#প্রেমাঙ্গন
লেখিকা:#শ্যামলী_রহমান
পর্ব:১০
হঠাৎ হাত টান দেওয়াতে আরশিয়া হকচকিয়ে যা,ভয়ও পায় কিছুটা,কারণ এদিকে খুব একটা মানুষ নেই। হাতের সাথে তার মুখেও হাত দিয়ে চেপে ধরা।পিছনে কে দেখতে পাচ্ছে না,মুখ দিয়ে আওয়াজ করবে সে উপায়ও নেই।
আরশিয়া কেবল ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। বলিষ্ঠ দেহের পুরুষের সাথে কি আর পেরে উঠা যায়?সেও পারলো না।
ভার্সিটির পিছনের গেইট দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তা দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?কেন নিয়ে যাচ্ছে তা জানা নেই। অনেকটা যাওয়ার পর হাত ও মুখ ছেড়ে দিলো। আরশিয়া হাফাতে লাগলো।মনে হচ্ছিলো দম বন্ধ হয়ে আসছে,হাসফাস লাগছে, নিঃশ্বাস পড়ছে তড়িঘড়ি করে। কে তাকে নিয়ে আসলো তা দেখার জন্য পিছনে তাকাতেই কাউকে দেখতে পেলো না। আশে পাশে কেউ নেই। হুট করে কেউ সামনে আসলো। সোডিয়ামের আলোয় সে ব্যক্তির মুখশ্রী স্পষ্ট দেখা গেলো। ঠোঁটের কোনে মুঁচকি হাঁসি লেগে আছে। যেন বেশ মজা পেয়েছে।
তার হাসি দেখে আরশিয়ার রাগ হলো।কিছু বলতে নিলেও রিহান শুনলো না। আবারো ধরে টেনে নিয়ে গাড়িতে বসালো।আরশিয়া উঁঠতে নিলে সেও বসে পড়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। গাড়ি স্টাট দেয় তখনই।
আরশিয়া রেগে ছোট ছোট করে তাকালো।বলল,
“কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?এসবের মানে কি আবার কি? করতে চান?
আরশিয়ার অদ্ভুত কৌতূহল চোখের দিকে একবার তাকালো রিহান, কিন্তু উত্তর দিলো না।
শুধু গাড়ি চালাচ্ছিলো, আরশিয়ার প্রশ্নকে অবহেলা করে। আরশিয়া চিৎকার করতে চাইলেও রিহান থামতে চাইলো না।
“শুনবেন না তো?” আরশিয়া বললো, কিন্তু রিহান মাথা নাড়ালো না।
“তাহলে লাফ দিবো?
“দরজা খুলতে পারলে দাও।
আরশিয়া ফুঁসে উঠলেও সে শুনলো না। শেষে বাঁধ্য হয়ে চুপ করে থাকলো।দেখতে থাকলো কই যায়,কি হয়।
এতোদিন সামান্যটুকু চিনেছে, জেনেছে, তার প্রতি ধারণা বদলেছে।
তারেক মির্জা আশরাফ মির্জা কে ফোন করলেন। ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে জানতে চাইলো মেয়ের মতামত।
তিনি কি বলবেন?মেয়ে তো জাননি।
তাই বলল,
“আজ ফিরুক জেনেই বললো কাল সকালে কিংবা রাতেই।
আরো কিছু কথা বলে ফোন রাখলো।
আশরাফ চৌধুরী হাফ ছাড়লো। সবে অফিস থেকে ফিরেছে। আজকে মিটিং ছিলো আর এতো ক্রান্ত লাগছে।
আনজুমা চৌধুরী এক গ্লাস পানি এনে দিলো।পানিটুকু শেষ করে সোফায় গা এলিয়ে দিলো। কিছুক্ষণ পর চোখ খুললো। স্ত্রী কে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আরশিয়ার তো ফাংশন শেষ হয়েছে এতক্ষণে আসার কথা।
‘ফোন করে দেখেন কোথায় আছে। মেয়েটা কথা শোনোনা। বলি বাড়ির গাড়ি নিয়ে যেতে কিন্তু তার নাকি রিকশা ভালো লাগে।
