#১৫_বছর_বয়সী_মা (৬৬/অন্তিম পর্ব)
#সোফিয়া_সাফা
রূপসাকে নিয়ে ইয়াদ বেরিয়ে যেতেই নূরনাহার ডুকরে কেদে উঠলেন। সে কিভাবে বোঝাবেন কতটা যন্ত্রণায় জর্জরিত হয়ে ছেলেকে এভাবে বলেছেন। আলভী এখনও ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, দিহান এতক্ষণে নিচে চলে এসেছে।
রাত্রির গভীরতা বেড়েই চলেছে। আরিশকে দোলনায় শুইয়ে দোল দিচ্ছে অলি। ছেলেটা কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে গেছে। আলভী রুমে নেই, দিহান আসার পর থেকেই সে দিহানের সাথে ব্যস্ত। এরই মাঝে দরজা লাগানোর আওয়াজ ভেসে এলো। ঘাড় বাকিয়ে তাকাতেই দেখল, আলভী এলোমেলো পায়ে বিছানার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অলি নিজেও গিয়ে আলভীর পাশে বসল,
“কি হয়েছে? চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন আপনাকে?”
আলভী থতমত খেয়ে গেল। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বসা থেকে উঠে দাড়াল। ব্যতিব্যস্ত পায়ে চলে গেল কাভার্ডের কাছে। সেখান থেকে একটা সাদা রঙের শপিং ব্যাগ বের করে পুনরায় অলির কাছে ফিরে এলো। আলভীর হাতে শপিং ব্যাগ দেখে অলি ভ্রু কুচকে তাকাতেই আলভী ফিচেল হেসে বলল,
“এটা তোমার জন্য এনেছিলাম। দেয়া হয়ে ওঠেনি।”
অলি ব্যাগটা হাতে নিল। ব্যাগ খুলতেই একটা শাড়ি নজরে এলো। সে শাড়িটা বের করে নেড়ে চেড়ে দেখতে লাগল, অলির চোখেমুখে হাসির ঝিলিক দেখে আলভীর মন খারাপে’রা বহুদূর সরে গেল। অলি আলভীর ডান হাতটা হাতের মুঠোয় নিয়ে ঠোঁট ছোয়াল,
“ধন্যবাদ।”
আলভী দুষ্ট হেসে বলল,
“শুধু ধন্যবাদ দিলেই যে হবেনা মিসেস তাসনীম মির্জা। শাড়িটা পড়ে আসুন। দেখি আপনাকে একটু।”
অলি মাথা নিচু করে উঠে দাড়াতেই আলভী বলল,
“আপনার যদি সাজতে মন চায় তাহলে সাজতেও পারেন। এখন আর বাধা নিষেধ নেই।”
অলি লজ্জায় জবুথবু হয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। আলভী উঠে গিয়ে আরিশের মশারি ঠিক করে দিয়ে ব্যালকনিতে চলে গেল। কোনো একটা ভাবনা তাকে শান্তি দিচ্ছেনা, ভীষণ ভাবে ক্ষতবিক্ষত করছে।
এদিকে অলি শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে বসল। চিরুনি টা হাতে নিয়ে চুল আঁচড়ে উঁচু করে খোপা করে নিল। তারপর হাল্কা করে মেক-আপ করে ঠোঁটজোড়া লাল টকটকে লিপস্টিকের আবরণে ঢেকে ফেলল। সবশেষে পারফিউম টা হাতে নিতেই আলভী পেছন থেকে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। একহাতে পারফিউম টা পূর্বের জায়গায় রেখে অলিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে হিসহিসিয়ে বলল,
“এসব কৃত্রিম ঘ্রাণ ইউজ করবেনা কখনো। এতে করে আমার পছন্দের সুঘ্রাণটা ঢাকা পড়ে যাবে।”
আলভীর কথা শুনে অলির শরীর কাপছে, আলভী অলিকে উপনিচ পরখ করে ঠোঁট কামড়ে হাসল, শাড়িটাতে অলিকে কল্পনার চেয়েও অধিক সুন্দর লাগছে,
“তোমার নূপুর জোড়া পড়ে নেও।”
