মনের আঙিনায় পর্ব-০১

0
23

#মনের_আঙিনায়

দুই বছর আগে যে লোকের সাথে আপু এনগেজমেন্ট ভেঙে দিয়েছিল, সেই লোককে নিজের ক্লাস টিচার হিসেবে দেখে হালকা করে নীলাদ্রির পায়ের তলা থেকে জমিন সরে গেল। বেচারি এতটাই অবাক হয়েছে যে পুরো ক্লাসের সবাই বসে পড়লেও সে দাঁড়িয়ে আছে। নীলাদ্রি এখনও এই ধাক্কাই কাটিয়ে উঠতে পারছে না, নতুন এই স্যার তার হতে না পারা দুলাভাই। পরিবারের পছন্দে আপু এনগেজমেন্ট করে চার মাস চালালেও শেষ সময়ে বিয়ের ডেট ঠিক হয়ে যাওয়ার পর বয়ফ্রেন্ডের সাথে পালিয়ে কোর্ট ম্যারেজ করে নিয়েছে। আহা তার ভাগ্য কি এতটাই খারাপ? পৃথিবীতে এত এত কলেজ ভার্সিটি থাকতে সে যে কলেজে পড়ে এই লোকের সেই কলেজেই জয়েনিং দিতে হলো! পুরোনো অপমান ভুলে না গিয়ে এখন যদি বোনের শত্রুতা তার সাথে শুরু করে দেয়! এই লোক যে ইচ্ছে করে তার পরীক্ষার খাতার নম্বর কাটবে না এই গ্যারান্টি কে দিবে?

ক্লাসে ঢুকেই সবার আগে নীলাদ্রির উপর চোখ পড়ে উচ্ছ্বাসের। প্রথমে চোখের ভুল ভাবলেও পরবর্তীতে তাকিয়ে মনে পড়তে বাকি রইল না, আরে এই মেয়েটাকে তো সে চেনে! মেয়েটার সাথে পূর্বপরিচয় থাকলেও উচ্ছ্বাস সেসব কিছু ভুলে গিয়ে শুধুমাত্র ক্লাস টিচারের ভূমিকা পালন করে শান্ত চোখে নীলাদ্রির দিকে তাকিয়ে সহজ গলায় জিজ্ঞেস করল,

-তোমার কি কিছু বলার আছে?

নীলাদ্রি এখনও বুঝতে পারছে না পুরো ক্লাস যে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। সে বোকার মতো হাঁ করে দাঁড়িয়ে অল্প বয়সী নতুন প্রফেসরকে দেখে যাচ্ছে, ব্যাপারটা সবাই অন্য ভাবে দেখছে। কেউ কেউ মুখ টিপে হাসছে। নিজেদের মধ্যে ফিসফিস শব্দে কানাঘুঁষা করছে।

নীলাদ্রির এই অস্বাভাবিক আচরণে তার বন্ধবীরাও মোটামুটি লজ্জিত। মুন নীলাদ্রির হাত ধরে হেঁচকা টানে বসিয়ে দিল। চাপা গলায় বলল,

-পাগল ছাগল হয়ে গেলি নাকি? স্যারের উপর ক্রাশ খাওয়া ইজ নরমাল। বর্তমানে ট্রেন্ড চলছে। কিন্তু তাই বলে চক্ষু লজ্জাও ত্যাগ দিবি?

এবার নীলাদ্রির হুঁশ ফিরল। অবিশ্বাস্য চোখে একবার বান্ধবীকে দেখে আরেকবার নতুন স্যারের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলল।

মেয়েটার আচরণে উচ্ছ্বাসও কিছুটা অপ্রস্তুত হলেও পরবর্তীতে পরিস্থিতি সামলে নিল।

নীলাদ্রির ঘোর পুরোপুরি কাটতে কাটতে নতুন স্যার ততক্ষণে ক্লাসের বাকি ছাত্রছাত্রীদের সাথে পরিচিত হতে শুরু করে দিয়েছে। মেয়েরা চোখ দিয়ে নতুন এই স্যারকে গিলে খাচ্ছে। মুন সহ নীলাদ্রির বাকি বন্ধুরাও স্যারের প্রশংসায় কবিসাহিত্যিক হয়ে যাচ্ছে। পলকহীন চোখে স্যারের দিকে তাকিয়ে গালে হাত দিয়ে রাফা বলল,

