ইচ্ছেঘুড়ি পর্ব-৪৪

0
20

#ইচ্ছেঘুড়ি (৪৪)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

মায়ের কথা শুনে আমি মুগ্ধ। তার পুরো কথা মন দিয়ে শুনে বোঝার চেষ্টা করেছি। এমন শাশুড়ী পেলে জীবনে আর কি চাই। মা ঘর থেকে বের হলে আমি চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলাম, কিভাবে শান্তর রাগ ভাঙানো যায়। যদিও সে রেগে নেই। তবুও আমি তো জানি সে রেগে আছে। আর সেও চায় আমি তার রাগ ভাঙাই। সেজন্য আমাকে তো ভাঙাতেই হবে। তবে কি করবো সেটা ভেবে পাচ্ছিলাম। বেশ খানিকটা সময় ভাবার পর মাথায় একটা পরিকল্পনা এলো। প্রথমে অবশ্য ভেবেছিলাম বড় পরিসরে সারপ্রাইজ প্লান করবো। কিন্তু না। পরক্ষণে মনে হলো শান্তর এরচেয়ে খুব সাধারণ কিছু জিনিসে বেশি খুশি হবে। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। আলমারি খুলে শান্তর পছন্দের সেই কালো রঙের শাড়ীটি তুলে নিলাম। এটা হাতে নিতে আমার সেদিনের কথা মনে পড়লো। যেদিন প্রথম এই শাড়ী পড়ে শান্তর দোকানে গিয়েছিলাম। শান্তর মুখে শুনেছি, সেদিন সে ঐ লোকটিকে মা রতে গিয়ে আমাকে দেখে থমকে গিয়েছিলো। তার হৃদয়ে প্রথম আমার জন্য অন্যরকম অনুভূতির জন্ম হয়েছে। সে প্রথম অনুভব করেছে, আমি দেখতে বেশ মিষ্টি। আমি এসব কথা ভেবে মনেমনে খুব হাসছিলাম। আমার মনে হলো, সেদিনের মতো সাজলে শান্ত পছন্দ করবে। তাই আমিও দেরি না করে শাড়ীটি পড়ে নিলাম। তবে এবার সেদিনের মতো বেনী করলাম না। ঘন কালো চুলগুলো ছেড়ে দিলাম। কোমর অব্দি খোলা চুল। বাম পাশে সিঁথি করে নিলাম। অতঃপর সেই পাশের কানে একটি ফুল গুজে নিলাম। এটা তাজা ফুল নয়। আর্টিফিশিয়াল। এই মূহুর্তে তাজা ফুল কোথায় পাবো। সেজন্য এটাই নিলাম। এবার আরও একটি জিনিস যোগ করেছি। তাহলো কপালে কালো টিপ। ব্যাস এভাবেই সেজে তৈরি হয়ে নিলাম। এবার অপেক্ষার পালা। শান্ত কখন বাড়ি ফিরে তার অপেক্ষা।

ঘন্টা খানেকের মাঝে শান্ত বাড়ি ফিরে। বাড়ি ফিরে সোজা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে। আমি তার উপস্থিত টের পেয়ে লজ্জায় দরজার পিছনে গিয়ে লুকিয়ে থাকলাম। এই প্রথম আমার সাজটা শান্তর জন্য। তাই কিছুটা লজ্জা পাচ্ছিলাম। শান্ত ঘরে প্রবেশ করে আমাকে না দেখে হয়তো বিরক্ত হলো। তবে পিছনে ঘুরে মাকে ডাকতে গিয়ে আমার দিকে নজর পড়লো তার। আমি শান্তকে দেখে লাজুক হাসলাম। শান্ত আমার হাসিতে পাত্তা না দিয়ে আমাকে দেখতে ব্যস্ত হয়ে গেল। তার মুগ্ধ দু’টি চোখ আমার হৃদয়ে শান্তির অনুভূতি দেয়। এই সাজ তার জন্যই তো ছিলো। সে মুগ্ধ হয়েছে। এটাই তো আমার চাওয়া। তবে শান্তর মুগ্ধ চোখের পাতায় হয়তো সেদিনের সেই ঘটনা ভেসে উঠেছে। সেটা আমি দেখতে না পেলেও অনুভব করতে পারলাম। শান্ত বেশ খানিকটা সময় আমাকে মুগ্ধ নয়নে দেখলো। অতঃপর তার মনে পড়লো সে রেগে আছে। তাই মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলে,“নারীর ছলনায় পা দিস না শান্ত। এরা বজ্জাত হয়। বহু বজ্জাত। বর রাগ করে আছে, কোথায় তার সেবা করবে তা না করে নিজেকে এমনভাবে উপস্থাপন করছে যে বর বাধ্য হবে তাকে সেবা করতে।”

