#সুগন্ধি_ফুল_২
#পর্ব_১৫
#জান্নাত_সুলতানা
ফিজা খুব ক্লান্ত। শপিং শেষ ডিনার করে বেরিয়ে বেচারি আরও হাঁটতে পারছে না। আবরাজ কিছু শপিং ব্যাগ হাত হাঁটছে। ফিজা চোখ-মুখ কুঁচকে বলে উঠলো,
-“আপনার এতো গার্ড। শুধু শুধু কেনো রেখেছেন?”
-“তো তুমি কী চাইছিলে আমি আমাদের ডেটে ওদের নিয়ে আসি?”
ফিজা চোখ পিটপিট করে তাকায়। আসলেই তো। সে ভেবে দেখে নি সেটা। সারাদিন যা করেছে আবরাজ গার্ড সাথে থাকলে নিশ্চয়ই ফিজা আরও বেশি অপ্রস্তুত হতো। এসব ভাবতেই ওর লাঞ্চ করার সময়কার ঘটনা মনে পরলো। খাওয়াদাওয়া শেষ গাড়িতে আবরাজ ওর শার্টের বাটন তিনটা খুলে নিয়ে ছিলো। সেখানে মুখ গুঁজে কত সময় ছিলো ফিজার সময় মনে নেই। তবে এমন ভাবে তাকে আঁকড়ে ধরে ছিলো মনে হচ্ছিল তার শরীর থেকে আত্মা শুষে নিচ্ছে। ফিজার মনে হতেই শরীর জুড়ে কম্পন ছড়িয়ে পরে। সে ভাবনায় বিভোর আবরাজ ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে টের ও পায় নি। শক্ত খাম্বার মতো কোনো কিছুতে ধাক্কা খেয়ে চোখ মুখ বিকৃতি করে নিলো। সে ভেবে নিয়েছে তার কপাল ফেটে রক্তক্ষরণ হবে। আবরাজ ঘাড় বাঁকিয়ে পেছনে তাকায়। আর গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,
-“সামনে এসো।”
ফিজা কপালে ঘষে একবার। এরপর সামনে চলে আসে। আবরাজ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। হাতে ব্যাগ না থাকলে হয়তো তার মনের না বলা অব্যক্ত বোঝা যেতো। ফিজা চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে বোঝার প্রয়াস করে। আবরাজ চওড়া কাঁধ টানটান করে দাঁড়িয়ে আছে। আর মুখের ভাবভঙ্গি খুব সিরিয়াস। সে গুরুগম্ভীর স্বর আদেশ করে,
-“গলা জড়িয়ে ধরো।”
ফিজা অবাক হয়। চারপাশে তাকায়। মানুষ নিজেদের মতো চলাফেরা করছে। এখন আবার এই পুরুষ কী করবে? ফিজার ভাবতে গিয়ে চোখ বড়ো বড়ো করে নিলো। আবরাজ খুব ভালো মানুষ নয়। তার ভাষায় নির্লজ্জ। যা কিছু হতে পারে।
-“কেনো?”
-“প্লিজ।”
আবরাজ যেনো অনুরোধ করছে। ফিজা চোখ গোল গোল করে হাত বাড়িয়ে গলা জড়িয়ে ধরে। আবরাজ সাথে সাথে নিজের দুই হাত ওর হাঁটুর নিচে দিয়ে জড়িয়ে ধরে। ফিজা চমকায়। এতো কিছু হাতে নিয়ে তাকে-ও কোলে নিয়ে হাঁটতে অসুবিধা হবে না? ফিজার খারাপ লাগলো। সে তাই অস্থির কণ্ঠ বলে উঠলো,
-“প্লিজ নামিয়ে দিন।”
-“কেনো?”
