#ইচ্ছেঘুড়ি (৪)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
অফিসে বসে কাজ করছিলাম। সেই মূহুর্তে মা ফোন দিলো। ফোনটা ধরতে ওপাশ থেকে বললো,“আসার সময় এই জিনিসগুলো নিয়ে আসিস।”
কিছু জিনিসের নাম বলে ফোনটা কেটে দিলো। তার যা প্রয়োজন সেগুলোর কথা বলে ফোনটা রেখে দিলো। আমার কথা শোনার প্রয়োজনবোধ করলো না। মায়ের এমন আচরণে অবাক হলাম না। এগুলো এখন আমার জন্য রোজকার ঘটনা। তবে তাদের এমন আচরণ নিয়ে আগে প্রচুর ভাবতাম। কষ্ট পেতাম। কারণ তখন আমি সত্যিটা দেখেও দেখার চেষ্টা করিনি। আজ সেই সত্যিটা আমি দেখতে পাচ্ছি। সব ঘটনা এবং কিছু কথা সাজিয়ে গুছিয়ে আমি আমার উত্তরটা পেয়ে গেছি। আমার সন্দেহ যে মিথ্যা নয় সেটা আমি জানি। এখন অনেকটাই নিশ্চিত। তাই তো তাদের কথায় কষ্ট পাচ্ছি না। হয়তো আমার মন মেনে নিচ্ছে তারাই ঠিক। আমার আগমন তাদের জীবনে ভুল সময়ে হয়েছে। এটি তাদের একটি ভুল সিদ্ধান্ত ছিলো। তাই তো আজ এটা নিয়ে আফসোস হচ্ছে।
★
অফিস থেকে বের হওয়ার পথে বাজারে ঢুকলাম। মায়ের বলে দেওয়া জিনিসগুলো কিনতে শুরু করলাম। সবগুলো কিনে রাস্তার কাছে এসে রিকশা খুঁজছিলাম। সেই সময়ে রাস্তার ওপর পাশে ফুলের গাছের দোকানে শান্তকে দেখে অবাক হলাম। সে এই সময়ে এখানে কী করছে? কয়েকটি গাছ দেখছে দেখলাম। এগুলো কিনবে? মনে এই প্রশ্নটি আসলেও তেমন ভাবান্তর দেখালাম না। আমি রিকশা ডেকে চলে আসলাম। বাসায় এসে জিনিসগুলো মায়ের হাতে দিতে মা বললো,“আগামীকাল পাত্রপক্ষ আসবে কাজলকে দেখতে। ছবি দেখে পছন্দ করেছে। সব ঠিক থাকলে এখানে বিয়েটা হয়ে যাবে। কিন্তু কাজল একটু পাগলামি করছে। তুই একটু কাজলকে বোঝা।”
আমি মাথা নাড়ালাম। মা আমতা আমতা করে বলে,“কাজলকে একটু এটা বলিস যে আমি যেটা বলেছি সেটাই সত্যি। সেজন্য তুই বিয়ে করতে চাস না। নয়তো বুঝিস তো, পাড়ার সবাই এই বিষয়ে কথা বলছে দেখেই ও এমন পাগলামি করছে। ওর বিয়েটা দেওয়াও তো জরুরি। তাই বলছিলাম কী এটা নিয়ে…।”
আমি মায়ের দিকে শান্ত চোখে তাকাতে সে থেমে গেল। মায়ের কথার ভাবার্থ বুঝতে পেরে আমি অনেকটা আহত হলাম। যতই মনকে শক্ত করার চেষ্টা করি। তবুও কষ্টটা এসে যায়। নিজেকে সামলে আমি বললাম,“আমি কাজলে বুঝিয়ে বলবো। ও বিয়েতে অমত করবে না। চিন্তা করো না।”
এই কথা বলে ফ্রেশ হয়ে আমি কাজলের ঘরে গেলাম। আমাকে দেখে কাজল বললো,“মা পাঠিয়েছে?”
আমি মাথা নাড়ালাম। কাজল বিরক্তি নিয়ে বলে,“তোমার মনে হয় না বাবা, মা তোমার সঙ্গে অন্যায় করছে আপা?”
