ইচ্ছেঘুড়ি পর্ব-২৭+২৮

0
20

#ইচ্ছেঘুড়ি (২৭)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

শান্ত মায়ের কোলে মাথা রেখে মুচকি হাসছে। তার মুখের হাসি দেখে তার মা খুশিমনে বলে,“মেয়েটা বিয়েতে রাজি হলো?”

শান্তর মায়ের ধারণা শান্ত বিয়ের বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে তখন চলে আসলো। এখন কথা শেষ করে এসে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়েছি। শান্তর মুখে হাসি দেখে মনে হচ্ছে, মেয়েটা এখন বিয়ে করতে রাজি। নিশ্চিত হতে জানতে চাইলো। মায়ের প্রশ্ন শুনে শান্ত খুশিমনে বললো,“আমাদের মধ্যে প্রেম ছিলো না। আমি তাকে পছন্দ করতাম। এখন নিশ্চিত হলাম সেও আমাকে পছন্দ করে। তাই বিয়ের কথা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়।”

“ওহ এই ব্যাপার। তা মেয়েটা কে?”
শান্তর মায়ের এই প্রশ্নে শান্ত স্বাভাবিকভাবে বলে,“মেয়েকে তোমরা চেনো। আমাদের এই পাড়ায় আগে থাকতো।”

“এই এলাকার?
নাম কি মেয়ের?”
শান্তর মা কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করতে শান্ত খুব সুন্দরভাবে বললো,“পুষ্প।”

“কি!”
শান্তর মা হতভম্ব হয়ে তার দিকে তাকায়। সে ভীষণ অবাক হয়েছে। নরম গলায় বলে,“এই মেয়েটা তোদের মামার পাশের বাড়ির মেয়েটা না?”

”হ্যাঁ।”
শান্ত সম্মতি জানাতে শান্তর মা অবাক চোখে তাকে দেখে বলে,“তোর কোন সমস্যা আছে?”

“মানে?”
শান্ত বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে। তার মা বলে,“তুই পাগল হয়েছিস? ঐ মেয়েটার তো সমস্যা আছে। পুরো এলাকা জানে। সেখানে তুই এমন একটা মেয়েকে পছন্দ করেছিস। হয় তোর মাথা খারাপ নয় তোরও একই সমস্যা রয়েছে।”

“আরে ধুর। তেমন কিছুই নয়। আচ্ছা মা তুমিও বিশ্বাস করো এলাকার মানুষ যা বলে তা সত্যি? এসব ওর মা ওকে বিয়ে দিতে চাইনি তাই ছড়িয়েছে। নিজেদের মেয়ে নয় তো তাই।”
শান্তর মা বিষয়টি বুঝতে না পারলে শান্ত পুরো কথা বলে। সব শুনে শান্তর মা বলে,“আচ্ছা বুঝলাম। কিন্তু এলাকার লোক তো এত কথা জানে না। তাছাড়া ঐ মেয়েটা তোর বড় হবে।”

মায়ের সংকোচময় মুখ দেখে শান্তর যা বোঝার বোঝা হয়ে গিয়েছে। সে খুবই স্বাভাবিক গলায় বলে,“দেখো মা, বিয়ে আমার। এখানে আমি না তোমাদের পছন্দে বিয়ে করবো আর না সমাজের পছন্দে। তাই অবশ্যই আমি তাকেই বিয়ে করবো যাকে আমি চাই।
এলাকার লোকজন সারাদিন অন্যের পরনিন্দা পরচর্চা করতে ব্যস্ত, তারা উল্টাপাল্টা কথা ছড়িয়েছে এর মানে এটা নয় যে তাদের কথায় দাম দিয়ে আমাকে আমার জীবন চালাতে হবে। আর বাকি রইলো পুষ্প বড়। এক বছরের বড় মাত্র। এটা কোন সমস্যা হতেই পারে না।”

“কিন্তু?”
শান্ত তার মায়ের দ্বিধায় ভরা মুখ দেখে কিছুটা কঠিন গলায় বলে,“যদি বিয়ে করতে হয় তবে পাত্রী হিসাবে পুষ্পই থাকবে। পাত্রী পুষ্প নাহলে আমি বিয়েই করবো না। স্যরি মা। এটা আমার জীবন, এখানে এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আমি নিজেই নিবো। হ্যাঁ সন্তান হিসাবে আমার যা দায়িত্ব তা আমি পালণ করার চেষ্টা করবো। যদিও আমি জানি আমি তোমাদের দায়িত্ব পালণ না করলেও তোমাদের কিছু যায় আসে না। তবে ছেলের বউয়ের থেকে তোমরা যেটা চাও বা তোমাদের যেটা প্রাপ্য সেটা অবশ্যই আমার পছন্দের মানুষ তোমাদের দিবে। এই কথাটা আমি তোমাদের দিতে পারি।”

শান্তর এসব কথা শুনে তার মা ম্লান হাসে। সে মনেমনে বলে,“সব বাবা ছেলের দূরত্ব কমলো। এরমাঝে এমন খবর ওর বাবা নিতে পারবে তো? কখনো পারবে না। কিন্তু শান্ত যা বলছে তাতে ওর বাবার আপত্তিও শুনবে না। মধ্যেখানে দুজনের সম্পর্কও আবার খারাপ হবে।”

