#ইচ্ছেঘুড়ি (২)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
“এটা আমার ঘুড়ি।”
কথাটি কানে যেতে আমি পাশে ঘুরে তাকালাম। আমার সামনে পাড়ার সবার পরিচিত বাউন্ডুলে ছেলেটি দাঁড়ানো। সবসময় অফিস থেকে ফেরার সময় পাড়ার মোড়ে আড্ডা দিতে দেখি। কখনো বা কারো সঙ্গে তর্কে জড়াতে। আমি ঘুড়িটা দিচ্ছিলাম না দেখে সে আবার বলে,“এটা আমার ঘুড়ি।”
আমি এবার তাকে ভালোভাবে লক্ষ্য করলাম। তার পাশে এসে কয়েকজন বাচ্চা দাঁড়িয়েছে। হাতের ঘুড়ির দিকে একবার তাকিয়ে তার দিকে উপহাসের এক হাসি দিয়ে বললাম,“আজ বড় কাউকে পাননি বলে বাচ্চাদের জ্বালাতন করছেন?”
“জ্বী না।”
এটা বলে ছো মেরে ঘুড়িটা আমার হাত থেকে কেড়ে নিলো।
“আপনি কেমন এবং কী পারেন সেটা সবাই জানে।”
এই কথা বলে আমি কথা না বাড়িয়ে রিকশায় উঠে বসলাম। রিকশাওয়ালাকে রিকশা চালাতে বললে সে রিকশার সামনে এসে দাঁড়ায়। এটা দেখে আমি কিছুটা বিরক্ত হলাম। সে হাসি মুখে বলে,“এই যে বাচ্চারা আমি তোমাদের বিরক্ত করছিলাম?”
”না তো। তুমি তো আমাদের সাথে খেলছিলে। আমরা খুব মজা করছিলাম।”
একটি বাচ্চা ছেলে কথাটি বলে উঠলো। তার সঙ্গে সম্মতি জানায় সবাই। অতঃপর ছেলেটি অর্থাৎ শান্ত রিকশা থেকে সরে দাঁড়িয়ে বলে,“যদিও আমাকে কে কী ভাবলো তাতে আমার যায় আসে না। তবুও মাঝে মাঝে কিছু মানুষকে চোখে আঙুল দিয়ে সত্যি দেখাতে হয়।”
“মামা চলুন। এখানে বসে কারো বাজে কথা শোনার একদম সময় নেই।”
আমার এই কথাটি শুনে শান্ত রিকশার সামনে আবার এসে দাঁড়ায়। বিরক্তি নিয়ে বলে,“পাড়ার কুচুটে কাকি মাদের মতো ব্যবহার করবেন না। আপনি একজন শিক্ষিত মেয়ে, অবশ্যই ঘটনার একটু অংশ দেখে পুরোটা সাজাবেন না। এটা আপনার থেকে আশা করা যায় না। যাই হোক আমি কেমন ছেলে সেটা তো আমি আপনাকে জানাবো না। তবে আপনিও শুনে রাখুন, শোনা কথায় আপনার সম্পর্কেও অনেককিছু জেনেছি। সবাই জানে। তো সেই হিসাবে আমিও নিজের মতো আপনি কেমন মেয়ে সেটা ধরে নিবো।”
শান্ত কোন কথায় ইঙ্গিত করে কথাটি বলেছে বুঝতে পেরে আমি থ মেরে গেলাম। কথা না বাড়িয়ে বললাম,“স্যরি। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
আমার মুখের ভাবভঙ্গি দেখে শান্ত সরে যায়। রিকশা চলতে শুরু করে, সেই সময়ে শান্ত তার ঘুড়িটি আমার হাতে ধরিয়ে দেয়। অতঃপর বলে,“এটা ইচ্ছেঘুড়ি। একটি ইচ্ছে বলে উড়িয়ে দিয়েন। ইচ্ছে পূরণ হয়ে যাবে।”
