আমার ভূমিকা পর্ব-০১

0
23

#সূচনা_পর্ব
#আমার_ভূমিকা
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

বিয়ে করে সেনাবহিনীর মেজরকে (বউকে) চুমু খাওয়ার কারণে ইমতিয়াজের গালে থাপ্পড় পড়লো। থাপ্পড়টা দিয়েছে ওর সদ্য বিবাহিত বউ ভূমিকা রহমান। যে একদিন আগেও তার প্রেমিকা ছিল।

‘ তুমি আমায় মারতে পারলে ভূমি? ’

‘ বেশ করেছি, কখনো চুমু দিতে চেষ্টাও করো না। ’

ইমতিয়াজ ভূমিকার ভস্ম করার দৃষ্টিতে পড়ে ঢুক গিললো। মুখ ফস্কে বলে ফেললো,

‘ চুমৃ ছাড়া বাকি সব করতে পারবো? ’

ভূমিকা এবার ভয়ানক রেগে গেলো। ইমতিয়াজ কি বলেছে বুঝতে পেরে জিহ্বাতে কামড় দিয়ে হাসতে চেষ্টা করে বলল,

’ আমি তো… ’

ওর কথা শেষ করতে দেয়নি ভূমিকা। সদ্য বিবাহিত বউয়ের হাতে মার খেয়ে ইমতিয়াজ বিয়ে করার শিক্ষা পেয়ে গেলো। এলোমেলো ছেঁড়া শেরওয়ানি খুলে ছলছল চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘ তুমি এমন করছো কেন? ’

ভূমিকা আয়েশ করে খাটে বসলো। তারপর কুটিল হেসে বলল,

‘ কি ভেবেছিলে? তুমি অন্য মেয়ের সাথে টাংকি মারবে আর আমি জানতে পারবো না? ’

ইমতিয়াজ চোখ বড়বড় করে ফেললো,

‘ আসতাগফিরুল্লাহ্! ’

‘ তুমি যতোটা সহজ সরল দেখতে ততোটাও নও ইমতিয়াজ। ভালো সাজার নাটক করবে না আমার সাথে। ’

ইমতিয়াজ কষ্ট পেলো মনে,

‘ আমি নাটক করছি ভূমিকা? তুমি আমাকে বলবে তো কি করেছি। আমি তো জানি না আমি কি করেছি। বলো কি করেছি? ’

ভূমিকার গলার স্বর নরম হয়ে এলো,

‘ রাইসা কে ইমতিয়াজ? ’

ইমতিয়াজ অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকালো। ভূমিকা হাসলো,

‘ চমকে গেলে বুঝি? ’

‘ এক্সপ্লেইন করার সুযোগ দাও ভূমি, তুমি যা ভাবছো সব মিথ্যা। ’

ভূমিকা ও ভাবে বসেই ধীরে ধীরে সমস্ত গহনা খুললো। তারপর ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে নিজের লাগেজ খুলে ডায়েরি বের করে টেবিলে বসলো। ইমতিয়াজ তখনো মেঝেতে বসে। ওর কোমল দৃষ্টি ভূমিকাতে। ভূমিকা গম্ভীর গলায় বলল,

‘ ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ো, তোমার সব কথা আগামীকাল শুনবো। আজকে আমি ক্লান্ত। ’

ইমতিয়াজ উঠে এসে দাঁড়ালো ওর পাশে। ভূমিকা চোখ তুলে তাকাতেই কপালে সেকেন্ডের মধ্যে চুমু দিয়ে একটু সরে গেলো।

‘ তুমি কি রাগ করলে ভূমিকা? ’

‘ না, ঘুমিয়ে পড়ো। ’

‘ তুমি আমায় অবিশ্বাস করো? ’

‘ করলে তো বিয়ে করতাম না সব জেনেও। ’

এই একটা উত্তর শুনেই ইমতিয়াজের মন শান্ত হয়ে গেলো। শরীরের ব্যথা হালকা মনে হলো। ভূমিকার গায়ে অনেক শক্তি, সেনাবাহিনীর একজন মেজর হওয়ার কারণে চেহারায় একটু কাটকাট ভাব চলে এলেও ইমতিয়াজের চোখে ভূমিকা আজও সেই সদ্য হওয়া প্রেমিকার মতো সুন্দর। সেটা ভূমিকা জানে, আর জানে বলেই ও ফ্রেশ হয়ে এসে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লো নিশ্চিন্তে। ভূমিকা লাইট অফ করে টেবিল লেম্প অন করে ডায়েরি ও কলম নিয়ে বসলো। লিখতে শুরু করলো তোমাদের জানানোর জন্য নিজের কাহিনি, ইমতিয়াজের সাথে দেখা হওয়ার কাহিনি। ওদের প্রেম কাহিনি। ভূমিকার ভালো সন্তান হওয়ার কাহিনি।

