প্রেমাঙ্গন পর্ব-০৩

0
21

#প্রেমাঙ্গন
লেখিকা:#শ্যামলী_রহমান
পর্ব:৩

চৌধুরী বাড়ির আকাশ যেন আজ মেঘলা।শান্ত নীড় আজ নিস্তব্ধ হয়ে গেছে।সানজানা বেগম এবং আশরাফ চৌধুরীর মাথায় হাত দিয়ে চিন্তিত মুখে বসে আছে।
রাতভর দুশ্চিন্তায় কারও চোখে ঘুম আসেনি।

সানজানা বেগম বারবার আরশিয়ার ফোনে কল দিচ্ছেন, এক হাতে তসবিহ নিয়ে পড়ছে, অন্য হাতে কপাল চেপে ধরেছেন। আশরাফ চৌধুরী বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন, মুখ গম্ভীর ও চিন্তিত, চোখ লাল রাত পেরিয়ে সকাল হওয়ার অস্থিরতা তাকে যেন আরও অস্থির করে তুলেছে।
এখনো কোনো খবর পাওয়া যায়নি।যদি টাকার জন্য কিডন্যাপ করে তবে কেউ তো এখনো ফোন করলো না।
বিজনেস কিংবা কোথাও তো তার শত্রুও নেই।
না ভাবতে পারছে না। গাড়ির চাবিটা নিয়ে আবারো বেরিয়ে পড়লেন।

অর্থি ঘর জুড়ে হেঁটে হেঁটে বেড়াচ্ছে। আরশিয়ার চিন্তায় সেও সারারাত ঘুমায়নি।
তারপর ফোনটা হাতে নিয়ে আবার রনিতকে কল করলো।

ওপাশ থেকে ক্লান্ত কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠ ভেসে এলো,
“চিন্তা কোরো না, আমি খুঁজছি।রিহানের ফোনে রাত থেকে কল দিচ্ছি কল যাচ্ছে না।

অর্থির বুকটা ধক করে উঠলো হঠাৎ কেঁদে ফেললো,বলল,
“আমরা যদি ওকে না পাই, তাহলে ভাবতে পারছেন কী হবে?যদি ওর সাথে খারাপ কিছু হয়ে যায়?

ওপাশে কিছুক্ষণ নীরব থেকে রনিত নরম গলায় বললো,
“তুমি চিন্তা করো না।রিহান আর যাই হোক ওতো খারাপ ছেলে নয়।

“খারাপ না হোক কিন্তু একটা মেয়ে একরাত বাড়ির বাহিরে থাকা তো মানুষ নিশ্চয়ই ভালো চোখে দেখবে না?

রনিত ভাবলো।সত্যি তো মানুষ কে তো বুঝানো মুশকিল। কিছু মানুষ ওতপেতে থাকে কখন কে কি করছে তা শুনে তার দশগুন বানিয়ে চারদিকে ছড়ানো।
অর্থির চোখে জল ভরে উঠলো।রনিতের উত্তর না পেয়ে
কল কেটে বিছানায় বসে পড়লো।

রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে চলেছে মিহিতা।গন্তব্যহীন, অচেনা পথে।এই রাস্তা কিংবা আশে পাশে কিছু চিনেনা সে।
রিহান ওকে নিয়ে আসতে চেয়েছিলো, জোর করে হাত ধরে বলেছিলো,
“চলো,এখন তোমাকে রেখে আসি।আমার কাজ শেষ।

কিন্তু মিহিতা রাগে,ঘৃণায় ধাক্কা মেরে বলেছিলো,
“আই হেট ইউ! আমি আপনাকে ছাড়বো না কোনোদিন না।

রিহান উঠে মিহিতার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে, মুখের উপর ফুঁ দিয়ে হেসে বলে,
“কেনোদিন ছাড়বে না তাহলে ধরে থাকো,কে মানা করেছে?এই নাও এগিয়ে আসলাম বলেই আরেক ধাপ এগিয়ে গেলো,কাছাকাছি হলো দুজনে।
মিহিতা আবারো ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়।দরজার দিকে হাঁটা দিলো একাই।সেই ধাক্কার পর পেছনে তাকায়নি সে। একা একা বেরিয়ে এসেছে। এখন একা হাঁটছে, অথচ জানে না এই হাঁটার শেষ কোথায়। মানুষের ভিড়ের মাঝে থেকেও একা হয়ে যাচ্ছে তার মন।

