#আমার_ভূমিকা
#পর্ব-০৫
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
আমি যখন ইমতিয়াজদের গ্রামে পৌছালাম তখন সন্ধ্যা নেমে গেছে ধরনীতে। অন্ধকার আমি ভয় পেতাম না কখনোই। ছোট থেকেই বাবার সাহসী মেয়ে ছিলাম কি না। আশেপাশের লোকজনকে বলে অবশেষে আমি ইমতিয়াজদের বাড়িতে পৌছেছিলাম। কিন্তু পৌঁছেই মন হাহাকার করে উঠেছিল আমার। বাড়ির অবস্থা থমথমে। আশেপাশের মানুষের বলাবলিতে বুঝতে পেরেছিলাম কিছু হয়েছে। সেই কিছু একটা হলো, ইমতিয়াজের বাবা আর নেই। দুপুরে জানাযা পড়া হয়ে গেছে। বড্ড খারাপ লাগলো আমার, মনে হলো আমার আরও আগে এখানে আসা উচিত ছিল। ইমতিয়াজের পাশে বসা উচিত ছিল। ইমতিয়াজ তাহলে এই জন্যই অমন পাগল বেশে চলে এসেছিল। ইমতিয়াজকে খুঁজবো কি করে ভাবছিলাম আমি। সাথে এটাও ভাবছিলাম, এভাবে আচমকা চলে এসেছি আমি, গ্রামের মানুষ কিভাবে নিবে আমাকে? এমন পরিস্থিতিতে আমি ফিরে যাবে কি না ভাবছিলাম। পরে সিদ্ধান্ত নিলাম, নাহ্ আমাকে ইমতিয়াজের সাথে কথা বলতে হবে। প্রিয় মানুষের দুঃখে পাশে থাকার নামই তো ভালোবাসার একটা অংশ। উঠানে তখনো লোকজন গসিপ করে চলেছে। আমি ইমতিয়াজদের গেইটের সামনে গিয়ে দাড়ালাম। গেইট খুলা বারান্দায় বসে আছেন একজন যুবক। সম্ভবত তিনি ইমতিয়াজের বড়ো ভাই ছিলেন। আমি ইতস্তত করে বললাম,
‘ আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া। ’
ইমদাদুল ভাইয়া বিষন্ন মন নিয়ে বসেছিলেন। আচমকা আমার সালাম শুনে মাথা তুলে তাকালেন। আমাকে চিনতে পারছিলেন না ইমদাদুল ভাইয়া। আমার পড়োনে সেদিন ছিল ফতুয়া ও জিন্স। পায়ে হাই হিল। শহুরে মানুষ বলতে তেমন কোনো আত্মীয় ইমতিয়াজদের ছিলো না।সেজন্য ইমদাদুল ভাই সম্ভবত আমাকে দেখে অবাক হয়েছিলেন। কিংবা ভেবেছিলেন শহুরে আমিটা কে যাকে তিনি চিনেন না বা জানেন না। অথবা আমি নামক মেয়েটি কে?
ইমদাদুল ভাই উত্তরে বলেছিলেন,
‘ ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আপনি কে? ’
‘ আমাকে ইমতিয়াজ চিনে ভাইয়া, আমি ওর বেস্টফ্রেন্ড। ’
ইমদাদুল ভাই অবাক হতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলেন হয়তো। হয়তো ভাবছিলেন, ছোট ভাই শহরে পড়াশোনা করে মেয়ে বন্ধু থাকতেই পারে। তিনি গেইট খুলে দিয়ে আমাকে ভিতরে আসতে বললেন। আমি গেইট দিয়ে প্রবেশ করতেই ইমদাদুল ভাইয়া আমাকে সাথে নিয়ে ভিতরে এলেন। ইমতিয়াজকে ডাকতেই পাশের ঘর থেকে বের হয়ে আসলো অগোছালো উষ্কখুষ্ক চুলের ইমতিয়াজ।
ইমতিয়াজ অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো, ‘ ভূমিকা তুই! ’
আমি হেসে বলেছিলাম,
‘ ভালো সময় পাশে না-ই বা রাখিস, খারাপ সময়ে তো জানাতে পারিস। বন্ধু হিসাবে পাশে থাকতে পারলে আমার মন্দ লাগবে না। তোর ফোন বন্ধ রাত থেকে। আমি টেনশনে পড়ে গেছিলাম। তোর ক্লাসমেইট থেকে জানলাম ভার্সিটিতে আসিসনি। তোর ম্যাসে গেছিলাম, দারোয়ান চাচা বললেন তুই কি অবস্থায় বেরিয়েছিস। আমি তোর গ্রামের ঠিকানা জোগাড় করে চলে এসেছি। মন বলছিল তুই কোনো কষ্টে আছিস। কিন্তু ভাবিনি এরকম কিছু হবে। ’
