#ইচ্ছেঘুড়ি (৭)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
কাজলের বিয়েটা ভেঙে গেল। পাত্রপক্ষ বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে বিয়েটা ভেঙে দিলো। বাবা, মা এটা শুনে প্রচন্ড ভেঙে পড়লো। তারা পাত্রপক্ষকে একের পর এক ফোন দিতে থাকে। এক পর্যায়ে বিয়ের ভাঙার কারণ হিসাবে জানা যায়, মায়ের মিথ্যা। সেদিন মা নিজের বড় মেয়ের কথা গোপন করেছে। অথচ পুরো এলাকাজুড়ে আমার নামে একটি কথা প্রচলিত রয়েছে। তাই যা ঘটার সেটাই ঘটেছে। পাত্রপক্ষ সবটা জানতে পেরেছে। তাদের কথা,“বড় মেয়ের এমন সমস্যা আছে। দেখা যাবে ছোট মেয়েরও আছে। আমরা এই পরিবারে ছেলের বিয়ে দিবো না।”
এসব শুনে বাবা, মা প্রথমে খুব ভেঙে যায়। অতঃপর তারা পাত্রপক্ষের বাড়ি গিয়ে বিষয়টি মিটমাট করার চেষ্টা করেছে৷ যদিও বাবা, মা আমাকে সঙ্গে নিলো না। তবুও সমস্যা যখন আমার জন্য সৃষ্টি হয়েছে তাই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমার গিয়ে তাদের সাথে কথা বলা উচিত। সেই ভাবনা থেকে তৈরি হয়ে বের হলাম। গলির মাথায় এসে রিকশা খুঁজছিলাম। ওপরপাশে একটি রিকশা দেখে আমি সেদিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম সেই মূহুর্তে হাতে টান খেলাম। কেউ আমার হাতটি ধরে আছে। আমি চমকে পিছনে ঘুরে তাকালাম। শান্ত আমার বাম হাতটি শক্ত করে ধরে আছে। এটা দেখে আমি পুরো হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমাকে রাগী চোখে শান্তর ধরে রাখা হাতের দিকে তাকাতে দেখে শান্ত হাতটি ছেড়ে দেয়। আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম,“সমস্যা কী?”
“আমার কোন সমস্যা নেই। আপনার সমস্যা সমাধান করার জন্য আসলাম।”
আমি শান্তর এই কথার ভাবার্থ বুঝতে পারলাম না। তাই বললাম,“মানে?”
“নিশ্চয় এই সন্ধ্যা বেলা মহান হতে যাচ্ছেন বিয়ে ভেঙে দেওয়া পাত্রের বাড়ি।”
শান্তর কথা শুনে চমকে গেলাম। শান্ত মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলে বলে,“আপনি নিশ্চয় ভাবছেন আমি কিভাবে জানলাম? আরে এসব কথা বেশিক্ষণ চাপা থাকে না। বিকালে পাত্রপক্ষ বিয়ে ভেঙে দিয়েছে, ইতিমধ্যে সেটা পুরো এলাকাজুড়ে গসিপের হট টপিক হয়ে গিয়েছে। তাই সবাই জানে। তাছাড়া ঐ মামার দোকানে বসলে দুনিয়ার সব খবর জানা যায়। স্যরি দুনিয়া নাহলেও অন্তত এলাকার।”
“বেশ ভালো। আপনার সাথে কথা বলার সময় নেই। আমাকে যেতে হবে।”
এই কথা বলে আমি যেতে নিলে শান্ত বলে,“লজ্জা করে না। এভাবে মহান সেজে নিজেকে ছোট করতে।”
”চুপ করুন। আপনি কী বুঝবেন? একটা মেয়ের বিয়ে ভেঙে যাওয়ার অর্থ বুঝেন? পাকা কথা হয়েছে, এখন বিয়েটা ভেঙে গেলে কত লোক কী বলবে? আমাদের পরিবার নিয়ে এমনি ছি ছি করে। এসব শোনার পর তো আরও।”
