প্রেমাঙ্গন পর্ব-০৭

0
22

#প্রেমাঙ্গন
লেখিকা:#শ্যামলী_রহমান
পর্ব:৭

বর্ষাকাল মানেই বৃষ্টি আর কাঁদা পানি। চারদিক বৃষ্টির পানিতে জুবুথুবু হয়ে গেছে।শহরের পাকা রাস্তায় কাঁদা না থাকলেও অনেক জায়গায় জমে আছে পানি।রিকশা কিংবা গাড়ি নিয়ে যাওয়া অনেকটা ভোগান্তির।তবে আজ বর্ষার আকাশে কড়া রোদ উঠেছে,ঝকঝক করছে আকাশ।ভেসে বেড়াচ্ছে নীলের মাঝে শুভ্র মেঘ।
আরশিয়া আজ এক সপ্তাহ পর ভার্সিটিতে যাচ্ছে।
রাস্তায় পানি থাকার কারণে এক জায়গায় আঁটকে গেছে।
রিকশা ওয়ালা অন্য ভালো রাস্তা দিয়ে নিয়ে এসে আরো ঝামেলা বাড়লো।আরশিয়ার দেরি হচ্ছে এই কয়েকদিন এমনিতে ভার্সিটি যায়নি। আজ গেলে যদি ক্লাস মিস হবে তবে হবে কি?আরশিয়া দম ছাড়লো রিকশা ওয়ালাকে বলল,

“ দেখলেন মামা ভালো রাস্তা বলে এটা কেমন রাস্তায় এনেছেন?যেখানে হেঁটে যাওয়া মুসকিল, সেখানে রিকশা যাবে কি করে?কোথায় খাল আছে না-কি আছে কেমনে বুঝবেন?তার উপর সামনে তো নিষেধ দেওয়া যাওয়া যাবে না।

রিকশা ওয়ালা কাচুমাচু হয়ে বলল,

“দুঃখিত আপা।আমি বুঝতে পারিনি এ রাস্তা এমন। একজন কইলো এ রাস্তা নাকি ভালা তাই আইলাম।
আরশিয়া নেমে পড়লো।

“এখন করবো কি তাহলে?”
আবার ঘুরে যাইতে হবে?”

“আপা আপনি দাঁড়ান আমি কিছু একটা ব্যবস্থা করছি।
লোকটা পিছনে কোথাও গেলো। আরশিয়া দাঁড়িয়ে আছে। অর্থি কল দিছিলো দেখে ব্যাক করছে। রিং হচ্ছে কিন্তু ধরছে না। তখনই বাইকের হর্নে সে চমকে উঠলো। এতো কাছে এসে কে হর্ন বাজাচ্ছে?আরশিয়া রেগে গেলো।মনে মনে বকা দেওয়ার জন্য চোয়াল শক্ত করে পিছনে ঘুরলো,বলল,

“কে র….
রিহানের হাসিমাখা মুখশ্রী তার চোখে পড়লো।মুখের কথা মুখেই রইলো।তার হাসিমাখা ফেস দেখে আরশিয়ার রাগ উঠলো সাথে ভ্রু কুঁচকে আসলো।

“আপনি এখানে কেন?”

রিহান বাইক থেকে নামলো।হেলমেট টা খুলে রাখলো।ওর সামনে দাঁড়িয়ে হাসিহাসি ভাব নিয়ে বলল,

“তোমার জন্য।তুমি বিপদে পড়ছো তোমাকে নিতে আসবো না?”

আরশিয়া চোখ ছোট ছোট করে তাকালো।

“আপনাকে কি আমি ডেকেছি?
ওয়েট,ওয়েট!আমি এখানে আপনি কিভাবে জানলেন?

“মন বললো থাকবে তুমি এখানে,
তাই চলে আসলাম তোমাকে সঙ্গ দিতে।

“মানে আপনি এসব করেছেন? রিকশা ওয়ালা মামা..
পিছনে ঘুরে দেখে রিকশা নেই রিকশা ওয়ালা নেই। তার মানে তার ধারণা সঠিক। আরশিয়া কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ালো। রাগি রাগি ফেস করে বলল,

“এসবের মানে কি?আপনার মতলব কি?

রিহানের সোজা উত্তর,
“ অধ্যাঙ্গিনী করার মতলব। হবে কেন বলো তো?”