শান্ত কথাটি আমাকে শুনিয়েই বললো। তার কথা শুনে আমি শব্দ করে হেসে দিলাম। এটা দেখে শান্ত আমার দিকে রাগী লুক দেয়। অতঃপর বলে,“এমন পেত্নীর মতো সেজে আছো কেন?
দুপুরের ঘটনা ভুলে গেলে বুঝি?”
শান্ত কথাটি বলে আমার মুখ ঘুরিয়ে নেয়। আমি তার সামনে গিয়ে কান ধরে মিষ্টি করে বলি,“স্যরি। সেই সময়ে অবশ্য আমাদের দুজনেরই ভুল ছিলো। তবে তুমি আমার আগে অভিমান করলে তাই আমি তোমার দোষটা ধরতে পারলাম না। তাই স্যরি।”

“হ্যাঁ?”
শান্ত হকচকিয়ে গেল। সে আমার মুখে এই কথা আশা করেনি। আমি তার বিষ্মিত মুখ দেখে চোখ টিপ দিলাম। অতঃপর কান ধরে রাখা অবস্থায় মুখটা কাঁদো কাঁদো করে বললাম,“স্যরি। প্লীজ মাফ করে দাও।”

শান্ত আমার কাছে এগিয়ে আসে। আমাকে তার বাহুডোরে আবদ্ধ করে বলে,“তুমি বাচ্চাদের মতো করে আমার রাগ ভাঙাচ্ছো? এটা তোমার সাথে যায়?”

“হ্যাঁ যায়। কারণ তুমি বড়দের মতো আচরণ করছো। তুমি যদি বড় হয়ে যাও তাহলে তো আমাকেই বাচ্চা হতে হবে। দুজন একইরকম মানুষ তো একসঙ্গে থাকতে পারে না।”
আমি কান ছেড়ে শান্তর ঘাড়ে হাত রেখে বললাম। শান্ত আমার কথা শুনে হেসে দেয়। অতঃপর বলে,“খুব বুদ্ধিমতী হয়ে গেছো না?
শাড়ী পড়ে, কান ধরে স্যরি বলা হচ্ছে। এভাবে আমার রাগ কমিয়ে ফেলছো। খুব বুদ্ধি ধরেছে মাথায়। এটা করলে শান্ত খুশি হয়ে যাবে বুঝে গেছো?”

“তুমি খুশি হয়েছো?”
আমার কথা শুনে শান্ত আমাকে ছেড়ে দেয়। মুখটা গম্ভীর করার চেষ্টা করে বলে,“একদম না। একটা পেত্নী দেখে খুশি হওয়ার কী আছে? এটা খুশি হওয়ার মতো কোন বিষয় নাকি।”

”ওহ আচ্ছা।
আমি পেত্নী?”
আমি রাগ দেখিয়ে কথাটা বললাম। শান্ত সেটায় গুরুত্ব না দিয়ে বললো,“অবশ্যই।”

আমি মুখ ফুলিয়ে রাখলাম। কোন কথা বলবো না ঠিক করলাম। এটা দেখে শান্ত শব্দ করে হেসে দেয়। অতঃপর বলে,“তুমি দিন দিন বড় বাচ্চামো করছো। এবার তো দেখছি সত্যি আমায় বড় হয়ে যেতে হবে।”

