মনের আঙিনায় পর্ব-০৭

0
20

#মনের_আঙিনায়
#জেরিন_আক্তার_নিপা

বিয়ে পড়ানোর পুরোটা সময় নীলাদ্রি একটুও কাঁদেনি। তার জীবনে কী ঘটছে এটা ভেবে এতটাই আশ্চর্য হয়েছিল যে কাঁদতেও ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু এখন যখন বুঝতে পারছে তাকে এবার ওই লোকটার সাথে অচেনা অজানায় পা বাড়াতে হবে তখন থেকেই চোখের পানি বাঁধ মানছে না। কোনকালেই সে জোরে শব্দ করে কাঁদতে পারে না। তার কান্না শুধু চোখে পানি আসা। অবশ্য ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যায়। কিন্তু কাউকে বোঝাতে পারে না। নীলাদ্রি মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। মা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নানা কথা বলে সান্ত্বনা দিচ্ছে।
নীলাও কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতেই উচ্ছ্বাসকে বলল,

-আমার বোনকে তুমি কতটুকু জানো আমি জানি না। তোমার সাথে আমার এনগেজমেন্ট হয়ে গিয়েছিল, তারপরও কিন্তু নীলাদ্রি কখনও তোমার সামনে আসতে চায়নি। তোমার সাথে কখনও ভালো করে দু’একটা কথা বলেনি। তোমাকে ওর অপছন্দ ছিল এমনটা মোটেও না। আমার বোনটা ভীষণ লাজুক। ওর মতো ইন্ট্রোভার্ট মেয়ে আমি দুইটা দেখিনি। মানুষের সামনে যাওয়ার থেকে ও মরে যাওয়া সহজ মনে করে। ছোটবেলা থেকেই নীলাদ্রি এরকম। কোন আত্মীয়দের সামনে যেত না। ওর জন্য মানুষ আমাদের কম কথা শোনায়নি। কিন্তু এতেও ওকে আমরা কিছু বলিনি। সব মানুষ একরকম হয় না। মেয়েটা ভীষণ শান্তশিষ্ট চুপচাপ স্বভাবের। ওকে আমরা যা বলব তা-ই করবে।

নীলা কান্নার কারণে কথা বলতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে।

-আমরা পাত্র পছন্দ করলে নীলাদ্রি আপত্তি করেনি। তবে বিয়েতে ওর একটাই শর্ত ছিল, ছেলের সাথে একা দেখা করবে না। বা ফোনেও কথা বলবে না। কেমন পাগল মেয়ে ভাবো একবার। তুমি আমাদের দুঃসময়ে পাশে দাঁড়িয়েছ। আমার বোনটাকে বিয়ে করেছ। আমি জানি এই বিয়ে সম্পর্কে তোমার পরিবার কিছুই জানে না। ওরা নীলাদ্রিকে না-ও মেনে নিতে পারে।

এপর্যায়ে নীলা উচ্ছ্বাসের হাত ধরে ফেলল।

-তবে তোমার উপর আমার বিশ্বাস আছে। তুমি আমার বোনটাকে কখনও একা ছাড়বে না। তুমি ওর হাত শক্ত করে ধরে রেখো। নীলাদ্রি এমন মানুষ ও মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলবে না। এমনকি তোমাকেও না। তুমি ওর না বলা কথাগুলো বুঝে নিও। তোমার সাথে মানিয়ে নিতে ওর সময় লাগবে। তুমি ওকে সে সময়টুকু দিও ভাই। তোমার কাছে এটাই আমার শেষ অনুরোধ।

উচ্ছ্বাস তার আরেকটা হাত নীলার হাতের উপর রেখে নীলাকে আস্বস্ত করে বলল,

-নীলাদ্রি তোমার বোন হলে এখন ও আমার অর্ধাঙ্গিনী। আমি ওর দায়িত্ব নিয়েছি। আমার ওয়াইফকে যে কোন সিচুয়েশনে প্রটেক্ট করার দায়িত্ব আমার। তুমি কেন ভয় পাচ্ছ আমি বুঝতে পারছি নীলা। আমার পরিবার নীলাদ্রিকে মেনে নিবে। নীলাদ্রি আমার পরিবারে তার যথার্থ মর্যাদা পাবে এই নিশ্চয়তা আমি তোমাকে দিচ্ছি। আমি বেঁচে থাকতে অন্তত কেউ আমার ওয়াইফকে অসম্মান করতে পারবে না।

