরো সতর্ক থাকবো।”
উত্তরে অলি শুধু মাথা নাড়লো। হুইলচেয়ারে করে করিডরের দিকে এগোতেই বাইরে থেকে হাসপাতালের গন্ধ মিশ্রিত হাওয়া এসে লাগল অলির মুখে। গেটে এসে আলভী আগে গাড়ির পিছনের সিটে নরম কুশন ঠিক করল, তারপর নিজ হাতে অলিকে কোলে তুলে নিল। সে অলিকে এমন ভাবে যত্ন করে সিটে বসাচ্ছে, যেন ভেঙে যাওয়া পুতুলকে জায়গায় বসানো হচ্ছে।
বাড়ির দিকে রওনা হতেই শহরের বিকেল তার রঙ মেলে ধরল। রোদ ম্লান হয়ে আসছে, রাস্তায় ট্রাফিকের হালকা গুঞ্জন, দোকানের সামনে ভিড়। অলি জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরের পৃথিবী দেখছে, কিন্তু চোখেমুখে একধরনের ক্লান্তি।
বাড়িতে পৌঁছানোর পর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নূরনাহার ছুটে এসে আলভীর সাথে মিলে অলিকে ভেতরে নিয়ে এল। ড্রইংরুম পেরিয়ে সিড়ি ডিঙিয়ে সোজা আলভীর বেডরুমে নিয়ে শুইয়ে দিলো। আলভী আসার সময় একজন নার্স ঠিক করে রেখে এসেছে যে এই দুই মাস সর্বক্ষণ অলির সাথেই থাকবে। আর আলভী তো আছেই এই দুই মাস সেও বাড়িতেই থাকবে।
“নার্স কালকে সকালে এসে পড়বে। তুমি এবার রেস্ট নেও।”
আলভীর কথা শুনে অলির চোখে জল চলে আসে, কিন্তু সেটা সে দেখাতে চাইল না। অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, “আমি রেস্ট নিতে চাইনা। আমি হাটতে চাই। আমি আর শুয়ে থাকতে পারছিনা। আপনি প্লিজ ব্যান্ডেজ গুলো খুলে দিন।”
আলভী একটা শ্বাস ফেলে অলির মাথার সামনে বসলো, “আর দু চারদিন পরেই খুলে দেবো। ততোদিন তুমি একটু বিশ্রাম নেও কেমন?”
অলি চোখ বন্ধ করে কেদে ওঠে। বাড়িতে আসার কিছুক্ষণ পূর্বে আলভী যখন কাগজপত্র ঠিক করছিল, ডিসচার্জ স্লিপ, ওষুধের প্রেসক্রিপশন আর হাসপাতালের বিল মিটিয়ে নেওয়ার ব্যস্ততায় ছিলো। সেই সময় একজন নার্স এসেছিলো কেবিনে আর সেই তাকে বলে দিয়েছে যে দুই মাসের আগে সে আর নিজের পায়ে হাটতে পারবেনা। ব্যপারটা তাকে ভীষণ ভাবে আহত করেছে। সে আলভীর উপর বোঝা হয়ে কিভাবে থাকবে এতোদিন? আল্লাহ এভাবে কেনো তার পরীক্ষা নিচ্ছে? এমন অবস্থায় সেতো নামাজ আদায় করে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাইতেও পারবেনা। সে বাবা মায়ের জন্যও দোয়া করতে পারবেনা। সে দোয়া না করলে তার বাবা মা কি কষ্ট পাবেনা? পাবে তো।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই অলি কেদে ওঠে, আলভী শাওয়ার নেয়ার জন্য ওয়াশরুমের দিকেই যাচ্ছিলো কিন্তু অলির কান্নার শব্দে সে উল্টো ঘুরে অলির পাশে এসে বসলো। অলি মুখ ঘুরিয়ে নিতে চাইলেও পারলোনা। আলভী তার কপালের সাথে নিজের কপাল ঠেকিয়ে বলল,
“কান্না করেনা বউ। বললাম তো, তুমি খুব শীঘ্রই সুস্থ হয়ে যাবে। নিজের পায়ে হাটতেও পারবে।”
“আপনি কেনো আমাকে মিথ্যা বলছেন? এই ব্যান্ডেজ গুলো তো দুমাসের আগে খোলাই যাবেনা। আমি দুমাস হাটতে পারবোনা। নিজ হাতে খেতেও পারবোনা। আপনি আমাকে কেনো মিথ্যা সান্ত্বনা দিচ্ছেন?”
আলভী মুখ তুলে অলির দিকে তাকায়। অলি এখনো ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছে। আলভী একহাতে অলির চোখজোড়া মুছে দিয়ে, গালে নিজের ঠোঁট ছোয়ায়।
“তুমি কি বাচ্চার কথা ভুলে গেছো? তুমি যদি এভাবে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ো তাহলে ওর উপরেও কিন্তু এর প্রভাব পড়বে।”
“আমি আর পারছিনা। আমার কিচ্ছু ভালো লাগছেনা। আমি আর বেচে থাকতেই চাইনা।”
বলেই অলি ডুকরে কেদে ওঠে।
“এভাবে বলোনা। তুমি সুস্থ হয়ে যাবে। কিচ্ছু হবেনা তোমার।”
অলি না বোধক মাথা নেড়ে আলভীর উদ্দেশ্যে বলে,
“আপনি আমাকে দূরে কোথাও রেখে আসুন প্লিজ। আমি আর থাকবোনা এখানে। আমাকে এমন কোথাও রেখে আসুন যেখানে আপনার শত্রুরা পৌঁছাতে পারবেনা।”
কথাটা শুনে আলভী সোজা হয়ে বসলো,
“তুমি সত্যিই যাবে?”
অলি হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ে। “আমার এখানে থাকতে চাওয়াটাই ভুল হয়েছে। এই বাড়ির কেউ আমাকে দেখতে পারেনা। আমি আর থাকবোনা এখানে। আমি… আমি অনেক দূরে চলে যেতে চাই।”
আলভী ভাবনায় পড়ে গেলো। এরই মাঝে অলি আবারও বলে ওঠে, “আমি একা চলে যাবো। আপনাকে আমার সাথে যেতে হবেনা। আমি আপনার উপর বোঝা হয়ে থাকতে চাইনা। আপনি বরং রিফাতের কথামতোই আরেকটা বিয়ে করে নিন। তাহলে হয়তো সে আমাকে আর আলোকে মে*রে ফেলতে চাইবেনা।”
অলির কথাগুলো শুনে আলভী থমকে গেলো। অলি এসব কি বলছে? বেশকিছুক্ষন ভাবনা চিন্তা করে আলভী অলির দিকে তাকিয়ে দেখে অলির চোখজোড়া বন্ধ হয়ে গেছে। আলভী ঘাবড়ে গিয়ে অলিকে ডাকতে লাগলো,
“অলি… এই অলি?”
অলি কোনোপ্রকার রেসপন্স করলোনা। আলভী অলির গালে আলতো ভাবে হাত রেখে ডাকলো,
“অ… লি, অলি।”
অলি যেন ঘুমন্ত পরীর ন্যায় ঘুমিয়ে গেছে। আলভী বুঝতে পারলো অলি সেন্সলেস হয়ে গেছে। সে অলির হাতের পালস চেক করলো। পালস স্বাভাবিকের তুলনায় বেশ ফাস্ট। অবশ্য গর্ভবতী হওয়ার কারণে এটাকে অস্বাভাবিক ধরা যায়না। আলভী অলির ঘাড়ের নাড়ির পালস চেক করে দেখলো তারপর নাকের সামনে আঙুল নিয়ে দেখলো তার শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক। আলভী আলগোছে অলির বাম হাতটা হাতের মুঠোয় নিয়ে পরপর কয়েকটা চুমু খেয়ে মৃদু স্বরে ডাকতে লাগলো,
“অলি… আমার মিষ্টি বউ… চোখ খোলো প্লিজ। আমি ডাকছি তো। চোখ… খুলবেনা? প্লিজ চোখ খোলোনা।”
আলভী হাত ছেড়ে দিয়ে অলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কোমল ভাবে ডাকতে লাগলো,
“আমি সবসময় তোমার পাশেই থাকবো তো। আমি জানি… তুমি অভিমান করে দূরে চলে যেতে চাইছো। তুমি মন থেকে চলে যেতে চাওনি। আমি এও জানি আমি দ্বিতীয় বিয়ে করা তো দূর আমি কারো দিকে তাকালেও সেটা তুমি সহ্য করতে পারবেনা।”
আলভী কিছুক্ষণ চুপ থেকে ফের বলতে লাগলো,
“তুমি আমার উপর রাগ করেছো তাইনা? আমি রিফাতকে এখনো ধরতে পারিনি। সেই জন্য… সেই জন্যই অভিমান করেছো কি? আমাকে ক্ষমা করে দেওনা। আমি আর… তোমাকে একা রেখে যাবোনা। তোমার সাথে সাথেই থাকবো। প্লিজ চোখ খোলো কলিজা।”
আলভীর চোখজোড়া লাল হয়ে এসেছে। কিন্তু পুরুষদের কি কান্না করা মানায়? মানায় না, একদমই মানায় না। তবুও অলির এই অবস্থা দেখে সে নিজেকেও সামলে রাখতে পারছেনা। অলির হাতটা মুঠোয় নিয়ে সে নিজের কপালে ঠেকিয়ে রাখলো। সে কেদেছে কিনা সেটা আর দৃষ্টিগোচর হলোনা। কিন্তু তার কাধজোড়ায় মৃদু কম্পন পরিলক্ষিত হলো। শাহানাজ বেগম, ঊর্মিলা, নূরনাহার আর ইয়াদ এসেছিলো অলিকে দেখার জন্য তাদের পেছনে রূপসা আর রুনা খাতুনও আছেন তারা সবাই দরজা পর্যন্ত এসেই থেমে গেছে। আলভীকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে সবাই কিছুক্ষনের জন্য থমকে গিয়েছিলো। ঊর্মিলা এবার রুমে প্রবেশ করে খাটের দিকে এগিয়ে গিয়ে আলভীর কাধে হাত রাখে। মৃদুস্বরে ডেকে ওঠে,
“ভাইয়া।”
ঊর্মিলার ডাকে আলভী নিজেকে সামলে নিয়ে চোখ তুলে তাকায়। “ভাবীর এখন কি অবস্থা?”
