#আমার_ভূমিকা
#পর্ব-০৩
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
সকালের নরম মিঠে রোদ এসে পড়েছে মেঝেতে। খোলা জানালা ভেদ করে আসা রোদ চোখেমুখে পড়তেই ইমতিয়াজ চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো। চোখ খুলে পাশে শুয়ে থাকা ভূমিকার দিকে তাকিয়ে হাসলো। ভূমিকা জানলা লাগায়নি, ইচ্ছে করেই হয়তো লাগায়নি। রোদের আলোয় ভূমিকার মুখটা স্বর্ণের মতো চকচক করছে। দেখতে ভালো লাগছে। মহারানী সারারাত জেগে ডায়েরি লিখেছে, ইমতিয়াজ তাই আর তাকে ডিস্টার্ব করলো না। কিন্তু রাতের ব্যাপারটা মনে হতেই ওর মন খারাপ হয়ে গেলো। রাইসা কি করেছে সে জানে না, ভূমিকা রেগে গেছিল। তার মানে ভুলভাল কিছু নিশ্চয়ই করেছে। ভূমিকা তাকে জিজ্ঞেস করেছিল রাইসা কে? ইমতিয়াজ রাতে বলতে চাইছিল রাইসা কেউ নয় ভূমি। তাকে আমি চিনি না, তোমাকে ভালোবাসার পর আমি এই নামে কাউকে মনে রাখিনি। তারপর জানতে চাইতো রাইসা ঠিক কি বলেছে। কিন্তু সেগুলোর কোনোটারই সুযোগ হয়নি।
দরজার শব্দ হচ্ছে, এবং তখনই ইমতিয়াজের মনে পড়লো তারা সদ্য বিবাহিত দম্পতি। আজ তাদের বৌভাত। দরজা যেভাবে ধাক্কানো হচ্ছে, মনে হচ্ছে না খোলা পর্যন্ত ওরা থামবে না। ইমতিয়াজের কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হতে শুরু করলো লজ্জায়। গ্রামের চেনাপরিচিত ভাবীরাই হবেন হয়তো। ভূমিকা যদি একবার এদের মুখোমুখি হয় তবেই হয়েছে।
ইমতিয়াজের ভাবনার মধ্যে ভূমিকার ঘুম ভেঙে গেলো। হম্বিতম্বি করে উঠে বলল,
‘ এতো সকালে কে দরজা ধাক্কাচ্ছে এভাবে? বাড়িতে কি চোর ডাকাত পড়েছে ইমতিয়াজ? ’
ইমতিয়াজ চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে হাত টেনে ধরলো। ভূমিকা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
‘ কি সমস্যা? দেখতে দাও কে বাহিরে। ’
‘ তুমি ঘুমাও, আমি দেখছি। ’
ভূমিকা ঝাড়া মেরে হাত ছাড়িয়ে নিলো। পড়োনের কুঁচকানো টিশার্ট ঠিক করে দরজা খুলে দিতেই মেঝেতে সাত থেকে আটজন হুমড়ি খেয়ে পড়লো। কারো পড়োনে শাড়ি, কারো পড়োনে থ্রিপিস। হাত ভাজ করে দাড়িয়ে ভূমিকা জিজ্ঞেস করলো,
‘ আপনারা? ’
সবাই ততোক্ষণে উঠে দাড়িয়েছে। ভূমিকাকে দেখে সবাই অবাক হলো। একজন আমতা আমতা করে বলল,
‘ না ভাবি আসলে দেখতে এসেছিলাম তোমরা উঠেছো কি না। তোমাকে তো তৈরি হতে হবে। ’
ইমতিয়াজ হাসি চেপে ভূমিকার পেছনে দাড়িয়ে বলল,
‘ আমি ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে গেলে তোমরা এসো। ’
ভূমিকা তৎক্ষনাৎ জিজ্ঞেস করলো,
‘ ওরা আসবে মানে? ’
‘ ওরা হয়তো তোমাকে সাজতে সাহায্য করতে চায়। তোমাকে অনেক পছন্দ করে। ’
ইমতিয়াজ ওয়াশরুমে চলে যেতেই ভূমিকা ওদের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল,
‘ ঠিক আছে, পাঁচ মিনিট লাগবে ফ্রেশ হতে আমার। ’
সবাই একে অপরের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ালো। ভূমিকা ওদের সহজ করতে বলল,