শান্ত এই কথাটি বলে হাসতে থাকে। তার হাসির মাঝে হুট করে আমি তার গালে চুমু দিয়ে বসি। শান্তর হাসি বন্ধ হয়ে যায়। সে এক মূহুর্তের জন্য হতভম্ব হলো। এইমাত্র কী হলো বুঝতে পেরে সে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দেয়। অতঃপর আমাকে কোলে তুলে নিলো। হাসি মুখেই বলে,“এবার আমাকে পুরোপুরি খুশি করতে পারছো। আমি ঘায়েল হয়ে গেছি।”

“তাই?
তাহলে আর রেগে নেই তো? আর আমার সঙ্গে রাগ করবে?”
আমার কথা শুনে শান্ত হাসতে হাসতে জবাব দেয়,“রেগে নেই। তবে হ্যাঁ রাগ করবো। রাগ করে এমন খুশি হওয়া গেলে আমি তো রোজ রাগ করবো।”

“একদম না।
আমি রোজ রোজ তোমার মান ভাঙাতে পারবো না। এটা তোমার কাজ। তুমি আমার মান ভাঙাবা। আমি রোজ অভিমান করবো।”

“ওহ আচ্ছা।
তাহলে ধরো তুমি এখন রেগে আছো। চলো আমি তোমার মান ভাঙাই।”

“মানে?”
আমি কথাটি বলে শান্তর দিকে তাকাতে লজ্জা পাই। সে দুষ্টুমিভরা মুখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তার অভিসন্ধি বুঝে তার বুকে কয়েকটি আলতো করে মে রে দিয়ে বলি,“বাজে ছেলে।”

“তোমার পাল্লায় পড়ে হয়ে গেছি বাজে।”
আমি এটা শুনে তার চোখে চোখ রেখে বললাম,“আমার পাল্লায় পড়ে বাজে হয়েছো?”

”হ্যাঁ।
বিশ্বাস হয় না?”
আমি নাসূচক মাথা নাড়ালাম। শান্ত হেসে বলে,“তারমানে আমি বাজে এখনো হয়নি। খুব ভালো আছি।”

“জ্বী না। আমি বোঝাতে চাইছি আপনি আগে থেকেই বাজে।”
আমি মজার সুরে কথাটি বলতে শান্ত জবাব দেয় না। শুধু হাসে। আমি তার গলা জড়িয়ে ধরে বলি,“চুপ হয়ে গেলে যে?”

“খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে। ভালোবাসবো?”
শান্তর কথা শুনে আমি তার চোখের দিকে তাকালাম। আমার চোখ সম্মতি দিয়েছে বুঝতে পেরে শান্ত আমাকে বিছানায় বসিয়ে দরজা বন্ধ করতে চলে গেল। অতঃপর সে আমার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে।

_____

কাজল জয়ের হাত শক্ত করে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। বাচ্চা হবে বলে জয় এবং কাজল দুজনেই খুব খুশি ছিলো। কিন্তু তাদের খুশি বেশিদিন স্থায়ী হলো না। দুই মাসের মাথায় বাচ্চাটি নষ্ট হয়ে যায়। এজন্যই কাজল খুব কান্না করছে। জয় কাজলকে কিভাবে সান্ত্বনা দিবে বুঝতে পারছে না। তারও খুব খারাপ লাগছে। বাচ্চাকে নিয়ে তারও অনেক আশা ছিলো। এই ঘটনা জানতে পেরে কাজলের মা ছুটে আসে। তাকে দেখে কাজল হাউমাউ করে কান্না করে বসে। সেই মূহুর্তে মা সান্ত্বনা দিয়ে বলে,“এত ভেঙে পড়ছিস কেন?
যা যাওয়ার গেছে। আবার চেষ্টা কর পরে হবে।”