আলভী অলির দিকে তাকিয়ে দেখলো অলির চোখের পাতা নড়ছে। সে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ঊর্মিলার উদ্দেশ্যে বলল, “দেখতেই তো পাচ্ছিস ওর কি অবস্থা।”
বাকি সবাই এক এক করে রুমে ঢুকে খাটের চারপাশে দাড়ালো। শাহানাজ বেগম জিজ্ঞেস করলেন,
“ও কি ঘুমিয়েছে নাকি?”
আলভী বলল, “না ঘুমায়নি। ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।”
কথাটা শুনে রূপসা আর রুনা খাতুন বাদে বাকি সবাই ঘাবড়ে যায়। শাহানাজ বেগম চিন্তিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, “বাচ্চাটা কেমন আছে? ঠিকঠাক আছেতো?”
তার কথাশুনে আলভী অবাক চোখে তাকায়। ঠাট্টার স্বরেই বলে ওঠে, “তুমি আবার কবে থেকে বাচ্চাটার কথা ভাবছো? তামাশা করছো নাকি?”
শাহানাজ বেগম ভীষণ অপমানিত বোধ করলেন,
“এভি ভুলে যাসনা আমি তোর মা, আর মায়ের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় সেই শিক্ষা আমি দিয়েছি তোকে।”
আলভী হেসে উঠলো, “কাম অন মা। তুমি ন্যাচারাল বিহেভ করলে আমিও তোমার সাথে ন্যাচারাল বিহেভ করবো। শুধু শুধু দরদ দেখাতে এসোনা।”
নূরনাহার বলে ওঠেন, “তোমার নাতি ভালোই আছে ভাবী। আমি তো তোমাকে বলেছিলামই।”
শাহানাজ বেগম গম্ভীর কন্ঠে বললেন, “ওর বর্তমান অবস্থা দেখে তো ভালো ঠেকছেনা। যদি বাচ্চাটার কোনো সমস্যা হয়ে যায়? ওকে হাসপাতালেই রাখতে পারতি।”
আলভী এবার স্বাভাবিক স্বরেই বলে, “তোমাদের কাউকেই ওকে নিয়ে ভাবতে হবেনা। নিজেদের কাজ করো গিয়ে।”
শাহানাজ বেগম চুপ থাকতে চাইলেন কিন্তু পারলেন না,
“তুই আমাদের কাজ বলতে কি বোঝাতে চাইলি? ওর গর্ভে থাকা ছেলে সন্তানটা যদি আমাদের বংশেরই হয়ে থাকে তাহলে তার খোঁজ খবর নেওয়াটাও আমাদের কাজের মধ্যেই পরে।”
শাহানাজ বেগমের কথা শুনে আলভী বেশ বিরক্ত হলো, “তোমাকে কে বলেছে যে ওর ছেলে হবে?”
নূরনাহার আমতা-আমতা করে বললেন,
“আ… আমি বলেছি বাবা। গতকাল বৌমার চেকাপের পর কেবিন থেকে বের হওয়ার সময় দুজন নার্স বলাবলি করছিলো আমি সেখান থেকেই শুনেছিলাম। আর আমিই বাড়িতে এসে ভাবীকে কথায় কথায় বলে ফেলেছিলাম।”
আলভী প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে গেলো। সে জানে ছেলে হবে শুনেই শাহানাজ বেগম আগ বাড়িয়ে অলির স্বাস্থ্যের তদারকি করতে এসেছেন। তার ভাবনার মাঝেই শাহানাজ বেগম ফট করেই বলে ওঠেন,
“ওর ছেলে বাবুই তো হবে নাকি?”
আলভী চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “হু হবে তো? তাতে কি হয়েছে?”
রুনা খাতুন আগ বাড়িয়ে বলে উঠলেন, “এভি বাবার কথা শুনে মনে হচ্ছে বাচ্চাটাকে ও পছন্দ করেনা। আচ্ছা সত্যি সত্যিই বাচ্চাটা এভির…?”
আলভী অগ্নিঝরা চোখে রুনা খাতুনের দিকে তাকানো মাত্রই রুনা মুখে লাগাম টানলেন। তবে এবার আলভী কিছু বলার আগেই শাহানাজ বেগম বলে উঠলেন,
“এই কথাটা কেউ আর কক্ষনো বলবেনা। তোমাদের কি মনে হয়? বাচ্চাটা এভির না হলে ও এই মেয়েটাকে নিজের জীবনে জায়গা দিতো?”
শাহানাজ বেগমের কথা শুনে সবাই একসাথে তার দিকেই তাকালো। রুনা খাতুন বলে উঠলেন,
“ভাবী আমার কি দোষ? এই প্রশ্নটা সর্বপ্রথম তুমিই করেছিলে কিন্তু।”
শাহানাজ বেগম অন্যদিকে তাকিয়ে বললেন,
“তখন পরিস্থিতি অন্য রকম ছিলো। কিন্তু এখন থেকে এই প্রশ্ন কেউ করবেনা।”
শাহানাজ বেগম আর একমূহুর্ত দাড়ালেন না দ্রুতপায়ে স্থান ত্যাগ করলেন। তার পিছুপিছু বাকি সবাইও প্রস্থান করলেন। আলভী একটা শ্বাস ফেলে অলির দিকে তাকাতেই দেখলো অলির জ্ঞান ফিরেছে। সে পিটপিট চোখে তাকিয়ে আছে।
এদিকে, রুনা খাতুন রূপসার রুমে এসে বসলেন।
“দেখলি, নাতি হবে শুনেই ভাবী কিরকম পল্টি খেলো?”
রূপসা চোখ পাকিয়ে বলল, “হাহ বাদ দেও তো মা”
“এবার কি করবি?”
“যা করার আমি করবো মা। তোমাকে এসবে জড়াতে চাইনা। তুমি যাও এখান থেকে।”
রুনা খাতুন চলে যেতে নিলেন কিন্তু তার আগেই শাহানাজ বেগম রূপসার রুমে এলেন। তাকে দেখে রূপসা খানিকটা অবাক হয়ে যায়।
“রূপ, আমি তোকে কিছু বলতে চাই।”
রূপসা মুখে হাসি টেনে বলে, “বলোনা মামনি কি বলবে?”
“দেখ রূপ আমি এভির বাচ্চাটাকে মেনে নিয়েছি। আমি চাই বাচ্চাটা পৃথিবীতে আসুক। তবে তুই এটা নিয়ে চিন্তা করিস না, বাচ্চাটা হয়ে গেলেই আমি নিজে এভির আর মেয়েটার ডিভোর্স করিয়ে দেবো।”
রূপসা হাসতে হাসতেই বলল, “তারপর? তারপর ওই বাচ্চাকে পালবে কে?”
শাহানাজ বেগম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠলেন,
“কেনো? তুই পালবি। এভির ডিভোর্স করিয়ে আমি তোকেই তো ওর বউ বানাবো।”
রূপসা ভীষণ রেগে গেলো কিন্তু শাহানাজ বেগমের মুখের উপর কিছুই বলতে পারলোনা। পরিস্থিতি বুঝে রুনা খাতুন বলে উঠলেন,
“আরে ভাবী তুমি এসব কি বলছো? এটা অসম্ভব। শোনো আমার মেয়ের এতোটাও খারাপ দিন আসেনি যে ওকে অন্যের পেট থেকে জন্ম নেওয়া বাচ্চা লালন পালন করতে হবে।”
“বাচ্চাটা যার পেট থেকেই জন্ম নিক, বাচ্চাটা তো এই বংশের। এভির ছেলে। তোমরা একবার ভেবে দেখো, আল্লাহ না করুক রূপসা আর এভির বিয়ের পর যদি ওদের ঘরে কোনো ছেলে সন্তান না হয় তখন? আমার ছোটো ভাইকে দেখোনি? তার তো দুই মেয়ে ইশা আর তিশা। সেই হিসেবে তার সম্পত্তির ভাগ কিন্তু আমার বড় ভাইও পাবে।”
রূপসা এবার শাহানাজ বেগমের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, “সম্পত্তির উপরে আমার কোনোকালেই লোভ ছিলোনা মামনি। আমি আমার বাবার একমাত্র সন্তান। তাছাড়া আমার বাবাও আমার দাদার একমাত্র সন্তান সেইক্ষেত্রে আমার বাবার স্থাবর অস্থাবর সব সম্পত্তির একমাত্র উত্তরসূরী আমি।”
শাহানাজ বেগম এই ব্যাপারটা জানেন। সে জানেন যে রূপসার বাবা অনেক সম্পদশালী। সেই জন্যই তো সে রূপসাকে এভির জন্য পছন্দ করে রেখেছিলেন। রূপসা বলল, “ভবিষ্যতে আমার আর এভির ছেলে হোক বা মেয়ে হোক আমার যা সম্পত্তি আছে তাতেই ওদের হয়ে যাবে।”
এই কথা শোনার পরে শাহানাজ বেগমের আর কিছুই বলার থাকলোনা। সে নিঃশব্দে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।
–—
রাতের বেলা,
আলভী অলিকে খাইয়ে দিচ্ছে। যদিও কাউকে খাইয়ে দেওয়ার অভিজ্ঞতা কোনোকালেই ছিলোনা আলভীর তবুও শশুর শ্বাশুড়ি মা*রা যাবার পর প্রায়ই সে অলিকে খাইয়ে দিয়েছে। আর এখন তো আগামী দেড়-দুমাস তাকেই হয়তো অলিকে খাইয়ে দিতে হবে। অলি চুপচাপ খাচ্ছে কোনো কথা বলছেনা। হঠাৎ করেই অলি লক্ষ্য করে আলভী তাকে খাইয়ে দেওয়ার সময় নিজেও হা করে। ব্যাপারটা সে এর আগে কখনোই লক্ষ্য করেনি। হয়তো লক্ষ্য করার মতো পরিস্থিতিতেও ছিলোনা। কিন্তু এখন এটা দেখে সে না চাইতেও হেসে ওঠে। অলির হাসি দেখে আলভী হকচকিয়ে যায়। “কি হলো?”