★ প্রেমের শুরু –

‘ আমি ভূমিকা রহমান। আমি সবসময়ই খুবই চুজি ছিলাম। যাই চয়েজ করতাম তা-ই সবার ভালো লাগতো। আমি যে জামাটা কিনতাম সেটার প্রশংসা করতে করতে মুখে ফেনা তুলে ফেলতো আমার কাজিন মহল। মা বাবা আমাকে কখনো তেমন শাষণে রাখতেন না। কারণ তারা আমার উপর বিশ্বাস করতেন। তাদের বড়ো কন্যা ভূমিকা রাহমান হলো বুদ্ধিমান নারী। তার উপর যার সবসময়ই চয়েজ এতো ভালো হয় সে কি কোনো ভুল করতে পারে? সবার বিশ্বাস অর্জন করেছিলাম নিজের বুদ্ধি ও বুঝদার স্বভাব দিয়ে। আমার সিদ্ধান্ত সবসময়ই মা বাবার পছন্দ হতো। তাই আজ পর্যন্ত মা বাবার সাথে কোনো বিষয়ে তর্কাতর্কি হয়নি। এক কথায় আমি মা বাবার বাধ্য এবং ভালো মেয়ে। প্রতিবেশীসহ পাশের বাড়ির আন্টির মুখেও আমার সুনাম। পাশের বাড়ির আন্টিরা তাদের মেয়েদের সবসময়ই খোঁটা দিতেন ভূমিকার মতো হও। দেখেছ কেমন বুদ্ধিমান মেয়ে? ফাস্ট ডিভিশনে থাকে সবসময়। আমি সবার কথা দুই কান দিয়ে শুনতাম। সত্যি কথা বলতে কেউ সামনাসামনি আমার প্রশংসা করলে আমি খুবই লজ্জা পেতাম। এইচএসসি পরীক্ষার পর এডমিশন শুরু হলো আমার। এডমিশন পরীক্ষা দিয়ে চান্স পেলাম সিলেটের একটি ভার্সিটিতে। ঢাবিতে বা মিলিটারি সব ভার্সিটিতে আমি ট্রাই করিনি কারণ আমি এডমিশনের সময় মারাত্মক অসুস্থ ছিলাম। তবুও বাবা আবেদন করেছিলেন, কিন্তু পরীক্ষার দিনই হসপিটালে এডমিট ছিলাম। সব হাতছাড়া হলেও আমার পরিবার কোনো দুঃখ প্রকাশ করলেন না। বলা বাহুল্য আমার মা বাবা কখনো কিছু আমার উপর চাপিয়ে দেন না। গুচ্ছের পরীক্ষা দিয়ে সিলেটে চান্স পেলাম আইন বিভাগে। মা বাবা অনেক খুশি হলেন। ব্যাগপত্র গুছিয়ে সিলেটের মাটিতে পা রাখলাম। সিলেটের সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন আমার সবে দুইদিন হয়েছে। গোছানো আমি’র চোখ পড়ে যায় এক অগোছালো ছেলের উপর। সহজসরল সাদাসিধা ছেলেটির চুলে সবসময়ই ঝুপঝুপ করে তেল দিয়ে কপালের সোজাসুজি বরাবর সিঁথি করা থাকতো। স্মার্টদের যুগে এমন সাদাসিধা সাজগোজের ছেলে অনেকেরই নজরে পড়ে যায়। অনেকে হাসাহাসি করে আবার অনেকে মজা নেয়। বলতে হবে ছেলেটির মুখে মায়া আছে। আমি আগবাড়িয়ে ছেলেটির সঙ্গে পরিচিত হতে চাইলাম। কিন্তু ছেলেটি আমাকে তেমন পাত্তা দিলো না। আমি যখন প্রশ্ন করলাম, ‘ তোমার নাম কি? ’

তখন সে মুখ নিচু করে বলেছিল, ‘ শেখ ইমতিয়াজ আলী। ’

কেউ নাম জিজ্ঞেস করলে যে বিপরীতে তাকেও কিছু জিজ্ঞেস করতে হয় তা বোধহয় সে-ই সাধাসিধা ছেলেটি জানেনা। জানলেও বলতে দ্বিধাবোধ করছিলো হয়তো। নিজের নামটি বলেই ইমতিয়াজ আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। আমি বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম তখন। আজকের যুগে এমন ভদ্রলোক আছে?

