#মনের_আঙিনায়
#জেরিন_আক্তার_নিপা
১০
উচ্ছ্বাস বাবা মা’র ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ডাকল।
-মা।
মিসেস শর্মিলা ছেলের ডাক শুনে মুখ ঘুরিয়ে বসলেন। উচ্ছ্বাস ভেতরে এসে দেখে মা অন্য দিকে ফিরে বসে আছে। মায়ের মন গলাতে আদুরে গলায় বলল,
-তুমি কি আমার মুখও দেখতে চাও না?
মিসেস শর্মিলা জবাব দিলেন না। উচ্ছ্বাস এগিয়ে এসে মা’র সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসল। দু’হাতে মা’র হাত ধরে বলল,
-আমি অন্যায় করেছি তাই আমার উপর রাগ করে আছো। খাবার তো অন্যায় করেনি। রাত থেকে তুমি না খেয়ে আছো।
-আমার না খেয়ে থাকা নিয়ে তোমার তো সমস্যা হবার কথা না।
মিসেস শর্মিলা এমনিতে ছেলেদের তুই করে বললেও রেগে গিয়ে তুমি বলেন।
-আমার মা না খেয়ে থাকলে সমস্যা তো আমারই হবে।
মিসেস শর্মিলা ছেলের থেকে হাত ছাড়িয়ে নিতে চেয়ে বললেন,
-যেটুকু কষ্ট দেওয়ার তা তো দিয়েই ফেলেছ। এখন কেন দরদ দেখাতে এসেছ? মায়ের কষ্টের কথা যদি ভাবতে তাহলে না বলে বিয়ে করে নিয়ে আসতে না।
-আমার ভুল হয়েছে। ধরে নাও এটাই তোমার ছেলের শেষ ভুল। এরপর থেকে তোমাকে না জানিয়ে কিছুই করব না। তারপরও কি আমাকে ক্ষমা করতে পারবে না?
উচ্ছ্বাস মাকে মানাতে গেছে অনেকটা সময় হয়ে গেছে। জেবা শাশুড়ির ঘরের দিকে তাকিয়ে উসখুস করছে। ইউসুফ খান বৌমাকে বললেন,
-আদরের ছেলে মাকে মানাতে গেছে না মানিয়ে ফিরবে না। মা ছেলে যা খুশি করুক তুমি এত ভেবো না তো বউমা। খেতে বসে পড়ো। উচ্ছ্বাস ঠিকই তোমার শাশুড়িকে নিয়ে আসবে।
সত্যিই উচ্ছ্বাস মাকে নিয়েই ফিরেছে। যদিও মিসেস শর্মিলা খাবার টেবিলে বসেও কারো সাথেই কথা বলছেন না। জাহানারা বেগম ধমকে নাতিনকে বললেন,
-ওই নাদান, বিয়া কি করছোস বউরে শোকেসে সাজাইয়া রাখার
জন্য? নাতবউরে আমাদের সামনে আনোস না কেন? নাকি তোর বউরে দেখতে টিকেট কাটতে লাইন ধরতে হবে?
ইউসুফ খানও বললেন,
-বিয়ে যখন করেই ফেলেছিস এখন তো আর না মেনে নিয়ে উপায় নেই। নিজের ছেলেই যদি ঠিক না থাকে তাহলে পরের মেয়েকে আর কী দোষ দিব। যা মেয়েটাকে নিয়ে আয়।
উৎসব, জেবা আড়চোখে মাকে দেখছে। মা-ও কিছু না বললে উচ্ছ্বাস চেয়ার ছেড়ে উঠে নীলাদ্রিকে আনতে যাচ্ছে।
একটু আগেই নীলাদ্রির ঘুম ভেঙেছে। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠে ভাবল, এতবেলা পর্যন্ত ঘুমিয়েছে! নয়টা বেজে গেছে। ঘরে সে ছাড়া দ্বিতীয় কেউ নেই। লোকটা কি রাতেও ঘরে আসেনি? নীলাদ্রি তাড়াহুড়ো করে উঠে বসতে গিয়ে তলপেটে চিনচিন ব্যথা অনুভব করল। মাসের নির্দিষ্ট একটা সময়ে এই ব্যথা আসে। কিন্তু আজ তো সেই তারিখ না। এখনও চারদিন বাকি আছে। এবার কি তাহলে মাস শেষ হওয়ার আগেই! নীলাদ্রি কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। এব্যাপারে কার কাছে সাহায্য চাইবে সে? লজ্জায়, জড়তায় কুঁচকে গিয়ে কতক্ষণ পেট চেপে ধরে বসে থাকল। তখনই বাইরে উচ্ছ্বাসের শব্দ পেয়ে নীলাদ্রি আরও ঘাবড়ে গেল। কী করবে বুঝতে না পেরে বিছানা ছেড়ে উঠে দৌড়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। উচ্ছ্বাস ঘরে এসে নীলাদ্রিকে না দেখে একটু অবাক হলেও পরে ভাবল হয়তো ওয়াশরুমে গেছে। তাই কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করল। অনেকটা সময় পরও নীলাদ্রি বেরিয়ে না এলে উচ্ছ্বাস ওয়াশরুমের দরজার সামনে এসে ডাকল,
-নীলাদ্রি। তুমি কি ভেতরে?
