প্রেমাঙ্গন পর্ব-০৫

0
21

#প্রেমাঙ্গন
লেখিকা:#শ্যামলী_রহমান
পর্ব:৫

ব্রেকিং নিউজ,
রাজশাহী সরকারি কলেজের ছাত্রী সুহানি আক্তার কে রাস্তার ধারে পড়ে থাকা অবস্থায় পাওয়া যায়। শরীরে তার অজস্র দাগ,হিংস্র পশুর ন্যায় কেউ খুবলে খেয়েছে।আপাতত সে লাইফ সাপোর্টে রাজশাহী মেডিকেলে ভর্তি আছে। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। ডাক্তাররা এখনো বলতে পারছে না সে বাঁচবে কি বাঁচবে না।সুহানির বাবা মা কান্নায় ভেঙে পড়ছে,পরিবারের আহাজারিতে কাঁদছে মানুষ।

সকাল,সকাল এমন নিউজ দেখে আরশিয়ার শরীর শিউরে উঠলো।সে মেয়েটাকে চিনতো তারই স্কুলের ছাত্রী তবে সে তার তিন ব্যাচ নিচে ছিলো।সবে কলেজে উঠেছে তার এই অবস্থা কে করলো?অসুস্থ শরীর নিয়ে সে শুয়ে সেই সবই ভাবছে।আজকাল মেয়েদের নিরাপত্তা কোথাই?”
সে তো শালিন পোশাকই পরে ছিলো দেখাচ্ছে,অথচ কিছু মানুষ দোষ দেয় মেয়েদের পোশাকের।

পাঁচদিন হয়ে গেছে আরশিয়াকে ক্যাম্পাসে দেখা যাচ্ছে না।শুরুর দু’দিন রিহান ভেবেছিলো ইচ্ছে করেই আসেনি। কিন্তু পরে খবর এলো আরশিয়া ভীষণ অসুস্থ, বিছানা থেকে উঠতেও পারছে না। খবরটা শোনার পর থেকেই অদ্ভুত এক অস্থিরতা কাজ করছে তার ভেতর।

লাইব্রেরির একটা টেবিল আজও ফাঁকা রইলো, আরশিয়া আসেনি।রোজ এসে বই পড়তো। রিহান নিজের উপর অবাক হয়। আমি কে তাকে নিয়ে ভাবছি?
নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করে, “এতে আমার কি আসে যায়! ও আসুক বা না আসুক, আমার কিছু যায় আসে না।”
কিন্তু হৃদয় যেন কথা মানতে চায় না।

বন্ধুরা সেটা টের পেয়ে যায়।

রনিত একদিন হাসতে হাসতে বললো,
“মেয়েটা আসছে না বলে তুই এতো অস্থির কেন? নাকি ওর অনুপস্থিতি খুব টের পাচ্ছিস?”

অভিক ঠাট্টা করে যোগ দিলো,
“যা না একবার খোঁজ নিয়ে আয়। ভদ্রলোক হলে অন্তত খবরটা নিতো।”

রিহান ভ্রু কুঁচকে রেগে উঠলো,
“এইসব বাজে কথা বাদ দে। আমি কি তার প্রেমিক নাকি? অসুস্থ হোক বা সুস্থ হোক, আমার কেন মাথাব্যথা হবে?”

কথাটা মুখে বললেও ভেতরে ভেতরে যেন কেমন খচখচ করে।

সাহিল মুচকি হেসে বললো,
“মুখে মানছিস না, তাতে কি? চোখ সব বলে দিচ্ছে দোস্ত।”

অভিষেক এবার মুখ খুলে শান্ত স্বরে বললো,
“কখনো কখনো আমরা কাউকে না চাইতেই মিস করি। এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। অস্বীকার করে লাভ নেই।”

রিহান আর কিছু বললো না। কেবল হেসে কথাটা উড়িয়ে দিলো,
“তোরা সব বেশি ভাবিস। আমি ওর নামও শুনতে পারি না,সেখানে মিস করার প্রশ্নই আসে না।”

পাঁচদিন হলো আরশিয়া ঘরেই বন্দী। একরকম শয্যাশায়ী হয়ে আছে সে। জ্বর বারবার ওঠানামা করছে, শরীর ভীষণ দুর্বল।

আনজুমা চৌধুরী মেয়ের মাথায় সিক্ত তোয়ালে দিয়ে বারবার মুছে দিচ্ছেন, কণ্ঠে উদ্বিগ্নতা,
“এমন দুর্বল হয়ে পড়েছিস।দুটোদিন হসপিটালে থাকলে কি হতো?।”

