#আমার_ভূমিকা
#পর্ব-০৬
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
ফজরের আজান কানে যেতেই ইমতিয়াজের ঘুম ভেঙে গেলো। হাত দিয়ে পাশ হাতড়ে ও ভূমিকাকে না পেয়ে চট করে উঠে বসলো। দেখলো চেয়ারে বসে টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে ভূমিকা৷ ইমতিয়াজ তৎক্ষনাৎ ওকে নিয়ে এলো বিছানায়৷ মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো৷
তারপর ডায়েরি ও কলম হাতে নিজেই বসে পড়লো টেবিলে। লিখতে শুরু করলো নিজের পক্ষ থেকে কিছু। যেটা ও ভূমিকাকে বলেছে, তোমাদেরও বলছে।
আমি শেখ ইমতিয়াজ আলী, ভূমিকা রহমান আমার স্ত্রী। আজ সে আমার বিছানা, আমার রুম, আমার মন সবকিছু জুড়ে রাজত্ব করে। আমি জানি ভূমিকা কি লিখছে বা কি শুনচ্ছে তোমাদের। ভূমিকার থেকেই নাহয় তোমরা বাকিটুকু শুনে নিও। আমি শুধু ভূমিকার উদ্দেশ্যে কিছু লিখবো, তোমাদের সাক্ষী রেখে৷
ভূমি, আমার উজ্জ্বল নক্ষত্র! আমি তোমাকে আকাশের মতো ভালোবাসি। এমন ভালো আমি কাউকে বাসিনি কখনো। তোমাকে ভালোবাসার পর আমি যেন সঠিক ভালোবাসার মানে বুঝেছিলাম। বুঝে অবাক হয়েছিলাম, আরে এতোদিন তবে কি আমি সত্যিকারের কাউকে ভালোবাসিনি? আমার ভাবনাচিন্তা চলতো এ বিষয়ে। তুমি জানো, আমিও জানি আমার প্রাক্তন আছে। এখন আমি যদি তোমাকে বলি ভূমি আমি তোমাকেই প্রথম ভালোবেসেছি, তবে কি তুমি বিশ্বাস করে নিতে? আমিও বিশ্বাস করতে পারিনি। আমারও মনে হয়েছিল হয়তো এসব অযথা ভাবনা। কিন্তু তোমাকে ভালোবাসার পর আমি যখন একবার রাইসার সাথে হঠাৎ দেখা হওয়ার পর কথা বললাম, তখন ও কি সহজেই আমাকে দেখে হেসে বলে দিলো ‘ অবশেষে তুমি যাকে ভালোবাসো, তার সাথেই আছো তবে। ’
রাইসার কথা শুনে আমি অবাক হয়ে ছিলাম। সে আমাকে কি বললো জানো? সে আমাকে আরও বললো, আমি নাকি তার সাথে সম্পর্ক থাকা অবস্থায় তোমাকেই ভালোবাসতাম৷ আমি চুপ করে নিজের সেই অযথা ভাবনাটা আবারও ভাবছিলাম। রাইসা যাওয়ার পর কিছুক্ষণ বসে থাকার পর আমি বুঝলাম অন্য কারো সাথে রিলেশনে থাকলেও আমি এ জীবনে শুধু তোমাকেই চেয়েছিলাম৷ কি অদ্ভুত তাই না? তোমাকে এ কথাগুলো কখনো বলিনি, পাছে তুমি আমাকে বকা দাও৷ হয়তো ভাবতে আমি তোমার সাথে রিলেশনে আছি বলে নিজের পুরনো সম্পর্ক নিয়ে বাহানা দিচ্ছি।