অলি মাথা নেড়ে বলে, “আপনার হয়তো অনেক ক্ষুধা লেগেছে। আমার মনে হয় খাবারগুলো আমার মুখে না দিয়ে আপনার নিজের মুখে দেওয়া উচিৎ।”
অলির কথা শুনে আলভী সরু চোখে অলির দিকে তাকায়। সে অলির কথা বুঝতেই পারেনি। তবে অলিকে হাসতে দেখে তার ভালো লাগছে।
“তুমি চাইলে আমি তোমার মুখ থেকে নিয়েও খেতে পারি।”
আলভী বিরবির করে বলেছে কিন্তু অলি কথাটা শুনেও না শোনার ভান করলো। খাওয়া শেষ হতেই আলভী বলে ওঠে, “তোমার জন্য একটা ভালো খবর আছে।”
অলি ভ্রু কুচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। আলভী মৃদু হেসে বলল, “কিছুক্ষণ আগেই ডিটেকটিভের কল এসেছিলো সে বলেছে তারা রিফাতের গাড়ির নম্বর কালেক্ট করতে সক্ষম হয়েছে। ২-১ দিনের মধ্যেই আমরা রিফাতকে পেয়ে যাবো। বুঝলে?”
অলি একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ে।
রূপসা সবেমাত্র ডিনার করে নিজের রুমে এসে বসেছে এরই মাঝে কেউ একজন তার দরজায় নক করে। রূপসা উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই ইয়াদ তার রুমে প্রবেশ করে। ইয়াদকে দেখে রূপসা বেশ অবাক হয়ে যায়, “তুমি?”
ইয়াদ ভ্রু কুচকে বলল, “হুম আমি। তুই কি ভাইয়াকে আশা করেছিলি নাকি?”
রূপসা বিরক্তি সূচক শব্দ উচ্চারণ করে বলল,
“সবসময় এভির কথা বলো কেনো? এভির কথা আমি ভাবতেই বা যাবো কেনো? সে কোন জন্মে আমার রুমে এসেছিলো যে আমি তার কথা ভাববো?”
ইয়াদ পাশে থাকা টেবিলের উপর একহাত রেখে মৃদু স্বরে বলল, “তুই বলতে চাইছিস যে তুই ভাইয়ার পিছু ছেড়ে দিয়েছিস?”
রূপসা চমকিত নয়নে ইয়াদের দিকে তাকায়,
“অবশ্যই ছেড়ে দিয়েছি। হ্যাঁ প্রথম প্রথম একটু আকটু কষ্ট হয়েছিলো বটে।”
রূপসা একটু থেমে পুনরায় বলল, “তোমার কি মনে হয়? আমি এখনো একজন বিবাহিত পুরুষের পেছনে ঘুরে নিজের টাইম ওয়েস্ট করবো?”
কথাটা শুনেই ইয়াদ রূপসাকে চমকে দিয়ে গেয়ে উঠলো,
“তুজে টাক টাক টাক তাকতে রেহনা
তেরি বক বক বক শুনতে রেহনা
কাম কাজ সব ভুল ভ্যুলা কে…
তেরে পিছে পিছে চলতে রেহনা
ইয়ে তো হ্যায় ওয়েস্ট অফ টাইম
লাভ ইজ আ ওয়েস্ট অফ টাইম
পেয়ার ভেয়ার ওয়েস্ট অফ টাইম
লাভ ইজ ওয়েস্ট অফ টাইম”
গানটা শুনে রূপসার মাথা ঘুরে পড়ে যাবার মতো অবস্থা। ইয়াদের কন্ঠ কাকের চাইতেও খারাপ। হিন্দি না বুঝলেও ‘লাভ ইজ আ ওয়েস্ট অফ টাইম’ এতোটুকু ভালোই বুঝতে পেরেছে রূপসা। রূপসা বোকা চোখে ইয়াদের দিকে তাকানোর সাথে সাথেই ইয়াদ রূপসার মাথায় চাপড় মে*রে বলল, “কিরে গাধী কিছু বুঝতে পারলি?”
রূপসা মাথায় হাত দিয়ে চোখ কটমট করে ইয়াদের দিকে তাকায় ৭ মাসের বড় বলেই কি তাকে এভাবে চাপড় মারবে? ইয়াদ মুখ বাকিয়ে বলল,
“চোখ নিচে নামা নইলে আরেকটা খাবি।”
“তুই… (ইয়াদ তাকাতেই রূপসা একটা ঢোক গিলে বলল) তুমি এখানে কেনো এসেছো ভাই… (ইয়াদ আবারও রাগী চোখে তাকালো) থুক্কু ইয়াদ।”
ইয়াদ একটা শ্বাস ফেলে বলল,
“এমনি ভুল করে এসে পড়েছি। ফোনে কথা বলছিলাম তো তাই খেয়াল করিনি। বাই দ্য ওয়ে আমার রুমটা তো এখানের কোথাও একটা ছিলো। তুই বলতে পারবি, আমার রুমটা কোথায়?”
রূপসা অনেকদিন যাবৎ ইয়াদকে এভাবে কথা বলতে দেখেনি। ইদানীং বলতে গেলে ইয়াদ খুব অল্পই কথা বলে তার সাথে। সেই যে এভির বৌভাতের সময় কথা বলেছিলো সেদিনের পর থেকে আজ পর্যন্ত একটাও অপ্রয়োজনীয় কথা বলেনি। যদিও এভির বিয়ের আগে ইয়াদ এভাবেই কথা বলতো। “ওই কিরে? ভাইয়ার কথা ভাবছিস নাকি?”
রূপসা ভীষণ বিরক্ত হলো। সে আর এভির ব্যাপারে কাউকেই কিছু জানাতে চায়না। কারণ বাড়ির লোকেরা উনিশ থেকে বিশ হলেই তাকে সন্দেহ করবে। আর তাছাড়া ইয়াদকে তো সে একদমই কিছু বলবেনা। ইয়াদ আবার এভি ভাইয়ের বিরাট বড় ভক্ত কিনা।
“বললাম তো, আমি আর তোমার ভাইয়াকে নিয়ে ভাবিনা।”
“বিশ্বাস হচ্ছেনা।”
“কি করলে বিশ্বাস করবে?”
“উম, একবার বল যে এভি ভাইয়ার চাইতে আমাকে বেশি হ্যানসাম দেখতে। তাহলেই আমি বিশ্বাস করে নেবো যে তুই আর ভাইয়াকে নিয়ে ভাবিস না।”
কথাটা শুনে রূপসা আহাম্মকের মতো ইয়াদের দিকে তাকিয়ে রইলো, “ওয়েট আমি এটা কেনো বলতে যাবো?”
ইয়াদ বাকা হেসে বলল, “আচ্ছা ভাবী সিড়ি থেকে পড়ে কিভাবে গেলো বলতো? আমার মনে হচ্ছে এর পেছনে নিশ্চয়ই কারো না কারো হাত আছে।”
রূপসা একটা শুষ্ক ঢোক গিলে ইয়াদের দিকে তাকাতেই ইয়াদ মিষ্টি হাসলো। তারপর দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে পেছনে তাকিয়ে বলল, “আমি বরং গিয়ে ভাইয়াকে এই বিষয়ে খোঁজ নিতে বলি। কি বলিস?”
রূপসা দুপা সামনে এগিয়ে এসে বলল,
“আরে এভি এখন বউকে নিয়ে অনেক ব্যস্ত সময় পার করছে। তার মধ্যে তুমি গিয়ে অহেতুক তাকে পেরেশান করোনা তো। আর আমি নিজের চোখে দেখেছি মেয়েটা লাফিয়ে লাফিয়ে সিড়ি বেয়ে নামতে গিয়েই পড়ে গেছে।”
ইয়াদ আঙুল উঁচিয়ে বলল, “সেটা তুই বরং প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে ভাইয়াকে বলিস কেমন?”