আশরাফ চৌধুরী আরশিয়ার নাম্বার ডায়াল করলো। রিং হলেও ধরলো না। দুইবার কল দিয়ে আর দিলো না। মাঝে মধ্যে এমন হয় বাসার আশে পাশে আসলে কল কেটে দেয়।হয়তো এসেছে এজন্য আর দিলো না।
এক সময় গাড়ি থামলো নির্জন নদীর পাড়ে।রিহান আগে নেমে পড়লো। ধীরে ধীরে আরশিয়াও নামলো। নদীর পাড়ে এক সাইডে আলো জ্বলছে, তবে এই সাইডটা একটু অন্ধকার। আরশিয়ার মনে নানা অনুভূতি ভয়, উত্তেজনা, ও অদ্ভুত আকর্ষণ একসাথে। কে এখানে নিয়ে আসলো সেই ভাবনাও।
রিহান কিছু বললো না। সে নদীর পাড়ে বসে পড়েছে, আরশিয়া পাশে দাঁড়িয়ে রইলো।
চাঁদের আলো নদীর পানিতে পড়ে ঝলমল করছে। আরশিয়ার চোখে আলো-ছায়ার খেলা। রিহানের অবয়ব নদীর জলে প্রতিফলিত হচ্ছে, আর পাশে আরশিয়ার ও প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হলো। আরশিয়ার নজর সেদিকেই ছিলো।
হঠাৎ রিহান ধীর কণ্ঠে বললো,
“নদীর জলের প্রতিচ্ছবির মতো, বাস্তবে আমরা কবে পাশাপাশি হবো? ভালোবেসে এক সাথে চলবো? আমি কি বেশি খারাপ?”
আরশিয়া কিছু বলতে চাইলো, কিন্তু রিহানের চোখের গভীরতায় যেনো কথা আটকে গেলো।
“আজ কিন্তু অন্য কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে আসিনি।
রিহান আরও বললো,
“শুধু কিছু কথা বলতে নিয়ে এসেছি।”
আরশিয়া গভীরভাবে শ্বাস ফেললো। চাঁদের আলো, নদীর স্নিগ্ধতা, আর রিহানের কাছাকাছি থাকা সব মিলিয়ে তার হৃদয় হঠাৎ অচেনা রকম উত্তেজনায় ভরে গেলো।রিহান চুপ করে কিছু ভাবছে।
আরশিয়া নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে রইলো। চাঁদের আলো তার চুলে নরম আবছা আভা ফেলছে। নদীর জলের ধারা হালকা বাতাসে দুলছে, প্রতিটি ছোঁয়া যেনো মুহূর্তকে আরও কোমল করে তুলছে।
রিহান হুট করে উঠে পড়লো। কিছুটা কাছে এগিয়ে এল। চোখে গভীর উদ্বেগ আর মৃদু আবেগের মিশ্রণ। তার পা আরশিয়ার দিকে এগিয়ে গেল।
“আরশিয়া।
রিহানের শীতল কন্ঠে কি ছিলো জানা নেই তবে হৃদয়ে কম্পন সৃষ্টি হলো।
সে ধীর কণ্ঠে আবারো বললো,
“আমি জানি তোমাকে এখানে আনা ঠিক হয়নি কিন্তু আমি কোনো উপায় না পেয়ে এনেছি। এক সময় সম্পর্ক কেমন ছিলো তা মনে রাখতে চাইনা। আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি নিশ্চয়ই সেটা জানো?
❝আমি তোমাকে ভালোবাসি❞ এই কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে আরশিয়া হৃদয়ের অন্তপটে কিছু অনুভব করলো।বুকের বা পাশে ধুক করে উঠলো। মনে হলো চারপাশে শীতল বাতাসে হৃদয় শিউরে উঠলো।তার পর
আবারো রিহানের কথা শোনার জন্য তারই পানে চাইলো।
“আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করতেও রাজি কিন্তু অপেক্ষার শেষে তুমি কি আমার হবে?এই কথা দিতে হবে।
অপেক্ষা কষ্টকর হলেও অপেক্ষার শেষে ফল মিষ্টি হলে অপেক্ষা করা ব্যর্থ হবে না। এমন আশ্বাস কি তুুমি দিবে?