“কী ভাবছো মা?”
শান্তর প্রশ্নে তার মা হাসার চেষ্টা করে বলে,“কিছু না। তোর বাবাকে এই বিষয়ে এখন কিছু বলার দরকার নেই। আমি পরে বলবো। তুইও কিছুটা ভাব এই ব্যাপারে।”

শান্ত এই কথা শুনে তার মাকে জড়িয়ে ধরে। মিষ্টি হেসে বলে,“মন খারাপ হয়ে গেছে তোমার মা? স্যরি। কিন্তু বিশ্বাস করো মা ও খুব ভালো মেয়ে। তুমি একবার কথা বলে দেখো। ও অনেক ভালো মেয়ে। সবচেয়ে বড় কথা আমার পছন্দের। আমি ওর সঙ্গে বিয়ে করলে খুশি হবো। তুমি আমার খুশি চাও না?”
শান্তর মা শান্তর এই কথা শুনে থমকে যায়। সে কোন কথা বলতে পারে না। শান্ত মায়ের অনুভূতি বুঝে বলে,“আচ্ছা আমার চিরকুমার থাকতে অসুবিধা নাই। তুমি যদি চাও চিরকুমার থাকি তবে তাই থাকি।”
শান্ত কথাগুলো মজা করে বলছিলো। যা শুনে তার মা হাসতে বাধ্য হয়। সে হাসি মুখে বলে,“পাগলের প্রলাপ বকিস না। আমরা না চাইলে বুঝি বিয়ে করবি না তাকে?”
শান্ত জবাব দেয় না। সে ম্লান হাসে। সে জানে তার মা এখন অমত করলেও পরে ঠিকই রাজি হবে। শান্ত যখন মুখ দিয়ে বলেছে এই মেয়েকেই বিয়ে করবে তবে করবেই। সেজন্য তার মা পুষ্পকে মেনে নিবে। হয়তো এখনই মেনে নিয়েছে। কিন্তু বাবা এসব কথা কিভাবে নিবে সেটা নিয়েই ভাবছে।

_____

জয় হন্তদন্ত হয়ে ঘরে প্রবেশ করে। তার মুখজুড়ে চিন্তার ছাপ। সেটা দেখে কাজল উদ্বিগ্ন হয়ে বলে,“কী হয়েছে?”

“আমার মাথা। তোমার সমস্যা কী বলবে? ভালো না লাগলে থেকো না।”
জয়ের মুখে এমন কথা শুনে কাজল অবাক হয়ে যায়। জয় বিরক্তি নিয়ে বলে,“তোমার মায়ের কাছে আমার নামে নালিশ দিয়েছো ভালো কথা। তাই বলে তোমার বাবা আমাকে ফোন দিয়ে হুমকি দিবে?”

“বাবা হুমকি দিয়েছে মানে?”
কাজল হতভম্ব হয়ে যায়। জয় কিছুটা বিরক্তি নিয়ে সব বলে। আজ কাজলের বাবা জয়কে হুমকি দিয়েছে। তার মেয়েকে নিয়ে হয় জয় আলাদা সংসারে উঠবে নয়তো তারা জয়ের নামে পুলিশের কাছে মামলা করে দিবে। জেলের ঘানি টানাবে। এসব শুনে কাজল হতভম্ব হয়ে যায়। গতকাল রাতে শাশুড়ী খুবই সামান্য বিষয়ে তার সঙ্গে ঝগড়া করে। যার এক পর্যায়ে জয় বাড়ি চলে আসে। যেখানে কাজলও তার শাশুড়ীকে প্রতিত্তোর করে। জয় আসলে দুজনেই একে-অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেয়। সারাদিন অফিসের ব্যস্ততায় জয় এসব নিতে না পেরে কাজলের গালে থাপ্পড় মে রে বসে। নিজের রাগ মায়ের উপর দেখাতে না পেরে বউকে দেখিয়ে দিয়েছে। যেটায় কাজল খুবই কষ্ট পেয়েছে। কষ্ট পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে মায়ের সঙ্গে একটু কথা বলে মন হালকা করতে নিয়েছিলো। যার ফলাফল এমন হলো। জয় কাজলকে উদ্দেশ্য করে বলে,“তোমার বাবা, মায়ের মতো কিছু মানুষের অতিরিক্ত অধিকার ফলানোর জন্যই তোমার মতো মেয়েরা স্বামীর সংসারটা ঠিকমতো করতে পারে না। হ্যাঁ মানছি গতকাল যা হয়েছে ভুল হয়েছে। আমি ক্ষমা চেয়েছি। সেই সঙ্গে এসব ঝামেলা থেকে মুক্ত হতে আমি তোমাকে নিয়ে আলাদা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আর সেই তুমি কি-না তোমার বাবাকে দিয়ে আমাকে হুমকি দেওয়াচ্ছো? এতটুকু ধৈর্য তুমি ধরতে পারলে না? তুমি আমার নামে মামলা দিবে? পুলিশের কাছে যাবে? আমি তোমায় অত্যাচার করি?”

