#প্রেম_ও_অসুখ
|পর্ব ১৬|
– নবনীতা শেখ
সাঁঝ অস্থির হয়ে উঠল,
-“কী হয়েছে? ঠিক আছো?”
-“নাহ। তুমিও মাফ করে দাও।”
সাঁঝ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
-“ও গো, মাফ চাইছো কেন?”
-“তুমি না মাফ করলে এমন শাস্তি সবসময় পাওয়া লাগবে।”
-“তুমি মাফ চেও না, স্বামী। আমি তোমায় অনেক আগেই ক্ষমা করেছি। জ্বর বেশি লাগছে? কষ্ট হচ্ছে? আল্লাহ, আপনি আমার স্বামীকে আর কষ্ট দেবেন না, প্লিজ।”
সাঁঝের কান্নাভেজা কণ্ঠ শুনে হৃদের বলতে ইচ্ছে করল, “শাস্তি তো তুমি দিচ্ছো, গিন্নি! এমন কী পাপ করেছি তোমার সাথে, যার জন্য এভাবে কিডনিতে ভূমিকম্প সৃষ্টিকারী শাস্তি দিচ্ছ?”
সাঁঝ নিজের রান্না খেয়ে দেখেছে। তার কাছে খারাপ লাগেনি। হ্যাঁ, ডালটা একটু মিষ্টি হয়েছে। সে এর আগেও এমন ডাল বানিয়ে খেয়েছে, তার কাছে মজা লেগেছে। তবে তরকারিতে যে লঙ্কাকাণ্ড বাঁধিয়ে রেখেছে তা চেখে দেখেনি। হৃদের আশঙ্কাজনক অবস্থা দেখে তার খটকা লাগল। সরিয়ে রাখা প্লেটের একপাশ থেকে একটু তরকারি মুখে নিল সে। আর তারপর সোজা ছুটল বেসিনে। বমি আসবে আসবে করেও গলা অবধি এসে ফিরে গেল।
অবশেষে সাঁঝ যখন ডাইনিংয়ে এসে বসল, তখন আর সে হৃদকে নিজের চেহারা দেখাতে পারে না। হৃদ সাড়াশব্দ না পেয়ে টেবিল থেকে মাথা তুলল, বাঁকা চোখে তাকাল সাঁঝের দিকে। প্রথমে বিস্মিত হলো। আর তারপর সাঁঝকে তারই অনুকরণ করে টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করে বসল,
-“তোমার কী হয়েছে?”
সাঁঝ মাথা তুলতে পারল না। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
-“আমাকে মাফ করে দাও, স্বামী!”
হৃদ অবুঝের মতো শুধাল,
-“মাফ তো আমি চাই। তুমি কেন চাইছো? কী উপলক্ষে?”
সাঁঝ মুখোমুখি বসা টেবিলে থুতনি ঠেকিয়ে হৃদের দিকে তাকাল। ঠোঁট উলটে তার, চোখ-মুখে অসহায়ত্ব। বেচারি দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বলল,
-“স্বামী নির্যাতনের জন্য, স্বামী। প্লিজ মাফ দাও।”
-“তুমি খেয়েছো নাকি?”
-“মাত্র।”
-“সর্বনাশ। অমৃতের স্বাদ কেমন?”
-“লজ্জা দিও না তো। মরে যাচ্ছি, এমন স্বাদ।”
হৃদের ভ্রুদ্বয়ের মাঝে ভাঁজ, ঠোঁটের একপাশে এঁটে রয়েছে শীতল হাসি। অমন হাসি সহজে দেখা যায় না, বোঝা যায় না। অনুভূতির বিষয় তো..সোজা উপলব্ধি করে নিতে হয়।
হৃদ উঠে দাঁড়াল। সাঁঝের মাথার চুলগুলো সামান্য এলোমেলো করে দিয়ে বলল,
-“পাঁচ মিনিট ওয়েট করো এখানে। একদম নড়বে না।”
-“কেন?”
-“প্রশ্ন না। থাকো।”
হৃদ কিচেনে চলে গেল। আর তার পাঁচ মিনিট পর দুটো ডিমভাজি করে নিয়ে এলো। নিজের প্লেটটা টেবিলের একপাশে সরিয়ে রেখে দুটো প্লেট সোজা করল। আর তারপর দুটোতে ভাত বাড়তে বাড়তে বলল,
-“দুপুরে খেয়েছিলে?”
সাঁঝ মাথা নাড়ল,
-“উঁহু। সময় পাইনি। আপনি তো কল দেননি গতকাল থেকে। বাসায় আসতেই মা জানাল, আপনি অসুস্থ। তাই চলে আসছি।”
-“ভালো ভাত রান্না করেছো।”
-“লজ্জা দেবেন না।”
-“না, আসলেই। ডিমভাজি দিয়ে অল্প একটু খাও। রাতে অনলাইন অর্ডার করে দেবো।”
হৃদ খাবার বেড়ে সাঁঝের দিকে প্লেট এগিয়ে দিলো। নিজেরটাও সামনে নিয়ে বসল। সাঁঝ অবাক হয়ে হৃদকে দেখছে। এত নমনীয় সে! এত দায়িত্বশীল! যা খাইয়েছে সে, অন্য পুরুষ হলে একটু হলেও কটুকথা শোনাত। কিংবা নিশ্চুপ থাকলেও.. অথচ হৃদ? অভিযোগ নেই কোনো?
সাঁঝকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে হৃদ বলল,
-“কোনো সমস্যা?”
-“হু? ন..নাহ!”
-“খাও।”
-“খাচ্ছি।”
সাঁঝ ভাতের প্লেটে হাত দিলো এবং ভাত নেড়েই গেল দুই মিনিট ধরে। সে গরম খাবার খেতে পারে না। ঠান্ডা হলে, তারপর খায়। সাঁঝ তার খাবার ঠান্ডা হওয়ার অপেক্ষায় রইলো। আর হৃদ অপেক্ষায় রইল তার বউয়ের খাবার মুখে তোলার। আর কিছুক্ষণ পরই সাঁঝ লক্ষ করল, হৃদ তার খাবার মুখে দেওয়ার আগ অবধি নিজে খায়নি।
খাবার শেষে রুমে আসতেই সাঁঝ বলল,
-“আসুন, জ্বর আছে কি না দেখি।”
সাঁঝ বক্স থেকে থার্মোমিটার বের করতে যাচ্ছিল। হৃদ সেটুকুর সময় তাকে দিলো না। লম্বা দুটো কদমে এগিয়ে এলো ছোট্ট মানবীর সম্মুখে। হৃদ লম্বায় তার চেয়ে অনেকটা বেশি, কাজেই খানিকটা ঝুঁকে দাঁড়ানো লাগল।
সাঁঝ থতমত খেয়ে তাকাল। লোকটা এমন কেন করল, কী সমস্যা, বা কী চায়—কিছুই মেয়েটা বুঝতে পারল না। বড়ো বড়ো চোখ দুটো দিয়ে তাকিয়ে রইল তাই।
সেকেন্ড বিলম্বে জনাব বললেন,
-“রানি সাহেবা, জ্বরটা দেখুন!”
সাঁঝের ডান হাতের উলটো পিঠটা উঠে এলো হৃদের কপাল বরাবর। জ্বর নেই। অনেকটা সুস্থ। সাঁঝ হাত সরালো না। সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। হৃদও প্রিয়তমা স্ত্রীর এটুকু স্পর্শলোভে ঝুঁকেই দাঁড়িয়ে রইল।
কিছু অসুখ কেবল অসুস্থতা থেকেই আসে না। কিছুটা আসে একাকীত্বের অভিলাষে। সঙ্গলোভে মানুষ কত কী-ই তো করে। হৃদের সহজে জ্বর হয় না। অথচ বৃষ্টি গা ছোঁয়া মাত্র জ্বরে বিছানার সাথে লেপটে থাকে সে। সেই জ্বরের স্থায়িত্ব তিনরাত। অথচ আজ একরাতেই সেড়ে উঠেছে সে। কেন? সে একা নেই। তার খেয়াল রাখার জন্য একজন আছে। একটু পাগলাটে বটে। একটু নাটকীয়তা করে অবশ্য। কিন্তু সে অসুস্থ হলে এই মানুষটাই সব ছেড়ে ছুটে আসবে, সে কষ্ট পেলে এই মেয়েটাই ঠোঁট উলটে কাঁদতে লাগবে। তার হাজারটা বদ অভ্যাসে, এই মেয়েটাই বকতে বকতে বুকে এসে যাবে। কী আনন্দ! এত আনন্দের সাথে অসুস্থ থাকা যায় নাকি?
হৃদ নতমুখী হয়েই স্মিত হাসল। ধীর শব্দে বলল,
-“জ্বর ছেড়ে ঘামছি, ম্যাডাম। আই নিড আ শাওয়ার। যেতে পারি?”
