#১৫_বছর_বয়সী_মা (৫৮)
#সোফিয়া_সাফা
“ভাইয়া বিশ্বাস করো। আমি শুধু মাত্র তোমার আর রূপের বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। আর কোনোকিছু চাইনি।”
“তুই কতদিন ধরে রিফাতের সাথে যুক্ত ছিলি? আর ওকে পেলিই বা কিভাবে?”
আলভীর ঠান্ডা কন্ঠ শুনে ইয়াদ একটা শুষ্ক ঢোক গিলল,
“তুমি যেদিন ভাবীকে বাড়িতে এনেছিলে তার কিছুদিন পরেই আমার কাছে রিফাতের ফোন আসে। আমি জানিনা সে কিভাবে আমার সাথে কন্টাক্ট করেছিল। কিন্তু আমি রূপের স্বার্থে তাদের সাথে হাত মেলাতে রাজি হয়েছিলাম। রিফাতের মূল উদ্দেশ্যে ছিল তোমার শান্তি কেড়ে নেয়া। তবে ও একা ছিলোনা ওর সাথে আরও একজন ছিলো।”
আলভী ভ্রু কুচকে তাকালো। সে ভাবতেই পারছেনা যে এতগুলো লোক একসাথে তার পেছনে লেগেছিলো।
“এসবের পেছনে আর কে আছে?”
,
পরপর কলিংবেলের আওয়াজে সিদ্দিক দরজা খুললেন। দরজার ওপাশে ইয়াদকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সিদ্দিক হেসে উঠলেন।
“আরে ইয়াদ তুমি? কি খবর? কয়েকদিন ধরে ফোনেও পাওয়া যাচ্ছেনা ব্যাপার কি? এসো ভেতরে এসো।”
ইয়াদ রুমে না ঢুকে সাইডে সরে দাড়ালো। সাথে সাথেই তাকে পাশ কাটিয়ে সিদ্দিককে ঠেলে আলভী রুমের ভেতরে প্রবেশ করলো। আলভী সাথে করে কয়েকজন গুন্ডাও নিয়ে এসেছে। এই গুন্ডাদের দিয়েই আলভী ইয়াদকেও ধরে নিয়ে গিয়েছিলো। এরা শহরের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর গ্যাংয়ের লোক।
“কিরে সিদ্দিক? শুধু ইয়াদকেই মিস করছিলি বুঝি? আমাকে মিস করিসনি? দ্যাটস নট ফেয়ার।”
আলভীকে দেখে সিদ্দিকের কলিজা শুকিয়ে গেলো।
“তুই এখানে?”
ইয়াদের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই ইয়াদ বলে ওঠে,
“ভাইয়া আমাকে ধরে ফেলেছিলো। আমি বাধ্য হয়েই আপনার নাম বলে দিয়েছি।”
সিদ্দিক রেগে গেল, “তুমি এটা কিভাবে করতে পারো ইয়াদ?”
আলভী ঠাস করে সিদ্দিকের গালে থাপ্পড় দিয়ে বলল,
“তোর সমস্যাটা কি আমাকে বল।”
সিদ্দিক বুঝতে পারলো এখন আর বাচার রাস্তা নেই। সে তড়িৎ গতিতে আলভীর পা জড়িয়ে ধরলো।
“আমাকে ছেড়ে দেও আলভী। আমার ভুল হয়ে গেছে।”
আলভী হেসে উঠলো। বাম হাতে প্যাচানো ওড়নাটা নাকের নিকটে এনে গভীরভাবে শ্বাস টেনে নিলো।
“তোর ভুল গুলো কি সেগুলো আগে স্বীকার কর। তারপর ভেবে দেখবো।”
আলভী পা ছাড়িয়ে সোফায় গিয়ে বসলো,
“বলতে শুরু কর।”
সিদ্দিক মেঝেতে বসেই বলতে লাগলো,
“আড়াই বছর আগে তোমার কারণে আমার ডাক্তারি লাইসেন্স বাতিল হয়ে গিয়েছিলো। তাই আমি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই রিফাতের সাথে হাত মিলিয়েছিলাম।”
“তুই রিফাতকে চিনলি কি করে?”
“ভুলে গেলে? আমি যেই হসপিটালে ডাক্তার হিসেবে ছিলাম তুমি সেখানে কার্ডিওলজি রেসিডেন্ট হিসেবে ছিলে। আমি প্রায়ই তোমাকে তোমার দুই বন্ধুর সাথে দেখতাম। সেখান থেকেই ওকে খুঁজে বের করেছিলাম।”
আলভী টেবিলের উপরে রাখা উইস্কির বোতল হাতে নিয়ে ঢকঢক করে খেতে লাগলো। খাওয়া শেষ হতেই বলল,
“কতদিন ধরে ওর সাথে মিলে আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করেছিস?”
সিদ্দিক একটা শুষ্ক ঢোক গিলল, “বেশি না একবছর।”
“অলিকে কিডন্যাপ করার পেছনে তোরও তো হাত ছিলো?”
সিদ্দিক না বোধক মাথা নাড়লে, ইয়াদ বলে ওঠে,
“উনি মিথ্যা বলছে। উনি তোমাকেও মে*রে ফেলতে চেয়েছিল ভাইয়া, শুধু আমার জন্যই পারেনি। আমি বলেছিলাম আমি তোমার মেডিক্যাল লাইসেন্স বাতিল করতে সাহায্য করবো। বিনিময়ে তোমার কোনো ক্ষতিই ওনারা করবেনা। সেই সাথে তোমার সম্পত্তির ৫০% ও আমি ওনাকে দিয়ে দেবো বলেছিলাম।”
আলভী রক্তচোখে ইয়াদের দিকে তাকিয়ে দেখলো ইয়াদ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আলভী আর কিছু শোনার প্রয়োজন বোধ করলোনা। উঠে গিয়ে সিদ্দিকের গলা চেপে ধরলো,
“তোকে আমি মে*রে ফেললেও কেউ জানবেনা কারণ তুই এমনিতেও জেল থেকে পালিয়ে এসেছিস। তাই তোকে ছেড়ে দেয়ার কোনো মানেই নেই।”
কথাগুলো বলতে বলতেই আলভী সিদ্দিকের শ্বাসরোধ করে মে*রে ফেলে। সিদ্দিকের এই বাড়িটা শহরাঞ্চল থেকে দূরে হওয়াতে তার লাশটাও বাড়ির পেছনেই পুতে দেয়। আলভী ইয়াদকে নিয়ে ফিরে যায় নিজের আন্ডারগ্রাউন্ড বাংকারে। যেটা মূলত ইয়াদকে আটকে রাখার জন্যই তৈরি করিয়েছে।
,
সকাল নয়টা, আলভী একটা সিগারেট ধরিয়ে ঠোঁটে চেপে ধরলো, সামনেই ইয়াদ বসে আছে।
“তো কি ডিসিশন নিলি?”
ইয়াদ নড়েচড়ে বসলো, “ভাইয়া ও আমাকে বিয়ে করতে রাজি হবেনা।”
“আমি ওর মতামত জানতে চাইনি। তোর সিদ্ধান্ত জানতে চেয়েছি।”
ইয়াদ নিশ্চুপ হয়ে গেল, “তুই যে এমন পাগল সেটা আমি আগে জানতাম না। জানলে নিজে তোর চিকিৎসার ব্যবস্থা করতাম।”
“আমি রূপের পাগল। আমি ওর জন্য সব করতে পারি।”
“সব করতে হবেনা শুধু ওকে বিয়ে করে নে। নইলে আই সোয়ার তোদের দুটোকেই মে*রে ফেলবো।”
“আমি ওকে কিভাবে বিয়ে করবো ভাইয়া? ও তোমাকে ভালোবাসে।”
“খবরদার এই কথাটা আর একবারও রিপিট করবিনা। ননসেন্স কোথাকার। তুই ওকে ভালোবাসিস, তোর উচিৎ ওর মস্তিষ্কের চিকিৎসা করানো।”
“ওর চিকিৎসা না, তোমাকে প্রয়োজন।”
“আমার ওকে প্রয়োজন নেই। আর শোন অনেক ভালোমানুষি দেখিয়েছিস। এবার জোর করে হলেও ওকে নিজের করে নে। অধিকার খাটা।”
ইয়াদের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো, “তুমি আমাকে জোর খাটাতে বলছো? তুমি নিজে জোর খাটাতে পেরেছিলে?”
আলভী ভ্রু কুচকে তাকালো। ইয়াদের কথা বোধগম্য হলোনা। ইয়াদ আবারও বলতে শুরু করলো,
“ভাবীকে নোমানের সাথে দেখেও তুমি জোর খাটাতে পারোনি কেনো ভাইয়া? স্বামীর অধিকার নিয়েও তো পারতে টেনে হিচরে নিজের সাথে নিয়ে আসতে। তুমি যেখানে স্বামী হয়েও অধিকার খাটাতে পারোনি। সেখানে আমি কোন অধিকার খাটাবো বলতে পারো? আমার কি আদৌ রূপের উপরে কোনো অধিকার আছে?”
“আমি এতো কিছু শুনতে চাইনা। হয় ওকে বিয়ে কর। নয় মৃত্যুকে বরণ কর।”
আলভীর কথার মাঝেই দুজন লোক একটা মেয়েকে নিয়ে এসে ঠাস করে মেঝেতে ছুড়ে মারলো।
“রূপ।”
ইয়াদ ছুটে গেলে রূপসার কাছে। রূপসার হাত, মুখ বাধা। ইয়াদ সেগুলো খুলে দিতেই রূপসা উঠে দাঁড়িয়ে আশেপাশে তাকালো। রূপসা গাড়ি থেকে নেমে কলেজে ঢোকার সময়েই দুজন লোক তাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে এসেছে।
“আমাকে এখানে কে এনেছে? ওরা কার লোক ছিল?”
আলভী সিগারেটের অবশিষ্ট অংশটা ফেলে দিয়ে বলল,
“আমি এনেছি। সেদিন তোর প্রাপ্য শাস্তিটা তোকে দিতে পারিনি। তাই আফসোস হচ্ছিলো। খুব শখ তোর মৃ*ত্যুকে আলিঙ্গন করার? তোর কি মনে হয়? আমার বউজানকে মে*রে ফেললেই আমি তোকে বিয়ে করে নিতাম?”
রূপ আলভীর দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে উচ্চারণ করলো,
“এভি?”
আলভী হেসে উঠে একজনকে ডেকে বলল,
“ওনাকে নিয়ে এসো।”
রূপসা নিজের বাহু থেকে ইয়াদের হাত সরিয়ে দিয়ে দুপা পিছিয়ে গেলো। এরই মাঝে একজন লোক রুমে প্রবেশ করলো। লোকটা হচ্ছে নিকাহ রেজিস্ট্রার,
“এখানে কি হচ্ছে?”
রূপসার কথার প্রেক্ষিতে ইয়াদ মিনমিনিয়ে বলল,
“ভাইয়া আমাদের বিয়ে দিতে চায়।”
রূপসা হতভম্ব হয়ে গেলো, “আমাদের মানে?”
ইয়াদ রূপসার দিকে দুপা এগিয়ে গেলো, “আমাদের মানে, আমার আর তোর।”
“অসম্ভব। মজা করছো, আমার সাথে?”
আলভী ভীষণ বোর হচ্ছে। সে আরেকটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল,
“মজাই করছি। তোদেরকে বাচিয়ে রাখবো ভাবতেই পারিনি। তোদের হাতে দশ মিনিট আছে। আমার মাইন্ড চেঞ্জ হওয়ার আগেই বিয়ে কর। নইলে দুটোকেই এখানে পুতে ফেলবো।”
ইয়াদ জানে আলভী মজা করছেনা। সে নিজের চোখে আলভীকে খু*ন করতে দেখেছে। ইয়াদ রূপসার হাত ধরতে গেলে রূপসা পিছিয়ে যায়।
“আমি তোমাকে বিয়ে করবোনা।”
আলভী ভ্রু কুচকে রূপসার দিকে তাকায়। মনে পড়ে যায় অলির কথা। অলিকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার পর অলি বলেছিল,
***আমি ম’রে যাবো তবুও আপনাকে বিয়ে করবোনা। আপনাকে বিয়ে করার আগে আমি দরকার হলে বি’ষ খেয়ে নেবো***
আলভী এবার উঠে দাড়ালো, রূপসার দিকে এগিয়ে যেতেই ইয়াদ রূপসার সামনে এসে দাঁড়ায়,
“ভাইয়া ওকে কিছু বলোনা। আমি ওকে বিয়ে করে নেবো।”
“ওকে সাবধান করে দে, আর একবার যদি বিয়ে করবোনা শব্দটা উচ্চারণ করে তাহলে আমি ওর পোস্ট মর্টেম করার ব্যবস্থা করবো।”
রূপসা এবার শুষ্ক ঢোক গিলল। আলভীকে স্বাভাবিক দেখাচ্ছেনা। চোখদুটো লাল টকটকে হয়ে আছে। যে কেউ দেখলেই ঘাবড়ে যাবে।
“তোরা আমার বউজানকে মা*রতে চেয়েছিস। তবুও এবারের মতো ছেড়ে দিচ্ছি। এর থেকে আর বেশি কিছু কি চাই তোদের? কি ভেবেছিস? পার পেয়ে যাবি? নো ওয়ে আমার বউজানের চোখের সামনেই তোদেরকে শাস্তি দেবো। ততোদিন ম্যারিড লাইফ উপভোগ কর। দেখলি আমি কতোটা মহান। তোরা আমার আর অলির ডিভোর্স করাতে চেয়েছিস। আর আমি তোদের বিয়ে দিতে চাইছি। তোদের কি আমার শুকরিয়া আদায় করা উচিৎ নয়?”
ইয়াদ নিশ্চুপ হয়ে রইলো। রূপসা ছলছল নয়নে আলভীর দিকেই তাকিয়ে আছে,
“তোদের হাতে আর আট মিনিট সময় আছে।”
ইয়াদ এবার রূপসার দিকে তাকালো।
“চল।”
“নাহ আমি তোমাকে বিয়ে…
বাক্যটা শেষ করার পূর্বেই ইয়াদ বেশ জোরেশোরেই রূপসার গালে চড় দিয়ে বসলো। তারপর রূপসার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল সামনের দিকে। নিকাহ রেজিস্ট্রার বললেন,
“বিয়ে পড়ানোর জন্য তো এনআইডি কার্ড লাগবে।”
ইয়াদ আলভীর দিকে তাকাতেই আলভী বলল,
“আমার দিকে তাকাচ্ছিস কেনো?”