“না। জয় বাবা যেটা করেছে হটকারিতার মাঝে করেছে। আমি….।”

”চুপ। আমি কোন ফালতু কথা শুনতে চাই না। বিয়ে করে খুব অশান্তিতে আছো, তাই না? আচ্ছা যাও এই বিয়ে থেকে তোমাকে মুক্তি দিলাম। আমি যেহেতু স্বামীর দায়িত্ব পালণ করতে পারছি না সেহেতু একসঙ্গে থাকার কোন মানে হয় না। আমি আমার ভুল স্বীকার করছি। তুমি যাও। তোমাকে আমি মুক্ত করে দিলাম।”
এটা বলে জয় ঘর থেকে বের হয়। কাজল জয়কে কিছু বোঝানোর সময়টুকু পায়নি। জয়ের বাবার হুমকিতে খুব আত্মসম্মানে লেগেছে। তাছাড়া যেহেতু সে সবটা দেখে নিজেই আলাদা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেখানে এই মূহুর্তে তাকে মামলায় ভয় দেখানোতে সে প্রচন্ড হার্ট হয়। কাজল সবটা বুঝতে পেরে বাবা, মায়ের উপর রেগে যায়। সেই মূহুর্তে তার মা ফোন দেয়। কাজল ফোনটা ধরতে মা বলে,“মা চিন্তা করিস না। জামাইকে তোর বাবা বুঝিয়ে দিয়েছি। এবার থেকে তোর কথায় কিভাবে উঠে বসে দেখিস।”

”দয়া করে আর ফোন দিও না মা প্লীজ।
তোমরা জেনেশুনে তো আপার জীবন নষ্ট করেছিলে এতদিন। এখন যেই তাকে পাচ্ছো না ওমনি না বুঝে আমার জীবনটা নষ্ট করতে উঠেপড়ে লেগেছো। প্লীজ মা থামো। তোমাদের আমার ভালো ভাবতে হবে না। তোমাদের আর আমার ভালো ভাবতে হবে না।”
এটা বলে কাজল রাগে ফোন রেখে দেয়। তার এখন প্রচন্ড রাগ হচ্ছে নিজের উপরই। কেন এমন একটা জীবন সে পেলো। যেখানে কেউ তার কথা বুঝতেই চায় না। যে বা চায় সেও এখন ভুল বুঝলো।

___

শান্ত বাবা, মাকে বিদায় জানিয়ে আবার কর্মস্থলে চলে আসে। গত তিনদিন ধরে পুষ্পর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না। সেজন্য কিছুটা মন খারাপ। পুষ্পের ফোন নষ্ট হয়েছে ভেবে শান্ত না পেরে আজ এখানে এসে পুষ্পর বাড়ি চলে আসলো। পুষ্পের ঘরের সামনে তালা দেখে শান্তর মনে পড়লো এখন অফিস টাইম। পুষ্পকে দেখার অস্থিরতায় সে ভুলেই গিয়েছে। তবে শান্ত ফেরত যায় না। সে বিল্ডিং এর সামনে থাকা চায়ের দোকানে বসে।সন্ধ্যার কিছুটা আগে পুষ্প অফিস থেকে আসে। শান্ত পুষ্পকে দেখে দোকান থেকে বের হয়। শান্ত হাসি মুখে পুষ্পের সামনে এসে বলে,“অন্যকারো ফোন দিয়েও তো কল করা যেতো। আপনার আমাকে একটুও মনে পড়েনি? একবার ফোন দিলে খুব ক্ষতি হতো?”

শান্তকে এই সময়ে চোখের সামনে দেখে কিছুটা হচচকিয়ে গেলাম আমি। সেই সঙ্গে তার কথা শুনে আরও থমকে গেলাম। শান্ত আমার জবাব না পেয়ে হাসি মুখেই বলে,“এই সময়ে আমাকে এখানে আশা করেননি? এই পুষ্প? ভূত ভাবছেন নাকি আমাকে? আরে না আমি ভূত না। এত সহজে পটল তুলে ভূত হবো না। আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন।”

শান্তর মজা শুনে হেসে দিলাম। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলা ঠিক হবে না বুঝতে পেরে বললাম,“ঘরে চলুন শান্ত।”

“সন্ধ্যা নেমে আসছে। এখন ঘরে নিবেন?”
শান্তর কথায় জবাব না দিয়ে আমি পা বাড়ালাম। শান্তও আমার পিছনে আসলো। আমি ঘরের সামনে এসে তালা খুলতে খুলতে বললাম,“কেমন আছেন শান্ত?”

“পুরাই বিন্দাস।
এখন আরও ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”

“ভালো আছি।”
আমার কথা শুনে শান্ত অবাক হয়ে বলে,“শুকনো মুখে বলছেন যে। আমাকে দেখার পরও আপনার মন খারাপ দূর হয়নি?”

“আমার তো মন খারাপ হয়নি৷ তাহলে দূর হবে কিভাবে?”

”কেন আমি যে ছিলাম না, আমার সঙ্গে তিনদিন যোগাযোগ করতে পারেননি তাতে আপনার মন খারাপ হয়নি?”
আমি শান্তর কথা শুনে অবাক হওয়ার ভান ধরে বললাম,“আপনি বিশেষ কেউ যে না থাকলে মন খারাপ করবে?”

