সুগন্ধি ফুল ২ পর্ব-১৯+২০

0
22

#সুগন্ধি_ফুল_২
#পর্ব_১৯
#জান্নাত_সুলতানা

-“আমি ওদের ভয়ংকর মৃত্যু দেবো, সুইটহার্ট। আমার ফুলের দিকে নজর দেওয়ার মাশুল ভয়ংকর হবে।”

আবরাজ ফিজার দেহটা জড়িয়ে রেখে ফিসফিস করে বলে। ফিজার জ্ঞান নেই। সে বেঘোরে ঘুমচ্ছে। ডক্টর তাকে রেস্ট রাখতে বলেছে। চিন্তামুক্ত রাখতে বলেছে। সেদিনের ঘটনা তার ব্রেনে প্রভাব ফেলবে। যতোটা সম্ভব চোখে চোখে রাখা যায় আর এই ট্রমা থেকে বের করে আনা যায় এমন কিছুই করতে হবে। আবরাজ গত চব্বিশ ঘন্টা বউয়ের কাছ থেকে একটু সময়ের জন্য দূরে যায় নি। কিন্তু আজ যেতেই হবে। সে মেয়ে টার কানের কাছে মুখ নিয়ে আবারও চোয়ালে, চুলের ভাজে, কানে ঠোঁট ছুঁয়ে দিতে থাকে। কতবার সে হিসাব করে না। এরপর ফিসফিস করে বললো,

-“তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও, জান।”

আবরাজ নিজের গায়ের উলের সোয়েটারের ওপর একটি হাঁটু সমান কোট পরে নেয়। আর মাথায় হুডি টা তুলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার আগে অবশ্যই সার্ভেন্ট কে ফিজার দেখাশোনার নির্দেশ দিয়ে যায়।

—–

-“কোথায় কোথায় টাচ করেছিস ওকে?”

আবরাজ শান্ত স্বরে জি করে। জুনায়েদ দুর্বল দৃষ্টি তুলে আতংকিত নয়নে চেয়ারে বসা আবরাজের দিকে তাকায়। গত চব্বিশ ঘন্টায় অনাহারে তারা। আবরাজ তাদের তাদেরই গোডাউনে বেঁধে রেখেছে। কী হাস্যকর। জুনায়েদ ঢুলতে ঢুলতে জবাব দেয়,

-“গাল।”

-“আর?”

-“হাত।”

-“ওর হাত কে বেঁধেছে?”

আবরাজ চোয়াল শক্ত করে জানতে চায়। তৃণার ও একই অবস্থা। বরং আরও অবনতি হয়েছে। তার বা হাতে গুলি লেগেছে। আর এটাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। আর কোনো চিকিৎসা নয়। তার জুনায়েদের চেয়ে ও খারাপ অবস্থা। সে ভয়ার্ত এখন। তার বাবা তাকে আজ দুই দিনে ও খুঁজে পায় নি। এটা স্বাভাবিক। নিজের আস্তানায় নিজের মানুষ কে কেউ খুঁজতে আসবে না। তার ফোন সিম আবরাজ কী করেছে কে জানে। তৃণা ফিসফিস করে জবাব দেয়,

-“আমি।”

-“মুখ?”

-“আমি।”

-“ওর গায়ে ইনজেকশন কে পুশ করেছে?”

-“আমি।”

তিনটা প্রশ্নেরই তৃণা উত্তর দেয়। আবরাজ আবারও জুনায়েদের দিকে তাকায়। সে এদের ভয়ংকর মৃত্যু দেবে। যা কল্পনার ও বাইরে। আবরাজ দাঁতে দাঁত চেপে রাখলো। তার পেছন থেকে জন জিজ্ঞেস করলো,

-“কারে কে তুলেছে?”

-“আমি।”

জুনায়েদ ফিসফিস করে বলে। বলা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবরাজ ওর টুঁটি চেপে ধরে আর আরেক হাতে ওর চুল মুঠোয় করে ধরে। জুনায়েদ কাতরায় ব্যাথায়। আবরাজ ওর টুঁটিতে চাপ দিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-“গাড়ি থেকে এখানে কিভাবে এনেছিস?”