রূপসা একটা ঢোক গিলে বলল,
“আমি বলছিলাম কি, তুমি এভির থেকে সত্যিই দেখতে অনেক বেশিই হ্যানসাম।”
ইয়াদ ভ্রু কুচকে ঘুরে দাড়িয়ে বলল,
“কি বললি, শুনতে পাইনি।”
রূপসা এবার চিল্লিয়ে বলে উঠলো,
“বলেছি তুমি এভির চাইতেও বেশি সুদর্শন।”
রূপসার কথা শুনে ইয়াদ ঠোঁট চেপে হাসি আটকে রেখে বলে ওঠে, “নির্লজ্জ মেয়ে। ভাইকে কেউ এভাবে বলে? যাক, তুই যেহেতু ভাইয়ার পিছু ছেড়েই দিয়েছিস সেহেতু খুব শীঘ্রই তোর বিয়ের ব্যবস্থা করছি দাড়া।”
কথাটা বলে ইয়াদ হাসতে হাসতেই চলে গেলো। এদিকে রূপসা বেকুবের মতো তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো।
চলবে,,,
শব্দসংখ্যা- ৩১৫০+
#১৫_বছর_বয়সী_মা (৪৪)
#সোফিয়া_সাফা
(পাপের পরিনতি)
রাতের সময়, খোলা জানালা দিয়ে মৃদু ঠান্ডা হাওয়া রুমে প্রবেশ করছে। খাটের একপাশে অলি ঘুমুচ্ছো। কিন্তু আরেকপাশে বসে থাকা আলভীর চোখে ঘুম নেই। সে ল্যাপটপে কোনো একটা ফুটেজ সুক্ষ্ম ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। এই ফুটেজ টা হলো সেদিনের ফুটেজ যেদিন নোমান দাড়োয়ানের থেকে ডিভোর্স লেটার টা নিয়েছিলো।
এই ফুটেজ টা এর আগেও আলভী অনেকবার চেক করেছে কিন্তু তেমন কিছুই খুঁজে পায়নি। ফুটেজে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে দাড়োয়ান পোস্ট বক্স থেকে একটা খাম বের করে খামের উপরের লেখাগুলো পড়ে ভীষণ ঘাবড়ে যায়। এরপর আশেপাশে তাকিয়ে নিজের জায়গায় গিয়ে বসেন তার ঠিক ২ ঘন্টা পরেই নোমান এসে তার থেকে খামটা নিয়ে চলে যায়। আলভী দাড়োয়ানকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছে। তার কথা ছিলো,
“আমি প্রতিদিনের মতোই খবরের কাগজ নেয়ার উদ্দেশ্যে বক্স চেক করতে সেদিন গিয়ে একটা চিঠি পাই চিঠির খামের উপর লেখা ছিলো ‘খামটা নিয়ে চুপচাপ বসে থাকুন একজন লোক এসে খামটা চাওয়া মাত্রই তাকে দিয়ে দেবেন। কথার বরখেলাফ হলে আপনাকে কাজ থেকে বাদ দিয়ে দেয়া হবে।’ লেখাটা পড়ে আমি ভেবেছি এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা চিঠি তাই কথামতোই আমি একটা লোক আসামাত্রই খামটা লোকটাকে দিয়ে দিয়েছি স্যার। বিশ্বাস করুন আমি আর কিছুই জানিনা।”
আলভী দাড়োয়ানকে নানা ভাবে ভয়ভীতি দেখিয়েছিলো কিন্তু দাড়োয়ান এই একটা কথাতেই অটল ছিলেন। হঠাৎ গোঙানির শব্দ কানে আসতেই আলভী পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখে অলি ঘুমের মাঝেই ছটফট করছে। আলভী দ্রুত অলি দিকে ঝুকে—মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
“হানিবি, এই। কি হয়েছে? আমি এখানেই আছি তো ভয় পেওনা।”
অলি ঘুমের ঘোরেই বামহাত দিয়ে আলভীর পরণের শার্ট খামচে ধরে। আলভী অলির কপালে নিজের ঠোঁট ছুইয়ে একহাতে আলতো করে অলিকে জড়িয়ে ধরে।
“তোর এই অবস্থার জন্য দায়ী প্রত্যেককে আমি সর্বোচ্চ শাস্তি দেবো হানিবি। অবশ্যই দেবো।”
২ দিন পর,
ঘড়িতে এখন তিনটা ছুইছুই। অলির পার্সোনাল নার্স সায়মা কিছুক্ষণ আগেই অলির মাথায় পানি দিয়ে তার পুরো শরীর মুছে দিয়েছে। সায়মা মেয়েটার বয়স ২৫ এর কাছাকাছি হবে। অলি শুনেছে তার নাকি কিছুদিন আগেই বিয়ে হয়েছে। আর এদিকে অলি ১৫ বছর বয়সেই মা হয়ে বসে আছে। যদিও তাকে এখনো কেউ মা বলে ডাকেনা তবুও সে মাতৃত্বের স্বাদ অনুভব করতে পারে। আলভী খাবার এনে অলিকে খাইয়ে দিয়েছে। সায়মা খাইয়ে দিতে চাইলেও অলি কেবল আলভীর হাতেই খাবে বলে জেদ করে। আর আলভীও দ্বিমত না করে অলিকে যত্ন করে খাইয়ে দেয়। এরই মাঝে আলভীর ফোনে একটা কল আসে। আলভী কলটা রিসিভ না করে অলিকে পুরোটা খাবার খাইয়ে দিলো। তারপর হাত ধুয়ে এসে কলটা রিসিভ করলো। অপরপাশ থেকে কিছু একটা শুনে সে উচ্চস্বরে বলে ওঠে, “হোয়াট?”
অপরপাশ থেকে আলভীকে আরও কিছু বলা হলো। সে উত্তরে বলল, “ওকে, আমি আসছি। আমি এক্ষুনি আসছি।”
আলভী কলটা কেটে দিয়ে হাসফাস করতে লাগলো। আলভীর এরকম আচরণ দেখে অলির কপালে চিন্তার ভাজ পড়ল, “কি হয়েছে?”
আলভী ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে নিজের মানিব্যাগ টা পকেটে নিয়ে অলির দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
“ডিটেকটিভের কল এসেছিলো তারা রিফাতের গাড়ি ফলো করছিলো কিন্তু হঠাৎ করেই রিফাতের গাড়িটা ব্রেকফেল হয়ে রাস্তার পাশে থাকা গাছের সাথে ধাক্কা খায়।”
অলি অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে, “কিহ!”
“হুম, গাড়ি থেকে রিফাতকে বের করে হসপিটালে নেয়া হয়েছে কিন্তু ওর বর্তমান অবস্থা আশংকাজনক।”
অলি আর প্রতিউত্তর করতে পারলোনা। নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলো। সে জানে রিফাত শায়লার ভাই। সেক্ষেত্রে রিফাতের কিছু হলে শায়লাদের পুরো পরিবার ভেঙ্গে যাবে তার চেয়ে বড় কথা রিফাত না থাকলে তারা কিভাবে আরেকজন অবধি পৌছোবে? তার ভাবনার মাঝেই আলভী সায়মার উদ্দেশ্যে বলল,
“আমি বের হওয়ার পর দরজা লাগিয়ে দিবেন। আপনিও রুম থেকে বের হবেন না। কিছুর প্রয়োজন হলে সার্ভেন্টদের কাউকে কল করে ডেকে নেবেন।”
সায়মা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলতেই আলভী অলির দিকে তাকিয়ে একটা শ্বাস ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
–—
আলভী হসপিটালে এসে রিফাতের কেবিনের সামনে দাড়ালো। সেখানে কয়েকজন পুলিশ আর ডিটেকটিভের লোকজন ছিলো। আলভী তাদের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করে,
“ওর এখন কি অবস্থা?”
“অবস্থা ভালো নয় এক্সিডেন্টের ফলে মাথার অংশ পুরোটাই ড্যামেজ হয়ে গেছে।”
তাদের কথার মাঝেই একজন ডাক্তার কেবিন থেকে বের হয়ে নম্রভাবে বললেন,
“স্যরি, আমরা তাকে বাচাতে পারিনি। মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণের কারণে তার মৃ*ত্যু হয়েছে।”
কথাটা বলেই ডাক্তার চলে গেলেন। আলভী কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে রইলো। তারপর পুলিশের উদ্দেশ্যে বলল,
“আমার মনে হয় ব্যাপারটা ওর ফ্যামিলির লোকেদের জানানো উচিৎ।”
“হ্যাঁ আপনি চিন্তা করবেন না মিস্টার মির্জা ওনার সাথে হ্যান্ডসেট ছিলো সেখান থেকেই আমরা বাকি সব ইনফরমেশন কালেক্ট করবো আর ওনার ফ্যামিলি মেম্বার্সদেরও জানাবো।”
“ওকে। তাহলে আমি আগামীকাল আপনার সাথে দেখা করবো।”
কথাটা বলেই আলভী হসপিটাল থেকে বেরিয়ে আসে। সে কি করবে বুঝে উঠতে পারছেনা। রিফাতকে তো সে নিজের হাতে মা*রতে চেয়েছিলো। আর সেই রিফাত এতো সহজেই ম*রে গেলো? ব্যাপারটা হজম হচ্ছেনা তার। আলভী হতাশা নিয়েই বাড়িতে ফিরে আসে। এদিকে রিফাত মা*রা গেছে শুনে শায়লার জন্য খারাপ লাগলেও অলির মনটা একটু হাল্কা হয়েছে। কিন্তু আলভী ব্যাপার টা কিছুতেই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছেনা।
সন্ধ্যার শেষ আলোটুকু নিভে গিয়ে ধরনীর বুকে রজনী নেমে এসেছে। আকাশের বুকে আজ পূর্ণ চাদের উপস্থিতি। রূপসা নিজের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সেই অচেনা লোকটাকে বার্তা পাঠাচ্ছিলো। কিন্তু লোকটার আজকের বার্তা গুলো তার মনপুত হচ্ছেনা। রূপসা খানিকটা ক্ষুব্ধ হয়েই লিখলো,
—আপনি কিসের জন্য অপেক্ষা করতে বলছেন? ক্লিয়ার করে বলুন। আমি কিন্তু বিনা কারণে একমুহূর্তও অপেক্ষা করবোনা।
লোকটা প্রতিউত্তরে লেখে,
—তুমি বুঝতে পারছোনা যে এভি আমাদের কতোটা কাছে পৌঁছে গেছে? বেশি বাড়াবাড়ি করলে তুমিই এরপর ধরা পড়বে।
রূপসা রেগেমেগে লোকটার নম্বর ব্লক করে দিলো। যা করার সে একাই করবে। ওই লোকটার কথায় সে কেনো অপেক্ষা করবে? ওই লোকটা তো একটা কাজও ঠিকঠাক ভাবে করতে পারেনি। অলিকে আটকে পর্যন্ত রাখতে পারেনি। এদিকে রূপসা বাচ্চাটাকে মে*রে ফেলতে না পারলেও অলির হাত পা ভেঙ্গে তো ফেলতে পেরেছেই। বাকি কাজটুকুও সেই করতে পারবে।
পরেরদিন দুপুরের দিকে, রূপসা ক্লাস করছিলো। এরই মাঝে সে লক্ষ্য করলো ইয়াদ আজকে লাস্ট ক্লাস না করেই বেরিয়ে যাচ্ছে। রূপসা অবাক হলোনা। ইয়াদ বেশিরভাগ সময়েই ক্লাস ফাকি দেয়। কোনো সময় খেলা ধুলার জন্য তো কোনো সময় অফিসের জন্য। তবে আজকে অন্যরকম একটা ঘটনা ঘটলো ইয়াদ বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে রূপসাও চুপিসারে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলো। যেদিন ইয়াদ আগেভাগে চলে যায় সেদিন রূপসা নিজেদের ড্রাইভারকে কল করে ডেকে নেয়। আর যেদিন ইয়াদ পুরো ক্লাস করে সেদিন ঊর্মিলাসহ তারা এক গাড়িতেই চলে যায়। রূপসা আজকে ড্রাইভারকে কল না করে একটা ট্যাক্সি ডাকলো তারপর সোজা চলে এলো একটা ফার্মেসীর সামনে। ট্যাক্সি ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে সে ফার্মেসির ভেতর ঢুকলো তার চোখে মুখে একটা অস্বস্তি ভাব ফুটে উঠেছে। তবে সব অস্বস্তি সাইডে রেখে ভদ্র স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“Misoprostol 200 mcg আছে?”
