#মনের_আঙিনায়
#জেরিন_আক্তার_নিপা
৫
ছুটির দিনে দুই বোন মিলে নানান আজগুবি কাজ করে। এমন এমন সব রেসিপি আবিষ্কার করে যার নামই হয়তো আগে কেউ কখনও শুনেনি। খাওয়া তো অনেক দূর। আজকে অবশ্য আপু তাকে নিয়ে বেরোবার কথা বলেছে। নীলাদ্রির ঘোরাঘুরি মোটেও পছন্দ না। ঘরে থাকতেই তার ভালো লাগে। কিন্তু আপুটা উড়নচণ্ডী। সুযোগ পেলেই তাকে বেরোতে হবে। সাথে নীলাদ্রিকেও বগলদাবা করে নিয়ে যাবে। আজ কোথায় যেতে চাচ্ছে কে জানে।
-এখনও তৈরি হোস নি? কখন বের হবো?
-তৈরি হয়েছি তো।
নীলা বোনকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে নিয়ে বলল,
-এভাবে যাবি?
-হুম।
-একদম না। নতুন নতুন জামাকাপড় গুলো আলমারিতে তেলাপোকা খাচ্ছে। যা গিয়ে নতুন কোন জামা পরে আয়।
নীলাদ্রি নিজের দিকে তাকিয়ে তার কাপড়ে খারাপ কিছু দেখছে না।
-এটাও তো নতুনই।
-তোর নতুন জামা দিয়ে আমি পাপোশ বানাব।
ফোঁস করে দম ফেলে নীলাদ্রি জামা পাল্টাতে গেল। মাঝে মাঝে ভেবে পায় না আপুকে কি বাবা মা কোথাও থেকে পেয়ে এনেছে? নাকি তাকে পেয়ে এনেছে? এক মায়ের পেট থেকে হলে দুই বোনের স্বভাবচরিত্র এতটা ভিন্ন কীভাবে হয়? কোনকিছু নিয়ে তাদের মিল নেই। আপু বেশি কথা বলে। সে কথাই বলে না। আপু ছটফটে চঞ্চল। সে নীরব ঘরকুনো।
এই রেস্টুরেন্টটা নাকি নতুন খুলেছে। আপু তাই এদের সিগনেচার ডিস ট্রাই করতে এসেছে। শহরে এমন কোন রেস্টুরেন্ট নেই আপু যেটাতে গিয়ে খায়নি। নীলা নীলাদ্রিকে অর্ডার করতে বলেছিল। নীলাদ্রি জানিয়েছে,
-আমি বুঝি না। তুমি অর্ডার করো।
এটা বলেও নীলাদ্রি পস্তাচ্ছে। চোখ বুঝে সে-ই কোন একটা আইটেম অর্ডার করে দিত। তার বোন আজকে অর্ডার করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। তখন থেকে মেন্যু কার্ড দেখে যাচ্ছে। সময় কাটানোর জন্য নীলাদ্রি ফোন ঘাঁটছে। তখনই স্বল্প পরিচিত এক গম্ভীর কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে ঝট করে মাথা তুলে তাকাল। উচ্ছ্বাস চোখ থেকে কালো সানগ্লাস খুলে নিয়ে বলল,
-সরি আসতে একটু লেট হয়ে গেছে।
নীলাদ্রি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। এই লোক এখানে কী করছে! নীলা আন্তরিক গলায় বলল,
-খুব একটা লেট হয়নি। আমরাও মাত্রই এসেছি। এখনও খাবার অর্ডার করিনি। তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
এই লোকের সাথে কি আপুর যোগাযোগ আছে? আপু কি এখানে এই লোকটার সাথে দেখা করতে এসেছে! তাকে আগে কেন কিছু বলেনি। আগে জানলে নীলাদ্রি কখনোই আসত না। উচ্ছ্বাস চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল,
-তারপরও অপেক্ষা করানোর জন্য দুঃখিত।
উচ্ছ্বাসের উপস্থিতিতে নীলাদ্রি খোলসের ভেতর ঢুকে গেল। অস্বস্তিতে এক মুহূর্তও এখানে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না। অথচ আপু কী সুন্দর হেসে হেসে লোকটার সাথে কথা বলছে। উচ্ছ্বাস একপলক নীলাদ্রির দিকে তাকিয়ে নীলার সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। নীলা জিজ্ঞেস করল,
-কী হালচাল? সব ভালো?
