#মনের_আঙিনায়
#জেরিন_আক্তার_নিপা
৩
কথা মতো পরদিন রাফা নেহা মুন নীলাদ্রিকে নিতে চলে এসেছে। নীলা ওদের বসিয়ে চা নাস্তা দিতে চাইলে সকলে হাত জোর করে না করতে লাগল। রাফা বলল,
-আপু আমরা এখন কিচ্ছু খাব না। খেয়েই বেরিয়েছি।
-চা তো খাবে?
নেহা বলল,
-চা-ও না আপু। গলা অব্দি ফুল।
নীলা মুনের দিকে তাকালে মুন বলল,
-আমি ডায়েটে আছি আপু। আমাকে কিছু খেতে সাধবেন না। কারণ আমি না করতে পারব না।
নীলা হেসে বলল,
-আচ্ছা ঠিক আছে। কিছুই সাধবো না তোমাদের।
হঠাৎ ওই কথাটা মনে পড়তেই রাফা বলে উঠল,
-আপু সত্যিই কি আপনি উচ্ছ্বাস স্যারকে রিজেক্ট করেছিলেন!
নীলাদ্রি তাহলে ওদের জানিয়ে দিয়েছে। নীলা আগের মতোই হেসে বলল,
-নীলাদ্রি বলেছে বুঝি?
-যে-ই বলুক। সত্যিই কি এনগেজমেন্ট হয়ে যাওয়ার পর বিয়ে ভেঙে দিয়েছিলেন?
নীলাদ্রি এতক্ষণে তৈরি হয়ে চলে এসেছে।
-আমি রেডি। ওঠ এবার।
নেহা নীলাদ্রিকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
-দাঁড়া একটু। আপুর সাথে গুরুত্বপূর্ণ টক চলছে।
নীলাদ্রি ভেবে পাচ্ছে না এতক্ষণ তাড়া দিয়ে পাগল করে দিয়ে এখন কেন দাঁড়াতে বলছে। নীলা এদের কান্ড দেখে হাসছে। নীলাদ্রি ফের তাড়া দিয়ে বলল,
-কিরে চল। যাবি না নাকি!
রাফা বিরক্ত হয়ে বলল,
-উফ দাঁড়া না। আপুকে বলতে দে।
-কী বলবে আপু?
নীলাদ্রি প্রশ্নসূচক চোখে বোনের দিকে তাকাল। নীলা উঠে পড়ে বলল,
-আজ না। অন্য একদিন তোমরা পুরো দিনের জন্য আসবে। তখন সময় নিয়ে ঘটনা প্রথম থেকে খুলে বলব। শুনলে মজা পাবে।
রাস্তায় বেরিয়ে ওরা নীলাদ্রিকে দুষছে। ওর তাড়াহুড়োর জন্য শুনতে পারল না। এদের যন্ত্রণায় অসহ্য হয়ে নীলাদ্রি বলল,
-আপু তো বলেছে আরেকদিন বলবে। তখন শুনে নিস।
চার বান্ধবী গল্পে মশগুল হয়ে হাঁটতে হাঁটতে কখন পথ শেষ হয়ে গেছে বুঝতেই পারল না। স্যারের ফ্ল্যাটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে ওদের মনে পড়ল একটা কল করে স্যারকে জানিয়ে আসা উচিত ছিল। একেবারে না বলে কারো বাসায় আসা ঠিক না। এখন যেহেতু এসে পড়েছে তাই ওসব ভেবে কাজ নেই। বেশ অনেকবার কলিংবেল বাজাতে হলো। দাঁড়িয়ে থেকে বিরক্ত হতে হতে মুন বলল,
-স্যারের বউ কী এমন কাজে ব্যস্ত! দরজা খুলতে এত দেরি হচ্ছে কেন?
-বাড়িতে রোগী আছে। সেবাযত্ন করছে হয়তো। তুই সবসময় এরকম অধৈর্য গিরি দেখাস কেন?
