#ইচ্ছেঘুড়ি (৩৫)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
কাজল এবং জয়ের নতুন সংসার শুরু হলো। তারা বেশ ভালো রয়েছে। জয় চেষ্টা করছে কাজল এবং তার পরিবারকে খুশি রাখার৷ কিন্তু পারছে না। যদিও রোজ নিয়ম করে মায়ের সঙ্গে দেখা করে আসছে। তার হাতেই রাতের খাবারটা খেয়ে আসে। তবুও তার বাবা, মা সবকিছু স্বাভাবিক নিতে পারেনি। হয়তো কখনো পারবেও না। এটা মেনে নিয়েই জয় তার দায়িত্ব পালণ করে যাচ্ছে। তবে তার মা সুযোগ পেলেই চেষ্টা করে কাজলের নামে বদনাম করতে।জয় সেসবে কিছু বলে না। না সেগুলো কানে দিচ্ছে।
এই তো আজও জয় মায়ের হাতের লাউ চিংড়ি রান্না দিয়ে ভাত খাচ্ছিলো। সেই সময়ে তার মা বলে,“তুই যে আমার হাতে খেয়ে যাচ্ছিস, এটাতে তোর বউ রাগ করে না? তুই তো ঐ মেয়ের কথা ছাড়া চলিস না। অলক্ষী মেয়েটা আমাদের নামে তো সুযোগ পেলেই তোর কান ভাঙায়। সেসব কানে না নিয়েও যে দেখা করতে আসিস এটা তো আমি ভাবতেই পারছি না। নিশ্চয় কালনাগিনীটাকে না জানিয়ে আসিস। জানিয়ে আসলে তো কালনাগিনীটা তোকে নির্ঘাত শেষ করে দিতো।”
জয় এসব শুনে যায়। কিন্তু কিছু বলে না। হয়তো স্বামী হিসাবে তার বলা উচিত ছিলো। কিন্তু সে চাচ্ছে না বাবা, মায়ের মনে কষ্ট দিতে৷ তাছাড়া সে তো জানে কাজল কেমন? তাই এসব কথা তারা বললেও বা কি। এসব ভেবে জয় সবসময় কথাগুলো হজম করে নেয়। অতঃপর মাকে বিদায় জানিয়ে বাড়ি ফিরে আসে।
রাতে জয় বাড়ি ফিরতে কাজল মুখে হাসি ফুটিয়ে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে,“ঐ বাড়ি থেকে খেয়ে আসছো?”
“আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। তুমি খাবার বাড়ো।”
জয়ের মুখে এই কথা শুনে কাজল কিছুটা মজা করেই বলে,“ঐ বাড়ি থেকে খেয়ে এসেও কেন সবসময় এই প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে খাবার বাড়তে বলো? ভরা পেটে কেন জোর করে আবার খেতে বসো? এটা ঠিক নয়। আমি তো তোমাকে তোমার মায়ের বাড়ি থেকে খেয়ে আসতে বারণ করছি না। বা এটা নিয়ে রাগ দেখাচ্ছি না।”
”জানি।
কিন্তু আমি তো সন্তানের সঙ্গে স্বামীও। রোজ দুপুরে তো হয় না একসাথে খাওয়া৷ তাই এই রাতটুকু তুমি যে আমার সঙ্গে খাবার খেতে চাও এটা আমি জানি। তুমি এটা করলে খুশি হবে। নিজের স্ত্রীকে এতটুকু খুশি দিতেই পারি। তাই না?”
কাজল জয়ের এমন ভাবনা চিন্তা দেখে খুশি হয়। জয় মুচকি হেসে আবার বলে,“এটাও তো আমার দায়িত্ব। তো নাহয় অল্প করে দুবার খেলাম। ক্ষতি তো নাই।”
কাজল খুশি হয়ে জয়কে জড়িয়ে ধরে। সে খুশি মনে বলে,“এমন একজনকেই তো চেয়েছিলাম। যে নিজের বাবা, মায়ের সঙ্গে আমার কথাও ভাববে। আমার খুশির জন্য কিছু করবে।”
একটু থেমে কাজল আবার বলে,“জয় এখন আমি খুব খুশি। তোমার ছোট ছোট যত্ন, আমার জন্য ভাবনা এখন আমায় মুগ্ধ করে। তবে এটাও সত্যি আমি চাইনি আমার জন্য তোমাকে এভাবে দোটানায় পড়তে হোক। বাবা, মায়ের থেকে দূরে থাকতে হোক। এটার জন্য আমি সত্যি স্যরি।”
“এখানে তোমার ভুল কোথায়? শুধু শুধু স্যরি বলে আমাকে অপরাধী করছো কেন?
তাছাড়া আমি তো বাবা, মায়ের থেকে দূরে চলে যাইনি। বাবা, মা বা সন্তান কেউ চাইলেই দূরে সরে যেতে পারে না।”
জয়ের কথায় কাজল খুব খুশি হয়। সে শক্ত করে জয়কে জড়িয়ে ধরে। সেই মূহুর্তে কাজলের ফোনটি বেজে উঠে। কাজল জয়কে ছেড়ে ফোনটি ধরতে চলে যায়।
___
তিন দিনের মাথায় বিয়ের আয়োজন করে ফেললেন শান্তর বাবা, মা। আমার ছুটি কম। তাছাড়া একই বাড়িতে আমিও থাকছি এসব নিয়ে পাড়া প্রতিবেশীদের মাঝে গুঞ্জন তৈরি যাতে না হয় তাই দ্রুত সব ব্যবস্থা করে ফেললেন তারা।
কমিউনিটি সেন্টারটি যেন এক নতুন রূপে সেজে উঠেছে। বিশাল হলঘর জুড়ে ঝলমলে আলো, ছাদের সঙ্গে ঝুলছে সোনালি আর লাল রঙের পর্দা, চারপাশে ফুলের মালা দিয়ে সাজানো হয়েছে। প্রবেশদ্বারের দু’পাশে রঙিন আলপনা আঁকা, আর গেটের ওপর ঝোলানো ফুলের তোড়ায় যেন অতিথিদের স্বাগত জানাচ্ছে এক নতুন জীবনের শুরু।
মঞ্চ অথবা বলা যায় আসনমঞ্চ, সেটি যেন সাজানো এক রাজসিংহাসন। লাল মখমলের কাপড় দিয়ে ঢাকা চেয়ার দু’টি পাশাপাশি রাখা, চারপাশে ফুলের মালা, আর মাথার ওপর ঝাড়বাতির আলো পড়ে চারপাশকে আরো রাজকীয় করে তুলেছে।
আমি লাল রঙের শাড়ীতে সেজে উঠেছি, যেন আগুনের শিখার মতো দীপ্তিময়। কপালে টিপ, হাতে চুড়ির ঝঙ্কার, গায়ের গয়নায় ঝলমলে আভা। সব মিলিয়ে লাল বউ সাজ যেন নতুন এক প্রাণের আহ্বান। লাল রঙের ঐতিহ্য আর সৌন্দর্য আমাকে এক অনন্য আবহ দিয়েছে।
শান্তও সেজেছে লাল পাঞ্জাবিতে। গাঢ় লাল রঙ তার গায়ের ওপর দারুণ মানিয়েছে। সে মঞ্চের পাশে বসে আছে আমার ঠিক পাশে, দুজন মিলে যেন একে অপরকে সম্পূর্ণ করেছে।
