আমার ভূমিকা পর্ব-০৭

0
21

#আমার_ভূমিকা
#পর্ব-০৭
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

নামাজ পড়ে সকাল দশটা পর্যন্ত ঘুমালো ভূমিকা। ইমতিয়াজ ওকে ডেকে তুললো দশটার পর। ভূমিকা হাই তুলে উঠে বসতেই ইমতিয়াজ ওর হাতদুটো ধরে বলল,

‘ তুমি কি আমাকে বলবে রাইসা তোমাকে ঠিক কি বলেছিল? আমি ডায়েরিতে লিখেছিলাম, কিন্তু তুমি সেখানেও এ বিষয়ে কিছু লিখোনি। আমার নিজের জন্য নয়, তোমার জন্য চিন্তা হয় ভূমি। সিরিয়াস বিষয় এটা, এবং এটা আমার জানা উচিত। তুমি যতো বড়ো অফিসারই হও না কেন, যতোই নিজের সুরক্ষা নিজে দিতে পারো না কেন আমি তোমার স্বামী। তুমি বুঝদার হলেও আমি তোমার সবকিছু নিয়ে মাথা ঘামাবো। বুঝতে চেষ্টা করবো সবকিছু। বুঝতে পেরেছো? এখন তুমি আমাকে বলবে সবকিছু। বলো! ’

ভূমিকা গালে হাত দিয়ে হাসলো৷ ইমতিয়াজ চোখ রাঙালো,

‘ তোমাকে বলতেই হবে৷ ’

ভূমিকা চোখ বন্ধ করে ওর বুকে মাথা রেখে বলল,

‘ তোমাকে বললে তো গল্পের টুইস্টই শেষ হয়ে যাবে ইমতিয়াজ। পাঠকেরা জেনে যাবে তো৷ ’

‘ জানবে না, তুমি পরে তোমার পাঠকদের জন্য ডায়েরিতে লিখো। ’

‘ ঠিক আছে, এসো কানে কানে বলি। ’

ইমতিয়াজ কান পাতলো। ভূমিকা কানে কানে ফিসফিস করে বলতেই ইমতিয়াজ কিছুক্ষণ ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকিয়ে রইলো। ভূমিকা ওর অবস্থা দেখে খিলখিল করে হাসলো৷

‘ দেখলে তো সিরিয়াস কোনো বিষয় নয়। ’

‘ তুমি পাগল ভূমি৷ ’

’ হুম, নাহলে কি তোমাকে ভালোবাসতাম? ’

ইমতিয়াজ স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে ভূমিকাকে বলল,

‘ তৈরি হও, শ্বশুর বাড়ি যেতে হবে আমাকে। ’

ভূমিকা বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে বলল,

‘ তোমার শ্বশুরবাড়িতে তুমিই যাও। ’

ইমতিয়াজ টেনেহিঁচড়ে কোলে তুলে নিয়ে ওয়াশরুমে নিয়ে গেলো। বাহির থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলল,

‘ একেবারে ফ্রেশ হয়ে বের হবে৷ আমাদের একঘন্টার মধ্যে রওনা দিতে হবে। ’

ভূমিকা মৃদু জোরে চিৎকার করে বলল,

‘ তুমি কি আন-রোমান্টিক ইমতিয়াজ, উচিত ছিল তোমারও ভেতরে থাকা। বেশি পড়াশোনা করে তুমি রোমান্টিকতা খুইয়ে বসে আছো। ’

ইমতিয়াজ তৎক্ষনাৎ দরজার লক খুলে ভেতরে এলো। ভূমিকাকে চোখ মেরে বলল,

‘ আমারও মনে হচ্ছিল কিছু একটা ঠিক হয়নি, তোমার কথা শুনো মনে পড়লো আরে আমি তো ভেতরে না এসে বাহিরে রয়ে গেছি। নাও চলে এসেছি। ’

*

ঢাকা পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। ভূমিকা নিজের রুমে এসেই হাত পা ছড়িয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। ইমতিয়াজ ওর দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো,

‘ করে নাও যতো খুশি অলসতা, ডিউটিতে ফিরলে ডিসিপ্লিনের মধ্যে থাকতে হয় তোমার। ’

