মনের আঙিনায় পর্ব-১৩

0
18

#মনের_আঙিনায়
#জেরিন_আক্তার_নিপা
১৩
মারজিয়া জেবাকে দেখেই জিজ্ঞেস করল,

-তোমার শাশুড়ি মা কোথায়?

জেবা জবাব দেওয়ার আগেই মিসেস শর্মিলা বেরিয়ে এলেন। মারজিয়া তাকে দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলল,

-এই কাজ তুমি কীভাবে করতে পারলে শর্মিলা? আমার মেয়েটা কী দোষ করেছিল? তুমি আর তোমার ছেলে কেন আমার মেয়েটাকে এত কষ্ট দিলে?

মারজিয়াকে শান্ত করার জন্য মিসেস শর্মিলার কাছে কোন কথা নেই। সে জানে মেয়েটার সাথে অন্যায় হয়েছে। নীলাদ্রি দাদীর ঘরে ছিল। বাইরে চেঁচামেচি শুনে দাদী বলল,

-চলো তো নাতবউ দেখে আসি।

দাদী নীলাদ্রির হাত ধরে এখানে এসে উপস্থিত হলে মারজিয়া নীলাদ্রিকে দেখেই বুঝে গেল, এটাই সেই মেয়ে যার জন্য তার মেয়ের কপাল পুড়েছে। নীলাদ্রি কিছু বুঝে উঠার আগেই মারজিয়া ক্ষিপ্র গতিতে নীলাদ্রির সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,

-তুমি আমার মেয়ের সুখ কেড়ে নিজে সুখী হবে মনে করেছ? তোমার মতো মেয়ে আমি অনেক দেখেছি। দোষ তো আসলে তোমারও না। তোমার বাবা মা’ই হয়তো তোমাকে এই শিক্ষা দিয়েছে।

নীলাদ্রির সাথে কখনও কেউ উঁচু গলায় কথা বলেনি। কটু কথা সে নিতে পারে না। এই মহিলার কথা শুনে আপনাতেই তার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। জেবা অবশ্য নীলাদ্রির পক্ষ নিল।

-আপনি নীলাদ্রিকে এসব কথা বলতে পারেন না আন্টি।

মারজিয়া তেতে উঠে বলল,

-কেন পারব না? এই মেয়ে আমার মেয়ের জায়গা নেওয়ার সময় তোমরা কোথায় ছিলে? জানতে না উচ্ছ্বাসের সাথে মনিকার বিয়ে হবে।

মারজিয়া নীলাদ্রির দিকে তাকিয়ে খুবই নোংরা ভাবে বলল,

-আর তুমিও মেয়ে, ছেলে দেখেছ আর গলায় ঝুলে পড়েছে। আগে পরে কোনকিছু জানার চেষ্টা করোনি। পরিবার থেকে এই শিক্ষাই পেয়েছ? অবশ্য তোমার পরিবারের দেওয়া শিক্ষা নিয়েও আমার সন্দেহ আছে৷ নাহলে ছেলের বাবা মা ছাড়া শুধু ছেলের হাতে কোন পরিবার মেয়ে তুলে দেয়?

মারজিয়া যেভাবে পারল নীলাদ্রিকে কথা শুনিয়ে গেল। মিসেস শর্মিলাও বাধা দেননি। জেবা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেও লাভ হয়নি। শেষে দাদী কঠিন ভাষায় মারজিয়াকে বলল,

-তোমার সাহস তো কম না৷ কার বাড়িতে দাঁড়াইয়া কারে কথা শুনাও তুমি? বেশি কথা কইবা ঘাড় ধইরা বাড়ি থেকে বের করে দিমু দেখছো। তুমি আমারে চিনো না। জাহানারা বেগম আমি। আমার সামনে দাঁড়াইয়া তুমি আমার নাতবউরে কথা শোনাও। আমার নাতি কোনদিনও বলে নাই সে তোমার মেয়েরে বিয়ে করবো। তুমিই জোর কইরা আমার নাতির ঘাড়ে তোমার মেয়েরে তুইলা দিতে চাইছো। মেয়ে এত বেশি হইছে তাইলে জন্ম দিছিলা কেন?

