ইচ্ছেঘুড়ি পর্ব-১৭+১৮

0
23

#ইচ্ছেঘুড়ি (১৭)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

আমি আমার গন্তব্যে বেশ ভালোভাবে পৌঁছে গেলাম৷ যদিও কিছুটা ভয় কাজ করছিলো। তবে অফিস থেকে বলে দেওয়া স্থানে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। সেখান থেকে একজন আমাকে আমার ঘর দেখিয়ে দিলো। সে আগে থেকেই জানতো আমি আসবো। তার সঙ্গে কুশল বিনিময় করে ঘরে এসে কিছুটা বিশ্রাম নিলাম। থাকার জন্য ঘর দিলেও সেখানে তেমন কোন জিনিসপত্র দেওয়া হয়নি। প্রয়োজনীয় কয়েকটা জিনিস কিনতে হবে। যদিও এত টাকা হাতে নেই। তবে এই টাকার মাঝে যা হয়। কিন্তু এখান থেকে আবার একা এসব কিনতে বের হতে হবে ভাবতে কিছুটা ভীত হলাম। ঘরের মধ্যে বসে নিজেই নিজেকে মোটিভেশন দিচ্ছিলাম। সেই মূহুর্তে ফোনে শান্তর একটি ম্যাসেজ এলো। যেখানে লেখা,“সঙ্গ পেলে মানুষ তাতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। আপনিও তেমনটা করছেন। এটা ভুল পুষ্প। আমার সঙ্গে কাটিয়ে আপনি ধীরে ধীরে যে পরিবর্তন নিজের মধ্যে এনেছিলেন, আমি চলে আসতে আপনার সেই পরিবর্তন থমকে গিয়েছে। আপনি আবার আগের পুষ্পের মতো ঘরের মধ্যে জমে ছিলেন। তাতেই বুঝে গিয়েছিলাম আমি আপনাকে সঙ্গ দিয়ে পরিবর্তন করে ভুল করেছি। বরং আপনাকে একা একা সবকিছু করানো উচিত ছিলো। তবে এবার আর আমি সেই ভুল করছি না। আমি আর আপনার সঙ্গে দেখা করছি না। তাই সাবধানে এবং বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে একাই জীবনটা সাজান। বিশ্বাস করুন ঠকবেন না। মনোবল রাখুন, আপনি পারবেন। নিশ্চয় পারবেন।”
আমি শান্তর ম্যাসেজ মেয়ে মুচকি হাসি দিলাম। সত্যি তাই। আমি এই শহরের বুকে আসার সাহস জীবনেও করতে পারতাম না। যদি না জানতাম এখানে শান্ত আছে। সে আমার সঙ্গ দিবে। একা এসে এখানে জীবন কাটাতে হবে এটা জানলে এতদূর কখনো আসা হতো না। তাই হয়তো শান্ত প্রথমে বলেছে, সে আমাকে বাস স্টেশন থেকে নিতে আসবে। আমি চলে আসার পর নিজের আসল সিদ্ধান্ত জানালো। শান্ত যা করছে সেটা যে আমার ভালোর জন্য এটা আমি বেশ বুঝলাম। আমিও মনেমনে ঠিক করে নিলাম, এটা আমার লড়াই। আমাকে একাই সবটুকু পথ পাড়ি দিতে হবে। অতঃপর কিছু একটা ভেবে শান্তকে ফোন দিলাম। শান্ত ফোনটি ধরে বলে,“বলেন মিস।”

“হঠাৎ হঠাৎ ফোন বন্ধ করে দেন কেন?
কথাগুলো তো ভালোভাবে বলেও ফোনটা রাখা যায়। তাই নয় কি?”
আমার এই কথা শুনে শান্ত হাসে। তার হাসির শব্দ শুনে আমি কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে যাই। আমার স্মৃতিতে তার হাসিমাখা মুখটি ভেসে উঠে। এরই মাঝে শান্ত বলে,“আপনাকে ভালোভাবে বোঝানো সম্ভব নয়। তখন আমার ফোন খোলা থাকলে আপনি অনুরোধ করতেন আপনার কাছে আসার জন্য। যেহেতু আমার ফোনটা বন্ধ ছিলো, তাই উপায় না পেয়ে আপনাকে সামনে এগিয়ে যেতে হয়। আসলে দেওয়ালে পিঠ না ঠেকলে কেউ বড় বড় সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তার উপর আপনি তো দেওয়ালে পিঠ ঠেকার পরও সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। তাই আমাকে হঠাৎ হঠাৎ ফোন বন্ধ করতে হয়।”
শান্তর এই কথা শুনে আমি ম্লান হাসলাম। শান্ত আমার জবাব না পেয়ে বলে,“চলার পথে সঙ্গী থাকা ভালো। তবে সেই সঙ্গীর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়াটা উচিত নয়।”