-“আমি আপনার মতো এতো নির্দয় নয়।”
আবরাজ বাঁকা হাসে। বউ তার কেনো এই কথা বলছে সে খুব ভালো করে জানে।
-“সরি বাট নট সরি, সুগন্ধি ফুল। তোমার এই কথায় তুমি রাতে কাঁদা থেকে ছাড় পাবে না। আমি এতো টাও ভালো নই। ”
-“অসভ্য পুরুষ।”
ফিজা বিড়বিড় করে। আবরাজ হাঁটে। তবে তার দৃষ্টি শকুনের মতোই তীক্ষ্ণ। সুইমিংপুলের ওপারে থাকা কোনো এক ব্যাক্তি কে সে ঠিকই দৃষ্টি দিয়ে শাঁসালো।
——
আগে মেহরিনের কাজ ছিলো অফিসের যাবতীয় ফাইল কালেক্ট করা। আর সাব্বির কিংবা মিলন খানের পিএ কে দেওয়া। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে আজ সে এই কাজ পাচ্ছে না। এটার জন্য অন্য আরেকটা ছেলে রাখা হয়েছে। আর তাকে সাব্বিরের সাথে দেখা করতে বলা হয়েছে। সাব্বিরের সাথে দেখা করতে হলে বসের কেভিনের পাশের কেভিনে যেতে হবে। আর সেখানেই বসে সাব্বির। তবে মিলন খান এখন অফিস আসে না। খুব প্রয়োজন ছাড়া। আর ভয় এখানেই আব্রাহাম খান এখন বর্তমানে অফিসে বাবা-র দায়িত্ব পালন করছে। আর মেহরিন সেইজন্যই আরও আতংকিত। সেদিনের পর তারা সকালেই খান বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে চলে এসেছিলো।
আব্রাহাম অফিসে চেয়ারে বসে আছে। খুব অস্থির দেখাচ্ছে তাকে। আর বারবার সাব্বিরের দিকে তাকাচ্ছে। সাব্বির তাকাচ্ছে দরজার দিকে। আব্রাহাম যেনো অধৈর্য। সে দাঁতে দাঁত চেপে বিরক্তি প্রকাশ করলো। আর বললো,
-“তুমি বলেছিলে ওকে কেভিনে পাঠাতে?”
-“জি স্যার। কিন্তু এখানে আসছে না কেনো বুঝতে পারছি না।”
-“উফ।”
সাব্বির ঠোঁট কামড়ে ধরে বারবার দোয়া পরছে। আব্রাহাম মাথায় হাত ঠেকিয়ে বসে ছিলো তখনই সাব্বির চেঁচিয়ে উঠলো। আর বললো,
-“স্যার স্যার ওই দিকে দেখুন।”
আব্রাহাম ঘাড় কাত করে রেখেই বাইরে দৃষ্টিপাত করলো। একটা মেরুন রঙের থ্রি-পিস পড়া মেয়ে কাচের দেয়ালের ওপাড়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাব্বির কে আব্রাহাম ইশারা করে। সাব্বির বেরিয়ে যায়। আব্রাহাম তপ্ত শ্বাস ফেলে বসে থাকে। গুলুমুলু মেয়ে টা সাব্বিরের সাথে খুব ভদ্রভাবে কথা বলছে। আব্রাহাম কত সময় এভাবে তাকিয়ে ছিলো কে জানে। তবে দরজায় নক পড়তেই তার ধ্যান ভাঙে। আর নিজে কে সামলে নিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,
-“কাম ইন।”
মেহরিনের একটা পা প্রথমে কেভিনের ভেতর পরে। নরমাল একজোড়া নকওয়ালা ফ্ল্যাট জুতো। জুতোটা সুন্দর না-কি পা? আব্রাহাম নিজের ভাবনায় নিজেই আশ্চর্য হয়। মেহরিন যখন সশরীরে উপস্থিত হলো আব্রাহাম একটু নড়েচড়ে বসলো।