ইমতিয়াজের শারিরীক বর্ণনা দেই। দেখতে আহামরি কেউ না। শ্যামবর্ণ চামড়ার গম্ভীর মুখশ্রীর এক সহজ-সরল যুবক। শ্যামবর্ণের মানুষের মুখে এক ধরনের মায়া থাকে। ইমতিয়াজের সহজ-সরল গম্ভীর মুখশ্রীতেও অসম্ভব মায়া রয়েছে। যা সহজে কারো চোখে পড়েনা। কিন্তু একবার কারো চোখে পড়ে গেলে নিশ্চিত ঘুম হারাম হবে। আমার চোখে ইমতিয়াজের সেই অসম্ভব সুন্দর মায়া পড়ে যায়। আমার ঘুম হারাম হয়ে যায়। সবসময়ের গুছানো আমিটা কেমন অগোছালো হয়ে গেলাম। প্রথম সেমিস্টারের পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হলো। মা বাবা কিছু বলার আগে প্রতিবেশী আত্মীয়স্বজন হায় হায় করে উঠলেন। ভূমিকার রেজাল্ট এতো খারাপ! বাবা জরুরি ভিত্তিতে ঢাকায় যেতে বললেন। আমি রাতের ট্রেনে ঢাকায় রওনা হলাম। বাবা মা মাথায় হাত ভুলিয়ে আমার সমস্যার কারণ জানতে চাইলেন। আমি কিছু বললাম না। বাবাকে কথা দিলাম পরেরবার ভালো রেজাল্ট অবশ্যই করবো। ফিরে এলাম সিলেটে। তখন ইমতিয়াজ গ্রাম থেকে মেসে ফিরেছে। আমি সবসময়ের মতোই গার্লস হোস্টেলে। ইমতিয়াজ ও আমি সেম ব্যাচ হলেও সে ছিলো বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং এর স্টুডেন্ট। পড়াশোনা আবারও নিজের মতো চলতে থাকলো। আমি আসা যাওয়ার ফাঁকে ইমতিয়াজকে দেখতে পেলেই কথা বলার চেষ্টা করতাম। কিন্তু ছেলেটি কারো সাথে মিশতো না। এড়িয়ে চলতো সবসময় আমাকে। একদিন সুযোগ বুঝে চেপে ধরলাম।

‘ সমস্যা কি ইমতিয়াজ? ’

ইমতিয়াজ হয়তো আমার এমন আচমকা আক্রমণ আশা করেনি। বেচারা হকচকিয়ে গিয়ে নিজের শার্টের কলার ঠিক করলো। শুধালো, ‘ কিসের সমস্যা আপু? ’

আমার তখন মেজাজ তুঙ্গে। শেষ পর্যন্ত আপু ডাকলো! হিসহিসিয়ে বললাম, ‘ আমি তোমার আপু হইনা গাধা। তোমার সেম ইয়ার ব্যাচ। নাম ধরে ডাকবে। ’

সেই থেকে টুকটাক কথা হতে শুরু হলো।ইমতিয়াজ আগের মতো আমাকে এড়িয়ে যায় না আর। একসময় আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়। আজ আমরা একে অপরের বেস্টফ্রেন্ড। এইতো আমি ঘাসে বসে আছি, ইমতিয়াজ ক্লাস শেষ করে এগিয়ে আসছে আমার দিকে।

‘ কিরে ভোটকি বসে আছিস কেন? ’

ইমতিয়াজ এখন আমায় তুই করেই বলে সাথে অসংখ্য নাম। যার আদি অন্ত কি আমি নিজেও মাঝে মধ্যে বুঝিনা। হয়তো গ্রামের ছেলে বলে ও অনেক কিছুই জানে যা আমি শুনিনি বা বুঝতে পারবো না। ইমতিয়াজ আমার পাশে বসলো। কাঁধে টুকা দিয়ে বললো, ‘ কি হইছে তোর? ’