এসব বলে সান্ত্বনা দিচ্ছিলো। কিন্তু কাজল তো মা। এই বাচ্চা নিয়ে তার এবং জয়ের কত আশা ছিলো। সেটা পূরণ হলো না। সেদিন জয় এই বাচ্চার জন্য তার মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে। তার মা অভিশাপ দিয়ে বলছিলো,“তুই ঐ মেয়ের জন্য আমায় ছাড়লি, এখন বাচ্চার জন্য কথা শোনাচ্ছিস। দেখিস এটা ধর্মে সইবে না। তোর বাচ্চা টিকবে না।”

কাজল তার মাকে জড়িয়ে কান্না করছিলো। সেই সময়ে জয় দূরে দাঁড়িয়ে তার মায়ের ঐ কথাটি ভাবছিলো। তার খুব রাগ হয়। সে তার মাকে ফোন দিয়ে বলে,“এবার খুশি হয়েছো?
আমার বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে গেছে। তুমি খুব খুশি হয়েছো? তোমার অভিশাপ ফলে গেল? খুশি হয়েছো না?”

“কি!”
জয়ের মা এই কথা শুনে ভীষণ অবাক হয়। সে কাজলের উপর রাগটা ওভাবে ঝেড়েছে। কিন্তু তাই বলে মন থেকে কখনোই চায়নি তার ছেলের খারাপ হোক। বাচ্চাটার ক্ষতি হোক। জয় মনমরা গলায় বলে,“আমি সন্তান হিসাবে অপদার্থ। তোমাদের কষ্ট দিয়েছি। তাই আমার সন্তানকে অভিশাপ দিলা মা। তুমি মা হয়ে পারলে। আমি নাহয় সন্তান তাই তোমাদের কষ্ট দিতে পারলাম৷ কিন্তু তুমি এটা কিভাবে পারলে? তুমি তো মা। মায়েরা তো ক্ষমাশীল হয়। তুমি আমায় ক্ষমা না করে অভিশাপ দিলে মা।”

“দেখ জয় বাবা।
আমি একদম এটা চাইনি। তুই ভুল ভাবছিস।”
এটা বলে জয়ের মা প্রায়ই কান্না করে দিচ্ছিলো। সে জয়ের কন্ঠ শুনে বুঝতে পেরেছে সে খুব কষ্ট পেয়েছে। সেদিন ঐ কথা বলার পর জয় রাগ করে তার সঙ্গে কথা বলেনি। সেই সময়ে সে উপলব্ধি করতে পেরেছে বাচ্চার বড্ড শখ জয়ের। তাই আজ মা হয়ে সন্তানের কষ্টটা বুঝতে পারছে। জয় মায়ের অনুভূতি বুঝে বলে,“মা দেখলে তোমার অজান্তে দিয়ে দেওয়া অভিশাপ লেগে গেল। কাজল পরের মেয়ে। তাকে তুমি আপন করতে পারোনি। তাই বলে এমন কথা বলবা। হ্যাঁ মানছি আমি দুইদিক ব্যালেন্স করতে পারিনি। তুমি তাই বলে কাজলকে এত হিংসা করবা। কেন মা? আমি তো তোমার ছেলে। নিজের ছেলের ভালো চেয়ে ঐ মেয়েটাকে বিন্দু পরিমান ভালোবাসা দিতে পারোনি। একটু ভালোবাসা দিতে পারোনি। কেন? আজ যদি তুমি একবার ভাবতে ও আমার স্ত্রী। তাহলে তোমার মুখ দিয়ে অজান্তে তোমার নাত/নাতনির জন্য অভিশাপ বের হতো না। হ্যাঁ মানছি যার যাওয়ার সে এমনি যাবে। এসবে মানুষের হাত নেই। কিন্তু মা বিশ্বাস করো এই মূহুর্তে এসে আমার শুধু তোমার ঐ কথাটাই মনে পড়ছে। না চাইতেও আমার মন বলছে তুমি অভিশাপ দিয়েছো বলেই সেটা এভাবে লাগলো। আমি জানি এটা সত্যি নয়। তাও ঐ কথাগুলোই কানে ভেসে আসছে।”
এসব বলে জয় ফোন কেটে দেয়। সে পুরুষ মানুষ। তাই তার কষ্টটা তাদের দেখাতে পারছে না। সে নিজের মাকে এসব কথা বলেও খুশি নয়। কিন্তু না বলেও পারলো না। এমন সময় কাজলের মা তাকে ছেড়ে জয়ের কাছে এসে বলে,“দেখো বাচ্চাটার বাঁচার ছিলো না। তাই বাঁচলো না। এসব ভেবে কষ্ট পেও না। আমার মেয়ে কিন্তু বাজা নয়। তাই এমন ভেবো না আর বাচ্চা হবে না। এটা ভেবে আমার মেয়েকে কষ্ট দিও না।”