-“এখানে আপনার সাইন লাগবে স্যার।”
-“এদিকে নিয়ে এসো।”
মেহরিন ফাইলটা সামনে থেকে ধরলেও আব্রাহাম চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আদেশ টা দিলো। মেহরিন এমনিতেই একটু অস্বস্তিতে আছে। কেননা তার কাজ টা হঠাৎ করে চেঞ্জ করে আব্রাহামের নিকট হতে সকল ফাইল সাইন করিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব টা তার। আর তারউপর মানুষ টাকে নিয়ে ওর মনে ভয়ের শেষ নেই। এখন তার শরীর যে কাঁপছে কিভাবে গিয়ে দাঁড়াবে সে? মেহরিন লম্বা শ্বাস টানে আর নিজে কে শান্ত রাখতে চেষ্টা করে। আব্রামের বাঁ দিকে গিয়ে দাঁড়িয়ে সামন্য ঝুঁকে মেহরিন কলম টা এগিয়ে দিলো আব্রাহাম কে। আব্রাহাম প্রথমেই চোখে বন্ধ করে শ্বাস টানলো। অদ্ভুত মেয়ে টার শরীর থেকে বেলী ফুলের সুগন্ধি ভেসে আসছে।
-“তোমার থেকে বেলী ফুলের স্মেল আসছে।”
আব্রাহাম কাঁধ উঁচিয়ে জানায়। মেহরিন মাথা নিচু করে রাখে। মানুষ টা বিদেশ পড়তে গিয়ে হয়তো দেশি তেলের গন্ধ ভুলে গিয়েছে। মেহরিনের হাসি পায় কেনো জানি। সে হাসি চেপে বলে,
-“এটা ফুলের নয়, তেলের ঘ্রাণ।”
আব্রাহাম ভ্যাবাচ্যাকা খায় যেনো। ঠোঁট দু’টো অটোমেটিক নিজেদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটায়। তবে সে নিজে কে সামলে নেয়। আর ফাইলে সাইন করে। মেহরিন চলেই যাচ্ছিলো। আব্রাহাম ডাকতেই দাঁড়িয়ে গেলো সে। ভয় হচ্ছে কিছু ভুল করে ফেললো না তো সে? আব্রাহাম পেছন থেকে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
-“তুমি কী প্রেম করছো?”
-“ন না তো।”
মেহরিন অপ্রস্তুত হয় এমন প্রশ্নে। আব্রাহাম কাঁধ উঁচিয়ে বলে,
-“আচ্ছা যাও। এসব করা ভালো নয়। পছন্দ হলে বিয়ে করে নেওয়া উচিৎ।”
-“আর যদি সে পছন্দ না করে?”
এটা কী বোকা মানুষের প্রশ্ন? না মোটেও নয়। কিন্তু মেহরিনের প্রশ্ন শুনে আব্রাহামের ওকে বোকাই মনে হচ্ছে। আব্রাহাম ওর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আর তার চোখ দু’টো যেনো শান্ত কোনো এক সাগর। যাতে লুকিয়ে আছে হাজার রকমের প্রশ্ন। গম্ভীর স্বরে আব্রাহাম উত্তর করে,
-“তাহলে জোর করে করা উচিৎ।”
মেহরিন মাথা নাড়ে আর বেরিয়ে যায়। আব্রাহাম সঙ্গে সঙ্গে ফোন হাতে নিয়ে কাউ কে কল দেয়।
——