আমি রিকশাওয়ালা মামাকে একটু দাঁড়াতে বলে ঘুড়িটি শান্তর দিকে এগিয়ে দিলাম। শান্ত গলায় বললাম,“আমি আপনার মতো নই যে এই বয়সে এসে বাচ্চামো করবো। এসব না করে পড়ালেখা শেষ করেছেন, একটি চাকরি করুন। তাতে পরিবার খুশি হবে।”
“চাকরির বাজার ভালো না। তাই পরিবারকে খুশি করতে পারছি না। আর পরিবারকে খুশি করতে পারছি না বলে নিজেকে খুশি রাখবো না। সারাদিন আপনার মতো দুঃখী মুখ নিয়ে ঘুরবো এমন আমি নই। আর হ্যাঁ এটা আমার শখের ঘুড়ি। আপনাকে দিলাম মায়া করে। কারণ এই মূহুর্তে আপনার এটা প্রয়োজন।”
একটু থেমে পরক্ষণে বলে,“একদিন নাহয় বাচ্চামোই করলেন।”
এই কথাটি বলে মিষ্টি এক হাসি দিয়ে শান্ত আমার হাতে ঘুড়ি ধরিয়ে দিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে উল্টো পথে হাঁটা ধরে। আমি অবাক চোখে তার চলে যাওয়া দেখি। এই ছেলেটি নাকি পুরো পাড়ার আতংক। সারাদিন কারো না কারো সঙ্গে মারামারি করে বেড়ানো, বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ দিয়ে তাদের সঙ্গে খেলাধুলা করে। আবার সেই বাচ্চাদের মায়েরা যখন এসব নিয়ে অভিযোগ করতে চায় তখন তাদের সঙ্গে অভদ্রের মতো আচরণ করে বেড়ায়। এসবই নাকি তার নিত্যদিনের কাজ। সেজন্য মেয়েরা এর থেকে দূরে থাকে। যদিও কেউ স্বচোখে তার চরিত্র খারাপ কি-না দেখেনি। তবে এমন বখাটে ছেলেরা ভালো হয় না। সেই ধারণা পোষণ করেই সবাই এর থেকে দূরে থাকি। কিন্তু কই। তার একটি কথাও তো অসম্মানজনক ছিলো না। একটু আগেও যখন আমি তাকে আমার সামনে দেখছিলাম তখন মনেমনে ঠিক করে নিয়েছিলাম, এ যদি কোন বাজে আচরণ করে তবে আমিও তার প্রতিবাদ করবো। মেয়েরা দূর্বল নয় সেটা দেখিয়ে দিবে। অথচ তার একটি ভাষাও বাজে কোন ইঙ্গিত ছিলো না। আমি এসব ভাবনা বাদ দিয়ে অফিসের উদ্দেশ্য এগিয়ে গেলাম। হাতে এখনো ঘুড়িটা। যার উপরে লেখা,“ইচ্ছেঘুড়ি।”
একবার ভাবলাম ফেলে দিবো। পরক্ষণে মনে হলো রেখে দেই। তাই রেখে দিলাম।
___
অফিস শেষে বাসায় ফিরতে মা এবং কাজলের ঝগড়া শুনে দরজার কাছেই থেমে গেলাম। কাজল উচ্চশব্দে বলছে,“সাড়া পাড়া বলে বেরিয়েছো আপার সমস্যা রয়েছে। আবার এখন বাড়িতে পাত্র নিয়ে আসছো আমার জন্য। আপার আগে আমার বিয়ে দেওয়ার কথা তুমি মা হয়ে ভাবছো কিভাবে? আমি বুঝতে পারছি না তোমরা দুজনের সঙ্গে দুইরকম আচরণ কেন করছো? ছোট থেকে দেখে আসছি। যদিও তোমরা আপাকে ভুলবাল বুঝিয়ে সবসময় মানিয়ে নিতে। কিন্তু জামা-কাপড় থেকে শুরু করে খাবারে অব্দি তোমরা ভেদাভেদ করেছো। আর আজ বিয়ের নিয়েও। তোমাদের আপাকে নিয়ে সমস্যাটা কী বলো তো?”