“এসব ফাউল প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে নেই।

রিহান বাইকে উড়লো। হেলমেট মাথায় দিয়ে বলল,

“ওহ সরি!চলো নামিয়ে দেই। ক্লাস শেষ করে না হয় অন্যসব কথা বলবো। পার্কের বেঞ্চে বসে প্রেমের কথা শুনাবো।
আরশিয়া চোখ গরম করে তাকালো।
রিহান ভয় পাওয়ার নাটক করে বলল,

“আচ্ছা ঠিক আছে প্রেমের কথা না বলি ঝগড়া করবো।

আরশিয়া ওর কথাকে পাত্তা না দিয়ে আশে পাশে রিকশা খুঁজতে লাগলো। কিন্তু এদিকটা এমন বাজে অবস্থা হওয়ায় কোনো রিকশা আটো কিছু নেই। সে আরেকটু সামনে গেলো। ভাগ্যের জোরে একটা সিএনজি পেলো।রিহানের মুখ তখনি গোমড়া হয়ে এলো।যা সব প্ল্যান ভেস্তে গেলো শেষে এই ভেবে মন খারাপ করলো।
আরশিয়া সিএনজি ওয়ালার সাথে কথা বলতে গিয়ে উয়া বলে মুখে হাত দিয়ে দূরত্বে দাঁড়ালো।

“ ছি কি বিচ্ছিরি গন্ধ। আপনি আটো ওয়ালা হয়ে এমন নেশা করে গাড়ি চালান? যদি কোনো এক্সিডেন্ট হয়ে যায় তার দায়ভার কে নিবে?

অর্ধ মাতাল অবস্থায় সিএনজি ওয়ালা বলল,

“আপনার জ্ঞান শুনতে আসিনি।আমি মাল খাই আমাল টাকায় আপনি কি?যান আমার গাড়িতে যেতে হবে না।

আরশিয়া আরেকটু সরে এসে দাঁড়ালো। অর্থি ফোন দিচ্ছে ওর সাথে কথা বললো”আসছি দশ মিনিট।
এদিকে আর কোনো কিছু নেই আর ক্লাসের সময় ও নেই মাত্র পনেরো মিনিট আছে। সামনে হেটে গেলে পাবে কিন্তু লেট হবে। রিহান এখনো দাঁড়িয়ে আছে। আরশিয়া তাকালো তার পর কিজানি মনে করে গেলো।
আরশিয়া চুপচাপ উঠে বসলো। রিহান তখনই হেসে উঠলো। মাথার হেলমেট টা খুলে আরশিয়া কে দিলো।
আরশিয়া নিলো নিতে গিয়ে স্পর্শ হলো হাতের সাথে।
হেলমেট পরতে পরতে বলল,

“ক্লাস মিস যাবে বলে উঠলাম নয়তো কখনো উঠতাম।
আবার অন্য কিছু ভাবিয়েন না।

রিহান মুঁচকি হাঁসলো। আরশিয়া পিছন থেকে বাইকের আয়নায় তা খেয়াল করো।রিহান বাইক স্টাট দিয়ে বলল,

” না অন্য কিছু ভাবছি না। শুধু ভাবছি উপায় না পেয়ে আজ বাইকে উঠলে,আরেকদিন বিয়ে করবে,আরেকদিন ভালোবাসবে,আরেকদিন বা…

“ স্টপ! আজগুবি স্বপ্ন না দেখে চলুন।
গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল এমন কাহিনি।

“ম্যাডাম কাঁঠাল যদি ভাগ্যের জোরে নিচে পড়ে তখন সে খাবে এবং গোঁফে যদি আঁঠা লাগে তাই আগে থেকে তেল দিয়ে সাবধান হতে সমস্যা কই?”

রিহানের যুক্তির কাছে হার মারলো সে।চুপচাপ বাইক চলছে। খুব জোরেও না আবার আস্তেও না। আরশিয়া রিহান কে ধরে বসেনি। বাইকের সিট ধরে আছে।
মাঝ রাস্তায় এসে রিহান ব্রেক কষলো, কিন্তু আরশিয়া ঝুঁকে পড়লেও ওকে ধরলো না। নিজেকে সামলে নিয়ে দাঁত পিষে বলল,

“এটা সিনেমা নয় যে ব্রেক কষলে আপনার গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়বো। অবশ্য ফারিয়া হলে এমনি পড়বে। আপনি তার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।