আবরাজ খুব তাড়ায় আছে। বউ কে ঘুমে রেখে সে এখানে এসছে। বউয়ের ঘুম কোনোভাবে ভেঙে যাওয়ার আগে বাড়িতে পৌঁছাতে হবে। সে কালো রঙের স্যুটের সঙ্গে সাদা শার্টে গলায় ঝুলানো টাই ঠিক করে। এরপর দুই হাত মেলে পা ক্রস করে বসে। মিস্টার জি এবং জুনায়েদ তার বিপরীতে বসে আছে। মিস্টার জি কয়েকটি ছবি সামনের চকচকে কাচের টেবিলের ওপর রাখতেই আবরাজ ভ্রু কুঁচকে নিলো। মিস্টার জি বললো,
-“এটা নিলামে তুলতে চাই।”
আবরাজ ভ্রু কুঁচকে নিলো। সে এ-সব নিয়ে মোটেও আগ্রহ নয়। তবুও ছবিগুলো দেখা থেকে নিজে কে আটকাতে পারে না। ছবি হাতে নিয়ে তার মুখ লাল হয়ে আসে৷ রাগে চোখ দু’টো জ্বলজ্বল করছে তবে শপিংমলের সুইমিংপুলে মানুষটাকে দেখা আর তার ধারণা সত্যি। আবরাজ তবুও ঠোঁটের কোণে বাঁকা হেঁসে টেনে বলে উঠলো,
-“বাহ পিকচার গুলো জাস্ট এমেইজিং।”
ছবিগুলো সত্যি সুন্দর। আবরাজ ফিজা কে কোলে নিয়ে হাঁটছে। কোনটাতে ফিজা পেছনে পেছনে হাঁটছে আবরাজ সামনে তারপরও জুনায়েদ অবাক হয়। আবরাজ এটা এতোটা স্বাভাবিক ভাবে নেওয়ার কথা নয়। তার ভাবনার মাঝেই আবরাজ আবারও গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
-“ফটোগ্রাফার কোথায়?”
মিস্টার জি আঁড়চোখে ওনার পেছনে দাঁড়ানো বিদেশি ছেলেটার দিকে চায়। সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবে কয়েক সেকেন্ড পরই তার দেহ টা ফ্লোরে লুটিয়ে পরলো। গান পাউডারের গন্ধে মূহুর্তের নাকে লাগে। জন নাক কুঁচকে নেয়। মিস্টার জি জনের থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে আবরাজের দিকে তাকাতেই দেখলো আবরাজ গানের নলে ফু দিচ্ছে। যেখান থেকে মাত্রই একটি গুলি বেরিয়ে কারোর জীবন নিয়েছে। মিস্টার জি এবং জুনায়েদ দুজনেই বোধহয় অবাক হয়েছে। আবরাজ সচারাচর এই কাজ করে না। তাদের সাথে কাজে অন্তত খুব প্রয়োজন ছাড়া এটা সে পূর্বে কখনোই করে নি। আবরাজ ওঠে দাঁড়াল। গান টা জনের হাতে দিয়ে প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে কাঁধ উঁচিয়ে বলে উঠলো,
-“আপনার এই সাম্রাজ্যে ধ্বংস করতে আবরাজ খানের খুব বেশি টাইম লাগবে না। এখন আপনি ডিসাইড করুন আমার বউয়ের দিকে নজর দিবেন না-কি নিজের সাম্রাজ্যে বাঁচাবেন। যদি আমার বউয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাতে যান। তাহলে আপনার সাম্রাজ্যে আর আপনার এই লাল-নীল জীবন কোনটাই থাকবে না। আর সেকেন্ড অপশন বেছে নিলে আপনার জন্য ভালো। সো চয়েস অনলি ওয়ান অপশন।”
#চলবে…..
[ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]
#সুগন্ধি_ফুল_২
#পর্ব_১৬
#জান্নাত_সুলতানা
-“আপনি কোথায় ছিলেন?”