এই মূহুর্তে কাজলের মায়ের এমন কথা জয়ের উপর কেমন প্রভাব ফেলতে পারে সেটা বুঝতে পেরে কাজল রেগে যায়। তবে সে কিছু বলার আগে জয় বলে। জয়ও রেগে যায়। সে কিছুটা রাগান্বিত গলায় বলে,“আপনার বয়স তো ভালোই হয়েছে। এই বয়সে এসে নিজের নোংরা মানসিকতা নিজের মেয়ের সংসারে না ফেলে বরং গিয়ে ম রার কথা চিন্তা করুন।”

“তুমি আমাকে…।”
মাকে থামিয়ে দিয়ে কাজল বলে,“ভুল কী বলেছে ও? এই সময়ে আমাদের অবস্থা ভালো নেই সেই সময়ে তুমি জয়কে এমন উল্টাপাল্টা কথা বলছো। তুমি কী আদৌ মানুষ। নূন্যতম জ্ঞান নেই। জয় যেটা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না তুমি সান্ত্বনা দেওয়ার নামে উল্টো সেই ভাবনা তার মাথায় ঢুকিয়ে দিচ্ছো। আমার ভালোর কথা ভেবে আমার ক্ষতি করছো। তুমি এই সামান্য বিষয়টা বুঝতে পারছো। সত্যি বুঝতে পারছো না?”
কাজলের মা কিছু বলতে নিলে কাজল থামিয়ে দেয়। সে তাকে চলে যেতে বলে৷ কারণ কাজল জানে তার মা এখন কথা বললে সেটা ভুলই বলবে। এতকিছুর পরও তার মায়ের কোন বোধ হয় না। মাঝে মাঝে কাজলের ভাবতে অবাক লাগে সে এই অসুস্থ মানসিকতার বাবা, মায়ের সন্তান। যাদের সে চেয়েও ঠিক করতে পারে না। কিছু বাবা, মা এমন থাকে৷ যারা ভুল করে। কিন্তু নিজেদের ভুল দেখতে পায় না৷ তাদের সন্তানরা ভুলটা বুঝে সেটা ঠান্ডা মাথায় বোঝাতে গেলেও তারা সেটাকে ভুলভাবে নেয়। কাজলের বাবা, মায়ের অবস্থা তাই।

কাজলের কথা শুনে আমি এবং শান্ত খুব কষ্ট পাই। আমরা দ্রুত তার কাছে আসি। যতটা সম্ভব তাদের সান্ত্বনা দেই। আমি কাজলের কাছে ছিলাম আর শান্ত জয়ের কাছে চলে যায়। কাজল আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব কান্না করে। সে কাঁদতে কাঁদতে বলে,“আমার বাবা, মা তোমার সঙ্গে অনেক অন্যায় করেছে আপা। আজ আমি বোধহয় সেই পাপের ফল পাচ্ছি না।”