‘ তোমরা কি আমাকে ভয় পাচ্ছো? আসলে আমি তোমাদের মতো করে ভাবি না, বা তোমাদের মতো মিশুক নই। তোমাদের অনেক কথাই বুঝতে অসুবিধা হয়, আমাকে বুঝিয়ে বলবে কেমন? ’
ওর বলতে দেরি সবার ওকে ঘিরে হাসিঠাট্টা শুরু করতে দেরি হয়নি। ইমতিয়াজ বের হয়ে দেখলো ভূমিকা চোখমুখ শক্ত করে বসে আছে সবার মধ্যে।
‘ তোমরা ওকে কি বলছো? ’
‘ আপনার সেটা জানার দরকার নেই ভাই, এটা আমাদের ও ভাবীর ব্যাপার। ’
ইমতিয়াজ টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বললো,
‘ তোমরা কি একটু বাহিরে যাবে? আমার তোমাদের ভাবীর সাথে দরকার ছিল। ’
ওরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিত করে চলে যেতেই ইমতিয়াজ জাপ্টে ধরলো ভূমিকাকে। কাঁধে মাথা রেখে বলল,
‘ সবার কাছে ভালো হতে গিয়ে যেটা পছন্দ করো না সেটা করার বা সহ্য করার দরকার নেই তো ভূমিকা৷ ’
‘ কেউ শুনলে তোমাকে বউ পাগল বলবে। ’
‘ কিন্তু আমি তো বউ পাগল-ই। ’
‘ তুমি জানতে চাইবে না রাইসা আমাকে কি বলেছিল? ’
ইমতিয়াজ পাঞ্জাবী বের করে পড়ে নিয়ে বলল,
‘ আপাতত নয়, আমাদের মূল্যবান সময় গুলো কারো জন্য নষ্ট করার ইচ্ছে নেই। আমি উঠোনে যাচ্ছি, কোনো দরকার হলে ফোন দিও। ’
ইমতিয়াজ কপালে উষ্ণ স্পর্শ এঁকে দিয়ে বেরিয়ে যেতেই সবাই হুড়মুড় করে ভেতরে এলো। ভূমিকা লজ্জায় অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। সবাই ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে।
‘ তোমরা বসো, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। ’
*
সিলেটের হবিগঞ্জের কুশিয়ারা নদীর পাশের একটি ছোট্ট গ্রামে জন্ম শেখ ইমতিয়াজ আলীর। বাবা একজন কৃষক, মা গৃহিনী। দুই ভাই ও এক বোনকে নিয়েই তাদের পরিবার। ইমতিয়াজ হলো দ্বিতীয়। প্রথম হলেন ইমতিয়াজের বড়ো ভাই শেখ ইমদাদুল আলী। ছোট বোন শেখ ইয়াসমিন আক্তার। বাবা শেখ ইমন আলী। মায়ের নাম আসমাউল হুসনা। নাম গুলো প্রথম যখন শুনেছিল খুবই অবাক হয়েছিল ভূমিকা। গ্রামীন নাম। কিন্তু অদ্ভুত সুন্দর অদ্ভুত মাধুর্য যেনো। নামের মতো মানুষ গুলোর মধ্যেও নিশ্চয়ই এক ধরনের মাধুর্য আছে? ইমতিয়াজের ভাই ইমদাদুল একজন প্রবাসী। সাধারণত ভাইয়ের বিদেশে থেকে পাঠানো টাকাতেই পাকা দালান তৈরি করেছেন ইমতিয়াজের বাবা। ইমতিয়াজের কাছে ভার্সিটি থাকাকালীন ভূমিকা শুনেছিল খুব শীগ্রই ইমদাদুল দেশে আসবে। বিয়ে করে সম্ভবত আর বিদেশে যাবে না। দেশেই যা করার করবে। ইমদাদুল কারিগরি থেকে ডিপ্লোমা শেষ করে বিদেশে পাড়ি দিয়েছিল। ইমতিয়াজের কাছে শুনেছে বড়ো ভাই ইমদাদুল বিদেশে গেছিলেন স্টুডেন্ট ভিসায়। ইন্জিনিয়ারিং এ বিএসসি করার পাশাপাশি কাজেও নেমেছিলেন। তারই বদৌলতে আজ ইমতিয়াজদের পাকা বাড়ি। বড়ো ছেলেদের অনেক কিছু ত্যাগ করতে হয়। পরিবারের বড়ো সন্তানেরা সবসময়ই পরিবারের জন্য অনেক শখ ত্যাগ করেন। ইমতিয়াজের