-“কাঁধে তুলে।”

জুনায়েদ মুখ বাঁকিয়ে কাঁধ ইশারা করে বলে। সে হয়তো কখনো কল্পনা করে নি তার সাথে এমন কিছু হতে পারে। আবরাজ ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো আর বা কাঁধে নিজের ডান বা দিয়ে চেপে ধরে। হিংস্রতা চোখে-মুখে পুরুষ টার। ক্রোধিত সে। জুনায়েদের চোখ লাল। দম টা গলায় এসে আঁটকে আছে যেনো। তার দুনিয়া অন্ধকার হয়ে আসছে। মৃত্যুর ভয় সে ছটফট করতে থাকে। আবরাজ হাড় ভাঙার মটমট শব্দে একটু শান্ত হলো। জুনায়েদ জোরে জোরে চিৎকার করছে। ব্যাথায় তার চোখ দিয়ে জল আর মুখ দিয়ে অজস্র গালিগালাজ বের হচ্ছে যার সবগুলো ইতালিয়ান। তৃণা জুনায়েদ কে এভাবে দেখে সহ্য করতে পারলো না। জ্ঞান হারিয়ে ফেললো মেয়ে টা। তার সিকনেস আছে আগে থেকে। জুনায়েদ ব্যাথায় ছটফট করতে করতে এক সময় অনুরোধ করলো,

-“আবরাজ প্লিজ ফর গিভ মি। আর কোনো দিন তোমার,,,,

-“সেই চান্স পাবি না। তুই আমার বউয়ের গায়ে হাত দিয়েছি। কী করে ছেড়ে দেবো?”

আবরাজের কঠিন স্বর। জুনায়েদের ভ্রু বেয়ে মাথা থেকে রক্ত টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছে। গায়ের পোষাক রক্তে মাখামাখি। কাঁধ টা ভীষণ ভারি লাগলো। তুলতে গিয়ে ব্যথায় চিৎকার করে উঠলো। তার দুর্বল চোখ দেখলো একটা বিশাল লোহার দরজা খুলে গেলো। আর দু’টো বড়ো বড়ো খাঁচা। গর্জন। সিংহের গর্জন? মূহুর্তেই চমকায় সে। এমন ভয়ংকর মৃত্যু তার প্রাপ্য নয়।

-“আবরাজ নো। এটা তুমি করতে পারো না। আমরা আমরা এতো বড়ো পাপ কর,,,,

-“অন্যের বউয়ের দিকে নজর। এরচেয়ে বড়ো পাপ কী হতে পারে? আর তুই? তুই পাপের কথা বলছিস?”

আবরাজের উচ্চস্বরের হাসি পুরো গোডাউনে প্রতিধ্বনিত হতে হতে ফিরে আসে কানে। জুনায়েদের চোখ মুখে হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। জোর করে বলে উঠলো,

-“আমাকে মারলে তোমার জীবন নরকে পরিণত হবে।মিস্টার জি তোমায় ছাড়বে না।”

-“আমি ছাড়লেই না তিনি আমাকে ধরবে। উপর থেকে দেখিস বাকিটা। এখন তোর সময় শেষ।”

আবরাজ অলস ভঙ্গিতে বললো। তারপর জুনায়েদের পেছনে থাকা গার্ডদের ইশারা করতেই ওরা জুনায়েদের দেহ টা তুলে নিয়ে ওই খাঁচার ভেতর ছুঁড়ে ফেলে এবং সিংহ দুটো মূহুর্তের ওর দেহের ওপর ঝাঁপিয়ে পরে। আর কিছু দেখার প্রয়োজন নেই। দরজা বন্ধ হয়ে আসে। জন নিজের আঁটকে রাখা দম টা ফোঁস করে ছাড়ল। পরপুরুষ নিজের বউয়ের গায়ে হাত দেওয়ার অপরাধে এক স্বামী রূপী ভয়ংকর প্রেমিক পুরুষ সেই লোককে সিংহের লাঞ্চ বানিয়েছে। হায়। জন আস্তে করে ঢোক গিলে। কী ভয়ংকর। আবরাজ জনের দিকে তাকিয়ে বলে,

-“ওকে এমন এমন ড্রাগস দাও। যেনো ওর বাপ মেয়ের অবস্থা দেখে আঁতকে ওঠেন। আর মেয়ে নিয়ে ব্যাবসা যেনো নিজ থেকে বন্ধ করতে বাধ্য হয়।”