আমি আমার দীর্ঘ ঘুর থেকে বের হয়ে আসলাম। ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছু সেকেন্ড। আগের ইমতিয়াজ আর আমার সামনে দাড়ানো ইমতিয়াজের মধ্যে কিঞ্চিৎ পার্থক্য আছে। এখন ইমতিয়াজ চুলে তেল দিয়ে আসেনা। আমার বদৌলতে সে তেল ছেড়ে জেল ইউজ করে এখন। একটু স্মার্ট ভাব এসেছে। কিন্তু এখনো মাঝে মধ্যে আগের মতো অগোছালো দেখা যায়। তখন আমার ভালোই লাগে, এই অগোছালো মানুষটিকে দেখেই তো আমি পাগল হয়েছিলাম। ইমতিয়াজের বড়োসড়ো ধাক্কায় আমি আবারও ভাবনার জগৎ থেকে বের হলাম। ইমতিয়াজ রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি হেসে বললাম, ‘ কি হইছে দোস্ত? ’

ইমতিয়াজ বিরক্তি নিয়ে বললো, ‘ এতোক্ষণ কোন জগতে ছিলি ভূমির বাচ্চা? কোন বেডার কথা ভাবতাছিলি? ’

আমি হেসে বললাম, ‘ যে বেডার কথা ভাবলে শান্তি লাগে। দিলে যার জন্য টান লাগে তার কথা ভাবতাছিলাম দোস্ত। কি যে টান দোস্ত। ’

ইমতিয়াজ কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে হেসে ফেললো। কি চমৎকার সেই হাসি। চকচকে সাদা দাঁত বের হয় তখন। অসম্ভব সুন্দর লাগে দেখতে। ইমতিয়াজ হাসি থামিয়ে বললো, ‘ মশকরা করো মিয়া? ’

আমি বিরক্তির বাণ করলাম সামান্য। বললাম, ‘ মিয়া কি আবার ইমতিয়াজ আলী? আমি কি পুরুষ? ’

ইমতিয়াজ ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘ ও স্যরি আপনে তো মহিলা মানুষ। খালা নাকি চাচি ডাকমু? ’

আমি কিঞ্চিৎ রেগে গিয়ে ঘুষি বসালাম ইমতিয়াজের বাহুতে। সহজ-সরল ইমতিয়াজ যে বন্ধুদের সাথে একদম অন্যরকম সেটা ওর সাথে বন্ধুত্ব না করতে পারলে বুঝতে পারতাম না হয়তো।

ইমতিয়াজকে সাথে নিয়ে ভার্সিটি থেকে বের হলাম। ইমতিয়াজকে আজও মনের কথা বলা হয়নি। সাহস এসে আবার চলে যায়। ইমতিয়াজ যদি আমাকে মেনে না নেয়? তখন যদি বন্ধুত্বটাও ভেঙে দেয় তাহলে তো আমআঁটি সব যাবে। সেজন্য নিজেকে সামলিয়ে রাখি। চলুক না এভাবে। যেমন চলছে চলতে থাকুক। একদিন নাহয় হুট করে ভালোবাসার আলাপ করে নিবো। ইমতিয়াজ মানা করলেও শুনবো না। আমার ভাবনার মধ্যে কানে এলো ইমতিয়াজের বিরক্তিকর বাক্য,

‘ সবসময়ই কি বাল-চাল ভাবোস? মন কই থাকে তোর? এখনই তো এক্সিডেন্ট করতি। ওই শালী কথা কস না কেন? মন কই তোর? ’

আমি ভাবনার জগৎ থেকে বের হয়ে ইমতিয়াজের হাত জড়িয়ে ধরলাম। শুধালাম, ‘ তুই এভাবে আগলে নিস সবসময় তাহলে এক্সিডেন্ট হবেনা। ’

ইমতিয়াজ মৃদু রাগ দেখিয়ে বললো, ‘ আমি কি সবসময় এভাবে তোকে আগলে রাখবো নাকি? তোর জামাই হলে তো আমি বাদ পড়ে যাবো দোস্ত। তাই যতোদিন তোর জামাই না আসে ততোদিন নিজেরে নিজে আগলে রাখ। হুদাই বউদের মতো কথা কস কেন? ’

আমি কিছু বললাম না। মনে মনে হেসে বিরবির করলাম,

‘ আমি তো তোর বউই হবে রে ইমতিয়াজ। শেখ ইমতিয়াজ আলীর বউ ভূমিকা রহমান। সুন্দর না? ’

(চলবে)