মনের আঙিনায় পর্ব-০৪

0
20

#মনের_আঙিনায়
#জেরিন_আক্তার_নিপা

স্যারের মুখে নীলাদ্রির নাম শুনে নেহা রাফা মুন ঝট করে একযোগে নীলাদ্রির দিকে তাকায়। নীলাদ্রি নিঃশ্বাস আটকিয়ে বসে আছে। ঠোঁট কামড়ে ভয় ও চিন্তার কারণে পা নাচানোর সাথে হাতও কচলাচ্ছে। মনিকা উচ্ছ্বাসের ঠোঁটে ক্ষীণ হাসির আভাস দেখতে পেয়ে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইল। উচ্ছ্বাস নীলাদ্রির উদেশ্যে বলল,

-তোমাদের স্যার সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেন। এত বেশি টেনশন করার কিছু নেই।

উচ্ছ্বাসের দৃষ্টি অনুসরণ করে মুন নীলাদ্রির দিকে তাকিয়ে বুঝল স্যার কেন এই কথা বলেছে। নীলাদ্রির পায়ের উপর হাত রেখে চাপা কন্ঠে বলল,

-পা নাচানো বন্ধ কর।

উচ্ছ্বাসের ছাত্রীদের মনিকা নিজের গেস্ট হিসেবেই আপ্যায়ন করছে। ওরা কোনকিছু নিতেই না করলেও মনিকা অনেক বেশি জোড়াজুড়ি শুরু করল। মুন বলল,

-না না। আপনি প্লিজ কষ্ট করবেন না। আমরা বসব না। এক্ষুনি চলে যাব।

-সেটা কীভাবে হয়? আমি তোমাদের শুধু মুখে যেতে দিলে তো যাবে!

মনিকা ইচ্ছে করেই মেয়ে গুলোকে দেখিয়ে দিতে চাচ্ছে উচ্ছ্বাসের সাথে তার সম্পর্ক কীরকম। যদিও সে জানে না এ বাসায় কোথায় কী আছে। আজই তো প্রথম বার এসেছে। তাই এদের সামনে থেকে উচ্ছ্বাসকে নিজের সাথে ডেকে নিল।

-তুইও আয় না প্লিজ। হেল্প করে দিবি একটু।

মনিকা যাওয়ার আগে ওদেরকে বলে গেল,

-বসো তোমরা। আমরা এক্ষুনি আসছি।

মেয়েটা আর স্যার চলে যাওয়া মাত্র ওদের ফিসফিসানি শুরু হয়ে গেল। রাফার মন ভেঙে খানখান।

-আমি দুইশো পার্সেন্ট শিওর এই মেয়েটা স্যারের গার্লফ্রেন্ড।

মুখ বাঁকিয়ে নেহা বলল,

-সেজন্যই দেখলি না আমাদের সামনে থেকে কীভাবে স্যারকে ডেকে নিয়ে গেল। মেয়েটা আসলে আমাদের বোঝাতে চেয়েছে স্যারের উপর তার কত অধিকার।

মুন একমত জানাতে পারল না। ভাবুক কন্ঠে বলল,

-স্যারকে দেখে কিন্তু মনে হয়নি ওই মেয়ের সাথে স্যারের কিছু আছে।

রাফা খেঁকিয়ে উঠে বলল,

-তুই কি কানা? নাকি চোখ বন্ধ করে রেখেছিস যাতে না দেখতে হয়। সবকিছু দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। তারপরও অস্বীকার করতে চাচ্ছিস।

এদের ঝগড়া মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে নীলাদ্রি চাপা ক্রোধ নিয়ে রাফা নেহাকে ধমকে বলল,

-দোষ তো তোদের। তোরা কেন ভেতরে এসে বসতে গেলি? আমি আর মুন তো চলে যাব ঠিক করেছিলাম। তোদের জন্যই তো পারলাম না।

নেহা মুখ বাঁকিয়ে বলল,

-আমাদের দুষছিস কেন?