ওই মহিলার কথাগুলো নীলাদ্রি কিছুতেই ভুলতে পারছে না। আর না চোখের পানি থামাতে পারছে। ঘরে এসে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে কেঁদে চলেছে।

উচ্ছ্বাস বেরিয়েছিল। বাড়ি ফিরে রুমে এসে নীলাদ্রির দিকে তাকিয়েই বুঝে গেল তার অবর্তমানে এমনকিছু হয়েছে যার জন্য নীলাদ্রি কেঁদেছে। অনেক আগেই নীলাদ্রি চোখে মুখে পানি দিয়ে এসেছে। সে ঠিক করেছে এই ঘটনার ব্যাপারে লোকটাকে কিছুই বলবে না।

-কী হয়েছে নীলাদ্রি?

কিন্তু উচ্ছ্বাসের এমন প্রশ্নে নীলাদ্রি কিছুটা ভড়কে গেল। ভাবল বাইরে থেকে নিশ্চয় শুনে এসেছে। নীলাদ্রি কিছু না বললেও উচ্ছ্বাস ওর ফোলা চোখ দেখেই প্রশ্নটা করেছে। নীলাদ্রি উত্তর না দিয়ে কাচুমাচু মুখে বসে আছে। উচ্ছ্বাস এসে ওর পাশে বসলে নীলাদ্রি একটু সরে গেল। কোমল গলায় উচ্ছ্বাস বলল,

-কী হয়েছে আমাকে বলো।

নীলাদ্রি তবুও চুপ থাকল। উচ্ছ্বাস নীলাদ্রির দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা দম ফেলল। এই মেয়ের থেকে কথা বের করা কষ্টের কাজ হয়ে যাবে ভেবে সে নিচে চলে এলো। ভাবীর থেকে সব জেনে আবার রুমে এলো। তবে এবার তার মুখ থমথমে। চোখে রাগের আভাস। নীলাদ্রির হাত ধরে বলল,

-এসো আমার সাথে।

উচ্ছ্বাস নীলাদ্রিকে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে নিজেই সিট বেল্ট লাগিয়ে দিল। নীলাদ্রি উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে ভয়ে এটাও জিজ্ঞেস করতে পারল না কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাকে৷ একটা বাসার সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে উচ্ছ্বাস নেমে এলো। এপাশে এসে দরজা খুলে নীলাদ্রিকে নামতে বলল।

-নামো।

নীলাদ্রি নামলে আবার নীলাদ্রির হাত ধরে ভেতরে নিয়ে যেতে লাগল। নীলাদ্রি বুঝতে পারছে না এটা কার বাড়ি। ভয় লাগলেও সে এবার জিজ্ঞেস করে বসল,

-কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?

-চুপচাপ চলো।

উচ্ছ্বাসের ধমক খেয়ে নীলাদ্রি চুপ হয়ে গেল। উচ্ছ্বাস মনিকাদের বাসায় এসেছে। কলিংবেল চাপলে একটা মেয়ে দরজা খুলে দিল। উচ্ছ্বাস জিজ্ঞেস করল,

-মনিকা বাসায় আছে?

-আছে।

-ডাকো ওকে।

মনিকার মন মেজাজ ভালো নেই। সেই সাথে শরীরও খারাপ যাচ্ছে। তবুও কাজের মেয়ের কথা শুনে সে নিচে এসেছে। উচ্ছ্বাসকে মনিকা আশা করেনি। উচ্ছ্বাসকে দেখে সে যতটা খুশি হয়েছিল উচ্ছ্বাসের সাথে নীলাদ্রিকে দেখে ততটাই কষ্ট পেলো।

-আমি তোকে কখনও বলেছি আমি তোকে ভালোবাসি বা তোকে বিয়ে করব?

উচ্ছ্বাসের এমন প্রশ্নে মনিকা বোকার মতো তাকিয়ে রইল। উচ্ছ্বাস যথেষ্ট শান্ত স্বরেই কথা বলছে।

-আমার মা তোকে কী বলেছে তার দায়ভার তো আমি নেব না। কারণ আমি সবসময় তোর কাছে ক্লিয়ার ছিলাম। আমি তোকে কখনও আশা দেইনি। তারপরও কেন তুই আশা রেখেছিস? আর আজ তোর মা কোন সাহসে আমার বাড়িতে গিয়ে আমার বউকে অপমান করেছে?