“ভাইয়া আমার ফোনটা দাও সেটার ভেতরেই এনআইডি কার্ডের ছবি আছে।”
আলভী একজনকে ইশারা করতেই লোকটা ইয়াদের ফোনটা এগিয়ে দেয়।
“আমার ফোনে এনআইডি কার্ডের ছবি নেই।”
রূপসার কথায় ভ্রুক্ষেপ করলোনা ইয়াদ। রূপসার হাত থেকে জোরপূর্বক ফোনটা নিয়ে রুনা খাতুনকে ম্যাসেজ পাঠালো,
—মা আমার এনআইডি কার্ডের ছবিটা লাগবে দু মিনিটে খুঁজে ছবি তুলে পাঠাও।
৫ মিনিট পেরোতেই রুনা খাতুন রূপসার এনআইডি কার্ডের ছবি তুলে পাঠিয়ে দিলেন।
বিকাল বেলা,
“তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছেনা তো?”
নোমানের কথায় অলি মুখ তুলে চাইলো। না বোধক মাথা নেড়ে বলল,
“বাসে চড়ার অভ্যাস আছে আমার।”
নোমান একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলল, “আচ্ছা আমরা তো তোমার খালার বাড়িতে যাচ্ছি তাইনা?”
“না রাবেয়া আন্টি আমার খালা নন। মায়ের বান্ধবী ছিলেন। আমরা সেখানেই যাচ্ছি।”
“আমি কি জানতে পারি যে আমরা সেখানে কেনো যাচ্ছি?”
অলি কোলে থাকা আরিশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি শুধু জানতে চাইবো, সে কেনো কাউকে কিছু না বলে চলে এসেছিলো।”
“তুমি তার ঠিকানা জানো কিভাবে?”
“২ বছর আগে মায়ের সাথে আন্টির গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলাম। সেই জন্যই ঠিকানা টা একটু আকটু জানা আছে।”
“তোমার কি মনে হয় আন্টি আংকেলের মৃ*ত্যু স্বাভাবিক ছিলোনা?”
“জানিনা। এতদিন সব স্বাভাবিক লাগলেও ইয়াদের বিষয়ে জানার পর সন্দেহ হচ্ছে। আচ্ছা আপনিই তো সেদিন আমাকে কিডন্যাপ করেছিলেন। আপনি কি এই ব্যাপারে কিছু জানেন?”
নোমান ভাবুক ভঙ্গিতে বলল, “আমার মনে হয়না যে তোমার বাবা মায়ের মৃ*ত্যুতে কারো হাত ছিলো। আর থাকলেও আমি জানিনা। আমাকে শুধু তোমাকে কিডন্যাপ করারই অর্ডার দেয়া হয়েছিল।”
“আমি এটাই বুঝতে পারছিনা যে বাবার সাথে মোবাইল ছিলো। সেটা কোথায় হাওয়া হয়ে গেলো। মোবাইলটা থাকলে অন্তত হসপিটালের লোকেরা আমাদের আত্মীয়দের সাথে যোগাযোগ করতে পারতেন।”
অলির কথায় যুক্তি আছে। নোমান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠলো,
“আচ্ছা তোমার চাচাতো দেবর ‘ইয়াদ’ তোমাকে মারতে চেয়েছিলো সেটা জানার পরেও তুমি ওকে কিছুই বলবেনা?”
অলি শান্তকন্ঠে বলল, “ওকে যা বলার ওর ভাই-ই বলবে।”
নোমান চমকে গেল, “আলভী ভাই কিভাবে জানবে যে এসবের পেছনে ইয়াদ আছে?”
প্রশ্নটা শুনে অলির মনে পড়ে যায় সেদিন মির্জা ভিলা থেকে পালিয়ে আসার সময় ব্যাগ আনতে বাগানে গিয়েছিলো সে। সেখানে গিয়েই ইয়াদের ব্যাপারে একদম নিশ্চিত হয়েছিল। মির্জা ভিলা থেকে বের হওয়ার পরেই তার মনে হতে থাকে,
“আমি সবাইকে এভাবে ছেড়ে দিয়ে যেতে পারিনা। ঘরের শত্রু বিভীষণ। ইয়াদের মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমার পুরোপুরি ধারণা নেই।”
কথাটা ভেবেই অলি আবারও মির্জা ভিলাতে প্রবেশ করে। আসার সময় আলভীর রুমে থাকা মেইন গেটের এক্সট্রা চাবিটা আনার সুবিধার্থে প্রবেশ করতে তার বিশেষ ঝামেলাও হয়না। যদিও এরই মাঝে সে ক্লান্ত হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে যেকোনো সময়েই জ্ঞান হারাবে। তবুও অলি ফুলদানির উপরে রেখে যাওয়া নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে নোটপ্যাড ওপেন করলো তারপর সেখানেই চিঠির মতো করে সবকিছু তারাহুরো করে লিখে দিলো। বেশি সময় না থাকাতে অলি ততটা গুছিয়ে লিখতে পারেনি। এরই মাঝে ঊর্মিলা পানি খাওয়ার জন্য রুম থেকে বের হয়। তাকে বের হতে দেখে অলি ফুলদানির পেছনেই লুকিয়ে পড়ে। ঊর্মিলা নিচ থেকে জগে পানি ভরে নিজের রুমে যেতেই অলি সময় নষ্ট না করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে ৩০ মিনিট হাটার পর একটা বড়সড় ট্রাক নজরে পড়ে। অলি জানে এই রাতে ঘোরাঘুরি করাটা সেফ হবেনা। তার উপর শরীরের দূর্বলতাও জানান দিচ্ছে এখন আর সম্ভব নয়। অলি ব্যাগটা কাধে ঝুলিয়ে ওড়নার সাহায্যে আরিশকে নিজের সাথে বেধে নিলো। তারপর ট্রাকের পেছনে চেপে বসলো। সেটা ছিলো মূলত পাটবাহী ট্রাক। অলি সেখানে বসে থাকতে থাকতেই ঘুমিয়ে যায়। সকালে পানির ঝাপটায় তার ঘুম ভাঙ্গে৷ অলি তাকিয়ে দেখে একজন বয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে আছে,
“এই মেয়ে কেডা তুমি? গাড়ির মধ্যে কি করো?”
অলি দ্রুত মাথা নেড়ে গাড়ি থেকে নেমে গেলো। চারপাশে আলো ফুটে গেছে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো সে রেলস্টেশনের কাছাকাছি আছে। একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে অলি হাটা ধরলো কিন্তু লোকেদের নজর দেখে সে থমকে গেলো। তার পায়ে জুতো নেই। জামাটাও নোংরা হয়ে গেছে। সেই সাথে প্রচুর ক্ষুধা লেগেছে। অলি এবার না পেরেই একটা দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“আশেপাশে কোথাও টাকা তোলার সিস্টেম আছে?”
দোকানদার অলিকে ইশারায় একটা ব্যুত দেখিয়ে দিলেন। অলি সেদিকে এগিয়ে গিয়ে প্রথম বারের মতো টাকা তুললো। সে টাকা তুলতে চায়নি কিন্তু এভাবে সে ক্ষুধার তাড়নায় মা*রা যাবে। এছাড়া আর উপায় নেই। অলি ক্রেডিট কার্ড সমেত টাকাগুলো ব্যাগে না রেখে নিজের কাছেই রাখলো। স্টেশনে অনেক সময়ই ব্যাগপত্র ছিনতাই হয়ে যায়। তাকে সতর্ক থাকতে হবে। অলি সেখান থেকে বেরিয়েই প্রথমে মার্কেটে ঢুকলো। নিজের জন্য বোরকা, নিকাব আর আরিশের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনলো। তারপর খাওয়াদাওয়ার জন্য রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসলো। যদিও অলি বেশি কিছুই খেতে পারলোনা। খুবই সামান্য পরিমানের খেলো। আরিশের জন্য হলেও তাকে শেষ পর্যন্ত লড়াই করতে হবে। এরই মাঝে সিদ্ধান্ত নিলো সে সিলেটে যাবে। তার মায়ের বান্ধবীর বাড়িতে। এছাড়া অন্য কোথাও গেলে আলভী খুব সহজেই তাকে পেয়ে যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। অলি টিকেট কেটে ট্রেনে উঠে বসলো।
অলির কথাগুলো শুনে নোমান কিছুটা স্বস্তি পেলো। অলির দেয়া ঠিকানা অনুযায়ী রাবেয়া আখতারের বাড়ি এখান থেকে বেশি দুরে নয়।
সন্ধ্যার আগেই অলি আর নোমান রাবেয়া আখতারের বাড়িতে এসে পৌছায়। দরজায় নক করতেই এক তরুণী দরজা খুলে দেয়। দরজা খুলে অলিকে দেখে তরুনীটি ভীষণ আনন্দিত হয়ে গেলো,
“আরে অলি তুমি?”
“হ্যাঁ রায়া আপু। কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। ভেতরে এসো।”
অলি আর নোমান ড্রইংরুমে এসে বসতেই রায়া মাকে ডাকতে লাগলো,
“ও মা দেখে যাও কে এসেছে।”
রাবেয়া আখতার কিচেন থেকে বেরিয়ে অলিকে দেখেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন,
অলি ভদ্রভাবে সালাম দিলো, “আসসালামু আলাইকুম আন্টি।”
রাবেয়া আখতার সালামের জবাব দিলেন। যদিও তাকে দেখে অন্যমনস্ক লাগছে তবুও জিজ্ঞেস করলেন,
“কেমন আছো অলি?”
“ভালো আছি আন্টি। আপনার কি অবস্থা? এভাবে কাউকে কিছু না বলে চলে এলেন কেনো?”
রাবেয়া আখতার অলির উদ্দেশ্যে বললেন,
“সব কথাই বলবো মা, তুমি এতোদূর থেকে এসেছো। আগে ফ্রেশ হয়ে এসে খাওয়া দাওয়া করো।”
অলি স্বাভাবিক গলায় বলল, “না আন্টি আমি শুধু জানতে এসেছি যে সেদিন আমি কিডন্যাপ হওয়ার পর ঠিক কি ঘটেছিল। সেটুকু জেনেই চলে যাবো।”
রাবেয়া আখতার অলির সাথে নোমানকে দেখে অবাক হলেন। এরই মাঝে চোখ পড়ল আরিশের উপর,
“বাচ্চাটা কার অলি?”
অলি আরিশের গালে হাত রেখে বলল, “আমার ছেলে।”
রাবেয়া চমকালেন না। সে অলির প্রেগ্ন্যাসির ব্যাপারে জানতেন। আসমা বানু বলেছিল। স্বাভাবিক গলায় শুধালেন,
“জামাই কোথায়? তাকে তো দেখছিনা।”
“তার কাজ ছিলো তাই আসতে পারেনি। উনি আমার বন্ধু ওনাকে নিয়েই এসেছি।”
রাবেয়া আখতার নোমানকে উপর নিচ পরখ করে বললেন,
“আরে এনাকে নিয়েই তো সেদিন তোমার আর জামাইয়ের মাঝে ঝামেলা হয়েছিল তাইনা?”
অলি অস্বস্তিতে পড়ে গেল, মিনমিনিয়ে বলল,
“সেদিন আলোর বাবা ভুল বুঝেছিলেন। এখন সত্যিটা জানেন।”
রাবেয়া আখতার মুখে হাসি টেনে বললেন, “আজকে তোমাদেরকে কিছুতেই যেতে দিচ্ছিনা। সেদিনের ব্যাপারে সবকিছু বলবো কিন্তু তার আগে ফ্রেশ হয়ে খাওয়াদাওয়া করে নেও।”
রায়া এগিয়ে এসে অলির হাত ধরলো, “মা ঠিকই বলেছে। তুমি আমার সাথে চলো।”
অলি আর না করতে পারলোনা রায়ার সাথে চলে গেলো। এই বাড়িতে রাবেয়া আখতার নিজের ছোট ভাই আর দুই মেয়েকে নিয়ে থাকেন। নোমানকে সে ভাইয়ের রুম টাই দেখিয়ে দিলেন।
***
“আপু বাবুটা এত্তো সুন্দর কেনো?”
রিদির কথা শুনে রায়া হাসলো। রিদি হচ্ছে রায়ার ছোটো বোন ক্লাস সিক্সে পড়ে। আর রায়া এবার ইন্টার সেকেন্ডে ইয়ারে উঠেছে।
রায়া আরিশের গায়ে কাথা টেনে দিয়ে বলে,
“অলি দেখতে সুন্দর তো তাই ওর বেবিও সুন্দর।”
রিদি কিছুটা ভাবুক ভঙ্গিতে বলল, “কিন্তু বাবুটা মোটেও অলি আপুর মতো দেখতে না।”
অলি হাতমুখ ধুয়ে বেরিয়ে এসে রিদির কথা শুনতে পায়। তবে কিছুই বলেনা,
“আচ্ছা আপু তোমার বিয়ে হয়ে গেলেও কি এই বাবুটার মতো তোমারও একটা বাবু হবে?”
কথাটা শুনে রায়া থতমত খেয়ে গেল। এই মেয়েটা বড্ড বেশিই পাকামো করে,
“এই তুই এসব কি বলছিস? আমার বিয়ের বয়স হয়েছে নাকি?”
রিদি মুখ বাকালো, “তুমি তো অলি আপুর থেকে বড় ক্লাসে পড়। তবুও তোমার বয়স হয়নি বলছো?”
“একটা চড় খাবি। যা গিয়ে পড়তে বোস।”
“এরকম করো কেনো আপু? একটা বিয়ে করে নেওনা। আমারও এরকম একটা বাবু চাই।”
“তোর বাবু লাগলে তুই-ই বিয়ে করে নেনা।”
“তাহলে আমার বিয়ে দিয়ে দেও। আমার একটা বাবু চাই।”
রায়ার এবার ভীষণ হাসি পেল, “বোকা মেয়ে। বেবি শুধু দেখতেই সুন্দর হয়। পালতে বহুত কষ্ট।”
“কিরকম কষ্ট?”