নেহার কথায় মুন মুখ বাঁকাল। একেকটা যেন ধৈর্যের রানি। তাকে জ্ঞান দিচ্ছে। শেষবার নীলাদ্রি কলিংবেল চেপেছে। ওরা তিনজন তার পেছনে দাঁড়িয়ে ঝগড়া করছে। নীলাদ্রি ঘাড় ঘুরিয়ে ওদের চুপ থাকতে বলে যে-ই সামনে তাকিয়েছে, দরজা খুলে দেওয়া ব্যক্তিটিকে দেখে এক লাফে তার চোখ কপালে উঠে গেল।
উচ্ছ্বাস ভেবেছিল চারতলার বাচ্চা দু’টো হয়তো আবার দুষ্টুমি করছে। যতবার ওরা নিচে যাবে কলিংবেল না টিপে যাবে না। তাই অনেকবার কলিংবেল বাজলেও উচ্ছ্বাস দরজা খুলতে আসেনি। শেষে ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলে বাচ্চা দু’টোকে ধমক দেওয়ার জন্য এসেছিল। কিন্তু দরজা খুলে যাকে দেখল তাকে সে কল্পনা করেনি।
উচ্ছ্বাসকে এখানে দেখে নীলাদ্রি মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। দরজা খুলে গেছে বুঝতে পেরে বাকি তিনজনও এদিকে তাকিয়ে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। নতুন স্যার এখানে কী করছে?
উচ্ছ্বাস তার ক্লাসের চারজন ছাত্রীকে দেখে অনেকটা অবাক হওয়ার পাশাপাশি কিছুটা অপ্রস্তুত হলো। বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে স্যারের দিকে তাকিয়ে থেকে রাফা মুখ ফসকে জিজ্ঞেস করে ফেলল,
-স্যার আপনি এখানে কী করছেন? এটা তো হক স্যারের বাসা।
উচ্ছ্বাস বিষয়টা এবার বুঝতে পেরেছে এরা তাদের স্যারকে দেখতে এসেছে। কিন্তু মামাকে তো গতকালই ইন্ডিয়া নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এরা তা জানবে না এটাই স্বাভাবিক। রাফার প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে নেহা জিজ্ঞেস করল,
-হক স্যারের বাসায় আপনি কী করছেন স্যার?
এদের গাধামি প্রশ্নের ধরন দেখে বিরক্ত মুখে মুন বলল,
-বারবার কী এক কথা বলে যাচ্ছিস। উচ্ছ্বাস স্যারও মনে হয় আমাদের মতো হক স্যারকে দেখতে এসেছে।
নীলাদ্রি অন্য কথা ভাবছে। এই লোকের পোষাক আশাক দেখে তো মন বলছে না উনিও তাদের মতো হক স্যারকে দেখতে এসেছে। মানুষ নিজের বাড়িতে যেমন থাকে উনাকেও তেমন দেখাচ্ছে।
উচ্ছ্বাস মেয়ে গুলোর উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করল,
-তোমরা কি স্যারকে দেখতে এসেছ?
নেহা বেচারির সাদা মনে কাদা নেই। সে চট করে বলে বসল,
-দেখতে তো এসেছিলাম হক স্যারকে। কিন্তু এখানে এসে আপনাকে দেখতে পেলাম। এটাও খারাপ না।
এদেরকে ভেতরে ডেকে অযথাই সময় নষ্ট না করে এখান থেকেই বলে দিক। এটাই ভালো হবে।
-হক স্যার বাসায় নেই। চিকিৎসার জন্য উনাকে ইন্ডিয়া নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
মুন জিজ্ঞেস করল,
-স্যারের স্ত্রী আছেন?
-না। উনিও স্যারের সাথে গেছেন।
চারজন কিছুতেই হিসেব মিলাতে পারছে না। স্যার বা স্যারের স্ত্রী কেউ বাসায় নেই। তাহলে স্যারের খালি বাসায় উনি কী করছেন? ভেতরেই বা ঢুকেছেন কীভাবে? মেয়ে গুলোর চোখ মুখ দেখেই উচ্ছ্বাস বুঝতে পারছে এরা ভেতরে ভেতরে কৌতূহলে ফেটে পড়ছে। এই মুহূর্তে এদের মনে অনেক প্রশ্ন আসছে। কিন্তু সেসব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার উচ্ছ্বাসের কোন আগ্রহ দেখা গেল না। সে কিছু বলে এদের বিদায় করবে
এর আগেই ভেতর থেকে মনিকা ডেকে জিজ্ঞেস করল,
-কে এসেছে রে উসু? দরজা খুলতে কতক্ষণ লাগে?