“বিয়েটা হয়ে গেলে বুঝি তারা কথা বলা বাদ দিবে? আপনি যদি এটা ভেবে থাকেন তবে বোকার স্বর্গে বাস করছেন মিস। আপনি যতই ভালো কাজ করুন না কেন, সবাই ঠিকই সেই কাজের ভেতরে খুঁত বের করে কথা শোনাবে। আজ এই ভাঙা বিয়ে জোড়া লাগলেও দেখবেন বিয়ে বাড়িতে এসে হাজারটা লোকের হাজারটা সমস্যা। আপনি চাইলেও এটা কখনো বন্ধ করতে পারবেন না। উল্টো তাদের কাছে ভালো হওয়ার চেষ্টা করতে করতে আপনি নিজেকে হারিয়ে ফেলবেন। যদিও আপনাকে দেখেই মনে হয় আপনি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছেন। তাও আমি এই কথাগুলো বলছি, কারণ এখন সময় আছে চাইলেই আপনি নিজেকে ফিরিয়ে আসতে পারবেন।”
শান্তর এসব কথা শুনে আমি পুরো থ হয়ে গেলাম। শান্ত একটু থেমে আবারও বললো,“যে পরিবার বড় বোনের ছোট বোনের সঙ্গে বিয়ে ভেঙে দেয়। একবার জানারও বোঝারও চেষ্টা করে না, একই পরিবারের সব মেয়ে বা ছেলে একরকম হয় না। তেমন একটা পরিবারে বিয়ে হলে আপনার বোন সুখী হবে না। এটা আপনি নিশ্চিত থাকেন।”
”এমন ঘটনা তো অনেক হয়েছে। তাহলে কী সবাই দোষী? তাদের ভাবনায় তো ভুল নেই। যদি বড় বোনের সমস্যা থাকে তবে ছোট বোনের থাকতে পারে। এটা তো সব পরিবারই ভাবে।”
এই কথা শুনে শান্ত শব্দ করে হেসে দেয়। অতঃপর বলে,“তাহলে তো আপনার কোনদিন বিয়েই হবে না। যদি মানুষের মুখের কথায় সবাই ধরে নেয় আপনার শারীরিক সমস্যা রয়েছে। তাহলে এই যুগে তো বিয়ে করতে পারবেন না।”
শান্তর এই কথাটি শুনে আমার মুখটা শুকিয়ে গেল। আমি মলিন মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছি। এটা দেখে শান্ত তার স্বভাবমতো হাসি মুখেই বলে,“ভয় পাচ্ছেন? চিন্তা করবেন না। পৃথিবীর বুকে এমন মানুষ আছে যে মুখের কথা নয় বরং বাস্তবে বিশ্বাস। আবার অনেকে আছে আপনাকে ভালোবেসে আপনার হাত ধরে বলবে, সমস্যা থাকতেই পারে চলো ডাক্তার দেখাই। পুরো পৃথিবীর মানুষ একই চিন্তাধারার হলে আপনার মতো সবাই পুষ্প হয়ে যেতো। যাদের এক জীবন মহান হতে হতে শেষ হয়ে যেতো।”
”তবে আমার যাওয়া উচিত নয়?”
আমার মুখে এই প্রশ্ন শুনে শান্ত বোকা বোকা হেসে বলে,“বয়সের সঙ্গে প্রশ্নটা যায়। এই বয়সে এসেও নিজের সিদ্ধান্ত নিজে পারছেন না। অন্যদের জিজ্ঞেস করে আপনি আপনার সিদ্ধান্ত নিবেন? আবার আমাকে বয়স নিয়ে কথা শোনান।
“বিরক্তিকর।”
শান্তর কথা শুনে আমার মুখ দিয়ে এই কথাটি বের হয়ে গেল। শান্ত হেসে বলে,“এই তো লোকের সামনে মনের কথা এভাবেই বলবেন। দেখবেন ভালো লাগবে। যাই হোক আপনার যাওয়া উচিত কি উচিত নয় সেটা আপনি নিজেই ভাবুন। আমার কথা শোনার পরও যদি আপনার মনে হয় আপনার যাওয়া উচিত তবে যান।”
আমি কোন কথা বললাম না। আমার তো মনে হয় সত্যি তাই যাওয়া উচিত নয়। পাকা কথা বলার পর বিয়ে ভেঙে দেয় যারা তারা বিয়ের আগের দিনও বিয়ে ভাঙতে দুবার ভাববে না। এমন পরিবারের সঙ্গে বিয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে কথা বাড়ানো একদম উচিত নয়।কিন্তু বাবা মা যে গেল, তারা যদি বিয়েটা ভাঙা না আটকাতে পারে তবে তো এসে আমাকেই কথা শোনাবে। আমার জন্যই বিয়েটে ভেঙে গেছে বলবে। এসব কথা ভাবছিলাম সেই মূহুর্তে শান্ত বলে,“কোন জগতে চলে গেলেন?”