-আমাদের কলেজে এরকম অল্প বয়সী হ্যান্ডসাম প্রফেসর এটাই মনে হয় প্রথম এসেছে।

নেহাও রাফার সাথে তাল মিলিয়ে বলল,

-ঠিকই বলেছিস রে। এতদিন ভুঁড়ি আর টাক ওয়ালা বুড়ো বুড়ো সব প্রফেসরদের লেকচার শুনতে শুনতে মুখে অরুচি এসে গিয়েছিল। এবার মনে হয় পড়াশোনায় মনোযোগ ফিরে আসবে। অন্তত স্যারের সাবজেক্ট ব্লেন্ডারে ব্লেন্ড করে জুস বানিয়ে খেয়ে ফেলতে হবে।

আশঙ্কার কথা মনে করিয়ে দিয়ে মুন বলল,

-কিন্তু এই স্যার কি পারমানেন্ট ভাবে এসেছে? কেমিস্ট্রি ক্লাস তো হক স্যার নিত। স্যার অসুস্থ বলে স্যারের জায়গায় এই নতুন ছোকরাকে কিছুদিনের জন্য ক্লাস নিতে আনেনি তো! হক স্যার সুস্থ হয়ে ফিরে এলে ইনি আবার চলে যাবেন।

মুনের এই কথা শুনে রাফা নেহা ভীষণ আহত হয়েছে বলে মনে হলেও মনে মনে নীলাদ্রির খুশির শেষ রইল না। যাক কয়েকদিনের জন্য এলে ঠিক আছে। পরীক্ষায় অন্তত নম্বর কাটতে পারবে না। এই প্রথম হক স্যারের সুস্থতার জন্য মন থেকে দোয়া করল নীলাদ্রি।

-আল্লাহ তুমি শীঘ্রই স্যারকে সুস্থ করে দাও। স্যার সুস্থ হয়ে ফিরে এলে আমি বিশ রাকাত নফল নামাজ পড়ব।

ওই পাশের সবার সাথে পরিচয় হওয়া শেষ। এবার নীলাদ্রিদের পাশ থেকে প্রথম বেঞ্চে বসা মেয়েগুলো এক এক করে নিজেদের নাম বলছে। তৃতীয় বেঞ্চে কেন বসেছে এই দুঃখে নীলাদ্রির নিজেকে গালি দিতে ইচ্ছে করছে। আজকে পেছনে বসলেই ভালো হতো। দ্বিতীয় বেঞ্চের পর এবার তাদের পালা এলো। মুন, রাফা, নেহা সুন্দর মতোই দাঁড়িয়ে পরিচয় দিয়েছে। নীলাদ্রির পালা এলে সে উঠে দাঁড়িয়েছে তো ঠিক, কিন্তু মুখ দিয়ে কোন কথাই বের করতে পারছে না। নিজের নাম বলতেও এত দেরি লাগছে দেখে ক্লাসের একটি মেয়ে বলে উঠল,

-স্যারকে দেখে মনে হয় নীলাদ্রি নিজের নামই ভুলে গেছে।

পুরো ক্লাস জুড়ে হাসির গুঞ্জন উঠল। নীলাদ্রির গাধামি দেখে ওর বন্ধুরা মুখ লোকাচ্ছে। উচ্ছ্বাস সবাইকে চুপ করিয়ে দিয়ে বলল,

-ঠিক আছে। বসো তুমি।

উচ্ছ্বাসের গম্ভীর কন্ঠ কানে যেতে নীলাদ্রি সাথে সাথে বসে পড়ল। সবার পরিচয় জেনে স্যার এবার নিজের পরিচয় দিচ্ছেন। জানা গেল উনি এখানে গেস্ট টিচার হিসেবে এসেছেন। এই কথা শুনে পুরো ক্লাসের মেয়েরা একসাথে হতাশার দম ফেলল। নীলাদ্রির কলিজায় পানি এলো। গেস্ট টিচার তার মানে খুব বেশিদিন থাকবে না। মায়া গদগদ ভঙ্গিতে বলল,

-স্যার আপনি কিন্তু এখনও আপনার নামই বলেননি।

-আমার নাম উচ্ছ্বাস ইউসুফ খান।

নেহা নীলাদ্রির গা ধাক্কা দিয়ে ঘোর লাগা কন্ঠে বলল,

-শুনেছিস? স্যারের নামটাও স্যারের মতোই কিউট।

রাফা শুধু কিউট শব্দটাতে সন্তুষ্ট হতে না পেরে বলল,

-শুধু কি কিউট? হট বল হট।

নীলাদ্রি মুখ বাঁকাল। তার স্পষ্ট মনে আছে আপুকে যেদিন প্রথম দেখতে গিয়েছিল এই নাম শুনে নীলাদ্রি বলেছিল,

-এটা তো অনেক কঠিন নাম। তার উপর আবার উচ্ছ্বাস ইউসুফ খান। মনে হচ্ছে এক নামের মধ্যে তিনজন ব্যক্তি।

তার কথা শুনে বাবা হেসে বলেছিল,

-তোর নামটাও তো তাহলে কঠিন।

-মোটেই না। নীলাদ্রি ইয়াসমিন নাম উচ্চারণ করতে কি জিহবায় প্যাঁচ লেগে যায়?