“হ্যাঁ অবশ্যই।”
শান্ত উৎফুল্ল মনে কথাটি বলে। এটা শুনে আমি জবাব না দিয়ে ঘরের ভেতর প্রবেশ করি। শান্তও ভেতরে আসে। চেয়ার টেনে বসে শান্ত বলে,”আমি বিশেষ কেউ নই?”

”হ্যাঁ খুব ভালো বন্ধু। বন্ধুর জন্য মন খারাপ হওয়া স্বাভাবিক। তবে আমার হচ্ছিলো না। কারণ পাশে বন্ধুর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ কেউ একজন ছিলো তো।”
আমার মুখে এই কথা শুনে শান্ত পুরো হতবাক হয়ে যায়। সে বিষ্ময়ের গলায় বলে,“আমার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেউ?”

“হ্যাঁ।ফোনটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। তাই আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি। তাই জানেন না৷ আপনাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা বলার ছিলো শান্ত।”
আমি হাসি মুখে খুবই আগ্রহ নিয়ে কথাটি বললাম। শান্ত বুঝতে না পেরে বলে,“কী?”

“শ্রাবণ।”
আমি লাজুক হেসে নামটি বললাম। শান্ত হতভম্ব হয়ে বলে,“কে শ্রাবণ?”

“আমার বিশেষ একজন।
সেদিন রায়ান তার বউকে নিয়ে গর্ব করে আমাকে খুব টিজ করছিলো। এসব সহ্য করতে না পেরে শ্রাবণ প্রতিবাদ করে। শ্রাবণ আমার কলিগ হলেও আমাদের মাঝে তত বেশি বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেনি। তবে সেদিন রায়ানের সঙ্গে ঝামেলায় সে স্বীকার করে সে আমাকে পছন্দ করে। আমি এটা শুনে অবাক হওয়ার সঙ্গে খুশিও হয়েছি। শ্রাবণ অনেক ভালো একটা ছেলে। সেই সঙ্গে সেদিন আমি তার চোখে আমার জন্য যে সম্মান, ভালোবাসা দেখেছি তা বলার মতো নয়। একদম আমার স্বপ্ন পুরুষের মতো। আমি যেমন মানুষ জীবনসঙ্গী হিসাবে চেয়েছিলাম শ্রাবণ তেমন মানুষ।”
শান্ত আমার মুখে এমন কথা শুনে হতবাক হয়ে যায়। সেই সঙ্গে খুব কষ্ট পায়। তার সেদিনের কথা মনে পড়তে রাগ উঠে যায়। রাগ নিয়ে বলে,“কিসব ফালতু কথা বলছেন পুষ্প? আপনার স্বপ্ন পুরুষ শ্রাবণ মানে? তাহলে আমি কে?”

“মানে!”
আমি না বোঝার ভান ধরে কথাটি বললাম। এটা শুনে শান্ত রেগে গিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। এই প্রথম শান্তর চোখে আমি এতটা রাগ দেখলাম। সে রাগান্বিত গলায় বলে,“থাবড়ে গাল লাল করে দিবো। শুনুন পুষ্প আপনি যদি মজা করে থাকেন তাহলে এখানেই থামুন। এমন ফালতু মজা আমি শুনতে চাই না।”

“শান্ত আপনার কী হয়েছে? আমি এভাবে কথা বলছেন কেন?”
আমার কথায় শান্ত বিরক্ত হয়ে বলে,“আমি এভাবে কথা বলছি কেন? আপনি বুঝতে পারছেন না?”

“না তো।
আচ্ছা আপনি বোধহয় কোন বিষয়ে রেগে আছেন। আপনার না বিয়ের কথা চলছে। তা পাত্রী পছন্দ হয়নি বুঝি। তাই বাবা, মায়ের সঙ্গে রাগ করে চলে আসছেন।”
আমার এই কথা শুনে শান্ত পুরো হতভম্ব হয়ে যায়। আমি আবারও বললাম,“ওহ সেদিন আপনার পুরো কথা শোনা হয়নি। আসলে ফোনটা অনেক ডিস্টার্ব করছিলো। সেজন্য লাইন কেটে যায়। তার পরেরদিনই তো ফোনটা বন্ধ হয়ে যায়। তো সেদিন পরে কী বলছিলেন বলুন?”

“আপনি সেদিন চুপ ছিলেন কারণ আপনার ফোনে সমস্যা দেখা দিয়েছিলো?”
শান্তর কথায় আমি মাথা নাড়াতে শান্ত বলে,“আমার কোন ম্যাসেজ পাননি?”

“হ্যাঁ। কিন্তু স্যরি ম্যাসেজ পড়া হয়নি। আসলে ফোনে এত সমস্যা দেখা দিচ্ছিলো, ম্যাসেজ আসছে এটা দেখাচ্ছিলো কিন্তু তাতে ক্লিক করা যায়নি। আমি ভাবলাম ফোন হঠাৎ কেটে যাওয়ায় আপনি ম্যাসেজ দিয়ে কী হলো জানতে চেয়েছেন, তাই আর সেভাবে গুরুত্ব দেইনি।”
আমার মুখে এসব কথা শুনে হঠাৎ শান্ত প্রচন্ড রেগে আমার বাহু চেপে ধরে। শান্তর এত রাগ দেখে আমি অবাক হয়ে যাই। শান্ত প্রচন্ড রাগ নিয়ে বলে,“এটা আমার মন। খেলনা নয় পুষ্প। যদি আপনার বলা একটা শব্দও মিথ্যা হয় তবে খুব খারাপ হবে।”