তৃণার দিকে তাকিয়ে কথা গুলো বলে উঠলো। জন মাথা নাড়ে। আবরাজ বেরিয়ে যায় গোডাউন থেকে। জন আবরাজের নির্দেশ মতো গার্ডদের নিয়ে কাজ শুরু করে।

—-

ফিজা ঘুম থেকে কিছু সময় আগেই ওঠেছে। তখন দুপুর। বিদেশি সার্ভেন্ট টা সেই থেকে ওর সাথে সাথে আছে। ওর বিরক্ত লাগছে। তবুও কিছু বলছে না। বোনের সাথে কথা বলেছে সে। আবরাজ যে গত চারদিনের কথা বাংলাদেশ বলে নি সেটা তাদের কথার ধারায় বোঝা গিয়েছে। ফিজা স্বস্তি পায়। নয়তো অসুস্থ মা তার আবারও স্ট্রোক করতেন। ফিজা ব্যালকনি থেকে ফিরে এসে ফোন বিছানায় রাখে। আর নিজেও পা গুটিয়ে বিছানায় বসে। সার্ভেন্ট রুমে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। ফিজা সেই কখন থেকে ভাবছে আবরাজ কোথায় গিয়েছে কিছু কী জানে তিনি? কিছু বলে গিয়েছে কী? ফিজা যদিও জানে আবরাজ তেমন কিছুই করবেন না৷ তবুও আচমকাই জিজ্ঞেস করলো,

-“হুয়ের ইজ ইউর স্যার?”

-“স্যার ইজ আউটসাইডা, ম্যাম।

গড়গড় করে মহিলা উত্তর দেয়। ফিজা ফোলা ফোলা চোখের ওপর ভ্রু জোড়া কুঁচকে আবারও জিজ্ঞেস করলো,

-“হাউ লং হ্যাজ হি বিন আউটসাইড?”

-“সিন্স মর্নিং, ম্যাম।”

-“ওকে, ইউ ক্যান গো নাউ।”

ফিজা অবাক হয়। সারাদিন? সে ঘুমিয়েছে এতো? ফিজা বিরক্ত এবং তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো। সার্ভেন্ট তবুও গেলো না। ফিজা বিরক্ত হলো। কী অদ্ভুত বলার পরে-ও যাচ্ছে না। তাই সে বিরক্ত হয়ে একটি ইংলিশ নোবেল বুক হাতে নিলো আর সেটার দিকে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলো।

——-

আবরাজ যখন সদর দরজা দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলো তখন ফিজা লিভিং রুমের লেদার সোফায় বসে আছে। সামনের বড়ো এলইডি টিভি টায় জ্বলজ্বল করছে একটা চাইনিজ ড্রামা। ফিজার মনোযোগ সেদিকে থাকলে-ও ব্যাক্তিগত পুরুষের উপস্থিতি এবং মানুষ টার শরীর থেকে আসা সুগন্ধি তার নাসারন্ধ্র পৌঁছাল। ফিজা ত্বরিত ঘাড় বাঁকিয়ে চাইলো। আর আবরাজ কে নিজের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুখে অটোমেটিক হাসি ফুটে উঠলো। সে বসা ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালো। পায়ের অসহ্য ব্যাথা উপেক্ষা করে সে বসা থেকে ওঠে এগিয়ে যায়। আবরাজ বউয়ের মুখের দিকে তাকায়। চোখ গুলো ফোলা। মুখ ভারি। হাতের কব্জি কালশিটে দাগ। আবরাজের মুখের ভাবভঙ্গি মূহুর্তে পরিবর্তন হয়। আর সে আবারও ইচ্ছে পোষণ করে ওই জুনায়েদ কে আবারও মারতে। ভয়ংকর মৃত্যু। আরও। আরও। আবরাজ নিজে কে সামলে নিলে। আর ফিজা ঠিক ওর বরাবর দাঁড়িয়ে। আবরাজ নিজের হাতের কোট ফেলে দেয় আর ঝট করে বউ কে কোলে তুলে সিঁড়ির দিকে যায়। ফিজা আবরাজের গলা জড়িয়ে ধরে মিনমিন করে জিজ্ঞেস করলো,

-“আপনি কোথায় ছিলেন? আমি একা ছিলাম অনেক্ক্ষণ।”

-“সার্ভেন্ট ছিলো, সুগন্ধি ফুল।”

আবরাজ আস্তে করে ওর মুখে ফু দিয়ে বলে। ফিজা চোখ বন্ধ করে। চোখের পাতা তিরতির করে কাপে। আর চোখ বন্ধরত অবস্থায় জবাব দেয়,

-“আপনি ছিলেন না।”

-“তুমি আমাকে চাই ছিলে?”