উচ্ছ্বাস হেসে বলল,
-ভালো। তোমার হাজবেন্ড এখন কী করছে?
-আর্মিতেই তো। এই আর্মি বেডাকে বিয়ে করে এখন পস্তাচ্ছি। তোমাকে বিয়ে করে নিলেই ভালো হতো।
বোনের এই কথা শুনে নীলাদ্রির কাশি উঠে গেল। তার বোনটা কি পাগল! এসব আজেবাজে কথা কীভাবে বলতে পারছে। নীলা বোনের দিকে নজর দিয়ে বলল,
-তোর আবার কী হয়েছে? নে পানি খা।
নীলাদ্রি পানি খেয়েও স্বাভাবিক হতে পারছে না। এর মাঝেই নীলা নীলাদ্রিকে দেখিয়ে উচ্ছ্বাসকে বলল,
-এটা আমার ছোট বোন। নীলাদ্রি। ওকে মনে আছে তোমার? আমাদের এনগেজমেন্ট হওয়ার সময় দেখেছ নিশ্চয়। ও অবশ্য তখন লজ্জা পেয়ে তোমার সামনে যেত না।
অস্বস্তিতে নীলাদ্রি পারছে না এদের সামনে থেকে ছুটে পালিয়ে যেতে। উচ্ছ্বাস নীলাদ্রিকে দেখে ছোট্ট করে বলল,
-হুম।
নীলা হেসে বলল,
-এখন তো আবার তোমার ছাত্রীও। দুলাভাই হতে পারোনি তাতে কী? স্যার হয়ে গেছ।
নীলাদ্রি হতাশ মুখে বসে আছে। এটা তার বোন হতে পারে না। কিছুতেই না। দু’জন আরও নানান কথাবার্তা বলে যাচ্ছে।
-বিয়েশাদি করেছ?
উচ্ছ্বাস সামান্য হেসে জানাল,
-এখনও করিনি।
-গার্লফ্রেন্ড নিশ্চয় বানিয়েছ।
-সেটাও পারিনি।
এপর্যায়ে নীলাদ্রি চোখ তুলে একবার উচ্ছ্বাসকে দেখে মনে মনে বলল,
-গার্লফ্রেন্ড বানাতে না পারলেও একটা মেয়ের সাথে একা ফ্ল্যাটে ঠিকই সময় কাটাতে পারে।
-তুমি যে রাজশাহীতে আছো আমি জানতামই না। সেই যে তোমার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলো। তারপর আর তোমার ফোন নম্বর জোগাড় করতে পারিনি।
-মামার অসুস্থতায় এখানে আসতে হয়েছে।
-কে তোমার মামা?
বোঝা গেল নীলাদ্রি বোনকে কিছুই জানায়নি। মেয়েটা তাকে এখানে দেখেও সহজ হতে পারছে না। খাবার এসেছে। নীলা খেতে খেতেই গল্প করছে। কিন্তু নীলাদ্রি উচ্ছ্বাসের সামনে খেতে পারছে না।
-কতদিন আছো এখানে?
-মামা সুস্থ হওয়া পর্যন্ত আছি।
নীলাদ্রি মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দু’জনের কথাবার্তা আলাপ-আলোচনা শুনে কেউ বলবে এদের এনগেজমেন্ট হয়েছিল। একজন আবার সেই এনগেজমেন্ট ভেঙে দিয়ে অন্য একজনকে বিয়ে করে নিয়েছে।
পুরোটা সময় ওরা নিজেরা নিজেরাই কথা বলেছে। নীলাদ্রি নীরব দর্শক হয়ে শুনেছে।
যাবার সময় নীলাদ্রি পেছনে হাঁটছে। দু’জন কিছুটা এগিয়ে গেছে। নীলা বলল,
-তোমার কিন্তু একটা ধন্যবাদ পাওনা ছিল। সেবার তুমি সাহায্য না করলে আমাদের বিয়েটা হতো না। তুমি ছিলে বলেই ওর আর্মির জবটাও বেঁচে গেছে।
নীলাদ্রি পেছন থেকে ওদের কথা শুনে কপাল কুঁচকে ভাবছে এই লোক আপুকে কীভাবে সাহায্য করেছে? উচ্ছ্বাস চলে যাওয়ার পরই নীলাদ্রি বলল,
-তুমি আমাকে মিথ্যা বলে নিয়ে এসে মোটেও ঠিক কাজ করোনি।
নীলা বোনের কথা পাত্তা না দিয়ে বলল,
-সত্য বললে তুই আসতি? আমার সাথে এসেছিস বলে উচ্ছ্বাস কি তোকে খেয়ে নিয়েছে? ও তো তোর সাথে কথাও বলেনি। তুই সবসময় বেশি বেশি করিস।
নীলাদ্রি বোনের উপর নাখুশ হয়ে বিড়বিড় করছে।
-ইন্ট্রোভার্ট মানুষের কষ্ট তুমি কী বুঝবা? অচেনা একটা মানুষের সাথে কথা বলা তো দূর সামনে যাওয়ার কথা চিন্তা করলেও হৃদযন্ত্র কাজ করা বন্ধ করে দেয়। আল্লাহ তো আর সবাইকে তোমার মতো করে বানায়নি।
-বিড়বিড় করে কী বলিস?