নীলাদ্রির বুক কাঁপছে। গলা শুকিয়ে আসছে। সেই সাথে কান্নাও পাচ্ছে। এই অবস্থায় কিছুতেই সে বাইরে বেরুতে পারবে না। আর না লোকটাকে বলতে পারবে তার কী চাই।
নীলাদ্রির সাড়াশব্দ না পেয়ে উচ্ছ্বাস আবার ডাকল,
-নীলাদ্রি, হয়ে গেলে বেরিয়ে আসো। নিচে সবাই খাবার টেবিলে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
নিচে গিয়ে সবার সামনে খেতে বসা তো দূর নীলাদ্রি তো এই লোকের সামনেই যেতে পারবে না।
-নীলাদ্রি তুমি কি আমাকে শুনতে পারছো?
অনেকক্ষণ ধরে ডাকাডাকি করছে। অথচ মেয়েটার কোন সাড়াশব্দ নেই। উচ্ছ্বাস এবার কিছুটা ভয় পেয়ে গেল। কিছু কী হয়েছে?
-নীলাদ্রি, তুমি ঠিক আছো?
নীলাদ্রির কান্না পাচ্ছে। লোকটা তো যাচ্ছেও না। ডাকাডাকি করেই যাচ্ছে। উচ্ছ্বাস এবার দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাকল,
-নীলাদ্রি, আর ইউ ওকে? কথা বলছো না কেন?
কাঁপা কাঁপা কন্ঠে নীলাদ্রি বলল,
-আমি ঠিক আছি।
উচ্ছ্বাস স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল।
-তাহলে কথা বলছিলে না কেন?
নীলাদ্রি একথার জবাব না দিলে উচ্ছ্বাস বলল,
-ঠিক আছে। তুমি সময় নিয়ে বের হও। আমি অপেক্ষা করছি।
-না।
উচ্ছ্বাসের কপালে ভাঁজ পড়ল। জিজ্ঞেস করল,
-কী না?
-আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে না।
-কেন?
উচ্ছ্বাস বুঝতে পারছে নীলাদ্রির কন্ঠ কাঁপছে।
-কী হয়েছে নীলাদ্রি? আমাকে বলো।
-আপনি প্লিজ চলে যান। আমি বেরুতে পারব না।
-কেন?
নীলাদ্রি আবারও চুপ মেরে গেছে। কী সমস্যা ঠিক করে বলছেও না। উচ্ছ্বাস ভেবে পায় না এই মেয়েকে নিয়ে সে বাকি জীবন কীভাবে কাটাবে? বিয়ের দ্বিতীয় দিনেই ঘাম ছুটিয়ে দিচ্ছে।
উচ্ছ্বাস কপাল চেপে ঘুরে দাঁড়ালে হঠাৎ বিছানার দিকে তার চোখ পড়ল। সাদা চাদরে লাল জাতীয় কিছু দেখে ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেল। পরক্ষনেই পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারল। এজন্য নীলাদ্রি বাইরে বেরুতে চাচ্ছে না! মেয়েটা তাকে বললেই পারত। যদিও উচ্ছ্বাস বুঝতে পারছে সে বিষয়টাকে স্বাভাবিক ভাবে নিলেও নীলাদ্রির জন্য ঘটনাটা অস্বস্তিকর, লজ্জার। সে ওয়াশরুমের সামনে গিয়ে বলল,
-ঠিক আছে। তোমাকে বেরুতে হবে না। তবে আমি ভাবীকে পাঠাচ্ছি। তোমার যা লাগবে ভাবীকে বোলো।
উচ্ছ্বাস যাওয়ার জন্য দরজার কাছে গিয়েও আবার ফিরে এসে বিছানার চাদরটা তুলে ফেলে জড়ো করে রেখে দিল।
নীলাদ্রি বুঝতে পারছে না লোকটা সত্যিই কি চলে গেছে? পায়ের শব্দ শুনেছিল। উনি কি কিছু বুঝতে পেরেছেন? না বুঝলে ভাবীকে পাঠানোর কথা কেন বলল? লোকটা তার সমস্যা বুঝতে পেরেছে এটা ভেবেই নীলাদ্রি লজ্জায় মিইয়ে গেল।
জাহানারা বেগম পানসে মুখে বললেন,
-বউরে আনতে গিয়া তোর পুত হারাইয়া গেল নাকি?