চলবে,

#ইচ্ছেঘুড়ি (২৮)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

“এটা আমার মন। খেলনা নয় পুষ্প। যদি আপনার বলা একটা শব্দও মিথ্যা হয় তবে খুব খারাপ হবে।”
শান্তর মুখে এই কথা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। তবুও নিজেকে সামলে বললাম,“শান্ত আমি আপনার কথা কিছুই বুঝছি না।”

শান্ত আমার বাহু ছেড়ে দেয়। স্পষ্ট ভাষায় বলে,“আমি শুধু বন্ধুত্বের সম্পর্কে থাকতে পারছি না পুষ্প। সেদিন ম্যাসেজে আমি আপনাকে আমার পাত্রী হিসাবে চেয়েছি। আশা করি আমার কথা আপনি বুঝতে পারছেন।”

“এসব কী বলছেন?
আপনার মনের মধ্যে এসব চলছিলো? কবে থেকে? কখন এমনটা হলো?”
আমার মুখে এই কথা শুনে শান্ত আমার দিকে তাকায়। সে আমার চোখে চোখ রাখে। অতঃপর বলে,“আপনার মনে এমন কিছু নেই?”

“এটা কেমন কথা বলছেন?
এসব আদৌ সম্ভব? আপনি আমার খুব ভালো বন্ধু। কিন্তু আপনি যা বলছেন তাতে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। আপনার কথা…।”
আমাকে থামিয়ে দিয়ে শান্ত বলে,“আমার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে কথা বলছেন কেন? আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলুন পুষ্প। শ্রাবণ কে আমি জানতে চাই না? আপনার পছন্দ কেমন সেটাও জানতে চাই না? আমি শুধু জানতে চাই আপনি আমাকে নিয়ে বন্ধুত্বের বাহিরে কোনকিছু ভাবেননি?”

“না।”
আমার কন্ঠ দিয়ে কথাটি বের হতে শান্ত কঠিন গলায় বললো,“জীবনে এক মূহুর্তের জন্যও আপনি আমাকে বন্ধুর বাহিরে কিছু ভাবেননি?”

“শান্ত এসব কথা কেন আসছে?
আমি তো রীতিমতো অবাক, আপনি এসব কিভাবে ভাবছেন? আমার কাছে তো আপনার আজকের এই ব্যবহার স্বপ্নের মতো লাগছে। আমার মনে হচ্ছে আপনি শান্ত নন। ভিন্ন কেউ।”
আমার মুখে এই কথা শুনে শান্ত মুখ ঘুরিয়ে নেয়। সে নিজেকে সামলে বলে,“আচ্ছা।”

শান্ত চুপ হয়ে যায়। আমি সাহস করে তাকে কিছু বলতে পারছিলাম না। বেশ কিছুটা সময় দুজনে নিরব থাকি। অতঃপর নিরবতা ভেঙে আমিই বললাম,“শান্ত?”

“হ্যাঁ। আচ্ছা আপনি অফিস থেকে এসেছেন ফ্রেশ হন যান।”
এটা বলে শান্ত আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দেয়। আমি এটা দেখে কিছুটা মলিন গলায় বলি,“শান্ত এসব কিভাবে হলো?
বিশ্বাস করুন আপনার অনুভূতি…।”

“আমি কোন মিথ্যে শুনতে চাই না। প্লীজ পুষ্প অনেক বলেছেন। আপনি অভিনয়টা বেশ ভালো পারেন। তাছাড়া আপনি খুব সিরিয়াস মানুষ, আমার চেয়ে বয়সে বড়। আপনি তো আমার থেকে বেশি ভালো অভিনয় পারবেন স্বাভাবিক।”
শান্তর কথা বুঝতে না পেরে আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। শান্ত বাকা হেসে বলে,“বুঝতে পারছেন না? সমস্যা নেই। পরে বুঝবেন। তবে এতটুকু মনে রাখবেন পুষ্প আপনি আমার সঙ্গে ঠিক করলেন না। আপনার চোখ আর মুখ ভিন্ন কথা বলছে। এটা ঠিক নয়।”

“শান্ত মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কী বলছেন জানেন?”
আমার কথা শুনে শান্ত বলে,“হ্যাঁ জানি। আর এটাও জানি হয়তো বয়সের জন্য, লোকে কী বলবে কিংবা অন্যকোন কারণে আপনি আজ আমার সঙ্গে এই মিথ্যাচার করছেন। আমি সঠিক কারণ জানি। তবে খুব শীঘ্রই খুঁজে বের করবো। সেই দিনটি আপনার জন্য সুখের হবে না।”