বিদায় বেলা নীলাদ্রি দাদাজানের হাত এত শক্ত করে ধরে রেখেছে যে দাদাজান কয়েকবার চেষ্টা করেও ওর হাত ছাড়াতে পারল না। উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে গর্বিত হেসে তিনি বললেন,

-আমার ভালোবাসার পাওয়ার দেখেছ! আমি কিন্তু তোমার টাফ কম্পিটিশন।

উচ্ছ্বাস প্রত্যুত্তরে হাসল। দাদাজান অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে নীলাদ্রির হাত উচ্ছ্বাসের হাতে শপে দিল।

-আমার অতি যত্নের নাতনিটাকে তুমি আগলে রেখো ভাই।

কথাটা বলে দাদাজান হু হু শব্দে কেঁদে উঠলেন। গাড়িতে বসে নীলাদ্রি জানালা দিয়ে সবাইকে দেখছে। যেহেতু সাথে ড্রাইভার নেই উচ্ছ্বাস নিজেই ড্রাইভ করে এসেছিল তাই যাওয়ার সময়ও তাকেই ড্রাইভ করতে হচ্ছে। নীলাদ্রি পেছনে বসেছে। বাবার দিকে তাকিয়ে নীলাদ্রি বলল,

-আমি যাব না বাবা।

রায়হান সাহেব মেয়ের মাথায় চুমু খেয়ে বললেন,

-আমি কালই তোকে দেখতে আসব মা।

গাড়ি ছেড়ে দিলে নীলাদ্রি একবার শুধু জোরে কেঁদে উঠেছিল। তারপর থেকে ফোঁপানোর শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ পাওয়া যায়নি। উচ্ছ্বাস অবশ্য একটু পরপরই ঘাড় ফিরিয়ে নীলাদ্রিকে দেখছে।

—–
চার বছর পর ছেলে বাড়িতে আসছে। খান বাড়িতে আয়োজনে বাহার দেখে যে কারোর চোখ কপালে উঠে যাবে। মিসেস শর্মিলা বড়ো ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন,

-তোর ভাই কতদূর? খোঁজ খবর নিয়েছিস?

-তোমার ছেলে আমাকে কিছুই বলেনি মা। শুধু বলেছে আজ আসবে। সকালে, দুপুরে নাকি রাতে আসবে এব্যাপারে কিছুই জানায়নি। জানালে আমি ওকে রিসিভ করতে যেতাম না?

ছেলে আসছে মিসেস শর্মিলা এতেই খুশি। ছেলের এসব পাগলামিই মিস করছিলেন তিনি। মনিকা আজ নীল রঙের একটা শাড়ি পরেছে। উচ্ছ্বাসের নীল রং পছন্দ। তাকে আজ আকাশে উড়তে দেখে জেবা মজা করে বলল,

-চার বছর বর ছাড়া শ্বশুরবাড়িতে এসেছ। আজ বর আসছে। বাসরঘর কি সাজিয়ে ফেলব?

ভাবীর কথায় মনিকা লজ্জা পেয়ে লাল হতে লাগল। যদিও উচ্ছ্বাস কখনোই তাকে সেরকম প্রতিশ্রুতি দেয়নি। কিন্তু আন্টি তো দিয়েছে। আর তাছাড়া মনিকা এটাও খুব ভালো করেই জানে, সে ছাড়া উচ্ছ্বাসের জীবনে কোন মেয়ে নেই। জেবা মনিকাকে দেখে হেসে বলল,