ফিজা মাথা নাড়ে। আবরাজ ওকে বিছানায় রাখে আর বলে,

-“ফ্রেশ হয়ে আসছি। জাস্ট ফাইভ মিনিটস জান। এরপর তোমার পছন্দের ড্রাক রোমাঞ্চ হবে। এটা মনে হয় তোমার খুব পছন্দের।”

আবরাজে বেডসাইডে ফিজার বিকেলে পড়তে নেওয়া বইয়ের দিকে ইশারা করে বলে উঠলো। ফিজা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আবরাজ ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করার আগেই ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে। ফিজা থতমত খেয়ে বসে থাকে। মনে মনে বেশ কয়েকবার দোয়া আওড়ায় আবরাজ যেনো বইটার কথা ফিরে এসে ভুলে যায়।

#চলবে…..

#সুগন্ধি_ফুল_২
#পর্ব_২০
#জান্নাত_সুলতানা

-“আপনি কিভাবে খুঁজে পেলেন আমায়?”

যদিও ফিজা জানে এই প্রশ্ন টা বোকার মতো শোনায়। তবুও সে জানতে চায়। আবরাজ ওর হাতের কালশিটে দাগে ঔষধ লাগাচ্ছে। আর গম্ভীর স্বরে জবাব দেয়,

-“তোমার হাতের ঘড়ি। তোমার ফোন তোমার মাথায় থাকা হেয়ার ক্লিপ।”

-“আপনি অনেক বেশি ধূর্ত আবরাজ।”

ফিজা ফিসফিস করে বললো। আবরাজ ওর চুল হাত বুলায়। ঘাড় থেকে চুল সরিয়ে দেয় আর সেখানে ঠোঁট বসিয়ে দেয়। কিছু সময় পর আবরাজ নিজে কে ছাড়লো।

-“আমি তোমাকে,,,

-“ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি।”

আবরাজের কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই ফিজা বলে উঠলো। আবরাজের চোখে-মুখে দুষ্টুমিতে মেতে উঠলো। সে হালকা স্বরে বলে উঠলো,

-“ওহ, সুগন্ধি ফুল পুরো কথা শুনবে তো।”

-“তো?”

-“আমি তোমাকে আদর করবো।”

আবরাজ বাঁকা হেঁসে বলে। ফিজা লজ্জায় মুখের ওপর হাত রাখে। ফিজার চোখ বন্ধ। আবরাজ ওকে বলে,

-“আমাকে দেখো।”

এই আদেশ অমান্য করতে পারে না ফিজা। চোখ খুলে আর আবরাজের মুখের দিকে তাকায়। চোখের মনি পুরুষ টার কালো নয়। ড্রাক চকলেট রঙের। সাদা অংশ টা ও সম্পূর্ণ সাদা নয়। অদ্ভুত সুন্দর আর মায়ায় ভরতি পুরুষ টার চোখ। ফিজা কথা বললো না। শুধু তাকিয়ে রইলো। আবরাজ ওর চোয়ালে হাত বুলিয়ে বলে উঠলো,

-“তুমি কত সুন্দর, সুগন্ধি ফুল।”

নীরবতায় লজ্জায় ফিজার মুখে লাল আভা ছড়িয়ে পরে। একটি সদ্য ফোঁটা গোলাপ। যে শুধু তার মালকিনের নয় পুরো বাগানের আনন্দ। আবরাজের শুধু মনে নয় পুরো শরীরে অনুভূতি ছড়িয়ে পরে। সে মেয়ে টার কপালে মাথায় আর মুখে লাগাতার চুমু দেয়। আর বলতে থাকে,

-“তুমি শুধু আমার। অনলি মাইন।”