সকাল থেকে মানসিক দোলাচলে থাকা আরশিয়া একা একা হাঁটছিলো। অচেনা রাস্তায়,গন্তব্যহীন পথ গুলো যেন তার ভিতরের অস্থিরতাকেই প্রকাশ করছিলো। চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে আসছিলো সবকিছু।

একসময় হঠাৎই বুঝতে না পেরে সে সোজা রাস্তার মাঝে চলে আসে। ঠিক তখনই দ্রুতগতির একটি গাড়ি হর্ন বাজিয়ে তার সামনে এসে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যে কারো শক্ত হাত তার কব্জি ধরে টেনে নেয় রাস্তার ধারে।
“দেখে চলবেন তো? এতো কি ভাবছেন?”
কঠোর ধারালো কণ্ঠে শুনে আরশিয়ার হুস আসে। তখন তাকালো সামনে।তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একজন যুবক। বয়স খুব বেশি নয়, সর্বোচ্চ ২৭-২৮। লম্বা দেহ, গায়ের রঙ উজ্জ্বল ফর্সা, কালো শার্ট আর জিন্স পরনে। চোখে তীব্র দীপ্তি, হালকা দাড়ি আর চোয়ালে দৃঢ়তার ছাপ তাকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে।

আরশিয়া কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে যায়।

যুবকটি আবার বলে,
“এভাবে আনমনে হাঁটছিলেন কেন?। এখনি একটা দুর্ঘটনা হয়ে যেতে পারতো।

আরশিয়া বাড়তি কথা বললো না। শুধু বলল,

“ধন্যবাদ বাঁচানের জন্য।আমি আসলে রাস্তা চিনিনা আর কিছু কারণে চিন্তিত ছিলাম তাই।

কিছুক্ষণ নীরব থাকার ছেলেটি বলল,
“চলুন, আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিই। এভাবে একা অচেনা রাস্তায় হাঁটা নিরাপদ নয়।

আরশিয়া প্রথমে কিছুটা দ্বিধায় পড়ে যায়। এক অচেনা মানুষ,তাকে বিশ্বাস করা কি ঠিক হবে?কিন্তু যুবকের কণ্ঠস্বর আর চোখের ভরসা টুকু যেন তাকে আশ্বস্ত করে।
যে হীবন বাঁচাতে পারে তার মধ্যে নিশ্চয়ই খারাপ উদ্দেশ্য থাকবে না।দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে রাজি হয়ে যায়।

ছেলেটি এক পাশে ইঙ্গিত করে,
“চলুন, ওদিকে আমার গাড়ি।”

আরশিয়া নীরবে তার সঙ্গে হাঁটতে থাকে।
ছেলেটি গাড়ির দরজা খুলে দিলো আরশিয়া সামনে বসলো।গাড়ি চললো সামনের দিকে।ছেলেটি এবার আরশিয়ার মুখের দিকে তাকালো।ভীষণ মিষ্টি চেহারা তবে মিষ্টি মুখখানা কালো আঁধারে ঢেকে আছে যা খুব একটা ভালো লাগলো না। তার পর জানতে চাইলো,

“আপনার বাসার ঠিকানা টা বলুন।

আরশিয়া বললো।ছেলেটি একটু অবাক হলো,বলল,

“এতদূর একা কি করতে এসেছেন?

আরশিয়া জানা নেই সে ঠিক কতদূরে তাই সেও জানতে চাইলো,
”কতদূর এটা?

“শহর থেকে প্রায় দুই ঘন্টার রাস্তা। আপনি কিভাবে এখানে আসলেন?