তুমি আমার জীবনের প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্তের অংশ হবে?তোমাকে চাই আমার জীবন সঙ্গী হিসাবে।পথ পেরোতে হাতের ডান পাশে, ঘুমের ঘোরে বুকের বা পাশে।
ঘুম ভেঙে গেলে যেন তোমাকেই দেখতে পাই।
আরশিয়া নিশ্চুপ তাকিয়ে শুনছে তার দেখছে সামনের মানুষটাকে। কি পরিবর্তন! সত্যি কি পরিবর্তন? নাকি অন্য কিছু?এমন প্রশ্ন আসে মাঝে মধ্যে।
“কোনো শব্দের প্রয়োজন নেই। শুধু আমাকে দেখো, বুঝো। আমি তোমাকে ভালোবাসি আর চাই তোমার পাশে থাকতে।কোনো বাধা নেই, কোনো ভয় নেই। তুমি যদি রাজি হও, আমরা একসাথে চলতে পারি, যেমন নদীর ধারা চিরকাল একসাথে প্রবাহিত হয়।”
রিহান উত্তরের আশায় তাকিয়ে রইলো। কিন্তু আরশিয়া তার পর ও চুপচাপ তার দিকে তাকিয়ে রইলো।
রিহানের হৃদয় দ্রুত ধুকপুক করছে। নদীর ধারে চাঁদের আলোতে রিহানের চোখে মিশে আছে ভয়, ভালোবাসা এবং প্রত্যয় সব মিলিয়ে এক অনন্য আবহ। আরশিয়া বুঝতে পারছে ভয় তার উত্তর নিয়ে।
আরশিয়া রিহানের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ রইলো। নদীর ঝলমল পানির প্রতিচ্ছবির মতো, তার অনুভূতিও মিশ্রিত ভয়,অনিশ্চয়তা।
আরশিয়া কেবল ধীট কন্ঠে বললো,
“বাসায় যাবো।”
রিহান আাশাহত হলো। চোখ চিকচিক করে উঠলো।
চোখে মুখে অদ্ভুত শূন্যতা ফুটে উঠলো, হৃদয়ে হাল্কা ব্যথা অনুভব করলো। এ ব্যথা না পাওয়াট ব্যথা। নদীর স্রোতের মতো তার অনুভূতি ভেঁসে গেলো,কোনো এক পাড়ে আঁচড়ে পড়লো।
সে নিঃশব্দে গাড়ির দিকে ফিরে গেলো। পকেটে রাখা ছোট গোলাপ ফুলটা ফেললো নিঃশব্দে। আরশিয়া মাটিতে পড়ে থাকা ফুলটার দিকে তাকালো, তার পর তাকালো মানুষটার দিকে।
রিহান ততক্ষণে গাড়িতে উঠে বসছে।সে বুঝতে পারছে তার অনুভূতির মূল্য নেই অপরপ্রান্তের মানুষটার কাছে।
‘মানুষ যখন অনুভূতির মূল্য পায় না, তখন সে পাথরের ন্যায় শক্ত,নিশ্চুপ হয়ে যায়।’
আরশিয়া এসে গাড়িতে বসলো।একবার রিহানের দিকে চোখ রাখলো।
আরশিয়া বসতেই রিহান স্টার্ট দিলো, ধীরে ধীরে গাড়ি চললো। নিস্তব্ধ রাত, নদীর পাশে কেবল বাতাসের হালকা শব্দ আর গাড়ির চাকা মাটিতে ঘষার শব্দ।
দুইজনের মধ্যে ভারী নিস্তব্ধতা। আরশিয়ার মন ভরা ভাবনা আর রিহানের হৃদয়ে হাহাকার—সব মিলিয়ে একটি অদ্ভুত মুহূর্ত।
কিছুদূর চলার পর গাড়ি থামলো। রিহান নেমে পড়লো। আরশিয়া তাকালো ওদের বাসার গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
সে ধীরে ধীরে নেমে এলো।দরজা বন্ধ করে বাসার ভেতর যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। হাত ঘড়ির দিকে একবার তাকালো বেশ দেরি হয়ে গেছে। একটু আগে আশরাফ চৌধুরী ফোন ও করেছিলেন কিন্তু সে ধরেনি।