দীর্ঘ কথা বলে থামলাম আমি, ইচ্ছে করেই বলেছি কাল রাতের কথা। কারণ এই মুহুর্তে যদি বলতাম আমি ইমতিয়াজকে অনেকদিন ধরে ফোনে পাচ্ছি না সেজন্য খুজতে খুজতে চলে এসেছি। তবে এই মানুষ গুলো সম্ভবত সহজে সেটা হজম করতে পারতো না। আমাকে দেখে ইমদাদুল ভাইয়া অবাক হয়ে কিছু ভাবছিলেন। সেটন হলো, তিনি দেখেছিলেন একজন সত্যিকারের ভালো বন্ধুকে। আজকের যুগে ছেলেরাই ছেলেদের ভালো বন্ধু হতে পারেনা। সেখানে মেয়ে হয়ে সামনের মেয়েটি (আমি) বন্ধুত্বের একটি নিদর্শন যেনো হয়ে উঠেছিলাম। আমাকে দেখে বন্ধু জগতের সবার অনেক কিছু শিখা উচিত। এরকম কিছুই আমি আন্দাজ করেছিলাম তার মুখ দেখে। তারপর তিনি সম্ভবত তার মাাে ডাকতে গেলেন।
ইমতিয়াজ হতবিহ্বল হয়ে বললো,
‘বিশ্বাস কর দোস্ত তখন তোকে জানানোর পরিস্থিতিতে ছিলাম না। আমি এমনিতেই খুব ডিস্টার্ব ছিলাম। আচমকা বাড়ি থেকে ফোন আসে। আমি দিশেহারা হয়ে গেছিলাম। কাউকে কিছু জানানোর কথা মাথাতেই ছিলো না। আমি ভাবতেও পারিনি তুই আমার খুঁজ না পেলে বাড়িতে চলে আসবি। আমার খুব প্রাউড ফিল হচ্ছে তোকে বন্ধু হিসাবে পেয়ে। ’
আমি ওর কথা শুনে অনেক হেসেছিলাম। তখন ইমদাদুল ভাইয়া মা ও বোনকে নিয়ে হাজির হয়েছেন। ইমতিয়াজের মা অবাক হয়ে শহুরে সুন্দরী আমাকে দেখলেন। এমন সুন্দর মেয়ে তার ছেলের বন্ধু, সেটাই তিনি ভাবছিলেন হয়তো। ইমতিয়াজের বোন ইয়াসমিন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে মুখে হাত দিয়ে বললো,
‘ ছোট ভাইয়ার বান্ধবী তো মেলা সুন্দর আম্মা! ’
তোমরা হয়তো ভাবছো আমি নিজের অনেক প্রশংসা করছি। কিন্তু আমার ধারণা করা ভাবনাগুলো সত্যি।আমি পরে ওদের জিজ্ঞেস করেছিলাম কে কি ভেবেছিল সেদিন।
ইমতিয়াজ মা বোনের আগমনে কিঞ্চিত চমকে গেছিল। ও ভাবছিলো মা কি তার মেয়ে বান্ধবীকে স্বাভাবিক ভাবে নিবেন? সেটা ভেবেই দিশেহারা হচ্ছিল ইমতিয়াজ। ইমতিয়াজকে অবাক করে দিয়ে ইমতিয়াজের মা হাসিমুখে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।
বললেন, ‘মাগো এমন দিন এসেছো যে তোমাকে বিশেষ ভাবে আমন্ত্রণ জানাতে পারছি না। তবে আমি ভীষণ খুশি হয়েছি। ছেলে আমার একটা ভালো কাজ করেছে তোমার মতো প্রয়োজনে পাশে থাকে এমন বান্ধবী বানিয়ে। ’
আমি হেসে বললাম, ‘আমি তো আপনাদের নিজের মানুষই আন্টি। এতো অস্থির হতে হবেনা। বাড়ির পরিস্থিতি যা তাতে আমি ভেবেছিলাম আপনারা আমাকে কিভাবে গ্রহণ করবেন। আমি আপনাদের ব্যবহারে অনেক স্বস্তি বোধ করছি। আপনাদের আমার অনেক পছন্দ হয়েছে। ’