“এইযে বেবিকে গোসল করাতে হয় খাওয়াতে হয়, ঘুম পাড়াতে হয়।”
রায়া আরও কিছু বলতে যাবে তার আগেই কেউ বলে ওঠে,
“বেবির হাগুমুতুও পরিষ্কার করতে হয়।”
কথাটা শুনে অলি, রিদি আর রায়া ৩ জনই দরজার দিকে তাকালো। নোমান দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রায়া জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই নোমান বলে ওঠে,
“সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট আর কমপ্লিকেটেড কাজ হচ্ছে বেবির হাগুমুতু পরিষ্কার করা। আপনি সেটা বলতেই ভুলে গেছেন। আমি মনে করিয়ে দিলাম।”
রায়ার কপালে ভাজ পড়লো। লোকটাকে কথার মধ্যে বা হাত ঢোকাতে কে বলেছে সেটাই বুঝতে পারছেনা।
“শুনুন আমি বলতে ভুলে যাইনি। উল্টো আপনিই যেচে পড়ে বলতে এসেছেন।”
নোমান কথা বাড়ালোনা। অলির সামনে এসে দাঁড়ালো।
“আন্টি ডাকছে, চলো।”
অলি মাথা নেড়ে আরিশকে কোলে তুলে হাটা ধরলো।
খাওয়া দাওয়া শেষে রাবেয়া আখতার বলতে শুরু করলেন,
“সেদিন অলি কিডন্যাপ হবার পর ভাই অনেক অসুস্থ হয়ে যান। এরই মাঝে আসমাও অপারেশন চলাকালীন মা*রা যায়। খবরটা শোনামাত্রই ভাইয়ের অবস্থা আরও খারাপ হতে শুরু করলো, আমি তাকে সেই হসপিটালেই ভর্তি করি। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হয়না। ভাইয়ের ফোন তখন আমার কাছেই ছিলো। এরই মাঝে একজন লোক এসে আমাকে ভয় ভীতি দেখাতে শুরু করে। বলে যে আমি যদি অলির কিডন্যাপের বিষয়ে কাউকে কিছু বলি তাহলে আমাকে গুম করে দেবে। এবং আমাকে শহর ছাড়তেও বাধ্য করে। ভুলবশত ভাইয়ের ফোনটা আমার ব্যাগেই থেকে যায়। পরবর্তীতে ভয় পেয়ে আমি সেটা ফেলে দিয়েছিলাম।”
সবকিছু শোনার পর অলি স্তব্ধ হয়ে গেল। চোখের কার্ণিশ বেয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়তেই খুব সন্তর্পণে মুছে নিলো।
“আমাকে ক্ষমা করে দিও অলি। সেদিন আমার পালিয়ে আসাটা উচিৎ হয়নি। আমার পুলিশের কাছে যাওয়া উচিৎ ছিল।”
অলি হাসার চেষ্টা করে বলল, “না আন্টি আমি এখানে আপনার কোনো দোষ দেখছিনা।”
***রাত ৯ টা,
ইয়াদ ধীর পায়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। তার একপাশে রূপসা, মুখটা ফ্যাকাশে। দু’জনকে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বাড়ির ভেতরের বাতাস মুহূর্তে ভারী হয়ে গেল। কারও মুখে কথা নেই, কিন্তু চোখগুলো বিস্ময়ে স্থির হয়ে আছে তাদের দিকে। সবার দৃষ্টি এড়িয়ে হনহন করে ভেতরে ঢুকে গেল আলভী। মুখাবয়ব বরাবরের মতোই অনূভুতিশূন্য। ড্রইংরুমে ঢুকেই ভারী শরীরটা ছুড়ে দিলো সোফার উপর। কুশনের চাপা শব্দ চারপাশের নিস্তব্ধতা ভাঙ্গলো ক্ষণিকের জন্য।
হঠাৎ ছেলেকে চোখের সামনে পেয়ে নূরনাহার আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। কাঁপা হাতে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেদে উঠলেন,
“বাবা কোথায় ছিলি? এরকম টা কেউ করে?”
ইয়ামিন মির্জা ব্যস্ত কন্ঠে বললেন, “তুই ঠিক আছিস তো?”
ইয়াদ হ্যাঁ বোধক মাথা নেড়ে মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,
“আমি তোমাদের সামনে আসার সাহস পাচ্ছিলাম না মা। আসলে আমি অনেক বড় একটা অন্যায় করে ফেলেছি।”
ইয়াদের কথায় নূরনাহার কান্না থামিয়ে সোজা হয়ে দাড়ালেন। একবার রূপসার দিকে গভীর চোখে চেয়ে ফের ইয়াদের পানে তাকালেন,
“কি করেছিস তুই?”
ইয়াদ ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি রূপকে বিয়ে করেছি মা।”
কথাটা যেন বজ্রপাতের ন্যায়ে নূরনাহারের মাথায় আঘাত হানলো।
“কিহ! তুই মজা করছিস আমার সাথে?”
রূপসা এবার জড়োসড়ো হয়ে দাড়ালো। ছোট মামী তাকে আগে থেকেই ততটা পছন্দ করেনা। আর এখন তো…
ইয়ামিন মির্জা ইয়াদকে টেনে অন্য সাইডে নিয়ে গেলেন,
“তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে? কি বলছিস এসব?”
“আমি সত্যিই বলছি বাবা।”
নূরনাহার দুপা পিছিয়ে গেলেন। একি করে ফেলল তার ছেলে? শাহানাজ বেগম সহ বাড়ির বাকি সদস্যরাও স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নূরনাহার এবার চিল্লিয়ে উঠলেন,
“এটা তুই কি করলি হতভাগা? একটা বন্ধ্যা মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে এলি?”
কথাটা শুনে রূপসা দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতা হারিয়ে ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়লো। এই কথাটা এতোটা ভারী কেনো? যতবার শোনে ততবারই ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। ততবারই মনে হয় প্রথমবার শুনছে। আলভী একমনে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। ফোনের স্ক্রিনে হাসোজ্জল মেয়েটিকে শতবার দেখলেও যেন চোখ ভরেনা। তার মনে পড়ে যায় সেদিনের কথা যেদিন সে অলিকে নিয়ে এবাড়ির চৌকাঠে পা রেখেছিল। সেদিন অলির পেটে আরিশ ছিলো। আর আজ রূপসাও বউ হিসেবে এই একই চৌকাঠে পা রেখেছে তবে বন্ধ্যাত্ব নিয়ে। আলভী এই দৃশ্য গুলো এনজয় করার জন্যই তো বাচিয়ে রেখেছে ওদের।
পুরো ১ ঘন্টা যাবত বাকবিতন্ডার শেষে অবশেষে ইয়াদ সবাইকে বুঝিয়ে শুনিয়ে রূপসাকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি পেয়ে যায়। নূরনাহার আর কিইবা করবেন? একমাত্র ছেলে, রেগেমেগে চলে গেলে? সে অবশ্য জানে ইয়াদ উপরে উপরে হাসিখুশি দেখালেও ভেতরে ভেতরে ভীষণ জেদি।
ইয়াদ রূপসাকে নিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। অবশ্য রূপসা পায়ে হেটে যায়নি। ইয়াদ তাকে কোলে করে নিয়ে গেছে। আলভী একভাবেই বসে আছে। তাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে ঊর্মিলা আর শাহানাজ বেগম এগিয়ে গেলেন।
“এভি, ইয়াদ এটা কি করলো?”
আলভী প্রাণহীন কন্ঠে জবাব দিল, “সেটাই যেটা তোমরা আমাকে দিয়ে করাতে চেয়েছিলে।”
ঊর্মিলা মাকে থামিয়ে দিয়ে ভাইয়ের কাধে হাত রাখলো,
“ভাইয়া ডিনার করে নিবি আয়।”
“আমি খেয়েই এসেছি।”
ঊর্মিলার একটা শ্বাস ফেলে ভাইয়ের দিকে তাকালো,
“কি খেয়েছিস? তোর কি মনে হচ্ছেনা ইদানীং তুই একটু বেশিই ওসব খাচ্ছিস?”
“কোনসব?”
শাহানাজ বেগম আফসোসের সুরে বললেন,
“তুই এরকম না করে বউকে খোঁজার চেষ্টা কর। মেয়েটা অভিমান করে চলে গেছে। তোর কি ওকে খুঁজে এনে মান ভাঙ্গানো উচিৎ নয়?”
ঊর্মিলাও তাল মেলালো, “হ্যাঁ ভাইয়া। তুই সবসময় ভাবীর কথাটা এড়িয়ে যাস কেনো?”
আলভী কোনো উত্তর দিল না। নিঃশব্দেই অলির ছবির দিকে তাকিয়ে রইল। শাহানাজ বেগম একটা শ্বাস ফেলে ডাইনিং রুমের দিকে পা বাড়ালেন। এদিকে আলভী ফোনের স্ক্রিনের উপর হাত রেখে ধীরে ধীরে ঠোঁট নাড়ল। প্রথমে শব্দগুলো স্পষ্ট হয়নি, পরে বোঝা গেল, সে আস্তে আস্তে গাইছে।
*ভাড়া কইরা আনবি মানুষ
কান্দিতে মোর লাশের পাশে
চারিদিকে রাখবি নজর,
সে না যেন দেখতে আসে।
সে যদি পায় রে খবর,
কেমনে দিবি লাশের কবর?
আমারে জাগিতেই হবে
যদি গো তার নয়ন ভাসে
চারিদিকে রাখবি নজর,
সে না যেন দেখতে আসে
গানটা শুনে শাহানাজ বেগম থমকে গেলেন। ঊর্মিলা অবাক চোখে ভাইয়ের দিকে চেয়ে রইলো। আলভীর চোখের সামনে ভেসে উঠলো অলির নামাজ আদায় আর কোরআন তেলওয়াতের দৃশ্য। গান থামেনি, বরং আরও ভারী হয়ে উঠল। প্রতিটি লাইন যেন আলভীর বুক ফুঁড়ে বেরোচ্ছে।
তার হৃদয় যেন পবিত্র
ওই মদিনারই মাটি
আমি তার হৃদয়ে বিছাইয়াছি
জায়নামাজের পাটি রে
জায়নামাজের পাটি
পাঁচ ওয়াক্ত মোনাজাতে
বলিতো সে জোড়া হাতে
আখেরাতের পরেও যেন
আমারে সে ভালোবাসে
চারিদিকে রাখবি নজর,
সে না যেন দেখতে আসে
আলভীর চোখ বেয়ে একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো অলির ছবির উপর। আলভী ঝাপসা চোখেই অলির স্নিগ্ধ সরল মুখপানের দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় পুনরায় গেয়ে উঠলো,
ভাড়া কইরা আনবি মানুষ
কান্দিতে মোর লাশের পাশে
চারিদিকে রাখবি নজর,
সে না যেন দেখতে আসে।
সে যদি পায় রে খবর,
কেমনে দিবি লাশের কবর?
আমারে জাগিতেই হবে
যদি গো তার নয়ন ভাসে
চারিদিকে রাখবি নজর,
সে না যেন দেখতে আসে*
শাহানাজ বেগম ছুটে এসে আলভীকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেদে উঠলেন,
“এসব তুই কি বলছিস এভি?”
“আমি একমূহুর্তের জন্য ওর ভালোবাসা অনুভব করেছিলাম, মনে হয়েছিল আমি ওর ভালোবাসা পেয়ে গেছি। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম মা। ও কখনোই আমাকে ভালোবাসেনি। একটুও না। কেনো ভালোবাসলোনা?”
আলভীর বিলাপ শুনে এবার ঊর্মিলার চোখজোড়াও ভিজে গেল। আলভী কান্নাজরিত কন্ঠে হিসহিসিয়ে বলে উঠলো,
“ওকে এনে দেও মা। ওকে এনে দেও। আমি আর পারছিনা। আমি ওকে ছাড়া শেষ হয়ে যাচ্ছি।”
চলবে,,,
#১৫_বছর_বয়সী_মা (৫৯)
#সোফিয়া_সাফা
ড্রইংরুমের সোফায় বসে অলি আর রাবেয়া আখতার কথা বলছে।
“সবকিছু এভাবে ওলট-পালট হয়ে যাবে কল্পনাও করিনি।”
রাবেয়া আখতার দ্বীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অলি আরিশের ছোট্ট ছোট্ট আঙুল ধরে খেলা করছে। আপাতত তার সম্পূর্ণ মনোযোগ আরিশের দিকেই নিবদ্ধ।
“অলি তোমরা আরও দুদিন থেকে যাওনা।”
এবার অলি রাবেয়া আখতারের পানে তাকালো,
“না আন্টি, আমাদের কালকেই চলে যেতে হবে। নোমান ভাইয়া কিছুদিন আগেই কাজে জয়েন হয়েছেন।”
“ওহ আচ্ছা,”
রাবেয়া আখতার থামলেন কিছুক্ষণ, ফের বলে উঠলেন,
“অলি তোমাকে একটা কথা জানাতে চাইছি। তুমি কথাটা রায়াকে বলবেনা কেমন?”
“হুম বলুন আন্টি, কি এমন কথা?”
রাবেয়া আখতার আশেপাশে তাকালেন। তারপর অলির দিকে কিছুটা অগ্রসর হয়ে মৃদু কন্ঠে বলতে আরম্ভ করলেন,
“আগামী কাল রায়াকে দেখতে আসবে।”
অলি চমকে গেল, বার দুয়েক চোখের পলক ফেলে কথাটার মাঝে বোঝার চেষ্টা করলো।
“রায়া আপুকে দেখতে আসবে? মানে আপনি রায়া আপুর বিয়ের কথা বলছেন?”
রাবেয়া আখতার হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লেন, “হ্যাঁ বিয়ের কথাই বটে, তাদের যদি রায়াকে পছন্দ হয় তাহলে কালকেই বিয়ে সেড়ে ফেলবেন।”
অলির কপালে চিন্তার ভাজ পড়লো, “শুধু আপুকে পছন্দ হলেই বিয়ে দিয়ে দেবেন? আপুর তো তাকে নাও পছন্দ হতে পারে আন্টি। আর আপনি এতো বড় ব্যাপারটা আপুর থেকে আড়াল করতে চাইছেন কেন?”