একবার কি হলো জানো? একবার আমি আর রাইসা একটা রেস্টুরেন্টে খেতে গেলাম৷ বড়োসড়ো কোনো রেস্টুরেন্ট নয়, যেখানে শুধু ডাল ভাত ও মাছের আইটেম পাওয়া যায় সেখানে। সেখানে বসেই আমার প্রথমেই তোমার কথা মনে পড়ে গেলো রাইসাকে নাক খুচকাতে দেখে। ভাবলাম, তুমি যদি ওর জায়গায় হতে তবে হয়তো ভেতরেই আসতে চাইতে না। না তুমি ভেবো না আমি তোমাকে ছোট করছি বা তুলনা করছি। আমি সেদিন বন্ধু তোমার কথা ভেবে অনেক হেসেছিলাম মনে মনে। তারপর সেটা রাইসাকেও বলেছিলাম। তারপর একদিন ওকে আমি এটাও বলেছি যে, বড়োলোকের দুলালি তুমি কিভাবে আমার সাথে টঙ দোকানে বসে চা খেয়েছো৷
তুমি কি আমার অগোছালো কথা গুলো বুঝতে পারছো ভূমি? রাইসার সাথে আমার আরও একদিন দেখা হয়। তখন তুমি তোমার চাকরি নিয়ে বিজি, সবে মাত্র ছুটি শেষ করে ফিরে গিয়েছো। আমরা কফিশপে বসলাম৷ রাইসার সাথে অনেক কথা হলো। সে আমাকে পূর্বের বলা কথাটা ডিটেইলসে বললো। সেগুলো এমন,
‘ আমার সাথে তোমার রিলেশন অথচ অদ্ভুত ভাবে আমাদের কথাবার্তা ভূমিকাতে আটকে থাকতো। ভূমিকা এটা করেছে, ভূমিকা সেটা করেছে সেটা নিয়েই তোমার আমার শুধু কথা হতো। আমার মনে হলো তুমি কি নিজেই বুঝতে পারছো তুমি কি করছো? আমি তোমাকে অনেকদিন খেয়াল করলাম, বুঝলাম তুমি নিজেই নিজের অনুভূতি সম্পর্কে অবগত নও। এই সময় আমি যদি তোমাকে বলতাম, তুমি আমার সাথে রিলেশনে থাকলেও ভালোবাসো ভূমিকাকে কিংবা পছন্দ করো তবে তুমি মানতে না। আমার এসব ভাবনা চিন্তার মধ্যে বাসা থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিলো, আমি সেই সুযোগে তোমাকে ছেড়ে গেলাম। ’
ওর কথা গুলো সত্যি ছিল। আমি জানি না রাইসা তোমাকে কি বলেছে, এরপর ওর সাথে আমার আর কখনো দেখা হয়নি। যাই বলে থাকুক, আমি জানি তুমি আমাকে বিশ্বাস করো। রাইসা ভালো একটি মেয়ে, আমি এখনো আশা করছি যে ও এমন কিছু করেনি যার জন্য ও আমাদের কাছে খারাপ হয়ে যাবে। কিন্তু তবুও যদি ও এমন কিছু করে থাকে তবে তুমি আমাকে সেটা বলে দিও। আমরা একসাথে সেটার মোকাবেলা করবো। নিজের ভেতর পুষে রেখে আমাদের সম্পর্ক জটিল করো না। তোমার ছুটি শেষ হলেই তুমি চলে যাবে, আমাকে থাকতে হবে একলা। কিছু ভালোবাসা দিয়ে যাও ভূমি, যাতে তুমি আসার আগপর্যন্ত আমি সেটা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারি। শরীরের দূরত্ব মনের দূরত্ব নয়।
ইমতিয়াজ ডায়েরিটা বন্ধ করে নামাজের উদ্দেশ্যে চলে গেলো মসজিদে। ভূমিকা তখনই চোখ মেললো। তাড়াতাড়ি করে চেয়ারে বসে পড়ে ফেললো ইমতিয়াজের লেখাগুলো। তারপর আবারও লিখতে শুরু করলো সেখান থেকে, যেখানে ও থেমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
★