“না মানে। বিয়েটা ভেঙে গেলে তো বাবা, মা আমাকেই দোষারোপ করবে।”
আমার এই কথা শুনে শান্ত ব্যঙ্গ করে হেসে বলে,“কাকি মা বয়স তো কম হলো না। আপনার বয়সের সঙ্গে একদম কথা শুনে মুখ ফুলিয়ে কাঁদা যায় না।”
”আপনি একটু বেশি বকছেন না? শুনুন আপনার মতো আমার জীবন নয়। আমাদের দুজনার জীবনে অনেক পার্থক্য। তাই আপনার ভাবনা মতো আমার জীবনটা চলবে না।”
“আচ্ছা তাই। তা বিয়েটা ভাঙায় আপনার দোষ আছে? আপনি বিশ্বাস করেন এই বিয়ে আপনার জন্য ভেঙেছে?”
শান্তর এই কথায় আমি নাসূচক মাথা নাড়ালাম। এটা দেখে শান্ত বলে,“তাহলে অন্যরা আপনাকে কথা শোনানোর সুযোগ কিভাবে পাবে? আপনার মুখে কি তালা দেওয়া যে অন্যরা একের পর এক মিথ্যা বলে যাবে আর আপনি সেটা হজম করে নিবেন।”
“আপনি বুঝবেন না আমার বিষয়টা।”
এটা বলে আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। চোখের কোনে পানি চলে আসলো। আমি যে কেন তাদের কথার প্রতিবাদ করি না এটা আমিই জানি। তবে আমার মনের কথা বোধহয় শান্ত বুঝতে পারলো। তাই বলে,“সবসময় প্রতিবাদ যে গলা উচু করে করতে হবে তার কোন মানে নেই। নিজের স্বভাব ধরে রেখে শান্ত গলায় কৌশলে চাইলেই অন্যকে তার ভুলটা ধরিয়ে দেওয়া যায়। এজন্য তেমন কিছুর প্রয়োজন হয় না। শুধুমাত্র নিজের মধ্যে ইচ্ছাশক্তি জাগ্রত করতে হয়।”
এই কথাটি শুনে আমি শান্তর দিকে ঘুরে তাকাই। শান্ত ম্লান হেসে বলে,“যেদিন সবার মাঝে আপনার সমস্যা আছে কথাটি ছড়িয়ে গেল সেদিনই আপনার প্রতিবাদ করা উচিত ছিলো। সেটা না করে আপনি এই কথাটিকে সত্যি প্রমাণ করে দিয়েছেন। তাই এবার অন্তত চুপ থেকে মিথ্যাকে সত্যি প্রমাণ করবেন না। আপনি আপনার বাবা, মায়ের সঙ্গে উঁচু বাক্যে কথা বলেন না ঠিক আছে। শান্তভাবেও বলা যায়। শুধু কন্ঠ জোর রাখতে হয়।”
এটা বলে শান্ত চলে যায়। আমি তার চলে যাওয়া দেখতে থাকি। শান্ত গিয়ে দোকানটায় বসলো। একটি সিগারেট ধরিয়ে তাতে টান দিলো। আমি তাকিয়ে আছি বুঝতে পেরে ভেঙচি দিয়ে আমার দিকে ধোঁয়া ছেড়ে দিচ্ছে বোঝালো। আমি এটা দেখে ম্লান হাসলাম। অতঃপর বাড়ির পথে হাঁটা ধরলাম।
পুষ্পের চলে যাওয়া দেখে শান্ত মুচকি হাসে। তারপর মনেমনে বলে,“আমার বাচ্চামোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেদিন ইচ্ছেঘুড়ি আকাশে উড়িয়ে দিয়েছিলেন মিস। সেটা আমি দেখেছি। ঘুড়িটা তো নিচেই পড়েছিলো। আমি জানি না, আপনি কী চেয়েছেন। তবে আমার মনে হয় আপনার জীবনটা পরিবর্তন হওয়া জরুরি। সেটা হলে আপনার চাওয়া এমনি পূরণ হয়ে যাবে। তাই আমার বাচ্চামোকে সত্যি প্রমাণ করতেই এটা করছি। নয়তো শান্ত কোন মেয়ের সঙ্গে এত কথা বলে না।”
শেষ কথাটি খুব ভাব নিয়ে বলে শান্ত। নিজের কথা ভেবে নিজেই মনেমনে হাসে।
____
আমি বাসায় ফিরতে কাজল আমাকে কান্না করে বললো,“আপু বাবা, মাকে ফিরে আসতে বল না। আমি এই বিয়েটা করবো না। তারা বিয়ে ভেঙে দিয়েছে সেখানে বাবা-মায়ের এত খবরদারি করে কেন বিয়ে যাতে না ভাঙে সেটার জন্য যেতে হবে?”