“আরে ওকে বললে ও রাজি হবেনা। তুমিই বলো আমার একার পক্ষে কি সবদিক সামলানো সম্ভব? তোমার আংকেল থাকলেও একটা কথা ছিল। মেয়েটা এসব বুঝতেই চায়না।”
তাদের কথার মাঝেই নোমান এসে বসলো। তাকে দেখে রাবেয়া আখতার চুপ হয়ে গেলেন।
***
বেলা ১০:২৮
পাত্রপক্ষের সামনে মাথা নিচু করে বসে আছে রায়া। পরণে গাঢ় খয়েরী রঙের শাড়ি। সামনেই বিচারকের ভঙ্গিতে বসে আছেন পাত্রের পরিবার। রায়া একপলক পাত্রের দিকে তাকিয়ে দেখলো পাত্রের বয়স কম করে হলেও ৪৫ এর কাছাকাছি হবে।
“আমার পোলার আগের বউ মারা গেছে। তয় বউডা আপনাগো মাইরার থেইকা দেখতে হুনতে ভালা আছিল।”
কথাটা শুনে রায়ার শরীর কেপে উঠলো, না চাইতেও চোখের সামনেটা ঝাপসা হয়ে এলো। শেষমেশ তার মা একজন বিপত্নীক পুরুষের সাথে বিয়ে দিয়ে দায়সারা হতে চাইছে? তার চামড়ার রঙ একটু অনুজ্জ্বল বলেই কি তাকে এভাবে বানের জলে ভাসিয়ে দেবে? রায়া ঠোঁট চেপে বসে রইলো। এবার আর সে দ্বিমত পোষণ করবেনা। যেই মা এতোবড় একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বে জিজ্ঞেস করারও প্রয়োজন বোধ করেনি তাকে কিছু বলার রুচিটুকুও নেই। তারচেয়ে বরং বানের জলে ভেসে যাওয়াটাই শ্রেয়।
এরইমাঝে রিদি ছোট্ট আরিশকে কোলে নিয়ে ড্রইংরুমে চলে আসে। কিছুক্ষণ যেতেই আরিশকে খুঁজতে খুঁজতে অলি অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ড্রইংরুমের সবার সামনে চলে আসে। সে ওয়াশরুমে গিয়েছিল এরই মাঝে রিদি আরিশকে নিয়ে চলে এসেছে। এদিকে অলিকে দেখে পাত্রপক্ষের প্রত্যেকের চোখ চকচক করে উঠলো। অলিও তাদেরকে দেখে মাথার ওড়না ঠিকঠাক করে নিলো। পাত্র তো অদ্ভুত চোখে অলির দিকেই তাকিয়ে আছে। তাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অলি আরিশকে না নিয়েই উপরে চলে গেলো।
“মাইয়াডা কেডা আছিল আপা? মাইডা আমার খুব পছন্দ হইছে।”
পাত্রের মায়ের কথাটা শুনে রাবেয়া আখতার কিছুটা আশাহত হলেন,
“আমার বোনের মেয়ে। ওর নাম অলি।”
তারপর রিদির কোলে থাকা আরিশকে দেখিয়ে বললেন,
“অলি বিবাহিতা। বাচ্চাটা ওরই।”
পাত্রের মা অবিশ্বাসের সুরে আওড়ালেন,
“এইটুকুনি মাইয়ার বিয়া হইয়া বাচ্চাও হইয়া গেছে?”
রাবেয়া আখতার ফিচেল হেসে বললেন, “হ্যাঁ আপা। আপনারা ওর কথা বাদ দিয়ে বলেন রায়াকে পছন্দ হয়েছে কিনা।”
পাত্রের মা নিজের স্বামী আর ছেলের সাথে পরামর্শ করে জানালেন,
“আপনার মাইয়ারে আমগোর পছন্দ হইছে তয় আমাগো একখান কথা আছে।”
রাবেয়া আখতার নড়েচড়ে বসলেন। নিশ্চিত এবার দেনা পাওনা নিয়ে কথা ওঠাবে।
“জি বলুন আপা।”
পাত্রের মা রায়ার দিকে একনজর চেয়ে বললেন,
“বিয়ার পর লেহাপড়া করুন যাবোনা। অতো লেহাপড়া করলে স্বামী সংসার দেহাহুনা করবো কহন? আর বাকি রইলো দেনা পাওনা। ওইসব নিয়া আপনেরা ভাববেন না আমাগো কিছুই লাগবোনা।”
রাবেয়া আখতার হেসে উঠলেন, “আলহামদুলিল্লাহ।”
পাত্রের বাবা বললেন, “তাহলে কথা তো ফাইনাল হলোই। আমাগো পোলা আবার কাজের সূত্রে ঢাকা যাবে তাই বিয়েটা আজকে হলেই ভালা হয় আপা।”
রাবেয়া আখতার সম্মতি জানিয়ে উঠে দাড়ালেন। রায়ার দিকে এগিয়ে যেতেই রায়া তাকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত পায়ে নিজের রুমে চলে যায়। রাবেয়া আখতার নিজের ভাইকে ডেকে বললেন,
“যা গিয়ে কাজি সাহেবকে নিয়ে আয়। শুভ কাজ যত তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে ততই ভালো।”
,
এদিকে রুমে এসে রায়া আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলোনা শব্দ করেই কেদে উঠলো। তাকে কাদতে দেখে অলি এগিয়ে এলো,
“কি হয়েছে আপু? তোমাকে ওনারা কিছু বলেছে?”
রায়া চোখজোড়া মুছে হাসার চেষ্টা করলো,
“না গো অলি। ওনাদের আমাকে পছন্দ হয়েছে আর মামা কাজি আনতে গেছে আজকেই বিয়ে হয়ে যাবে।”
রায়া আবারও কেদে উঠলো। অলি তার কাধে হাত রেখে চিন্তিত কন্ঠে শুধালো,
“কাদছো কেনো আপু? বিয়ে তো সবাইকেই করতে হয় তাইনা? আমাকেই দেখো, আমিও তো আগে বলতাম বিয়ে করবোনা। কিন্তু আমার তো আরো আগেভাগেই বিয়ে হয়ে গেলো।”
রায়া হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লো কিন্তু কান্না থামলো না উল্টো কান্না গুলো দলা পাকিয়ে গলায় আটকে যাচ্ছে,
“কি হয়েছে আপু আমাকে বলো। তোমার কি পাত্রকে পছন্দ হয়নি?”
রায়া না বোধক মাথা নাড়লো, “তুমি তো দেখেছোই অলি। মানলাম আমার গায়ের রঙ একটু চাপা। তাই বলে মা আমাকে বিপত্নীক পুরুষের সাথে বিয়ে দিয়ে দেবে? তার উপর লোকটার বয়স ৪৫ তো হবেই, লোকটার চাহনি আমার ভালো লাগেনি। ইচ্ছা করছিল চোখদুটো গেলে দেই। তোমার দিকেও কেমন যেন অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে ছিল। এতো কিছুর পরেও আমি মেনে নিতাম কিন্তু ওনারা আমাকে পড়াশোনাও করতে দেবেনা। আমি কি করবো অলি?”
অলির এবার খারাপ লাগলো, “হ্যাঁ লোকটার তাকানোটা আমারও ভালো লাগেনি। আচ্ছা আপু তোমার কি পছন্দের কেউ নেই?”
রায়া চোখ তুলে তাকালো। অলি জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
“আমি বলতে চাইছি অনেকেরই তো বয়ফ্রেন্ড টয়ফ্রেন্ড থাকে। তোমার সেরকম কিছু নেই?”
অলি রায়ার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, রায়া হঠাৎ বসা অবস্থাতেই অলিকে জড়িয়ে ধরলো। কান্নাজরিত কন্ঠে বলতে লাগলো,
“না অলি আমার সেরকম কেউ নেই। থাকলে তো আমি আরও আগেই বিয়ে করে নিতাম এতোদিন বিয়ের প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতাম না। আমি তো পড়াশোনা শেষ করে নিজের পায়ে দাড়াতে চেয়েছিলাম তাই এগুলো করার কথা ভাবিইনি কখনো কিন্তু আমার মা আমাকে নিজের পায়ে দাড়াতে তো দিলোই না উল্টো শেকল পড়াতে চাইছে। আমি কি করবো অলি? কি করবো?”
রায়ার কথার মাঝেই দরজায় টোকা পড়লো। অলি ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে তাকাতেই দেখলো নোমান দাড়িয়ে আছে,
“মিসেস অলি এনি প্রবলেম?”
নোমানের কন্ঠ শুনে রায়া অলিকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসলো, অলি নোমানের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
“হুম ভাইয়া দেখুন না রায়াপু বিয়ে করতে চাইছেনা কিন্তু আন্টি জোর করে তাকে বিয়ে দিতে চাইছেন।”
নোমান অলির কথাটা গায়েই মাখলো না।
“মিসেস অলি এসবের জন্য আমাদের হাতে সময় নেই। তুমি তারাতাড়ি রেডি হয়ে নেও। বাড়িতে ফিরতে হবে।”
অলির কপালে ভাজ পড়লো। কিছুটা তেজি কন্ঠে বলল,
“এসবের জন্য মানে কি? আমরা রায়া আপুকে এই রকম একটা পরিস্থিতিতে ফেলে রেখে কিভাবে চলে যাবো?”
নোমান একবার রায়ার দিকে তাকাতেই দেখলো মেয়েটা মাথা নিচু করে কেদেই যাচ্ছে।
“আমাকে যেতেই হবে। অ্যাডভোকেট হিসেবে এটাই আমার প্রথম কেস। আমি না যেতে পারলে কেসটা হাতছাড়া হয়ে যাবে।”
“তো চলে যান আপনি। এমনিতেও আমি এখন সুস্থ আছি। আমাকে আর মানবতা দেখাতে হবেনা। অনেক করেছেন আমার জন্য আমি সারাজীবন আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো।”
নোমান থমকে গেল। ভ্রুযুগল কুচকে বেশ কিছুক্ষণ অলির দিকে তাকিয়ে রইলো,
“তুমি এসব কি বলছো? আমি তোমাকে একা ফেলে রেখে চলে যেতে পারবোনা। সেটা তুমিও খুব ভালো করেই জানো।”
“আর আমিও রায়া আপুকে এই রকম পরিস্থিতিতে ফেলে রেখে চলে যেতে পারবোনা সেটা আপনিও জেনে রাখুন ভাইয়া।”
অলি পুনরায় রায়ার পাশে গিয়ে বসলো, “তুমি চিন্তা কোরোনা রায়াপু, তোমার বিয়েটা ভাঙ্গার দায়িত্ব আমার।”
রায়া অশ্রুসজল চোখে অলির দিকে তাকায়, “তুমি না হয় আজকে আমার বিয়েটা ভেঙ্গে দিয়ে যাবে অলি, কিন্তু মায়ের মাথা থেকে বিয়ের ভূতটা আমি কিভাবে নামাবো?”
অলি ভাবনায় পড়ে গেলো। রায়া ভুল কিছু বলেনি। রাবেয়া আখতারের ভাবভঙ্গি দেখে বোঝাই যাচ্ছে মেয়ের বিয়ে না দিয়ে তিনি থামবেন না। নোমান চুপচাপ দাঁড়িয়ে অলির কর্মকাণ্ড দেখছে, এরই মাঝে অলির সাথে তার চোখাচোখি হয়ে যায়। অলি অভিমানী সুরে বলে,
“কি হলো ভাইয়া? যাচ্ছেন না কেন? আপনার হাতে তো সময় নেই।”
নোমান একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে অলির পাশে এসে দাঁড়ায়,
“আমি তোমাকে রেখে যাচ্ছিনা। কিন্তু যা করার একটু তাড়াতাড়ি করো যেন বিকেলের আগেই বাড়িতে ফিরে যেতে পারি।”
অলি সরু চোখে তাকাতেই নোমান মিনমিনিয়ে বলল,
“অনুরোধ করছি বাকিটা তোমার ইচ্ছা।”
অলি কোনোকিছু না ভেবেই বলে ওঠে, “আমার ইচ্ছা তো করছে আপনার সাথে রায়া আপুর বিয়ে দিয়ে দিতে।”
নোমান যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছেনা। এটা তার ফ্লাওয়ার কুইন কি আজগুবি ইচ্ছা পোষণ করে ফেলল? মাথা ঘুরছে, তবুও ভুল শুনেছে বলে মনকে সান্ত্বনা দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। অলি এবার শান্তকন্ঠে বলে উঠলো,
“নোমান ভাইয়া আপনি যদি আমার আপন ভাই হতেন আমি জোর করে হলেও রায়া আপুর সাথে আপনার বিয়ে দিয়ে দিতাম।”
রায়া বলে উঠলো, “অলি তুমি এসব কি বলছো? এ হয়না। তাছাড়া আমি বিয়ে করতেই চাইছিনা।”
“তুমি বিয়ে না করে পারবে কি? তার চেয়ে নোমান ভাইয়াকে বিয়ে করে নেও। তাকে বিয়ে করলে তুমি পড়াশোনাও করতে পারবে।”
রায়া চুপ হয়ে গেল। নোমান আর সহ্য করতে পারলোনা, দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই অলি পেছন থেকে বলে ওঠে,
“রায়া আপুকে বিয়ে করে নিন না ভাইয়া। অনুরোধ করছি।”
নোমান কাঠকাঠ কন্ঠে বলে উঠলো, “এই কথাটা আর একবারও রিপিট করবেনা মিসেস অলি।”
অলি এবার নোমানের সামনে এসে দাড়ালো, “আপনি এভাবে বলছেন কেনো ভাইয়া? বিয়ে তো একদিন না একদিন করবেনই। তাহলে আজ কেনো নয়? রায়া আপু খুব ভালো মেয়ে। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি রায়া আপুকে বিয়ে করলে আপনি ঠকবেন না।”
নোমান অলির দিকে তাকাতেই অলি লক্ষ্য করলো তার চোখজোড়া রক্তবর্ণ ধারণ করেছে,
“কি সমস্যা ভাইয়া বলুন আমাকে। রায়া আপুকি দেখতে অসুন্দর? গায়ের রঙই কি সবকিছু?”