ইমতিয়াজের মা কেঁদে ফেলে বললেন, ‘ মাগো মানুষটা আচমকা চলে গেলো। কোনো রোগবালাই ছিলো না। আল্লাহর জিনিস আল্লাহ নিয়ে গেছেন। আমরা তো আর আটকাতে পারব না। তুমি বসো মা। কতোটা জার্নি করে আসছো। ইয়াসমিন যা শরবত নিয়ে আয়। ’
আমি বসে বললাম, ‘ আপনাদের ব্যস্ত হতে হবেনা আন্টি। ’
কিন্তু আমার কথা শুনল না কেউ। যতোটুকু পারা সম্ভব ইমতিয়াজের মা করলেন। আমার ঘুমানোর ব্যবস্থা করা হলো ইয়াসমিনের সাথে। রাতে ঘুমাবার আগে ইমতিয়াজের মুখোমুখি হলাম আমি।
ইমতিয়াজ জিজ্ঞেস করলো, ‘ঠিকানা কার কাছ থেকে জেনেছিলি? ’
আমি বিনা দ্বিধায় বললাম, ‘তোর প্রাক্তন থেকে। ’
ইমতিয়াজ হেসে ফেলে বলেছিল, ‘ প্রাক্তন! সত্যিই তো। রাইসা আমার প্রাক্তন হয়ে গেছে। ’
আমি অনেক অপেক্ষার পর প্রশ্নটা করেই ফেললাম,
‘ সম্পর্ক ভেঙেছে কেন? ’
আমার প্রশ্নে ইমতিয়াজের হৃদয় দগ্ধ হতে লাগলো। মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
‘ তার কাবিন হয়ে গেছে অন্য কারো সাথে। ’
‘ তোর সাথে সম্পর্ক থাকাকালীন অন্য কারো সাথে কিভাবে? ’
ইমতিয়াজ বিষন্ন হয়ে বললো,
‘ আমি ঠিক জানিনা। তবে সে বলেছিল, আচমকা নাকি তাকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসে কাজি ডেকে বিয়ে করিয়ে রেখে গেছে। পরিস্থিতি এমন ছিল যে সে মা বাবার বিরুদ্ধে যেতে পারেনি। তার স্বামী একজন উকিল। ভালোই পরিবার, এরকম পরিবার পাত্র পেলে কোন মেয়েই বা চাইবে আমার মতো ছেলের হয়ে থাকতে? যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। সে যদি আমাকে দয়া করতো তাহলে আমি সেটা মেনে নিতে পারতাম না ভূমিকা। ’
আমি জিজ্ঞেস করলাম,
‘ এখন মেনে নিতে পারছিস? ’
ইমতিয়াজ উত্তরে বলল,
‘ পারছি। সে আমাকে দয়া করেনি সেজন্য আমি তার কাছে চিরকৃতজ্ঞ। ’
আমি চরম মন খারাপ নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম,
‘ কেউ যদি তোকে ভালোবাসে সেটা তোর কাছে দয়া মনে হবে ইমু? ’
‘ নাহ্, সেটা দয়া হবেনা। কিন্তু আমি আমার থেকে বড়ো কোনো পর্যায়ের কাউকে কখনো জীবনে জড়াবো না। নাহলে দেখা যাবে সে বড়ো পর্যায়ের হওয়ার কারণে আমার পরিচয় দিতে ইতস্তত করবে। ’
আমার চরম মন আরও চরম হলো। বললাম,
‘ যে সত্যিকারের ভালোবাসবে তার কাছে সবকিছুর উর্ধ্বে তুই থাকবি ইমতিয়াজ। সে তোর পরিচয় দিতে কখনো লজ্জিত হবেনা। ’
‘ আজকের যুগে এমন পাবলিক পাওয়া কঠিন। সেটা যদি হয় আমার জন্য তাহলে তো কখনোই পাবো না। আর যাই হোক আমার মতো অগোছালো ছেলেকে কেউ গ্রহণ করবে না। মেয়েরা অগোছালো ছেলের সাথে প্রেম করতে পারে কিন্তু জীবনসঙ্গী বানাতে পারেনা। শুনিস নি? ’
আমি হেসে বলেছিলাম,
‘ তুই প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়ে এসব বলছিস ইমতিয়াজ। তোর বা আমার আশেপাশে এমন মানুষ দেখবি বা দেখেছিস যারা সত্যিকারের ভালোবেসে অগোছালো ছেলেকেই বিয়ে করেছে। আমার মনে হয় আমার থেকে তুই বেশি দেখেছিস। ’
(চলবে)