রূপসার কথা শুনে ফার্মাসিস্ট, সন্দিহান চোখে তার দিকে তাকায়। তার এরকম চাহনি দেখে রূপসা খানিকটা ঘাবড়ে গেলো। সে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো আশেপাশে কেউ নেই। রূপসা আবার জিজ্ঞেস করলো,
“আপনার কাছে নেই?”
ফার্মাসিস্ট চাপা হেসে বলল, “ আছে। তবে এই ধরনের ওষুধ তো সহজে দেয়া যায়না, আপনি কি প্রেসক্রিপশন নিয়ে এসেছেন?”
রূপসা অস্থির হয়ে একটা ভাজ করা কাগজ এগিয়ে দিলো। ফার্মাসিস্ট কাগজটা খুলতেই অনেকগুলো টাকা বেরিয়ে আসে। যা দেখে সে হকচকিয়ে যায়। রূপসা বিনয়ের স্বরে বলে,
“আমি নিজের জন্যই নিতে চাইছি কিন্তু আমার কাছে প্রেসক্রিপশন নেই। আপনি দিতে পারলে দিন নইলে আমি অন্য কোথাও থেকে নিয়ে নেবো।”
ফার্মাসিস্ট টাকা গুলো আস্তে করে পকেটে রেখে একটু গম্ভীর হয়ে ফিসফিস করে বলল, “আমিই দিচ্ছি, একটু অপেক্ষা করুন।”
কথাটা বলেই সে দরজার পিছনে ঢুকে গেল। কয়েক মুহূর্ত পর ফিরে এসে একটি ছোট্ট, সাদা প্যাকেট রূপসার দিকে এগিয়ে দিলো।
“এটা অবশ্যই সাবধানে ব্যবহার করবেন, কোনোরকম সমস্যা হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন। আমার কিন্তু কোনপ্রকার দায়ভার নেই।”
রূপসা মাথা নেড়ে দ্রুত হস্তে প্যাকেটটি ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলো, তারপর ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে এল। সে রাস্তার একসাইডে দাঁড়িয়ে ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করছিলো, ঠিক তখনই রাস্তার অন্যপ্রান্ত থেকে একদল পথশিশু হঠাৎ দৌড়ে রাস্তায় নেমে গেল। একটি সিএনজি চালক ব্রেক কষতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল, গাড়িটি ঘুরে সোজা রূপসার দিকে ধেয়ে এলো।
রূপসা সরে যাওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু সময় পেল না। ট্যাক্সি ড্রাইভার ব্রেক করতে চাইলেও ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। ট্যাক্সির ধাক্কায় রূপসা রাস্তায় ছিটকে পড়লো। সে চিৎকার দেওয়ার সুযোগ টুকু পেলোনা তার আগেই ট্যাক্সির একটা চাকা তার পেটের উপর দিয়ে চলে গেলো। রূপসা ব্যথায় কুঁকড়ে উঠল, তার আধখোলা চোখজোড়া থেকে একবিন্দু পানি গড়িয়ে পড়লো, মুখ থেকে শুধু অস্পষ্ট গোঙানি বের হচ্ছে। সে হাত বাড়িয়ে দিলো কিছুটা দূরে পড়ে থাকা ব্যাগটার দিকে তখনই পথশিশুদের মধ্যে থেকে একজন এসে ব্যাগটা নিয়ে চলে গেলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকজন চিৎকার দিয়ে ছুটে আসলো, তাদের মধ্যে থেকেই কেউ একজন অ্যাম্বুলেন্স ডাকলো। রূপসার গলায় থাকা স্টুডেন্ট আইডি কার্ড থেকে নম্বর কালেক্ট করে তার মাকেও খবরটা জানিয়ে দিলো।
–—
হসপিটালের করিডোরে দাড়িয়ে আছে মির্জা ফ্যামিলির সবাই। শুধু আলভী আর ইয়াদ বাদে। আলভী শুনেছে রূপসার এক্সিডেন্টের কথা কিন্তু অলির জন্য আসতে পারেনি। তাছাড়া সবাই যেখানে আছে তার না থাকাতেও প্রভাব পরবেনা। উল্টো অলির তাকে বেশি প্রয়োজন। মেয়েটা খাটের উপর শুয়ে-বসে থাকতে থাকতে ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছে। এদিকে ইয়াদ যখন খবরটা পেয়েছিলো সে তখন অফিসে ছিলো। আলভী অফিস থেকে বিরতি নেওয়ার কারণে তাকেই আলভীর ভাগের কাজের দিকেও লক্ষ্য রাখতে হয়। যদিও উসমান আর ইয়ামিন মির্জা তাকে বেশ সাহায্য করে।
কয়েক ঘণ্টা অস্ত্রোপচার শেষে ডক্টর ওটি থেকে বের হওয়া মাত্রই ইয়াদও এসে উপস্থিত হয়। সে এসেই এগিয়ে যায় ডক্টরের দিকে,
“রূপ… কেমন আছে?”
ডাক্তার একটা চাপা শ্বাস ফেলে বললেন,
“পেলভিক এরিয়ায় ভয়ানক চোট লেগেছে, যার কারণে জরায়ুর স্থায়ী ক্ষতি হয়েছে, উনি আর কখনো মা হতে পারবেন না।”
খবরটা শুনে রুনা খাতুন চিৎকার দিয়ে উঠলেন। শাহানাজ বেগম আর নূরনাহার তাকে সামলাতে লাগলেন। আর এদিকে ইয়াদ দুপা পিছিয়ে গিয়ে পুনরায় সামনে এগিয়ে এসে, এক অবাক কান্ড করে বসল। সে হিংস্র ভাবে ডাক্তারের গলা চেপে ধরে বলল,
“ডোন্ট ডেয়ার। ডোন্ট ডেয়ার।”
ইয়াদকে আচমকা এরকম টা করতে দেখে বাকি সবাই ভড়কে গেল। উসমান আর ইয়ামিন মির্জা এসে তাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু ব্যর্থ হলেন। ইয়াদ ভীষণ চেচামেচি করছে আর অকথ্য ভাষায় ডাক্তারকে গা*লিগা*লাজ করছে। চিৎকার চেচামেচি শুনে কয়েকজন ওয়ার্ডবয় এসে ডাক্তারকে ইয়াদের হাত থেকে ছাড়ায়। ছাড়া পাওয়া মাত্রই ডাক্তার দ্রুত পায়ে চলে যেতে লাগলে ইয়াদ পেছন থেকে গর্জন করে উঠলো,
“ডোন্ট ইউ ডেয়ার রান অ্যাওয়ে। ইফ ইউ হ্যাভ দ্য গাটস, সেয় দ্যাট এগেইন!”
চলবে,,,
শব্দসংখ্যা- ১৫০০+
#১৫_বছর_বয়সী_মা (৪৫)
#সোফিয়া_সাফা
(মুখোশ উন্মোচন)
ধরিত্রীর বুকে রাতের নিকষ কালো আঁধার নেমে এসেছে। রুনা খাতুন বাদে বাকিরা বাড়িতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কেবিনের এককোনে অগোছালো ভঙ্গিমায় বসে আছে ইয়াদ। নূরনাহার এগিয়ে গেলেন সেইদিকে। ইয়াদের চোখমুখ বড্ড ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। নূরনাহার ইয়াদের কাধে হাত রাখলেন কিন্তু তার মাঝে কোনোপ্রকার ভাবাবেগ পরিলক্ষিত হলোনা। নূরনাহার আজকে ছেলের এমন রূপ দেখে রীতিমতো অবাক হয়েছে। এর আগে ইয়াদকে সে এমন বিহেভ করতে কখনোই দেখেননি।
“ইয়াদ।”
নূরনাহার ডাকলেন কিন্তু ইয়াদ পূর্বের ন্যায়েই বসে রইলো। তার দৃষ্টি শূন্যে নিবদ্ধ। নূরনাহার এবার খানিকটা বিচলিত ভঙ্গিতেই ইয়াদের কাধে ঝাকি দিলেন। প্রতিউত্তরে এবার ইয়াদ তার দিকে তাকালো।
“ইয়াদ বাড়িতে চল। ভার্সিটি থেকে অফিসে চলে গিয়েছিলি লাঞ্চও করিসনি হয়তো। চেহারার কি হাল বানিয়েছিস, ওঠ।”
ইয়াদ মায়ের হাত সরিয়ে দিয়ে বললো,
“ফুপা এখনো আসেননি। একজন পুরুষ মানুষ এখানে থাকা দরকার। তোমরা যাও, ফুপা এলেই আমি চলে আসবো।”
নূরনাহার হয়তো কিছু বলতে চাইলেন কিন্তু ছেলের শান্ত চাহনির প্রেক্ষিতে কথাটা আর বলে উঠতে পারলেন না। মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বাকিদের সাথে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।
***
সায়মা অলির চুল আচড়ে দিচ্ছে আর অলি আনমনে বসে আছে। কিছুক্ষণ আগেই ঊর্মিলা এসেছিলো তার কক্ষে আর তার কাছ থেকেই সে রূপসার ব্যাপারে জানতে পেরেছে। এক্সিডেন্টের ব্যাপারে সে আগেই জানতে পেরেছিলো কিন্তু রূপসা আর কখনো মা হতে পারবেনা ব্যাপারটা ঊর্মিলাই জানিয়েছে তাকে। অলি বাম হাতটা নিজের পেটের উপর রেখে একটা শ্বাস ফেলল। এরই মাঝে আলভী রুমে প্রবেশ করে। অলি তার দিকে তাকিয়ে দেখলো তাকে ক্লান্ত আর বিধস্ত দেখাচ্ছে। অলি কন্ঠে কিছুটা অভিমান মিশিয়ে বলল,
“কোথায় গিয়েছিলেন আপনি? আম্মা যখন রূপসা আপুকে দেখতে যাওয়ার কথা বললো তখন আপনি বললেন যে আমাকে রেখে যেতে পারবেন না। কিন্তু তারা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়া মাত্রই আপনি কোথায় উধাও হয়ে গেলেন?”