“সমস্যা টা তুমি বুঝতে পারবেনা মিসেস অলি। তুমি যেখানে নিজের স্বামীকেই বোঝোনি সেখানে আমি তো পরপুরুষ। আমার সমস্যা গুলো তুমি বুঝবেনা সেটাই স্বাভাবিক।”
অলি দুপা পিছিয়ে গেল। রায়া উঠে এসে অলির উদ্দেশ্যে বলল,
“তুমি ওনাকে জোর কোরোনা অলি।”
“আমি ওনাকে জোর করবো কোন অধিকারে আপু? আমি জোর করছিনা। কিন্তু উনি এটা কি বললেন? আমি আমার স্বামীকে বুঝিনি মানে কি? কি বুঝিনি আমি?”
নোমান ফের চলে যেতে নিলে অলি বলে ওঠে, “দাড়ান ভাইয়া, আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যান। আমি কি বুঝিনি?”
নোমান উত্তর দিলোনা। একজন ছেলে আরেকজন ছেলের চোখের ভাষা বুঝতে পারে। সেও পেরেছিল, আলভী যে অলিকে কতোটা ভালোবাসতো সেটা নোমান সেদিনই বুঝতে পেরেছিল যেদিন সে প্রথম আলভীকে দেখেছিল। কিন্তু অলি আলভীর সাথে এক ছাদের নিচে থেকেও বুঝতে পারেনি। পারলে কি আর এভাবে আলভীর থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতো?
“আপনি চলে যান ভাইয়া আমি আর যাবোনা আপনার সাথে।”
নোমান পূর্বের ন্যায়েই দাঁড়িয়ে রইলো,
“আজকে আপনি যদি রায়া আপুকে বিয়ে না করেন তাহলে ফলাফল টা কি দাড়ালো? আমার মতোই রায়া আপুও তো বিপদগামী। আপনি আমাকে সাহায্য করতে পারলে আপুকে সাহায্য করতে পারবেন না কেনো?”
“সাহায্য করা আর বিয়ে করা এক নয় অলি৷ আমি যাকে ভালোবাসি তাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করা আমার পক্ষে অসম্ভব। আর মজার ব্যাপারটা হলো আমার ভালোবাসার মানুষটিকেও আমি বিয়ে করতে পারবোনা।”
“মানে কি? আপনি তাহলে কি কখনোই বিয়ে করবেন না?”
নোমান বিনা দ্বিধায় উত্তর দিলো, “নাহ।”
অলি হাল ছেড়ে দিলো। নোমানের সাথে ফাও কথা বলে লাভ নেই। অলি রায়ার দিকে তাকিয়ে দেখলো রায়া অশ্রুসিক্ত নয়নে নোমানের দিকেই তাকিয়ে আছে। অলির খারাপ লাগলো, এভাবে রায়ার সামনে নোমানের সাথে এই বিষয়ে কথা না বললেই ভালো হতো। এরইমাঝে রাবেয়া আখতার আরিশকে নিয়ে রুমে ঢোকেন। আরিশ কান্না করছে, অলি এগিয়ে এসে আরিশকে কোলে তুলে নিলো।
“একি রায়া তৈরি হোসনি এখনো? নিচে কাজি সাহেবও চলে এসেছেন।”
অলি আরিশকে বুকে জড়িয়ে ধরে প্রশ্ন ছুড়লো,
“আন্টি পাত্রকে আপনার পছন্দ হয়েছে?”
রাবেয়া আখতার অলির দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন,
“না মানে, লোকটা বয়সে আপনার থেকেও বড় হবে আন্টি সেই জন্যই বললাম আরকি।”
“তাতে কি হয়েছে অলি? তোমার স্বামীও তো বয়সে তোমার থেকে অনেক বড়। তুমি কি সংসার করছোনা?”
অলি থতমত খেয়ে গেলো, “আমার স্বামীর বয়স বেশি নয় আন্টি। তার বয়স ঠিকই আছে উল্টো তার তুলনায় আমার বয়সটাই একটু কম। যাক, সেটা নাহয় বাদ দিলাম কিন্তু ওনার আগের বউ নাকি মা*রা গেছে। আপনি আপুকে একটা বিধবার সাথে কিভাবে বিয়ে দিতে পারেন আন্টি? তার উপর লোকটার নজর ভালোনা। আবার লেখাপড়াও করতে দেবেনা।”
রাবেয়া আখতার অলির কথায় কর্ণপাত করলেন না,
“এসব কোনো বিষয়ই নয় আর নজর তো ঠিকই ছিলো। কই আমি তো তেমন কিছু দেখলাম না। পড়াশোনা করতে দেবেনা এটা বড় কোনো ব্যাপার না। ওনারা বড়লোক আছে। ওর চাকরি করার প্রয়োজন পরবেনা।”
অলি আরও কিছু বলতে চাইলে রায়া তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
“অলি আমার শাড়িটা একটু ঠিক করে দেওনা।”
“হ্যাঁ অলি তুমি ওকে রেডি হতে সাহায্য করো। তারপর ওকে নিয়েই নিচে এসো।”
কথাটা বলেই রাবেয়া আখতার চলে গেলেন।
“আপনি বরং চলে যান ভাইয়া। আমি রায়া আপুকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবো।”
নোমান গলা পরিষ্কার করে বলল, “তো আমিও সাহায্য করতেই পারি ওনাকে পালিয়ে যেতে।”
“আপনার সাহায্যের প্রয়োজন নেই।”
অলি একহাতে রায়াকে জড়িয়ে ধরে বলল, “তুমি চিন্তা কোরোনা আপু আমি আছি তোমার পাশে। প্রয়োজনীয় সবকিছু গুছিয়ে নেও।”
রায়া নাক টেনে বলল, “না অলি আমি তেমনটা করতে পারবোনা। আমি পালিয়ে গেলে আমার মাকে সবাই অপমান করবে। তোমরা আমার জন্য শুধু শুধু নিজেদের ভেতরে ঝামেলা কোরোনা। আমার ভাগ্যে হয়তো এটাই লেখা ছিল।”
অলির এবার ভীষণ খারাপ লাগলো। নোমান নিঃশব্দে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। অলিও একটা শ্বাস ফেলে বোরকা পড়তে লাগলো। একটা মেয়ের জীবন এভাবে শেষ হয়ে যেতে দেখতে পারবেনা সে। সেই হিসেবে বিয়ের আগেই চলে যাওয়া শ্রেয়। অলি রেডি হয়ে বের হতেই দেখলো নোমান ড্রইংরুমের এককোনায় দাঁড়িয়ে আছে। অলিকে হঠাৎ চলে যেতে দেখে রাবেয়া আখতার এগিয়ে এলেন,
“একি এভাবে কোথায় চলে যাচ্ছো?”
অলি শান্তকন্ঠে বলল, “আমার একটা দরকারী কাজ পড়ে গেছে আন্টি আমাকে যেতেই হবে।”
অলি অপেক্ষা করলোনা কোলে থাকা আরিশের দিকে একনজর তাকিয়ে দ্রুত পায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। এরইমাঝে লক্ষ্য করলো নোমান তার পিছু পিছুই আসছে। অলি থেমে গেল,
“আসবেন না।”
নোমান দ্রুত পায়ে অলির সামনে এসে দাঁড়ায়,
“এরকম করছো কেনো?”
অলি উত্তর দিলোনা তাকে পাশ কাটিয়ে হাটা ধরতেই নোমান ভুলবশত অলির হাত ধরে ফেলল। সামান্য স্পর্শতেই অলির শরীর শিউরে ওঠে, যদিও নোমান সাথে সাথেই তার হাত ছেড়ে দিয়েছে।
“বোঝার চেষ্টা করো। আমি বিয়ে করতে পারবোনা।”
“না করুন। আমি জোর করিনি। শুধু আমার পিছু পিছু আসবেন না।”
নোমান এবার বাধ্য হয়েই বলল, “আচ্ছা, আচ্ছা বিয়ে করে নেবো।”
অলির পা থেমে গেল, “সত্যিই করবেন?”
নোমানের গলা দিয়ে কথা বের হলোনা। শুধু মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল,
অলি নোমানকে নিয়ে আবারও বাড়িতে ঢুকলো তারপর সবার সামনেই পাত্রকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“রায়া আপু আপনাকে বিয়ে করবেন না। আপনার চাহনি তার ভালো লাগেনি। আর সে পড়াশোনাও করবে।”
পাত্রপক্ষের সবাই ক্ষুব্ধ হয়ে রাবেয়া আখতারের দিকে তাকালেন,
“আপা এই মাইয়া এগুলা কি কয়?”
“অলি এসব তুমি কি বলছো? দয়া করে এসব বলোনা। এবার যদি রায়ার বিয়েটা না দিতে পারি তাহলে আমি আর নিতে পারবোনা।”
অলি রাবেয়া আখতারের উদ্দেশ্যে বলল, “রায়া আপুর বিয়ে হবে। আজকেই হবে, আমার বন্ধুর সাথে হবে।”
অলি নোমানের দিকে ইশারা করতেই রাবেয়া আখতার চমকে গেলেন। নোমানের মতো দেখতে শুনতে ভালো একটা ছেলে রায়াকে বিয়ে করবে ভাবতেই তার মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো,
“দেখো অলি এটা মজা করার সময় নয়। তুমি চুপ করে থাকো।”
নোমান একটা শ্বাস ফেলে বলল, “মিসেস অলি যখন বলেছে আমি অবশ্যই রায়াকে বিয়ে করবো।”
তাদের কথাবার্তা শুনে পাত্রপক্ষের সবাই কয়েকটা বিশ্রী ভাষার প্রয়োগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।
***
“মনে প্রেমের বাত্তি জ্বলে, বাত্তির নিচে অন্ধকার।
এই জীবনে চাইলাম যারে হইলোনা সে আমার।”
রূপসা গুনগুন করছিল, এরইমাঝে ইয়াদ এসে তার সামনে দাঁড়ায়,
“তোর বাবা মা এসেছে। দেখা করবিনা?”
রূপসার মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হলোনা। পূর্বের ন্যায়েই সোফায় জড়োসড়ো হয়ে পড়ে রইলো,
“সবকিছু রেখে আমার সোফাটা তোর এতো পছন্দ হলো যে গতকাল থেকে এই পর্যন্ত সোফার সাথে চিপকে আছিস?”
“কেনো বিয়ে করলে আমাকে?”
রূপসার কথার প্রেক্ষিতে ইয়াদ বলল,
“অভিয়াসলি ভাইয়ার জন্য। দেখলিনা সে কিভাবে ভয় দেখালো।”
“মিথ্যা বলছো তুমি।”
“সত্যিটা কি তাহলে?”
“তুমি আমাকে ভালোবাসো?”
ইয়াদ হেসে উঠলো, “ভালোবাসি? কেমন ভালোবাসি আমি? তুই ভাইয়াকে ভালোবেসে তাকে পাওয়ার জন্য কতোকিছুই তো করলি। আমি কি তোকে পাওয়ার জন্য তার এক পার্সেন্টও করেছি?”
রূপসা উঠে বসলো, নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ইয়াদের দিকে তাকিয়ে রইলো। ইয়াদ চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকালো,
“তুমি আমাকে হেল্প করেছো সেসব করতে। কেনো করেছো? কেন আমার সামনে ঢাল হয়ে দাড়ালে? এভি আমাকে মে*রে ফেললে ফেলতো। বাচালে কেনো আমাকে? তুমি জানোনা আমি এভিকে ছাড়া বাচবোনা?”
ইয়াদ চুপ করে রইলো,
“প্রথম প্রথম ভাবতাম বোন বলে হেল্প করছো। কিন্তু কালকে এটা কি করলে? আচ্ছা এইসব এভির সাথে মিলে তোমার করা কোনো ষড়যন্ত্র নয়তো?”
“ষড়যন্ত্র? ষড়যন্ত্র করে তোকে বিয়ে করবো? কেনো রে? কেনো তোকে বিয়ে করবো এতো আয়োজন করে? কি আছে তোর মাঝে? ভাইয়া তামাশা দেখার জন্য আমাদের বিয়ে দিয়েছে। আমার সামনে তার ছেলে তাকে বাবা বলে ডাকবে। সেই ডাক শুনে আমি জ্বলে পুড়ে মরবো। সেই দৃশ্য দেখে সে আনন্দিত হবে।”
রূপসা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো, ইয়াদ আবারও হেসে উঠলো,
“তোর কি মনে হয়? সেদিন তুই-ই শুধু মা হওয়ার ক্ষমতা হারিয়েছিস? নাহ সেদিন তোর সাথে আমিও বাবা হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি। আর এসব তোর পাপের ফল। অন্যের স্বামীর দিকে নজর দিলে এরকম কিছু তো হবেই।”
রূপসা চড়া গলায় বলল, “আমি মা হতে না পারলেই যে তুমিও বাবা হতে পারবেনা এমন তো কোনো কথা নেই। তাছাড়া আমাদের বিয়েটা শুধু পরিস্থিতির চাপে নেওয়া একটা ভুল পদক্ষেপ ছিল। আমি তোমাকে ডিভোর্স…
“চুপ একদম চুপ। তুই আমাকে ডিভোর্স দেবার কথা মুখেও আনবিনা।”
“মানে কি?”
“মানে ভাইয়া তো বললোই তার বউকে মে*রে ফেললেও সে তোকে বিয়ে করবেনা। তাহলে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে তোর লাভ কি?”
রূপসা হতভম্ব হয়ে গেল। এই ইয়াদ যে কি চায় সেটাই সে বুঝে উঠতে পারছেনা।
“তুমি ঠিক কি চাও বলবে আমাকে?”
“আমি তোকে ভাইয়ার সাথে বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা আর সম্ভব নয়।”
“সেটা তো আগে চাইতে এখন তুমি কি চাও।”
ইয়াদ কিছু সময় চুপ থেকে ঠোঁট নাড়ল,
“বর্তমানে আমি চাই তোর মন থেকে এভির নামটা মুছে ফেলতে।”
“তুমি আমাকে মে*রে ফেলতে চাইছো?”