“না কাজল।
এখানে কোন পাপের ফল নেই। তুই খুব ভালো মেয়ে। আর আল্লাহ ভালোদের পরীক্ষা নেয়। তোরও নিচ্ছে। এখানে অন্যকিছু নেই। তাছাড়া এত কষ্ট কেন পাচ্ছিস? তোরা আবার চেষ্টা করবি। সবকিছু নতুনভাবে। একবার দূর্ঘটনা ঘটে গেছে মানে এই নয় জীবন থেমে গেছে।”
আমি আমার সাধ্য অনুযায়ী কাজলকে বোঝানোর চেষ্টা করি। যদিও বাচ্চাটা পৃথিবীতে আসেনি। কিন্তু তাই বলে কি মায়ের মন মানে? কাজলের অবস্থা বুঝতে পারছি। কিন্তু কিছু করার তো নেই। তাই তাকে সাধ্য অনুযায়ী সান্ত্বনা দিচ্ছি।

অন্যদিকে শান্তও জয়কে বোঝাচ্ছে। শান্ত খুব স্বাভাবিক গলায় বলে,“আপনার এই সময়ে কিছুদিন ছুটি নেওয়া উচিত। কাজলের সঙ্গে বেড়িয়ে আসুন। এই সময়ে তার আপনাকে খুব প্রয়োজন। তাই আমি বলবো আপনি এতটা ভেঙে পড়বেন না। নিজেকে সামলান।”

“ছোট ছোট বাচ্চাদের আমার বরাবরই ভালো লাগে। সেখানে নিজের বাচ্চা আসবে শুনে আমি কতটা ইমোশনাল হয়ে গিয়েছিলাম জানো? লোকে বলে নারী সন্তান গর্ভে নিয়েই মা হয়ে যায়। আর পুরুষ সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর ধীরে ধীরে বাবা হয়। কিন্তু আমি না বাবা আগেই হয়ে গেছি। ঐ যে ইমোশনাল হয়ে গেলাম। তাই তো কল্পনায় বাচ্চার সঙ্গে অনেক সুখের গল্প সাজিয়েছি। তাই এখন মানতে পারছি না।”
জয় মনমরা গলায় কথাটি বলে। এটা শুনে শান্ত বলে,“আমি আপনার ইমোশন বুঝতে পারছি। কিন্তু একসঙ্গে দুজনার ভেঙে পড়লে চলবে না। আপনি একবার ভাবুন, আপনি মাত্র দুই মাসে একটি খবর শুনে। জাস্ট বাচ্চা আসছে শুনে এতটা ইমোশনাল হয়ে গেছেন। সেখানে সে গর্ভে রেখেছে। তো এই সময়ে অবশ্যই আপনার চেয়ে তার ইমোশনটা বেশি। তার কষ্টটাও বেশি৷ দুজনেই যদি কষ্ট পান তাহলে সম্পর্কের মাঝে দূরত্ব তৈরি হবে। আর দূরত্ব হলে আপনার বাচ্চার শখটা শখই রয়ে যাবে। একটা দূর্ঘটনা কিন্তু আপনার শখটা মে রে ফেলছে না। সেটা আপনি নিজেই মে রে ফেলবেন। যদি না এই সময়ে আপনার যা করনীয় সেটা না করেন। এই মূহুর্তে নিজেকে সামলান। পুরুষ মানুষ তো। এত ইমোশনাল হলে চলে না। আর ইমোশনটা থাকলেও সেটাকে একটু গোপন রাখুন। তার জন্য। অবশ্যই সে আপনার ভালোবাসা। ভালোবাসার মানুষের জন্য নিজেকে এতটা সামলানো যায়।”
জয় শান্তর কথা শুনে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। এখানে অন্যকেউ থাকলে তার আবেগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাকে হয়তো সান্ত্বনা দিয়ে বলতো,“সব ঠিক হয়ে যাবে। নিজেকে সামলাও।” সেখানে শান্ত তার নিজেকে নয় বরং কাজলকে সামলাতে বলছে৷ যেটা করলে কাজলের সঙ্গে জয় নিজেকেও সামলে নিতে পারবে। শান্তর এমন চিন্তা জয়ের বেশ ভালো লাগলো। সে মাথা নাড়ায়। শান্ত এবং জয় বেশ খানিকটা সময় কাটায়। এখানে তারা নিজেদের ছোটবেলার গল্পও করে। যদিও শান্তর ছোটবেলা তার পছন্দের বা খুশির ছিলো না। তবে জয়কে সেটা বুঝতে দেয় না। সব সত্যিই বলে। তবে ভিন্নভাবে। যাতে জয় বুঝতে পারে শান্ত বেশ ভালো ছিলো। কারণ এই মূহুর্তে জয়ের দুঃখের সময় তার দুঃখ বলাটা উচিত নয়। এটা অন্যরকম হয়ে যায়।