-না তোদের দুষবো না। আমাদের ক্লাসের মায়াকে দুষব। কারণ ওর সাথেই তো আমি এখানে এসেছি।

নীলাদ্রি রেগে এই কথা বলেছে এটা বুঝতে না পেরে রাফা বলল,

-মায়ার সাথে কোথায় এসেছিস? তুই তো আমাদের সাথে এসেছিস।

একটু আড়ালে এসেই উচ্ছ্বাস মনিকার উপর রাগ দেখাতে লাগল।

-তোকে আমি চলে যেতে বলেছিলাম। তুই নিজে তো গেলি না উল্টো ওদেরকে ভেতরে এনে বসিয়েছিস।

-তুই রেগে যাচ্ছিস কেন?

-রাগব না আমি? তুই এখনও বুঝতে পারছিস না ওই মেয়ে গুলো কালই কলেজে গিয়ে আমার সাথে তোকে জড়িয়ে কতরকমের গল্প জুড়ে দিবে।

-দিলে দিক। তাতে সমস্যা কী?

-তোর সমস্যা থাকতে না পারে কিন্তু আমার সমস্যা আছে। তুই আমার ফ্রেন্ড। এর বাইরে কখনোই তোকে আমি অন্য কিছু ভাবিনি। আর না ভবিষ্যতে ভাববো। আমি চাই না যা আমাদের মাঝে কোনদিনও ঘটেনি এমনকি ভবিষ্যতেও ঘটবে না মানুষ তা নিয়ে সন্দেহ করুক।

উচ্ছ্বাসকে মনিকা পছন্দ করে। শুধু পছন্দ না, ভীষণ পছন্দ। মনিকা এটাও জানে উচ্ছ্বাস হয়তো তাকে তার মতো পছন্দ করে না। তবে আজকের আগ পর্যন্ত তার মনে একটা আশা ছিল। তার ভালোবাসা দিয়ে হয়তো একদিন উচ্ছ্বাসের মন জয় করে নিতে পারবে। কিন্তু আজ উচ্ছ্বাসের কথাগুলো শুনে মনিকার সেই আশাটুকুও শেষ হয়ে গেল। জলে টলমলে চোখে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে রইল।

মনিকা তার হাইস্কুলের ফ্রেন্ড। মনিকাকে কখনও উচ্ছ্বাস কষ্ট দিতে চায়নি। কিন্তু মনিকা হয়তো তার নীরবতাকে সম্মতি ভেবে নিয়েছে।

-আমি জানি আমার মা তোর মাথায় এসব ভাবনা ঢুকিয়েছে। মাকেও আমি অনেকবার বলেছি। কিন্তু মা যে আমার কথা শুনেনি বোঝাই যাচ্ছে।
আমাদের ফ্রেন্ডশিপ অনেক পিওর মনি। এই সম্পর্কটাকে এভাবে নষ্ট হতে দিস না।

চোখের পানি লুকিয়ে মনকে শক্ত করে মনিকা জিজ্ঞেস করল,

-তুই আমাকে ফ্রেন্ড ভাবিস। এর বেশি অন্যকিছু ভাবতে পারবি না। ঠিক আছে মেনে নিলাম। আমার জায়গায় অন্য মেয়ে থাকলে কি মেনে নিতে পারতি? আন্টি তোকে নিয়ে ভয় পায়। ওই ঘটনার পর তুই মেয়েদেরকে বিশ্বাস করিস না এটা আন্টির ভয়। আন্টির এই ভয়টা কি সত্য? আমার সাথে অন্তত মিথ্যা বলিস না।

-এরকম কিছুই না। আর ওই ঘটনা তো আমি কবেই ভুলে গেছি। ওই একটা মেয়ের জন্য আমি সব মেয়েদের অবিশ্বাস কেন করব?

-তার মানে ভবিষ্যতে তুই বিয়ে করবি? সংসারী হবি?

-কেন করবো না? ভালো মেয়ে পেলে অবশ্যই সংসারী হবো। মা’র চাওয়া মতো সবকিছুই হবে। কিন্তু সেই সময়টা আগে আসতে দিতে হবে।

-তোর জন্য সেই সময়টা কবে আসবে বলবি একটু?