কাজলের এই কথার জবাবে মা রাগান্বিত গলায় বলে,“মুখে খুব খৈ ফুটেছে। আপার জন্য দরদ উতলে উঠছে। এই আমরা কী তোর আপাকে বিয়ে দিতে চাইনি? যখন দিতে চেয়েছি তখন তো বিয়ে করেনি। কেন করেনি? ওর সমস্যা আছে বলেই তো করেনি। এখন আমি সেটা বলছি বলে দোষ হয়ে গেছে।”
“মা!”
কাজল কিছুটা রাগান্বিত গলায় কথাটি বলে। মা এটা শুনে তার গালে একটি থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। তারপর বলে,“যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর। এই তুই ঐ মেয়েটার জন্য আমার মুখে মুখে তর্ক করছিস। এত সাহস তোকে কে দিয়েছে?”
”মা তোমরা যখন আপার বিয়ের কথা ভেবেছো তখন তার বয়স চৌদ্দ বছর ছিলো। সেই সময়ে তার বিয়ের বয়স হয়েছিলো? বিয়ে বুঝতো? তাছাড়া সে পড়ালেখা করতে চেয়েছে। তাই বিয়ে করেনি। তোমরা তো পারলে তখন বিয়ে দিয়েই দিতে যদি না আপা কান্নাকাটি করে, খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে না দিতো। আর এখন এসে বলছো সমস্যা ছিলো বলে বিয়ে করেনি?”
কাজল এই কথাটি বলে মায়ের দিকে অবাক চোখে তাকায়। তারপর বলে,“সত্যি করে বলবে মা তোমাদের এমন আচরণের কারণ কী?”
“তুই বেশি কথা বলছিস কাজল। একদম বাড়াবাড়ি করিস না। চুপচাপ আমার কথামতো পাত্র পক্ষের সামনে বসবি। এত আপা আপা করিস না। এমন করলে পরে দেখা যাবে তোর বিয়েটাই হবে না। তাছাড়া পুষ্পের বিয়ের বয়স কী পার হয়ে যাচ্ছে নাকি? তোর বিয়েটা দিয়ে আমাদের ঋনটা শোধ করে ওর বিয়ে নিয়ে ভাববো।”
”এত ঋন আমাদের? সেই ছোটবেলা থেকে শুনছি ঋন, ঋন আর ঋণ। যখনই আপা বায়না ধরতো কিছুর তখনই এই ঋনের গান শুনিয়ে তোমরা তাকে সেটার জন্য না করতে। সবসময় কম দামি জামা দিতে, আমাকে দামি জামা। অথচ আপা যখন এই বিষয়ে জানতে চাইতো তখন ঋন আর কি সুন্দর একটা বুঝ দিয়ে দিতে। তোমরা পারোও। চার জনের সংসার চালাতে আহামরি কী খরচ যায়? সেই সংসারে তোমরা এত ঋন করে করেছো কী? এখনও আপাকে অভাব অভাব আর অভাবের কথা শোনাও। সংসার চলে না এমন একটা ভান ধরে তাকে দৈনিক ওভার টাইম করাতে বাধ্য করো। এত অভাব আমাদের? নাকি এসব দেখিয়ে আপার সমস্ত টাকা নিয়ে নিচ্ছো কৌশলে?”
কাজল এবার বাড়াবাড়ি করে ফেলছে বুঝতে পেরে মা তাকে আরও কয়েকটা থাপ্পড় লাগিয়ে দেয়। তারপর চুপচাপ ঘরে চলে যেতে বলে। কাজল ঘরে যায়। তবে যাবার আগে বলে,“আমাকে চুপ করিয়ে দিলে নাহয়। তবে আপা যেদিন এসব প্রশ্ন করবে সেদিন এর জবাব দিতে পারবে তো?”