“আপনি সবসময় এত চমৎকার কথা বলেন কেন?”
আমার এই কথার জবাবে শান্ত হাসে। অতঃপর ভাব নিয়ে বলে,“কারণ আমি চমৎকার মানুষ। আমি তো আপনার জেনারেশনের নই।”

“তাই বুঝি?”
আমি তার মজায় তাল দিয়ে বললাম। শান্ত সম্মতি জানিয়ে বলে,“তাই। আমার শরীরের বয়স যাই হোক মনটা যোলো বছরের।”

“তা এই ষোলো বছরের মন দিয়ে ব্যবসাটা কেমন করছেন? ব্যবসা করতে তো একটু অভিজ্ঞ মন দরকার। পারছেন ঠিকভাবে?”

“অবশ্যই পারছি।
হ্যাঁ প্রথম দিকে একটু লস চলছে। তবে চাপ নেই হয়ে যাবে।”
এখানে শান্তর কথায় বুঝলাম সে ওখানে বসেও পাগলামি করছে। এলাকার তার বয়সী কিছু ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে নিয়েছে। তাদের সঙ্গে নিয়ে দোকানে বসে আড্ডা দেয় কাস্টমার না থাকলে। আর কিছু বেঁচাকেনা যাতে হয় সেজন্য জামা-কাপড়ের দাম একদম কম লাগছে। তার কেনা দাম থেকে সামান্য বেশি। এসব শুনে আমি অবাক হয়ে বলি,“এভাবে চললে জীবনে উন্নতি করতে পারবেন?”

”পারবো। এটা আমি মিস। আপনার মতো সাধারণ চিন্তা ভাবনা আমি করি না। সবার মতো যদি আমি ভাবতাম তবে তো আমার এবং অন্যদের মাঝে কোন পার্থক্য থাকতো না।”
শান্তর ভাব নিয়ে বলা এই কথাটি আমার হজম হলো না। আমি যে কিছু বুঝতে পারিনি এটা বুঝে শান্ত বলে,“নতুন দোকান। কাস্টমার না চিনলে আসবে? তাদের চেনানোর জন্য এখন কম দামে মাল ছাড়তে হচ্ছে। অন্য দোকানের তুলনায় দাম কম শুনলে কাস্টমার ধীরে ধীরে এমনি বেড়ে যাবে। এক কাস্টমার বারবার রিপিট হবে। তো একটা সময় তারা আমার চেনা হয়ে যাবে। তাদের এটাও বিশ্বাস হয়ে যাবে আমার দোকানে কম দামে ভালো মাল পাওয়া যায়। সেই সময়ে হুট করে লাভের অংশ বাড়িয়ে দিবো। সচরাচর অন্য দোকানের চেয়ে দাম কম থাকে আমার দোকানে বুঝতে পেরে তারা ঐসময়ও আমার দোকান থেকেই কিনবে। আর তখন এখন যেটা লস হচ্ছে সেটা উসূল হয়ে যাবে। যদিও এখন লস হচ্ছে না। কিন্তু হ্যাঁ দোকান ভাড়া সহ আরও যাবতীয় খরচ শেষ করলে হাতে পয়সা একদমই থাকবে না বলা যায়। এভাবে বড় ব্যবসাও দেওয়া যাবে না। তবে সাময়িক এই সমস্যা মিটিয়ে উঠলে পরবর্তীতে এমনি ভালো হয়ে যাবে।”
শান্তর এসব কথা শুনে চমকে গেলাম। তার বুদ্ধি অসাধারণ। তবে আমি কিছুটা ভাবনায় পড়ে বললাম,“কিন্তু ভবিষ্যতে তারা লাভ বাড়িয়ে দিলে কিনবে? যদি না কিনে তখন তো লস প্রাইজে ছাড়তে হবে।”
আমার এই কথা শুনে শান্ত বিরক্ত হয়ে বলে,“কাকি মা ভাব কমাবেন না। আরে কাকি মায়েরা সবসময় নেগেটিভ কথা বলে। কিন্তু আমি আপনার থেকে এসব কথা আশা করি না। সবসময় পজেটিভ ভাববেন। বুঝলেন?”
আমি সম্মতি জানালাম। শান্ত পরক্ষণে মজারসুরে বলে,“আপনি জানেন এখানে গলির মধ্যে একটি দোকান আছে। সেখানে সেই জমে। পুরো দুপুর আমি সেখানেই কাটাই বন্ধুদের সঙ্গে। একসঙ্গে সবাই মিলে সেই জমে। একসঙ্গে সিগারেট খাওয়া, ক্রাম খেলা। পুরো জমে যায়। ইশ মেয়ে হয়ে আপনি এসব মিস করলেন।”