বেশ খানিকটা সময় পর শান্ত আমার কাছে আসে। এবার আমাদের যেতে হবে। শান্ত এখানে থাকতে পারবে না আমি জানি। এক মাস হলো শো-রুম দিয়েছে। এখন প্রচুর কাজ। তাছাড়া বড় পরিসরে দেওয়ায় বাবার বেশ ঋন করতে হয়েছে। যদিও বাবা সব টাকা তার অবসারের সময় পেনশন দিয়ে শোধ করতে চাইছে। কিন্তু শান্ত সেটা চায় না। তাই সে প্রচুর পরিশ্রম করছে। এখন তার একদন্ড বসে থাকার সময় নেই। তাও আমার খুশির জন্য আমার সঙ্গে আসলো। আমি এটা বুঝতে পেরে শান্তকে বললাম,“আমি আজকে এখানে কাজলের কাছে থাকি।”

“না।”
শান্ত সম্মতি জানাবে না এটা আমি ভাবতেও পারি না। আমি কিছুটা অবাক হয়ে গেলাম। শান্ত ম্লান হেসে আমাকে একটু দূরে নিয়ে বলে,“এখন কাজলের তোমাকে নয় তার স্বামী প্রয়োজন। পরিবারের থেকে এই ঔষধ বেশি কার্যকরী। তাই চলো।”
আমি শান্তর কথা বুঝতে পেরে মাথা নাড়াই। যদিও কাজল আমাকে রাখতে চাইছিলো। তবে আমি থাকি না। কোনরকম কাটিয়ে নেই। আমি এবং শান্ত কাজলের বাসা থেকে বের হতে জয় এসে কাজলের পাশে বসে। এবার জয় কাজলকে সান্ত্বনা দেয়। সেই সঙ্গে ভরসা দেয়। তার সঙ্গে সারাটা জীবন কাটানোর। তারা খুব দ্রুত আবার বাচ্চার জন্য ট্রাই করবে। কাজলের এটারই প্রয়োজন ছিলো। এতক্ষণ যেই সান্ত্বনা দিক না কেন? জয়ের কথায় তার যেমন ভালো লেগেছে তা আর কারো কথায় লাগেনি। তাই সে খুব খুশি হয়। সে জয়ের কাধে মাথা রেখে জয়ের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে। এমন সময়ে স্বামী পাশে থাকলে, বিশ্বাস এবং ভরসার হাত বাড়ালে সব দুঃখ ঘুচে যায়। যেটা কাজলের ধীরে ধীরে হচ্ছে। তার মনটা হালকা হচ্ছে। এমন সময় জয়ের বাবা, মা আসে। তাদের দেখে জয়ের রাগ হলেও তারা এখানে ক্ষমা চায়। তারা এবার জয় নয় সরাসরি কাজলের কাছে ক্ষমা চায়। তাদের ভুল হয়েছে। তারা জয়ের ক্ষতি তো চায় না। কিন্তু কাজলকে পছন্দ করে না। তাই মুখ ফুসকে ভুল কথা বলে নিজের সন্তানকেই কষ্ট দিয়েছে। এখানে তারা খুব কান্নাকাটি করে। তাদের এমন ব্যবহার দেখে জয় এবং কাজলও তাদের ক্ষমা করে দেয়।


চলবে,