ইয়াদ ভ্রু কুচকে তাকায়,
“একমাত্র মৃ*ত্যুই আমার মন থেকে এভিকে মুছতে পারবে।”
“ম*রে গেলে যাবি। আমার কাছে আর কোনো পথ নেই। ভাবীকে মে*রে ফেলার পরেও যদি ভাইয়া তোকে বিয়ে না করে সেক্ষেত্রে আমার করনীয় কি? ভেবেছিলাম জোর করে হলেও তোদের বিয়েটা দিয়েই ছাড়বো কিন্তু আমি বুঝি গেছি ভাইয়া ম*রে গেলেও তোকে বিয়ে করবেনা।”
রূপসার চোখে অশ্রু জমতে শুরু করলো,
“সে বিয়ে না করলে নাই। তবুও আমি তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে দেবো। আমার জন্য তুমি কেন বাবা ডাক শোনা থেকে বঞ্চিত হবে?”
“বাব্বাহ তুই আবার নিজ ব্যাতিত অন্য কারো কথাও ভাবিস? আর তোর মা হওয়ার ক্ষমতা থাকলেও কি আমি তোর বাচ্চার বাবা হতে পারতাম?”
রূপসা শব্দ করে কেদে উঠলো, “নাহ পারতেনা। কখনো পারতেনা।”
ইয়াদ এবার বিষমিশ্রিত কন্ঠে বলল, “সেই জন্যই হয়তো আল্লাহ সেই ক্ষমতা টাই কেড়ে নিয়েছে।”
রূপসা আর কিছুই বলতে পারলোনা। পুনরায় সোফাতে গা এলিয়ে দিলো। ইয়াদও উল্টো ঘুরে রুম ত্যাগ করলো।
বেশ কিছুদিন পর,
“অলি তুমি আরিশের কাছে যাও আমি একাই বাকি রান্নাটুকু করে নেবো।”
রায়ার কথা শুনে অলি ওড়নায় হাত মুছতে মুছতে বলল,
“আলো নানুর কাছে আছে, চিন্তা কোরোনা আপু। তাছাড়া আমার রান্না বান্না করতে ভালোই লাগে। আগে রান্না করতে পারতাম না তবে এখানে আসার পর নানুর কাছ থেকে শিখেছি।”
রায়া চুলার আচঁ কমিয়ে দিয়ে অলির দিকে তাকালো,
“কিছু মনে না করলে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?”
অলি হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়তেই রায়া বলতে লাগলো,
“তুমি কেনো স্বামী-সংসার ছেড়ে চলে এসেছো অলি?”
অলি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো, এটা এমন একটা প্রশ্ন যার উত্তর সে কাউকেই দিতে পারেনি আর পারবেও না। অলি কিছুক্ষণ ভাবনা চিন্তা করে বলল,
“এমনি, তেমন কিছুই হয়নি।”
রায়া বুঝতে পারলো অলি তাকে কিছুই বলতে চাইছেনা। অলি ওড়নার একপ্রান্ত দিয়ে কপালের ঘামগুলো মুছে মুখে হাসি টেনে বলল,
“বিয়ের তো অনেকদিন হলো আপু ভাইয়াকে কেমন লাগছে?”
রায়ার মুখটা মলিন হয়ে গেল। অলিকে সে কিভাবে বলবে নোমান তার সাথে কেমন ব্যবহার করে। শুধুমাত্র নানুর জন্য তারা একসাথে একরুমে থাকে। এর বাইরে তাদের মাঝে আর কিইবা আছে? নোমান তার দিকে ফিরেও তাকায় না। সে কিছু জিজ্ঞেস করলে সংক্ষেপে উত্তর দিয়ে দেয়। আগ বাড়িয়ে কিছুই বলেনা। সারাদিন কাজকর্মের অজুহাতে বাইরে থাকে। রাতে ঘুমানোর সময় উল্টো দিকে ফিরে একভাবে শুয়ে থাকে। যদিও বিয়ের আগে রায়ার মনে নোমানের জন্য সেরকম কোনো ফিলিংস ছিলোনা তবে এখন যেন নোমানের ব্যবহারে সে খুবই আহত হচ্ছে। মাঝে মাঝে প্রশ্ন করার সাধ জাগে,
“এতো অবহেলা কেনো করছেন আমায়? একবারও কেনো তাকান না আমার দিকে? আমি কি দেখতে এতোটাই অসুন্দর?”
রায়ার ভাবনার মাঝেই নোমান বাড়িতে প্রবেশ করে।
“মিসেস অলি।”
নোমানের ডাকে রায়া কেপে উঠলো। তারপর নিজেকে সামলে চুলার দিকে ঘুরে দাড়ালো। প্রতিদিন এসেই নোমান সর্বপ্রথম অলির নাম ধরেই ডাক দেয়। অলি বসার রুমে এসে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই নোমান মুখে হাসি টেনে বলল,
“আজকে আরিশের দেড় মাস পূর্ণ হলো। ওকে ভ্যাকসিন দিতে নিয়ে যেতে হবে। মনে আছে নিশ্চয়ই?”
অলি উপরনিচ মাথা নাড়ল,
নোমান ফের বলল, “চলো তাহলে।”
তাদের কথার মাঝেই রায়া এসে বলল, “আপনারা বাইরে যাবেন?”
“হ্যাঁ আপু আলোকে টিকা দিতে নিয়ে যাবো।”
রায়া মাথা নিচু করে আওড়ালো, “ওহ।”
“তোমার কিছু লাগবে আপু?”
রায়া সংকোচ বোধ করলো। নোমান একনজর তার দিকে তাকিয়ে প্রথমবারের মতো বলল,
“কিছু লাগলে বলুন। আসার সময় নিয়ে আসবো।”
নোমানের কথার প্রেক্ষিতে রায়ার চোখজোড়া চকচক করে উঠলো উল্লাসিত কন্ঠে বলল,
“আসলে আমার কিছু বই কেনা লাগতো।”
“তাহলে তুমিও আমাদের সাথে চলো আপু।”
নোমান বাধ সাধলো, “উনি যাবেন কি করতে? বইয়ের নামগুলো বলে দিলেই তো হবে।”
মূহুর্তেই রায়ার সদ্য প্রস্ফুটিত মুখটা ম্লান হয়ে গেল।
“আপুও আমাদের সাথেই যাবে। আসার সময় আমরা একসাথে ফুচকা খাবো। খাবে তো আপু?”
রায়া কান্না আটকে বলল, “না অলি তোমরাই বরং যাও।”
“আমি কোনো কথা শুনতে চাইনা আপু তুমিও যাবে আমাদের সাথে। যাও তারাতাড়ি রেডি হয়ে নেও।”
অলি একপ্রকার টেনেটুনেই রায়াকে রেডি হতে নিয়ে গেল।
***
“বাচ্চার বাবার নাম কি?”
ডাক্তারের প্রশ্নে অলি কিছুটা সময় নিয়ে বলল,
“আলভী তাসনীম মির্জা”
ডাক্তার মাথা নেড়ে আবারও জিজ্ঞেস করলেন,
“মায়ের নাম?”
অলি শান্তকন্ঠে বলল,
“আলিয়া তাবাসসুম অলি।”
ডাক্তার কাগজের ওপর খসখস শব্দে নাম লিখে নিচ্ছেন।
“বাচ্চার নাম কি রেখেছেন?”
অলি এবার আরিশের পানে চেয়ে কোমল কন্ঠে বলল,
“আফরান আরিশ মির্জা।”
“বাবা মায়ের এনআইডি কার্ড বা বার্থ সার্টিফিকেটের ফটোকপি দিন, আমরা বাচ্চার টিকার কার্ড বানিয়ে দিচ্ছি।”
অলি একটু তাড়াহুড়ো করে ব্যাগের চেইন খুলল। হাত গলিয়ে বেশ যত্নে রাখা ফাইল থেকে বের করল আলভীর এনআইডির ফটোকপি আর নিজের জন্মসনদের কপি। নোমান আড়চোখে একবার সেদিকে তাকালো, মেয়েটা বুদ্ধি খাটিয়ে এগুলো সাথে নিয়ে এসেছিল ভাবতেই বিস্মিত হলো।
কিছুক্ষণ যেতেই নার্স সাদা ট্রেতে রাখা কয়েকটা ছোট্ট সিরিঞ্জ আর টিকা ভায়াল একে একে সাজিয়ে নিলেন। অলি আরিশকে কোলে নিয়ে নার্সের সামনে বসে আছে। আরিশ তো বুঝতেই পারছেনা তার সাথে কি হতে চলেছে কিন্তু অলির বুকের ভেতরটা কেমন যেন কেঁপে উঠছে বারবার। নার্স যখন সিরিঞ্জে টিকা ভরে বাতাস বের করল, অলি শক্ত করে ছেলের জামার কোণা চেপে ধরল। তার প্রতিক্রিয়া দেখে নার্স মিষ্টি হেসে বললেন,
“ভয় পাবেন না। বাচ্চাকে একটু শক্ত করে ধরুন, নড়াচড়া যেন না করে।”
অলি বুকের সাথে আরিশকে চেপে ধরল। নার্স ছেলেটার বাঁ উরুর মাংসে তুলো মুছে সিরিঞ্জের সূঁচ ঢুকিয়ে দিতেই আরিশের ছোট্ট শরীরটা ঝাকুনি তুলল, মূহুর্তেই গলা ফাটিয়ে কেদে উঠলো। ছেলের কান্নার শব্দে অলির গলা শুকিয়ে এলো, কাপা কাপা হাতে ছেলেকে স্থির রাখার চেষ্টায় নিয়োজিত হলো। নিজের চোখের পাতা ভারি হয়ে উঠলেও ঠোঁট চেপে কান্না আটকে রাখলো, কিছুক্ষণের মধ্যেই দ্বিতীয় টিকাটা দেয়া হলো ডান উরুতে। আরিশ এবারও চিৎকার করে কেঁদে উঠতেই অলির সারা শরীর ঝংকার তুলল। মনে হলো, আরিশের কষ্ট সেও অনুভব করতে পারছে।
টিকাদান শেষে নার্স নরম গলায় বললেন,
“হয়ে গেছে, এখন একটু বুকের দুধ খাওয়ালেই শান্ত হয়ে যাবে।”
অলি মাথা নেড়ে উঠে দাড়ালো তারপর দ্রুতপায়ে ছেলেকে নিয়ে রেস্টরুমের দিকে চলে গেলো।
চলবে,,,
শব্দসংখ্যা- ৩৫৫০+
#১৫_বছর_বয়সী_মা (৬০)
#সোফিয়া_সাফা
রাতের আধারে নিস্তব্ধ চারিধার। অলি আর রায়া ফুচকা খেতে বসেছে। নোমান আরিশকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এরইমাঝে রায়া নোমানের উদ্দেশ্যে বলল,
“আপনি খাবেন না?”
নোমান উত্তর দিলোনা, অলি মুখে থাকা ফুচকা টা শেষ করে বলল,
“ভাইয়ার কোলে তো আলো আছে। সে খাবে কি করে? তবে তুমি চাইলে কিন্তু ভাইয়াকে খাইয়ে দিতেই পারো৷ ভাইয়া কিছুই মনে করবেনা।”
নোমান কিছু বলতে যাবে তার আগেই রায়া একটা ফুচকা তার মুখের সামনে ধরলো। নোমান আনমনেই হা করে ফুচকাটা মুখে নিলো। ফলস্বরূপ রায়ার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। নোমান একপলক তার দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো।
খাওয়া দাওয়া শেষ হতেই তারা একটা বুকশপের সামনে এলো। এই বুকশপের মালিক তাদের পরিচিত, তাদের প্রতিবেশি। সেই জন্যই নোমান এখানে এসেছে।
“ভাই কিছু ভালো মানের গ্রামার বই দেখান তো।”
নোমানের কথায় দোকানদার বই বের করতে লাগলেন। অলির মনোযোগ সেদিকে নেই। সে বারবার দোকানের বাইরের দিকে তাকাচ্ছে।
“তুমি কিছু খুজছো?”
অলি থতমত খেয়ে গেলো, মুখে হাসি টেনে বলল,
“আমি একটু আসছি। তুমি আলোকে রাখতে পারবে?”
রায়া মাথা নেড়ে আরিশকে কোলে নিলো। অলি নোমানের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে রায়ার জন্য বই ক্রয়ে ব্যস্ত। এই সুযোগে অলি হাটা ধরলো, কিছুটা দূর আসতেই সে একটা এটিএম ব্যুত খুঁজে পেল। তার হাতে এক টাকাও নেই। এভাবে অন্য কারো বাড়িতে কিভাবে থাকা যায়? সে কি পারবে নোমানের কাছে টাকা চাইতে? অলির খারাপ লাগলো, সে এই টাকা ভাঙ্গতে চায়না।
“আমি হিসাব করে টাকা ভাঙ্গবো, তারপর ভবিষ্যতে কোনো একটা কাজ করে আবারও টাকা গুলো রেখে দেবো। আমি তার দেয়া এক টাকাও নিতে চাইনা, কিন্তু আমি অসহায়।”
অলি ভাবনা চিন্তা করে আবারও বিশ হাজার টাকা তুলে নিলো। ব্যুত থেকে বের হয়ে কয়েক কদম যেতেই সামনে নোমান আর রায়াকে দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে গেলো।
“মিসেস অলি, তুমি এভাবে চলে এলে কেনো?”
অলি আরিশকে কোলে নিতে নিতে বলল,
“এদিক দিয়ে খেলনা যাচ্ছিল। আলোর জন্য কিনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমি আসতে আসতেই চলে গেছে।”
“আমাকে বলতে পারতে।”
“সমস্যা নেই ভাইয়া। আপনাদের হয়ে গেছে?”
“হুম হয়ে গেছে।”
“চলুন তাহলে বাড়িতে ফেরা যাক।”
বাড়িতে ঢোকার পথেই এক প্রতিবেশী বলে উঠলো,
“কি গো নোমান ভাই? বোন আর বউকে নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিলে বুঝি?”