বলতে বলতে উচ্ছ্বাস কী করছে দেখতে মনিকাও বেরিয়ে এসেছে। মেয়েটাকে দেখা মাত্র চার বান্ধবীর চোয়াল একসাথে ঝুলে পড়ল। চার জনের চোখই কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইল। উচ্ছ্বাস এজন্যই এদের ভেতরে ডাকছিল না। আজ সকালেই মনিকা এসেছে। উচ্ছ্বাস কোনভাবেই একে বিদায় করতে পারেনি। তাকে একটা মেয়ের সাথে একা বাসায় দেখে স্বাভাবিক ভাবেই এই মেয়েগুলো নানান কথা ভেবে নিবে। শেষমেশ তার ভয়টাই সত্যি হলো।
নীলাদ্রি মুন রাফা নেহা নিজেরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। চার জনের চোখের দৃষ্টি এক কথাই বলছে,
-হক স্যারের ফাঁকা বাসায় উচ্ছ্বাস স্যার একটা মেয়ের সাথে! ও মাই গড!
ওদেরকে দেখে মনিকাও বোকা হয়ে গেছে। এই মেয়েগুলো কে? উচ্ছ্বাসের কাছে এদের কী কাজ?
-ওরা কারা উচ্ছ্বাস?
মনিকার উপর প্রচণ্ড রাগ হলেও উচ্ছ্বাস সেই রাগ প্রকাশ করতে পারল না। মনিকা আরও আগেই চলে গেলে ওরা তার সাথে মনিকাকে দেখত না। মেয়েগুলোর চোখই বলে দিচ্ছে ওরা উচ্ছ্বাসকে সন্দেহ করছে।
-ওরা আমার স্টুডেন্ট।
ওদেরকে ভেতরে ডাকার উচ্ছ্বাসের কোন ইচ্ছেই ছিল না। কিন্তু এখন এদের ভেতরে না ডাকলে পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ দেখাবে। এরা যা সন্দেহ করছে সেটাই সত্যি মনে করে নিবে। তাই ওদের উদ্দেশ্য করে উচ্ছ্বাস বলল,
-ভেতরে আসো তোমরা।
এ সময় এসে এমনিতেই লোকটাকে অপ্রীতিকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। এখন আবার ভেতরে গেলে ঘটনা আরও বাজে দেখাবে। নীলাদ্রি মুনের হাত চেপে ধরে নিচু গলায় বলল,
-চল ফিরে যাই মুন।
মেয়েটা কে, স্যার এখানে কী করছে প্রশ্ন গুলোর উত্তর জানার জন্য মুনেরও কম কৌতূহল কাজ করছে না। তারপরও নীলাদ্রির কথা মেনে নিল। সত্যিই তারা ভুল সময়ে চলে এসেছে। মানুষ তার ব্যক্তিগত জীবনে যা খুশি করতে পারে। তাদের মাথা ঘামানোর তো কোন অধিকার নেই। নীলাদ্রি আর মুনকে ফিসফিস করতে দেখে উচ্ছ্বাস আবার বলল,
-ভেতরে এসে বসো তোমরা।
নীলাদ্রি মুনকে আটকাতে পারলেও স্যারের কথা শুনে বাকি দু’জন অলরেডি ভেতরে ঢুকে গেছে। তাই বাধ্য হয়ে তাদেরও যেতে হলো। ওরা ভেতরে চলে গেলে দরজা লাগিয়ে দেওয়ার সময় উচ্ছ্বাস ফোঁস করে দম ফেলল। আল্লাহ জানে কাল কলেজে গিয়ে এরা তাকে নিয়ে কোন কাহিনি রটাবে। এদের থেকে যে পুরো কলেজ বিষয়টা জানতে পারবে এতে কোন সন্দেহ নেই।
আন্টির কাছে মনিকা শুনেছিল উচ্ছ্বাস নাকি কলেজে জয়েনিং দিয়েছে। এব্যাপারে শিওর হওয়ার জন্যই সে এখানে এসেছে। উচ্ছ্বাস তো কখনও বলেনি ও টিচার হবে। তাকে তো বলতো দেশেই থাকবে না। এখানে এসে অবশ্য মনিকা জানতে পেরেছে। উচ্ছ্বাস তার মামার ক্লাসটা কয়েকদিন নিবে। গেস্ট টিচার হিসেবে গিয়েছে সে। খুব বেশি দিন থাকবে না। ওরা নিশ্চয় তার মামারই স্টুডেন্ট। মনিকা হেসে মেয়ে গুলোর উদ্দেশ্য বলল,