রিহান রেগে গেলো। চোখ মুখ গম্ভীর হলো আর কিছু বললো না। আরশিয়া শুধু আয়নায় তার কাহিনি দেখলো।
এর পর আর কোনো কথা হলো না। চুপচাপ নির্জনতায় চললো বাইক।
দূর থেকে কেউ তাদের লক্ষ্য করলো। তা তাদের অজানা রয়ে গেলো।

ভার্সিটির গেইটের সামনে বাইক থামলো। আরশিয়া নেমে পড়লো তাড়াহুড়ো করে।এর মধ্যে অনেকের নজর তাদের দিকেই। কারো বিস্ময়কর দৃষ্টি কারো বা অবাক করা চাহনি। রনিত, অভিক,সাহিল আর অভিষেক গেইটের খুব কাছাকাছি ছিলো যার কারণে ওরা দেখতে পেলো।
সাহিল অবাক হয়ে হা করে তাকিয়ে আছে। রনিত খুব একটা অবাক হলো না তবে অভিক বিস্ময় নিয়ে বলল,

“ ওল আর তেঁতুল এক সাথে কি করে? আমি কি ভুল দেখছি নাকি?
বরাবরের মতো অভিষেক কেবল চুপচাপ তার স্বভাব এমনই। রনিত বলে উঠলো,

“ শত্রুর জন্য জেগেছে মনে প্রেম, হয়েছে সে দিওয়ানা,
তাহাকে ছাড়া বন্ধু বাঁচবে না, তাইতো পাঠিয়েছে অর্ধাঙ্গিনী হওয়ার প্রস্তাব খানা।

সাহিল হা হয়ে বলল,

“কি বলিস দোস্ত হাচানি?

“আমি কি মিথ্যে বলি?”

অভিক মাঝ খান থেকে খোঁচা মেরে বলল,

“না তুই মিথ্যে বলতেই পারিস না। এজন্য তো দেখি চোখ দিয়ে গিলে খাস একজনকে আর আমাদের বলিস প্রেম নাই জীবনে।

রনিত মুখ বাঁচাতে হেসে বলল,

“ প্রেমের মাস চলছে হাওয়া লাগছে আর কি।

অভিষেক মুখ খুললো। র্নিলিপ্ত বলল,

“ বসন্ত এখনো আসেনি। আসতে আরো দেরি আছে।

রনিত চোখ মুখ কুঁচকে তাকালো অভিষেকের পানে।বলল,

“সালা তোর মুখ দিয়ে এমনি কথা বাহির হয় না কিন্তু ভুল ধরার জন্য বসে থাকিস কেন? যা তোর কপালে কোনোদিন মাইয়া জুটবে না।

“মাইয়া জুঁটতে হবে না। আমার ভাগের সব মাইয়া তোর হোক।

রনিত লাফিয়ে উঠলো। তার পর কপালে ভাজ ফেলে বলল,

“না লাগবে না আমি অন্যের দান নিই না।আমার একটা হলে হবে।তোর জিনিস তোর কপালে জুটুক সালা।

“আমার বোন নেই আর থাকলেও তোকে দিতাম না তাই সালা বলা বন্ধ কর।

রনিত চোখ পাকিয়ে ওর দিকে তাকালো। রাগি রাগি ভাব নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে ধরলো। তার পর হঠাৎ নিচু হয়ে পা ধরার চেষ্টা করে বলল,
“মাফ কর তোর সাথে কথায় পারবো না। ভাই তোরা একে বলিস কম কথা বলে?দেখ কেমন পেঁচালো কথা কইয়া আমার মনের প্রেম ঘাটিয়ে দিলো।

রনিতের কথা শুনে বাকি তিনজনে হেসে উঠলো।
অভিষেক ও হাসলো একটু রনিত কেবল রাগের ভান ধরে দাঁড়িয়ে রইলো।

আরশিয়া ততক্ষণে বাইক থেকে নেমে গেইট পেরিয়েছে। রিহান তড়িঘড়ি করে আসলো পিছন থেকে বলল,

“এ কেমন মেয়ে লিভ দিলাম তার পর ও একটা থ্যাংকস পর্যন্ত দিলো না।
আরশিয়া শুনতে পেলো ঠিকই কিন্তু উত্তর দিলো না।
অর্থির ক্লাস আগে শুরু হয়েছে সেজন্য ও নেই। আরশিয়া টাইম দেখলো আর দুমিনিট আছে।তাই এক দৌড়ে চললো ক্লাস রুমে। এর মধ্যে ঘটলো আরেক কাহিনি ক্লাস রুমে প্রবেশ করার আগে ফারিয়া এসে সামনে দাঁড়ালো।
আরশিয়া থমকে দাঁড়ালো।

“কি সমস্যা?”