“যদি এসবই করেন। তবে ব্যবসা কখন করেন?”
আমার এই কথা শুনে শান্ত হাসি থামিয়ে বলে,“একদম আমার বাবার মতো কথা বলেন আপনি। যাই হোক প্রতি শুক্রবার আমার দোকান বন্ধ। ঐদিন আমার আড্ডা দেওয়ার সময়। আর সকাল ৯ টা থেকে ১টা এবং বিকাল ৫টা থেকে রাত ১০টা অব্দি ব্যবসা করি। বাকি সময় এসব করি।”
আমি শান্তর কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। হতভম্ব গলায় বললাম,“বাসায় যান কখন?”

“ঐ তো রাত দুইটা তিনটায়। এজন্যই তো চাচার বাসায় থাকছি না। সেখানে থাকলে এসব করা হতো না। বাবা, মায়ের মতো কি অন্যদের আর বলা যায়?”
শান্তর এই কথা শুনে আমি কৌতূহলী হয়ে বললাম,“আপনি এসবও ভাবেন?”

“না। একদম ভাবি না। কিন্তু চাচার জন্য এত সহজে এখানে দোকান খুলতে পারলাম তো। তাই তার সঙ্গে তর্কে জড়াতে চাই না। এজন্য যেখানে থাকলে নিজের খুশি মতো থাকা যাবে সেখানে থাকছি।”
শান্তর মুখে এই কথা শুনে অবাক হলাম না। শান্ত চরিত্রটার সঙ্গে যতটা পরিচয় হয়েছে ততটায় এই উত্তর আশা করছিলাম। আমি এসব প্রসঙ্গ বদলে বললাম,“আপনি আমার সঙ্গে দেখা কবে করবেন?”

“যেদিন আপনি এই শহরের আলো বাতাসের সঙ্গে মানিয়ে নিবেন। সবচেয়ে বড় কথার নিজের সঙ্গে নিজে মানিয়ে নিবেন। সেদিন আমি নই আপনি নিজে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন। আমাদের সেদিনই দেখা হবে। অন্যরকম দেখা।”
আমি শান্তর কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। কয়েক লাইনের বাক্য। কিন্তু ভাবার্থ কত গভীর! এটা ভাবতেই শান্ত আবার বললো,“অন্যরকম এক আপনির সঙ্গে অন্যরকম দেখা করতে আমি খুব আগ্রহী। আশা করি আমার এই ইচ্ছে খুব দ্রুত পূরণ হবে।”
আমি শান্তর কথার জবাব না দিয়ে ফোন কেটে দিলাম। বসে বসে তার কথাগুলো ভাবছিলাম। অতঃপর প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস কিনতে বাহিরে বের হলাম। আমার হৃদয় শান্তর সঙ্গে দেখা করতে চাচ্ছে। জানি না কেন? তবে চাচ্ছে। সেই দেখা করার জন্য হলেও আমাকে সবকিছুর সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারতে হবে। পারতেই হবে। তাছাড়া আমি জানি শান্ত আমার খারাপ চায় না। সে মানুষটি এমন যে কারো খারাপ চায় না। তাই তার কথা শুনে চললে আমার জীবনটা সত্যি অন্যরকম হবে। আমি আমার মাঝে অন্যরকম একজনকে খুঁজে পাবো। যার হৃদয়ের গভীরে অনেক ইচ্ছেরা জমে আছে। যেগুলো পূরণ হতে চাচ্ছে। এসব ভেবে বেরিয়ে পড়লাম। একটি অটোতে উঠে স্থানীয় মার্কেটে যেতে চাইলাম। সেই মূহুর্তে শান্ত একটি ম্যাসেজ পাঠায়। যাতে লেখা,“স্মার্ট হতে হবে। কাউকে বুঝতে দিলে চলবে না আপনি এখানে নতুন কিংবা যে জায়গায় যাবেন সেটা চিনেন না। আপনাকে এমনভাবে কথা বলতে হবে যাতে অন্যরা বুঝে আপনি ওখানে বারবার গিয়েছেন। এগুলো শেখাও জরুরি। অবশ্যই আপনার জন্য।”
আমি ম্যাসেজটি দু’বার পড়লাম। অতঃপর মুচকি হাসি দিলাম। এই হাসির অর্থ শান্ত সেই সময়ে বাস স্টেশনে ঠিকই এসেছিলো। তবে সে সামনে এসে আমাকে ধরা দেয়নি। দূরে থেকে আমাকে দেখেছে। এটা ভেবে আমার খুশি লাগছে। হঠাৎ আমার মন বলে উঠলে,“একজন প্রকৃত বন্ধু বুঝি এমন হয়। বন্ধুত্বের এই সংঙ্গা শান্ত না আসলে শিখতাম না। সব বন্ধু যে স্বার্থপর নয় সেটা বোঝার জন্য হলেও সবার জীবনে একজন শান্ত থাকা জরুরি।”