ধীরে ধীরে আত্মীয়স্বজনরা আসতে শুরু করেছে। কারো হাতে উপহার, কারো মুখে হাসি, কারো চোখে আবেগ। কোলাহলে ভরে উঠছে হলঘর, বাচ্চাদের হাসি, বড়দের শুভকামনার আওয়াজ, আর চারদিকে আনন্দের আবহ। তবে কারো কারো মন্দ কটুক্তি রয়েছে। কেউ বা বিদ্রুপের হাসিও দিচ্ছে। কিন্তু আমি সেসবে গুরুত্ব না দিয়ে শান্তর দিকে তাকিয়ে আছি। শান্ত আমার তাকানো লক্ষ্য করে মুখে এক মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে তুলে অতিথিদের সঙ্গে কথা বলছে। তার বন্ধুরা আসতে তাদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলো। তবে হ্যাঁ বিয়ের এতসব আয়োজন এসব শান্ত করেনি। সবটা তার বাবা, মা করেছে। আজকে যে আমরা লাল রঙে সাজবো সেটাও তারা ঠিক করেছে। যদিও এটা আমাকে ভালোবেসে নয়। সবটা নিজেদের ছেলেকে ভালোবেসে করেছে৷
দলে দলে আসা আত্নীয়র মাঝে হঠাৎ বাবা, মাকে দেখে অবাক হলাম। তারা এসেছে! আমি ভাবতে পারছি না। কিন্তু তারা এসব আয়োজনের কথা কিভাবে জানলো? আমি তো জানায়নি। যদিও জানানো উচিত ছিলো। কিন্তু সংকোচবোধ হওয়ায় জানায়নি। তারা আমার ডাক ভালোভাবে নিবে না। তাছাড়া শান্তর বাবা, মা যদি এটাকে খারাপ ভাবে নেয়। এতসব কিছু ভেবে কিছুটা স্বার্থপরের মতোই তাদের দূরে ঠেলে দিলাম। আমি বসে বসে এসব ভাবছিলাম সেই সময়ে বাবা, মা আমার কাছে এগিয়ে আসে। কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বাবা বলে,“বাহ্। সারাজীবন মানুষ করলাম আমরা। অথচ আমাদের ছাড়াই বিয়ে করেছো। এতবড় আয়োজন হলো বিয়ের অথচ আমরা জানি পাড়া প্রতিবেশীর থেকে। ভালোই প্রতিদান দিলে।”
“এজন্যই বলে পর কখনো আপন হয় না। তুমি যে আমাদের পর সেটা প্রমাণ করে দিলে।”
মায়ের কথা শুনে আমি কিছুটা কষ্ট পেলাম। বাবা, মাকে আমার দিকে আসতে দেখে শান্ত বন্ধুদের ছেড়ে আমার কাছে আসে। সে বাবা, মায়ের কথা শুনে হাসিমুখে বলে,“আপনারা তো ভালোই মজা করতে জানেন আংকেল আন্টি। এটা কিন্তু ভালো।”
“মানে!”
বাবা মা বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে। শান্ত হাসতে হাসতে বলে,“আরে আমি আপনাদের জামাই। নিজ পায়ে হেঁটে নিজ মুখে গিয়ে আপনাদের দাওয়াত দিয়ে আসলাম। আর আপনি কি-না বলছেন বিয়ের খবর পাড়া প্রতিবেশী দিয়েছে। বাহ্। আমার শ্বশুড় শাশুড়ী তো বেশ মজার। তাহলে আমাদের ভালো জমবে কিন্তু।”
শান্তর কথা শুনে বাবা, মা হচচকিয়ে যায়। মা কিছুটা বাকা গলায় বলে,“আমরা জানি তুমি কেমন ছেলে? এই পাড়ায় কি কি না করে বেড়িয়েছো? তাই আমরা তোমার সঙ্গে মুখ লাগাতে চাই না। তুমি দাওয়াত দিয়েছো এসেছি। যদিও আসতাম না। তবে ভাবলাম যাই দেখি, পঁচা শামুকে পা কেটে মেয়ে আমার কী অবস্থায় আছে? বাবা, মাকে ছাড়া বিয়ের মতো সিদ্ধান্ত নিলে কপালে যে বখাটে গুন্ডা জুটবে এটা জানাই ছিলো। তাও একটু দেখতে আসলাম।”
“ওহ আচ্ছা। বলবেন না আপনার বাড়ি গিয়ে গুন্ডামি করে এসেছিলাম তো। আমার তো মনেই ছিলো না। ইশ বড় ভুল হয়ে গেছে।”
শান্তর মজার ছলে এভাবে জবাব দেওয়া দেখে বাবা, মা বিরক্তি নিয়ে অন্যদিকে চলে গেল। তারা চলে যেতে আমি শান্তকে আস্তে করে জিজ্ঞেস করি,“আপনি বাবা, মাকে ডেকেছেন?”
”হ্যাঁ।”
“কেন? শুধু শুধু…।”
আমাকে থামিয়ে দিয়ে শান্ত বলে,“তারা যেমনই হোক তোমার এই বিশেষ দিনে তাদের উপস্থিতি তুমি আশা করছিলে। যেহেতু আমি তোমার দায়িত্ব নিয়েছি তো তোমার আশা পূরণ করাও তো উচিত।”
শান্তর কথা শুনে আমি তার চোখে চোখ রাখলাম। শান্তর হাসি মুখে বলে,“ভয় নেই। তারা এখানে তোমাকে কষ্ট দিতে পারবে না। আমি আছি তো।”
শান্তর এই ছোট ছোট কথাগুলোর মাঝে অনেক গভীরতা লুকিয়ে রয়েছে। যা আমাকে বরাবরই মুগ্ধ করে। তবে বাবা, মাকে দেখে আমার মনে হলো এখানে তাদের সঙ্গে কাজল থাকলে ভালো হতো। বাবা, মা তো এখানে আমার ভালো চেয়ে মোটেও আসেনি। কিন্তু কাজল আসলে আজকের এই দিনে আমার ভালোটাই চাইতো। আমি এসব ভাবতে ছিলাম তখন শান্ত আস্তে করে,“আপনার এই ইচ্ছেও পূরণ হয়ে গেছে।”
আমি শান্তর কথা বুঝতে না পারলে শান্ত ইশারায় সামনে তাকাতে বলে। আমি সামনে তাকিয়ে দেখলাম কাজল আসছে। মেরুন কালারের একটি শাড়ী পড়ে হালকা সাজে কাজল এখানে আসলো। কাজল এগিয়ে আসতে শান্ত কুশল বিনিময় করে বললো,“আপনি আমার ফোন পেয়ে যে এসেছেন তার জন্য ধন্যবাদ। আমি খুব খুশি হলাম। সঙ্গে ভাইয়া থাকলে আরও ভালো হতো।”
“জয়ের আসলে একটা কাজ পড়ে গেছে। তাই আসতে পারেনি।”
শান্ত ইশারা বোঝালে সমস্যা নাই। অতঃপর সে আমাদের কথা বলতে দিয়ে চলে যায়৷ কাজল আমার দিকে তাকায়। তবে আমি তার দিকে তাকাই না৷ কারণ আমি জানি কাজলের দিকে তাকালে আমি তার চোখে আমার জন্য অভিমান দেখতে পাবো। এর মাঝে কিছু আত্মীয় এসে আমার সঙ্গে কথা বললো। আমি তাদের সঙ্গে টুকটাক কথা বলে কোনমতে বিদায় করলাম। তারা চলে যেতে কাজল বললো,“নিজের জন্য ভেবে ঘর ছেড়েছো সেই অব্দি ঠিক ছিলো আপা। তাই বলে একেবারে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিবে? আমার সঙ্গে একবার যোগাযোগ করা যেতো না? তোমার মনে হয় আমি তোমার খারাপ চাইতাম আপা?”