আরশিয়া উত্তর দিলো না তাই ছেলেটিও আর জিজ্ঞেস করলো না। ভাবলো হয়তো তিনি বলতে চাননা।
সকালের সুনশান রাস্তায় ছুটে চলেছে গাড়ি।আরশিয়া মাথা এলিয়ে দিয়ে ভাবছে কাল রাতের কথা।
অন্য কিছু বুঝতে না পারলেও কিছু একটা তো হয়েছে সেটা সে বুঝতে পারেছে।

আশরাফ চৌধুরী আবার বাড়িতে আসলেন কিছু দরকারে।দরকারী জিনিস টা নিয়ে আবার যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই কেউ একজন সামনে এসে দাঁড়ায়।

দীর্ঘ দুই ঘন্টা পর গাড়ি এসে থামলো চৌধুরী বাড়ির গেইটর সামনে।ছেলেটি নেমে আরশিয়া কে বলে,
“মিস নামুন এসে গেছি।

আরশিয়া চোখ খুললো।তার চোখ লেগে এসেছিলো বুঝতে পারেনি এসে পড়েছে। আরশিয়া নেমে পড়লো বাড়ির দিকে তাকালো।ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলল,

“আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আজকের উপকারের কথা আমি কখনো ভুলবো না।

ছেলেটি হাসলো।সেই হাসিতে মাধুর্য মেশানো।বলল,

“মোস্ট ওয়েলকাম।

“এখন তাহলে যাই?

ছেলেটি তড়িঘড়ি করে জানতে চাইলো,
“মিস আপনার নামটাই তো জানা হলো না।

আরশিয়া তীর্যক হেসে বলল,
“আরশিয়া চৌধুরী।

“ওকে এবার যেতে পারেন।ভালো থাকবেন আর নেক্সট টাইম থেকে দেখেশুনে চলবেন,সব সময় কিন্তু আমার মতো কেউ বাঁচাতে আসবে না।এই শহরের মানুষ বড় স্বার্থপর রাস্তায় মানুষ মরতে দেখলে তারা বাঁচানোর বদলে ছবি তুলে পোস্ট দেওয়ার জন্য।
হাসতে হাসতে ছেলেটা বললো।তার কথার বিপরীতে আরশিয়াও একটু খানি হাসলো।তার পর পা বাড়ালে দরজার দিকে।ছেলেটি তাকিয়ে রইলো আরশিয়াকে আর দেখা গেলো না। গাড়ি ঘুরিয়ে চলে যাওয়ার আগে বাড়ির দিকে চোখ বুলালো।তার চলে গেলো।

আরশিয়া কলিং বেল চাপ দিলো। মুহূর্তেই সানজানা বেগম দরজা খুলে দিলেন।মনে হচ্ছে তারই অপেক্ষায় বসে ছিলো।মেয়েকে পেয়ে সেখানেই জাপটে ধরলেন।বললেন,

“তুই ঠিক আছিস দেখে ভালো লাগছে আয়।
আরশিয়া ধীর পায়ে ভেতরে ঢুকলো।
ড্রয়িং রুমের সোফায় নজর যেতেই সে চমকে উঠে,সে কি ভুল দেখছে?না সে ভুল দেখছে না।তার বাবার পাশে রিহান বসে আছে। শুধু বসে না হেসে গল্প জুড়ে দিয়েছে।
আশরাফ চৌধুরী মেয়েকে দেখে এগিয়ে আসলেন।
আহ্লাদে মেয়েকে পেয়ে চিন্তা মুক্ত হলেন।
আরশিয়া নিশ্চুপ তাকিয়ে দেখলো রিহান তার দিকে তাকিয়ে হাঁসছে।
আরশিয়া চোয়াল শক্ত হয়ে এলো।
তার সামনে গিয়ে রেগে জানতে চাইলো,

“আপনি এখানে?

রিহান কিছু বলার আগেই সানজানা বেগম বলল,
“ছেলেটা আমাদের সব বলেছে।ওর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।

আরশিয়া বুঝলো না এই লোকটির কাছে তারা কিসের জন্য কৃতজ্ঞ।তাই জানতে চাইলো,
“কি বলেছে?কিসের জন্য কৃতজ্ঞ?