আমি জবাব দিলাম না। কাজল নিজ থেকেই বলে,“আমার তো মাঝে মাঝে মনে হয় তুমি তাদের মেয়েই নও। বাবা, মা তোমাকে সেটা মনেই করে না।”
আমি ম্লান হাসলাম। কিছু একটা মনে পড়তে হাসিটা মুখে ফুটে উঠলো। না এটা খুশির হাসি নয়। আমি ম্লান হাসি মুখে ধরে রেখে বললাম,“তোর বিয়েটা করা উচিত।”
”কিন্তু বড় তো তুমি।”
কাজলের এই কথার জবাবে আমি তার পাশে বসে তার হাতটি ধরে শান্ত গলায় বললাম,“আমি বিয়ে করবো। তবে এই সময়ে না। আগে আমাদের সংসারের সব ঋন, তোর বিয়েটা ভালোভাবে মিটে যাক তারপর করবো।”
“ঋন না কচু।”
কাজল ব্যঙ্গ করে কথাটি বলে। আমি শান্ত গলায় বললাম,“আমি জানি আমাদের ঋন নেই। বাবার বরং জমানো টাকা রয়েছে। যেটা সে তোর বিয়েতে কাজে লাগাতে চায়। অনেক শখ যে তাদের তোর বিয়ে নিয়ে। আমার মনে হয় তাদের এই শখটা পূরণ হওয়া দরকার। তাছাড়া আমার যে ঋন রয়েছে। তাদের ঋন না থাকলেও আমার ঋন রয়েছে। আমাকে সেটা শোধ করতে হবে। সেজন্য হলেও এই মূহুর্তে আমার বিয়ে করা সম্ভব নয়। তাই তুই আমার কথা ভেবে এতবড় কান্ড ঘটাস না।”
আমার কথা শুনে কাজল চুপ হয়ে যায়। আমি তাকে খুব ঠান্ডা মাথায় বোঝালাম। সবশেষে বললাম,“তোর যদি পছন্দ থাকে সেটাও বল। আমি বাবা, মাকে তার কথা বলবো। আর যদি না থাকে তবে বাবা, মা যে পাত্র নিয়ে আসছে তাকে দেখ। তার সম্পর্ক জেনে নে। যদি মনে হয় একে তুই বিয়ে করতে পারিস তবে কর।”
কাজল আমার কথায় মাথা নাড়ালো। যার অর্থ সে রাজি। সেই সঙ্গে কাজলের সাথে কথা বলে বুঝলাম তার জীবনে কেউ নেই। তবে একজন ভালো লাগার মানুষ ছিলো। তার অন্যত্র বিয়ে হয়ে গিয়েছে। এটা শুনে আমি তাকে বাবা, মায়ের নিয়ে আসা পাত্রকে নিয়ে ভাবতে বললাম। কাজল সম্মতি জানিয়ে মাকে জানালো, সে পাত্রের সঙ্গে আলাদা কথা বলতে চায়। আগামীকাল দেখতে আসলে এই ব্যবস্থা করে দিতে। মা রাজি হয়ে গেল।
___
পাশের প্রতিবেশীর চিৎকার শুনে হচচকিয়ে গেলাম। সকালে একটি কান্ড ঘটলো। সেটা নিয়ে বেশ কান্নাকাটি হলো। এখন আবার চিৎকার করছে কেন? সেই গাছের শোকে আবার কান্না করতে নিবে নাকি? কিন্তু কই। না তো। তেমন কিছুই নয়। বরং সে চিৎকার দিয়ে সবাইকে ডেকে বলছে,“দেখে যাও সবাই দেখে যাও।”
কৌতুহলবসত আমি ঘর থেকে বের হলাম। সেখানে গিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। তার গেটের কাছে অনেকগুলো গাছ। সে খুশি হয়ে সবাইকে দেখিয়ে বলছে,“দেখো কান্ড। আমাকে খুশি করতে কে জানি ফুলগাছ রেখে গিয়েছে। কত সুন্দর গাছগুলো।”
খুশি মনে সে সবাইকে বলছে। সেই সঙ্গে যে এই কাজ করেছে তাকে খুব দোয়া দিচ্ছে। আমি তার ফুল গাছের প্রতি এত ভালোবাসা দেখে অবাক হলাম। সেই সঙ্গে ভালোও লাগলো। যদিও কারো কারো কাছে এগুলো অতিরঞ্জিত, বুড়ো বয়সে ভিমরতি মনে হয়। তবে কিছু ভিমরতি থাকা ভালো। এটা ভেবে আমি গাছগুলো খুব ভালোভাবে দেখছিলাম। এই গাছগুলো সেই সময়ে শান্তকে দেখতে দেখছিলাম। তারমানে শান্ত গাছগুলো তার মামাকে দেওয়ার জন্য কিনেছে। বাহ্। যে নষ্ট করছে সেই আবার কিনে দিচ্ছে। এমন সময় শান্ত সেখানে আসে। তাকে দেখে তার মামা বলে,“দেখ। এসব দেখে কিছু শিখতে তো পারিস। কিভাবে বয়স্কদের ভালোবাসাকে সম্মান করতে হয়। তা না করে সারাদিন বখাটে হয়ে ঘুরে বেরিয়ে অন্যদের উত্তাক্ত করবি।”
“আমি আবার কাকে উত্তাক্ত করলাম?”
