ইচ্ছেঘুড়ি পর্ব-০৫

0
19

#ইচ্ছেঘুড়ি (৫)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

আজ ছুটির দিন। তবে বাসায় মন টিকলো না। তাই একটু বাহিরে বের হলাম। ঘরের ভেতর বেশ তোড়জোড় চলছে। কাজলের আজ পাকা দেখা। মা আমাকে ঘরের কোন কাজে হাত দিতে দিলো না। সে কয়েকজন প্রতিবেশীকে সঙ্গে নিয়ে সব আয়োজন করছে। প্রতিবেশীদের ভাষ্যমতে,“পুষ্পর যে সমস্যা শুনলাম তাতে বিয়ের কাজে তার হাত লাগলে অমঙ্গল হবে।”
আমার মা এই কথাটি ধরেই আমাকে কোন কাজে হাত লাগাতে দিলো না। সে আমাকে ঘরে বসে নিজের কাজ করতে বললো। তবে ঘরে বেশ খানিকটা সময় কাটানোর পরও ভালো লাগছে না। তাই একটু বাহিরে বের হলাম। রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করছিলাম। মুনটা ভীষণ বিষন্ন। যদিও আমি মন খারাপ করতে চাচ্ছি না। তবুও মন খারাপ হচ্ছে।

বিষন্ন মন নিয়ে রাস্তা দিয়ে একা একা হাঁটছিলাম। সেই মূহুর্তে গলির মাথার দোকানটির সামনে চোখ গেল। সেখানে শান্তকে দেখা যাচ্ছে। যে খুব রাগান্বিত। তার রাগের বহিঃপ্রকাশ তার চোখ জানান দিচ্ছে। সে অগ্নিচোখে তাকিয়ে সামনের ছেলেটিকে কয়েকটা থাপ্পড় লাগিয়ে দিয়ে আঙুল তুলে শাসালো। আমি খানিকটা দূরে দাঁড়ানো। তাই তাদের কথা শুনতে পেলাম না। তবে শান্তর এমন ব্যবহার দেখে অবাক হলাম না। তার সম্পর্কে এসব কথা প্রায়ই শোনা যায়। যদিও নিজ চোখে আজ প্রথম দেখলাম তাকে কাউকে আঘাত করতে। আমি সেদিক দিয়ে চোখ সরিয়ে উল্টো দিকে হাঁটা ধরলাম।

বেশ খানিকটা হেঁটে ক্লান্ত হয়ে গেলাম। সেই মূহুর্তে সামনে কয়েকটি গাছের খন্ড রাস্তার পাশে রাখা দেখে সেখানে গিয়ে বসলাম। দুপুর বেলা হওয়া রাস্তার মানুষের চলাচল তেমন একটা নেই। মাঝে মাঝে দুই একটি গাড়ির আসা যাওয়া দেখা যাচ্ছে। বেশ ভালোই লাগছে। মুক্ত আকাশ, মৃদু বাতাস বইছে, সেই সঙ্গে মাঝে মাঝে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে বাঁধা দিচ্ছে গাড়ির শব্দ। খুব একটা খারাপ লাগছে না। অনেকটা সময় সেখানেই বসে কাটিয়ে দিলাম।

___
বিকালে ছাদে একা বসে ছিলাম। নিচে পাত্রপক্ষ এসেছে। তাদের সঙ্গে বাবা, মা আলোচনা করছে বিয়ের তারিখ নিয়ে। সেসবে আমার কোন প্রয়োজনীয়তা নেই দেখে ছাদে বসে আছি। আজকের দিনটা ভালো লাগছে না। অফিস খোলা হলে বেশ হতো। এদিকে তাদের জন্য রাতের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেজন্য তাদের বিদায় নিতে বেশ সময়। ততক্ষণ অব্দি এখানে থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু আমার ঘরে যেতে একদম ইচ্ছে করছে না। সবচেয়ে বড় কথা আমার পরিবারের আমাকে প্রয়োজন নেই। সেজন্যই সেখানে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। যদিও কাজল আমাকে তার পাশে থাকতে বলেছিলো। কিন্তু আমি থাকি না। মা এই জিনিসটা ভালোভাবে নিবে না। বিশেষ করে প্রতিবেশীদের কাছে নিজের কথাকে সঠিক প্রমাণ করে রাখতে হলে আমাকে এসব থেকে দূরেই রাখতে হবে। তাই আমি কাজলের সঙ্গে থাকিনি। তাকে বুঝিয়ে ছাদে চলে আসলাম। হঠাৎ কানে চিকন স্বরে শিস বাজানোর শব্দ ভেসে আসলো। আমি পাশে ঘুরে তাকাতে পাশের বাড়ির ছাদে শান্তকে দেখতে পেলাম। সে তার মামার বাড়িতে এসেছে। এটা দেখে অবাক হলাম না। এখানে তাকে আগেও প্রায়ই দেখা যেতো। আমাদের কথা নাহলে আগেও অনেকবার দেখা হয়েছে। তবে সেদিন ‘ইচ্ছেঘুড়ি’ হাতে পাওয়ার পর থেকে কথা হয়েছে। তারপর বেশ কয়েকবার তার সঙ্গে কথা হয়েছে। তবে এবার আমি তার সঙ্গে কথা না বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আজ তাকে সরাসরি একটি ছেলেকে মারতে দেখার পর তার মতো বখাটে ছেলের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে আমার নেই। আমি চোখ ঘুরিয়ে নিবো সেই মূহুর্তে শান্ত আমার দিকে তাকালো। আমাদের চোখাচোখি হলো। শান্ত আমাকে দেখে মিষ্টি হেসে বলে,“হাই।”
আমি কথা না বলে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। সে বোধহয় কিছুটা অবাক হলো। তৎক্ষনাৎ লাফ দিয়ে আমাদের ছাদে চলে এলো। আমি তাকে আমাদের ছাদে দেখে অবাক হলাম। ছাদ থেকে উঠে চলে যেতে নিবো তখন শান্ত বলে,“সমস্যা কী?”

আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। শান্ত স্বাভাবিক গলায় বলে,“এভাবে এড়িয়ে যাচ্ছেন কেন? এড়িয়ে যখন যাবেন তখন সেদিন আমার ইচ্ছেঘুড়ি হাত দিয়ে ধরেছিলেন কেন?”

”মানে!”
আমি অবাক হয়ে কথাটি বললাম। পরক্ষণে আবার বললাম,“ইচ্ছেঘুড়ির সঙ্গে আপনার সাথে কথা বলা বা না বলা মধ্যে কী সংযোগ?”

“আছে।”

”কী?”
আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে শান্ত মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে,“আগে প্রশ্ন আমি করেছি। তাই আপনাকে আগে উত্তর দিতে হবে। নয়তো আমি আপনার কথার উত্তর দিবো না।”
এই কথা শুনে আমি কিছুটা রাগ নিয়ে বললাম,“আমি কোন বখাটে ছেলের সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী নই। তাই আপনাকে এড়িয়ে যাচ্ছিলাম। আমার প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার পর অবশ্যই পার্মানেন্টের জন্য এড়িয়ে যাবো।”

“ও মা গো। তাই নাকি।”
শান্ত অবাক হওয়ার ভান ধরে কথাটি বলে। কথার মাঝে কিছুটা ব্যঙ্গ প্রকাশ পায়। অতঃপর বলে,“আগে যখন কথা বলেছিলেন তখন জানতেন না আমি বখাটে? তখন কেন বলছিলেন?”

“তখন জানতাম। তবে নিজ চোখে নিরীহ একটি ছেলেকে মা রতে আজ প্রথম দেখলাম। এর আগে আপনার গুন্ডামির কথা শুনলেও সৌভাগ্যক্রমে দেখিনি। তবে আজ দূর্ভাগ্যক্রমে দেখা হলো।”
আমার কথার ধরন দেখে শান্ত আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকালো। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে পরক্ষণে হেসে দেয়। শব্দ করে হাসে। আমি তার হাসির কারণ খুঁজে না পেয়ে অবাক হলাম। সে হাসি মুখে ধরে রেখে বলে,“নিরীহ ছেলে? হাউ ফানি!”
এটা বলে একটু থেমে পরক্ষণে বলে,“পাড়ার কুচুটে কাকি মায়েদের মতো অর্ধেক দেখে সবটা নিজের মতো ভেবে নেন বলেই আপনাকে ভালো লাগে না। যাই হোক ও মোটেও নিরীহ ছেলে ছিলো না। ও দোকানের খাবার খেয়ে বিল না দিয়ে বরং দোকানদারের সঙ্গে খারাপ আচরণ করছিলো।
নিশ্চয় ও খুব ভালো কাজ করছিলো না। এটা আপনিও মানবেন। তাই বলি ভোলাভালা চেহারা দেখে তাকে সাধু ভাববেন না। এটা একটু বেশিই ন্যাকামি হয়ে যায়।”

“আপনি আমাকে ন্যাকা বললেন?”
আমি কিছুটা হচচকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। আমি ন্যাকা। সিরিয়াসলি। যেখানে সবাই আমাকে ম্যাচিউর বলে। সেখানে এই ছেলে আমাকে ন্যাকা বললো। এটা আমি কিছুতেই মানতে পারছিলাম না। তখনই শান্ত বলে,“আপনাকে নয়। আপনার কাজটাকে ন্যাকা বললাম।”

”আসলেই ঐ ছেলেটা এই কাজ করছিলো?”
আমি কিছুটা শান্ত গলায় জানতে চাইলাম। শান্ত স্বাভাবিক ভাষায় বললো,“শান্ত মিথ্যা বলে না।”

“আচ্ছা বুঝলাম। স্যরি আপনাকে ভুল বোঝার জন্য। তবে অন্যরা তো সবাই চুপ ছিলো সেখানে আপনার এমন বসগিরি দেখানো উচিত হয়েছে?”