আশরাফ চৌধুরী আগে বলতে শুরু করলো,

“রিহান তো তোকে বাঁচিয়েছে।কোন ছেলে নাকি তোকে কিডন্যাপ করেছিলো।সে তোকে চিনে বলে পিছু নেয় এবং সুযোগ বুঝে তোকে বাহির করে আনে।
রাত হয়ে যাওয়ার জন্য ভোরবেলা বাড়ির পথে রওনা দিয়েছিলি।তুই নাকি মাঝ পথে নেমে গেছি মানুষ একসাথে দেখলে অন্য কিছু ভাবতে পারে।

আরশিয়া অবাকের চরম পর্যায়ে চলে গেছে। রিহান তার দিকে তাকিয়ে এখনো হাসছেই।আরশিয়া বাবা মায়ের সামনে কিছু বলতে পারলো না। তার আপাতত ভালো হয়েছে নয়তো কোথাই ছিলাম কি উত্তর দিতাম?
তার পর দাঁতে দাঁত পিষে বলল,

“সেই ছেলে উনি দেখেন তাহলে শুনুন কে সে ছেলে?তাকে তো জেলে দেওয়া উচিত।এতো বাজে ছেলে বাবা মা শিক্ষা দিতে পারেনি।মেয়েদের সাথে কেমন ব্যবহার করতে হয়।

রিহান ভ্রু কুঁচকে তাকালো আবারো সেই ভুল।যদিও এবার বলার যথার্থ কারণ আছে। সে বলল,

“আংকেল আমি তো ছেলেটাকে চিনিনা।আরশিয়া চিনলে বলো।

আরশিয়া কিড়মিড় করে তাকালো।বলতে পারলো না।
শুধু বলল,

“চিনিনা তবে এতটুকু জানি সে আর যাই হোক ভালো ছেলে তো নয়।

রিহান আরশিয়ার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিলো।আরশিয়া রেগে গেলো। ইচ্ছে করলো খু*ন করতে। বাবা মায়ের সামনে এতো ভালো পাত্র সাঁজলো।তবে এর সোধ আমিও নিবো।

রিহান এবার উঠে দাঁড়ালো। সবাই কে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আংকেল আন্টি আজ তাহলে আমি আসি।অন্য কখনো আবার দেখা হবে।আমাদের বাসায় বেড়াতে যাবেন।আব্বুকে তো আপনি চিনেনই।

সানজানা বেগম বাধ সাধলো,বলল,
“এতো বড় উপকার করলে কখনো ভুলবো না। তুমি খেয়ে তার পর যাও।

“না,না আন্টি আজ যাই অন্য দিন এসে খাবো।রাতে বাসসয় ছিলাম না কাউকে কিছু বলিনি আম্মু নিশ্চয়ই চিন্তা করছে।

তিনি আর আটকালেন না রান্না ঘরে গেলেন।আশরাফ চৌধুরীর ফোন আসলে তিনি কথা বলতে এক সাইডে যান।আরশিয়া আশে পাশে দেখেই রিহানে সামনে আসলো কলার চেপে বললো,
“এখানে ভালো সাঁজতে এসেছেন?অভদ্র,বেয়াদব লোক।

রিহান কলারে ধরা হাতটা চেপে ধরলো বলল,
“সব সময় তেড়ে এতো কাছে আসো তুমি অথচ অভদ্র বলছো আমায়?কেমন শুনতে লাগছে না?
আরশিয়া ঝট করে শার্টের কলার ছেড়ে দিলো, রাগী চোখে তাকিয়ে বলল,
“দিন আমারো আসবে আপনাকে কি করি দেখবেন।

“কি করবে?আদর?
ছি তুমি না ভদ্র।

আরশিয়া চোখ গরম করে তাকালো তার পর চলে গেলো তার ঘরে।রিহান শুধু হাসলো আর বলল,
“এমনিতে রাগিণী হলেও বড্ড বোকা পাখি।

চলবে……………..?