ইচ্ছেঘুড়ি পর্ব-০৩

0
21

#ইচ্ছেঘুড়ি (৩)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

ছাদে মনমরা হয়ে বসে ছিলাম৷ সেই মূহুর্তে লক্ষ্য করলাম ছাদের পাশে থাকা নারিকেল গাছটিতে কেউ আছে। এত রাতে চোর ডাকাতের হাতে পড়লাম বুঝতে পেরে কিছুটা ভয় পেলাম। ইতিমধ্যে গাছ থেকে লাফ দিয়ে চোরটি আমাদের ছাদে পড়লো। আমি যেই না চিৎকার দিয়ে লোক ডাকবো তখনই লোকটি এসে আমার মুখ চেপে ধরলো। লোকটি কিছুটা ধমক দিয়ে বলে,“চুপ। এতরাতে ছাদে কী করছেন? আমাকে ফাঁসানোর জন্য রয়েছেন?”

কন্ঠ শুনে বুঝলাম এটা শান্ত। আমি তৎক্ষনাৎ তার হাত সরিয়ে দিয়ে কিছুটা দূরে সরে গেলাম। শান্ত তার ফোনের ফ্লাশ জ্বালালো। আমি কিছুটা দূরত্ব রেখেই বললাম,“আপনি এতরাতে আমাদের বাড়ির ছাদে কী করছেন? চুরি করার অভ্যাসও আছে? এই দুনিয়ার সব খারাপ গুনই কী আপনার আছে?”
আমার মুখে এই কথা শুনে শান্ত বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকালো। অতঃপর বিরক্তির গলায় বললো,“আমি চোর নই।”
এটা বলে আমাদের ছাদ থেকে লাফ দিয়ে পাশের ছাদে চলে গেল। আমি অবাক হয়ে গেলাম। তবে ঐ বাড়ির ছাদে যাওয়ার জন্যই আগে গাছ বেয়ে আমাদের ছাদে নেমেছে। হ্যাঁ তাই হবে হয়তো। পাশের বাড়ির ছাদের আশেপাশে কোন গাছ নেই। সেজন্য আমাদের নারকেল গাছটিকে বেছে নিলো। কিন্তু তার এতরাতে ঐ বাড়ির ছাদে কী কাজ? এই প্রশ্নটি মাথায় ঘুরছে। সেজন্য ছাদ থেকে বাসায় ফেরত আসতে পারলাম না। আমি শান্তর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। যদিও কিছুটা ভয় পাচ্ছিলাম। পাড়ায় যে পরিমান শান্তর কুকীর্তি নিয়ে চর্চা হয়। তাতে এতরাতে সে যে একা পেয়ে কিছু করতে পারে এই ভয়টা জন্ম নেওয়া স্বাভাবিক।

আমি এসব ভেবে উঁকি মেরে পাশের ছাদে শান্ত কর্মকান্ড দেখার চেষ্টা করছিলাম। ভালোভাবে লক্ষ্য করার পর তার কর্মকান্ড দেখতেও পেলাম। শান্ত পাশের বাড়ির ছাদে থাকা সমস্ত ফুল গাছগুলো নষ্ট করছিলো। আমি এটা দেখে ভীষণ হতবাক হয়ে গেলাম। চিৎকার দিয়ে বললাম,“এসব কী করছেন?”

শান্ত তৎক্ষণাৎ থেমে গেল। লাফ দিয়ে আবারও আমাদের ছাদে চলে এলো। তারপর আমার কাছে এসে বলে,“চুপ। চিৎকার করে লোক জড়ো করবেন নাকি? আপাতত থামুন, আমি চলে গেলে বা কাল সকালে এসব কথা সবাইকে বইলেন।”

”আপনি এভাবে ফুল গাছগুলো নষ্ট করছেন কেন?”
আমার এই কথা শুনে শান্ত স্বাভাবিক গলায় বললো,“ওটা আমার মামার বাড়ি। এক নাম্বারে ফালতু লোক। দৈনিক আমার বাড়ি গিয়ে আমার নামে আমার মায়ের কাছে বদনাম করে আসে। সেজন্য ওর শখের গাছগুলোর বারোটা বাজিয়ে দিলাম। শুনেছি গাছগুলো তার ভীষণ প্রিয়।”

”মানে? এই সামান্য কারণে আপনি এতরাতে এত রিস্ক নিয়ে এসব করতে আসলেন?”
আমার কথায় শান্ত মাথা নাড়ায়। অতঃপর বলে,“এটা সামান্য বিষয় আপনার কাছে। কিন্তু আমার মামার কাছে নয়। তার এই ফুল গাছগুলো এক প্রকার জীবনের মতো। তাই তার বারোটা বাজাতে এই উপায়টাই বেষ্ট।”

“আপনার বয়স কত?”
আমার কথা শুনে শান্ত কিছুটা হচচকিয়ে যায়। আমি আবারও জিজ্ঞেস করতে সে বলে,“আমার বয়স নিয়ে পড়লেন কেন?”