ইমতিয়াজের গ্রামের বাড়িতে হুট করে আমার আগমন হয়তো কেউই ভাবতে পারেনি। আমি নিজেও সেটা ভাবিনি। শুধু বারবার মনে হচ্ছিল কে কি মনে করবে? ইমতিয়াজ হুট করে আমাকে দেখে রাগ করবে নাতো? আমার ভাবনাকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়ে ইমদাদুল ভাই যখন সবাইকে ডেকে আনলেন এবং আন্টি আমার সাথে হাসিমুখে কথা বললেন তখনই আমার চিন্তা কমলো। ঘুমানোর আগে ইমতিয়াজের সাথে কিছু কথাও বললাম। রাইসার সাথে ওর রিলেশন আগেই শেষ হয়ে গেছিল। কিন্তু কি ভেবে ও আমাকে আর সেটা জানায়নি। সেটা নিয়ে অবশ্য আমার রাগ বা অভিমান নেই। কিন্তু অভিমান তখন হলো যখন ইমতিয়াজ বললো ও নিজের থেকে বড়ো পরিবারের কাউকে বিয়ে করবে না। আমি সেদিন আবারও মনে মনে আহত হয়েছিলাম। ইচ্ছে করছিল ইমতিয়াজের গালে ঠাস ঠাস করে দুটো দেই। অন্য মেয়ের সাথে ও সব করতে পারবে। রিলেশনেও যেতে পারবে। আমার ব্যাপার এলেই শুধু ইমতিয়াজ বাহানা দেয়। কিংবা আমাদের কোনোদিক থেকেই মিলে না, সেটার জন্যই আমি ওর চোখে পড়িনা। ও আমাকে ভালোবাসার চোখে দেখতে পারে না, ভাবতে পারে না আমিও ওকে পছন্দ করতে পারি। আমি রাগে কাঁপতে কাঁপতে ওকে বললাম,
‘ বড়ঁ পর্যায়ের কাউকে বিয়ে করতে কি অসুবিধা তোর? তোকে মেরে ফেলবে? নাকি তোকে অসম্মান করবে? ’
ইমতিয়াজ হুট করে আমার রাগ দেখে থমথমে গলায় বলল,
‘ তুই এতো রেগে যাচ্ছিস কেন? ’
আমি ওকে ঠেলা দিয়ে বললাম,
‘ তো রাগবো না? বড়ো পর্যায়ের মানুষদের প্রতি যদি এতোই ঘৃণা তবে আমার সাথে বন্ধুত্ব করেছিস কেন? তোর ওই রাইসাও তো মোটামুটি ভালো পরিবারের ছিল৷ ’
‘ সেটার জন্যই তো বললাম বড়ো পর্যায়ের কাউকে জীবনে জড়াবো না। একবারে শিক্ষা হয়ে গেছে দোস্ত৷’
আমি রাগে পারি না ওকে মে*রে ফেলি। কতবড় শয়তান, ছ্যাকা দিলো রাইসা আর ক্ষতি হবে কি না আমার। ইমতিয়াজ জিজ্ঞেস করলো,
‘ তুই এমন করছিস কেন? ’
আমি সেদিন গড়গড় করে বলেছি,
‘ বড়ো পর্যায় আর ছোট পর্যায়ের ফ্যামিলি বলতে কিছু হয়না। হলেও তাতে কিছু যায় আসে না। আমি তোকে পছন্দ করি। তোকে আমাকে সুযোগ দিতে হবে। ’
‘ কিহ্! ’
‘ কানে কম শুনিস? খবরদার যদি এখন বলিস যে আমি বড়োলোক পরিবারের ব্লা ব্লা ব্লা… বড়ো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে তুই মূর্খদের মতো কথা বলবি তো মার খাবি আমার হাতে ইমতিয়াজ। ’
ইমতিয়াজ সেদিন বিস্ময় নিয়ে ঘুমাতে গেলো, আর আমি এতোদিনে নিজের অনুভূতি সম্পর্কে জানাতে পেরে কিছু টা দ্বিধা কিছুটা স্বস্তিতে ঘুমিয়ে ছিলাম ইমতিয়াজদের বাড়িতে।
(চলবে)