বারবার। এই একই কথা উচ্চারিত হয়ে আবরাজের ঠোঁট ভেদ করে। ফিজা হাঁপিয়ে ওঠে। মানুষ টার আলিঙ্গন সে সানন্দে গ্রহণ করে। আর ফিসফিস করে বলে,

-“আমি শুধু আপনার।”

আবরাজ ওর অধরে হামলে পড়ে। ফিজা হাত আবরাজের পিঠে। আবরাজ নিজের কাজে বাঁধা একদম পছন্দ করে না। সে মেয়ে টার বুকের উপরিভাগে মুখ গুঁজে রেখেই ফিসফিস করে আদেশ দেয়,

-“হাত ওপরে সুগন্ধি ফুল।”

ফিজা মান্য করে হাত মাথার ওপর রাখে। আবরাজ এক হাতে মেয়ে টার কব্জি চেপে ধরে আঁটকে রাখে। ফিজা চোখ বন্ধই রাখে। শুধু অনুভব করে ঘর ভরতি ভারি নিঃশ্বাসের।

——

সময় খুব দ্রুত চলছে যেনো। ফিজার কিডন্যাপারে পর আজ চৌদ্দ দিন হয়ে গেলো। আবরাজ তাদের দেশে যাওয়ার বন্দবস্ত করছে। ফিজার আনন্দিত মুখ দেখলে বোঝা যায় সে বোনের বিয়ে নিয়ে খুব খুশি। ফ্লাইটের টিকিট ও নেওয়া হয়েছে। আজ জন বাসায় এসছে। কারণ ফিজা মার্কেট যাচ্ছে। জন তাকে নিয়ে এখান থেকে যাবে আর আবরাজ কে অফিস থেকে পিক করবে। আবরাজ না-কি মিস্টার জি এর বিজনেস ছেড়ে দিচ্ছে। এমনিতেই আবরাজ ছোটখাটো একটা কোম্পানি আছে যেটা সে জন এর দায়িত্বে রেখে যাবে বা আগে যেতো। মিস্টার জি ভীষণ অসুস্থ। আজ এতোদিনেও তিনি মেয়ে কে খুঁজে পায় নি। এক মাত্র মেয়ের জন্য তিনি আজ অসুস্থ। ফিজার শুনে খারাপ লাগছিলো। কিন্তু পরক্ষণেই তা উবে যায়। তাকে কতটা কষ্ট দিয়েছে তারা আঠারো ঘন্টায় সেটা তার হাতের কালশিটে দাগ এখনো তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তবুও মনটা আনচান করে।

-“তৃণা হঠাৎ করে কোথায় হারিয়ে গেলো?”

গাড়িতে বসে ফিজা জিজ্ঞেস করলো জন কে। জন মুখের ভাবভঙ্গি এমন যেনো সে সত্যি কিছু জানে না আর এটা নিয়ে সে নিজেও চিন্তিত। সে মশলা লাগিয়ে এটাকে আরও একটু স্বাদ করতে সাথে যোগ করে জবাব দিলো,

-“সাথে জুনায়েদ। মিস্টার জি এর একটি হাত বলা চলে ওই জুনায়েদ। বিজনেসের খুব খারাপ অবস্থা।”

ফিজার ভ্রু কুঁচকে যায়। সে খুব ভালো করে জানে এসবের পেছনে আবরাজ আছে। সে এটা নিয়ে চিন্তিত নয়। প্রথমে সে এই দেশ ছাড়তে চায়। বাকিটা সে পরবর্তীতে প্ল্যান করে নিজের মতো চালিয়ে নেবে।

——

কাল ফ্লাইট। ফিজা নিজের সব লাগেজ প্যাক করে নিয়েছে আস্তে আস্তে। আবরাজ রুমে ফিরে এখোনও বউ কে লাগেজ গোছাতে ব্যাস্ত দেখলো। সে তপ্ত শ্বাস ফেললো। ঢুলতে ঢুলতে এসে আবরাজ বউয়ের পেছনে দাঁড়াল। ফিজা তার উপস্থিতি পেয়ে ঘুরে আবরাজের মুখোমুখি হলো। আবরাজ কখনো তার সামনে সিগারেট খায় নি অ্যালকোহল পান করে বাড়ি ফিরতে দেখে নি। বিয়ের এতো মাসে ও সে আবরাজের সাথে মধুময় মূহুর্ত শেষ আবরাজ ক্লান্ত হয়ে সিগারেট জ্বালায় নি৷ ফিজা একটু অবাক হলো। আবরাজ নিজের বাঁ হাতের কনিষ্ঠ আঙুল টা তুলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো,