-“একটু বাইরে।”
আবরাজ রুমের ভেতর প্রবেশ করতে করতে উত্তর দেয় ফিজার প্রশ্নের। ফিজা বিছানার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলো। আবরাজ ওর কাছাকাছি পৌঁছতেই ফিজা নাক চেপে ধরে কৌতূহল নিয়ে জানায়,
-“কিন্তু আপনার শরীর থেকে কিসের যেনো দুটো স্মেল আসছে।”
-“এক মিনিট, এক মিনিট। একটা সিগারেট। আরেকটা,,,
-“গান পাউডার।”
ফিজা কে থামিয়ে দিয়ে আবরাজ খুব স্বাভাবিক ভাবে বলে উঠলো। ফিজা হতবাক হয়ে গেলো। তার পায়ের নিচের জমিন টা মূহুর্তেই ফাঁকা মনে হচ্ছে। সে যেনো শূন্যে ভাসছে। আবরাজ কথা বলে না আর। বরং নিজের শার্টের নিচ থেকে একটা রিভলবার বের করে নিয়ে ক্যাবিনেটে রাখে। ফিজা ধপ করে বসে পড়ে বিছানায়। এক হাতে মাথা চেপে ধরে চোখ ঘুরায় এদিক-ওদিক। ফ্লোরে যেনো নিজের ভবিষ্যতে দেখতে চাইছে সে৷ একজন মানুষের শরীর থেকে বারুদের গন্ধ। একটি রিভলবার। এতো এতো বডিগার্ড। এতো অর্থসম্পদ। তার রাতবিরেত বাইরে থাকা। নিজের কাজ সম্পর্কে বউ কে কখনোই অবগত না করা। যদিও জানার প্রয়োজন ফিজা কখনোই করে নি। বিশ্বাস করে ছিলো মানুষ টাকে। আর সেই বিশ্বাস নিয়ে সে মানুষ টার সাথে সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিতে ও দ্বিধা করে নি। তার একটা সংসার একটা সুস্থ স্বাভাবিক সংসার। সহজ জীবনযাপন কী তবে এটুকুই ছিলো? আর সব অভিনয়? যা সে এতোদিনে ধরতে পারে নি? ফিজা অস্থির হলো। ছুটে আসে আবরাজের কাছে। দুই হাতে আবরাজের বাহু আঁকড়ে ধরে। আর অস্থির কণ্ঠে বলে,
-“এসব মিথ্যা। আপনি খারাপ হতেই পারেন না। একবার বলুন না। প্ল,,,
-“সব সত্যি। তুমি যা ভাবছো আমি তাই।”
আবরাজ শান্ত স্বরে বাকিটুকু কথা শেষ করে। সে জানে তার বউ বিচক্ষণ। এটুকু এতোক্ষণে ঠিকই বুঝেছে।
ফিজার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে যেনো। দুনিয়া টা স্থির নয়। চারদিকে ঘুরছে। তার মাথায় এখন কিচ্ছু আসে না। সে শুধু জানে এই মানুষ টাকে সে ভালোবেসে ফেলেছে। সে থেকে যাবে। আবরাজ খান কে শুধরে নেবে। তার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পরে কিন্তু সেদিকে ওর খেয়াল নেই। আবরাজ হাত সামন্য উঁচু করে ওর গাল থেকে চোখের পানি মুছে দেয়। ফিজা ফিসফিস করে বলে,
-“আমি আপনাকে ভালোবাসি আবরাজ। আমারা একটা সংসার সাজাবো। আপনি একবার শুধু আমার হয়ে থাকুন। সবকিছু না বলুন।”
-“তুমি আমার জীবনের এক এমন অংশ যাকে ছাড়া আমি নিজে অসম্পূর্ণ, সুগন্ধি ফুল।”
-“আমি জানতাম আপনি আমায় ভালোবাসেন।”
ফিজা উচ্ছ্বাস নিয়ে আওড়ায়। আবরাজ ওর ভেজা চোখের পাতায় চুমু দেয় আর বলে,
-“হ্যাঁ বাসি। কিন্তু সরি জান, তোমার কথা আমি রাখতে পারছি না। তোমাকে যেমন আমি আমার লাইফে জোর করে এনেছি প্রয়োজনে জোর করে আঁটকে রাখবো।”
ফিজার শক্ত করে আঁকড়ে রাখা আবরাজের বাহু হঠাৎ করে ধীরে ধীরে ছেড়ে দেয়। কান্নারত চোখে আবরাজের দিকে অবাক হয়ে তাকায়। কিন্তু আবরাজ ওর হাত খপ করে ধরে আর নিজের বুকে চেপে ধরে। ফিজা চুপ করে থাকে। কিছু সময় পর ফিসফিস করে আবারও জিজ্ঞেস করে,
-“আপনি মানুষ খুন করেন?”
