#প্রেমাঙ্গন
লেখিকা: #শ্যামলী_রহমান
পর্ব: ১৭
সময় গড়িয়েছে দ্রুত। কয়েকটা দিন যেন স্বপ্নের মতো কেটে গেছে।আজ বৃহস্পতিবার। দিনটা অন্য দিনের চেয়ে আলাদা।কারণ আজ আরশিয়া আর রিহানের গায়ে হলুদ। কাল তাদের বিয়ে।তাড়াতাড়ি সবকিছু কেমন করে যেন হয়ে গেলো।
বাড়ির আঙিনা রঙিন আলো আর গাঁদা ফুলে সাজানো। ঘরে-বাইরে ব্যস্ততা, অতিথিদের আসা-যাওয়া। কেউ রান্নাঘরে, কেউ আঙিনায় সাজসজ্জার তদারকি করছে। বিয়েটা হঠাৎ করেই ঠিক হওয়ায় সবকিছু যেন অল্প সময়ের ভেতরে আয়োজন।
রিহান সেদিন রেস্টুরেন্ট থেকে ফেরার পরই বাবাকে বিয়ের কথা জানিয়েছিলো। আরশিয়ারও সম্মতি মেলাতেই আর দেরি করেনি কেউ। তাই মাত্র পাঁচদিনের মাথায় গায়ে হলুদ, ছয়দিনে বিয়ে ঠিক করা হয়।
এরই মাঝে তিনদিন আগে মিহির আর নীলার বিয়েটাও হয়ে গেছে। সেখানে একসাথে গিয়েছিলো রিহান-আরশিয়া। মনে হচ্ছিল যেন একটানা উৎসব চলছে চারপাশে।
এখন বিকেল। সূর্যের রোদ যেন আকাশে ঝলসে উঠেছে। কিন্তু ঘরের ভেতরে কেবল বিয়ের আমেজ।
আরশিয়া বিছানায় বসে আছে। চোখে-মুখে হালকা ভাবনা, বুকের ভেতরে লুকানো উত্তেজনা। অর্থি হাত বাঁকিয়ে দাঁড়িয়ে চোখ পাকিয়ে তাকালো।
“রেডি কি হবি?”
আরশিয়া ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
“এখনো সময় আছে। অনুষ্ঠান শুরু হবে রাতে। বিকেল থেকে সাজসজ্জা করে বসে থাকলে গরমে কষ্ট হবে না নাকি?”
অর্থি কিছু বলার আগেই আনজুমা চৌধুরী ব্যস্ত পায়ে ঘরে ঢুকলেন। হাতে একটা ব্যাগ, বিছানায় রেখে বললেন,
“এখানে কাঁচা ফুল আছে। রেডি হয়ে পরে নিস।”
আর্টিফিশিয়াল ফুল আনা হয়েছে। এখন আবার তাজা ফুল দেখে কৌতূহলী দৃষ্টিতে বলল,
“এগুলো কে আনলো আম্মু?”
“রিহানের বন্ধু এসেছে। নাকি রিহানই পাঠিয়েছে।”
বলেই আনজুমা চৌধুরী আবার ব্যস্ত পায়ে বেরিয়ে গেলেন।
ব্যাগ খুলে আরশিয়া অবাক হলো। তাজা ফুলের গন্ধে ভরে উঠলো ঘর। গাঁজরা, মালা, কানের দুল, টিকলি সবই দুটো করে।
অর্থি ঠোঁট কামড়ে জিজ্ঞেস করল,
“এখানে দুজনের জন্য আছে কেন?”
আরশিয়ার একটু ভাবলো। যখন বুঝতে পারলো ঠোঁটে দুষ্টু হাসি ফুটলো।
“আমার তো মনে হচ্ছে রনিত ভাইয়া এসেছে। তুই রাগ করে দুদিন ধরে কথা বলিস না, তাই হয়তো তোর জন্যও ফুল নিয়ে এসেছে।প্রেমিকার অভিমান ভাঙাতে প্রেমিক ফুল নিয়ে হাজির হলেই প্রেমিকা গলতে বাঁধ্য।এই ট্রিকস সব প্রেমকরা জানে।
অর্থি চোখ বড়ো করে তাকালো। তারপর দাঁড়িয়ে হঠাৎ করেই বেরিয়ে গেলো। আরশিয়া মুচকি হেসে ফোন হাতে তুলে নিলো রিহানকে কল দিতে।
অর্থি ঘর থেকে বেরিয়ে নিচে উঁকি দিলো। সত্যিই তো রনিত নিচে সোফায় বসে আছে। আনজুমা চৌধুরী তার সামনে নাস্তা সাজিয়ে দিয়েছেন। অথচ রনিত বারবার উপর দিকে তাকাচ্ছিলো, যেন কাউকে খুঁজছে।
হঠাৎ দু’জনের চোখাচোখি হয়ে গেলো।
অর্থি দাঁড়িয়ে আছে সিঁড়ির মাথায়, ঠোঁট চেপে হাসছে।
রনিত দুই কান ধরে কচলাতে কচলাতে মাথা নাড়লো
“সরি!”