-“এইটুকু। প্লিজ রাগে না লক্ষীসোনা।”

-“আসুন শাওয়ার নিলে ঠিক হয়ে যাবে।”

-“তুমি ও এসো তাহলে। আমি একা পারবো না।”

আবরাজ ঢুলে ঢুলে আবদার করলো। ফিজা আবরাজের বাচ্চামিতে হাসে পায়। সে গাল কামড়ে হাসি আঁটকে রাখে আর আবরাজ কে নিয়ে ওয়াশরুম যায়। গরম পানি বাথটাবের মধ্যে দিয়ে ফিজা আবরাজ কে সেখানে বসিয়ে দিলো। একটা টাওয়াল ও পাশে রেখে বললো,

-“আমি খাবার দিতে বলছি মেড কে।”

আবরাজ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। ফিজা যখন চলে নিতে যাচ্ছিলো আবরাজ তখন মেয়ে টার হাত ধরে নিলো। আর ঠোঁট প্রসারিত করে বলে উঠলো,

-“আই নিড ইউর হেল্প, সুগন্ধি ফুল।”

ফিজা চোখ পিটপিট করে তাকায়। আবরাজ হেঁচকা টানে ওকে ও নিজের কোলে বসিয়ে নেয় আর গরম ধোঁয়া ওঠা পানি মেয়ে টার গায়ে ছিটিয়ে দেয়। উলের সোয়েটার ভিজে মূহুর্তেই নারী কায়া দৃশ্যমান হয়। আবরাজ ওর ভেজা এলোমেলো চুল হাত দিয়ে ঠিক করতে করতে বলে,

-“তুমি সুন্দর।”

ফিজা তপ্ত শ্বাস ফেললো। এই এক কথা শুনতে শুনতে তার কান ঝালাপালা। তবুও তার বিরক্তি আসে না। সে আবরাজের ভেজা কপালে আলতো করে উষ্ণ ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়। আবরাজ চোখ বন্ধ করে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে।

——

বিয়ের ঠিক একদিন আগে এসে ওরা বাংলাদেশ পৌঁছাল। বিয়ের তোড়জোড় বেশ ভালো। ফিজার তেমন ভালো লাগলো না। ব্যাপার টা সে এখনো বুঝে উঠতে পারে না এটা কার পক্ষ থেকে হচ্ছে। সে চাই ছিলো না কোনো ভাবে তাকে কিংবা তার পরিবার কে মানুষ ছোটলোক বলার সুযোগ পায়। কিন্তু যখন সে জানলো তার মা নয় স্বয়ং তার শ্বশুর মশাই বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন সে এতে স্বস্তি পায়।

একটা রাজকীয় বিয়ের অনুষ্ঠান হতে পারতো। কিন্তু আব্রাহাম একদম সাদাসিধা একটা বিয়ের আয়োজন চাইলো। খান পরিবারের কেউই এ নিয়ে কিছু বলে নি। তাদের এই নিয়ে মাথাব্যথা নেই। পরে না-হয় তারা বড়ো করে অনুষ্ঠান করবে।
এখন সন্ধ্যায় সাত টা। বিয়ে হবে এশার নামাজের পর। বরযাত্রী ও চলে এসছে। ফিজা এসছে পর বোন আর মায়ের সাথেই আছে। বোন কে সে নিজেই সাজিয়ে দিয়েছে। মোহিতা বেগম রুমে আসতেই ফিজা মায়ের কাছে যায়। মেহরিন লজ্জায় অস্বস্তি নিয়ে বসে। ফিজা ফিসফিস করে। মোহিতা বেগম জোরেই বলেন,

-“আমার মেয়েরা তো এমনিতেই সুন্দর।”

একটা সুন্দর বিয়ে। শুধু খেজুর দিয়ে বিয়ে সম্পূর্ণ। এরপরই বিদায়ের সময়। মোহিতা বেগম এবার আরও ভেঙে পরলেন। দু’টো মেয়ে মাত্র। বিদায় বড়ো বিষাদ। ইলা বেগম বড়ো ছেলের বউকে আজ এখানে রেখে গেলেন।