কাজলের অভিমানে ভরা কথাগুলো শুনে আমি থ মেরে গেলাম। কোনমতে বললাম,“কাজল আমি আসলে…।”
“থাক কিছু বলতে হবে না। যোগাযোগ রাখোনি ভালো। তাই বলে বিয়ের কথাটাও আমাকে জানানো গেল না?”
কাজল অভিমান ভরা কন্ঠে আরও কিছু কথা বললো। তার কথার জবাব আমি দিতে পারলাম না। সত্যি তো তাই। আমি ভীষন স্বার্থপরের মতো ব্যবহার করেছি।কাজল তো আমায় ভালোবাসতো। তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ করা উচিত ছিলো। কিন্তু আমি যে কোন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেটা আমিই জানে। কাজল আমার নিরবতা দেখে বলে,“যাক সেসব বাদ দেই। আমার বাবা, মা তোমার সঙ্গে যা করেছে তাতে এটা আমার প্রাপ্য ছিলো না।”
“স্যরি বোন। এই মূহুর্তে দাঁড়িয়ে এটা বলা ছাড়া আমার কোন উপায় নেই।”
আমার মুখে এই কথা শুনে কাজল হেসে বলে,“হয়েছে। যা হয়েছে তা নাহয় বাদ দেই। তাহলে হয়তো জীবনের সমীকরণ সুন্দর হবে।”
কাজলের কথায় আমি মাথা নাড়াই। কাজল এবার আমার হাত ধরে। মিষ্টি করে বলে,“তোমার উপর রেগে নেই আমি। একটু অভিমান হয়েছে তবে সেটা দূর হয়েও যাবে। কিন্তু আপা আমার খুব ভয় হচ্ছে। তুমি জীবনে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছো সেটা ঠিক নিয়েছো তো?”
“মানে?”
আমি বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম। কাজল কিছুটা দ্বিধা নিয়ে বলে,“ওনি তোমার বন্ধু ছিলো। সেটাই ঠিক ছিলো না। এই ছেলেটা আদৌ তোমার স্বামী হওয়ার যোগ্য। তুমি তো জানো এই ছেলেটা কেমন। এলাকার কম বেশি সবাই একে খারাপ বলেই জানে। তেমন ছেলেকে তুমি…।”
কাজলের কথার ভাবার্থ বুঝতে পেরে আমি তাকে থামিয়ে দিলাম। অতঃপর বললাম,“ও আমার জীবনে দেখা সেরা একজন মানুষ। আমি কোন ভুল সিদ্ধান্ত নেইনি কাজল। তাছাড়া শোনা কথায় বিশ্বাস করতে নেই। তুই ওর সম্পর্কে শুনেছিস। আর আমি ওকে কাছ থেকে দেখেছি, চিনেছি। তুই নিশ্চয় বিশ্বাস করিস তোর আপা মানুষ চিনতে জানে।”
আমার এই কথায় কাজল মাথা নাড়ায়। তবুও তার মুখের সংকোচ ভাব কাটে না। কাজল তার আপাকে খুব ভালোবাসে তো। তাই তার জীবনটা যাতে সুন্দর হয় সেটাই চায়। এজন্যই এটা নিয়ে বেশি ভাবছে। এসব বুঝতে পেরে আমার খুব ভালো লাগলো। আমার বোনটা আমার বাবা, মায়ের মতো হলো না। আমি এসব প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে কাজলের সংসার কেমন যাচ্ছে সেসব জানতে চাচ্ছিলাম। কাজল সব ভালো বললো। এসবের মাঝে শান্তর বাবা, মা আমার কাছে আসছিলো তাদের এক ঘনিষ্ঠ আত্নীয়কে নিয়ে। হয়তো নতুন বউয়ের সঙ্গে পরিচয় করাবে। কিন্তু তারা কাছে আসতেই আমার বাবা, মায়ও সামনে আসলো। নিজ থেকে কথা বলে মা বলে,“বেয়াইন আপনাদের তো অবস্থা শান্তি সবই ভালো। হ্যাঁ ছেলেটা একটু বিগড়ে যাওয়া। তাই বলে শারীরিক সমস্যা আছে, বয়স্ক মেয়েটার সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিয়ে দিলেন? এটা কিন্তু আপনারা ভালো করলেন না। আরে ডাক্তার দেখাবে শুনছিলাম দেখিয়েছে কি-না তা তো জানি না। সেটা না জেনেই বিয়ে দিয়ে দিলেন।”
“আরে তুমি বুঝলে না কাজলের মা। হয়তো ছেলেরও একই সমস্যা আছে। তাই বিয়ে দিয়ে দিয়েছে।”
বাবা মায়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কথাটি বললো। আমি এটা শুনে লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললাম। কাজল বিরক্তি নিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগে শান্তর বাবা বলে,“আসলে কী বলুন তো? এই সমাজে শকুনির অভাব নেই তো। কিছু তো আপনাদের মতো। মানুষের বেশ ধরে থাকে। তারা আসলে লোকের ভালো দেখতে পারে না। সেজন্য এরকম সুন্দর এক পরিবেশে দাঁড়িয়ে পরিবেশটা নষ্ট করে।”
একটু থেমে শান্তর বাবা আবার বলে,“আমরা আমাদের বৌমা দেখেই চয়েজ করেছি। আর যদি নাও করি তাও আপনাদের কাছে তার দোষ বলতে যাবো না। স্যরি এটা আমাদের পার্সোনালিটির সঙ্গে যায় না। পুষ্প আমাদের বাড়ির বউ। ও ভালো হোক খারাপ হোক ও আমাদের বৌমা। আমাদের ঘরের লোক। তার সম্মান রক্ষার দায়িত্ব আমাদের। তাই আশা করবো এই সুন্দর এক পরিবেশে দাঁড়িয়ে এমন কিছু বলবেন না বা করবেন না যাতে আমি বাধ্য হই আপনাদের এখান থেকে বের করে দিতে। আর হ্যাঁ অবশ্যই আমার ছেলেটা বিগড়ে গেছে। তাই সাবধান। তার সামনে এসব বলবেন না। আড়ালে আবডালে কানাঘুষা করছেন করেন। ভুলেও আমার ছেলের সামনে বলে নিজেদের বিপদ ডাকবেন না। ছেলেটা তো বিগড়ে যাওয়া জানেনই। তার স্ত্রীর সম্মান রক্ষায় কখন কী করে ফেলে বলা যায় না। তাই সাবধান।”