-ইনি তোমাকে কীভাবে সাহায্য করেছে আপু? একটু আগে তুমি কী বলছিলে আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। আর উনার সাথে তোমার এত স্বাভাবিক সম্পর্ক কীভাবে?
যে কথাটা নীলা এতদিন কাউকেই বলেনি আজ নীলাদ্রিকে বলল।
-উচ্ছ্বাসের পরিবার থেকে আমাকে দেখতে এসেছিল। ওর পরিবার আমাকে পছন্দ করেছে। অথচ উচ্ছ্বাস আমি কেউই তখন বিয়ে করার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। তোর দুলাভাই তখন চাকরিতে নতুন জয়েনিং দিয়েছে। কঠোর ট্রেনিংয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বেচারা। সেসময় ওর পক্ষে আমাকে বিয়ে করাও সম্ভব ছিল না। ট্রেনিং ফেলে চলে এলে আর্মিতে জয়েন করার স্বপ্ন পূরণ হতো না। উপায় না পেয়ে আমি উচ্ছ্বাসের সাথে দেখা করি। ওকে সবটা খুলে বললে উচ্ছ্বাসই বুদ্ধি দিল, পরিবার যেহেতু এনগেজমেন্ট করিয়ে রাখতে চাচ্ছে সেহেতু তাদের কথা শোনাই ঠিক হবে। এনগেজমেন্ট হয়ে থাকলে আমার উপরও পরিবার থেকে বিয়ের চাপ পড়বে না। ততদিনে আশিকও ট্রেনিং সম্পূর্ণ করে ফিরে আসবে।
এটুকু শুনেই নীলাদ্রির মুখ হাঁ হয়ে গেল। আপু তাহলে এনগেজমেন্ট ভাঙেনি! বুদ্ধিটা ওই লোকেরই ছিল। ওই লোক নিজেই বিয়ে করতে চায়নি।
-তোর দুলাভাই ট্রেনিং শেষ করে ফিরলে উচ্ছ্বাস নিজে দাঁড়িয়ে কাজী অফিসে আমাদের বিয়ে পড়িয়েছে। মজার কথা কী জানিস। আমার পক্ষ থেকে উচ্ছ্বাস একজন সাক্ষী ছিল।
নীলাদ্রির মতো তার পরিবারও এতদিন ধরে অন্ধকারে ছিল। এমনকি এখনও আছে। দু’জন মিলে সবাইকে কেমন বোকা বানিয়েছে।
-তুমি কি আজ উনার সাথে দেখা করতেই এখানে এসেছ?
-হুম।
-উনি এখানে আসবে কীভাবে জেনেছ?