-“আমি মেয়েদের নিয়ে ও বিজনেস করি, সুগন্ধি ফুল।”
আবরাজ খুব স্বাভাবিক ভাবে জানায়। ফিজার বুকের ভেতর মোচড় দেয়। সে জানে আবরাজ তার প্রতি দূর্বল। না হলে নিশ্চয়ই তার ঠায় এখানে হতো না। সে সেই প্রসঙ্গে আর কথা বাড়াল না। রাত তিন টা তখন। সে বিছানায় গিয়ে একপাশে চুপ করে পিঠ ঘুরিয়ে শুয়ে পরলো। আবরাজ দাঁড়িয়ে তখন। সে জানে না। এরপর কী হতে পারে। তবে এমন কিছু সে হতে দিবে না যাতে করে এই রমণী তার জীবন থেকে হারিয়ে যায়। প্রয়োজন তার যা করতে হয় সে তাই করবে।
আবরাজ আলগোছে বিছানায় আসে। আর অন্ধকারে বউয়ের পেছনে শুয়ে কাঁধে ঠোঁট বুলিয়ে দেয়৷ ফিজা ফিসফিস করে বলে,
-“আমার একটা আবদার রাখুন।”
-“বলো।”
-“আমাদের একটু বাবু হলে সব ঠিক হবে।”
ফিজা বোকা বনে যায় কথা টা বলে। সে মরিয়া হয়েছে যেনো। সবার মতোই সংসারে স্বামীর সমস্যা সমাধান বাচ্চা মনে করছে। আহ। মানুষ কে পরিস্থিতি কতোটা বোকা বানিয়ে দেয়। আবরাজ ওর কাঁধের নাইট স্যুট সরিয়ে দেয়। উন্মুক্ত করে নিজের নরম অধর সেখানে চেপে ধরে বলে,
-“বেবি আমরা নেবো, জান। কিন্তু এখন নয়।”
ফিজা চোখ বন্ধ করে। সে জানতো আবরাজের উত্তর টা এমনই হবে। আগে ও এমন বলেছে। ফিজা চোখ বন্ধ করে, আবরাজ ওকে নিজের দিকে ফিরিয়ে নেয়। আর ধীরে ধীরে বউয়ের অধর নিজের অধরের ভাঁজে চেপে ধরে। ফিজার কিছু করার থাকে না। সে হারিয়ে যায়। আবরাজের প্রতিটি স্পর্শে সে ভালোবাসা খুঁজে পায়। ঠিক আগের মতোই।
——-
সকাল কখন হয়েছে ফিজা জানে না। আবরাজ তাকে আজ-ও সব সময়ের মতো সীমাহীন ভালোবাসা দিয়েছে। প্রতিবারের মতো মধুময় মূহুর্ত শেষ যত্ন করে তাকে বুকে আগলে নিয়েছে। ফিজা শান্তি পেয়েছিলো। তবে অস্থিরতা নিয়ে ঘুমিয়ে কখন গিয়েছিল সেটাও মনে নেই। রাতের কথা সে তখনও ভুলে নি। বুকের ভেতর হাহাকার করছে। সে চোখ খুলে পাশ ঘুরে দেখে নিলো। আবরাজ নেই। ফিজা চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। জীবন টা এতোটা জটিল হওয়ার কথা ছিলো না। সে এসব ভাবছে তখনই কানে আসে।
-“ওঠো জান। খেতে হবে।”
-“খাবো না।”
ফিজা দুই শব্দে জবাব দেয়। আবরাজ ওর গা থেকে কম্ফর্টার সরিয়ে নিতে চায়। ফিজা শক্ত করে ধরে রাখে। আবরাজ আবারও গম্ভীর স্বরে বলে,
-“না খেলে কিভাবে হবে? খেতে হবে। ওঠে সুগন্ধি ফুল।”
-“আপনি এই মুখে আমার নাম নিবেন না। প্লিজ।”
-“এটা তোমার নাম, কিন্তু দিয়েছি আমি। নাম এবং মানুষ দুইটাই আমার।”