ভূমিকা ঠোঁট উল্টে বলল,

‘ বিয়ের পর মনে হচ্ছে আমি আরও অলস হয়ে গেছি৷ তোমাকে শুধু দেখতে ইচ্ছে করে, কেন বলো তো? ’

ইমতিয়াজ পাশে শুয়ে পড়লো। ভূমিকা ওর বুকে থুতনি ঠেকিয়ে রাখলো। ইমতিয়াজ চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বলল,

‘ এরকম করে বললে আমি তো তোমাকে চাকরি করতে দিতে পারবো না ম্যাডাম। দেখা গেলো নিজের চাকরি-বাকরি সব ছেড়ে তোমার কাছে বসে আছি। ’

‘ ইমতিয়াজ একটা কাজ করি চলো। দুজনের মোবাইল বন্ধ করে কয়েকদিনের জন্য নিরুদ্দেশ হয়ে যাই৷ ’

‘ তুমি ক্লান্ত ভূমি, ঘুমাও। ঘুম থেকে উঠার পরও যদি তোমার সিদ্ধান্ত একই হয় তবে আমরা নিরুদ্দেশ হয়ে যাবো৷ কেমন? ’

ভূমিকা সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়লো। ইমতিয়াজ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নিজেও ঘুমিয়ে পড়লো। ওদের ঘুম ভাঙলো রাত বারোটার সময়। তাও দরজা ধাক্কানোর কারণে৷ ভূমিকার কাজিনমহল দরজা ভেঙে ফেলার প্ল্যান করেছে সম্ভবত৷ ভূমিকা উঠে বসে দেখলো ওদের দুজনের মোবাইলেই অনেকগুলো মিসডকল। সবই বাড়িতো উপস্থিত থাকা মানুষগুলোর৷ লজ্জায় ভূমিকা টইটম্বুর হয়ে গেলো। ইশ সবাই এখন কি ভাববে? ইমতিয়াজ তো আরাম করে ঘুমাচ্ছে, সবার সামনে তাকেই যেতে হবে। ভূমিকা দরজা খুলে দিতেই সবকটা হুরমড় করে ভেতরে এলো। ভূমিকা হাসার চেষ্টা করে বলল,

‘ অনেক ক্লান্ত ছিলাম, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তোমরা এতো কল দিলে, বুঝতেই পারিনি। ’

ভূমিকার মেয়ে কাজিন বলল,

‘ হুম, দুলাভাই তো আরাম করে এখনো ঘুমোচ্ছেন দেখছি৷ আমরা ভাবছিলাম তোমরা হয়তো ঘুমের মধ্যেই ইন্তেকাল করে ফেলেছো৷ ’

সবাই যে সত্যিই টেনশনে পড়ে গেছিল ভূমিকা বুঝতে পারলো। সবাইকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসলো সে। চায়ের দীর্ঘ আড্ডার পর ইমতিয়াজ চোখ কচলাতে কচলাতে ড্রয়িংরুমে উপস্থিত হলো। তখন রাত দুইটা বেজে গেছে। সবাই দুলাভাই বলে বলে চিৎকার জোরে দিলো। বেচারা ইমতিয়াজ অবাক হতে হতে ভূমিকার পাশে বসে সামান্য হাসলো। ভূমিকা হাসি আটকিয়ে ইমতিয়াজের কাধে হাত রেখে স্বান্তনা দিলো।

ভূমিকার কাজিনমহলের অত্যাচার থেকে ইমতিয়াজ মুক্তি পেলো রাত তিনটার পর। খেয়ে দেয়ে সবাই ঘুমাতে চলে গেছে৷ ইমতিয়াজ রুমে এসে আবারও ঘুমিয়ে পড়লো। ভূমিকা ব্যাগ থেকে ডায়েরি বের করে লিখতে শুরু করলো ইমতিয়াজকে নিয়ে ওর অনুভূতি।

‘ আজ আমি আর আমাদের অতীত নিয়ে লিখবো না। লিখবো শুধু ভূমির ইমতিয়াজকে নিয়ে, আমার হাসবেন্ড শেখ ইমতিয়াজ আলীকে নিয়ে। ইমতিয়াজ দারুণ একজন পুরুষ, সেটা আমি ওর সাথে সম্পর্কে গিয়ে আরও ভালো ভাবে বুঝতে পেরেছি। এখনকার যুগে যেখানে সবকিছু কমন সেখানে ও আমার হাতটা ধরতেও পারমিশন নিতো। আমি আরও গভীরভাবে ওকে ভালোবেসে ফেলি।