আরশিয়া মৃদু হাসলো, কণ্ঠ ভাঙা,
“আম্মু আজকে আগের থেকে ভালো লাগছে,আর হসপিটালে থাকলে নিজেকে আরো বেশি অসুস্থ মনে হয়।মাঝে মধ্যে আবহাওয়া পরিবর্তনের জন্য এমন হয়।ডাক্তার আংকেল তো এসে দেখে ঔষুধ দিয়েছে।
আনজুমা চৌধুরী আর কিছু বললেন না। আশরাফ চৌধুরী অফিসে গেছেন।গত তিনদিন যাননি বলে আজ যেতে হলো।এর মধ্যে অর্থি তিনদিন করে এসে দেখে গেছে।আজ ভার্সিটি শেষ করে আবার বসবে বলেছিলো।

অন্যদিকে ক্যাম্পাসে রিহান বারবার চেষ্টা করছে নিজের মনোযোগ ধরে রাখতে কিন্তু পারছে না।
ক্লাসের মাঝখানে হঠাৎ কলমটা হাত থেকে পড়ে গেলে সে অযথা বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো,
“সবকিছুই আজকাল বিষাদ লাগছে।”

রনিত মুচকি হেসে পাশ থেকে বললো,
“কারণটা জানিস, কিন্তু মুখে বলিস না।”

রিহান উত্তর দিলো না। জানালার বাইরে তাকিয়ে রইলো। মুষলধারে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে চলছে মাঠে। মনে পড়লো—সেই দিন ভয়ে কেঁপে উঠেছিলো মেয়েটা।তার বুকের মধ্যে লেপ্টে ঘুমিয়ে ছিলো,অদ্ভুতভাবে মনে একটা অন্য রকম অনুভূতি নাড়া দিলো।

ক্লাস শেষ করে বাহির হতেই হঠাৎ আজ অর্থি কে দেখতে পেলো।দৌড়ে তারই কাছে গেলো।অর্থি আরেকটা ক্লাস আছে সেটার জন্য যাচ্ছিলো, হঠাৎ রিহান সামনে আসায় দাঁড়িয়ে যায়।রিহান বলে,

“তোমার বান্ধবী কোথাই?আজ-কাল দেখিনা যে?”

অর্থি একটু অবাক হলো,উনি কেন খোঁজ করছে? উত্তর দিলো,

“আরশিয়া অসুস্থ এজন্য আসেনা।”

রিহানের মধ্যে উদ্বেগ প্রকাশ পেল,জানতে চাইলো,
“কি হয়েছে?”

“জ্বর,মাথা ব্যথা আর ঠান্ডা লাগছে অনেক।শয্যাশায়ী প্রায় জ্বরটা সারছে না কিছুতেই।
রিহান আর কিছু বললো না,শুধু কিছু একটা ভাবছে।
এর মধ্যে রনিত উপস্থিত হলো,প্রেয়শীর মুখ পানে চেয়ে রইলো।অর্থি খেয়াল করতেই সে চোখ নামিয়ে নিলো,জিজ্ঞেস করলো,
“আরশিয়া কে নিয়ে আসিও।কেউ একজন তাকে ছাড়া মরিয়া হয়ে যাচ্ছে।
অর্থি তার কথার মানে বুঝতে পারলো না তাই আবার জিজ্ঞেস করলো,
“কে?কাকে ছাড়া মরিয়া হয়ে যাচ্ছে?”

রিহান চোখ গরম করে রনিতের দিকে তাকাতেই সে থতমত খেয়ে গেলো,কথা ঘুরাতে বলল,

“মিস করছে বলতে আরশিয়া ক্লাস মিস করছে সেটাই বললাম।

অর্থি”ওহ বললো। ক্লাসের সময় হয়ে গেছে দেখে বলল”-যাই তাহলে ভাইয়া?”

রনিত দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“জ্বী আপু যান।আপনার বাবাকে বললেন তার নামের ফ্ল্যাট গুলে যেন আমার নামে লিখে দেন।

অর্থি ভ্রু কুঁচকে তাকালো, জিজ্ঞেস করলো,
“কেন”

“এই যে আমি তোমার মায়ের পেটের ভাই লাগি তাই অধিকার আছে।
অর্থি বাঁকা চোখে তাকালো।বুঝতে পারলো তাকে খুঁচিয়ে কথাটা বললো।
“আপনি আপনার বাবার সম্পত্তি আমার নামে লিখে দিয়েন তাহলে আপনাকে জামাই ডাকবো।”

ধীর কন্ঠে কথাটা বললো অর্থি সেটা শুধু রনিত শুনলো পেয়েছে। রিহান ততক্ষণে চলে গেছে। অর্থিরও চলে যাচ্ছিলো তখনই বলে উঠলো,
“আমাকে তোমার নামে লিখে নাও,বিনিময়ে ভালোবাসা দাও আর নাও।

“ভালোবাসা বিনিময় আমি বুঝিনা। এসব ব্যবসায়ীক সাবজেক্টে আমি কাঁচা ভাইয়া।”

রনিত হাসলো কেবল,অর্থি ততক্ষণে ক্লাস রুমে চলে গেছে। মনে মনে শুধু বলল”-একবার যখন গ্রীন সিগন্যাল এসেছে তার মানে কিছু একটা হবেই।