চলবে,

#ইচ্ছেঘুড়ি (১৮)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

বিছানার উপর অনবরত কাজলের ফোনটি বেজে চলেছে। সে বিছানার একপাশে বসা। তবুও ফোনটি তুলছে না। এটা দেখে জয় কিছুটা অবাক হয়। সে অবাক কন্ঠেই বলে,“কী হয়েছে? কার ফোন যে তুলছো না?”
“মায়ের।”
কাজল শান্ত গলায় জবাব দেয়। জয় কৌতূহলী হয়ে বলে,“ধরছো না কেন তবে? মা বিয়ে দিয়ে শ্বশুড়বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে বলে অভিমান করেছো?”
শেষ কথাটি কিছুটা মজার সুরেই বলে। কাজল সেটা কানে না নিয়ে শান্ত গলায় বলে,“আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে পারি জয়?”
কাজলের এই কথা শুনে জয় কিছুটা হতভম্ব হয়ে যায়। কাজল ম্লান হেসে বলে,“তুমি আমার স্বামী। এই ক’দিনে আমি তোমাকে যতটা চিনেছি ততটা জেনেই তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। সেই ভালোবাসার উপর আমি সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারি?”
”হ্যাঁ। বিশ্বাস করে দেখো হয়তো ঠকবে না।”
জয় খুব সুন্দরভাবে কথাটি বলে। কাজল তার কাছে এগিয়ে আসে। সে জয়ের সামনে দাঁড়িয়ে শান্ত চোখে তাকিয়ে বলে,“আমি আমার বাবা, মায়ের সাথে সব সম্পর্ক শেষ করতে চাই।”
“কি!”
জয় হতভম্ব হয়ে যায় পুরো। কাজল তাকে সামলে বলে,“আমি আমার বাবা, মায়ের মতো নই। বিশ্বাস করো একদমই তাদের মতো নই। হতেও চাই না। সেই সঙ্গে আমি মহানও নই। আমার আপার মতো ক্ষমা আমি করতে পারি না। আমি জানি আমার বাবা, মা কখনো শুধরাবে না। তবুও আমি তাদের বোঝাতে চাই তারা যা করেছে সেটা ভুল। তারা আমাকে খুব ভালোবাসে। নিজের সন্তান যে। সেই সন্তান দূরে চলে গেলে অবশ্যই তারা কিছুটা হলেও বুঝবে। তাই না?”
জয় কিছুই বুঝতে পারে না। তখন কাজল তাকে পুরো ঘটনা খুলে বলে৷ সব শুনে জয় কিছুটা দুঃখ প্রকাশ করে পুষ্পের জন্য। কাজল জয়কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,“আমি আমার আপাকে খুব ভালোবাসি জয়। অথচ আমার জন্মই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ এত নিষ্ঠুর কিভাবে হয়? এক ছাদের নিচে এতটা বছর কাটিয়ে নূন্যতম মায়া জন্মালো না তাদের? আমার বাবা, মা এত নিষ্ঠুর? আমি এসব মানতেই পারছি না। কিছুতেই মানতে পারছি না জয়।”
জয় এখানে কাজলকে সামলানোর চেষ্টা করে। তাকে যতটা পারে বোঝানোর চেষ্টা করে। কাজল কিছুটা শান্ত হলে জয় বলে,“এবার আমাকে অফিসে যেতে হবে।”
কাজল এই কথা শুনে মাথা নাড়ায়। সে জয়কে ছেড়ে দেয়। জয় তাকে বিদায় জানিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়। জয় বেরিয়ে যেতে তার মা ঘরে এসে কাজলের উদ্দেশ্য বলে,“বেলা কত হয়েছে খবর আছে? এই যুগের বৌমাদের কোন লাজ শরম নাই, স্বামীর সঙ্গে চিপকে থাকে। সংসারের কাজ বাজ যে পড়ে আছে সেগুলো কে করবে?”
কাজল এই কথা শুনে খুবই ভদ্রভাবে কাজ করতে চলে যায়। এদিকে কাজল কাজ করছিলো সেই সময়ে তার শাশুড়ী এবং ননদ ইঙ্গিত দিয়ে তাকে টিটকারি করে কথা বলছিলো। ননদ এখনো শ্বশুড়বাড়ি না গিয়ে এখানে বসে তার বাড়ি নিয়ে সমালোচনায় বসেছে। এটা দেখে কাজল বিরক্ত হয়। ননদ তো এক পর্যায়ে বলে,“আমার ভাই যে কেন পঁচা শামুকে পা কাটলো। বড় বোনটার দোষ আছে, না জানি ছোটটার কি আছে?”
“আপনার ভাই আসলে জিজ্ঞেস করে নিবেন কেন সে পঁচা শামুকে পা কাটলো? তাছাড়া এখন যেহেতু বিয়ে হয়ে গেছে সেহেতু আপনাদের এসব না বলাই ভালো। এতে পরিবারের সম্মানই যাবে। বিয়ের আগে পঁচা শামুকে পা কাটতে ভাইকে বাঁধা দিলেই পারতেন।”
কাজলের মুখের উপর বলা কথাটি তার শাশুড়ী এবং ননদ হজম করতে পারলেন না। বিয়ের মাত্র সাতদিন হলো। এখন বলতে গেলে কাজল নতুন বউ৷ সেই বউ মুখে মুখে জবাব দিচ্ছে, এটা ভালো লক্ষণ নয়। তাদের মুখের অবস্থা দেখে কাজল মনেমনে হেসে বলে,“নরম মাটি পেটে সবাই কচলাই। তাই শুরুতেই বুঝিয়ে দিচ্ছি আমি নরম মাটি নই।”