শান্ত অবাক হওয়ার ভান ধরে কথাটি বলে। তার মামা এক নাগাড়ে তাকে জ্ঞান দিয়ে যাচ্ছে। তার সমস্ত কাজেই অন্যরা বিরক্ত হয়। এটাই উত্তাক্ত করা। সেই সঙ্গে সকালে শান্ত ফুল গাছের জন্য তার কান্না নিয়ে মজা নিচ্ছিলো। সেসব কিছুই খারাপ। এভাবে অনেক কথা শোনায়। এটা দেখে শান্ত কান চেপে ধরে বলে,“আসছিলাম বুড়োর ঢং দেখতে। কিন্তু বুড়ো কানের মাথা খেয়ে নিলো।”
এটা বলে সে স্থান ত্যাগ করার জন্য পা বাড়ায়। সেই মূহুর্তে আমি তার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। শান্ত গলায় বলি,“এই গাছগুলো আপনি এখানে রেখে গেছেন। তাই না?”
শান্ত হচচকিয়ে যায়। সে আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে তার মামার দিকে তাকায়। যে শান্তকে খারাপ এবং তাকে যে গাছ দিয়েছে তাকে ভালো বলে যাচ্ছে। শান্ত এটা দেখিয়ে আমাকে বলে,“আপনার মনে হয় আমার মামার মুখে এত প্রশংসা শোনার মতো কোন কাজ আমি করবো? ইশ ঠ্যাকা পড়েছে। এটা কোন এক গাধা করেছে। যার টাকার মায়া নাই। নয়তো কেউ পকেটের টাকা দিয়ে এসব করে? আরে ভাই তোর টাকা বেশি ছিলো তো আমাকে দিতে। কয়েকদিনের সিগারেট খাওয়ার পয়সাটা হয়ে যেতো।”
শান্তর এসব উদ্ভট কথা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। সে যথেষ্ট চেষ্টা করছে এটা প্রমাণ করতে যে সে এই গাছ এখানে রাখেনি। তবে আমি তাকে অবাক করে দিয়ে বললাম,“আমি বোধহয় সেই গাধাটাকে গাছ কিনতে দেখেছি। শুধু তাই নয় দশ বিশ টাকা কমানোর জন্য দোকানির উপর খুব পাট নিছিলো।”
শান্ত একদম চুপ করে গেল। সে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মনেমনে ভাবছে,“ওটাও দেখেছে।” তার ভাবনাকে সত্যি করে দিয়ে আমি বললাম,“ওহ হ্যাঁ। সে তো অনেক আকুতি করে বলছিলো, তার মা তাকে এই টাকাই দিয়েছে। কিছু টাকা কম না রাখলে তার সিগারেট খাওয়া হবে না। ডাক্তার তাকে বলেছে তার মস্তবড় রোগ হয়েছে। ঠিক সময়ে সিগারেটে টান না দিলে তার পেটের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে।”
শান্ত ধরা পড়ে গিয়েছে বুঝতে পেরে বোকা হেঁসে বলে,“আসলেই ছেলেটা গাধা।”
এটা বলে কোনরকম ভাবে কেটে পড়লো। আর আমি কোনরকম হাসি চাপিয়ে একটু লোকজনের আড়ালে আসলাম। তারপর অট্টহাসি দিয়ে উঠলাম। ঠিক সেই মূহুর্তে শান্ত ঝরের বেগে আমার সামনে এসে বলে,“যেদিন লোকের সামনে এভাবে মন খুলে হাসতে পারবেন সেদিন নিজেকে ঠকানোর অপরাধে আর ভুগবেন না।”
কথাটি বলে যেভাবে ঝরের বেগে সামনে এসেছিলো সেভাবেই চলে যায়। তার কথা শুনে আমি থ হয়ে গেলাম। মনেমনে বললাম,“আমি নিজেকে ঠকাচ্ছি?”
’
’
চলবে,