শান্তর বাবার মুখে এসব কথা শুনে বাবা, মা বেশ অপমানিত হয়। তারা স্থান ত্যাগ করে। শান্তর বাবা, মা এলাকায় খুব সম্মানীয়। শান্তর সম্পর্ক এলাকায় যাই ছড়াক না কেন? তো এমন একটা পরিবারে আমার বিয়ে হয়েছে এটাই মেনে নিতে পারছে না বাবা, মা। তারা তো কখনো চায়নি আমার জীবনে ভালো কিছু ঘটুক। বাবা, মা এখান থেকে চলে যেতে শান্তর বাবা তার নিয়ে আসা আত্মীয়র সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেয়। আমি হাসি মুখে তার সঙ্গে পরিচিত হই। অন্যদিকে কাজল হতবাক হয়ে শান্তর বাবা, মাকে দেখতে থাকে। শান্তর বাবার কথা তার খুব ভালো লেগেছে। কাজল মনেমনে বলে,“ঠিক তো। খারাপ ভালো যাই হোক তাদের পরিবারের অংশ আপা। তার সম্মান তো তাদেরই রাখতে হবে। অথচ আমার শ্বশুড়বাড়ির লোক তারা যেচে অন্যের কাছে আমার নামে বাজে কথা বলতো। এখন তো আমার মনে হচ্ছে আপার সিদ্ধান্ত ভুল নয়। হয়তো শান্ত নামের ঐ বখাটে ছেলেটা আমাদের ভাবনার মতো নয়। সত্যি নয়।”
এটা ভেবে কাজল খুশি হয়। আমি কাজলের সঙ্গে শান্তর বাবা, মায়ের পরিচয় করিয়ে দেই। শান্তর বাবা তার এক বন্ধুর ডাকে সেদিকে যায়। শান্তর মা আমার হাতটি ধরে বলে,“তোমার তো ঐ ধরনের কোন সমস্যা নেই। তাহলে তুমি তাদের কথা শুনে লজ্জায় মাথানত করো কেন? দেখো এসব কিন্তু আমার ছেলে পছন্দ করে না। তোমার শ্বশুড়মশাই এইমাত্র কী বললে শুনলে? ভালো খারাপ যাই হও তুমি আমাদের বাড়ির বউ। আমার ছেলের বউ। আমরা তোমাকে পছন্দ করি বা না করি তাতে কিছু যায় আসে না। কারণ তুমি আমাদের নও বরং আমাদের ছেলের সঙ্গে সংসার করবে। তাই অবশ্যই আমার ছেলে যেমনটা পছন্দ করে তেমনটা তোমায় হতে হবে। যেটা তুমি নও বা করোনি তার জন্য মাথানত করার কোন দরকার নেই। হ্যাঁ নতুন বউ৷ তাই কিছুটা লজ্জা তোমার মুখে থাকা উচিত৷ তোমার মুখে সেটা ছাড়া যেন অন্য কোন লজ্জা দেখতে না পাই।”
শান্তর মায়ের কথা শুনে আমি বিষ্মিত হলাম। তাদের ছেলে বলছে তাদের পছন্দের কাজ করতে। আর তারা বলছে ছেলের পছন্দের হয়ে উঠতে। তবে খারাপ নয়। শান্তর বাবা, মা উপরে উপরে কঠোর হলেও ভেতরে খুব নরম। তারা আমাকে না চাইতেও হয়তো মনের মাঝে জায়গা দিয়ে ফেলেছে। তাই তো আমাকে নিয়ে এতটা ভাবছে। জানি এটা শান্তর জন্য। তাও ভাবছে। এটা ভেবে আমার খুব খুশি লাগলো। আমার সঙ্গে কাজলও এসব দেখে খুব খুশি হয়। শান্তর মা চলে যেতে সে আমার হাত ধরে বলে,“আপা তোমার সিদ্ধান্ত হয়তো সঠিক। আমি এটাই চাই। তোমার জীবনের এই অধ্যায়টা খুব সুন্দর হোক।”
’
’
চলবে,
#ইচ্ছেঘুড়ি (৩৬)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
আমি বসে আছি৷ কাজল আমার পাশে বসা। এসবের মাঝে শান্তর বন্ধুরা তাকে নিয়ে এসে আমার পাশে বসালো। অতঃপর কিছু ছবি তুললো। এক পর্যায়ে শান্তর এক বন্ধু বললো,“ভাবী শান্তর একটু কাছে আসুন। নয়তো ছবিটা ভালো হচ্ছে না।”
আমি কথাটি শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম। সেই সঙ্গে লজ্জাও পাচ্ছিলাম। সাহস করে কাছে এগিয়ে যেতে পারলাম না। শান্তই এগিয়ে এলো। আমার ঘাড়ে হাত রাখে। আমি কিছুটা চমকে তার দিকে তাকায়। সে বরবারের মতো মিষ্টি হাসি দিয়ে চোখের ভাষায় বোঝালো,“রিলাক্স।”
আমিও মৃদু মাথা নাড়ালাম। এই অব্দি সব ঠিক ছিলো। এতক্ষণ অব্দি সবাই আড়ালে কানে কানে বদনাম করলেও কাছে এসে কোন কথা বলতে পারেনি। শুধুমাত্র আমার বাবা, মায়ই বলছিলো। তবে এবার একজন এসে হাসতে হাসতে বলে,“শান্ত আমাদের বৌমা তো ভালোই দেখতে। কিন্তু শুনলাম তার নাকি তোর চেয়ে বয়স বেশি।”
সে কথাটি অনেকটা উচ্চশব্দে বলে। আশেপাশের অনেকে শুনছিলো। সবাই বোধহয় বেশ মজাও পেলো। নিজেদের মধ্যে কথা বলা শুরু করলো। তবে এসব দেখে শান্ত ঘাবড়ে না গিয়ে হাসি মুখেই বলে,“কী করবো চাচা? এত সুন্দরী বউ পেয়েছি জীবনে যে বয়সটা আর মাথায় ধরেনি। তাছাড়া বউ যদি এত সুন্দরী হয়, পাশে দাঁড়ালে হৃদয়ে ধুকপুকানি বেড়ে যায়। তাহলে এক বছরের বড় এটা তেমন বিষয়ই না।
এছাড়া এমন কোন আইন নেই তো যে বয়সে বড় কাউকে বিয়ে করা যাবে না।”
শান্তর এই কথাটি শুনে অন্য একজন বললো,“শান্ত বিয়ে না হতেই বউ পাগল হলি। এতটা পাগল হওয়া ভালো না। প্রথম প্রথম সবই মধু লাগে। তাই সাবধান।”