এদিকে গত দুইদিন ধরে কাজল ফোন বন্ধ রেখেছে। আজ যাও খুলেছে সে ফোন তুলছে না। এটা নিয়ে বাবা, মা বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। সেদিন রাতে কাজল স্পষ্ট ভাষায় বলেছে,“যে বাবা, মা একজন সন্তানকে দত্তক নিয়ে এসে তাকে নূন্যতম ভালোবাসা দিতে পারে না। আপন করতে পারে না। তাদের থেকে যন্ত্রণা পেয়ে মানুষটি চলে যাওয়ার পর অব্দি তারা শুধু তারই দোষ খুঁজে বেড়াচ্ছে। তেমন স্বার্থপর, অমানবিক বাবা-মা কাজলের প্রয়োজন নেই। তার জন্ম যখন পুষ্পের জীবনটাকে নরক বানিয়ে দিয়েছে তখন তার শা স্তি তাকে পেতে হবে। সেই সঙ্গে বাবা, মাকেও বুঝতে হবে তারা কি ভুল করেছে। এটা না বোঝা অব্দি কাজল আর তাদের সঙ্গে কথা বলবে না। কখনো না।”
বাবা, মা এসব কথা ভেবে বেশ ভেঙে পড়ে। শত হোক গর্ভের সন্তান। বিবাহিত জীবনের কতটা বছর পর কাজলের জন্ম হয়েছে৷ বড় আদরের সন্তান। তার দূরে চলে যাওয়ায় ভীষণ কষ্ট হয়েছে। তবুও মা বাবাকে বলছে,“সব হয়েছে পুষ্পের জন্য। পুষ্প মেয়েটার কান ভেঙেছে৷ নয়তো কাজল এমন করবে কেন? আমরা এতদিন ধরে যা করেছি সব তো তার জন্যই। তবে সে এমন করছে কেন? ঐ স্বার্থপর পুষ্পের জন্যই।”
বাবাও সম্মতি জানায়। আর তাদের এমন আচরণ প্রমাণ করে দেয়, এই পৃথিবীর বুকে তাদের মতো মানুষেরা কখনো নিজেদের ভুল উপলব্ধি করতে পারে না। একদমই পারে না।
____
দুই মাস কেটে যায়। নতুন এই শহরের সঙ্গে আমি আমার পরিচয় গড়ে নেই। ব্যস্ত এই শহরের বাতাস, রাস্তা, গাড়ি, জ্যাম সবকিছু আমার পরিচিত হয়ে উঠেছে। আমি সবকিছুর সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছি। এখন ব্যস্ত শহরের জ্যামের মাঝে বসেও আমি আনন্দ খুঁজি। বিরক্ত হই না। বরং গাড়িতে বসে অন্য যাত্রীদের বিরক্তি, অফিস লেট হয়ে যাওয়ায় চিন্তার ছাপ, কেউ কেউ বিরক্ত নিয়ে দুই চারটা গা লি দিচ্ছে সবগুলো মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করে আপনমনে নিজেই হাসি। আমার জীবনের এই ব্যাপক পরিবর্তনের পিছনে পুরোটাই শান্তর অবদান। সে আমাকে জীবনটাকে নতুনভাবে বাঁচতে শিখিয়েছে। যদিও এখনো হয়তো কিছু পরিবর্তন বাকি। যেটা আদৌ সম্ভব কি-না জানি না। হয়তো সম্ভব নয়। প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব কিছু সত্তা থাকে। যেগুলো আসলে চাইলেও পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। তবে আমি আজ যে অবস্থানে আছি সেখানে দাঁড়িয়ে নিজেকে অনেক মুক্ত, স্বাধীন এবং সুখী মানুষ লাগছে। এই দুই মাসে হয়তো বাসা থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিংবা হয়নি। তা আমার জানা নেই। কারণ আমি এই শহরে আসার আগেই যে নাম্বারটি তারা জানে সেটা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আমার বাবা, মা হয়তো আমার সঙ্গে কখনো যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি। করলেও সেটা টাকা চাইতে করবে। আমাকে ভালোবাসে কখনো যোগাযোগ করবে না। এটা আমার জন্য যন্ত্রণাদায়ক। এই কষ্ট পেতে চাই না বলেই তাদের সঙ্গে যোগাযোগের রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছি।
আজ আমি ভীষণ খুশি। কয়েক মাস পর অবশেষে শান্তর সঙ্গে দেখা হবে। যদিও শান্ত এটা জানে না। আমি নিজেই তার দোকানে গিয়ে তাকে সারপ্রাইজ দিতে চাই। সে তো এটাই চেয়েছিলো। আমি পরিবর্তন হয়ে তার সঙ্গে নিজেই দেখা করি। তার সঙ্গে দেখা করার কথা ভাবা বা করার সময় আমার মাঝে কোন জড়তা কাজ করবে না। অদ্ভুতভাবে আজ সত্যি কোন জড়তা কাজ করছে না। রিকশা যত গন্তব্যে এগিয়ে যাচ্ছিলো ততই ভালো লাগা কাজ করছিলো। এখানে কোন জড়তা কাজ করছে না। অবশেষে অনেকটা সময় পর গন্তব্যে স্থানে এসে নামলাম। রিকশা ভাড়া পরিশোধ করে আশেপাশের মানুষদের জিজ্ঞেস করছিলাম,“এখানে শান্তর দোকান কোথায়?”
ইতিমধ্যে একজন সামনে দেখিয়ে দিলো। আমিও সামনের দিকে পা বাড়ালাম। তবে সামনে গিয়ে হচচকিয়ে গেলাম। আমার সামনে শান্ত একজনকে একটি লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে। লোকটি মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ব্যথায় চিৎকার করছে। আমি লক্ষ্য করলাম শান্তর কপাল পাশও কেটে গিয়েছে। তার কপালে পাশ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে নিচে পড়ছে। এক পায়ে ভর দিয়ে অন্য পা কোনরকম রেখেছে। যেটা দেখে বুঝলাম ঐ পায়ে সে ভীষণ ব্যথা পেয়েছে। আমি এসব দেখে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