ইউসুফ খানের খাওয়া প্রায় শেষের দিকে। ছেলে যে সেই তখন গেছে এখনও ফিরে আসেনি। যদিও উনি বুঝতে পারছেন। তিনি যখন নতুন নতুন বিয়ে করেছিলেন তখন উনার অবস্থাও ছেলের মতোই ছিল। বউয়ের কাছে যাওয়ার জন্য কত ছুতো যে খুঁজত! উৎসব বউয়ের কানে কানে বলল,
-বউকে আনতে গিয়ে রোমান্স শুরু করে দিয়েছে নাকি?
জেবা চোখ পাকিয়ে বলল,
-করলে তোমার সমস্যা কী?
-আমার সমস্যা না? ওর গার্লফ্রেন্ডের জন্য রাতে আমি আমার বউয়ের সাথে রোমান্স করতে পারিনি। অথচ হতচ্ছাড়া সকাল সকাল শুরু করে দিয়েছে। বংশের প্রদীপ তো দেখা যাচ্ছে আমার আগে আমার ছোট ভাই নিয়ে আসবে।
-চুপ করো অসভ্য লোক।
তখনই উচ্ছ্বাসকে আসতে দেখা গেল। উচ্ছ্বাস একা এসেছে দেখে জাহানারা বেগম মুখ বাঁকিয়ে বললেন,
-বউরে আনতে গিয়া নিজেই নিখোঁজ হইলি অহন আবার বউ ছাড়াই ফিরা আসলি। তোর ভাবসাব তো সুবিধার দেখতাছি না। কীরকম বউ বিয়া কইরা আনছোস? কানাখোঁড়া না তো আবার!
-এত পকপক কেন করো বুড়ী? বউরে দেখবা। একটু ধৈর্য ধরো। আমার বউ তো আর যে সে জিনিস না যে, সহজেই দেখা পেয়ে যাবে।
মিসেস শর্মিলা কঠিন মুখে বসে আছেন। ছেলের দিকে তাকাচ্ছেন না। উচ্ছ্বাস ভাবীকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-ভাবী একটু আসতে পারবে?
-কোথায়?
-এসো আগে।
উচ্ছ্বাস কেন ডাকছে জেবা বুঝতে না পারলেও হাত ধুয়ে উঠে ওর সাথে এলো। রুমে আসতে আসতেও অনেকবার জিজ্ঞেস করেছে,
-কোথায় নিয়ে যাচ্ছে দেবরজি?
-আমার রুমে।
-তোমার রুমে আমার কাজ কী? ও বাবা, তুমি কি তোমার বউকে শুধু আমাকেই দেখাতে চাও! সেজন্য ওকে নিচে না নিয়ে আমাকে উপরে নিয়ে এসেছ?