নোমান মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলল, “হ্যাঁ ভাই।”
অলি আর রায়া ফ্ল্যাটের ভেতরে ঢুকে গেলো। এই এলাকায় নোমানেরা নতুন। অলি আসার পর তারা এখানে শিফট হয়েছিল। সবাই জানে নোমান আর অলি আপন ভাইবোন। অবশ্য নোমানের নানু আছে বলে কেউ বাজে কিছু চিন্তাও করেনা। নোমানের নানুই সবাইকে বলে যে নোমান আর অলি আপন ভাইবোন। আর এখন তো নোমান বিয়ে করে বউও নিয়ে এসেছে। তাই উল্টো পাল্টা কিছু চিন্তা করার অবকাশও নেই। অলির আগে যেটুকু অস্বস্তি হতো এখন রায়া থাকাতে একটুও অস্বস্তি হয়না।
রাত ১১:৪৩
অলি এশারের নামাজ আদায় করে মশারী টানাচ্ছে। নামাজ পড়তেও দেরি হয়ে গেছে। আরিশ আজকে অনেক জ্বালাতন করেছে। ভ্যাকসিনের প্রভাবে জ্বর চলে এসেছে বাচ্চাটার। নানু আধশোয়া হয়ে তছবী পাঠ করছেন। অলি আরিশের পাশে শুয়ে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। ছেলেটার চোখ মুখ ফুলে গেছে কান্না করতে করতে,
***
“আচ্ছা আপনি কাকে ভালোবাসতেন?”
রায়ার প্রশ্নে নোমান ভ্রু কুচকে তাকালো। সে মাত্রই শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো এরই মাঝে রায়ার এমন প্রশ্নে সে খানিকটা অবাক হলেও উত্তর দেয়ার প্রয়োজন টুকুও বোধ করলোনা।
“আপনার আমাকে ভালো না লাগলে আমি চলে যাবো৷ আপনি শুধু একবার মুখ দিয়ে বলুন।”
নোমান এবার গম্ভীর গলায় বলল, “আমি আপনাকে কোনোদিনই যেতে বলবোনা। যদি আপনার কখনো মনে হয় আপনার চলে যাওয়া উচিৎ। বা আপনি যদি ভবিষ্যতে কখনো বেটার কাউকে পেয়ে যান আমাকে নিঃসংকোচে বলবেন।”
রায়া আর প্রশ্ন করলোনা। নোমান তাকে চলে যেতে বলবেনা এটাই তার কাছে অনেক। এর চেয়ে বেশি আর কি চাওয়ার থাকতে পারে? আশ্রয় দিয়েছে, দায়িত্ব নিয়েছে এই তো অনেক। নোমান অন্যদিকে ফিরে চোখ বুজলো তবে আজ আর বরাবরের মতো অলির চেহারা টা বন্ধ চোখের পাতায় ভেসে উঠলো না। সেই জন্য সে আল্লাহর নিকট শুকরিয়া আদায় করলো৷ সে চায়না অলিকে নিয়ে ভাবতে। অলি পরনারী, তার উপর অন্য কারো স্ত্রী, সন্তানের মা। শুরু থেকেই সে অলির চিন্তা ঝেড়ে ফেলতে চেয়েছে। মনের উপর চাপও প্রয়োগ করেছে কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিলোনা। কথায় আছেনা মনের উপর জোর চলেনা। তবে আজকে আপনা-আপনি তার মন মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে আছে। নোমান হঠাৎ করে রায়ার দিকে ঘুরতেই দেখলো রায়া তার দিকেই তাকিয়ে শুয়ে আছে। নোমান কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। স্বাভাবিক হতে প্রশ্ন ছুড়লো,
“ঘুমাচ্ছেন না?”
“না, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি।”
“প্রার্থনা? কিসের জন্য? আপনার কি আরও কিছুর প্রয়োজন আছে?”
নোমান মুখ ফসকে প্রশ্নটা করেই ফেলল, রায়া লাজুক হেসে বলল,
“আমার প্রয়োজন আছে কি নেই জানিনা। তবে আমি প্রার্থনা করছি, আল্লাহ যেন আপনার মনের সকল অস্থিরতা দূর করে দেয়। সেই সাথে আপনার নিষিদ্ধ ভালোবাসাকেও ভুলে যেতে সাহায্য করে।”
“আমার ভালোবাসাটা নিষিদ্ধ সেটা আপনি কিভাবে জানেন?”
“সেদিন অলিকে বললেন না আপনি যাকে ভালোবাসেন তাকেও বিয়ে করতে পারবেন না। তখনই বুঝে নিয়েছিলাম আপনি এমন কাউকে ভালোবাসেন যাকে ভালোবাসা আপনার জন্য নিষিদ্ধ। আর নিষিদ্ধ কাউকে ভালোবাসাটা অন্যায়। যেটা মানুষকে ভালো থাকতে দেয়না। সেদিন যদি এভাবে না বলে শুধু বলতেন যে আপনি একজনকে ভালোবাসেন তাহলে আমি কখনোই আপনাকে বিয়ে করতাম না।”
নোমান শান্ত চোখে রায়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।
***
ঊর্মিলা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দিহানের সাথে কথা বলছে। এরই মাঝে দিহান বলে ওঠে,
“এগুলো কি ভালো লাগে বলো? বিয়ের ডেট ফিক্সড হয়েও বিয়েটা হলোনা। আর ভালো লাগছেনা, এভি যে কবে একটু স্বাভাবিক হবে কে জানে।”
ঊর্মিলা তেজমিশ্রিত কন্ঠে বলল, “আমার ভাইটা ম*রে যাচ্ছে আর আপনি বিয়ে নিয়ে পড়ে আছেন? সেলফিশ।”
দিহান দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বন্ধুর দুঃখে তারও যে হৃদয় পোড়ে,
“এভি কোথায়?”
“কোথায় আর রুমেই পড়ে আছে। আমার ভাইটা যে বউকে ছাড়া এমন উন্মাদ হয়ে যাবে কল্পনাও করিনি।”
“হুম, আমি কল করেছিলাম কয়েকবার কিন্তু রিসিভ করেনি। বেশি কল দিলে আবার রেগেমেগে ফোন আছাড় মারবে, সেইজন্য থেমে গেছি।”
“আচ্ছা আমি চলে গেলেও কি আপনি এরকম পাগল হয়ে যাবেন?”
দিহান থমকে গেল। ভাবনা চিন্তা না করেই বলে উঠলো,
“আমি এভির মতো কখনো তোমাকে সন্দেহই করবোনা। তাই আমাকে ছেড়ে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠেনা।”
ঊর্মিলার চোখ বড়বড় হয়ে গেল, “সন্দেহ? ভাইয়া ভাবীকে সন্দেহ করেছিল? কি নিয়ে সন্দেহ করেছিল?”
দিহান আহাম্মক বনে গেল। সে তো বেশি কিছুই জানেনা। শুধু জানে আলভী বাচ্চাটাকে নিয়ে সন্দেহ করেছিল আর সেটা অলি জেনে গিয়েছিলো। সেই জন্যই চলে গেছে। কিন্তু এসব কথা যে কাউকে বলা বারণ।
“সন্দেহ করেছিল হয়তো সেই জন্যই ভাবী চলে গেছে। এমনি এমনি তো আর যায়নি তাইনা?”
ঊর্মিলা শ্বাস ফেলল, “আপনি সত্যিই এই ব্যপারে কিছুই জানেন না?”
“আমি সত্যিই জানিনা ঊর্মি। জানলে কি তোমাকে বলতাম না বলো?”
“বলতেন না। এই ব্যপারে আমি সিওর, এর আগেও ভাইয়া ভাবীর বিয়ের ব্যপারে আপনি জানতেন কিন্তু আমাকে বলেননি। তবে এবার আমার বিশ্বাস যে আপনিও কিছুই জানেন না। কারণ ভাইয়া তার বউয়ের ব্যপারে কাউকে কিছু জানাবে বলে মনে হয়না।”
“যাক, তুমি বুঝতে পেরেছো।”
***
ভোরের দিকে, আলভীর ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম বললে ভুল হবে সে নেশা করে টাল হয়ে পড়ে ছিল। এখন শরীর কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। সে ফোনটা হাতে নিলো টাইম দেখার জন্য কিন্তু পাওয়ার বাটনে কয়েকবার চাপ দিয়েও ফোনটা অন করতে পারলোনা,
“ড্যাম ইট। এটার এনার্জিও শেষ? হাহ”
আলভী বহু কষ্টে উঠে বসে ফোনটা চার্জে লাগালো। ফোনের স্ক্রিন জ্বলে উঠতেই সময় পরিলক্ষিত হলো,
ভোর ৪:৩৭
আলভী সময়টা দেখে আবারও বিছানায় গা এলিয়ে দিলো এরইমাঝে তার ফোনে টুংটং শব্দে বেশ কয়েকটা ম্যাসেজ এলো। আলভী বিরক্তি নিয়ে বালিশে মুখ গুজে আবারও ঘুমে তলিয়ে গেলো।
ঘড়ির কাটা এগিয়ে চলেছে নিজ গতিতে, তবে এইমূহুর্তে ঘন্টার কাটাটা ১০ টার ঘর ছুয়েছে। ফোনের অবিরাম শব্দে আলভীর ঘুম হাল্কা হয়ে আসে। হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই তার ঘুম উবে গেল। একলাফে খাট থেকে উঠে প্রথমেই ম্যাসেজ গুলো চেক করতে লাগলো। তার যেই বন্ধু ব্যাংকে কাজ করে সেই বন্ধু ম্যাসেজ দিয়েছে,
—তুই ভাবীর যেই অ্যাকাউন্ট ট্র্যাক করতে বলেছিলি সেই অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা ওঠানো হয়েছে।
আলভীর চোখজোড়া মুহুর্তেই রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো অদ্ভুত হাসি। একহাতে কপালের উপর ছড়িয়ে থাকা সিল্কি চুলগুলো স্লাইড করে ধপাধপ্ পা ফেলে চলে গেল ওয়াশরুমে। এতদিনে মাথার চুল আর দাড়িগুলো অনেকটা বড় হয়ে গেছে। পূর্বে সবসময় ক্লিন সেভ করলেও এই অবস্থায় সেসব করার মন মানসিকতা কোনটাই নেই। সেই সাথে অনেক ওয়েট লস হয়েছে তার, আগে যেখানে তার ওজন ছিল 82kg এখন সেখানে তার ওজন নেমে গেছে 70kg তে। আলভী দ্রুত ফ্রেশ হয়ে এসে তার বন্ধুকে কল দিল,
“ও কোথায় আছে?”
ফোনের ওপাশ থেকে তার বন্ধু বলল,“তা তো আমি বলতে পারবোনা দোস্ত। সেটা তো তোকে গিয়ে খুঁজে নিতে হবে।”
আলভী হাসফাস করে উঠলো, “ওকে ওকে তুই শুধু বল ও কোন জায়গা থেকে টাকা তুলেছিল। বাকিটা আমি দেখছি।”
লোকেশন জেনে আলভী গায়ের শার্ট টা চেঞ্জ করে গাড়ির চাবিটা পকেটে ঢুকিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে লাগলো,
“এই এভি, ব্রেকফাস্ট না করে যাসনা বাপ।”
পেছন থেকে মায়ের ডাক শুনে আলভী ঘাড় বাকিয়ে চাইলো। শাহানাজ বেগম ছুটে এলেন আলভীর দিকে।
“মা, আমার হাতে সময় নেই। আমি বাইরে থেকে খেয়ে নেবো।”
“দয়া কর বাবা, না খেয়ে যাসনা।”
শাহানাজ বেগম আলভীর হাত ধরে টানতে লাগলেন। আলভী উপায় না পেয়ে খেতে বসলো। ঝটপট ব্রেকফাস্ট করে একমূহুর্তও অপেক্ষা না করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো।
গুগল ম্যাপ ফলো করে আলভী সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। ৭ ঘন্টা কার ড্রাইভ করে অবশেষে সে নির্দিষ্ট স্থানে এসে পৌছাল। এরই মাঝে তার ফোনে গোয়েন্দা টিমের লিডারের কল আসে। আলভী ফোনটা রিসিভ করে গাড়ি থেকে নেমে গেলো।
“হ্যালো?”
গোয়েন্দা লিডার বললেন, “ভাই, সিলেট রেলস্টেশন থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে থাকা বাস স্টপের সিসি টিভি ফুটেজ থেকে ভাবীকে শনাক্ত করা গেছে। ফুটেজ টা আরও ১ মাস আগের। যার মানে ভাবী ১ মাস আগে বাসে চড়ে কোথাও হয়তো চলে গেছে। সে ঠিক কোন বাসে উঠেছেন সেটা আমরা কনফার্ম করতে পারিনি। তবে আমরা আরও বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছি। আর ফুটেজটা আপনাকে পাঠিয়ে দিয়েছি চেক করে দেখুন।”
আলভী কল কেটে দিয়ে ভিডিওতে ক্লিক করতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠলো অলি আর নোমানের মুখশ্রী। যদিও অলির পরণে বোরকা আর মুখে নিকাব বাধা। আলভী হাত মুঠ করে নিলো। ফোনটা আছাড় মারার প্রবল ইচ্ছাটা ধামাচাপা দিয়ে এটিএম ব্যুতের দিকে পা বাড়ালো। সেখানে বসে থাকা দাড়োয়ানের উদ্দেশ্যে বলল,
“আমার একটা ইনফরমেশন দরকার।”
“জি বলুন।”
“ব্যুতের বাইরে সিসিটিভি ক্যামেরা দেখতে পাচ্ছি। এটার ফুটেজটা আমার লাগবে। গতকাল রাতে একটা মেয়ে এখানে এসেছিল। তার ডিটেইলস জানতে চাইছি।”
কথাটা শুনে দাড়োয়ান সন্দিহান চোখে তাকায়,
“দেখে তো ভদ্রলোক মনে হচ্ছে। আপনার তো জানা থাকার কথা যাকে তাকে সিসিটিভি ফুটেজ দেখানোর পারমিশন নেই।”
আলভী চটে গেল। কড়া গলায় বলল,
“আপনাকে টাকা দেবো। দেখান আমাকে।”
“আরে স্যার আমার কাছে সিসিটিভি ফুটেজের এক্সেস নেই তবে আপনি একজন মেয়ের কথা জানতে চেয়েছেন। আমি সেই ব্যাপারে কিছু তথ্য দিতে পারি।”
“হুম বলুন আপনি কি জানেন?”
“বোরকা আর নিকাব পরিহিতা একটা মেয়ে গতকাল রাতে এসেছিল।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ সেই মেয়েটাই। আপনি বলতে পারবেন সে কোনদিকে গেছে?”