ইমতিয়াজ জানে কিভাবে আমাকে প্রিন্সেসের মতো ট্রিট করতে হয়৷ জানে কিভাবে নিজের স্ত্রীকে তোমাকে রানীর মতো রাখবো না বলেও রানীর মতো রাখতে। আমার ইমতিয়াজ সহজ সরল একজন পুরুষ। ব্যক্তিত্ব খুবই সাধারণ, কিন্তু এই দেশের নারীদের জন্য অসাধারণ। কারণ এ যুগে এসেও এমন ব্যক্তিত্বের পুরুষ বিরল। আমার ভাগ্য কিংবা আমি খুবই চ্যুজি বলেই কি না ইমতিয়াজকে পছন্দ করে ফেলেছিলাম। শুধু মা বাবা বা কাজিনমহলের সুনামের জন্য নয়, ইমতিয়াজকে পেয়ে জিতে গিয়ে আমি বুঝতে পারছি আমি আসলেই অনেক চ্যুজি একটি মেয়ে।

ইমতিয়াজের সাথে রিলেশনের শুরুটা তোমাদের বলে দেই কেমন? সেদিন প্রথম ও আমার জন্য ফুল কিনেছিল সম্ভবত। তারপর এসেছিল আমার ভার্সিটির সামনে। সিলেট টু ঢাকা জার্নি করে ফুল কিনে দাড়িয়ে ছিল, নিশ্চয়ই আমাকে শুধু বন্ধু ভাবে সেজন্য নয়। তাই না? অথচ ও আমাকে ফুল দিয়ে প্রথমেই কি বললো জানো? বললো, ‘ তোর জন্য ফুল কিনতে ইচ্ছে হলো, তাই ঢাকায় এসে ফুল কিনে তোকে দিতে এলাম৷ ’

তোমরা নিশ্চয়ই ভাবছো কি অদ্ভুত! হ্যাঁ ও এমনই, এমনই আমার ইমতিয়াজ। আমি ফুল নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে যখন হেসেছিলাম তখন বেচারা কি লজ্জাটাই না পেয়েছিল৷ মাথা চুলকে বারবার বলছিল,

‘ বন্ধুকে কি বন্ধু হয়ে ফুল দেওয়া যাবে না? আশ্চর্য তুই হাসছিস কেন ভূমি? ’

আমি অনেক হেসেছিলাম, ইমতিয়াজ অনেক লজ্জা পেয়েছিল৷ তারপর যখন নিজের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম কিছু না বলে, ইমতিয়াজ তখন আমার দিকে তাকিয়ে ঢুক গিলছিল বার-বার। হয়তো ভাবছিল বুদ্ধিমতী ভূমির সামনে কোনো বাহানা দিয়েই সত্য লোকানো গেলো না। বেচারা লজ্জা ভুলে আলতো করে আমার হাত ধরেছিল। সেই থেকেই শুরু, আমার ইমতিয়াজ একটু পাল্টেছে সময়ের সাথে সাথে। সেই পাল্টানোটা খুবই স্বাভাবিক। ও আজকাল একটু নির্লজ্জ হয়েছে, অবশ্য পুরুষেরা স্ত্রীর সামনেই তো নির্লজ্জ হয়। ওর নতুন এক রুপ, আমার স্বামী রুপে দেখে আমি আবারও ওর প্রেমে পড়েছিলাম। আমি সবসময়ই বিশ্বাস করি, আমি নিজেকে ছাড়া কাউকে বিশ্বাস করিনা। কিন্তু এতোটুকুও বিশ্বাস করি যে, ইমতিয়াজের মনে আমি ছাড়া আর কেউ কখনো ছিল না। এখনো আমিই আছি। ভবিষ্যতে আমিই থাকবো।

ইমতিয়াজ! আমি জানি তুমি এটা পড়বে। এটা হলো তোমার লেখার পরিবর্তে তোমার জন্য লেখা আমার উত্তর।

(চলবে)