ইচ্ছেঘুড়ি পর্ব-০১

0
23

#ইচ্ছেঘুড়ি (১)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

বিয়ের পর মায়ের হাতে সমস্ত টাকা তুলে দিবো না এই ভয়ে মা আমার বিয়ে দিতে চাইতেন না। সেজন্য যখনই কোন পাড়া-প্রতিবেশী আমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে বাড়িতে আসতো তখন আমার মা বলতো,“আমার বড় মেয়ের একটু সমস্যা আছে। সে বিয়ে করতে পারবে না। তাই আপনারা তার জন্য পাত্রের খোঁজ না নিয়ে এসে বরং আমার ছোট মেয়ের জন্য নিয়ে আসুন।”

মায়ের কথা বুঝতে না পারলে। মা খুব মন খারাপ নিয়ে বলতো,“আমার মেয়ের শারীরিক সমস্যা রয়েছে।”
আমার মায়ের কথার ভাবার্থ বুঝতে পেরে প্রতিবশীরা আমার জন্য পাত্রের খোঁজ নিয়ে আসা বন্ধ করে দেয়। বিষয়টি এই অব্দি থাকলে ঠিক ছিলো। কিন্তু না। বিষয়টি ইতিমধ্যে ছড়িয়ে গিয়েছে। পুরো এলাকায় ছড়িয়ে গিয়েছে আমার সমস্যা রয়েছে। প্রতিবেশীরা এত ভালো মানুষ যে তার নিজ দায়িত্ব একজনের থেকে অন্যজনের কানে এই কথাটি ছড়িয়ে দেয়।

একটা সময় পর যখন আমার কানে এই কথাগুলো আসে তখন আমি পুরো হতভম্ব হয়ে যাই। বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে সরাসরি জিজ্ঞেস করি,“মা এসব কী? তুমি নাকি বলেছো আমার শারীরিক সমস্যা আছে? আমি বিয়ে করতে পারবো না? আমাকে বিয়ে করলে কেউ সুখী হবে না?”

“হ্যাঁ।”
মায়ের স্বাভাবিক কন্ঠ শুনে আমি বিষ্ময়ে থ হয়ে গেলাম। আটাশ বছরের আমার বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে, তাতে মায়ের কোন কিছু যায় তো আসেই না। সেই সঙ্গে সে নিজেই আমার জন্য যাতে কোন পাত্রপক্ষ না আসে তাই আমার নামে মিথ্যা একটি কথা ছড়িয়ে দিলো। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,“এসব সত্যি নয়। তবে সবাইকে কেন মিথ্যা কথা বলেছো?”

“আমি কী করবো বল?
আমি তো মা। আমাকে তো সংসারের সবটা নিয়ে ভাবতে হয়। সবাই এমনভাবে তোর বিয়ের জন্য পিছনে লেগেছে যে আমি না পেরে তাদের বলেছি এই কথা।”
মা কন্ঠ কিছুটা নরম করে কথাটি বলে। একটু থেমে আবারও বলে,“আমাদের পুরো সংসারটা দাঁড়িয়ে আছে তোর উপর। তুই চাকরি করে মাস শেষে যে বেতনটা আমাদের হাতে তুলে দিস, সেটা দিয়ে আমি বহুকষ্টে সংসার চালাই। এই মূহুর্তে তোর বিয়ে হলে আমরা তো পুরো ভেসে যাবো। তার উপর কাজল বড় হচ্ছে, তার বিয়ে দিতে হবে। সেখানে এত টাকা লাগবে। সব মিলিয়ে আমি আমার সংসার, তোদের সবার ভালোর কথা ভেবে এই কাজটি করেছি।”
এই পর্যায়ে মা কাজল অর্থাৎ আমার বোনের কথা বলতে গিয়ে কান্না করে দেয়। তার ভালো জায়গা বিয়ে হবে না। সেই চিন্তায় সে ম রে যাচ্ছে। এক কথায় আকারে ইঙ্গিতে মা বুঝিয়েছে, কাজলের বিয়েটা আগে দিতে চায় সে। তার বিয়ের পর আমার বিয়ের কথা ভাববে। আমি মায়ের চিন্তা বুঝতে পেরে বললাম,“তুমি কাজলের বিয়ে আগে দাও তাতে আমার কোন সমস্যা নেই। কিন্তু তাই বলে এসব মিথ্যা কথা বলবে?”