অলি আলমারি থেকে নূপুর জোড়া বের করতেই আলভী নিজ হাতে সেগুলো অলির পায়ে পড়িয়ে দিল। তারপর অলিকে টেনে নিয়ে গেল বিছানার দিকে। বিছানার সামনে অলিকে দাড় করিয়ে নিজে বিছানার উপর বসল। শাড়িটাতে অলিকে একদম ফুলপরীর মতো লাগছে। আলভী একটানে অলিকে নিজের সামনে বসিয়ে তার চুল গুলো বাধনমুক্ত করল। অলি তো চোখ বন্ধ করে ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে। হার্টবিট বেড়ে যাওয়াতে বুকটা অসম্ভব রকমের ওঠানামা করছে। আলভী একহাত অলির চুলের ভাজে রেখে নরমকন্ঠে বলল,
“এই পাগলি মেয়ে, ভয় পাচ্ছো কেন এতো? তাকাও আমার দিকে।”
অলি পিটপিট করে চোখ মেলতেই আলভীর হাসোজ্জল মুখশ্রী নজরে এলো।
“তোমার হার্ট খুব সেনসিটিভ হানিবি। আমি কি থেমে যাবো?”
অলি একটা শুষ্ক ঢোক গিলে নাবোধক মাথা নাড়ল। আলভীর হাসি আরও প্রসন্ন হল।
“থামবো না?”
অলি বিনাবাক্যে আলভীকে জড়িয়ে ধরল।
ভোর ৫ টা, আলভী ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। ভেজা চুলগুলো থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। এরইমাঝে অলি এসে তার পাশে দাড়াল। হাতে থাকা তোয়ালেটা দিয়ে ভালো করে মাথা মুছে দিতে লাগল। আলভী একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে অলির দিকে তাকাল। অলিকে ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছে, মাত্রই সে ফজরের নামাজ আদায় করে এসেছে।
“শুনছেন?”
অলির ডাকে আলভী খানিকটা বিরক্ত মিশ্রিত কন্ঠে বলল,
“রাতের স্পেশাল ক্লাসের পরেও আপনি সম্মোধন ঠিক মানতে পারলাম না।”
অলির অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল, প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল,
“নামাজ পড়ে নেও গিয়ে।”
আলভী যেন কথাটা শুনেও শুনলোনা। এরইমাঝে তারা অদ্ভুত কিছু শোরগোলের আওয়াজ শুনতে পায়। অলি গিয়ে দরজা খুলে দিতেই ঊর্মিলা আর দিহান হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢুকে পড়ল, ঊর্মিলার অবস্থা দেখে অলি ভীষণ রকমের ঘাবড়ে গেল।
“কি হয়েছে আপু? এরকম করছো কেন?”
ঊর্মিলা কিছুই বলে উঠতে পারলোনা। দিহান ঊর্মিলাকে ধরে নিয়ে গিয়ে খাটে বসাল। তারপর উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
“ইয়াদ আর রূপসা যেই গাড়ি করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছিল সেই গাড়িটা এক্সিডেন্ট করেছে।”
অলি বিস্ফোরিত নয়নে দিহানের দিকে তাকায়,
“কিহ?”
এতোক্ষণ যাবত আলভী ভ্রুক্ষেপ না করলেও এবার এগিয়ে এলো,
“ক্লিয়ার করে বলবি?”
দিহান বলল, “আমিও পুরো ব্যাপারটা জানিনা। কিছুক্ষণ আগেই কান্নাকাটির শব্দ শুনে রুম থেকে বেরিয়ে দেখলাম কাকিমা কান্না করছেন তার থেকেই শুনলাম।”
তাদের কথার মাঝেই শাহানাজ বেগম রুমে এলেন,
“এভি, তোর কাকিমাকে সামলানো যাচ্ছেনা। তুই একটু আয়না বাবা।”
আলভী কোনোরকমে একটা শার্ট গায়ে জড়িয়ে চলে গেল। অলিও আরিশকে কোলে নিয়ে ড্রইংরুমে এসে উপস্থিত হল। উসমান মির্জা ফোনে কারো সাথে কথা বলছেন। আলভী নূরনাহারের পালস রেট চেক করে খানিকটা চিন্তিত হয়ে পড়ল। বাবার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,
“ঠিক কি হয়েছে বলবে?”