ঠিক তখনই আনজুমা চৌধুরী ঘরে ঢুকলেন।
“কী বাবা! তুমি কান ধরে কী করছো?”
রনিত চমকে উঠলো। তাড়াতাড়ি হাত নামিয়ে নিয়ে বলল,
“না আন্টি, আসলে মাঝে মাঝে মনে হয় কানে কেমন তালা লাগে। তাই একটু চাপ দিচ্ছিলাম।”
আনজুমা চিন্তিত কণ্ঠে বললেন,
“আরে বাবা, তাহলে ডাক্তার দেখাও। না হলে দেখা যাবে একসময় কিছুই শুনতে পাবে না।”
রনিত মেকি হাসি দিয়ে মাথা নাড়লো।
আনজুমা চৌধুরী ব্যস্ত হয়ে আবার ভেতরে চলে গেলেন।
অর্থি তখন সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসছে।
রনিত চোখে-মুখে বিরক্তি নিয়ে নিচু স্বরে বলল,
“এই হাসির আমি কিন্তু শোধ তুলে নেবো।শুধু রাতটা নামতে হতে দাও।
তারপর দরজা পেরিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলো।
অর্থি দাঁড়িয়ে রইলো, ঠোঁটে ঝঙ্কার তোলা হাসি যেন বেশ মজা পেয়েছে।
রাত নামতেই আরশিয়াদের আঙিনায় জমে উঠলো গায়ে হলুদের আসর।
বাড়ির সামনের উঠান আলোয় ঝলমল করছে, চারদিকে গাঁদা আর গোলাপের সাজ। টেবিলে সাজানো পিঠা, মিষ্টি, ফলমূল। গানের তালে তালে ছোটরা নাচছে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আরশিয়া হলুদের শাড়ি পরে, কপালে টিপ, হাতে গাঁজরা পরে লজ্জায় মুখ নিচু করে বসে আছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল ফুলে ভরা কোনো কচি কুঁড়ি। আনজুমা চৌধুরী আর আত্মীয়রা বারবার চোখ মেলাচ্ছে এমন সাজে তাদের মেয়েকে দেখে মন ভরে যাচ্ছে।
প্রথমে ঘরের সবাই মিলে হলুদ দিলো। এরপর একে একে আত্মীয়রা। হাসাহাসি, ঠাট্টা সব মিলে চারপাশে আনন্দের রোল।
হঠাৎ খবর এলো,
“রিহানদের বাসা থেকে বোন আর বন্ধুরা এসেছে।”
দরজা দিয়ে প্রবেশ করলো কয়েকজন। সবাই প্রায় পরিচিত মুখ।রনিত, অভিক,সাহিল অভিষেক আর রিহানে কাজিনরা। একে একে সবাই আরশিয়াকে হলুদ দিলো। হৈচৈ, ফটো তোলা, খুনসুটি সব মিলিয়ে মুহূর্তটা রঙিন হয়ে উঠলো।
আরশিয়া রিহানের সাথে ভিডিও কলে কথা বলেছে। রিহান আসতে চাইলেও আরশিয়া মানা করে দেয় তাই আস আসেনি। তাছাড়া অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয় কথায় ও আছে। তাই একটু অপেক্ষা মন্দ নয়।
এদিকে অন্যপাশে অর্থি বসে আছে। তখন রনিত ওর পাশে এসে দাঁড়ালো।
রনিত মুখ টিপে বলল,
“আমারও তো হলুদ দেওয়া বাকি। কণ্যার গায়ে হলুদ নেওয়ার অনুমতি আছে?”