”সারা দুনিয়ার সবাই অন্ধ তাই বলে কি আমিও অন্ধ থাকবো?”
শান্তর এই কথার জবাব দিতে পারলাম না। প্রসঙ্গ বদলে আমি বললাম,“আমার প্রশ্নের উত্তর দিন। ইচ্ছেঘুড়ির সঙ্গে আমার কথা বলা বা না বলার সম্পর্ক কী?”

“সত্যি বলবো?”
শান্তর কথা শুনে আমি মাথা নাড়াই। যার অর্থ হ্যাঁ। আমি সত্যি শুনতে চাই। শান্ত নরম গলায় বলে,“আমি ইচ্ছেঘুড়ি আকাশে ওড়ানোর সময় মনেমনে বলেছিলাম যদি কোন মানুষের হাতে এটা পড়ে তবে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করবো। কিন্তু আমার কপাল দেখুন। ওটা পড়েছে আপনার মতো একটা কাকি মা টাইপ মেয়ের হাতে। আপনাকে সরাসরি যদি বলতাম বন্ধু হবেন, জীবনে হতেন না। তাই টুকটাক কথার মাধ্যমে সখ্যতা গড়ার চেষ্টা করছিলাম।
তবে যা মনে হয় এটা কখনো সম্ভব না।”

”কেন?”
আমি এই প্রশ্নটি করতে শান্ত হেসে বলে,“আপনার মতো মানুষের সাথে আমার বন্ধুত্ব যায়?”

“একদম না। আমি বাচ্চাদের সাথে বন্ধুত্ব করি না।”

“হ্যাঁ। সাতাশ বছরের আমিটাকে আপনি বাচ্চা বলছেন?”

”আমার আটাশ বছর। সে হিসাবে আপনি আমার ছোট। অন্যভাবে ভাবলে আপনার বয়স বাড়লেও আপনি আপাদমস্তক পুরোটাই বাচ্চামো স্বভাবের। নয়তো কেউ ঘুড়ি যার হাতে যাবে তাকে বন্ধু বানাবে, এই করবে সেই করবে এমন কাজ করে? তো আপনার মতো বাচ্চার সঙ্গে আমার বন্ধুত্বটা ঠিক যায় না।”

”একদম। আমিও আপনার সাথে বন্ধুত্ব করতে চাই না। জীবনে প্রথমবার আমি আমার ঐ ইচ্ছেঘুড়ি নিয়ে করা কান্ডটিকে বাচ্চামো হিসাবেই ধরে নিলাম। আপনার কথার সঙ্গে সম্মতি জানাচ্ছি। কারণ ওটা আপনার হাতে পড়েছে।তাই মেনে নিলাম। অন্যকেউ হলে ঠিক বন্ধুত্ব করে নিতাম।”
শান্ত এসব কথায় আমি কিছুটা বিরক্ত হলাম। তাই প্রসঙ্গ বদলাতে বললাম,“আবার ছাদের ফুল গাছগুলোর নষ্ট করতে এসেছেন?”

“না তো। কেন আপনার এটা মনে হলো?”
শান্তর এই কথার জবাবে আমি ইশারায় বোঝালাম তাকে ছাদে ফুল গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে এটা মনে হলো। এটা বুঝতে পেরে শান্ত বলে,“এই যে নিজের মতো সব ভেবে নেন এটাই খুব খারাপ। যাই হোক আমি গাছগুলো নষ্ট করতে আসিনি। আমার শখের সিগারেটের পয়সায় কেনা গাছগুলো মামা সঠিকভাবে যত্ন করছে কি-না সেটা দেখতে এসেছি।”

“বাহ্। ভালো।”
এই কথাটি বলে আমি চুপ করে গেলাম। শান্ত মাথা নাড়ালো। যার অর্থ সে খুব ভালো। আমি এটা দেখে ম্লান হেসে বললাম,“হ্যাঁ আপনি খুব ভালো।”

“আসলেই ভালো। সারা দুনিয়া মানতে চায় না এটা ভিন্ন কথা।”
দুঃখী হওয়ার ভান করে শান্ত কথাটি বলে। যা দেখে আমার মুখে অটোমেটিক হাসি ফুটে উঠলো। আমি শব্দ করে হেসে দিলাম। এটা দেখে শান্ত বলে,“এভাবে স্বাচ্ছন্দ্যে যখনই হাসি পাবে হাসবেন। সবার সামনে নিজেকে দমিয়ে রেখে ঠকাবেন না। পরে এটা নিয়ে আফসোস হবে। খুব আফসোস।”
শান্তর কথা শুনে আমি থেমে গেলাম। ভাবনায় মগ্ন হয়ে তাকে বললাম,“আপনার জীবনে কখনো মনে হয়নি আপনি ভুল করছেন। আপনার এই বয়সে নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবা উচিত। চাকরি খোঁজা উচিত।”

শান্ত আমার কথা শুনে ম্লান গলায় বলে,“হ্যাঁ ভুল তো করেছি। চাকরি নেওয়াটাই ছিলো আমার জীবনের মস্তবড় ভুল। এছাড়া সবই ঠিক।”
আমি শান্তর কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। তার কথাটা ঠিক আমার হজম হলো না। তার কথার ভাবার্থ বুঝলেও আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম,“মানে?”


চলবে,