উসমান মির্জা ফোনটা রেখে একবার ইয়ামিন মির্জার দিকে তাকালেন। ইয়ামিন মির্জা মূর্তির মতো বসে আছেন। উসমান মির্জা ধীরেসুস্থে বলতে আরম্ভ করলেন,
“গতরাতে বাড়ি ফেরার পথে ইয়াদের গাড়িটা ঝিলে পড়ে গেছে। ওদেরকে উদ্ধার করা হচ্ছে কিন্তু গাড়িটার অবস্থা…
উসমান মির্জা আর কিছু বলে উঠতে পারলেন না। বেলা ৭ টার দিকে সবাই এসে হাতিরঝিলের সামনে হাজির হল। নূরনাহারকে আনা সম্ভব হয়নি। ছেলে হারানোর শোক সহ্য করতে না পেরে সে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। একপর্যায়ে তাকে ইমার্জেন্সিতে ভর্তি করাতে হয়েছে। ঝিলের একপাশে বাড়ির সবাই বিধ্বস্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। সামনেই সাদা চাঁদর মোড়ানো দুটো লাশ। এরই মাঝে ওসি সাহেব এগিয়ে এলেন, রহিম আহমেদ একহাতে স্ত্রীকে সামলানোর চেষ্টা করে কাতর গলায় বললেন,
“শেষ বারের মতো একবার আমাদের মেয়েটাকে দেখতে দিন।”
ওসি সাহেব ভারী গলায় বললেন,
“গাড়িটার অবস্থা দেখে লাশদুটোর অবস্থাও তো অনুমান করতে পারছেন। পানিতে পড়ার পূর্বেই গাড়িতে আগুন লেগে গিয়েছিল।”
রুনা খাতুন সহ্য করতে না পেরে হাউমাউ করে কেদে উঠলেন। রহিম আহমেদ তাকে নিয়ে অন্যদিকে সরে যেতেই উসমান মির্জা বলে ওঠেন,
“কিভাবে এতোবড় দূর্ঘটনা ঘটে গেল? আপনারা কি ধারণা করতে পারছেন?”
“আপাতত নিশ্চিতভাবে কিছুই বলা যাচ্ছেনা। অনুমান থেকে বলা যায় যান্ত্রিক ত্রুটির কারণেই দূর্ঘটনাটি ঘটেছে। পোস্ট মর্টেমের রিপোর্ট পাওয়ার পরই নিশ্চিতভাবে বলা যাবে।”
***
সেদিনের পর চারসপ্তাহ কেটে গেল, এসব কিছু প্রকৃতির উপর প্রভাব না ফেললেও মির্জা পরিবারের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। গতকালকেই ইয়াদ আর রূপসার কেসটা যান্ত্রিক ত্রুটি হিসেবে ঘোষণা করে ক্লজ করে দেয়া হয়েছে। ফরেনসিক থেকে জানা গেছে গাড়ির ইঞ্জিনে সমস্যা থাকার কারণেই গাড়িতে আগুন লেগে গিয়েছিল। আর সেটার সূত্র ধরেই গাড়িটা কন্ট্রোল হারিয়ে ঝিলের পানিতে গিয়ে পড়েছিল। ইয়াদ আর রূপসার কথাটা কোনোভাবে দাদুমনিও জেনে যায় যার কারণে ৩য় বারের মতো সে স্ট্রোক করে। তাকে নিয়েও বেশ ছোটাছুটি করতে হয়েছে। নূরনাহার স্বাভাবিক হয়েছে বললে ভুল হবে। একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে সে যেন পাথরে পরিনত হয়েছেন। তারউপর সেদিন ছেলেকে ওভাবে বলাতে তার মনটা প্রতি মুহুর্তে বিষিয়ে ওঠে। শেষ সময়ে সে কেন ওভাবে বলেছিল ছেলেকে? কেনো থেকে যেতে বলেনি? কেনো বলেনি, চল আমরা আবার শুরু থেকে শুরু করি। সবকিছু ভুলে গিয়ে নতুনভাবে শুরু করি। তার তো ইচ্ছা করেছিল ছেলেকে আটকাতে তবুও কেনো আটকাতে পারলোনা।
