ইচ্ছেঘুড়ি পর্ব-০৮

0
21

#ইচ্ছেঘুড়ি (৮)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

বাবা, মা আমার ব্যবহারে কয়েক মূহুর্তে হতভম্ব হয়ে বসে থাকলেও পরে খুব রেগে যায়। তবে রাগটা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে তারা কাজলের বিয়ে নিয়ে আলোচনায় বসে যায়। একবার যে কারণে বিয়ে ভেঙেছে, একই কারণে তো বারবার ভাঙতে পারে। এসব ভাবনা আসতে তাদের চোখেমুখে চিন্তার ছাপ ভেসে উঠে। এক পর্যায়ে মা বলে,“চেয়েছিলাম বড়টার বিয়ের জন্য এত পাত্রপক্ষের হদিস যাতে না আসে। এখন সেটাই আমার কাজলের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো।”

“এজন্যই বলেছিলাম মুখে কথা আসলেই সেটা বলে দিও না। একটু ভেবেচিন্তে কথা বলো। কিন্তু তুমি তো তুমি।”
বাবার এসব কথায় মা বিরক্ত হয়ে চলে যায়। বাবা সেসবে পাত্তা না দিয়ে কাউকে ফোন দিয়ে ভালো পাত্রের সন্ধান দিতে বলে। ঘরের মধ্যে বসে তাদের এসব আলোচনা শুনে কিছুটা বিরক্ত হলাম। বিরক্তি কাটাতে ফোনে মুভি দেখতে শুরু করলাম৷
___
রাত বারোটার দিকে শান্ত বাসায় ফেরে। সচরাচর এত দ্রুত আসে না। শান্ত সবসময় রাত দুইটা তিনটা বাজলে বাসায় আসে। যেই সময়ে তার বাবা ঘুমিয়ে থাকে। তবে আজ তার বাবা জেগেই ছিলো। শান্তকে দেখে কিছুটা রাগান্বিত গলায় বলে,“বাসায় ফেরার কী দরকার? রাস্তায় গাছতলায় রাতটা পার করে দিতে পারো না।”

”রাস্তায় পার করা যায়। কিন্তু আমি রাস্তায় ঘুমিয়ে পড়লে যদি লোকে পাগল ভেবে ধরেবেধে মানসিক হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়? তখন তো আমাকে নিয়ে আসতে তোমারই কষ্ট করে সেখানে যেতে হবে। কত দৌঁড়ঝাপ করতে হবে। এই বয়সে তোমার এত দৌঁড়ঝাপ করা শরীরের জন্য ভালো হবে না।”
শান্ত তার স্বভাব মতো হাসি মুখে ধরে রেখে কথাগুলো বলে। এসব শুনে শান্তর বাবা রাগান্বিত গলায় কিছুটা উচ্চশব্দে বলে,”চুপ করো বেয়াদব ছেলে। তোমার জন্য আমি পাড়ায় মুখ দেখাতে পারি না। সবার মুখে মুখে তোমার গুণকীর্তন। এই বয়সে কোথায় তুমি পরিবারের দায়িত্ব নিবে, আমাকে এবং তোমার মাকে একটু শান্তি দিবে। তা না করে তুমি আমাদের শান্তি নষ্ট করছো। লজ্জা করে না এতবড় আধ দামড়া ছেলে হয়ে বাচ্চাদের সঙ্গে দুষ্টুমি করতে, পাড়ার বখাটেদের সাথে মারা মারি করতে। আড্ডাবাজি করতে। সামান্যতম লজ্জা হয় না নিজের কর্মকান্ড নিয়ে। আমার তো লজ্জা করে।”

”তাহলে লজ্জার ভ্যাকসিন নিয়ে নাও।”
এটা বলে শান্ত ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়। যাবার সময় তার মায়ের মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,“আরে মা। কী সবসময় মুখটা বাংলার পাঁচের মতো করে রাখো। না তোমার স্বামী মারা গেছে, না ছেলে। তো সারাদিন এমন মুখ করে রাখো কেন?”