”মানে?”
আমার প্রশ্নে শান্ত জবাব না দিয়ে খুব স্বাভাবিক গলায় বলে,“আপনাকে আমি একটু হলেও চিনি পুষ্প। আপনার চোখে ভাষা পড়তে জানি। আপনার চোখের ভাষা পড়তে জানি বলেই সেদিন আমি আমার বিয়ের খবর খুব উৎসাহের সঙ্গে আপনাকে জানিয়েছিলাম। কারণ আমি জানতাম এই কথা শুনে আপনি স্তব্ধ হয়ে যাবেন। আপনার বুকের ভেতর কষ্ট অনুভব হবে। আমি আপনার সামনে থেকেও আপনার সেই কষ্টের অনুভূতি অনুভব করতে পারছি পুষ্প। কিন্তু আজ যে আপনিটা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন সে মিথ্যা। সে মুখোশ পড়ে রয়েছে। হ্যাঁ হয়তো আমি আপনাকে সরাসরি কখনো চার অক্ষরের ঐ শব্দটি বলিনি। আপনিও আমাকে বলেননি। কিন্তু আমাদের মধ্যে ওটা ছিলো। পথ চলতে চলতে অজান্তেই হয়ে গেছে।
আমি জানি সেদিন আমার ম্যাসেজ আপনি ঠিকই পড়েছেন। সেই সঙ্গে খুশিও হয়েছেন। কিন্তু আজ বুঝতে পারছি না কেন আপনি এই নাটক করছেন? সমস্যা নাই। খুব শীঘ্রই বুঝে যাবো। যাই হোক স্যরি। আমি ভেবেছিলাম আপনার ফোন নষ্ট হয়েছে। কিন্তু সেটা তো হয়নি। আপনি এখন নিশ্চিন্তে ফোনটা অন করতে পারেন। শান্ত আর যাই হোক মেয়েদের ফোন দিয়ে বিরক্ত করে না।”

শান্তর এসব কথা শুনে আমি চুপ হয়ে যাই। কি বলবো। তবুও নিজেকে সামলে যখন বলতে নিলাম তখন শান্ত বলে,“আর একটাও মিথ্যে নয়। আমি যা ভেবেছি সেটা সত্যি। আপনার চোখ সেটা বলে দিচ্ছি। আপনার কাঁদো কাঁদো চোখ আপনার মনের কথা বলে দিচ্ছে পুষ্প। তাই আর মিথ্যে নয়।”

আমি চুপ হয়ে গেলাম। মুখ দিয়ে কোন কথা বলতে পারলাম না। এতক্ষণ অব্দি নিজেকে সামলে শান্তর সামনে অভিনয় করে গেলেও এখন পারলাম না। তাই নিজেকে সামলাতে এবার চুপ করতে হলো। নয়তো কথা বলতে গিয়ে কান্না করে দিবো। শান্ত আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,“কাঁদতে মন চাইলে কাঁদুন পুষ্প। নিজেকে তো সবসময় ঠকান। আমার সামনে নাই বা ঠকালেন। বিশ্বাস করুন আপনি কাঁদলে আমি কিছুই মনে করবো না। আর না আপনাকে কাঁদতে বারণ করবো।”

”শান্ত এবার আপনি যান।”
আমি বহুকষ্টে কথাটি বললাম। এটা শুনে শান্ত বললো,“অবশ্যই যাবো। আপনার এখানে থাকতে আসিনি। আমার সঙ্গে বিয়ে করে এলাকায় গেলে হয়তো আপনি মুখ দেখাতে পারবেন না। বখাটে ছেলের বউ হয়ে থাকতে আপনার কষ্ট হবে। তাই চিন্তা করবেন না এই বখাটে ছেলে আপনার অঙ্গের কলঙ্ক হবে না।”

আমি এই কথাটি শুনে চোখ তুলে শান্তর দিকে তাকাই। শান্ত আবার বলে,“শুধুমাত্র এটাই যদি আমার প্রতি থাকা আপনার অনুভূতির লোকানোর কারণ হয় তাহলে আমি আপনাকে কিছুই বলবো না পুষ্প। কিন্তু…।”
শান্ত কথাটি সমাপ্ত না করে থেমে যায়। অতঃপর চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। শান্ত দরজার কাছে যেতে আমি বললাম,“আজ থেকে আপনি আমার সঙ্গে বন্ধুত্বও রাখবেন না শান্ত?”

”না। কারণ আমার হৃদয়ে যা আছে সেটা বন্ধুত্বে সীমাবদ্ধ নেই। আর যে আমার হবে না তার সংস্পর্শে থেকে, হাসিমুখে সারাজীবন ভালো বন্ধুর অভিনয় আমি করতে পারবো না। স্যরি। আপনি নিজেকে ঠকাতে পারেন কিন্তু আমি নই।”
শান্ত কথাগুলো বলে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। শান্ত বের হয়ে যেতে আমি ধপ করে মাটিতে বসে পড়ি। আমার চোখের পানি বাঁধ ভেঙে গড়িয়ে পড়ে। কান্নারত অবস্থায় আমার মাথায় একটি কথাই আসছে,“নিজেকে ভালোবাসতে চাই শান্ত। নিজের জন্যই ভাবতে চাই। কিন্তু সত্যি তো এটাই। আমি নিজের কথা ভেবে আপনার ক্ষতি করতে যাচ্ছি। আপনার বাবা বলা একটাও কথাও তো মিথ্যে নয়। সেগুলো অস্বীকার করবো কিভাবে আমি?”