“ওহ আচ্ছা। তারমানে তোমার বউ তোমার কাছে প্রথম প্রথম মধু ছিলো। এখন বুঝি করলা। স্যরি গো। ও আমার স্ত্রী। আমার অর্ধাঙ্গিনী। বাজারের কোন পন্য নয় যে তাকে সবজি বা মধুর সঙ্গে তুলনা করবো। এসব কাপুরুষের কাজ। যারা জানে না স্ত্রীকে সম্মান দিতে তাদের কাজ।”
শান্তর বাকা বাকা কথায় সবাই বেশ হতভম্ব হয়। কেউ আর কথা বাড়ানোর সাহস পায় না। তবে পাশে একজন আর একজনকে বলছিলো,“মেয়ে তো কিছুই করতে পারবে না। তার মা নিজে বলছে শারীরিক সমস্যা আছে। তাও বিয়ে করলো। ছেলেটা সুন্দর দেখেই কপাল পোড়ালো।”
”কি যে করি। এখন তো মনে হচ্ছে লোকের কথা বন্ধ করতে বিয়ের বছরই বাচ্চা নিতে হবে। নয়তো লোককে বোঝানো যাবে না, শোনা কথা সবসময় সত্যি হয় না।”
শান্ত এতক্ষণ হাসিমুখে কথা বললেও এবার কিছুটা সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে,”আপনারা আমাদের অতিথি। এতক্ষণ অব্দি অনেক কানাঘুষা করেছেন। এবার বন্ধ করুন। আমরা যেমন আপনাদের যথার্থ অতিথির সম্মান দিচ্ছি সেটা গ্রহণ করুন। সেই সঙ্গে অবশ্যই আমাদের চিন্তা বাদ দিয়ে নিজেদের চিন্তা করুন। এটাই ভালো হবে। আর হ্যাঁ এতক্ষণ অব্দি আড়ালে আবডালে কানাঘুষা শুনে চুপ থাকলেও এবার কিন্তু থাকবো না।”
এই কথাটি বলে শান্ত আমার হাত শক্ত করে ধরে রাখে। অতঃপর বলে,“পুষ্প আমার স্ত্রী। তার সম্মান আমার কাছে অমূল্য। সেই সম্মান রাখার জন্য আমি যা ইচ্ছা তাই করতে পারি৷ তাই অবশ্যই আপনারা ভদ্রতা বঝায় রেখে এই অনুষ্ঠান উপভোগ করবেন। আমি এটাই চাইবো।”
শান্ত এসব কথা বলায় সবাই চুপ হয়ে যায়। যে যার মতো অনুষ্ঠান উপভোগ করতে ব্যস্ত হয়ে যায়। এদিকে আমি খুশিমনে শান্তর দিকে তাকিয়ে থাকি। আজকের এই দিনে শান্ত এবং তার বাবা, মা যেভাবে আমার পাশে দাঁড়ালো। লোকের কথাকে গুরুত্ব না দিয়ে আমার সম্মানের কথা ভাবছে সেটা আমার জন্য অনেক কিছু। যেখানে আমি এত বছর ধরে যাদের বাবা, মা ভেবে এসেছি। তারা আমার বিয়েতে এসে যেচে আমাকে অপমান করতে চাচ্ছে সেখানে দাঁড়িয়ে অন্যকেউ আমার সম্মানের জন্য লড়াই করছে। এটা আমার জন্য অনেক বড় কিছু। সত্যি বড়কিছু।শান্তর কথাগুলো শুনে কাজলও খুব খুশি হয়। এবার প্রথমবারের মতো সে তার কথায় হয়তো যোগ না করে বলে,“আপা তোর সিদ্ধান্ত সঠিক। এই ছেলেটা সত্যি তোর যোগ্য।”
এটা বলে কাজল মনেমনে বলে,“স্বামী তো এমনই হওয়া উচিত। যে সবার কথা শুনে এড়িয়ে না গিয়ে বরং স্ত্রীর হাত শক্ত করে ধরে বুক ফুলিয়ে বলবে, ও আমার স্ত্রী। ওর অসম্মান আমি মানবো না। সমাজের তথাগতিত ভদ্র ছেলেরা যারা ওপর পাশের মানুষ তাকে অভদ্র ভাববে বলে বউয়ের পাশে দাঁড়াতে লজ্জা পায় তাদের থেকে এমন এক বখাটের বউ হওয়া গর্বের। যে ভদ্রতা দেখিয়ে চুপ থাকবে না।
তবে এটাও সত্যি কিছু কিছু সন্তান বাবা, মায়ের শিক্ষাই পায়। শান্তর বাবা, মায়ের কথাবার্তা শুনেও ভালোই মনে হলো। তাদের মতো মানুষদের ছেলে বলেই হয়তো সে সবার সামনে দাঁড়িয়ে এসব কথা বলতে পারলো। দিনশেষে এই ছেলেরাই সুখে থাকতে বউ এবং বাবা-মাকে আলাদা আলাদা সংসার না দিয়ে বরং বাবা-মায়ের পাশে বউকে বসিয়ে সম্মানের সঙ্গে গল্প করবে।তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তুলবে।”
★
ধীরে ধীরে আত্মীয় স্বজন চলে যায়। অনুষ্ঠান প্রায় শেষের দিকে। হাতে গোনা কয়েকজন রয়েছে। তাদের বিদায় জানিয়ে আমরাও বাড়ির উদ্দেশ্য পা বাড়াবো। সেখানে আমার বধূবরন হবে। সেই সঙ্গে বাকি সব নিয়ম। আমার বাবা, মা চলে যাবার সময় আমার মা এসে শান্তর মাকে বলে,“আসছি বেয়াইন। ভালো থাকবেন। যদিও যে মেয়ে ঘরে ঢুকিয়েছেন হয়তো বেশদিন ছেলেকে কাছে পাবেন না। ছেলে পর হলো বলে। কষ্ট পাবেন না। মনকে সামলান।”
এসব কথা শুনে শান্তর মা হতভম্ব হয়ে যায়। সে বিষ্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকায়। আমি এটা লক্ষ্য করছিলাম। তবে দূরে থাকায় মায়ের কথা বুঝতে পারছিলাম না। শান্তর মা আমাকে দেখছে সেটা দেখে মা কিছুটা কষ্ট নিয়েই বলে,“মেয়ের যা বয়স। তাতে মনে হয় না আপনার নাতি নাতনি দেখার শখ পূরণ হবে৷ যদিও এসবের পর ভালো থাকা যায় না। তবে আশা রাখছি ভালো থাকবেন। দোয়া রইলো।”
এই কথার মাঝে আমি তাদের কাছে এগিয়ে আসলাম। মা আমাকে দেখে ম্লান হেসে স্থান ত্যাগ করে৷ এদিকে শান্তর মা চিন্তিত হয়ে আমার দিকে তাকায়। আমি তাকে এভাবে দেখে নরম গলায় বলি,“মা আপনি ঠিক আছেন?