ভাই ইমদাদুল বুয়েটে পড়ার স্বপ্ন নিয়ে বড়ো হলেও ভাগ্য সহায় হয়নি, বাবা বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। ছোট ভাইবোন আছে। সবারই একটা ভবিষ্যত আছে। নিজের শখ ভুলে স্বপ্ন ভুলে ইমতিয়াজের তাই বিদেশ বেছে নিয়েছিলো। বড়ো ভাইয়ের এতো ত্যাগের কারণেই ইমতিয়াজের মতো গ্রামের ছেলের বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার বড়ো হাতিয়ার। ভাই যদি বিদেশ থেকে টাকা না পাঠাতো তাহলে ইমতিয়াজের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যেতো সেই মেট্রিক পাশ করার পর পরই।
ইমদাদুল বিয়ে করেছে আরও বছর তিনেক আগে। ওর বউ এই গ্রামেরই মেয়ে। যে এখন বাকি মেয়ে গুলোর সাথে বসে আছে ভূমিকার সামনে। ওরা সবাই মিলে ভূমিকাকে তৈরি হতে সাহায্য করছে। মেকআপটা ভূমিকা নিজেই করে নিতে পারে। ও যে মেকআপ করতে পছন্দ করে সেটা ওকে প্রথম দেখায় রাগী বা রুক্ষ ভাবা মানুষেরা বিশ্বাসই করবে না। যেমন করেনি সামনে বসা মেয়ে গুলো। ভূমিকা যখন যত্নের সাথে গালে ব্লাশ লাগাচ্ছিল তখন সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছিল। ভূমিকা ওদের চমকে দিয়ে বলল,
‘ আমি মেক-আপ করতে অনেক পছন্দ করি। আমার কাছে সব ভালো ভালো ব্র্যান্ডের মেক-আপ আইটেম আছে যেগুলো ছুঁয়ে দেখাই হয়নি। তোমরা চাইলে সেখান থেকে একটা করে নিতে পারো। নিবে? ’
সবাই একে অপরের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ালো। ভূমিকা ওদের একটা করে ব্র্যান্ডের লিপস্টিক দিয়ে বলল,
‘ পেশাগত ব্যস্ততায় এগুলো ছুয়ে দেখিনি। ট্রাই করে দেখতে পারো, তোমাদের ভালো লাগবে। ’
‘ আপনি যখন দিছেন ভালোই হবে ভাবী। ’
ওরা সবাই চলে গেলো। ইমদাদুলের বউ শাড়ি গুছিয়ে দিতে দিতে বলল,
‘ তুমি ওদের ভালোই বশ করে নিলে দেখছি। যাক নতুন বউ নিয়ে তবে বদনাম করার কেউ রইলো না। ’
ভূমিকা খিলখিল করে হাসলো,
‘ এখনো তো পাড়ার আন্টি গুলো বাকি আছেন ভাবী। বদনাম একটা না একটা হবেই হবে, চিন্তা করো না। আমি ওদের এগুলো আমার পক্ষে থাকার জন্য দেইনি, এমনই দিয়েছি। ’
‘ ভালো করেছো। ’
শাড়ি পড়ানো শেষ হতেই ভূমিকা একজোড়া চুড়ি বের করে দিলো।
‘ এগুলো আপনার জন্য। সবাইকে কিছু না কিছু দিয়েছি, আপনাকে কিছু দেওয়া হয়নি। ’
ইমদাদুলের বউয়ের নাম হাসি। সে নিজের সরল হাসিটা হেসে চুড়িগুলো নিয়ে বলল,
‘ অনেক সুন্দর। ’
দরজায় ঠুকা পড়লো। হাসি দরজা খুলে হেসে চলে যেতেই ইমতিয়াজ ভেতরে এলো। পাঞ্জাবীর হাতা ভাজ করতে করতে এগিয়ে এসে বলল,
‘ কি ব্যাপার, সবাই শুধু তোমার প্রশংসা করছেন কেন বউ? আমি তো চিন্তায় ছিলাম না জানি তোমাকে কতো কি সহ্য করতে হয়। ’
ভূমিকা চমৎকার করে হাসলো।
‘ মেজর আমি এমনি এমনি হইনি তেল ওয়ালা। ’
‘ আমি তেল দেইনি মাথায়। ’
ভূমিকা গলা জড়িয়ে ধরলো,
‘ তুমি আমার কাছে সেই তেল ওয়ালা ইমতিয়াজই রয়ে গেছো। বুঝলে ইন্জিনিয়ার মশাই? ’
(চলবে)