ফিজার অন্য সময় হলে হয়তো এই কথাগুলো শুনে নিজে কে ভাগ্যবতী মনে করতো। কিন্তু এখন শুধু তার রাগ আর কান্না পাচ্ছে নিজের ভাগ্যের কথা চিন্তা করে। সে খুব সহজে কোনো কিছু করতে চাইছে না। আবরাজের সাথে প্রয়োজনে সে আবার কথা বলবে। ভালোবাসার জন্য মানুষ কত কিছু করে। সে তো একবার এটা চেষ্টা করতেই পারে।
——
-“শোনো গার্ড আছে। কিন্তু তুমি বাসা থেকে একদম বের হবে না। প্রয়োজন গার্ড কল করবে। ফোন অলটাইম নিজের সাথে রাখবে।”
আবরাজ ফিজার হাতে একটি ঘড়ি পরিয়ে দিতে দিতে উপরোক্ত কথা গুলো বললো। ফিজা ভ্রু কুঁচকে নেয়। আর জিজ্ঞেস করে,
-“কোথায় যাচ্ছেন আপনি?”
-“এতোদিন এই প্রশ্নের প্রয়োজন পরে নি।”
-“এখন পরছে। কারণ আপনি আমার বিশ্বাস নিয়ে ঠিক এভাবেই খেলেছেন।”
-“এখনো ও করো না?”
ফিজা জবাব দেয় না। আবরাজ বউয়ের কপালে শব্দ করে চুমু খায়। আর মৃদু হেঁসে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে।
ফিজা লিভিং রুমে সোফায় বসে একটি ম্যাগাজিন হাতে নেয়। যেখানে একজন ব্যাক্তি কে নিয়ে কিছু আর্টিকেলস আছে। লন্ডনের একজন ব্যাক্তি। কেউ দেখে নি তাকে। সে খারাপ লোক। কিন্তু ভালো কাজ করে। ফিজা কাঁধ উঁচিয়ে সে মনে মনে ব্যাক্তি কে বাহবা দেয়। তিনি এতো টাকাপয়সার মালিক যে মেয়ে পাচারকারী লোকেরা যতো মেয়ে নিলামে তুলে সে সব মেয়েদের সর্বোচ্চ মূল্যে ক্রয় করেন। কিন্তু এরপরের তথ্য কেউ জানে না। তিনি মেয়েদের সাথে কী করে এবং মেয়েদের কোথায় রাখে। কিছুই না। তিনি লন্ডনের সবচেয়ে ধনী ব্যাক্তি এবং ওয়ার্ডের তিনজন ধনী ব্যাক্তির মধ্যে তিনি দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। ফিজা তপ্ত শ্বাস ছাড়ে। একজন এতো বড়ো মানুষ। আর তাকে এখনো কেউ চিনেই না। ব্যাপার টা সত্যিই অদ্ভুত। আর আশ্চর্যজনক ও।
—–
আব্রাহাম মেহরিনের কথা বাবামা কে কিভাবে বলা যায় সে-সব নিয়ে বসে বসে চিন্তা করছিলো। তার সামনে একটা উপন্যাসের বই খোলা থাকলেও সে সেটা পড়তে পারছে না। মনোযোগ নষ্ট করছে মেহরিন। সে বিরক্ত হয়ে ওয়াশ রুম গেলো। রাত ন’টায় শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে এলো। ফিরে এসে দেখলো মা ইলা বেগম তখন বসে আছে।
-“তোমার বিয়ে ঠিক করতে চাইছে তোমার আব্বু। মেয়ে পছন্দই আছে। তৃণা।”
আব্রাহাম বিরক্ত হয়। তার মাথা ভনভন করতে থাকে। আব্রাহাম বিরক্তিকর স্বরে বলে উঠলো,
-“প্লিজ আম্মু। এসব কী?”