আমার মা আপনার সঙ্গে বাজে আচরণ করেছে?”
আমি কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করি। এসব দেখে শান্তর মা আমার গালে হাত রেখে বলে,“আমি ঠিক আছি। এত ব্যস্ত হতে হবে। তুমি চলো। এবার আমাদেরও বাড়িতে যেতে হবে।”
আমি মাথা নাড়াই। তবে মনের মধ্যে একটা সন্দেহ থেকেই যায়। আমি নিশ্চিত মা বাজে কিছু বলেছে। শান্তর মা আমার মুখ দেখে কিছু একটা আন্দাজ করলো। তবে কিছু বললো না।
____
মধ্যরাত। বাসর ঘরে বসে আছি একা। শান্ত এই রাতে কোথায় গেল জানা নেই। শুধু যাবার আগে বলছিলো,“যাবো আর আসবো।”
এটা বলে সেই কখন চলে গেল। একা একা ভালো লাগছিলো না। এমনিতে বিয়ের এত নিয়ম কানুন, সব পালণ করতে গিয়ে এতটা রাত হয়ে গেল। সব মিলিয়ে সারাদিন যা গেল তাতে খুব ক্লান্ত। ঘুম পাচ্ছে। অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে শান্ত ঘরে এলো। ঘরের ভেতর প্রবেশ করে দরজাটি বন্ধ করে দিলো। আমি এটা দেখে শান্তর দিকে তাকালাম। নরম গলায় বললাম,“কোথায় গিয়েছিলেন?”
শান্ত জবাব না দিয়ে আমার দিকে একগুচ্ছ ফুল এগিয়ে দেয়। বিভিন্ন রকমের ফুল। আমি সেটা দেখে খুশি হয়ে বললাম,“এতরাতে এগুলো কিনতে গিয়েছিলেন?”
“আরে না।
পাগল আমি। এতরাতে আমার জন্য কোন দোকান খুলে থাকবে।”
“তাহলে এগুলো কোথা থেকে নিয়ে আসলেন?”
আমার কথার জবাব না দিয়ে শান্ত আমার পাশে বসে। অতঃপর বলে,“পারলে বলো তো।”
আমি ফুলগুলো নাকের কাছে নিয়ে ঘ্রান নিচ্ছিলাম। আর ভাবছিলাম এগুলো শান্ত কোথা থেকে নিয়ে আসছে। হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়তে আমি অবাক চোখে শান্তর দিকে তাকালাম। শান্ত চোখ টিপ দিয়ে মাথা নাড়ালো। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,“আবার আপনি আপনার মামাকে জ্বালাচ্ছেন? সে যদি সকালে দেখে আপনি তার গাছের অধিকাংশ ফুল নিয়ে আসছেন তাহলে কত কষ্ট পাবে? আপনি এমন কেন করেন শান্ত?”
“এমনি।”
শান্ত ভাব নিয়ে কথাটি বললো। আমি ম্লান হাসলাম। শান্ত আমার ডান হাতটি ধরে বলে,“তুমি খুশি হওনি ফুল পেয়ে?”
”হ্যাঁ খুশি। তবে সকালে মামা, মামী বাড়ি গিয়ে এসব দেখলে কী হবে সেটা ভেবে কিছুটা ভয়ে আছি।”
“আরে ছাড়ো তো।
আমি যে এই কাজ করেছি সেটা কী তারা জানে?”
এটা বলে শান্ত বেশ ফুরফুরে মেজাজে থাকে। আমি মাথা নাড়াই। কিছুটা আফসোস নিয়েই বলি,“অন্যদের স্বামীরা তাদের ফুল দেয়, কত সুন্দর হাঁটু গেড়ে প্রপোজ করে। আর আমার স্বামী। সে ফুল চুরি করে নিয়ে এসে আমার হাতে ধরিয়ে দিলো। কোন রোমান্টিকতা নাই তার মাঝে।”
আমার মুখে এই কথা শুনে শান্ত হেসে বলে,“রোমান্টিকতা দেখাবো?
আর হ্যাঁ এত প্রপোজ করার কী আছে? ফুলগুলো ভালোবেসে দিয়েছি এটাই তো অনেক। আমি তো তাও ভালোবেসে দিচ্ছি। আমার বউ তো আমাকে ভালোবেসে কিছুই দিলো না।”
“ওহ হ্যাঁ। স্যরি আমি তো কোন গিফট নিয়ে আসিনি। আমার…।”
আমাকে থামিয়ে দিয়ে শান্ত বলে,“অন্যদের স্বামীরা তো তাদের অনেক দামি দামি গিফট দেয়। সেখানে আমি তো তোমাকে বাসর ঘরে শুধু ফুল দিলাম। তাও চুরি করা ফুল। সে হিসাবে তুমিও আমাকে ক্ষুদ্র এক উপহার দিতে পারো।”
”কী?”
আমি বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করায় শান্ত হাসি মুখে বলে,“তুমি আমাকে আপনি থেকে তুমি ডাকতে পারো। এটাই নাহয় তোমার উপহার হোক। যেটা তোমার কাছে ক্ষুদ্র আমার কাছে সবচেয়ে দামি উপহার।”
শান্তর কথার ভাবার্থ বুঝতে পেরে আমি লাজুক হাসলাম। অতঃপর বললাম,“আচ্ছা চেষ্টা করবো।”
“চেষ্টা নয়।
এখন থেকে ডাকতেই হবে। নাও শুরু করো।”
“আচ্ছা তুমি।”
আমার কথাটা শুনে শান্ত জবাব না দিয়ে হাসি দেয়। অতঃপর ফুলগুলো আমার হাত দিয়ে নিয়ে নেয়। এটা দেখে আমি কিছুটা অবাক হলাম। শান্ত সেগুলো নিয়ে আমার হাত ধরে আমাকে দাঁড় করায়। আমি কিছু বুঝতে না পেরে ইশারায় জিজ্ঞেস করলাম,“কি?”