“আজকাল উড়ছিস বেশি।বাইকে আসছিস, শত্রুর সাথে সন্ধি করে কিছু চলছে নাকি?”

ফারিয়ার বলার সাথে মুখের ভঙ্গি অন্য মতো ছিলো।যে ভঙ্গি অন্য কিছু ইঙ্গিত দেয়। আরশিয়ার রাগ উঠলেও কন্ট্রোল করলো।

“এমন স্বভাব আপনার থাকতে পারে আমার নয়।গলির ফাঁকে আপনাকে দেখা যায় আমাকে নয়।”

ফারিয়ার হাসি ধপ করে বন্ধ হয়ে গেলো। আরশিয়া ওকে পাশ কাটিয়ে ক্লাসে গেলো।ফারিয়া দাঁড়িয়ে চিন্তায় মগ্ন হলো। কিছু ভাবনা মনে বাজছে।

ক্লাস শেষ হতেই স্যার সবাই কে কয়েক মিনিট বসতে বললেন। ভিসি স্যার আসবেন বলে। কিছুক্ষণের মধ্যে ভিসি সাথে আরো কয়েকজন স্যার ও সিনিয়র স্টুডেন্ট এসেছে। তার মধ্যে রিহান ও তার বন্ধুরা আছে।
সবাই উঠে সালাম দিলো। সবাই কে বসতে বলা হলো। আরশিয়া মাঝখানের বেঞ্চে বসে ছিলো। রিহান তাকে খুঁজছিলো হঠাৎ চোখ পড়তে দেখে আরশিয়া এদিকে তাকিয়ে আছে।রিহান হেঁসে উঠলো চোখ টিপ দিলো সবার অগোচরে।আরশিয়া মনে মনে কয়টা গালি দিলো, চোখ সরিয়ে মন দিলো সামনের ব্যক্তিদের দিকে।

সবাই কে জানানো হলো বর্ষপূর্তি উদযাপন হবে আগামী মঙ্গলবার। কে কি করবে,কি নাচবে, গাইবে তা ঠিক করতে এবং প্রত্যেক বিভাগ থেকে একজন করে দায়িত্ব নিতে হবে। সিনিয়র রা আছে তাদের কাছে সবকিছু বললে হবে।ভিসি যেহেতু রিহানে চাচ্চু তাই তার দায়িত্ব বেশি দেওয়া হয়েছে।যখন বলা হলো তোমাদের বিভাগ থেকে কে দায়িত্ব নিবে?
হাত অনেকে তুললেও রিহান আরশিয়া কে দাঁড়াতে বলল,

আরশিয়া কিছু বলতে না পেরে দাঁড়ালো। রিহান বলল,

“স্যার ওকে নিই। ও সবকিছু বেশ বুঝবে এন্ড বেশ দায়িত্বশীল মেয়ে আমি চিনি।
ব্যস হয়ে গেলো অনিচ্ছা সত্ত্বেও দায়িত্ব নিতে হলো।রিহান হাসলো আরশিয়ার মুখের ভঙ্গি দেখে।
অভিক বলল,

“সালা তুই দেখি দেবদাস হয়ে যাচ্ছিস। কাছাকাছি থাকার কি সুন্দর উপায় বানালি।

রিহান অভিকের দিক থেকে নজর ঘুরালো।সবার মাঝের আরশিয়ার কুঁচকে রাখা মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,

“দেবদাস হতে যাবো কোন দুঃখে?আমরা তো হবো আমাদের মতো,ভালোবাসার জোড়া কবুতর।
না পাওয়া, সেঁকা খাওয়া এসব আমার ডিকশনারিতে থাকবে না। দেবদাস, চণ্ডিদাস সব দাসের মতো হয়ে আমি সবার কাছে পরিচিত হতে চাই না,ইতিহাসের পাতায় নাম লেখাতেও চাইনা।আমি চাই সে শুধু আমার হোক,লক্ষ্য মানুষ না জানুক,প্রেমের কাহিনিতে সেই শুধু আমার পাশে থাকুক।

চলবে……………?