দাড়োয়ান রাস্তার ডানদিকে দেখিয়ে বললেন,
“মেয়েটা ওইদিকে কিছুদূর যেতেই আরও দুজন এসে তাকে নিয়ে চলে যায়। তাদের কোলে একটা বাচ্চাও ছিলো।”
আলভী হতভম্ব হয়ে গেলো, “দুজন?”
“হ্যাঁ তাদের মধ্যে একজন নারী আর একজন পুরুষ ছিলো।”
আলভী এবার নোমানের ভিডিও দেখিয়ে বলল,
“দেখুন তো এই লোকটা কিনা?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ এই লোকটাই।”
আলভী এবার হতাশায় চুল টানতে লাগলো।
“ধ্যাৎ এভাবে কোথায় কোথায় খুজবো?”
আলভী দাড়োয়ানের দেখিয়ে দেওয়া রাস্তা অনুসরণ করে হাটতে লাগলো পথিমধ্যে থাকা দোকানদারদের অলি আর নোমানের ভিডিও দেখিয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগলো। এরই মাঝে সে সেই বুকশপে এসে হাজির হয়। অলি আর নোমানের ভিডিও দেখাতেই বুকশপের মালিক ভ্রু কুচকে আলভীর দিকে তাকায়। আলভীকে দেখতে খানিকটা সন্দেহজনক লাগছে।
“আপনি এনাদের কথা জিজ্ঞেস করছেন কেনো?”
আলভী বুঝতে পারলো লোকটা হয়তো নোমানকে চেনে। আলভী কিছুক্ষণ চুপ থেকে অলির ছবি দেখিয়ে বলল,
“আমি ওর হাজব্যান্ড, সেই জন্যই জানতে চাইছি। প্লিজ বলুন না আপনি জানেন, ও কোথায় আছে?”
বুকশপের মালিক মুখ বাকিয়ে বললেন,
“আপনি ওনার হাজব্যান্ড হলে আপনার তো জানার কথা যে আপনার বউ কোথায় আছে।”
আলভীর চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। ইচ্ছা করছে লোকটার নাক ফাটিয়ে ফেলতে,
“আপনি ওর ঠিকানা দিতে পারলে আপনি যত টাকা চাইবেন আমি আপনাকে ততো টাকাই দেবো।”
লোকটা চুপ হয়ে গেলো। তারপর বলে উঠলো,
“আমার টাকার প্রয়োজন নেই। শুধু প্রমাণ দিন যে উনি আপনার স্ত্রী হয়। তাহলেই আমি ঠিকানা দিয়ে দেবো।”
আলভী কিছু একটা ভেবে ফোনে থাকা তার আর অলির রিসেপশনের ছবি বের করে দেখাল,
“দেখুন, ওর আর আমার রিসেপশনের ছবি।”
***
পৃথিবীর বুকে রাত নেমে এসেছে। রুমজুড়ে কৃত্রিম আলো বিরাজমান, অলি মাগরিবের নামাজ আদায় করে ধীর হস্তে ওয়ারড্রব খুলল। সযত্নে তুলে রাখা নিজের ব্যাগটা টেনে বের করলো। খাটের উপরে আরিশ নির্বিঘ্নে ঘুমোচ্ছে, একদিনের জ্বরেই বাচ্চা ছেলেটা কাহিল হয়ে গেছে। যদিও জ্বর ছেড়ে দিয়েছে। ঘুমন্ত ছেলের মুখটা দেখে অলি অবচেতন মনেই হেসে উঠলো। ব্যাগ থেকে সাদা রুমালে মোড়ানো একজোড়া নূপুর বের করলো অলি। সোনালি নূপুরদুটো আলোর সংস্পর্শে আরও ঝলমল করে উঠলো। এই নূপুরজোড়া আলভী দিয়েছিল তাকে। কতদিন যাবত ব্যাগের মধ্যেই বন্দী ছিল এই স্মৃতিগুলো। নোমান বাড়িতে নেই। সেই হিসেবে নূপুর পড়ায় বাঁধা নেই।
অলি খাটের উপর পা তুলে বসলো। প্রথমে ডানপায়ে একটা নূপুর পড়লো তারপর বাম পায়ে পড়লো। নূপুর পড়তেই তার বুকের ভেতর ধুকপুক ধুকপুক করতে লাগলো। মনে হচ্ছে আলভী আশেপাশেই আছে। সে যেন তাকে অনুভব করতে পারছে। অলি ঠোঁট চেপে কান্না নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলো কিন্তু পারলোনা। আলভীর ভাবনা তাকে ঘিরে ফেলেছে, অলি মাথা ঝাকিয়ে খাটের বাইরে পা রাখতেই নূপুরের রিনিঝিনি শব্দ পুরো রুমে ছড়িয়ে পড়লো। সেই সাথে অলির হৃৎস্পন্দনের গতি এলোমেলো হতে শুরু করলো। অলি ছুটে গেল জানালার দিকে, মনকে স্বাভাবিক করতে একটু তাজা হাওয়া প্রয়োজন। জানালা খুলে দিতেই বাতাসের ঝাপটা এসে ছুয়ে দিলো অলির শরীর। অলি চোখ বন্ধ করে একটা বড় শ্বাস টেনে নিলো। কয়েক সেকেন্ড পর চোখ মেলে আশেপাশে তাকাতেই লক্ষ্য করল ফ্ল্যাটের সামনে একটা গাড়ি থেমেছে। সাথে সাথেই অলি বড় বড় চোখে তাকালো। গাড়িটা চিনতে খুব একটা অসুবিধা হলোনা তার। অলি থমকে গেল, শ্বাস নিতেও ভুলে গেল। গলা শুকিয়ে আসছে। এরই মাঝে গাড়ি থেকে আলভী আর বুকশপের দোকানদার নেমে দাঁড়ায়।
অলি দুপা পিছিয়ে গেলো। পাদুটো অবশ হয়ে আসছে, অলি বেখেয়ালি হয়ে রায়ার কাছে ছুটে গেল,
“আপু, আপু। সে এসেছে, সে এসেছে। তুমি তাড়াতাড়ি কিছু করো।”
অলির কথা শুনে রায়া আর নানু ঘাবড়ে গেলেন,
“কে এসেছে অলি?”
“আলোর বাবা এসেছে নানু। প্লিজ কিছু করুন।”
রায়া বিস্মিত কন্ঠে বলল, “আলোর বাবা মানে তোমার স্বামী?”
অলি হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লো। তার হাত-পা কাপছে। গলা শুকিয়ে কাঠ,
,
বেশ কয়েকবার কলিংবেল প্রেস করার পরেও দরজা খুললোনা। আলভীর সহ্যশক্তি ক্রমশই ফুরিয়ে আসছে। পাশে দাড়িয়ে থাকা বুকশপের মালিক অদ্ভুত চোখে আলভীর দিকে তাকিয়ে আছে। রাগে আলভীর মুখাবয়ব রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। শরীর অনবরত কাপছে। কপালের আর ঘাড়ের রগ দৃশ্যমান। ডানহাত দ্বারা একাধারে কলিংবেল প্রেস করছে আর বামহাতে একটা বড়সড় শেকল প্যাচানো। শেকলটার দিকেই তাকিয়ে আছে লোকটা। শেকলটা দিয়ে কি করবে সেটা ভেবেই কূল কিনারা পাচ্ছেনা। এরইমাঝে মৃদু শব্দে দরজা খুলে গেল। আলভী দরজা ঠেলে রুমে ঢুকেই চারপাশে খুঁজতে শুরু করলো। তাকে দেখে রায়া কিছুটা ভয় পেয়ে গেলেও সাহস জুগিয়ে বলল,
“এই মিয়া এই, কে আপনি হ্যাঁ? বলা নাই কওয়া নাই। বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলেন কেনো? আর এতোবার কেউ বেল বাজায়? কান ঝালাপালা করে ফেললেন। ধৈর্য্য বলতেও কিচ্ছু নেই। আর এভাবে কি খুঁজছেন হ্যাঁ?”
আলভী একবার রায়ার দিকে তাকিয়ে আবারও চোখ সরিয়ে খুজতে শুরু করলো এরইমাঝে সে দুটো রুমের সামনে এসে থামে। একটা রুমে তালা ঝোলানো, আরেকটা রুম খোলা। আলভী ভাবনা চিন্তা না করেই খোলা রুমে ঢুকে গেল।
“আরে তুমি?”
আলভীকে দেখে নানু বসা থেকে উঠে দাড়ালেন।
“নাতবউ ওনার জন্য নাস্তা পানির ব্যবস্থা করো গিয়ে।”
নাতবউ ডাক শুনে আলভী ঘাড় ঘুরিয়ে রায়ার দিকে তাকায়। রায়া মাথা নেড়ে রান্নাঘরে চলে গেলো,
“অলি কোথায়?”
নানু অবাক হওয়ার ভান করে বললেন, “অলি কোথায় মানে কি নানুভাই?”
আলভী রাগে হাত মুঠ করে নিলো। কয়েকটা বড়বড় শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলো,
“দেখুন আমি ভালোভাবে জিজ্ঞেস করছি। অলি কোথায়?”
আলভীর হাতে থাকা শেকলটা দেখে নানুর চোখ বড়বড় হয়ে গেলো। আলভী সেটা লক্ষ্য করে শেকলটা পেছনে লুকিয়ে নিলো। তারপর উত্তরের অপেক্ষা না করে নিজে থেকেই খুঁজতে লাগলো। এমনকি নানু যেই খাটে বসে ছিলো সেই খাটের নিচেও তন্নতন্ন করে খুঁজল কিন্তু পেলোনা। আলভী রুম থেকে বেরিয়ে রান্না ঘরে চলে গেলো। তাকে দেখে রায়া মাথার কাপড় ঠিক করে সরে দাড়ালো। আলভী পাগলের মতো অলিকে খুজতে লাগলো, একপর্যায়ে ফ্রিজ খুললে রায়া হতবাক হয়ে যায়,
“আপনি এসব কি করছেন?”
আলভী গম্ভীর কন্ঠে বলল, “অলিকে বের করুন জলদি।”
ফ্রিজ খোজা শেষে আলভী পাতিলের ঢাকনা পর্যন্ত উঠিয়ে খুঁজতে লাগলো। তাকে এমন পাগলামি করতে দেখে রায়া দৌড়ে গিয়ে নানুর ফোনটা হাতে নিয়ে নোমানের নম্বর ডায়াল করলো।
রাত্রী ৮ টা,
আলভী বসার রুমের চেয়ারে বসে তালা ঝোলানো রুমটার দিকে তাকিয়ে সিগারেট ফুকছে। রায়া আর নানু অন্য রুমের দরজার সামনে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আলভীকে দেখে তাদের ভয় করছে,
“আমিও দেখবো ও কতক্ষণ দরজার ওপারে নিজেকে বন্দী করে রাখতে পারে।”
রায়া ঢোক গিলে বলল, “বললাম তো ওই রুমে অন্য ভাড়াটিয়া থাকে। তারা গ্রামের বাড়িতে গেছে।”
আলভী শান্তচোখে রায়ার পানে তাকাতেই রায়ার শরীর শিউরে উঠলো। আড়ষ্ট হয়ে নানুর সাথে লেগে দাড়াল, আলভী বিরবির করে বলল,
“নোমান বিয়ে করে নিলো, দাওয়াত দিলোনা। ভেরি ব্যাড।”
দরজার অন্যপাশে অলি হাটুতে মুখ গুজে বসে বসে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। এরইমাঝে আরিশের ঘুম ভেঙ্গে যায়। বন্ধ দরজার ওপর পাশ থেকে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসতেই আলভীর কান সজাগ হয়ে গেল, হাতে থাকা সিগারেট টা মুষ্টিবদ্ধ করে দ্রুত পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। এদিকে অলি আরিশের দিকে পা বাড়াতেই তার নূপুরজোড়া রিনিঝিনি শব্দে বেজে উঠলো। অলি চোখজোড়া মুছে সেভাবেই ছুটে গেলো আরিশের কাছে। অন্যদিকে আলভীর ধৈর্য্যের বাধ পুরোপুরি ভাবে ভেঙ্গে গেল। সে হাত দিয়ে দরজার উপর ঘুষি দিতে লাগলো। প্রত্যেকটা আঘাতের শব্দে অলির রূহ কেপে উঠছে,
“তুই আমার হাত থেকে বাচতে পারবিনা। এই দরজা তোকে বেশিক্ষণ বাচিয়ে রাখতে পারবেনা।”
অলি আরিশকে বুকে আগলে নিঃশব্দে কেদে উঠলো। আলভীর হাতজোড়া রক্তাক্ত হয়ে গেছে। তবু্ও সে অনবরত দরজায় আঘাত করছে। রায়া তো রুমে ঢুকে চোখ কান বন্ধ করে বসে রইলো, প্রচন্ড ভয় পাচ্ছে মেয়েটা। নানুও আলভীকে আটকাতে যাওয়ার সাহস পাচ্ছেননা। এরই মাঝে নোমান ঘরে প্রবেশ করে। আলভীকে এরকম উন্মাদের মতো করতে দেখে সে ডেকে উঠল,
“রায়ায়ায়া,”
নোমানের ডাক শুনে রায়া কেপে উঠলো। ছুটে এলো নোমানের কাছে,
“গিয়ে দরজাটা খুলে দেও।
নোমানের কথাটা বোধগম্য হতেই রায়া হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ে। সে অনেক আগেই দরজা খুলে দিতে চেয়েছিল কিন্তু নোমানের ভয়েই দেয়নি। রায়া চাবিটা বের করে দিতেই আলভী খপ করে চাবিটা নিয়ে দরজা খুলে রুমে ঢুকলো। তারপর ঠাস করে ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দিলো। দরজা লাগানোর বিকট শব্দে রায়া আনমনেই গিয়ে নোমানের বাহু জড়িয়ে ধরে কেদে উঠলো।
“উনি এরকম করছেন কেন?”
রায়ার কান্নাজরিত কথাগুলো শুনে নোমান নরম কন্ঠে বলল,
“ভয় পেওনা।”
রায়া থমকে গেলো। নোমানের শীতল কন্ঠ শুনে সে শান্ত হয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা নোমান তাকে তুমি করে সম্মোধন করেছে।
চলবে,,,
শব্দসংখ্যা- ২৮৫০+