-আরে তোমরা লজ্জা পাচ্ছ নাকি? লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। এসো। ভেতরে এসে বসো।
মনিকা ওদের ড্রয়িংরুমে এনে বসালো। এই মেয়েটা কি স্যারের গার্লফ্রেন্ড? গার্লফ্রেন্ডেই হবে। নাহলে স্যারের সাথে একা এখানে কী করছে? স্যারের গার্লফ্রেন্ড কত সুন্দর। নেহা রাফার মন ভেঙে খানখান হয়ে গেল। অস্বস্তিকর এই পরিবেশ কাটাতে উচ্ছ্বাস বলল,
-ও মনিকা। আমার ফ্রেন্ড। মনিকাও মামাকে দেখতে এসেছিল।
মেয়েগুলোর সামনে উচ্ছ্বাস মিথ্যা বলছে। সে উচ্ছ্বাসের মামাকে দেখতে এসেছে এটা সত্য না। তারপরও মনিকা কিছু বলল না। কিন্তু ওরা চারজন বুঝতে পারল না ইনি মামা কাকে বলছেন। ওদের চোখে মুখেই যেন এই প্রশ্ন ভেসে উঠেছে। উচ্ছ্বাস বলল,
-তোমাদের হক স্যার আমার মামা হোন। উনার কথাতেই আমি তোমাদের ক্লাস নিচ্ছি।
অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর একসাথে পেয়ে গিয়ে মুন বলল,
-স্যার আপনার মামা! আমরা জানতামই না।
উচ্ছ্বাস কপাল চুলকিয়ে বলল,
-জানার কথাও না।
রাফা বলল,
-আপনিও তো ক্লাসে বলেননি।
-বলার প্রয়োজন পড়েনি।
নেহা জিজ্ঞেস করল,
-স্যার কি আপনার আপন মামা?
-হুম।
এদের মধ্যে বসে নীলাদ্রি ভাবছে সে এখানে কী করতে এসেছিল? আগে যদি জানত এই লোক স্যারের ভাগ্নে তাহলে জীবনেও এখানে আসত না। আর তার বান্ধবী গুলোও আল্লাহর বান্দা। এখানে বসে গল্প জুড়ে দিয়েছে। ভেতরে আসারই কী দরকার ছিল? অস্বস্তিতে নীলাদ্রি সমানে পা নাচাচ্ছে। উচ্ছ্বাস তা লক্ষ্য করে একপলক নীলাদ্রির মুখের দিকে দেখল। প্রথম দেখাতেই এই মেয়ে তাকে চিনতে পেরেছে এটা নিশ্চিত। কিন্তু তারপরও তার সামনে এলে কেন এমন অস্বাভাবিক আচরণ করে কে জানে। তার সাথে নীলাদ্রির বোনের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। কোন একটা কারণে সেই বিয়ে হয়নি। এই কারণেই কি নীলাদ্রি তার সামনে সহজ হতে পারে না? সেই ঘটনার দুই বছর পেরিয়ে গেছে। বলতে গেলে উচ্ছ্বাস ওসব ভুলেই গিয়েছিল। কিন্তু নীলাদ্রি দেখা যাচ্ছে এখনও ওসব কথা মনে রেখেছে।
-নীলাদ্রি।
চমকে উঠল নীলাদ্রি। উচ্ছ্বাসের মুখে নিজের নাম শুনে হকচকিয়ে গেল। সাথে সাথেই রাতের স্বপ্নের কথা মনে পড়ে গেল। এই লোক এখন তাকে কানে ধরে দাঁড়াতে বলবে নাকি?
তার ডাক শুনে নীলাদ্রির ভয় পাওয়া, ঘাবড়ে যাওয়া সবটাই লক্ষ্য করল উচ্ছ্বাস। মনে মনে হাসল একটু। এই মেয়ে তাকে ভয় পাচ্ছে নাকি? কিন্তু ভয় পাওয়ার মতো কোন কাজ কি সে করেছে? তার যতদূর মনে পড়ে এমন কোন কাজই সে করেনি। তাহলে শুধু শুধু নীলাদ্রি কেন তাকে ভয় পাচ্ছে?
চলবে