-এখন না এটা শিওর। যাক কয়েকটা বছর। আমার স্বপ্ন তো তুই জানিস।

-আন্টি যে মনে করে তুই কোনদিন বিয়ে করবি না।

-তোর আন্টিকে তো আমি কম বোঝাই নি। এবার তুই একটু বুঝিয়ে বলিস। বিয়েশাদি না করে সন্ন্যাসী জীবন কাটানোর তার ছেলের কোন ইচ্ছে নেই।

নীলাদ্রি উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। এত অস্বস্তি নিয়ে আর বসে থাকা যাচ্ছে না। ওর সাথে মুনও উঠল। নীলাদ্রি বলল,

-তোদের ইচ্ছে হলে তোরা বসে থাক৷ আমি যাচ্ছি।

-দাঁড়া একটু। স্যারকে অন্তত আসতে দে। না বলে চলে যাওয়া কেমন দেখায়।

রাফা নীলাদ্রির দিকে তাকিয়ে বলল,

-তুই এত যাই যাই করছিস কেন?

-কারণ আমি তোর মতো বলদ না।

নেহা দাঁড়িয়ে একটু এগিয়ে গিয়ে কিচেনের দিকে উঁকি দিয়ে বলল,

-অনেকক্ষণ তো হলো গিয়েছে। এখনও আসছে না কেন? স্যার কী করছে রে ভেতরে?

তখনই ওদের আসার শব্দ শোনা গেল। নেহা দ্রুত সরে এসে বান্ধবীদের সাথে দাঁড়াল। উচ্ছ্বাস এলে মুন বলল,

-স্যার আমাদের এখন যেতে হবে। বাসা থেকে কল দিচ্ছে।

উচ্ছ্বাসও কোনরকম আপত্তি জানাল না। ওরা চলে যেতে নিলেও রাফা দাঁড়িয়ে ছিল। নীলাদ্রি হেঁচকা টানে ওকে নিয়ে এলো। বেচারি পড়ে যেতে যেতে সামলে নিল।

ওরা যাওয়ার পরপরই মনিকাও চলে গেল। উচ্ছ্বাস মনিকাকেও আটকাল না। রুমে আসার পরই দাদীর কল এসেছে। মা ও মনিকার রাগ উচ্ছ্বাস দাদীর উপর দেখিয়ে বলল,

-দাদী এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তোমাকে পরে কল করছি।

রাস্তায় বেরিয়েও চারজন এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না উচ্ছ্বাস স্যার গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে একা ফ্ল্যাটে ছিল! রাফা বলল,

-ভাবা যায় স্যার কত ফাস্ট! বিয়ের আগেই গার্লফ্রেন্ডের সাথে একা সময় কাটাচ্ছে।

রাফাটার চিন্তাভাবনা সবই পঁচা। মুন বলল,

-যে যেমন সে মানুষকে তেমনই ভাবে।

এই কথা শুনে রাফা চেতে উঠে বলল,

-এই কথা দ্বারা কী বোঝাতে চাচ্ছিস তুই?

-তুই যেটা বুঝেছিস সেটাই বোঝাতে চেয়েছি।

দু’জনের মধ্যে ঝগড়া লেগে গেছে। নীলাদ্রি এক ধমকে এদের থামিয়ে দিয়ে বলল,

-আহ চুপ কর না। স্যার তোদের কে হয়? তোদের বাপ, ভাই, বর? তাহলে উনাকে নিয়ে ঝগড়া করে কেন নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ করছিস?

সত্যিই তো। স্যারকে নিয়ে
তারা কেন ঝগড়া করছে? ওই মেয়ে স্যারের গার্লফ্রেন্ড হোক বা বোন হোক। এতে তাদের কী?

নীলাদ্রি এত তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছে দেখে নীলা জিজ্ঞেস করল,

-স্যারের এখন কী অবস্থা?

-চিকিৎসার জন্য ইন্ডিয়া নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

-বাসায় গিয়ে পাসনি?