অর্থি চোখ পাকিয়ে বলল,
“আপনি আমাকে হলুদ দিবেন কেন?আপনি গিয়ে আপনার মৌমিতা কে হলুদ দেন।
রনিত একহাত মাথায় দিয়ে হতাশ হয়ে বলল,
“আল্লাহ আর কতবার বলবো মৌমিতা আমার ফ্রেন্ড।
গত দুদিন থেকে বোঝাচ্ছি।
“জুনিয়র কি ফ্রেন্ড হয়?এসব ধান্দা আমি বুঝি তাই জ্ঞান দিতে আসবেন না সরুন।
অর্থি হনহনিয়ে চলে গেলো। রনিত হতাশ হয়ে তাকিয়ে রইলো।অভিষেক এসে ঘাড়ে হাত রাখলো,হেসে মজা নিতে বলে উঠলো,
“কি রে প্রেমিক পুরুষ পাত্তা দিচ্ছে না কেন?প্রেমেও দুই নাম্বারি করছিস নাকি?
রনিত ঘাড় থেকে হাত ফেলে দিয়ে বলল,
“সালা কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিতে আসবি না। আমি সবকিছুতে এল নাম্বার আর প্রেমে তো একশ পারসেন্ট এক নাম্বার।আমার প্রেমে কোনো ভেঁজাল নেই। তাই পঁচা মাছির মতো নাক গলাবি না সালা।
“সালা আমার বোন নেই তার পর সালা কইস কেন?
“অর্থিকে তোর বোন বানিয়ে দিবো।তোদের দুজনের বেচ মিল আছে।দুটোতে শুধু ঝামেলা বাঁধাস আর আমারে অবিশ্বাস করিস,সালা।
রনিত চলে গেলো।অভিষেক হেসে উঠলো। রনিত কে রাগাতে তার বেশ ভালো লাগে এজন্য যেচে লাগতে আসে।
আজ শুক্রবার। কাঙ্ক্ষিত দিন এবং সময় দুটোই এসে গেছে।
বিকেলের পর থেকেই সাজ শুরু হলো।
আরশিয়ার পরনে লাল বেনারসি, ঠোঁটে লিপস্টিক, চোখে কাজল,মুখে হাল্কা মেকআপ। আয়নার সামনে বসে থাকতে তার বুক কাঁপছে বারবার। কেমন অনুভূতি হচ্ছে। আজ তার এক নতুন জীবনের সূচনা হতে যাচ্ছে।
সাঁজ শেষ হতেই সকলের নানান কথায় আরশিয়ার
ঠোঁটে মিষ্টি হাসি ফুঁটে উঠলো,সাথে চোখেমুখে লজ্জার মিশেল।
এদিকে রিহানও তার বাড়িতে প্রস্তুত। সাদা শেরওয়ানি, মাথায় পাগড়ি,হাতে রুমাল লোক দেখানোর জন্য নয়তো আবার লাজ লজ্জা কম। সকলে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লো আরশিয়াদের বাড়ির উদ্দেশ্য।
সময়ে অতিবাহিত হলো। সেই আনন্দের মুহূর্ত আসলো।কাজি বিয়ে পড়ানোর শেষে মেয়ে ছেলে একসাথে বসানো হলো। অন্যান্য অনুষ্ঠানে একসাথে বসে কবুল বলা হলেও অনেক জায়গায় দুজনে আলাদা জায়গায় কবুল বলে।
দুজনে পাশাপাশি বসতেই। দুইজনের চোখাচোখি হলো।
এক মুহূর্তে যেন সময় থেমে গেলো। চারপাশের শব্দ হারিয়ে গেলো, শুধু দু’জনার চোখে চোখে নীরব ভাষা।
রিহানের বুক ভরে উঠলো অজানা আনন্দে।
দুজনে একসাথে হাতে হাত রেখতেই সবাই হাততালি আর “মাশাআল্লাহ” ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠলো।
রিহান তাকিয়ে আছে শুধু আরশিয়ার দিকে। মনে মনে বলছে,
“এবার আর কোনো দূরত্ব নেই। তুমি শুধু আমার।”
এদিকে অন্যপাশে রনিত আর অর্থির খুনসুটি থামছেই না।
রনিত বলল,
“দেখলে? আজ থেকে তোর বান্ধবী আমার ভাবি। এবার তোমার পালা কবে?”
অর্থি মুখ লাল করে বলল,
“আপনি বরযাত্রীর দায়িত্ব পালন না করে আমার বিয়ে-বিয়ে করে ঘ্যানঘ্যান করছেন কেন?”