——–

-“আম্মু শাওয়ার নিতে হবে। তুমি একটা কফি কাউ কে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়ো।”

আব্রাহাম মায়ের সাথে কথা শেষ যখন রুমে এলো মেহরিন তখন একটা টাওয়াল হাতে দাঁড়িয়ে। আব্রাহাম এটা দেখে অবাক হয়ে মুখে হাসি নিয়ে বলে উঠলো,

-“ওহ মেহুরানী, তোমার কতো বড়ো কান।”

মেহরিন থতমত খেলো। লজ্জায় ফোলা ফোলা গাল গুলো যেনো জ্বলতে শুরু করলো। হায়। তাকে তো মা বলে দিয়েছিলো যেনো স্বামীর সবদিক নজর রাখে। মেহরিন দাঁড়িয়ে রইলো আব্রাহাম এগিয়ে এসে মুচকি হেঁসে টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুম চলে গেলো।

সে যখন শাওয়ার নিয়ে শুধু টাওয়াল কোমরে জড়িয়ে বেরিয়ে এলো মেহরিন গোল গোল চোখে কয়েক সেকেন্ড তাকে পর্যবেক্ষণ করলো। পরক্ষণেই চোখের ওপর হাত চেপে ধরলো। আব্রাহাম চুলের পানি ঝাড়তে ঝাড়তে এগিয়ে আসে। মেহরিন পানির ঠান্ডা স্পর্শ পেয়ে মৃদু কাপে। আব্রাহাম ওর থুতনিতে আঙুল ছুঁয়ে মুখ উঁচু করে ধরে। আর শান্ত স্বরে আদেশ করে,

-“মুখ ওপরে। চোখ খোলো মেহুরানী।”

-“আ-আম,,

-“আমি ভীতু। আই নো বেবি গার্ল। বাট বাট। আমাদের আজ ফার্স্ট নাইট।”

মেহরিন অবাক হয়। চোখ তুলে আব্রাহামের দিকে এক পলক তাকায়। তারপর আবারও দৃষ্টি নত করে। আর আমতা আমতা করে না বুঝে প্রশ্ন করলো,

-“আপনি কী বলছেন?”

-“তুমি যা ভাবছো।”

আব্রাহাম ওর শাড়ির আঁচলের ডান দিকে হাত রাখলো। অথচ শাড়ীর আঁচল বাঁ দিকে। আব্রাহামের ধীরে স্পর্শ আঁচল টা নিজের স্থান পরিবর্তন করতে শুরু করলো। মেহরিন চোখ বন্ধ করে। আব্রাহাম ওর ভীতু মুখের দিকে তাকায়। আর ওর অবস্থা দেখে নিঃশব্দে হাসে। একটা হালকা পিংক কালার শিফন শাড়ী। আর মুখে কোনো সাজ নেই। ঠোঁটে হয়তো লিপস্টিক লাগানো হয়েছিল। তবে মেহরিন হয়তো সেটা তুলে ফেলেছে। মোটামুটি সব সাজ এই মেয়ে তুলে নিয়েছে। মোটা চুলের বেণী টা একদম শক্ত। সামনে দিয়ে কোমর ছাড়িয়ে গিয়েছে। নাকে বড়ো ডায়মন্ডের রিং টা জ্বলজ্বল করছে। যেটা আব্রাহামের নামে পরা হয়েছে। আব্রাহাম ওর গালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে স্পর্শ করলো। মেহরিনের কম্পন টের পেলো সে। আর তাতে সে আরও ঘনিষ্ঠ হলো। মেহরিনের ভারি নিঃশ্বাস তার খোলা বুক ভেদ করে যেনো বুকের বাঁ পাশে থাকা যন্ত্র টায় লাগছে। আব্রাহাম নিজে কে সামলে নিলো৷ আর ওর কানের কাছে মুখ এগিয়ে নিয়ে চুলের গোছা শক্ত করে চেপে ধরে ফিসফিস করে বলে উঠলো,

-“শোনো মেয়ে, তুমি সময় নাও আর নিজে কে আমার জন্য গুছিয়ে নাও, ততদিনে আমি না-হয় সিগারেট দিয়ে চালিয়ে নেবো।”

#চলবে…..

[ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]