তার কথা শুনে বাবা উচ্চ শব্দে অনেকক্ষণ হেসেছিল।
বাবার কথা মনে পড়তেই নীলাদ্রি অন্যমনষ্ক হয়ে কিছু সময়ের জন্য ক্লাস থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। অনেকদিন বাবাকে দেখে না। এবার ছুটিতে অবশ্যই বাড়ি যাবে।

-স্যার আপনার পড়াশোনা কি শেষ?

উচ্ছ্বাস মৃদু হেসে বলল,

-পড়াশোনার কি কোন শেষ আছে?

-স্যার আপনি তো আমাদের কলেজে গেস্ট টিচার হয়ে এসেছেন। আপনার কলেজের নাম কী?

-আমি কোন কলেজের টিচার না।

-তাহলে কি ভার্সিটির টিচার?

উচ্ছ্বাস হাসল। বুঝতে পারছে তাকে নিয়ে মেয়ে গুলোর অনেক কৌতূহল।

-স্যার আপনার কি টিচার হওয়ার ইচ্ছে আছে নাকি অন্য কোন প্রফেশনে যাবেন? যদিও আপনাকে দেখে টিচার কম ফিল্মের হিরোই বেশি মনে হয়।

তুবার কথা শুনে পুরো ক্লাস হেসে উঠল। এদের হাহা হিহিতে নীলাদ্রির বিরক্তি বাড়ছে। মেয়ে গুলোর এতকিছু জেনে কাজ কী? এই লোককে তো আর বিয়ে করবে না। এমনভাবে সবকিছু জেনে নিচ্ছে যেন পাত্র দেখছে।

পড়ার নামে ক্লাসে আজ গল্পই হলো। কলেজে কেন অল্প বয়সী শিক্ষক না থাকাই ভালো এটার কারণ আজকে বুঝতে পেরেছে নীলাদ্রি। স্যারের বয়স কম হলে সারাবছর শুধু গল্পই হবে। পড়াশোনা আর হবে না।

ক্লাস থেকে বেরিয়েও তিন বান্ধবী নতুন স্যারের কথাই বলছে। তিন জনের বকবকের মাঝে নীলাদ্রি নীরব ভূমিকা পালন করছে।

-স্যারের মতো স্যারের কথা গুলোও কত সুন্দর না! আমার তো শুধু শুনতেই ইচ্ছে করছিল।

-শুধু কি কথা? ড্রেসিং সেন্স দেখেছিস? উনি ভালো করেই জানেন কোন রং উনার উপর মানাবে।

-কথাবার্তা চালচলন চেহারা সুরত কোয়ালিফিকেশন সব দিক দিয়েই একটা মানুষ এতটা পারফেক্ট কীভাবে হয় বল তো! তার উপর আবার অবিবাহিত। আমি তো স্যারের উপর ফিদা হয়ে গেছি।

নিজেদের মধ্যের কথা এখনও শেষ হচ্ছে না। এর মাঝে মুন দুম করে নীলাদ্রির পিঠে এক কিল বসিয়ে জিজ্ঞেস করল,

-সব কথা একদিকে, ক্লাসে স্যারকে দেখে তুই ওরকম ভ্যাবলামি কেন করছিলি? জানি নতুন স্যার প্রয়োজনের থেকে একটু বেশিই হট। তাই বলে তুই স্যার ছাত্রীর সম্পর্ক ভুলে যাবি? তোর জন্য আমাদেরও লজ্জা পেতে হয়েছে।

কিলটা জোরেই পড়েছে। নীলাদ্রি পিঠ বাঁকিয়ে নাক ফুলিয়ে রাগী মুখে বলল,

-আমি ভ্যাবলামি করছিলাম? পৃথিবীতে আর মানুষ পেলি না!