সে চলে গেলো খানিকটা। হঠাৎ ফোনের রিংটোনে পিছনে ফিরলো। রিহান ও তাকালো।ফোন তার হাতেই আছে তাহলে কার? আরশিয়া ব্যাগে খুঁজলো তার ফোন নেই তার মানে তারই। আরশিয়া এগোনোর আগেই রিহান এলো। গাড়ি থেকে ফোনটা হাতে নিতেই স্কিনে ভেসে থাকা নামটা দেখে বুকের ভেতর আরো তীব্র ব্যথা অনুভব হলো। আরশিয়া হাত বাড়াতেই তার চোখের দিকে না তাকিয়ে ফোনটা দিলো। ফোনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে চললো আবারো।
রিহান শেষ আশায় তাকিয়ে থাকলো, কিন্তু আরশিয়া পেছনে না তাকিয়ে সরাসরি বাসার ভেতরে চলে গেলো।
রিহানের চোখে অদ্ভুত হতাশা। সে একবার গাড়ির ডিকিকে লাথি মারে। চোখ বন্ধ করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলো।
তারপর গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিয়ে ধীরে ধীরে চলে গেলো।নিঃশব্দ রাতের পথের মতো হা হা কারে তার বুকের ভেতর তোলপাড় চললো।
রাত এগারোটা। রিহানের গাড়ি এসে থামলো তাদের বাসার সামনে। এতো দেরিতে ফেরার কারণে তারেক মির্জার ঝারি খেতে হবে নিশ্চিত। তবে আজ তা তোয়াক্কা করলো না। মনে তার অশান্তি কিছু ভালো লাগছে না।
আরশিয়া কে নেমে দিয়ে এসে মাঝ রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে ডিকির উপর চড়ে বসে ছিলো অনেকটা সময়।
গাড়ি পার্ক করে রেখে দরজার কলিং বেল চাঁপলো।
ইভা এসে দৌঁড়ে দরজা খুলে দিলো। তার ঠোঁটের মুচকি হাঁসি দেখে রিহান ভ্রু কুঁচকালো। জিজ্ঞেস করলো,
“পাগলের মতো হাঁসছিস কেন?আমাকে কি জোঁকার লাগছে?”
আবারো ইভা গটগটিয়ে হেঁসে উঠলো।
রিহান ছোট ছোট চোখ করে তাকালো।
সোফায় বসা হামিদ মির্জা কে উদ্দেশ্য করে বলল,
“চাচ্চু তোমার মেয়ে পাগল হয়ে গেছে, নয়তো জ্বীনে ধরেছে। কারণ ছাড়াই শুধু হাঁসছে দেখো।
হামিদ মির্জা ফোনে কথা বলছিলো। ফোন রেখে বলল,
“ওর কথা ছাড়।আয় তোর জন্য একটা খবর আছে।
হামিদ মির্জাও হাসছে।রিহান ভাবছে আজ সবার হলো কি?নাবিল কোথা থেকে এসে রিহান কে জড়িয়ে বলে উঠলো,
“কি মজা রিহান ভাইয়া বিয়ে হবে,নতুন বউ আসবে, আমি ভাবির কোলে চড়বো কি মজা।
নাবিলের কথা শুনে রিহান অবাক হলো। নীহারিকা মির্জা ওকে টানলো। সায়মা মির্জা এসে হেসে জানালো,
“তোমার জন্য মেয়ে ঠিক করেছি। একজনের জন্য তো অপেক্ষা করে থাকা যায় না। সে মেয়ে রাজি না হলে করার তো কিছু নেই।
রিহান এবার আর কিছু বললো না। নিরবতা পালন করলো খানিকক্ষণ। শুধু মনে মনে বলল,
“ বুকের বা পাশে তোমার জায়গা না হলেও,তোমায় না পাওয়ার ব্যথার জায়গা ঠিকই হলো।
চলবে…………………..?