”শান্ত।”
মা কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলে। শান্ত মিষ্টি হেসে ঘরে চলে যায়। এদিকে শান্তর বাবা তাকে বকাঝকা করছে। শান্তর মা তাকে সামলানোর চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। সে থামার নাম নিচ্ছে না। এসব দেখে শান্তর মা বলে,“এত বকাবকি করে লাভ কী হচ্ছে? তুমি যাকে বকছো গিয়ে দেখো সে কানে ইয়ারফোন গুজে গান শুনছে। সে তোমার কথায় কোন পাত্তায় দিচ্ছে না। শুধু শুধু এত জোরে কথা বলে নিজের প্রেশার বাড়াচ্ছো।”

“বাহ্। এখন দেখছি তুমিও ছেলের মতো বলতে শুরু করেছো। তোমার লাই পেয়েই ছেলেটা এমন উচ্ছিন্নে গিয়েছে। যখনই টাকা চায় দিয়ে দাও। এটা করেই তাকে আড্ডাবাজি করার সুযোগ করে দিয়েছো। হাতে পয়সা না থাকলে ঠিকই চাকরি খুঁজতো নয়তো দিন মজুরি করে কাটাতো। তাও কিছু একটা করতো। কিন্তু তুমি…।”
শান্তর বাবার এসব কথায় মা মলিন গলায় বলে,“একটা সময় তো তোমার কথা শুনতো। তুমি যা বলতে তাই করতো। তাও তো দিনশেষে শুধু বকতে। আর তোমার বকা শুনে ও সারাদিন মনমরা হয়ে বসে থাকতো। বড় হওয়ার আগ অব্দি তো কান্না করেই কাটাতো। আর আজ যখন ও তোমার কথায় মনমরা হয়ে না কাটিয়ে হাসি-খুশি ভাবে জবাব দিচ্ছে তখন তোমার মনে হচ্ছে ছেলেটা উচ্ছিন্নে গেছে? এসব করার আগে তো ভালো ছিলো। কই তখন তো দেখলাম না একটু প্রশংসা করেছো।”

”তুমিও একই কথা বলছো?”
বাবা অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকায়। মা মাথা নাড়িয়ে বলে,“হ্যাঁ। আমি জানি আমিও একই ভুল বারবার করেছি। কিন্তু আজ আমি বুঝি আমার ছেলের মনের ব্যথা। যেটা সে ভুলে ভালো থাকার চেষ্টা করছে। তাই আমি তার ভালো থাকার মাঝে বাধা হচ্ছি না। আর না হবো। হতে পারে ওর সব কর্মকান্ড ঠিক নয়। কিন্তু তাই বলে যে ও পুরোটা ভুল এমন নয়। লোকে ওর সম্পর্কে যা বলে সেটা সব সঠিক নয়। কারণ আর যাই হোক পাড়া প্রতিবেশীরা কখনো সত্যি কথা পুরো বলে না। তারা তাতে তেল ঝাল মশলা মিলিয়ে প্রচার করে। এসব আমি আগে বুঝতাম না। তবে এখন বুঝি।”

”তারমানে তুমি বলতে চাও কি তোমার ছেলে সারাজীবন এমন থাকুক?”
বাবার এই কথা মা মাথা নাড়িয়ে না জানায়। অতঃপর বলে,“আমি বিশ্বাস করি সময় হলে শান্ত ঠিক আবার চাকরি করতে ইচ্ছা প্রকাশ করবে। আর একটা সময় ঠিক করবেও। এখন আমরা দুজনেই চাকরি করছি, ওর জন্য অনেককিছু করেছি বলেই হয়তো ওর মনে হয় সব থাকতে আমি কেন এত কষ্ট করবো? তাই ও অন্যের কথা শুনে তার অধিনে জব করতে চাইছে না। তবে একটা সময় পর ও ঠিকই বুঝবে ওর জীবনে কিছু করা উচিত।”

”হ্যাঁ এই করে করে ছেলেটার মাথা এমনি খারাপ আরও খারাপ করে দাও। এভাবে আস্কারা দিয়ে মাথায় তুলে নাচো।”
এসব বলে শান্তর বাবা রেগে চলে যায়। তবে যাবার সময় বলে,“এখন তোমার নবাবজাদাকে ডেকে এনে ভাত খাওয়াও। আমার কষ্টের টাকার খাবার এভাবেই অপাত্রে ঢালো।” শান্ত ভেতরে বসে এসব কিছুই শুনতে পায় না। কারণ সে বাস্তবেই গান শুনছে। তবে সে জানে বাহিরে এসব আলোচনাই হচ্ছে। এসব শুনতে শুনতে তার মুখস্থ। তাই এসবে সে পাত্তা না দিতেই নিজের মতো গান শুনে সময়টাকে উপভোগ করছিলো। একটু পর মায়ের ডাক শুনে শান্ত বুঝতে পারে বাবার মাইক থেমে গেছে। এবার খাবার খেতে যাওয়া উচিত। সেই সাথে মায়ের থেকে কিছু টাকাও নিতে হবে।
___