শান্ত জবাব না দিয়ে আমার সামনে সুন্দরভাবে ফুলগুলো এগিয়ে দিয়ে বলে,“আজকের এই বিশেষ দিনে আমি নাহয় পুষ্পকে একগুচ্ছ পুষ্প দিয়েই বরণ করে নিলাম। নাই বা করলাম হাঁটুগেড়ে প্রপোজ, নাই বা দিলাম রঙ্গ করে ফুল। অতি এই সাধারণ কর্মকান্ডে তুমি নাহয় খুঁজে নিও আমার ভালোবাসার গভীরতা।”
এটা বলে শান্ত খুব সুন্দরভাবে ফুলগুলো হাতে ধরিয়ে দেয়। অতঃপর সেখান থেকে একটি লাল গোলাপ নিয়ে আমার চুলের খোঁপায় গুজে দিয়ে বলে,“আমার ভালোবাসার গভীরতা অনুভব হলেও তুমি নাহয় আমাকে তোমার মুগ্ধকরা কন্ঠে তুমিতে সম্মোধন করলে। যদি এটা করে তবে ধরে নিবো তুমি আমার ভালোবাসার সব ভাষা বোঝো।”
“আমি তোমার ভালোবাসার সব ভাষা বুঝি না। খুব বোকা মেয়ে তো। তবে তোমার খুশির জন্য তোমাকে তুমি করে ডাকতেই পারি।”
আমার মুখে এই কথা শুনে শান্ত আমার দুই কাধে নিজের হাত রেখে আমাকে বুকের কাছে কিছুটা টেনে নিয়ে বলে,“অনেকদিন একসাথে ছাদে বসে চাঁদ দেখা হয় না। আজ সেটা হলে মন্দ হতো না, তাই না?”
শান্তর মুখে এই কথা শুনে আমার অতীতের কথা মনে পড়ে। যখন রাতের বেলা আমাদের বাড়ির ছাদে বসে শান্তর সঙ্গে আমি ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করেছি। সেই সময়ে হয়তো এমন অনুভূতি ছিলো না। তবে যেটা ছিলো সেটাও মন্দ নয়। এখন এই অনুভূতিময় আমিটা তার সঙ্গে ছাদে কাধে মাথা রেখে বসে চাঁদ দেখার অনুভূতিটা অনুভব করে মন্দ হতো না। আমারও ইচ্ছা করছে। তাই বললাম,“হ্যাঁ মন্দ হতো না।”
“মন্দ হতো না?
এখন আবার এটা বলো চলো ছাদে যাই। বাড়িতে থাকা লোকজন যদি এটা দেখে তাহলে ভাববে আমি বউকে ভাগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। বিয়ে করা বউ সেটা তো তখন মাথাই রাখবে না। তারা ভাববে সদ্য বিয়ে করা শান্ত এক মেয়ের হাত ধরে পালাচ্ছে।”
শান্তর এমন উদ্ভট কথা শুনে আমি বললাম,”তোমার কথা শুনে আমার হাসি পেলো না। স্যরি। এটা তেমন মজার ছিলো না।”
”আরে তোমাকে হাসানোর জন্য বা মজা দেওয়ার জন্য আমি এটা বলেছি নাকি। আমি তো…।”
শান্ত আমতা আমতা করে কথাটি বলে। আমি তার চোখে চোখ রাখতে সে থেমে যায়। প্রসঙ্গ বদলাতে বলে,“তুমি জানো আজ কী হয়েছে?”
“কী হয়েছে?”
আমার প্রশ্ন করতে দেরি শান্তর বলতে দেরি হয় না। সে খুব মজা নিয়ে বলে,“তোমাদের বাড়ির ছাদ দিয়ে তো মামার ছাদে যাচ্ছিলাম। তো তখন শুনলাম তোমার বাবা, মা সেই লেভেলের ঝগড়া করছে। তোমার এত ভালো জায়গা বিয়ে হয়েছে মানতেই পারছে না। আমি তো ভয়ে ছিলাম কখন না বলে বসে, না এ আমি বিশ্বাস করি না। এটা বলার পর যদি তোমার বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়ে যায়। বাংলা সিনেমার এই দৃশ্যটা মাথায় আসছিলো।”
শান্তর এসব কথা শুনে আমি শব্দ করে হেসে দিলাম। অতঃপর বিছানায় গিয়ে বসলাম। শান্ত আমার পাশে এসে বসে। সে কিছুটা ভাব নিয়ে বলে,“দেখছো কত ভালো ছেলে বিয়ে করছো? আমি এত ভালো ছেলে যে তোমার বাবা, মা এই কষ্টে যায় যায় অবস্থা।”
“হ্যাঁ খুব ভালো ছেলে। কত ভালো?
সেটা তো দেখতে পাবো।”
আমার মুখে এই কথা শুনে শান্ত একই রকম ভাব নিয়ে বলে,“অবশ্যই আমি ভালো ছেলে। দেখে নিও।”
এটা বলে শান্ত উঠে যায়। সে আলমারির কাছে যেতে আমি বললাম,“এখন ওখানে যাচ্ছো কেন?”
“তোমার জন্য বিশেষ গিফট আছে বলছিলাম না? সেটা দিতে হবে তো?”
এটা বলে শান্ত আলমারি খুলে সেই ব্যাগটি বের করে। এই ব্যাগে বিশেষ কিছু আছে। এটা তো আমি আগেই জানতাম। তবে সেটা কী জানি না। আমি ভাবলাম হয়তো গহনা হবে। বাসর ঘরে স্বামীরা স্ত্রীদের দেয় তো। এটা ভেবে তেমন প্রতিক্রিয়া দেখালাম না। কিন্তু হঠাৎ চোখের সামনে একটি ঘুড়ি দেখতে হতবাক হলাম। আমি নিজেকে সামলে তাকাতে দেখলাম শান্ত আমার সামনে সেই ঘুড়িটি ধরে রয়েছে। এটা সেই ঘুড়ি যার মাধ্যমে শান্ত এবং আমার প্রথম কথা বলা শুরু হয়। যার উপরে লেখা,“ইচ্ছেঘুড়ি।”
যেটা আমি সেদিন রাতে ছাদে বসে লাটাই থেকে কেটে উড়িয়ে দিয়েছিলাম। শান্ত ঘুড়িটি আমার দিকে ধরে খুব সুন্দর করে বলে,“সোনা দানা গয়না সবাই তো দেয়। সবাই হয়তো পছন্দও করে। কিন্তু আজকের এই দিনে এই ঘুড়িটা আমার মনে হয় তোমার জন্য সবচেয়ে বেশি পছন্দের হবে। এটা তোমার জন্য অনেক বিশেষ হবে। তাই এটাই দিলাম।”
আমি খুশি হয়ে ঘুড়িটা নেই। খুশিতে শান্তকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেই। এটা অন্যরকম অনুভূতি। সারা পৃথিবীর কাছে এই ঘুড়িটি খুব সাধারণ হতে পারে। কিন্তু আমার মতো এক দুঃখী মেয়ের জন্য এটা অনেক বিশেষ। এই সেই জিনিস যার হাত ধরে আমার জীবনটা বদলে গেছে। হ্যাঁ এটা হয়তো ছেলে মানুষি ভাবনা। হোক না ছেলে মানুষি। তাও তো এটাই সত্যি। এ এক অন্যরকম অনুভূতি। শান্ত আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,“ইচ্ছেঘুড়ি তো আর ইচ্ছে পূরণ করে না। এটা আমার বাচ্চামো ভাবনা। তবে আমার এই বাচ্চামো ভাবনায় সঙ্গ দিয়ে সেদিন রাতে যখন তুমি ছাদে বসে এটা উড়িয়ে দিলে। যেহেতু সুতা কেটে দিয়েছিলে সেহেতু এটা বেশিদূর যায়নি। নিচে রাস্তায় পড়েছিলো। সেদিন এটা রাস্তায় দেখেই আমি বুঝেছি তোমার অনেক ইচ্ছে রয়েছে। যেই ইচ্ছের কথা তুমি কাউকে বলতে পারোনি। তাই তো আমার বাচ্চামোতে সঙ্গ দিয়ে এভাবে বললে। না চাইতেও কেন জানি না সেদিন এই ঘুড়িটা হাতে তুলে নিয়েছিলাম এবং বাসায় চলে আসলাম। দেখো আজ সেই ঘুড়িটা তোমাকে খুশি করতে কাজে লাগলো। খুব একটা ভুল করিনি, তাই না?”