উচ্ছ্বাস ঘরের দরজা খুলে ভাবীকে ভেতরে যেতে বলে বলল,
-নীলাদ্রি ওয়াশরুমে আছে। একটু দেখো ওর কী লাগবে।
জেবা ঠোঁট টিপে হাসল। তাহলে এই ব্যাপার! উচ্ছ্বাস ভেতরে এলো না। এমনকি আশেপাশেও থাকল না। জেবা রিনরিনে মিষ্টি কন্ঠে ডেকে বলল,
-কী গো দেবরানী, দরজা খুলে বেরিয়ে এসো। দেখি কী হয়েছে তোমার। তোমার বর কী এমন জরুরি প্রয়োজনে আমাকে খাওয়ার মাঝখানে তুলে নিয়ে এসেছে।
নীলাদ্রি পেট ব্যথায় কুঁজো হয়ে বসে ছিল। মেয়ে কন্ঠ শুনে দরজার দিকে তাকাল। ইনি নিশ্চয় ওই মানুষটার ভাবী।
-এইযে মেয়ে, বের হও বাবা।
নীলাদ্রি ভাবছে ভাবীর সাথে হয়তো উনিও এসেছেন। তাই সে বের হচ্ছে না।
-এই মেয়ে দেখি আমাকে ভরসা করতে পারছে না। তোমার বরটাও তো চলে গেছে।
উচ্ছ্বাস রুমে নেই কথাটা শোনা মাত্র নীলাদ্রি দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। জেবা ছোট্ট একটা দম ফেলে মিষ্টি করে হাসি দিয়ে বলল,
-মানছি বরই তোমার আপন। আমরাও কিন্তু তোমার পর না। আমি তোমার বড়ো ঝা বুঝেছ। এখন বলো কী হয়েছে? তোমার বর নিজে পালিয়ে গিয়ে আমাকে কেন ফাঁসিয়ে গেছে।
ভাবীর কাছে বলতে নীলাদ্রির এত বেশি সংকোচ হলো না। যদিও লজ্জা ঠিকই লাগছিল। নীলাদ্রির সমস্যার কথা শুনে জেবা কতক্ষণ চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে থেকে পরক্ষণে শব্দ করে হেসে উঠে বলল,
-এই কথা তো তোমার বরকেই বলতে পারতে৷ বরের কাছে আবার এসব বিষয়ে কিসের লজ্জা? ওই বোকাও আমাকে এমনভাবে ডেকে নিয়ে আসলো আমি ভাবলাম কী না কী।
জেবা নীলাদ্রির সমস্যা সমাধান করে দিল। নীলাদ্রিকে প্রথম দেখেই তার কাছে চেনা চেনা লাগছিল। হঠাৎ করে বলে উঠল,
-তুমি কি নীলার বোন?
নীলাদ্রি মৃদু সুরে জানাল,
-হুম।
জেবা যেন আকাশ থেকে পড়ল। নীলার বোনকে উচ্ছ্বাস বিয়ে করেছে! কী আশ্চর্য। জেবা নীলাদ্রিকে বেশি কিছু জিজ্ঞেস না করে উচ্ছ্বাসকে খুঁজতে লাগল।
-এই ছেলে এই, উচ্ছ্বাস দাঁড়াও।
ভাবীর ডাক শুনে উচ্ছ্বাস দাঁড়াল। একটা ফোনকল করতে যাচ্ছিল। জেবা উচ্ছ্বাসের সামনে এসে আশ্চর্য কন্ঠে বলল,
-এ কাকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছ তুমি? তোমার বউ নীলার বোন! সেই নীলা যে তোমার সাথে এনগেজমেন্ট ভেঙে দিয়েছিল। তুমি তার বোনকে কোত্থেকে পেলে? তারাই বা তোমার সাথে ছোট মেয়ের বিয়ে দিতে কেন রাজি হলো। মা-ও যদি আমার মতো নীলাদ্রিকে দেখে চিনে ফেলে তাহলে কী কাণ্ড ঘটবে তুমি ভাবতে পারছো?
ভাবীর স্মৃতিশক্তির প্রশংসা করতে হয়। উচ্ছ্বাস হেসে বলল,
-সেজন্যই তো একা একা বিয়ে করে নিয়ে এসেছি। এখন মা জানলেও তেমন কোন অসুবিধা হবে না। বিয়ে তো হয়েই গেছে।
জেবা উচ্ছ্বাসের কথায় আরও বেশি অবাক হয়ে বলল,
-তুমি জেনে-বুঝেই এমনটা করেছ, তাই না? কিন্তু আমার প্রশ্ন নীলার পরিবার তোমার সাথে মেয়ে বিয়ে দিতে কেন রাজি হয়েছে? তুমিই বা এত বছর পর নীলাদ্রিকে কোথায় পেলে? ওকে বিয়ে করার জন্যই কি তুমি দেশে এসেছ? সত্যি করে বলো। তোমাদের বিয়েটা স্বাভাবিক অবস্থায় হয়নি, না? তুমি আমাদের থেকে কী লোকাচ্ছ উচ্ছ্বাস। আমি যতটুকু বুঝতে পেরেছি তোমার সাথে নীলাদ্রির সম্পর্ক মোটেও অন্য সব স্বামী স্ত্রীদের মতো না। তুমি কি নীলা বা ওর পরিবারের থেকে প্রতিশোধ নিতে মেয়েটাকে বিয়ে করেছ!
চলবে