আলভী উত্তর না দিয়ে কাভার্ড থেকে কাপড় বের করতে লাগলো। অলি ভ্রু কুচকে বলে ওঠে,
“কি হলো? কোথায় গিয়েছিলেন বলুন। আপনি কেমন হ্যাঁ? মানলাম রূপসা আপু আপনাকে ভাইয়ের চোখে দেখে না কিন্তু আপনিও কি তাকে বোনের চোখে দেখেন না? কিভাবে একবারও তাকে দেখতে না গিয়ে পারলেন?”
আলভী এবার অলির দিকে চাইলো। রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বলল, “ও তো ম*রেনি। ম*রলে অবশ্যই দেখতে যেতাম।”
আলভীর কথা শুনে অলি হতভম্ব হয়ে গেলো। আলভী চোখ দিয়ে ইশারা করতেই সায়মা রুম থেকে বেরিয়ে যায়। সে চলে যেতেই আলভী রুমের দরজা লক করে দিয়ে এসে অলির সামনে বসে। অলি রাগী কন্ঠে বলে ওঠে, “আপনি একজন ডক্টর হয়ে এভাবে বলতে পারলেন? তাও আবার নিজের ফুপাতো বোনকে নিয়ে?”
“ও আমার বোন নয়। ওর মাঝে আমার বোন হওয়ার কোনো যোগ্যতাই নেই।”
অলি জিজ্ঞাসু চোখে আলভীর দিকে তাকিয়ে রইলো তখনই আলভী অলির বাম হাতটা মুঠোয় নিয়ে বলে ওঠে, “তুমি জানো ওই মেয়েটা কি করেছে?”
অলি শুধু তাকিয়ে রইলো আলভী একটা চাপা শ্বাস ফেলল, “তুমি ঠিকই বলেছিলে ফ্লোরে কিছু ছিলো আর সেটাতে স্লিপ খেয়েই তুমি পড়ে গিয়েছিলে। আর ফ্লোরে সেটা কে ফেলেছিলো জানো?”
অলি আনমনেই না বোধক মাথা নাড়ে, আলভী বলে ওঠে, “রূপসা ফেলেছিলো।”
“কিহ!”
“হু, একজন সার্ভেন্ট ওকে দেখেছিলো ফ্লোরে কিছু ফেলতে। সে পরিষ্কার করার জন্য কাপড় আনতে গিয়েছিল কিন্তু তার আসার আগেই তুমি স্লিপ করে পড়ে গিয়েছিলে।”
“আপনাকে এসব কে বললো?”
“যে দেখেছে, সেই বলেছে। তুমি যখন বলেছিলে ফ্লোরে স্লিপারি কিছু ছিল, তখনই আমার সন্দেহ হয়েছিল—নিশ্চয়ই কেউ ইচ্ছে করেই তোমাকে ফেলেছে। মিথ্যা বলব না, একবার তো নিজের মাকেও সন্দেহ করেছিলাম। কিন্তু নিশ্চিত হতে আমি বাড়ির সব সার্ভেন্টকে একসাথে ডেকে জিজ্ঞেস করি। তখনই রূপসার ব্যাপারে জানতে পারি।”
অলি স্তব্ধ হয়ে গেলো। সে ভাবতেও পারেনি রূপসা একজন মেয়ে হয়ে তার সাথে এতোবড় আর জঘন্য কাজ করতে পারে। আলভী কিছুক্ষণ চুপ থেকে গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে, “আমি সিওর যে বাড়িতে থাকা সেই সিক্রেট ক্রিমিনাল টা ওই মেয়েটাই ছিলো।”
অলি একটা শুষ্ক ঢোক গিলে বলল,
“কিন্তু আমি তো একজন ছেলের কন্ঠ শুনেছিলাম।”
আলভী অলির দিকে তাকিয়ে দেখলো অলির মুখটা চুপসে গেছে।
“ছেলেটা হয়তো রূপসার লোকই ছিলো।”
অলি মাথা নিচু করে নিলো। তার কেনো যেনো খুব খারাপ লাগছে। হঠাৎ কিছু একটা ভেবে সে আলভীর দিকে তাকায়, “আপনি কখন জানলেন যে রূপসা আপুই প্ল্যান করে আমাকে ফেলে দিয়েছিলো?”
“আজকে সকালেই জেনেছি।”
অলি জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, “আপুর সাথে যা হয়েছে তা কি এক্সিডেন্টই ছিলো?”
অলির কথাটা শুনে আলভী বিস্মিত চোখে অলির দিকে তাকায়। তার চাহনি দেখে অলি মিনমিনিয়ে বলে,
“না মানে,
“তোমার মনে হচ্ছে আমি ওর এক্সিডেন্ট করিয়েছি?”
অলি হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়তে গিয়েও না বোধক মাথা নাড়ে। আলভী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে ওঠে,
“তোমার ঠিকই মনে হচ্ছে। তবে আমার ওকে মে*রে ফেলার প্ল্যান ছিলো।”
কথাটা বলেই আলভী উঠে চলে গেলো। অলির কিছুক্ষণ লাগলো কথাটার মানে বুঝতে। যখনই সে বুঝে উঠতে পারলো তখনই সে চিৎকার দিয়ে উঠল,
“নাহহহ, কেনো করেছেন আপনি এমনটা?”
আলভী তার দিকে তাকিয়ে শান্তস্বরে বললো।
“আমার রুম সাউন্ডপ্রুফ, তোমার যতো খুশি চিল্লাও। তবে জেনে রাখো, রূপসার সময় ঘনিয়ে আসছে। ভাগ্যের জোরে বেচে গেছে। হয়তো আল্লাহ নিজেও ওর এতো সহজ মৃ*ত্যু মেনে নিতে পারেননি।”
অলি শব্দ করে কেদে উঠলো, তার কান্না দেখে আলভীর চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। কপালের রগ ফুলে উঠলো। সে এগিয়ে এসে বলল,
“তোর ভাষায় ও একটা জানো*য়ার। আর জানো*য়ারের জন্য যে কাদে সেও জানো*য়ার দের কাতারেই পড়ে।”
আলভীর কথা শুনে অলি আলভীর শার্ট খামচে ধরলো। অলির চোখমুখ লাল হয়ে গেছে, ঠোঁট জোড়াও অনবরত কাপছে।
“মানলাম রূপসা অন্যায় করেছে তার জন্য আপনি এমনটা করবেন? একটা মেয়ের কাছ থেকে মা ডাক শোনার অধিকার কেড়ে নেবেন?”
আলভীর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো,
“আমি মা হওয়ার অধিকার কেড়ে নিতে চাইনি। আমি তো ওর বেচে থাকার অধিকারই কেড়ে নিতে চেয়েছি। এসব ছোটোখাটো শাস্তি দিয়ে আমার আত্মা শান্তি পাবেনা হানিবি। ওকে আমি মে*রে ফেলবো। যে আমার হানিবিকে মা*রতে চেয়েছে তার বেচে থাকার কোনো অধিকার নেই।”
অলি ভীষণ রেগে গেলো। “আপনি এমন কিচ্ছু করবেন না।”
“আমি একশোবার করবো।”
“না, করবেন না।”
আলভী এবার রেগেমেগে অলির চুলের ভাজে হাত গলিয়ে দিয়ে তাকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বললো।
“তুই জানিস? আজকে দুপুরে ও ফার্মেসীতে Misoprostol 200 mcg কিনতে গিয়েছিলো।”
আলভী একটু থামলো তারপর আবারও বলে উঠলো,
“তুই জানিস এটা কি কাজে ব্যবহার করা হয়?”
অলি শুধু কান্নাভেজা চোখে আলভীর দিকে তাকিয়ে রইলো। আলভীর কপালে বিরক্তির ভাজ স্পষ্ট। তবুও সে ধৈর্য্য সহকারে বলতে লাগলো,
“এই ওষুধটা গ*র্ভপাত করানোর জন্য ব্যবহার করা হয়। ডাক্তারি তত্ত্বাবধান ছাড়া খেলেই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পেটের ভেতরে থাকা সন্তান নিঃশেষ হয়ে যায়। কিন্তু তাতেই শেষ নয়। তীব্র পেটমুচড়ে যাওয়া ব্যথা, অঝোর রক্তক্ষরণ, বমি, মাথা ঘোরা। তারপর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে… মায়ের জীবনটাও থেমে যেতে পারে। এটা শরীরের ভেতরে এক নরক ঝড় বইয়ে দেয়। জরায়ু যেন নিজেই সন্তানকে ছিঁড়ে বের করে দিতে উঠে পড়ে লাগে, রক্ত থামতেই চায় না, শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসে। ভুল ডোজ, ভুল সময়, বা সামান্য রিঅ্যাকশন… গর্ভের সন্তানের সাথে সাথে মায়ের জীবনও কেড়ে নেয়। হাহ… ও আজকে এই ওষুধটা কিনেছিলো তোকে খাওয়ানোর জন্য। তোর পেটের ভেতরে থাকা সন্তানটাকে মা*রার পাশাপাশি তোকেও পৃথিবী থেকে মুছে দিতে চেয়েছিলো। এখন বল, আমি কি চুপ করে বসে থাকবো? আমার হানিবিকে মে*রে ফেলার চেষ্টা করা ওই মেয়েটাকে বাঁচতে দেবো?”