নূরনাহার হঠাৎ কেদে উঠতেই অলি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল, তার কান্না দেখে অলির নিজেরও কান্না পায়। একজন মা হওয়ার সুবাদে সে যেন নূরনাহারের কষ্টটা গভীর ভাবে অনুভব করতে পারে। নূরনাহারকে কষ্ট দিতে চায়নি বলেই তো ইয়াদকে সে ক্ষমা করে দিয়েছিল। তবুও কেনো এমনটা হল? একেই কি বলে— ‘কর্মের ফল বাতাসে নড়ে?’ সন্তান হারানো মাকে শোনানোর মতো কোনো সান্ত্বনার বানী নেই অলির ঝুলিতে। সে শুধু পারবে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে।
রাত ৯ টার দিকে আলভী বাড়িতে ফেরে। ঊর্মিলার বিয়ের পর থেকেই আলভী আগের সিডিউল ফলো করছে। একবার অফিস তো আরেকবার হসপিটালে ছুটেই তার দিন পেরিয়ে যায়। নিত্যদিনের অভ্যাস অনুযায়ী আলভী বাড়িতে আসতেই অলি তার জন্য শরবত বা কফি বানিয়ে আনে। আজও তার ব্যতিক্রম হলোনা। আগে বারণ করলেও এখন আলভীর কাছে ব্যাপারটা ভালো লাগে। ফ্রেশ হয়ে এসে আলভী অলির উদ্দেশ্যে বলল,
“আগামী কাল শ্বশুরবাড়িতে যাচ্ছি আমি অনেক এক্সাইটেড।”
কথাটা শুনে অলির মনটা খারাপ হয়ে গেল। আলভীও কথাটা বলার পর আফসোস করতে লাগল,
“এক্সাইটেড হয়ে আর কি হবে? যেখানে শ্বশুর শ্বাশুড়িই নেই।”
আলভী প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,
“তুমি কিন্তু পড়াশোনা একদমই করছোনা। আমার তো ভয় হচ্ছে আবার না ফেল করে আমাকে লজ্জায় ফেলে দেও।”
অলি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলল,
“ফেল করার মতো খারাপ স্টুডেন্ট নই আমি। পূর্বে ফেল করার কোনো রেকর্ডও নেই।”
আলভী হেসে উঠল,
“আচ্ছা পাস করলে তোমাকে একটা কিছু গিফট করবো।”
অলির ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল,
“সত্যিই? কি গিফট করবে হুম?”
“সেটা পাস করার পরেই জানতে পারবে।”
অলি মুখ কুচকে আলভীর দিকে এগিয়ে গেল,
“এখুনি বলোনা।”
“নাহ।”
“বলোনা প্লিজ।”
আলভী দুষ্ট হেসে অলিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে তার পেটে হাত রেখে হিসহিসিয়ে বলল,
“একটা ছোট্ট রাজকুমারী গিফট করবো।”
অলির চোখ বড়বড় হয়ে গেল। একমূহুর্ত অপেক্ষা না করে আলভীর হাত সরিয়ে দিয়ে কয়েক কদম সরে গিয়ে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল,
“একদম না।”
আলভী হাসি চেপে রেখে বলল,
“গিফট পছন্দ হলোনা?”