-তোকে তো ফোন নম্বর এনে দিতে বলেছিলাম। তুই দিসনি। ফেসবুক ঘাঁটতে ঘাঁটতে হুট করে উচ্ছ্বাসের আইডি সামনে চলে এলো। প্রোফাইলে ওর ছবি ছিল দেখেই চিনেছি। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে মেসেজ দিয়ে রেখেছিলাম। ও গতকাল সিন করে রিপ্লাই দিয়েছে।
-গতকাল রিপ্লাই দিয়েছে আজই দেখা করতে চলে এলে! তুমিই ভালো। এত সহজে মানুষের সাথে মিশতে পারার এই গুণটা তোমার থেকে আমারও একটু পাওয়া উচিত ছিল।
সেদিনই বাড়ি থেকে খবর এলো দাদাজান অসুস্থ। রাতেই দুই বোন ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। দাদাজানের অসুস্থতার খবর শোনার পর থেকেই নীলাদ্রি কেঁদে যাচ্ছে। নীলা কতভাবে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিছুতেই নীলাদ্রির চোখের পানি থামছে না।
-দাদাজান তো আমারও দাদা। আমার কি খারাপ লাগছে না? আমার কি টেনশন হচ্ছে না? আমি তো কাঁদছি না। তুই কেন কাঁদছিস তাহলে?
নীলাদ্রি ফোঁপাতে ফোঁপাতেই বলল,
-দাদাজান আমাকে তোমার থেকে বেশি ভালোবাসে। দাদাজান চাননি আমি বাড়ি থেকে দূরে থাকি। কতদিন ধরে দাদাজান আমাকে দেখে না। আমিও দাদাজানকে অনেক মিস করেছি। আজ বাড়ি যাচ্ছি অথচ দাদাজান নাকি অসুস্থ।
নীলা তার এই পাগল বোনকে কীভাবে সান্ত্বনা দিবে ভেবে পেলো না।
—–
মুন রাফা নেহা কলেজে এসে দেখে নীলাদ্রি আজ আসেনি। এই মেয়ে তো কোনদিনও কলেজ মিস দেয় না। মুন নীলাদ্রিকে কল করল। রিং হচ্ছে কিন্তু কল তুলছে না। রাফা বলল,
-অসুস্থ টসুস্থ নাকি?
-অসুস্থ হলেও তো কল তুলবে।
নেহা বলল,
-ক্লাসের সময় হয়ে গেছে। আগে ক্লাসে চল। ছুটির পর নাহয় দেখতে যাব।
উচ্ছ্বাস ক্লাসে এসে সবার আগে যে জিনিস লক্ষ্য করল, নীলাদ্রি আজ ক্লাসে আসেনি। সে অবশ্য নীলাদ্রির ব্যাপারে এত বেশি ভাবল না। পড়ানো শুরু করে দিল। নীলাদ্রিকে ছাড়া তিন বান্ধবীর কারোরই ক্লাসে মন বসছে না। দুইটা ক্লাস না করেই নীলাদ্রিকে দেখা জন্য চলে এলো।
দাদাজানের অসুস্থতার খবর শুনে এলেও বাড়ি এসে দেখতে পেলো দাদাজান সুস্থ। অসুস্থ হয়েছিল। তবে ওরা আসার আগেই সুস্থ হয়ে গেছে। নীলাদ্রি দাদাজানের কাঁধে মাথা রেখে অভিযোগের সুরে বলতে লাগল,
-তুমি কেন মিষ্টি খেয়েছ দাদাজান? তুমি জানো না তোমার ডায়াবেটিস আছে। কেন সবাইকে ভয় দেখিয়েছ? তুমি জানো আমি কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
বাড়িতে যেহেতু এসেছেই তাহলে কয়েকটা দিন থেকেই যাবে। তাড়াহুড়োয় এসেছে বান্ধবীদের বলেও আসতে পারেনি। নীলাদ্রি মুনকে কল করল। ওরা নীলাদ্রির খোঁজেই যাচ্ছিল। মাঝপথে কল পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
-নীলাদ্রি, কোথায় গায়েব হয়ে গেছিস তুই? কলেজে কেন আসিসনি?
-কাল রাতেই বাড়ি এসেছি। দাদাজান অসুস্থ। এসেছি যখন এখন ভাবছি কয়েকটা দিন থেকে যাব।
-তোর দাদা এখন কেমন?
-এখন ভালোই।
নীলাদ্রি পাঁচ দিন বাড়িতে থেকেছে। ছয় দিনের মাথায় কলেজে এসে জানতে পারল উচ্ছ্বাস স্যার আর আসছেন না। হক স্যার সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। কয়েক দিনের মধ্যে ক্লাসও নিবেন। উচ্ছ্বাস স্যারের জন্য পুরো ক্লাসের মেয়েরা সহ তার বান্ধবীরা দুঃখ পেলেও নীলাদ্রি মনে মনে খুশি হলো।
চলবে