শান্তর হাতে মার খাওয়া ব্যক্তিটি বলছে,“স্যরি ভাই ভুল হয়ে গিয়েছে।” শান্ত তাও তাকে ছাড়ছে না। তার কানে বাজছে লোকটির তার মাকে নিয়ে দেওয়া গালি। তাই সে প্রচন্ড রাগ নিয়ে লাঠি দিয়ে তার মুখে বারি মা রতে নেয়। ঠিক সেই মূহুর্তে সে পুষ্পকে দেখে। শান্ত এক মূহুর্তে থমকে যায়। পুষ্পকে দেখে সে না চাইতেও থমকে যায়। পুষ্প আজ তার নামের মতোই রূপধারন করেছে। উজ্জ্বল ফর্সা গায়ে কালো রঙের স্টোন বসানো শাড়ীটি বেশ মানিয়েছে। কাজল কালো চোখের দৃষ্টি গাঢ় এবং মায়াবী, সেই সঙ্গে ঠোঁটে আভাসমাত্র রঙের ছোঁয়া। সুবিন্যস্ত হালকা লিপস্টিকে তাকে চমৎকার লাগছে। সেই সঙ্গে ঘন কালো চুল খোঁপায় আবৃত না হয়ে নিপুন বেনীতে বাঁধা হয়ে কাঁধ ছুঁয়ে একপাশে নেমে এসেছে৷ বয়স তার আটাশ থেকে নেমে সদ্য কিশোরীতে পা দিয়েছে যেন। চিকন মানুষের এই এক সুবিধা, চেহারায় বয়সের ছাপ পড়ে না। অনেকের হয়তো পড়ে তবে পুষ্পর পড়েনি। শান্ত পুষ্পর এমন রূপ দেখে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে। পুষ্পের দিকে এভাবে গভীরভাবে লক্ষ্য করা কখনো হয়নি। পুষ্প সেভাবে চলতোই না। যাতে তাকে গভীরভাবে লক্ষ্য করা যায়। তবে আজ শান্ত থমকে গেছে৷ সে আপনমনে বিরবির করে বলে,“ষোলো বসন্তে রাঙা আটাশ বছরের কিশোরী।”