“নাহ। চাইনা আমার গিফট, তোমার গিফট তুমি নিজের কাছেই রাখো।”
কথাটা বলেই অলি একছুটে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
অনেকদিন পর আজকে রাতের খাবারটা পরিবারের সবাই একসাথে খেল। ঊর্মিলা আর দিহান আজকেই এসেছে। অলির পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সুবিধার্থে আলভী তাকে নিয়ে তাদের বাড়িতে যাবে। একদম পরীক্ষা শেষ হলে আসবে। ততদিন ঊর্মিলা আর দিহান এই বাড়িতেই থাকবে। নইলে বাড়িটা একদম শূন্য হয়ে যাবে যে।
***
পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে প্রিয় মুখটা দেখে অলির সমস্ত ক্লান্তিভাব কেটে গেল। তার অপেক্ষাতেই গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আলভী, পরণে ব্রাউন রঙা শার্ট। কোলের মাঝে আরিশ ঘুমিয়ে আছে। অলি কাছে আসতেই আলভী একহাতে পকেট থেকে রুমাল বের করে অলির কপালে জমে থাকা ঘাম মুছে দিল। প্রশান্তিতে অলির ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি ফুটে উঠল।
“ভালোই গরম পড়ছে, বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
উত্তরে আলভী গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে বলল,
“কিছুক্ষণ আগেই বের হয়েছি। ভাবলাম তুমি যদি আমাকে না দেখে ঘাবড়ে যাও।”
অলি ঠোঁট উল্টে বলল,
“আমি বাচ্চা নই জনাব। উল্টো একবাচ্চার মা।”
“হুম জানি, লিটল হানিবি। ইউ আর ভেরি ম্যাচিওরড।”
“আপনি কি ঠাট্টা করলেন?”
“কই নাতো। আমি তো ভুলেই গেছি গত পরীক্ষার দিন আপনি আমাদেরকে না দেখতে পেয়ে কেদেই ফেলেছিলেন।”
অলি এবার ভারী লজ্জা পেল। লোকটা সবসময় তাকে লজ্জায় ফেলে দেয়। হ্যাঁ গত পরীক্ষার দিন সে বের হয়ে আলভীকে না দেখতে পেয়ে একটু ইমোশনাল হয়ে গিয়েছিল। তাই বলে এভাবে বলবে?
“উঠুন বিবিজান। খুব ক্ষুধা লেগেছে।”
অলি বিনাবাক্যে গাড়িতে উঠে বসল। আরিশকে অলির কোলে দিয়ে আলভী ড্রাইভিং সিটে বসতেই অলি দোয়া দুরুদ পড়তে লাগল। আলভী একটা শ্বাস ফেলে গাড়ি স্টার্ট দেয়। ইয়াদ আর রূপসার সেই ঘটনার পর অলি গাড়িতে উঠতে ভয় পায়। সে অবশ্য জানে যার হায়াত যতদিন আছে সে ততদিনই বাচবে তবুও মানুষের মন বলেও একটা কথা আছে। রেস্টুরেন্ট থেকে খাওয়া দাওয়া করে তারা বাড়িতে ফিরে আসে।
মাগরিবের নামাজ আদায় করে অলি কিচেনে গেল। কফি আর নাস্তা বানিয়ে রুমে এসে দেখল আলভী আর আরিশ রুমে নেই।
“আলো।”
আরিশের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে অলি ডানপাশের খোলা বারান্দায় এলো। এখানে এসে দেখল আরিশকে কোলে নিয়ে আলভী বসে আছে,
“এইযে, এতোক্ষণ যাবত ডাকছি শুনছো না?”
আলভী বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“হু, শুনেছি,”
“তাহলে উত্তর দিচ্ছিলে না কেন?”
“তুমি তো ছেলেকে ডাকছিলে। আমি উত্তর দেবো কেন?”
অলি থতমত খেয়ে গেল। সে মূলত আলভীকেই ডাকছিল আরিশকে নয়। আরিশ কি কথা বলতে পারে নাকি? আলভীর তো বোঝা উচিৎ ছিল তাইনা।
অলি হাতে থাকা নাস্তার ট্রেটা ছোট্ট টেবিলটার উপর রাখতেই লোডশেডিং হল। অলি অবশ্য ঘাবড়াল না। পাশে তো আলভী আছেই তার উপর আজকে চাদনি রাত। খোলা বারান্দা দিয়ে বাতাস আসছে। কফির মগটা আলভীর হাতে দিয়ে অলি সামনের চেয়ারে বসে পড়ল,
“নামাজ পড়তে বলেছিলাম। পড়লে না কেন?”