“বয়সটা কত?”
আমি কিছুটা কঠিন গলায় বললাম। শান্ত বিরক্তি নিয়ে বললো,“সাতাশ।”

”এই বয়সে আপনার এসব বাচ্চামো মানায়?
কোথায় জীবন, ক্যারিয়ার নিয়ে ভাববেন সেটা না করে কে আপনার বদনাম করলো তাকে শায়েস্তা করতে মধ্যরাতে চলে এলেন তার গাছ নষ্ট করতে। এসব আপনার বয়সের সাথে যায়?”
আমি একটু থেমে আবারও বললাম,“তাছাড়া সে আপনার নামে তো মিথ্যা বদনাম করেনি। হয়তো সত্যি কথাগুলোই বলেছে। কাজ বাজ না করে সারাদিন এর ওর সাথে ঝামেলা, আড্ডা দিয়ে বেড়ান। সে আপনার মামা। সেই হিসাবে সে আপনার ভালো মন্দ নিয়ে বলতেই পারে। তাই বলে…।”

“আপনার বয়স কত?”
শান্তর প্রশ্ন আমিও কিছুটা হচচকিয়ে গেলাম। পরক্ষণে নিজেকে সামলে বললাম,“আটাশ। এই প্রশ্ন কেন?”

“মাত্র এক বছরের বড়।
আপনার বয়সের সঙ্গেও এই পাড়ার কাকি মা টাইপ কথাবার্তা যায় না।”
আমি শান্তর কথা শুনে বিরক্তি নিয়ে তার দিকে তাকালাম। শান্ত আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে। আমি তার তাকানো দেখে কিছুটা অস্বস্তি অনুভব করলাম। শান্ত মুচকি হেঁসে বলে,“আপনাকে দেখেই মনে হয় একটা বিরস মহিলা। আপনার বয়সটা সেই তুলনায় কম হয়ে গেল। আর এদিকে আমার বয়সটা আমার স্বভাবের থেকে একটু বেশি হয়ে গেল। তাই আমার মনে হয় আমরা দুজনেই ঠিক জায়গায় আছি।”

”আপনি কী বলছেন আপনি নিজে বুঝছেন?”
আমার এই কথা শুনে শান্ত মাথা নাড়ায়। তারপর বলে,“আমি নিজে ঠিকই বুঝছে। তবে আমার কথা অন্যরা না বুঝলে তাতে আমার কিছু যায় আসে না।
থাক ছাড়ুন সেসব। আপনি এতরাতে ছাদে কী করছেন? কাকি মায়েরা তো এতরাতে জেগে থাকে না। তাহলে সকালে উঠে অন্যের বাচ্চাদের চোখের সামনে দেখে জ্ঞান কিভাবে দিবে?”

”আপনি ফালতু কথা বাদ দিয়ে যান।”
আমার কথা শুনে শান্ত চোখ বড় করে আমার দিকে তাকালো। আমি কিছু বলার আগে সেই বললো,“এখানে আমি আপনার ইচ্ছেতে আসিনি। আমি কারো ইচ্ছেতেই কিছু করি না। আমি নিজের জীবন নিজে পরিচালনা করতে পারি। আপনার মতো মহান নই আমি।”

”আমাকে কতটুকু চেনেন যে আমার সম্পর্কে না জেনেই মন্তব্য করছেন?”

“যথেষ্ট চিনি। পাড়ায় আপনাকে নিয়ে যে পরিমান আলোচনা হয় তাতে আপনাকে এই পাড়ায় চেনে না এমন মানুষ খুব কম।”
শান্তর মুখে এই কথা শুনে আমি হচচকিয়ে গেলাম। কিছুটা লজ্জাও পেলাম। মানুষ আমার সমস্যা আছে, বিষয়টি এমনভাবে ছড়িয়েছে যে এখন পুরুষরাও এসব জানে। এটা ভাবতেই খারাপ লাগছে। আমার মনের কথা বোধহয় শান্ত বুঝতে পারলো তাই বলে উঠলে,“আরে ওসবে চাপ নিয়েন না। মানুষ তো বলার জন্যই আছে। আপনি বিয়ে করে দুই বাচ্চার মা হয়ে যান, দেখবেন তখনও বলবে আপনার স্বামী আপনার এতবড় সমস্যা জানার পরও সংসার কিভাবে করছে?”
আমি অবাক হয়ে শান্তর দিকে তাকালাম। শান্ত মাথা নাড়ালো। যার অর্থ হ্যাঁ। প্রতিবেশীরা এমনই। আমিও জানি এটা। তবে মাঝে মাঝে খারাপ লাগাটা এসে যায়। আমি চুপ করে আছি দেখি শান্ত বলে,“এত দ্রুত এতদূর চলে যাবেন না। আমি এত রিস্ক নিতে পারবো না।”