কথাগুলো শুনে অলি ডুকরে কেদে উঠলো। সে ভাবতেই পারছেনা আজকে আলভী যদি রূপসার ব্যাপারে কিছুই না জানতে পারতো তাহলে… কি হতো? অলিকে কাদতে দেখে আলভী তাকে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে। তার মনে পড়ে যায় আজকে সকালে রূপসার ব্যাপারে জানামাত্রই সে দিহানকে পাঠিয়েছিলো রূপসাকে ফলো করতে। আজকে দিহানের কাজ না থাকায় সে দ্বিমত না করেই রূপসাকে ফলো করতে গিয়েছিলো। আলভীর প্ল্যান ছিলো রূপসা কলেজ থেকে বের হওয়া মাত্রই তাকে সিএনজিতে করে কিডন্যাপ করে নেওয়া। দিহান কিডন্যাপারকে সিএনজি ড্রাইভার সাজিয়ে এনেছিলো। কিন্তু রূপসাকে ট্যাক্সিতে করে কোথাও যেতে দেখে দিহান তাকে ফলো করার সিদ্ধান্ত নেয়। রূপসা ফার্মেসীতে ঢুকলে দিহান আলভীকে কল করে জানায়। আলভী খোঁজ নিয়ে দেখতে বলে যে ও কি কিনছে। রূপসা ফার্মেসী থেকে সরে যেতেই দিহান গিয়ে ফার্মাসিস্টকে হুমকি ধমকি দিয়ে কথাটা বের করেই ফেলে। আর এটা শুনে আলভী দিকবিদিকশুন্য হয়েই রূপসার এক্সিডেন্ট করানোর পরিকল্পনা করে ফেলেছিল।
***
রূপসার জ্ঞান ফিরেছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই, তাকে সরাসরি কেউ কিছু না বললেও সে কথোপকথন শুনতে পেয়েছিলো। যার দরুন সে বুঝেই গেছে যে তার সাথে কি হয়ে গেছে। রূপসা একমনে মাথার উপরে থাকা ঝুলন্ত ফ্যানের দিকে তাকিয়ে রইলো।
তার এই জীবনে কতো অপূর্নতা রয়ে গেলো। প্রথমত সে আলভীর ভালোবাসা পেলোনা। দ্বিতীয়ত আলভীর বউ হতে পারলোনা। আর তৃতীয়ত সে মাতৃত্বের স্বাদ গ্রহণ করার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে। আচ্ছা সে পেলোটা কি? যার জন্য কিশোরী মনে প্রথমবার ছন্দপতন হয়েছিলো সেই মানুষটার মনে নাকি সে একমুহূর্তের জন্যও প্রবেশ করতে পারেনি। আচ্ছা এরকম টা না হলে কি পারতোনা? সে জানে সে পাপ করেছে ভবিষ্যতেও হয়তো করবে। কিন্তু সবকিছু করবে শুধুমাত্র আলভীকে পাওয়ার জন্য। সে বাচবেনা আলভীকে ছাড়া। রুনা খাতুন রূপসার পাশেই বসে ছিলেন। সে মেয়েকে বলার মতো কিছুই খুঁজে পাচ্ছেন না। এরই মাঝে রূপসার বাবা রহিম আহমেদ কেবিনে প্রবেশ করেন। প্রথমেই সে রুনা খাতুনের উদ্দেশ্যে বলে ওঠেন,
“নেও এবার শান্তি পেয়েছো তুমি? বারবার বলেছি যে মির্জা বাড়িতে বেড়াতে যাও ঠিক আছে কিন্তু পার্মানেন্ট থাকার কথা ভাববেও না। কিন্তু তুমি আমার কথা শুনলে না। তোমার জেদের জন্যই আজকে মেয়ের এই হাল হয়েছে।”
রুনা খাতুন চোখ মুছে বললেন, “আমি কি করেছি? তোমার মেয়েই তো নানুর সাথে থাকবে বলে যেতে চেয়েছিলো।”
“একদম এক্সকিউজ দেবেনা। তুমি প্রথম থেকেই জানতে যে আমার মেয়েটা ওই আলভী মির্জার প্রতি উইক। তারপরেও জেনে-বুঝে তুমি নিয়ে গেলে কেনো ওকে? দরকার হলে তোমার মাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে পারতে। সেটা না করে আমি দেশের বাইরে যাওয়ার সাথে সাথেই মেয়েকে নিয়ে মির্জা ভিলাতে চলে গেলে। তার উপর আমি দেশে ফেরার পরেও হাজারবার বলেছি বাড়িতে ফিরে আসতে তাও শুনলেনা। ওই বিবাহিত পুরুষটার মধ্যে কি এমন দেখেছিলে তোমরা? আমার মেয়ের কোনদিকে কম ছিলো? আমি ওর থেকে বেটার কারো সাথেই রূপের বিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু এখন কি হলো এটা?”
“তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে? রূপের এক্সিডেন্ট হয়েছে সেখানে ওই বাড়িতে থাকা না থাকার কি সম্পর্ক?”
রহিম আহমেদ আবারও বলতে লাগলেন,
“আমি নিশ্চিত আমার মেয়ের মাথায় তোমার বড় ভাইয়ের ছেলের কথাই ঘুরছিলো সেই জন্যই ও রাস্তা দিয়ে চলার সময় বেখেয়ালি হয়ে গিয়েছিলো।”
তাদের তর্ক বিতর্ক শুনে রূপসা চিল্লিয়ে ওঠে,
“প্লিজ এভাবে সাউন্ড কোরোনা। বিরক্ত লাগছে আমার। যাও এখান থেকে।”
রুনা খাতুন কিছু বলতে চাইলে রহিম আহমেদ তাকে টেনে কেবিনের বাইরে নিয়ে যায়। কেবিন জুড়ে নীরবতা নেমে আসে। এসবের মাঝে হয়তো তারা কেবিনের এককোনে বসে থাকা ইয়াদকে ভুলেই গেছে। ইয়াদ কিছুক্ষণ সেভাবে বসে থেকে হঠাৎ করেই উঠে দাঁড়ায়। ধীরপায়ে এগিয়ে যায় রূপসার বেডের দিকে। রূপসা চোখ বন্ধ করে রেখেছিলো ইয়াদ মৃদু স্বরে ডেকে ওঠে,
“রূপ।”
আচমকা তীক্ষ্ণ কন্ঠে নিজের নামটা শুনে রূপসা বিরক্ত হয়ে ইয়াদের দিকে তাকাতেই ইয়াদ চাপা স্বরে বলে ওঠে,
“তুই ফার্মেসীর সামনে কিসের জন্য গিয়েছিলি?”
রূপসা উত্তর দিলোনা। শুধু মুখ বাকিয়ে অন্যদিকে তাকালো। ইয়াদ আবারও বলে ওঠে,
“যারা তোকে হসপিটালে এনেছিলো তাদের থেকেই শুনেছি যে ফার্মেসীর সামনেই তোর এক্সিডেন্ট হয়েছে। তুই সেখানে কেনো গিয়েছিলি বলবি আমাকে?”
রূপসা বুঝতে পারলো ইয়াদ নাছোড়বান্দা উত্তর না দিলে তাকে বিরক্ত করেই যাবে,
“আমার পেটব্যাথা করছিলো সেই জন্যই মেডিসিন আনতে গিয়েছিলাম।”
ইয়াদ রূপসার পানে অদ্ভুত চাহনি নিক্ষেপ করলো,
“সত্যি বলছিস?”
রূপসা একটা শুষ্ক ঢোক গিলে বলল,
“আমার কথা বলতে ভালো লাগছেনা। তুমিও চলে যাও।”
“আমি যাবোতো কিন্তু হসপিটাল থেকে বাড়িতে যাবোনা। আমি তো সেই ফার্মেসীতে গিয়ে জিজ্ঞেস করবো যে তুই কেনো গিয়েছিলি সেখানে।”
রূপসা ছলছল চোখে ইয়াদের দিকে তাকাতেই ইয়াদ কালক্ষেপণ না করে রূপসার দিকে ঝুকে গিয়ে তার গালজোড়া চেপে ধরে,
“কেনো এরকম টা করলি? কেনো এতো ডেস্পারেট তুই? কেনো এতো অধৈর্য্য? আমি বলেছিলাম না অপেক্ষা কর? কেনো আমার কথার অবাধ্য হয়েছিস? এখন এই ভুলের মাশুল কিভাবে দিবি? বল আমাকে।”
ইয়াদের শক্ত হাতের চাপে গালের হাড় ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম কিন্তু সেসব উপেক্ষা করেও রূপসা একরাশ বিস্ময় নিয়ে ইয়াদের পানে তাকিয়ে আছে,
“কিসব বলছো তুমি? তুমি আমাকে কি বলেছিলে?”
“বুঝতে পারছিস না এখনো?”
রূপসা ইয়াদের হাত সরিয়ে দিতে চাইলো কিন্তু পারলোনা। সে বুঝে গেছে, বুঝে গেছে যে এতোদিন ম্যাসেজে সে যার সাথে কথা বলতো সেই লোকটা আর কেউ নয় বরং ইয়াদ। কিন্তু ইয়াদ কেনো তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছে? কেনো আড়ালেই বা থেকেছিলো?
এরই মাঝে রুনা খাতুন আর রহিম আহমেদ কেবিনে চলে আসলেন। ইয়াদ নিজেকে সামলে নিয়ে সরে দাড়ালো।
“ফুপা যেহেতু এসেই গেছেন সেহেতু আমি বাড়িতে চলে যাচ্ছি ফুপু।”
রুনা বেগম মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলতেই ইয়াদ দ্রুত পায়ে কেবিন ত্যাগ করল। রূপসা বড়বড় চোখে তার যাওয়ার পানেই তাকিয়ে রইলো।
রাত্রী ১১ টা,
ইয়াদ সেই ফার্মেসীর সামনেই দাঁড়িয়ে আছে যেখানে রূপসা এসেছিলো। সে ফার্মেসী থেকে বেরিয়ে একজনকে কল করে গর্জে উঠলো,
“এভি রূপ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। আর বেশিকিছু জানার আগেই ওকে যেকরেই হোক আটকাতে হবে।”
ফোনের অপর পাশ থেকে ভেসে এলো,
“তুমি সিওর যে রূপসার এক্সিডেন্টের পেছনে আলভীর হাত ছিলো?”