-লজ্জা পেয়ে আবার মরে টরে যেও না। তাহলে বিয়ের আগেই আমার দেবর বিধবা হবে।

-দূর ভাবী! তুমিও কী এসব বলো।

তখনই কলিংবেল বাজলে মনিকার হার্টবিট থেমে গেল। উচ্ছ্বাস কি চলে এসেছে? জেবা বলল,

-তোমার উনি মনে হয় চলে এসেছেন।

মিসেস শর্মিলা দরজা খুলতে যাচ্ছিলেন। উৎসব বলল,

-আমি দরজা খুলছি।

উৎসব দরজা খুলে দিয়ে এত বছর পর ছোট ভাইকে চোখের সামনে দেখে জড়িয়ে ধরতে যাচ্ছিল। কিন্তু উচ্ছ্বাসের পেছনে একটা মেয়েকে দেখতে পেয়ে মাঝপথে থেমে গেল। জেবা ডেকে জিজ্ঞেস করল,

-কী গো, উচ্ছ্বাস ভাইয়া এসেছে?

উৎসব একবার ভেতরে তাকিয়ে সবাইকে দেখে নিয়ে আরেকবার ছোট ভাইকে দেখল। মেয়েটার বিয়ের সাজ দেখেই অনেকিছু আন্দাজ করে নেওয়া যাচ্ছে। তার ভাই কি তাহলে এই কারণেই কোনরকম আগাম বার্তা দেওয়া ছাড়া হুট করে দেশে আসা ঠিক করেছে! নানান কথা ভেবে উৎসবের মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। উৎসব যে কাজ করতে গিয়ে মাঝপথে থেমে গিয়েছিল উচ্ছ্বাস তা সম্পূর্ণ করল। ভাইকে শক্ত একটা হাগ দিয়ে জিজ্ঞেস করল,

-কেমন আছো ভাই?

উৎসব এখনও হতভম্ব ভাব কাটিয়ে উঠতে পারছে না। সে ওভাবেই বলল,

-ভালো থাকার সময় মনে হয় ফুরিয়ে এসেছে রে।

উচ্ছ্বাস ভাইয়ের কথা কানে নিল না। নীলাদ্রি ভীত হয়ে তার পেছনে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে নীলাদ্রির দিকে ফিরে ওর হাতটা ধরে বলল,

-ভেতরে চলো।

উচ্ছ্বাস হাত ধরায় নীলাদ্রি কেঁপে উঠলেও হাত ছাড়িয়ে নিতে পারল না। এমনকি উচ্ছ্বাসের দিকে চোখ তুলে তাকাতেও পারল না। উৎসব দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ভাই তাকে ভেতরে যেতে দিচ্ছে না। উচ্ছ্বাস ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বলল,

-ভেতরে আসতে দিবে না?

উৎসব যন্ত্রের পুতুলের মতো সরে দাঁড়াল। উচ্ছ্বাস তার সদ্য বিয়ে করা বউয়ের হাত ধরে বাড়ির ভেতর পা বাড়াল। যদিও নীলাদ্রির হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল। মিসেস শর্মিলা ছেলেকে দেখে যতটা খুশি হয়েছিলেন ছেলের হাতে হাত ধরা মেয়েটাকে দেখে চেহারার ভাব ততটাই গম্ভীর হয়ে উঠল। মনিকাও ছুটে এসেছিল। পেছনে জেবা। ওরাও উচ্ছ্বাসের সাথে বউ সাজে মেয়েটাকে দেখে মুখ হাঁ করে, বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইল। উচ্ছ্বাস মা’র সামনে এসে মুখে হাসি নিয়ে সহজ গলায় বলল,

-কেমন আছো মা?

মিসেস শর্মিলা ছেলের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কাঠকাঠ গলায় জিজ্ঞেস করলেন,

-এই মেয়েটা কে উচ্ছ্বাস?

উচ্ছ্বাসও বাড়তি কথায় গেল না। যা সত্য তা-ই বলল,

-তোমার বউমা।

উচ্ছ্বাস বিয়ে করে বউ নিয়ে এসেছে বুঝতে পেরে মনিকার চোখ থেকে টুপটুপ করে অশ্রু গাল গড়িয়ে পড়তে লাগল। জেবা মুখে হাত চেপে মনিকার দিকে তাকাল। মিসেস শর্মিলা তীক্ষ্ণ চোখে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললেন,

-তুমি বিয়ে করেছ?