“না বুঝে বলে ফেলেছি। মাফ করে দে। আমি তাদের কিভাবে থামাবো বুঝতে পারিনি রে। তাই তো বলে ফেলেছি।”
মা আমার কাছে বারবার ক্ষমা চাচ্ছিলো। তাই আমি আর কথা না বাড়িয়ে নিজের ঘরে চলে আসলাম। তবে এখানে আমি চাইলে মাকে বলতে পারতাম, আমার বিয়ে হলেও আমি তাদের দেখবো। আমার এই কথায় যে পাত্র রাজি হবে তাকেই বিয়ে করবো। কিন্তু না। এসব কথা বলে লাভ নাই। কারণ আমি খুব ভালো করে জানি, আমার মা যতই বলুক কাজলের বিয়ের পর আমার বিয়ে দিবে। সে আসলে চায় না আমার বিয়ে দিতে। সে কখনোই আমার বিয়ে নিয়ে ভাববে না।

আমার বাবা, মা বরাবরই আমার বিয়ে নিয়ে ভীষণ উদাসীন। দিনের পর দিন যে আমার বয়স বেড়ে যাচ্ছে। একটা সময় পর বয়সের জন্যই আমার বিয়ে হবে না। সেই কথা বুঝেও তারা কখনো আমার বিয়ে নিয়ে ভাবেনি। আমি ভাবতাম, এটা শুধুমাত্র আমার চাকরির জন্য। বাবার একার চাকরির টাকায় সংসারটা সত্যি চলছে না। সেজন্য আমার টাকাগুলো খুব দরকার। তবে বিয়ে হয়ে গেলে তো শ্বশুড়বাড়ির লোক কখনো পুরো টাকা এখানে খরচ করতে দিবে না। এটা আমার বাবা, মায়ের ধারণা। তাই তারা আমার বিয়ে নিয়ে উদাসীন। কিন্তু যাতে বিয়ের জন্য কোন প্রস্তাব না আসে সেজন্য এভাবে একটি মিথ্যা কথা বলে দিবে মা সেটা আমি কখনোই ভাবেনি। এই মূহুর্তে এটা এত ছড়িয়ে গিয়েছে যে এখন আমার বয়সের সঙ্গে যে এটাও বিয়ের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে তা আমি বেশ বুঝেছি। সেজন্যই মায়ের সঙ্গে কথা বাড়ালাম না। কথা বাড়িয়ে লাভ কী? শুধু শুধু নির্লজ্জ উপাধি পাবো। কিন্তু আমিও তো মানুষ। মেয়ে মানুষ। প্রত্যেক মেয়েরই বিয়ে নিয়ে অনেক স্বপ্ন থাকে। একটি আকাঙ্ক্ষা থাকে। আমার বাবা, মা যে চায় আমার এই স্বপ্ন না থাকুক সেটা আমি বেশ বুঝেছি। সেজন্য কথা বাড়িয়ে সত্যি কোন লাভ নেই। তবে পছন্দের মানুষ থাকলে অবশ্যই কথা বলতাম। তার সঙ্গে ঘর বাধার জন্য লড়াই করতাম৷

আমি এতদিন ভাবতাম, শুধুমাত্র টাকার জন্য আমার বাবা-মা আমাকে বিয়ে দিয়ে হাতছাড়া
করতে চায় না। কিন্তু এটা যে পুরোপুরি সত্যি নয় সেটা আমি আজ রাতে বুঝতে পারলাম। যদিও সত্যিটা জানতে পারিনি। তবে বাবা, মায়ের কথা শুনে বুঝলাম তাদের আমার প্রতি উদাসীন হওয়ার আরও একটি কারণ রয়েছে। আমার মনে যে মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে, আমার নিজের বাবা-মা হয়ে তারা কেন আমার কথা না ভেবে নিজেদের স্বার্থের কথা ভাবে। টাকার জন্য বাবা, মায়ও এমন করতে পারে। কিন্তু এটা যে শুধু টাকার জন্য নয় তার ইঙ্গিত আজ আমি পেলাম।

বাবা রাতে বাসায় ফিরতে মা তাকে বলে,“তোমার মেয়ে আজ জানতে চাচ্ছিলো আমি কেন অন্যদের কাছে তার নামে মিথ্যা বলে বেড়াই।”

”তারপর তুমি কী বললে?”
বাবা খুব শান্ত গলায় কথাটি জানতে চায়। মা খুব ভাব নিয়ে বলে,“প্রথমে অবশ্য ভেবেছিলাম দুই চার কথা শুনিয়ে দিবো। তবে পরে ভাবলাম ওর সঙ্গে এমনভাবে কথা বলা উচিত যাতে ও তেমনভাবে এসব বিষয় নিয়ে রিয়াক্ট না করতে পারে। আমি সেটাই করলাম।”