আমি এই কথার জবাব দিতে পারলাম না। পরক্ষণে কাজল তার ফোন বের করে বলে,“দেখ ছেলেটা কত খারাপ। এমন ছেলেকে বিয়ে করা যায়?” আমি ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে থ হয়ে গেলাম। বিয়ে ঠিক হতে না হতে ছেলেটা কাজলকে নেগেটিভ ম্যাসেজ পাঠাতে শুরু করেছে। এই ছেলেটা যে কত ফালতু সেটা এই একটি বিষয়ে বুঝে গেলাম। আমি এটা দেখে বললাম,“এই ছেলের সঙ্গে তোকে বিয়ে করতে হবে না। এই ছেলেটা তোর যোগ্য নয়।” কাজল এটা শুনে মাথা নাড়ায়।
প্রায় দুই ঘন্টা পর, বাবা মা ফিরে আসে। তাদের কাছে কাজল সব খুলে বলে। তারপর বাবা বলে,“ছেলেটা ভালো চাকরি করতো। পরিবারটা ভালো ছিলো। কিন্তু তারা আমাদের কোন কথাই শুনলো না। বিয়েটা ভাঙলো তো ভাঙলোই। উল্টো এই ম্যাসেজের জবাবে কাজলের বকাবকির কথা সরাসরি না বলে ছেলেটা বললো, সে তোকে পরীক্ষা করে নিয়েছে। তুইও অসুস্থ।”
বাবার মুখে এই কথা শুনে কাজল রাগ নিয়ে তাদের দিকে তাকায়। মা সেসবে পাত্তা না দিয়ে আমাকে দেখে বলে,“সব হয়েছে তোর জন্য।”
মায়ের রাগান্বিত কন্ঠে বলা কথাটি আমাকে বিচলিত করতে পারলো না। বরং হেসে হেসে আমি বললাম,“হ্যাঁ আমারই দোষ। যেদিন পাড়ায় রটে গিয়েছিলো আমার সমস্যা রয়েছে। সেদিনই এই কথা যে বলেছে তাকে আমার থাপ্পড় মা রা উচিত ছিলো। আমি তো মা রার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। কিন্তু এসে শুনি সেই কথা তুমি বলেছো। অতঃপর আমার আর মা রা হলো না। তুমি তো আমার মা। তোমাকে আমি মা রতে পারি?”
আমি খুবই শান্ত গলায় হেসে হেসে কথাটি বলি তাই মা এবং বাবা হচচকিয়ে যায়। অন্যদিকে কাজল আমার মুখ থেকে এমন কথা শুনে বিষ্ময়ে নিজেই নিজেকে চিমটি দেয়। যে সে সত্যি দেখছে কি-না। আমি ম্লান হেসে কিছুটা ভাব নিয়ে চলে আসলাম। গত দুই ঘন্টা ধরে আমি শান্তর কথা ভেবে মনেমনে সাজিয়ে নিয়েছিলাম কথাটা কিভাবে বলবো? ঘরের মধ্যে একা একা অনেকবার চেষ্টা করেছি। প্রথম দিকে হচ্ছিলো না। মুখে হাসি রেখে কথাটি বলতেই পারছিলাম না। অতঃপর দুই ঘন্টার চেষ্টায় সফল হলাম। আমার কথা শুনে বাবা, মায়ও কোন কথা বলতে পারলো না। তারা কয়েক মূহুর্তে জন্য থ হয়ে গিয়েছে।
’
’
’
চলবে,