ইতিমধ্যে শান্তর থেকে লোকটিকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। অন্য লোকজন লোকটিকে ধরে নিয়ে যায়। আমিও শান্তর দিকে এগিয়ে আসি। শান্ত মুচকি হেসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি এটা দেখে কিছুটা অবাক হয়ে বললাম,“শান্ত কোথায় হারালেন?”
আমার ডাকে শান্ত হচচকিয়ে যায়। সে আমতা আমতা করে বলে,“কোথাও না। আপনাকে হঠাৎ এখানে দেখে অবাক হয়ে গেছি।”
“ভাবলাম চলে আসি অন্যরকম আমি হয়ে।”
আমার কথা শুনে শান্ত হাসিমুখে বলে,“আসলেই অন্যরকম তুমি।”
“হ্যাঁ?”
আমি বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম। আসলে শান্ত আমাকে ‘তুমি’ সম্মোধন করেছে সেটা দেখে অবাক হলাম। শান্তও এটা বুঝতে পেরে কিছুটা বিব্রত হয়। এবং বলে,“আমাকে একটু ধরুন। পায়ে ব্যথা পেয়েছি খুব। দাঁড়াতে পারছি না।”
আমি দ্রুত তার হাতটি ধরি। অতঃপর তাকে নিয়ে তার দোকানে এসে বসি। দোকানটি শান্তই দেখিয়ে দেয়। আমি শান্তর পায়ে হাত দিতে নিলে শান্ত বলে,“কী করছেন?”
“দেখছি আপনার পায়ে কতটা লেগেছে।”
আমার কথা শুনে শান্ত তৎক্ষনাৎ বলে উঠে,“না না। আপনাকে দেখতে হবে না। তেমন লাগেনি।”
“তা লোকটির সঙ্গে আপনার এমন মা রামারি কেন হলো?”
আমার কথা শুনে শান্ত চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকায়। অতঃপর বলে,“এটা বলবেন না, এখানে এসেও গুন্ডামি করছি। আমি শুধরাবো না কখনো।”
শান্তর কথা শুনে আমি হাসি মুখ নিয়ে বললাম,“না। পুরো ঘটনা না জেনে কাউকে গুন্ডা সম্মোধন আমি করি না। এটা ঠিক নয়।” আমার এই কথা শুনে শান্ত বলে,“আপনি সত্যি অন্যরকম হয়ে গেছেন। বেশ ভালো।”
“হ্যাঁ। যদিও আপনার মতো হতে পারেনি।”
এই কথা শুনে শান্ত হাসতে হাসতে বলে,“এই পৃথিবীতে কেউ কারো মতো হতে পারে না। তাছাড়া এক ধরনের দুজন মানুষ বেশিক্ষণ এক স্থানে থাকতে পারে না। তাহলে ঠিক জমে না।”
“আচ্ছা বুঝলাম। এবার চলুন আপনাকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাই। পথে নাহয় এখানের ঘটনার বিস্তারিত শুনে নিবো।”
“এতটুকুতে ডাক্তার দেখাতে হবে না। এমনি মাথায় কাপড় বেধে নিলে ঠিক হয়ে যাবে।”
এটা বলে শান্ত তার দোকানে থাকা টুকরো কাপড় বের করে আমার দিকে এগিয়ে দেয়। ইশারায় বেধে দিতে বলে। আমি সেটা করি। সেই সঙ্গে বলি,“পায়েও তো ব্যথা পেয়েছেন। ডাক্তার একবার দেখিয়ে নিলে ভালো হয় না?”