মা কোন কথা বলে না। আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মনেমনে বলি,“এসব প্রশ্ন আমার মাথায় আগেই আসছিলো। তবে ছোটবেলা থেকে আমি বাবা, মা যেভাবে আমাকে বুঝ দিতো সেটাই বিশ্বাস করে নিতাম। তবে ইদানীং তাদের কথাবার্তা, আমাকে নিয়ে এত উদাসীনতা সব নিয়ে ভাবি। সেই সঙ্গে ছোটবেলার সেসব কথা মনে করি যেসব কথা সেই সময়ে আমি খুব সহজে এড়িয়ে গিয়েছিলাম। এসব ভাবার পরই আমি আমার কাঙ্ক্ষিত সেই উত্তরটি পেয়ে গেছি। না পুরোপুরি নিশ্চিত নই। তবে আমার কেন জানি মনে হয় এটাই সত্যি।”
আমার এসব ভাবনার মাঝে মা আমাকে দেখে বলে,“পুষ্প তুই কখন আসলি?”
“মাত্রই।”
এটা বলে ঘরের ভেতর চলে আসলাম। মা বোধহয় কিছু বলতে চাইছিলো। তবে আমি শুনলাম না। আমি নিজের ঘরে চলে আসলাম। হ্যাঁ আমার বোনের কথাগুলো সত্যি। আমার চৌদ্দ বছর বয়সে আমার বাবা, মা আমাকে বিয়ে দিতে চাইছিলো। কিন্তু আমি করিনি। আমি আমার মায়ের মুখে এত ঋনের গল্প শুনেছি যে পড়ালেখা করে তাদের জন্য কিছু করতে চাইছিলাম। সেই সাথে সেই সময়ে বিয়ের আগ্রহ ছিলো না। তবে আজ বুঝি সেই সময়ে তারা কেন আমাকে বিয়ে দিতে চাইছিলো, আর আজ কেন চাচ্ছে না। আমি একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলাম।
___
বেশ রাত। আমি ছাদের বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। মৃদু বাতাস গায়ে স্পর্শ করতে একটু ঠান্ডা অনুভব হলো। খারাপ লাগলো না। বেশ লাগছে। আকাশে অসংখ্য তারার ভিড়ে চাঁদটিকে বেশ উজ্জ্বল লাগছিলো। নিস্তব্ধ রাতে ছাদে আমি একা বসে সেই চাঁদের উজ্জ্বলতা মুগ্ধ নয়নে দেখছিলাম। হাতে আমার সেই ঘুড়ি। মনে হলো একটু ছেলে মানুষি করি। জানি বয়সটা ছেলে মানুষি করার নয়। তবে একবার করেই দেখি না। এটা ভেবে ঘুড়িটি আকাশে উড়িয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। অতঃপর সত্যি একটি ইচ্ছে বললাম। মনেমনে বললাম,“আমার জীবনে এমন কাউকে পাঠাও যে আমার এই দুঃখী মুখের হাসি ফোটার কারণ হবে। যার সংস্পর্শ আমার মুখটা হাস্যজ্জ্বল হয়ে থাকবে।”
এটা বলে আমি ঘুড়িটি আকাশে উড়িয়ে দিলাম। ঘুড়িটি উড়তে শুরু করে। যতক্ষণ না ঘুড়িটি আমার দৃষ্টি সীমার বাহিরে চলে যায় ততক্ষণ অব্দি আমি সেটি দেখতে থাকি। আর কিছুটা উপহাসের হাসি হেসে মনেমনে বলি,“ইচ্ছেঘুড়ি।” কথাটি বলতে চোখের কোনে পানি এসে জমা হলো। চোখের পানি আমাকে জানিয়ে দেয়, এসব বাচ্চামো। আমার ইচ্ছে কখনো সত্যি হবে না।
’
’
চলবে,