ওদিকে বিছানায় শুয়ে আরশিয়া চোখ বন্ধ করেছিলো। হঠাৎ যেন মনে হলো কেউ তার নাম ধরে ডেকেছে। চমকে চোখ খুলে চারপাশে তাকালো।দেখে অর্থি দাঁড়িয়ে আছে, হাতে তার প্রিয় ফুল কাঠগোলাপ। অসুস্থ শরীর নিয়ে বিছানা থেকে উঠলো।অর্থি মানা করলো উঠিস না তুই শুয়ে থাক।

”সমস্যা হবে না।আধশোয়া হয়ে বসলো।অর্থি ফুলো গুলো দিলো।রিহানের খোঁজ করার বিষয় টা খুলে বলতে লাগলো।
আরশিয়া মুখ বাঁকালো,পাত্তা না দিয়ে বলল,
“নিশ্চিত কেনো মতলব আছে নয়তো ঝামেলা করতে পারছে না সেজন্য।

“তা জানিনা বাপু আমি যা দেখি, শুনি তাই বলি।
অর্থি ওর পাশে বসে পড়লো। প্রিয় বান্ধবীকে সময় দিতে জুড়ে দিলো নানান গল্প।

সন্ধ্যে হয়ে আসছে। আশরাফ চৌধুরী আজ তাড়াতাড়ি বাসায় আসবে বলে আগে বেরিয়েছে। বাসার সামনে আসতেই দেখতে পেলো একটি ছেলে এ বাড়ির দিয়ে তাকিয়ে আছে।তার সন্দেহ হলো কে এই ছেলে?গাড়ি থেকে নেমে ধীর পায়ে ছেলেটার কাছে গেলো।কিন্তু তার কেনো হুস নেই আশে পাশে কেউ আছে কিনা।ঘাড়ে কেউ হাত বুলাতেই ছেলেটি চমকে পিছনে তাকালো।

“কে তুমি?আমার বাসার সামনে কি দেখছো?”

ছেলেরি নিজেকে ধাতস্থ করলো,বলল,
“আপনি আরশিয়ার বাবা?”

ভদ্রলোক হ্যাঁ বললেন।
আসসালামু আলাইকুম আংকেল। আমি আরশিয়ার ফ্রেন্ড।ভদ্রলোক হাসলো। বলল,

“আগে বলবে না?দাঁড়িয়ে আছো কেন?নিশ্চয়ই আরশিয়াকে দেখতে আসছো?মেয়েটা অসুস্থ বাঁধিয়ে বসে আছে। গত তিনদিন সিরিয়াস অবস্থা ছিলো আজ তাও ভালো।

“আরশিয়া অসুস্থ?

“হ্যাঁ তুমি জানতে না?”

আমতা আমতা করে বলল,
“জ্বী জানতাম কিন্তু এতো বেশি তা জানতাম না।

চলো ভেতরে চলো।দুজনে পা মিলিয়ে চললো।

রাত বাজে বারো টা।আরশিয়ার কিছুতে ঘুম আসছে না।
আজকে সব অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে,ভালো লাগছে না। হঠাৎ ফোনের নোটিফিকেশনের শব্দে তার ধ্যান ভাঙলো।পাশে ফোনটার দিকে তাকালো। ফোনের স্কিনে জ্বলজ্বল করছে একটা মেসেজ,
“আমি তোমাকে ভালোবাসি। উইল ইউ ম্যারি মি?”

একে অসুস্থ তার উপর মাঝ রাতে এমন মেসেজ মন মেজাজ খারাপ করে দিলো।নাম্বারটা চেক করলো অচেনা।ভাবলো রিপ্লাই দিবে না কিন্তু দিলো,

“হ্যাঁ বিবাহ করিব তো,পরিবার সহ বাসায় এসে প্রস্তাব দিবেন।
যত্তসব।
মেসেজটা সেন্ট করে বিরক্ত প্রকাশ করলো আবার ভাবলো কি বোকামোর মতো কাজ করলাম।
কোনো আলতু ফালতু ছেলে হয়তো জ্বালাতে এসব করছে আর আমিও বোকার মতো রিপ্লাই দিলাম।
আরেকপাশ ফিরে দেখে আনজুমা চৌধুরী ঘুমিয়ে আছে।এই পাঁচদিন ধরে তিনি মেয়ের সাথে ঘুমান।আরশিয়া হাঁসলো মায়ের মাথায় হাত বলিয়ে দিলো।
“মায়েরা কত র্নিস্বার্থভাবে ভালোবাসে তাই না?গত কয়টি রাত জেগে থেকেছে,যত্ন করেছে,খাইয়েছে। এজন্য আজ ক্রান্তিতে ঘুমিয়েছে আরশিয়ার জোরাজুরিতে। মায়ের মতো কেউই হয়না।মায়ের মতো ভালো কেউই বাসতে পারবে না।

চলবে…………….?