রনিত হেসে উঠলো।
“কারণ আমার মনেও বিয়ে-বিয়ে ভাব জেগেছে।”
অর্থি পাত্তা না দিয়ে আরশিয়ার পাশে গেলো।এখন সবাই ছবি তুলবে এজন্য ওকে ডাকলো।
অবশেষে আসলো বিদায় বেলা।এই মুহূর্তটা মেয়েদের জন্য কষ্টকর। আরশিয়ার কান্নার বাঁধ ভাঙলো।আশরাফ চৌধুরী মেয়েকে শান্তনা দিলে স্ত্রী কে থামতে বলছেন। অথচ তার চোখেও জল কিন্তু প্রকাশ করতে পারছে না।
তিনি কাঁদলে মেয়ে আর কাঁদবে ভেবেই।রিহান একহাতে শক্ত করে ধরে আছে তার হাত।আরশিয়াকে নিয়ে গাড়িতে উঠলো সে। মুহূর্তে গাড়ি ছুটলো পিচঢালা রাস্তায়। গন্তব্য নতুন বাড়ি,নতুন সম্পর্কে।
সারাদিনের ক্লান্তি, হৈচৈ আর অতিথিদের ভিড় শেষে রাত যখন গভীর হলো, তখনো চারপাশে মানুষের আনাগোনা লেগেই থাকলো। আরশিয়া বসে আছে রিহানের ঘরে।
ঘরটা ফুল দিয়ে সাজানো। বিছানায় লাল গোলাপ ছড়ানো, চারদিকে সুগন্ধিফুল,মোমবাতি জ্বলছে।
কাচের জানালা দিয়ে চাঁদের আলো ঢুকছে ধীরে ধীরে।
আরশিয়া লাল শাড়িতে মাথা নিচু করে বসে আছে বিছানার একপাশে।
বুক কাঁপছে এক অচেনা অস্থিরতা ছড়িয়ে আছে শরীর-মন জুড়ে।
হঠাৎ দরজার কড়ায় শব্দ হলো।
বন্ধুরা মজা করতে করতে বাইরে থেকে বলল,
“আচ্ছা আচ্ছা, বর-কে ঢুকতে দিচ্ছি, কিন্তু কাল সকালে আমাদেরকে খাওয়ানো চাই।”
হাসির রোল উঠলো বাইরে।
আরশিয়ার বুঝতে পারলো তার আগমন হবে।
তখনই দরজা খুলে রিহান ভেতরে ঢুকলো।
সাদা শেরওয়ানি আর হাসি মিশ্রিত চাহনিতে যেন নতুন আলোর আভা।
সে আস্তে দরজা বন্ধ করে কাছে এলো।
আরশিয়ার বুকের ধুকপুকানি আরও বেড়ে গেলো।
সে নিচে তাকিয়ে রইলো, হাতের চুড়ি মচমচ শব্দ করলো অজান্তেই।
রিহান ধীরে বসলো তার পাশে।
মুহূর্তের জন্য কিছু বললো না।
তারপর মৃদু স্বরে বললো,
“আজকের দিনটার জন্য অনেকদিন অপেক্ষা করেছি। অবশেষে তোমাকে আমার করে পেয়েছি।তুমি আমার প্রথম পূর্ণতা।
আরশিয়া মুখ তুলে তাকালো। মুগ্ধতা সরিয়ে বলল,
“প্রথম পূর্ণতা মানে?দ্বিতীয় আবার কেউ হবে নাকি?
রিহান হেসে গড়াগড়ি খেলো যেন।আরশিয়াকে রাগাতে চেয়েও রাগালো না বলল,
“দ্বিতীয় পূর্নতা হবে আমাদের সন্তান বুঝছো?
আরশিয়া লজ্জা পেলো। মাথা নিচু করে রইলো। রিহান ধীরে হাত হাত দুটো হাতের মুঠোয় নিয়ে রাখলো বুকের পাশে।
আরশিয়া কেঁপে উঠলো স্পর্শে। ঠোঁটে লাজুক হাসি খেলে গেলো।
রিহান তার ওড়নার আড়াল সরিয়ে কপালে আস্তে একটা চুমু দিলো।
“এটাই আমার প্রতিজ্ঞা, কখনো তোমাকে কাঁদতে দেবো না।”
আরশিয়া চোখ বন্ধ করে মুহূর্তটাকে মনে গেঁথে রাখলো।
বাইরে হয়তো এখনো উৎসবের শেষ আলো ঝলমল করছে, কিন্তু এই ঘরে শুরু হলো তাদের দু’জনের নতুন জীবনের অধ্যায়।লাজুকতা, ভালোবাসা আর চিরকালের বন্ধনে বাঁধা।
চলবে……….?