“হুহ আ’ম ড্যাম সিওর। ফার্মেসীতে থাকা সিসিটিভি থেকে দিহান শাখাওয়াতের ফুটেজ পাওয়া গেছে। রূপসা বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই দিহান এসেছিলো এখানে।”
ইয়াদ কথা বলছিলো এরই মাঝে তার ফোনে নূরনাহারের কল আসে। সে আগের কলটা কেটে দিয়ে মায়ের কল রিসিভ করে কানের কাছে ধরলো,
“হ্যাঁলো বাবা কোথায় আছিস তুই?”
ইয়াদ বিরক্তি চেপে স্বাভাবিক গলায় বলল,
“তুমি চিন্তা কোরোনা মা আমি আমার এক ফ্রেন্ডের বাড়িতে এসেছি। সকালে বাড়িতে ফিরবো।”
মাকে ভালোভাবে ভুংভাং বুঝিয়ে দিয়ে ইয়াদ কল কেটে দিয়ে হাটা ধরলো। ২০ মিনিট পর সে তাদের সিক্রেট বাড়িতে এসে পৌছায়। দরজায় নক করতেই একজন মধ্যবয়সী পুরুষ এসে দরজা খুলে দেয়। ইয়াদ রুমে ঢুকে তার উদ্দেশ্যে বলল,
“ফোনে আর কি কথা বলবো। তাই একেবারে চলে এসেছি।”
মধ্যবয়সী লোকটা ইয়াদকে বসার জন্য চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলতে শুরু করলো,
“তো কি ভাবলে? রিফাত ধরা পড়াতে ওকে তো জানে মে*রে ফেললে। এবার রূপসাকে কি করবে?”
ইয়াদ তীক্ষ্ণ চোখে লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল,
“খবরদার ডক্টর সিদ্দিক, রূপের নাম ভুলেও নেবেন না। ভুলে যাবেন না যে ওর জন্যই আমি আপনার সাহায্য করছি।”
সিদ্দিক হাল্কা হেসে বললেন,
“তুমি তো রূপসার সাহায্য করছো ইয়াদ। আমি তো আলভীকে মা*রতে চেয়েছি। কিন্তু তোমার রূপসার জন্যই মা*রতে পারলাম না।”
ইয়াদ মেজাজ খারাপ করে বলল,
“শুনুন বললাম তো, রূপের সাথে এভির বিয়েটা কমপ্লিট হলেই এভির ডাক্তারি লাইসেন্স নষ্ট করে দেবো। সেই সাথে আপনার ক্ষতিপূরণ হিসেবে এভির ভাগ থেকে কোম্পানির ৫০% শেয়ার আপনার নামে লিখে দেবো। শুধু এভিকে মা*রা যাবেনা।”
“হুম বুঝলাম কিন্তু রূপসা ধরা পড়ার পরেও যদি ওকে বাচিয়ে রাখতে পারো তাহলে রিফাতকে কেনো মে*রে ফেললে?”
“আমি রিফাতকে মা*রিনি ডক্টর সিদ্দিক। ও নিজেই ড্রাংক অবস্থায় গাড়ি চালিয়েছে। এতে আমার কি দোষ? তাছাড়া ও বেচে থাকলে এভি এই কয়েকদিনে আমাদেরকেও ধরে ফেলতো।”
“তাহলে এখন রূপসার কি ব্যবস্থা করবে?”
ইয়াদ কিছু একটা ভেবে বলল,
“ও এখন থেকে আমার কথামতোই কাজ করবে। তাও একটা বিষয় ভালোই হলো, এভি ভাবছে রিফাত আর রূপসা মিলেই এতোকিছু করেছে। ও আমাকে নিয়ে এসব দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারবেনা।”
“তুমি ঠিক কি করতে চাইছো?”
“শুনুন পরিস্থিতি এখন এলোমেলো। এই অবস্থায় কিছুদিন চুপ থাকা উচিৎ ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করা যায়না। এভি পানি ঘোলা করে ফেলেছে। আমাদের আগে ওকে অবজার্ভ করতে হবে। তারপর ভেবেচিন্তে যা করার করবো।”
“তুমি কি ব্রেক নিতে চাইছো?”
“হ্যাঁ। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হোক। এভি এখন কোনোভাবেই আমাদেরকে সফল হতে দেবেনা। ও অনেক প্রটেকটিভ হয়ে গেছে। ওর মনের ভয়টা দূর হওয়া অবধি অপেক্ষা করা ছাড়া আর উপায় নেই।”
সিদ্দিক উঠে গিয়ে ফ্রিজ থেকে একটি কোল্ড ড্রিংকের বোতল বের করল। বোতল খোলার ঠুং শব্দের সাথে ঘরে এক মুহূর্ত নীরবতা নেমে এলো। বোতলটা ইয়াদের হাতে দিয়ে সে নিচু গলায় বললেন,
“আজ থেকে ঠিক দুই বছর আগে, ডক্টর আলভী তাসনীম মির্জা আমার জীবনটা তছনছ করে দিয়েছিল। এক রোগী মা*রা গিয়েছিল আমার হাতে, আমি রোগীর পরিবারকে সত্যটা বলিনি। আইসিইউর দরজা বন্ধ রেখে প্রতিদিন বলতাম ‘উনি এখনো লড়ছেন, শুধু দোয়া করুন।’ তারা একবুক আশা নিয়ে টাকা দিচ্ছিল, বিল দিচ্ছিল… আর আমি সেই মৃ*তদেহের অঙ্গ বিক্রির চুক্তি পাকা করছিলাম।”
সিদ্দিকের ঠোঁটের কোণে এক বিকৃত হাসি ফুটে উঠল।
“ভেবেছিলাম সব ঠিকঠাক চলবে। আলভী সেই সময় হসপিটালে কার্ডিওলজি রেসিডেন্ট ডাক্তার হিসেবে ছিলো হঠাৎ করেই একদিন সে সব জেনে গেল। আমার কোনো কথা না শুনেই সে সরাসরি পুলিশের কাছে প্রমাণ দিয়ে দিল। এক সপ্তাহের মধ্যে আমার লাইসেন্স, মান-সম্মান সব শেষ। সেই দিনই ঠিক করে নিয়েছিলাম। ওর কাছ থেকেও আমি সব ছিনিয়ে নেবো।”
সিদ্দিক একটু থেমে ইয়াদের চোখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,
“কিন্তু ইয়াদ তুমি তো দেখছি আলভী তাসনীম মির্জার চেয়েও ভালো মানুষ। যাকে ভালোবাসো তাকে অন্য একজনের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছো।”
ইয়াদ ঢকঢক করে ড্রিংকটা খেয়ে মুখ মুছে বলল,
“অন্য একজন নয় ডক্টর সিদ্দিক রূপ এভিকে ভালোবাসে।”
“তুমিও তো রূপসাকে ভালোবাসো?”
“আপনার কি মনে হয় আমি ওকে ভালোবাসলে এভির হাতে তুলে দিতে চাইতাম?”
সিদ্দিক কিছু বলতে যাবে তার আগেই ইয়াদ আবারও বলে ওঠে,
“রূপ যেমন এভিকে পাওয়ার জন্য ছটফট করে, আমি কি ওকে পাওয়ার জন্য ছটফট করি ডক্টর সিদ্দিক? রূপ যেমন এভিকে পাওয়ার জন্য নিষিদ্ধ পথ বেছে নিয়ে পাপ পূন্যের ভেদাভেদ ভুলতে বসেছে। আমি কি পেরেছি সেই ভেদাভেদ ভুলতে? পারিনি তো। পারিনি নিষিদ্ধ পদ্ধতি অবলম্বন করে ওকে নিজের কাছে টেনে নিতে। পারিনি স্বার্থপর হতে। তাহলে আমি ওকে কিভাবে ভালোবাসলাম ডক্টর?”
সিদ্দিক বললেন, “তুমি ওকে সত্যিকারের ভালোবাসো সেই জন্যই পারোনি। উল্টো রূপসাই এভির পআক্রমণাত্মক হয়ে পড়েছে। ওর অনুভূতি টা ভালোবাসা নয় ইয়াদ। ও যা করছে ভালোবেসে করছেনা। আলভীর ওয়াইফকে হিংসে করে করছে। তোমার উচিৎ ওকে এই কাজে হেল্প না করে ওকে আটকানো তারপর ওর সামনে নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করা।”
ইয়াদ হেসে উঠলো, “আপনি এভিকে মে*রে ফেলতে চান সেই জন্য আমার ব্রেন ওয়াশ করতে চাইছেন তাইনা? শুনুন, আমার ব্রেন ওয়াশ করতে আসবেন না। রূপ এভিকে ভালোবাসে তাই এভি বেচে থাকবে আর রূপকে নিয়ে সংসারও করবে। আমি চাইনা রূপ সারাজীবন এভির থেকে দূরে থেকে যন্ত্রণা পাক।”
“তুমি কি মনে করো? রূপসার থেকে দূরে থেকে তুমি যন্ত্রণা পাবেনা?”
“আমি নিজের যন্ত্রণা সহ্য করে নিতে পারবো ডক্টর কিন্তু রূপের যন্ত্রণা সহ্য করতে পারবোনা।”
“আলভী কিন্তু নিজের ওয়াইফকে অনেক ভালোবাসে ইয়াদ। তোমার কি মনে হয় তুমি জোর করে রূপসাকে বিয়ে করতে বাধ্য করলেই রূপসা আলভীর সাথে সুখে সংসার করতে পারবে?”
“অবশ্যই পারবে। তার জন্য যা যা করা লাগে সব করবো আমি।”
চলবে,,,
শব্দসংখ্যা- ২৭৫০+