আমার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পারছি না। কোথাও গিয়ে আটকে যাচ্ছে। তাই নিরবে চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। গত তিনদিন ধরে শান্তর প্রতি জাগা আমার হৃদয়ের অনুভূতিগুলোকে খুব করে মে রে ফেলতে চেয়েছি। কিন্তু পারিনি। যতবার আমি এই চেষ্টা করেছি ততবার শুধু বালিশ ভিজিয়েছি। অথচ সেদিন রাতটা আমার খুশির হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু হলো না। আমার চোখের সামনে সেদিন রাতের ঘটনা ভেসে উঠলো।

রাত বারোটার দিকে শান্তর বাবা আমাকে ফোন দেয়। আমি ফোনটা ধরতে সে বলে,“তুমি পুষ্প বলছো?”

“হ্যাঁ। আপনি কে?”
আমার প্রশ্ন শুনে সে খুব রাগান্বিত গলায় বলে,“তুমি যে ছেলেটার গলায় ঝুলতে চাচ্ছো আমি তার বাবা। এই মেয়ে বলি তোমার কোন লাজ শরম কিছু নেই। নিজের বয়সের চেয়ে ছোট একটা ছেলেকে বিয়ে করতে চাইছো? নূন্যতম লজ্জা নেই?”
আমি তার কথা শুনে তাকে বোঝাতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু সে আমাকে বোঝানোর কোন সুযোগ না দিয়ে বলে,“এই এলাকায় আমার একটা সম্মান আছে। আমার ছেলে ফেলনা মোটেই নয়। যে রাস্তা থেকে কেউ একজন চাইলেই তার গলায় ঝুলতে পারে। বয়স নিয়ে না ভাবো অন্তত পরিচয় নিয়ে তো ভাববে? দেবার মতো তোমার কোন পরিচয় আছে? যা আছে সেই বাবা, মায়ের সঙ্গেও তো তোমার কোন যোগাযোগ নেই।”
পাশ থেকে শান্তর মা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে বলে,“শান্তর বাবা থামো।আমি শান্তর থেকে নাম্বারটা নিলাম যাতে আমরা মেয়েটার সাথে কথা বলে তাকে বুঝতে পারি, চিনতে পারি। আর তুমি এসব কী করছো? শান্তর পছন্দ ও।”

“তো? শান্ত পছন্দ করেছে বলে এই মেয়েকেও তার গলায় ঝুলতে হবে? এলাকার লোকজন আমাকে যেদিন বলেছিলো শান্ত এই মেয়েটার সঙ্গে ঘুরছে সেদিনই আমার ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু তখন ওরা বললো এই মেয়ের নাকি শারীরিক সমস্যা আছে। ছেলে মানুষ এর থেকে নিরাপদ। কিন্তু কই? ঠিকই তো আমার ছেলের মাথাটা খেলো? আর তুমি যে বলছো ও শান্তর পছন্দ তা ওকে বিয়ে করে এই পাড়ায় ওর কী পরিচয় দিবে? সারা পাড়ার লোক তো আমার ছেলের পুরুষত্ব নিয়ে প্রশ্ন করবে।
এতটুকু কী এই মেয়ে বোঝে না? শান্ত ওর সঙ্গে যায়? ওর মাথায় এতটুকু নেই যে শান্তর সঙ্গে বিয়ে হলে ওকে এই এলাকায় আসতে হবে। আর এখানে সবাই ওকে কতটা খারাপ চোখে দেখে। সবচেয়ে বড় কথা ওর যে বাবা, মা তারাই তো ওকে ভালো চোখে দেখে না। এখন তো বলে বেড়াচ্ছে, ছেলে নিয়ে ফুর্তি করবে তাই ঘরছাড়া হয়েছে। শারীরিক সমস্যা ট্রিটমেন্ট করে ঠিক করে নিয়েছে। তুমি বুঝতো পারছো এই মেয়েটাকে এই এলাকায় ঠিক কোন চোখে দেখে? কোন ভদ্র বাড়ির মানুষজন জেনেশুনে এমন মেয়ে ঘরে তুলবে? এটা এই মেয়ে বোঝে না?”
শান্তর বাবার কথাগুলো শুনে আমি একদম হতভম্ব হয়ে গেলাম। তার সবগুলো কথা আমার হৃদয়ে এসে বড় ধাক্কা দিলো। এই ধাক্কা সামলাতে না সামলাতে শান্তর বাবা আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো,“শোনো মেয়ে। আমি জানি না তুমি ভালো না খারাপ। কিন্তু আমি একটা সমাজে চলি। এখানের সবার কথার দামটা আমি দেই। আমার ছেলে দেয় না সেটা আলাদা বিষয়। কিন্তু আমি দেই। তাই দয়া করে আমার মান সম্মান নষ্ট করতে এসো না। আমার ছেলেকে ছেড়ে দাও। শান্ত ওর বয়সের দোষে এমন একটা সম্পর্কে জড়িয়ে গেছে। কিন্তু যখন বয়স হবে তখন ও ঠিক বুঝতে পারবে এটা ভুল।তাই তোমার ভালোর জন্য বলছি তুমি এমন ছেলেকে খুঁজে নাও যার পরিবার নেই। যাদের পরিবার রয়েছে তারা তোমাকে কখনো মানতে পারবে না। উল্টো তাদের সন্তানের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়ে যাবে। আমার ছেলের সঙ্গে যেটা তুমি এখন করতে চাইছো।তাই বলছি অনাথ কাউকে খুঁজে নাও। ভালো ছেলের অভাব নেই এই জগতে। সেই সঙ্গে তোমার বয়সের সঙ্গে যায় এমন ছেলেরও অভাব নেই।”