সকালবেলা নাস্তা খেতে বসলে মা রাতের ঘটনা নিয়ে কথা শোনাতে শুরু করে। কন্ঠ আবেগ ফুটিয়ে তুলে ধরে,“সেই ছোটবেলা থেকে তোকে বড় করেছি। ঋন করে ঘর তুলেছি, তোদের চাহিদা মিটিয়েছি। আজ যখন একটা চাকরি করছিস, দুটো পয়সা কামাচ্ছিস তখন আমরা সেটা দিয়ে ঋন শোধ করতে চাইলে সেটা আমাদের অপরাধ। সংসার চালাতে চাইলে অপরাধ। বাহ্। এত ত্যাগ করে লাভ হলো কী? এমনও দিন গেছে একবেলা খেয়ে বাকি দুইবেলা না খেয়ে থেকেছি। তোদের মুখে খাবার তুলে দিতে। আর আজ সেই মেয়ে কথা শোনাচ্ছে। আমার দোষ। হ্যাঁ আমার দোষ। সেদিন কেন বললাম তোর সমস্যা আছে। পাত্রপক্ষ আসতো কয়েক লাখ টাকা ঋন করে বিয়ে দিয়ে দিতাম। তারপর খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতাম। তাহলে তো আজ তোর মুখে এতবড় কথা শুনতে হতো না।”
মায়ের এসব কথায় বিরক্ত হয়ে না খেয়ে উঠে গেলাম। অফিসের উদ্দেশ্য বের হয়ে গেলাম। এটা দেখে মা হয়তো অনেক বকাবকি করছে। তবে তার কথা শোনার ইচ্ছা মোটেও নেই। তাই বের হয়ে আসলাম। মাঝপথে শান্ত এসে সামনে দাঁড়ালো। আমি বিরক্তি নিয়ে তাকে একবার দেখে হাঁটতে শুরু করলাম। কথা বলার একদম ইচ্ছা নেই। তবে এসবে শান্ত তেমন পাত্তা দিলো না। সে নিজের মতো বলে,“মানুষজন এত বোরিং জীবন কিভাবে কাটায় আমি বুঝি না। রোজ সকাল সকাল অফিসের জন্য বের হয়। তারপর সন্ধ্যায় বাড়ি আসে। এভাবে অফিস টু বাড়ি, বাড়ি টু অফিস করে দিন কাটায়। কিভাবে সম্ভব? একটা মানুষ এমন বোরিং জীবন কিভাবে কাটায়?”

“অহেতুক কথা না বলে নিজের কাজ করুন।”
আমি যথেষ্ট বিরক্তি নিয়ে কথাটি বললাম। এটা দেখে শান্ত বলে,“রোজ একই কাজ করতে হবে এমন তো কোন নিয়ম নেই। তাই আমি আজ ঠিক করেছি নিজের কাজ বাদ দিয়ে একটি বোরিং মেয়ের সাথে কাটানোর।”

“মানে? সম্ভব নয়। আমার অফিস আছে।”
এটা শুনে শান্ত অবাক হওয়ার ভান ধরে বলে,“আপনার অফিস আছে তো?”

“আমি অফিসে থাকলে আপনি সারাদিন আমার সাথে কিভাবে কাটাবেন?”

“তারমানে আপনি স্বীকার করলেন আপনি বোরিং জীবন কাটাচ্ছেন।”
শান্ত একটু দৌঁড়ে আমার সামনে এসে কথাটি বলে। শান্ত সামনে আসতে আমি থেমে গেলাম। শান্ত কৌতূহলী হয়ে বললো,“স্বীকার করলেন বোরিং জীবন। তাই না?”

“আচ্ছা স্বীকার করলাম।”
আমি কথা বাড়াতে চাচ্ছিলাম না। তাই শান্তকে কোনরকম কাটিয়ে চলে যেতে চাচ্ছিলাম। শান্ত আমার জবাব শুনে বলে,“এমন বোরিং জীবন কাটাতে আপনার ভালো লাগে?”