সাঁঝ লাফিয়ে তাকে ছেড়ে দাঁড়াল। বুকের ভেতরে জ্বালা দিতে থাকা অসহ্য হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। সাঁঝ বড়ো করে একটা শ্বাস টানল, আর তারপর দম আটকে দাঁড়িয়ে রইল। মেয়েটার এহেন কাণ্ডে হৃদ গাল টেনে দিয়ে একটা টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। দরজায় খট করে শব্দ হলো। বুকে হাত রেখে বিছানায় বসে পড়ল সাঁঝ। এমন অচেনা, অজানা ও ঐশ্বরিক অনুভূতির জন্য তার অপেক্ষা আঠারোটা বসন্ত। সাঁঝের পাগল পাগল লাগতে শুরু করল।
মেয়েটা বোধহয় সত্যিই পাগল হয়ে উঠল। সে পুরো বিছানায় কিছুক্ষণ গড়াগড়ি খেলো। সবকিছু কেমন তার তার! সবকিছুতেই তার স্বামীর সুবাস! এত সুখ এসবে…
হৃদের শাওয়ার নিয়ে রুমে ফেরার আগেই সাঁঝ ভদ্র হয়ে গেল। একদম শান্ত মেয়ে সেজে এককোণায় বসে রইল। এদিক-ওদিক তাকাল না পর্যন্ত। সাঁঝের এমন নাটক দেখে হৃদ না হেসে পারল না।
সাঁঝ তাকাল। কালো ট্রাউজার, অলিভ রঙের টিশার্ট আর টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে হাসি! সাঁঝ কি আরেকদফায় মরে যাবে? নাকি গিয়ে টুপ করে গালে একটা চুমু খেয়ে এসে এমন ভাজা মাছটা উলটে খেতে না জানা লক্ষ্মী বাচ্চা সেজে বসে থাকবে? ইশ! লজ্জা! সাঁঝের শ্যাম গাল দুটোর লাল আভা বাইরে থেকে দেখা গেল না। বুকের ভেতরে দ্রিমদ্রিম করতে থাকা বেখাপ্পা হৃৎপিণ্ড অসংলগ্ন আচরণ করতে লাগল।
হৃদ দু’কদম বাড়িয়ে এসে সাঁঝের সামনে বসল। টাওয়ালটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
-“স্ত্রীর দায়িত্ব আছে না? এমনি এমনি তোমার ভরণপোষণ করছি? কাজ-কাম করো। তবেই না খেতে-পড়তে দেবো।”
সাঁঝের কাজ-কাম হচ্ছে হৃদের চুল মুছে দেওয়া। সে হাসবে নাকি কাঁদবে বুঝতে পারল না। অবুঝের মতো টাওয়ালটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। আর তারপর চুল মুছে দিতে লাগল। হৃদের চুলগুলো আকারে মাঝারি ধরনের। স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বড়ই বলা যায়।
ভেজা চুলগুলো মুছে দিতে দিতে সাঁঝ সাংসারিক আবেশে হারিয়ে গেল। এমন একটা মিষ্টি সংসারই তো সে আজন্ম স্বপ্নে সাজিয়ে রেখেছিল! তার অন্যমনস্কতায় আচমকা হৃদ বলে ওঠে,
-“সন্ধ্যা?”
সাঞ্জিনা আফরিন! সাঁঝ! সাঞ্জিনা, সাঞ্জি, আফরিন.. এসবের পরে সন্ধ্যা নামটা তার জন্য নতুন। কেউ কখনো ডাকেনি। প্রিয় পুরুষের মুখে এমন ডাকনাম শুনে কাজেই চমকে গেল সাঁঝ। বিস্ময়ে চোখের পাতা জমে গেল, ঠোঁট কাঁপতে লাগল তিরতির করে। সেকেন্ড দুয়েক হাতও থেমেছিল, তা-ও চলমান হলো পরবর্তী মুহূর্তেই। ডাকশোনা জবাব কম্পনরত ঠোঁট দিয়ে অনেকটা সময় নিয়েই বেরোল,
-“হুঁ?”
-“হাওয়ায় ভাসা সত্যের অসত্যতা পেয়েছো কি?”
-“পেয়েছি।”
-“আমি নিজের মুখে বললে বিশ্বাস করতে?”
-“করতাম না হয়তো। তখন সামনে প্রমাণ পেলেও মানতে চাইতাম না। কারণ আপনার মুখ থেকে শোনা সত্য আমার কাছে তখন মিথ্যেই মনে হতো।”
আনমনে হাসল হৃদ,
-“আর এখন?”
-“আমার পৃথিবীর একমাত্র সত্যি আপনি।”
-“বিশ্বাস?”
-“কেবলই আপনার চোখ।”
-“যত্ন?”
-“আপনার বেড়ে দেওয়া এক থালা ভাত।”
-“গুরুত্ব?”
-“নিজে না খেয়ে আমার খাওয়ার অপেক্ষা।”
-“সম্মান?”
-“স্পর্শের আকাঙ্খা সত্ত্বেও অনুমতির অপেক্ষা।”
হৃদের হাসি প্রশস্ত হলো। সাঁঝ তাকে ছেড়ে দাঁড়াল। তাকাল হৃদের বাদামি বর্ণের ঘোলাটে চোখের দিকে। ভ্রুদ্বয়ের মাঝে পড়ল লম্বাটে তিনটি ভাঁজ। সে জিজ্ঞেস করল,
-“কিছু বলতে চাইছেন?”
-“হ্যাঁ।”
-“বলুন।”
-“উত্তরের নিশ্চয়তা দাও, তারপরই বলব।”
স্বাভাবিক হয়ে হেসে ফেলল সাঁঝ,
-“কেন? কঠিন কিছু নাকি?”
-“তা একটু..”
-“চিন্তা নেই। যে-কোনো উত্তর দিতে পারব।”
-“বড়ো করে শ্বাস নাও।”
-“নিলাম।”
-“স্বাভাবিক হও।”
-“হলাম।”
-“চোখ বন্ধ করো।”
-“করলাম।”
-“গা ছেড়ে নরম হয়ে বসো।”
-“বসলাম।”
-“এখন আরও একবার শ্বাস টানো।”
-“হুঁ।”
-“ভালোবাসো?”
চলবে…