আমি শান্তর কথার জবাব না দিয়ে তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে থাকি। শান্ত খুশি হয়ে বলে,“ইচ্ছেঘুড়ি মিথ্যে হলেও আমি মিথ্যে নই। তোমার ইচ্ছেগুলো পূরণ করতে তোমার পাশে থাকবো। সারাজীবন তোমায় সঙ্গ দিবো।”
“এটা কেমন কথা?
তুমি বলবে তুমি ভালোবেসে আমার ইচ্ছে পূরণ করবে। কিন্তু সেটা না বলে পাশে থাকবে শুধু এটা বলছো?”
“হ্যাঁ।এই জগতে কেউ কারো ইচ্ছে পূরণের দায়িত্ব নিতে পারে না যদি না সে নিজে থেকে চায়। তুমি যদি ইচ্ছা পোষণ করো তবে তোমাকেই সেই ইচ্ছাটা যাতে পূরণ হয় তার জন্য পা বাড়িয়ে দিতে হবে৷ হতে পারে সেটা আমার মাধ্যমে পূরণ হবে। সেই মাধ্যমটা যে আমি হবো সেটাও তোমার ভাবনায় থাকতে হবে। আমাকে তোমার সেভাবে গড়ে নিতে হবে, বলতে পারো ভালোবাসতে হবে যাতে আমি তোমার সব ইচ্ছাকে আমার মনে করে পূরণ করে দেই।”
শান্তর কথার গভীর ভাবার্থ বুঝতে পেরে আমি থমকে যাই। তাকে ছেড়ে বিছানায় গিয়ে বসি। হাত দিয়ে ঘুড়িটাকে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছিলাম। এটা দেখে শান্ত কিছুটা অবাক হয়ে বলে,“আমি বড্ড অগোছালো ভাবে কথা বললাম। তুমি বুঝতে পারোনি?”
“পেরেছি। কিন্তু বলার মতো কোন ভাষা নেই তাই জবাব দিচ্ছি না।”
আমার কথা শুনে শান্ত আমার পাশে এসে বসে। অতঃপর বলে,“আচ্ছা বলতে হবে না।”
“শান্ত তুমি আমার জীবনে সেই পরশ পাথর যার ছোঁয়ায় আমি পূর্ণতা পেয়েছি। আমি আমার আমিটাকে খুঁজে পেয়েছি। যে আমিকে হারিয়ে ফেলেছিলাম বহু আগে। আমি আমার প্রতি বাবা, মায়ের অবহেলা বুঝতাম। কিন্তু তবুও কখনো মানতে চাইনি তারা আমার বাবা, মা নয়। এটা ভাবতে পারিনি বলেই আমি কখনো সাহস করে নিজের খুশির জন্য কিছু করতে পারিনি। আসলে আমি আমার জীবনে এই সত্যিটা মানতে চাইনি। বা মানতে পারছিলাম না। অতঃপর তুমি এলে জীবনে, আমাকে এই সত্যিটা মানার সাহস দিলে।আমি মেনে নিলাম। আর আমার জীবনটাও সুন্দর হয়ে উঠলো।”
আমি এসব কথা বলতে গিয়ে মনমরা হয়ে গেলাম। আমার স্মৃতিতে আমার বাবা, মায়ের আমার প্রতি করা অবিচার গুলো মনে পড়ে যাচ্ছিলো। তারা আমাকে ভালোবাসেনি। এটা ভাবতেই মনটা বিষন্নতায় ভরে উঠলো। এটা দেখে শান্ত বলে,“অতঃপর তোমার জীবন সুন্দর করতে গিয়ে আমার মতো অবলা ছেলেটার বলি হলো। এই ছিলো কপালে। শেষমেশ অন্যের জন্য নিজেকে বলিদান দিতে হলো। এই পোড়া কপাল নিয়ে আমি কী করবো?”
শান্ত বিভিন্ন মজার অঙ্গ ভঙ্গির মাধ্যমে কথাগুলো বলছিলো। যা শুনে এবং দেখে না চাইতেও হেসে দিলাম। হাসতে হাসতে বললাম,“তুমি কখনো শুধরাবে না। সিরিয়াস মূহুর্তে এভাবে হাসির কথা বলে মনটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিবে।”
“আমি বদলে গেলে তুমি খুশি হবে না।
তোমাকে আমি অখুশি করতে পারি?”
শান্তর মুখ দিয়ে এই কথাটি বের হতে আমি থেমে গেলাম। সেই মূহুর্তে শান্ত আমার গালে হুট করে চুমু খেয়ে নিলো। আমি কিছুটা হচচকিয়ে গেলাম। শান্ত আমার ঘাড়ে হাত দিয়ে বলে,“ঠিক ভুলের হিসাব করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলো শুরু করি নতুন এক অধ্যায়। অবশ্যই সেটা ভালোবাসার। যেথায় সব ভুল মাফ করা যায়, শুধরে নেওয়া যায়। হয়তো ভুলের পরিপেক্ষীতে অভিমান করা যায়। কিন্তু ছেড়ে যাওয়া যায় না। চলো না শুরু করি সেই ভালোবাসার অধ্যায়।”
আমি থমকে গেলাম। ঠান্ডা চোখে শান্তর দিকে অদ্ভুতভাবে তাকালাম। শান্ত ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে আসলো। আমার খুব কাছে এসে বলে,“ভালোবাসবো?”
আমি হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ালাম। অতঃপর…
’
‘
চলবে,