“ভালো না লাগলেও লাগাতে হয়। এই অফিস বাড়ি, বাড়ি অফিস করে মাস শেষে আমি টাকা পাই। যেই টাকায় আমাদের মধ্যবিত্ত সংসার চলে।”
এটা শুনে শান্ত শব্দ করে হেসে দেয়। অতঃপর হাসতে হাসতে বলে,“অথচ সেই টাকা দিয়ে শুধু যাতায়াত ভাড়া ছাড়া নিজের প্রয়োজনে এক পয়সাও ব্যবহার করা হয় না। এরমানে কী দাঁড়ালো? নিজের কষ্টে উপার্জিত টাকায় নিজেরই কোন শখ পূরণ হয় না। দিনশেষে এত বোরিং জীবনের ফলাফল শূন্য।”
শান্তর এই কথাটি শুনে আমি থমকে গেলাম। শান্ত মুখে হাসি ধরে রেখে বলে,“কোথাও লেখা নেই রোজ একইরকম ভাবে জীবন কাটাতে হবে। রোজ অফিস যেতেই হবে। মাসে এক দুইদিন ছুটি নিলে খুব বেশি ক্ষতি হয় না।”

“আপনি কী চান বলুন তো?”
আমি জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে শান্তর দিকে তাকিয়ে কথাটি বললাম। শান্ত ম্লান হেসে বলে,“আমি চাই আপনি আজ অফিস ছুটি নিয়ে আমার সঙ্গে নিজের জীবনটা উপভোগ করুন।”

“তাতে আপনার লাভ?”
আমার এই কথায় শান্ত চুপ হয়ে যায়। তার মুখের হাসি বিলীন হয়ে যায়। পরক্ষণে মুখে একইরকম হাসি ফুটিয়ে বলে,“তাহলে আমার একটি বাচ্চামো কারো কাছে সত্যি হয়ে যাবে।”

আমি শান্তর কথা বুঝতে না পেরে তার চোখের দিকে তাকালাম। শান্ত সেটা বুঝতে পেরে বলে,“সব বুঝতে হবে না। একদিন ছুটি নিয়ে দেখুনই না। সবসময় নিয়মে চলতে হবে তার তো কোন মানে নেই। একবার নিয়ম ভেঙেই দেখুন। নিয়ম ভাঙায় ভীষণ মজা।”

“আপনি জানেন আপনার সাথে আমার যে এখন রোজ কথা হয় এটা পাড়ার লোক লক্ষ্য করলে কত কী রটে যাবে?”
আমার কথা শুনে শান্তর মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সে বিরক্তি নিয়ে বলে,“ওমনি কাকি মা টাইপ কথাবার্তা শুরু করে দিলেন। আরে ভাই কে জানি বলেছিলো মেয়েদের যতই বয়স হোক না কেন তারা সবসময় নিজেদের মনের বয়স ষোলো রাখে। শালার যে বলেছিলো তাকে সামনে পেলে আমি আপনাকে তাকে দেখিয়ে বলতাম। দেখ শালা দেখ। এর বয়স আটাশ আর মনের বয়স চল্লিশ। একটা পাড়ার কুচুকে কাকির আত্মা ভর করে আছে যেন।”
শান্ত কথাগুলো এমনভাবে বললো যে না চাইতেও হেসে দিলাম। হাসির শব্দ কিছুটা জোরে হয়ে গেছে বুঝতে পেরে আমি থেমে গেলাম। এটা দেখে শান্ত বলে,“একদিন ধরেই নিন না আপনি ছাড়া কোথাও কেউ নেই। শুধু আপনি আছেন। সেটা ভেবে মন খুলে হাসুন। যা করতে মন চায় করুন। একদিন নিজেকে নাই বা ঠকালেন।”
শান্তর এই কথাটি আমার ভীষণ ভালো লাগলো। আমার থেকে ছোট একটি ছেলে আমাকে জীবনকে নতুনভাবে বাঁচতে শেখাচ্ছে। আমার মনও বললো শান্তর এই কথাটি শোনা উচিত। অতঃপর মনখুলে হাসতে শুরু করলাম। নিজের হাসিটাকে হৃদয়ে লুকিয়ে না রেখে মনখুলে সবার সামনে হাসতে শুরু করলাম। আমার হাসির সঙ্গে তাল মেলালো শান্ত। সেও আমার সঙ্গে হেসে উঠলো।


চলবে,