রাফা টেনে টেনে বলল,

-ভ্যাবলামি করছিলে না কী করছিলে তা তো ক্লাসেই দেখেছি। তোর তো মুখই বন্ধ হচ্ছিল না। এখন আবার ভাব নিতে এসেছিস।

-মুখ বন্ধ হচ্ছিল না কারণ, তোদের ওই হট হ্যান্ডসাম মিস্টার পারফেক্ট স্যারকেই দুই বছর আগে আমার বোন চরম ছ্যাকা দিয়েছে। আপুর সাথে এনগেজমেন্টও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আপু উনাকে বিয়ে না করে দুলাভাইকে বিয়ে করেছে।

নতুন স্যার নীলাদ্রির বোনের এক্স ফিয়ন্সে শুনে তিন জনেরই চোয়াল ঝুলে পড়ল। অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে নীলাদ্রির কথা বিশ্বাস করার চেষ্টা করছে। নীলাদ্রি বলে যাচ্ছে,

-ক্রাশ ফ্রাশ কিচ্ছু না। ওই লোককে ক্লাস টিচার হিসেবে দেখে আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আপুর প্রতিশোধ যদি আমার উপর দিয়ে তুলে!

মুন, রাফা, নেহা কেউ বিশ্বাসই করতে চাইল না নীলাদ্রির বোন এত হ্যান্ডসাম ড্যাশিং একটা ছেলেকে রিজেক্ট করেছে। কিন্তু নীলাদ্রি তো মিথ্যাও বলে না। অবিশ্বাস্য গলায় মুন বলল,

-তোর বোন সত্যি সত্যিই এই কাজ করেছে?

ব্যথিত গলায় রাফা বলল,

-তোর বোন এই কাজ কীভাবে করতে পারল নীলাদ্রি! তোর দুলাভাই কি উচ্ছ্বাস স্যারের থেকেও বেশি সুন্দর?

বিস্ময় কাটিয়ে নেহা কিছু বলতেই পারল না। ওদের সাথে কথা বলতে বলতে নীলাদ্রি দেখতে পেলো ওই লোক অফিস রুম থেকে বেরিয়ে গেটের দিকে যাচ্ছে। নীলাদ্রি দু-হাত মেলে দিয়ে তিনজনের পথ আটকে দাঁড়াল। রাফা বলল,

-কী হয়েছে?

-একটু পরে যাই।

-কেন?

নীলাদ্রির সাথে সাথে ওরাও গেটের দিকে তাকাল। ওহ এই ব্যাপার। উচ্ছ্বাস স্যারকে দেখে নীলাদ্রি দাঁড়িয়ে পড়েছে। মুন বলল,

-তুই কি উচ্ছ্বাস স্যারকে ভয় পাস?

নীলাদ্রি মুখ বাঁকিয়ে বলল,

-ভয় কেন পাবো?

-তাহলে আগে উনি চলে যাওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে পড়লি কেন? উনার সামনে দিয়ে যেতে কী ভয়?

ভয় না। নীলাদ্রি ঠিক বুঝতে পারছে না তাকে নিয়ে ওই লোকের মনোভাব কী। দুই বছর কম সময় না হলেও খুব বেশি সময়ও না। ওই লোক দুই বছর আগের কথা কি এখনও মনে রেখেছে? নাকি অনেক আগেই সবকিছু ভুলে গিয়ে তাকে আজ চিনতেই পারেনি। আপুর সাথে বিয়ে ঠিক হলেও হবু দুলাভাইয়ের সাথে তার বেশি কথা হয়নি। এক দু’বার মনে হয় সামনা হয়েছিল। তখন লোকটা ‘কেমন আছো’ এতটুকুই জিজ্ঞেস করেছে। নীলাদ্রি মাথা নুইয়ে মৃদু স্বরে ‘ভালো’ জবাব দিয়েছে। এর বেশি কথা কোনদিনও হয়নি। নীলাদ্রি ভীষণরকম ইন্ট্রোভার্ট একজন মানুষ। অচেনা কোন মানুষের সামনেই যেতে পারে না। কথা বলা তো অনেক পরের ব্যাপার। কখনও সে নিজে থেকে কারো সাথে কথা বলতে পারে না। মানুষের সাথে মিশতে পারা তার যোগ্যতার বাইরে। এখানে এসে ভাগ্য করে মুন রাফা নেহাকে পেয়েছিল। কীভাবে কীভাবে যেন ওরাই নীলাদ্রির সাথে প্রথম কথা বলেছে। বন্ধুত্বের হাতটাও ওরাই আগে বাড়িয়েছে।

উচ্ছ্বাসকে গাড়ি করে চলে যেতে দেখল। নীলাদ্রি ছোট্ট একটা দম ফেলল। সামনের দিন গুলোতে কী হবে এটাই ভাবছে। ওই লোকের ক্লাস কীভাবে করবে সে?
বিয়ে করবে না জেনেও আপুটা যে কেন এনগেজমেন্ট করেছিল! তোর বয়ফ্রেন্ড আছে তুই কেন অ্যারেঞ্জ ম্যারেজে রাজি হবি? প্রথমে রাজি হয়ে পরে এমন পল্টি না খেলেই এসবকিছু হতো না।

চলবে।