আমি এসব কথা শুনে পুরো হতবাক হয়ে যাই। ফোনটা কেটে দেই। সেই মূহুর্তে ফোনটি বন্ধ করে নেই। অতঃপর তার কথাগুলো গভীরভাবে ভাবলাম। না। তার কথায় কোন ভুল নেই। আর না তার চাওয়ায়। সবগুলো কথা সত্যি। অনেক বেশি সত্যি। যেই সত্যির তেজ আমি নিজে পারিনি। একদম পারিনি। শান্তর বাবা, মা কেউ আমাকে পছন্দ করে না। যদিও তার মায়ের কথা মনে হয়েছে শান্তর জন্য সে মেনে নিবে। কিন্তু সেটা তো মন থেকে নয়।

____
শান্ত বাসায় এসে দরজা বন্ধ করে সিগারেট বের করে ধরায়। সে সিগারেটে টান দিতে কাশি উঠে যায়। তার এখন এটাও ভালো লাগছে না। তাই সিগারেট ফেলে দেয় শান্ত। তার মনের ভেতর এখন কেমন করছে কাউকে বোঝানোর মতো নয়। সে পারছে না এখন নিজেই নিজেকে আঘাত করতে। শান্ত নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে বিছানায় উপর হয়ে শুয়ে পড়ে। মাথার উপর বালিশ চাপা দেয়। এই মূহুর্তে এমন করলে তার ভালো লাগছে। শান্ত এমনটা করে ঠান্ডা মাথায় ভাবতে শুরু করে। তার চোখের সামনে পুষ্পের সঙ্গে কাটানো সুন্দর মূহুর্তগুলো ভেসে উঠছে। সবচেয়ে বড় কথা আজ পুষ্পের কাজলহীন কাঁদো কাঁদো চোখ তার মস্তিষ্ক থেকে সরছে না। ঐ চোখে সে স্পষ্ট তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার যন্ত্রণা দেখেছে। শান্ত ঠান্ডা মস্তিষ্কে পুষ্পের এসব করার কারণ ভাবছিলো। শুধুমাত্র তার বাচ্চামোর জন্যই সে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসব ভাবতে শান্তর মনে হয়,“ও তো আমার সব স্বভাব জানে। আমার সম্পর্কে সব জানে। লোকে কী ভাবে তাও জানে। তবে কেন এই কারণে ভালোবাসা প্রকাশ করবে না। না এটা নয় কারণ।”
হঠাৎ শান্তর মনে পড়ে সে তার মাকে পুষ্পর ফোন নাম্বার দিয়েছিলো। তার মা বলেছিলো, পুষ্পকে সে ব্যক্তিগতভাবে তো চেনে না। তাই সেটা চিনতে যোগাযোগ করবে। শান্তও স্বাভাবিকভাবে সেটা দিয়েছিলো। শান্তর মাথায় এসব আসতেই সে মেজাজ হারিয়ে ফেলে। সেদিন রাতে পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে বের হয়েছিলো। আর তখন বাবা বাসায় আসায় মা হয়তো সব বলে দিয়েছে। যেটা বাবা মানতে পারেনি।

শান্ত সারারাত বসে সমস্ত হিসাব মিলিয়ে নিয়েছে। সেদিন রাতের পর তার বাবার সবসময় তাদের মান সম্মান নিয়ে কথা বলা। শান্তকে নিয়ে তার অনেক আশা। এসব কথা ঘনঘন বলছিলো। এসব কথার অর্থ সেই সময়ে বুঝতে না পারলেও এখন বুঝতে পারলো শান্ত। ভোরের আলো ফুটতে সে বাসা থেকে হন্তদন্ত হয়ে বের হয়। সোজা পুষ্পের বাসায় চলে আসে। কলিংবেলে চাপ দিতে পুষ্প দরজা খুলে ফেলে। পুষ্পর এত দ্রুত দরজা খোলা দেখে শান্ত বলে,“কাল রাতে যেখানে রেখে গিয়েছিলাম সেখানে বসেই রাতটা পার করে দিলেন বুঝি?”

শান্তর কথার ভাবার্থ বুঝতে পুষ্পের অনেকটা সময় লাগে। তার চোখমুখের অবস্থা দেখেই মনে হচ্ছে সারারাত ঘুমায়নি। সেই সঙ্গে এত সকালে শান্তকে এখানে আশা করেনি। তাই তাকে দেখে অবাক হয়েছে। শান্ত পুষ্পকে আরও অবাক করে দিয়ে গায়ের জোরে একটি থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। শান্তর থাপ্পড় খেয়ে পুষ্প কিছুটা দূরে ছিটকে যায়। একটি থাপ্পড়ের রেশ কাটতে না কাটতে শান্ত আরও একটি থাপ্পড় দিয়ে বসে। অতঃপর বলে,“শালার রাগ এবার ঠান্ডা হলো। মেয়েদের গায়ে হাত তোলায় আমি বিশ্বাসী নই। কিন্তু তোর মতো মহান নামক প্রানীর গায়ে হাত তোলায় আমি বিশ্বাসী।”


চলবে,