”ভালো। এবার যত দ্রুত সম্ভব কাজলের বিয়েটা দিয়ে দিতে হবে। আমি কয়েকজনকে বলেছি ভালো পাত্রের খোঁজ দিতে।”
বাবার এই কথায় মা সম্মতি জানিয়ে বলে,“হ্যাঁ পুষ্প হাতের বাহিরে চলে যাবার আগেই কাজলের বিয়েটা দিয়ে দিতে হবে। ও মেয়ের লক্ষণ ভালো না। বয়স বেড়েছে, এখন মাথায় বিয়ের ভূত চাপছে মনে নয়। লাজ শরমের মাথা খেয়ে কোনদিন না বলে বসে আমার বিয়ে দাও। পুষ্পের মুখে বুলি ফোটার আগেই কাজলের বিয়েটা সেড়ে ফেলতে হবে।”

“ওর মুখে বুলি ফুটলেও বা কি। এতগুলো বছর ওর পিছনে এত এত খরচ করে যে পড়ালেখা করে মানুষ করেছি এটাই যথেষ্ট নয়। আমার তো প্রতি মূহুর্তে আফসোস হয় সেদিন ঐ ভুল সিদ্ধান্তটা না নিলে আজ পুষ্পের পিছনে এত টাকা নষ্ট হতো না আমার।”
বাবার শেষ কথাগুলো শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। তবে কিছু বুঝে ওঠার আগেই কাজল সেখানে চলে আসে। আমাকে এখানে দেখে জিজ্ঞেস করে,“আপু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”

“বাবার সাথে কথা ছিলো। তবে ভেতরে মনে হয় বাবা, মা গুরুত্বপূর্ণ কিছু আলোচনা করছে। তাই ভাবছি পরে বলবো।”
এই কথা বলে নিজের ঘরের উদ্দেশ্য পা বাড়ালাম। কাজল বিষয়টি নিয়ে ততটা ভাবে না। সে নিজের কাজে মগ্ন হয়ে যায়। এদিকে ঘরে এসে আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। বাবা এসব কী বললো! আমার প্রতি তারা এত বিরক্ত কেন? নিজের অজান্তেই কী আমি এমন কিছু করে ফেলেছি যার জন্য বাবা, মা আমার উপর বিরক্ত হয়ে গিয়েছে। আমাকে বোঝা মনে করছে। আমার পিছনে ব্যয় করাটাকে তারা তাদের দায়িত্ব না ভেবে বোঝা ভাবছে। কিন্তু আমি কী করেছি?
___
সকালবেলা, অফিসের উদ্দেশ্য বের হচ্ছিলাম। কিন্তু মাথায় রাতের প্রশ্নগুলোই ঘুরছে। তবে কাউকে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস না করে বাহিরে বের হলাম। গলির দিয়ে হেঁটে মেইন রোডের কাছে যাচ্ছিলাম। সেই পথে এক চাচীর সঙ্গে দেখা।সে আমাকে দেখে শান্ত গলায় বললো,“পুষ্প অফিসে যাচ্ছো?”

“হ্যাঁ।”
আমি মিষ্টি হেসে কথাটির জবাব দিলাম। চাচী হাসতে হাসতে আমাকে বলে,“অফিস বন্ধের দিন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করো। আমি এক ভালো হুজুরকে চিনি। যে তোমাকে দেখে তোমার সমস্যার সমাধান দিতে পারবে।”
এই কথা শুনে আমি বিরক্তি নিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেলাম। চাচী পিছনে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে সেই হুজুরের গুনগান গাইতে শুরু করে। তার পানি পড়ায় অনেক জোর। একবার তার থেকে তাবিজ নিলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি বিরক্তি নিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে মেইন রোডের কাছাকাছি চলে আসলাম। একটি রিকশাকে ডাক দিতে। রিকশা এসে আমার সামনে দাঁড়ায়। আমি রিকশায় উঠতে নিবো সেই মূহুর্তে আমার মাথার উপর একটি ঘুড়ি এসে পড়ে। আমি ঘুড়িটি মাথা থেকে হাতে নিয়ে চোখের সামনে ধরতে দেখি সেখানে লেখা,“ইচ্ছেঘুড়ি।”


চলবে,