-“দেখো তৃণা নিজে থেকে আমাকে জানিয়েছে তোমাকে সে পছন্দ করে।”
-“আমি করি না। এমন মেয়ে কখনো আমি বিয়ে ও করতে চাইবো না।”
-“এখন কী করবো?”
-“না বলবে। তুমি না পারলে আমি বলবো।”
-“তোমার বাবা কে বলো।”
-“ওকে।”
আব্রাহাম কাঁধ উঁচিয়ে বলে। তার বিরক্ত লাগছে তৃণা নামের উটকো ঝামেলার কথা চিন্তা করে। এতোদিন তার ভাই কে জ্বালিয়েছে। আর এখন তাকে।
——
ফিজা রুমে বসে একটা এডাল্ট নোবেল পড়ছিলো আর মনে মনে সে বিরক্ত হচ্ছিল। উপন্যাসের মেল খুব জঘন্য। ফিমেল ক্যারেক্টার টাকে একটু বেশি কষ্ট দেয়। সেও নায়িকাকে খুব ভালোবাসে। আর জোর করে নিজের কাছে আঁটকে রেখেছে। ফিজা একটু নিজের কথা ভাবে। সে যদি সবকিছু ঠিক করতে না পারে আর আবরাজ কে ছেড়ে দিতে চাই, তবে আবরাজও কী তাকে এভাবে আঁটকে রাখবে? আর কষ্ট দিবে? উঁহু কখনো ই তো আবরাজ তার সাথে খারাপ করে না। আবরাজ রুমে প্রবেশ করতেই ফিজা বই তড়িঘড়ি করে বেডসাইড টেবিলের ওপর রেখে চোখ বন্ধ করে নেয়। আবরাজ মৃদু হাসে। বউ তার সাথে রেগে আছে, অভিমান করছে। সে ফিজার দিকে একবার তাকিয়ে ওয়াশরুম চলে গেলো। ফিজা তপ্ত শ্বাস ফেলো একটু পর বিছানা ছেড়ে ওঠে দ্রুত বই টা হাতে নিয়ে শেলফে রাখতে গেলো। সে কোনো ভাবেই চাইছে না আবরাজের হাতে এটা পরে। ফিজা বই শেলফে রেখে ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে ধাক্কা খেলো কিছুর সাথে। আর চোখ তুলে তাকিয়ে তার মুখ হা হয়ে গেলো। লজ্জায় গাল লাল হয়। এতো মাসেও এই পুরুষ কে সে এভাবে অর্ধ উন্মুক্ত দেখে লজ্জা পায়। আবরাজ ওর কোমর হাত রেখে আরেক হাত হাঁটুর নিচে নিয়ে যায় আর ঝট করে কোলে তুলে নেয় ওকে। ফিজা চমকে গিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে।
আবরাজ ঝুঁকে এসে বউয়ের ঠোঁটে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়। আর তার মাথা থেকে টপটপ করে জল কয়েক ফোঁটা ফিজার মুখে পরে। ফিজা চোখ বন্ধ করে নাকমুখ কুঁচকে নেয়। আবরাজ হেঁসে দেয় আর হাস্কি আওয়াজে বলে,
-“আই নিড সাম ফাস্ট এনার্জি, সুইটহার্ট।”
সারাদিন পর কী কীর্তি করে বাড়ি ফিরে এখন ঢং করা হচ্ছে। ফিজা বিরক্ত প্রকাশ করার আগেই আবরাজ ওকে ধপাস করে বিছানায় ফেলে নিজেও ওঠে আসে বিছানায়। ফিজা শ্বাশ বন্ধ করে শুধু চেয়ে থাকে। তার অনুভূতির শেষ নেই। এই মানুষ টা সবকিছুর দাম দিবে তো!
#চলবে…..
[ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]
#জান্নাত_সুলতানা