“মানে?”
আমি বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করি। এই কথার জবাবে শান্ত কিছুটা দূরে গিয়ে বলে,“যেভাবে ভাবনায় পড়েছেন তাতে মনে হচ্ছে আপনি এখনই দুই বাচ্চা নিয়ে নিবেন। আর এখানে যেহেতু এখন আমি আছি। সেহেতু আপনার ঐ মিশনে যদি আমি ফেঁসে যাই। না বাবা আমার দ্বারা হবে না।”

“কি!”
আমি দুই মিনিট হতভম্ব হয়ে শান্তর দিকে তাকিয়ে আছি। শান্ত কথা না বাড়িয়ে দ্রুত নারকেল গাছে উঠে পড়লো। আমি চিৎকার করে বললাম,“ফাজিল ছেলে।”
আমার এই কথা শুনে শান্ত হাসতে শুরু করলো। হাসতে হাসতে গাছ থেকে নামছিলো। অতঃপর চলে গেল। শান্ত চলে যেতে তার শেষ কথা ভেবে আমিও হেঁসে দিলাম।
___
সকাল বেলা পাশের বিল্ডিং এর চাচার অর্থাৎ শান্তর মামার চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ শোনা গেল। যদিও বাসার অন্যরা বুঝলো না এই চিৎকারের কারণ। কিন্তু আমি বুঝেছি। আমি তো জানি কেন সে এমন করছে। মা বিষয়টি জানতে চলে যায়। আমি অফিসের জন্য তৈরি হয়ে বের হই। তবে বের হওয়ার সময় কাজলের সঙ্গে দেখা হয়। আমি শান্ত গলায় বলি,“মায়ের তোর বিয়ে নিয়ে অনেক শখ। সেটা এভাবে ভেঙে দিস না। রাজি হয়ে যা।”
কাজল কিছু বলতে চাচ্ছিলো। তবে তাকে সেটা বলার সুযোগ না দিয়ে আমি বেরিয়ে আসি। আমি বাহিরে বের হতে দেখি ইতিমধ্যে পাশের বিল্ডিং এ বেশ মানুষ জড়ো হয়েছে। সেখানে শান্তর মামা তার শখের ফুল গাছের জন্য কান্নাকাটি করছিলো। তাদের গেটের কাছে শান্তকে দেখে আমি কিছুটা অবাক হলাম। আমাকে দেখে শান্ত বোকা বোকা একটি হাসি দেয়। তারপর ইশারা দিয়ে ভেতরে তাকাতে বলে। সে তার মামার কষ্ট পাওয়া দেখে যে বেশ মজা পাচ্ছে, এই মজাটা উপভোগ করতেই সকাল সকাল এখানে চলে এসেছে। সেই বিষয়টিই আমাকে ইশারায় বোঝালো। আমি সেসবে কোন ভাবান্তর না দেখিয়ে আমার গন্তব্যে হাঁটা ধরলাম। কয়েক মূহুর্তের ব্যবধানে শান্তও আমার কাছাকাছি চলে এলো। আমি এটা দেখে বিরক্ত হলাম। শান্ত কিছুটা বিষ্ময় নিয়ে বলে,“মামার আচরণ দেখে মনে হলো সে এখনো জানে না এই কান্ড যে আমি ঘটিয়েছি। তা আপনি তাদের সত্যিটা বলেন নাই।”

“না। তবে আপনি কাজটি ঠিক করেননি।”

”সবাই জানে আমি যে কোন কাজই ঠিক করি না। কিন্তু সবাই জানলে তো চলবে না। আমি জানি আমি যা করি তা সঠিক। আমার জন্য এটাই যথেষ্ট।”
আমি শান্তর কথা শুনে দাঁড়িয়ে গেলাম। অবাক কন্ঠে বললাম,“নিজে সঠিক এটা মানেন বলে আপনি যা খুশি তাই করবেন? অন্যরা কি ভাবলো আর কি ভাবলো না সেসব নিয়ে একবারও ভাববেন না?”

“জ্বী না। একবারও ভাববো না। অন্যদের জন্য নিজের খুশি বিসর্জন দেওয়ার মতো মহান আমি নই। আর হতেও চাই না।”
এটা বলে শান্ত ভাব নিয়ে উল্টো হাঁটা ধরে। আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সে বলে,“আমি আর একটু মামার পাগলামি উপভোগ করতে যাচ্ছি।”
আমি আর কথা না বাড়িয়ে আমার গন্তব্যে এগিয়ে গেলাম।


চলবে,
(ভুলক্রটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)