আলভী উত্তর দিলোনা। অলি বুঝে উঠতেই পারেনা। এই নামাজের কথা বললেই আলভী এমন চুপ হয়ে যায় কেন? অলি জোরও করতে পারেনা। আর যাই হোক স্বামীকে জোর করাটা মানায় না। আর আল্লাহর ইবাদত তো মন থেকে করতে হয়। সে শুধু তাগাদা দিতেই পারবে জোরজবরদস্তি করতে পারবেনা। আলভী একদৃষ্টিতে বাগানের দিকে তাকিয়ে কফির মগে চুমুক দিচ্ছে। ইদানীং অলি বেশ দারুণ কফি বানায়।
“তোমার পছন্দের গোলাপ গাছগুলো কেটে ফেললে কেন?”
আলভীর প্রশ্নে অলি কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে বলল,
“আলোর আর তোমার তো গোলাপে এলার্জি। সেই জন্যই।”
অলি একবার বাগানের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল। এবার এসেই বাড়ির কেয়ার টেকারকে দিয়ে অলি বাগানের সব গোলাপ গাছ কেটে ফেলেছে। গোলাপের পরিবর্তে লাগিয়েছে বিভিন্ন ফল আর গন্ধহীন ফুলের গাছ। যেগুলোতে মূলত আলভী বা আরিশের সমস্যা হবেনা। এরইমাঝে অলি বলে ওঠে,
“আমি যে তোমাকে নামাজ পড়তে বলি তাতে কি তুমি বিরক্ত হও?”
আলভী উত্তর দিলোনা,
“তুমি বিরক্ত হলে আমি আর বলবোনা।”
আলভী এবারও নিশ্চুপ,
“আমি আসলে পরকালেও তোমার সাথে থাকতে চাই সেই জন্যই এতোবার বলি।”
আলভী এবার গম্ভীর গলায় বলল,
“নামাজ পড়লেই কি পরকালে আমরা পুনরায় মিলিত হতে পারবো?”
“মা বলতেন, সব নামাজিরাই যে জান্নাতি হবে তেমন নয় তবে সব জান্নাতিরাই নামাজি থাকবে। কারণ নামাজ বেহেশতের চাবি। চাবি ছাড়া কি বন্ধ দরজা খোলা যায়?”
আলভী প্রতিউত্তর করলোনা। বারান্দা জুড়ে নেমে এলো নিস্তব্ধতা। বেশ অনেকক্ষন পর আলভী হাতের মগটা টেবিলের উপর রেখে অদ্ভুত গলায় প্রশ্ন ছুড়লো,
“সেদিন কাকিমা বললেন খু’নিরা নাকি জান্নাতে যেতে পারবেনা। এটা কি সঠিক?”
অলি চমকিত নয়নে আলভীর দিকে তাকায়। আলভী হঠাৎ এমন প্রশ্ন করছে কেন?
“আচ্ছা বউজান, কোনো ইবাদত সাধনা করেই কি তারা জান্নাতে যেতে পারবেনা?”
আলভীর অসহায় কন্ঠ শুনে অলির বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। অজানা আতঙ্কে গলা শুকিয়ে এলো।
“ক…কি হয়েছে তোমার? এসব কেন জানতে চাইছো?”