-না।

নীলাদ্রি আপুকে জানায়নি ওই লোক হক স্যারের ভাগিনা। এমনিতেই আপু তাকে ওই লোকের ফোন নম্বর এনে দিতে বলেছিল। আপুটা কি পাগল? যাকে বিয়ে করেনি, এনগেজমেন্ট ভেঙে দিয়েছে এখন কেন তার সাথে যোগাযোগ করবে? লোকটাকে এতই যদি ভালো লাগত তাহলে বিয়ে করে নিলেই পারত।

উচ্ছ্বাস ভেবে নিয়েছিল মেয়েগুলো হয়তো এতক্ষণে তাকে নিয়ে ব্রেকিং নিউজ বানিয়ে ফেলেছে। কিন্তু পরের দিন কলেজে এসেছে সেরকম কোনকিছুর আভাস পেলো না। ক্লাসে এসেও আজ মেয়ে গুলোকে শান্তশিষ্টই দেখতে পেলো। উচ্ছ্বাস বই হাতে নিয়ে পড়াচ্ছে। পড়ানোর সময় সে চশমা ব্যবহার করে। রাফা গালে হাত দিয়ে আফসোস করে বলল,

-স্যারকে এত হ্যান্ডসাম হতে কে বলেছিল? আমি স্যারের উপর ক্রাশ খাওয়া ছাড়তে পারছি না। চশমা পরলেও কাউকে এত সুন্দর লাগবে আমার কল্পনার বাইরে ছিল। চশমা পরার জন্য যাদেরকে এতদিন চাশমিস ডেকে এসেছি তাদের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত।

নেহা ফোঁস করে দম ফেলে বলল,

-স্যারের গার্লফ্রেন্ড আছে ভেবে কষ্ট পাওয়ার চেয়ে আমার তো এটা ভেবে বেশি কষ্ট হচ্ছে স্যার বেশিদিন আমাদের মাঝে থাকবেন না। হক স্যার সুস্থ হয়ে এলেই উনি চলে যাবেন।

এরা আফসোস করলেও নীলাদ্রি মনে মনে প্রার্থনা করে বলল,

-হক স্যার দ্রুত সুস্থ হয়ে ফিরে আসুক। এই লোক গেলেই বাঁচি।

নীলাদ্রি যে স্যারের দিকে তাকিয়ে আছে এটা সে নিজেও বুঝতে পারেনি। বই সামনে ধরে থাকায় উচ্ছ্বাসের পুরো মুখ ঢাকা। চোখ দু’টো শুধু দেখা যাচ্ছে। সে বইয়ের উপর দিয়ে চোখ তুলে সরাসরি নীলাদ্রির দিকে তাকাল। নীলাদ্রি বুঝতে পারেনি স্যার এখনই তাকাবে। দু’জনের চোখাচোখি হয়ে গেলে নীলাদ্রি তাড়াহুড়ো করে চোখ সরিয়ে নিল। উচ্ছ্বাস গম্ভীর স্বরে ডাকল,

-নীলাদ্রি!

নীলাদ্রির আত্মা কেঁপে উঠল। মনে মনে বলল, হায় আল্লাহ! আমাকে ডাকে কেন? আমি আবার কী করেছি। অপমান টপমান করবে না তো!

নীলাদ্রিকে আতঙ্কের সাথে উঠে দাঁড়াতে হলো। সেই সাথে ক্লাসের সবার নজর তার উপর এসে পড়েছে। উচ্ছ্বাস বই বন্ধ করে স্পিচ টেবিলের উপর একহাত রেখে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,

-এই টপিকটা বুঝেছ?

নীলাদ্রি কচুও বুঝেনি। মনযোগই তো দেয়নি। তারপরও বলল,

-জ-জি স্যার।

মুখে তো বলেছে বুঝেছে। কিন্তু মনে মনে প্রার্থনা করছে, আল্লাহ প্লিজ এখন যেন উনি আবার এটা না বলেন, কী বুঝেছ একটু বলো তো শুনি।

-ঠিক আছে। বসো।

বসার কথা শুনে নীলাদ্রির দেহে প্রাণ ফিরে এলো। জিজ্ঞেস করেনি। জিজ্ঞেস করলে আজ মানসম্মান নিয়ে বাসায় ফিরতে পারত না।

চলবে