-হুম। আ’ম সরি মা, বিয়ে করার আগে তোমার অনুমতি নিতে পারিনি। তবে আমি জানি তুমি আমার সিদ্ধান্ত মেনে নিবে।

-ভুল জানো তুমি।

কথাটা বলতে গিয়ে মিসেস শর্মিলার কন্ঠস্বর উঁচু হয়ে যাওয়ায় নীলাদ্রি ভয় পেয়ে গেল। নীলাদ্রি ভয় পাচ্ছে বুঝতে পেরে উচ্ছ্বাস বলল,

-আমরা এখন রুমে যাচ্ছি মা। এবিষয়ে আমাদের পরে কথা হবে।

উচ্ছ্বাস দাঁড়াল না। নীলাদ্রির হাত ধরে নিয়ে যেতে লাগল। নীলাদ্রি পায়ে ব্যথা পাচ্ছে। সিঁড়ি পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লে উচ্ছ্বাস চিন্তিত মুখে জানতে চাইল,

-হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে?

নীলাদ্রি মুখে কিছু না বলে উপর-নীচ মাথা ঝাঁকাল। ব্যস উচ্ছ্বাস আর কোনকিছু না বলে নীলাদ্রিকে কোলে তুলে নিয়ে হাঁটা ধরল। ওর এই কাজে নীলাদ্রি যেমন চমকেছে তেমন ভয়ও পেয়েছে। প্রথমে ভয় পেয়ে উচ্ছ্বাসের গলা জড়িয়ে ধরলেও উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে ওর মুখে হাসি দেখে সাথে সাথে হাত ছেড়ে দিল। উচ্ছ্বাস দুষ্টুমি কন্ঠে বলল,

-ধরতে পারো। আমি তোমারই বর।

ওর এই কথা শুনে নীলাদ্রি লজ্জায় জমে গেল যেন। উচ্ছ্বাস মেয়েটাকে কোলে তুলে তার রুমের দিকে যাচ্ছে এই দৃশ্য দেখে মনিকা ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ল। সে কিছুতেই উচ্ছ্বাসকে অন্য কারো সাথে মেনে নিতে পারছে না। বেচারি মনিকার জন্য জেবারও কষ্ট হচ্ছে। মেয়েটা এবাড়ির বউ হওয়ার জন্য কত বছর ধরে স্বপ্ন দেখে আসছে। চোখের সামনে সেই স্বপ্ন এভাবে চূর্ণবিচূর্ণ হতে দেখে নিশ্চয় অনেক কষ্ট হচ্ছে। জেবা মনিকার পাশে বসে ওর পিঠে হাত রাখলে মনিকা জেবাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। মনিকার কান্নায় মিসেস শর্মিলাও কেঁপে উঠলেন। তিনি টলে উঠলে উৎসব এসে মা’কে ধরল।

-মা তুমি ঠিক আছো?

-তোমার বাবাকে কল করো উৎসব। সে দুনিয়ার যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে থাকুক, তুমি তাকে এক্ষুনি বাড়ি আসতে বলো।

উৎসব ভাইয়ের কাজে খুব একটা হতাশ হয়নি। কারণ তার ভাই তার পথই অনুসরণ করেছে। সে-ও জেবাকে ভাগিয়ে এনেই বিয়ে করেছিল। পরিবারের বড়ো ছেলে হওয়ায় মা সেই বিয়ে বুকে পাথর চাপা দিয়ে মেনে নিলেও উচ্ছ্বাসের বেলা মানবে কি-না বলা হচ্ছে না। না মানারই সম্ভাবনা বেশি। কারণ মা তার থেকে উচ্ছ্বাসকে চারগুণ বেশি ভালোবাসে। তাকে নিয়ে মা’র বিশেষ আশা ভরসা ছিল না। কিন্তু উচ্ছ্বাসকে নিয়ে,, ভাবতে ভাবতে উৎসব মনিকার দিকে দেখল। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

-আহারে বেচারি মেয়েটা!

চলবে