আলভী শ্বাস ফেলে বলল,
“এমনি, জানতে মন চাইলো তাই জিজ্ঞেস করলাম। আই থিংক কাকিমা ঠিকই বলেছিলেন। তাছাড়া আমি মনে করি খু’নিরা নামাজ পড়লে নামাজকে অসম্মান করা হয়।”
আলভী উঠে দাড়াতেই অলি বলে উঠল,
“এমন অনেক যোদ্ধারা ছিল যারা ধর্ম প্রতিষ্ঠা, দেশ রক্ষা এবং পরিবার রক্ষার্থে যুদ্ধের ময়দানে প্রাণ নিয়েছেন। অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তিস্বরূপ মৃ’ত্যুদন্ডও তো কার্যকর করা হয়। সেখানে তো মানুষকে একপ্রকার খু’নই করা হয় তাইনা? তাহলে খু’ন করলেই যে জাহান্নামে যাবে সেটা সবক্ষেত্রে সঠিক নয়। আগে দেখতে হবে সে খু’নটা কেন করল। খু’ন করা জঘন্যতম অপরাধ। কিন্তু আল্লাহ তো ক্ষমাশীল। কে বলতে পারে ক্ষমা চাইলে হয়তো তিনি খু’নিকেও ক্ষমা করে দিতে পারেন। তার কাছে যে অসম্ভব বলে কিছুই নেই। আর ক্ষমা চাইতে হলে তো নামাজ পড়তেই হবে।”
আলভী থমকে গেল। শান্তচোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল অলির দিকে। অলি অজান্তেই তার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছে।
“অলি, এরপর থেকে আমিও নামাজ পড়ব ইনশাআল্লাহ।”
আলভীর কথা শুনে অলি ভীষণ খুশি হল। আলভী ঘুরে এসে অলির সামনে দাঁড়াল। আরিশকে অলির কোলে রেখে অলির মুখখানা দু হাতের আঁজলায় নিয়ে অলির কপালে ঠোঁট ছোয়াল। মৃদুস্বরে বলল,
“আমার অন্ধকারে নিমজ্জিত ভূবনে তুমিই একমাত্র উজ্জ্বলতার উৎস, যার আলো আমার পথকে আলোকিত করেছে। তুমিই সেই ভুল, যে ভুল করে আমার কখনো আফসোস হয়নি। যে ভুল আমি আরও অসংখ্যবার করতে চাই। খুব ভালোবাসি তোমাকে, হানিবি।”
অলি আলভীর গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে নরম স্বরে বলল,
“ধন্যবাদ আমার জীবনে আসার জন্য… আমাকে আগলে রাখার জন্য… আমাকে এতোটা ভালোবাসার জন্য… সবকিছুর ঊর্ধ্বে গিয়েও আমার হাত না ছাড়ার জন্য। একটি ভুলকে সঠিকের মর্যাদা দেওয়ার জন্য। আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি, স্বামীজান।”
এরই মাঝে বিদ্যুৎ চলে এলো। আরিশ কেদে উঠতেই অলি তাকে নিয়ে বেডরুমের দিকে হাটা ধরল। আলভী বাগানের দিকে তাকিয়ে বুকে হাত বেধে একটা লম্বা শ্বাস নিল। ঘাড় কাত করে আপনমনেই বলল,
“এমন কিছু আছে যা তুমি কখনোই জানতে পারবেনা হানিবি। লাবিবকে আমি খু’ন করেছি, রিফাতের লাশ কবর থেকে তুলে এনে টুকরো টুকরো করেছি। আর পরিশেষে ইয়াদ আর রূপসা… তুমি ওদেরকে ক্ষমা করে দিতে পারলেও আমি পারিনি। ওরা ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য ছিলোনা। ওরা বেচে থাকলে আমি স্বস্তি পেতাম না। সর্বদা ভয়ে ভয়ে থাকতে হতো। আমি জানিনা পরকালে আমার স্থান কোথায় হবে। কিন্তু আমি আমার পাপের ভাগিদার তোমাকে বানাতে পারবোনা হানিবি। তুমি পবিত্র, আমি শুধু সেই পবিত্রতার ছায়াতলে একটু আশ্রয় প্রার্থী। আমার জন্যই তোমাকে সব হারাতে হয়েছে, আমি শুধু চাইবো পরকালে তুমি সেইসব কিছু ফেরত পাও। একটি সদ্য জন্মানো শিশুর ন্যায় নিষ্কলঙ্ক থাকো। আমি তোমার জীবনে কলঙ্ক হয়ে যেন না আসি।”
———————সমাপ্ত।।।