“আরে লাগবে না। ছাড়ুন তো। তা আজ আপনার অফিস নেই?”

”আছে। তবে আপনি তো শুক্রবার দোকান খোলেন না। সেই সঙ্গে বাড়ির ঠিকানা দেননি তাই ভাবলাম আজ একটা ছুটি নেই। যেই ভাবনা সেই কাজ।”
আমার কথা শুনে শান্ত খুশি হয়। পরক্ষণে বলে,“কিন্তু আপনি আশায় ভালো হলো না। এখন তো পায়ে ব্যথা। ঘুরতেও যেতে পারবো না।”
“সমস্যা নেই। আমি এখানে বসে বরং পুরো ঘটনা শুনি।”
এটা শুনে শান্ত অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। অতঃপর বলে,“এখানে একসঙ্গে আমরা গল্প করলে নানা লোক নানা কথা বলবে। এটার ভয় হচ্ছে না?”
আমি মাথা নাড়িয়ে না জানাই। এটা দেখে শান্ত হাসে। কিছুটা উচ্চশব্দেই হাসি। তার হাসির কারণ খুঁজে পাই না। সেই মূহুর্তে দোকানে থাকা বাচ্চাটির দিকে নজর পড়ে। আমি কৌতূহলী চোখে তাকাতে শান্ত বলে,“ওর নাম রবি। বয়স দশ। আমার কাজে সাহায্য করে।”
রবির আমার দিকে বিষ্ময় নিয়ে তাকানো দেখে বুঝতে পারলাম সে আমার এবং শান্তর বিষয়টি বুঝতে না পেরে তাকিয়ে আছে। সেই সঙ্গে শান্তর এই অবস্থা তার কি করা উচিত সেটা নিয়েও দ্বিধা দ্বন্দে রয়েছে। শান্ত এটা দেখে রবিকে বলে,“বাড়ি চলে যা রবি। আজকের মতো দোকান বন্ধ।”
“কেন?”
আমার কথা শুনে শান্ত জবাব না নিয়ে ম্লান হাসে। অতঃপর আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। পায়ে ব্যথা করলেও হাঁটতে পারছে। শান্ত দোকানের মাঝে কয়েক কদম হেঁটে আমার দিকে ঘুরে তাকায়। অতঃপর বলে,“লোকের কথায় আপনার এখনো অনেক কিছু যায় আসে। তাই আমাদের উচিত এখন অন্যত্র ঘুরতে যাওয়া। এই শহরের তো অনেক কিছুই আপনি দেখেননি। চলুন সেটা দেখাই।”
“কিন্তু!”
আমি কিছুটা সংকোচ নিয়ে কথাটা বলে শান্তর দিকে তাকাতে দেখি সে আমার দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে। আমি সংকোচ কাটিয়ে কমফোর্ট ভাবে কথা বলতে নিলে শান্ত থামিয়ে বলে,“পরিবর্তন হওয়া জরুরি বলেছি। তাই বলে অস্তিত্ব বিলীন করতে বলিনি। কিছু নিজস্বতা রেখে দিন। মন্দ হয় না।”


চলবে,