মনিকা মনে মনে নিজের উপরই তাচ্ছিল্য করে হাসল। নিজের মন তাকে উপহাস করে বলল,

-উচ্ছ্বাস তোর জন্য আসেনি হতভাগী। নিজের বউয়ের হয়ে লড়তে এসেছে।

মনিকা চেহারার ভাব স্বাভাবিক রেখেই বলল,

-মাকে আমি যেতে বলিনি।

-জানি। তোকে অন্তত এতটুকু চিনি। কিন্তু তোর মা আমাদের বাড়িতে গিয়েছে। আমার বউকে অপমান করে এসেছে।

মারজিয়া এসময় বাড়ি ফিরল। উচ্ছ্বাসদের বাড়ি থেকে সে আরেকটা বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিল। তার সেই বন্ধু মনিকার জন্য একটা ভালো পাত্রের সন্ধান এনেছে। নিজ বাড়িতে উচ্ছ্বাসকে দেখে মারজিয়া রাগে ফেটে পড়ে বলল,

-আমার বাড়িতে তুমি কেন এসেছ? আর কী চাও তুমি? আমার মেয়েটাকে ভেঙেচুরে দিয়ে তোমার শান্তি হয়নি? এখন বউ নিয়ে দেখাতে এসেছ তুমি কত সুখে আছো?

মারজিয়া আন্টি মায়ের অনেক দিনের পুরোনো বন্ধু। বয়সেও তার থেকে অনেক বড়ো। সেজন্যই উচ্ছ্বাস এখনও শান্ত আছে।

-আপনি আমাদের বাড়িতে কেন গিয়েছিলেন? আমার বউকে ওসব কথা বলার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে?

মারজিয়া নীলাদ্রির দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য করে হেসে বলল,

-এই মেয়ের জন্য এখন তুমি আমাকে শাসাতে এসেছ?

উচ্ছ্বাস খুবই শান্ত স্বরে বলল,

-শাসাতে আসিনি আন্টি। ক্লিয়ার করতে এসেছি। আপনার মেয়ের সাথে কখনোই আমার কোন ধরনের সম্পর্ক ছিল না। আমার কথা বিশ্বাস না হলে আপনি আপনার মেয়েকেই জিজ্ঞেস করে নিয়েন। তাকে আমি বিয়ের স্বপ্ন দেখাইনি। তারপরও যদি আমার জন্য আপনার মেয়ে কষ্ট পেয়ে থাকে তাহলে আমি তার কাছে ক্ষমা চাইতেও রাজি আছি। যা কিছুই হয়েছে তা আমাদের মাঝে হয়েছে। কিন্তু আপনি আমাদের মাঝে কেন আমার বউকে টেনেছেন? নীলাদ্রি তো এব্যাপারে কিছুই জানত না। তাহলে তাকে কেন কটু কথা বলেছেন?

মারজিয়া মুখ ঝামটা দিয়ে বলল,

-তুমি যেমন তোমার বউয়ের টানে আমার বাড়ি পর্যন্ত ছুটে এসেছ। আমিও আমার মেয়ের টানেই গিয়েছি।

-আপনি যেতেই পারেন। আমার আপত্তি নেই। আমাকে দোষ দিতে পারেন। এতেও আমার কোন আপত্তি নেই। আমার আপত্তি তখন হবে যখন আপনি আমার বউয়ের দিকে আঙুল তুলবেন। আমার বউ কোনভাবেই আপনার মেয়ের জায়গা নেয়নি। নীলাদ্রি আমার জীবনে আসেনি। আমি নিজে ওকে আমার জীবনে এনেছি। তাই এসবের জন্য আপনি নীলাদ্রিকে দায়ী করতে পারেন না। আজ যা হয়েছে তা আমি যেতে দিচ্ছি। কিন্তু ভবিষ্যতে এরকম কিছু হলে আমি ভুলে যেতে বাধ্য হবো আপনি মনিকার মা এবং আমার মায়ের বন্ধু।

নীলাদ্রি ফ্যালফ্যাল চোখে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে আছে। এই মানুষটাকে সে চেনার চেষ্টা করছে। উচ্ছ্বাস নীলাদ্রিকে নিয়ে মনিকাদের বাসা থেকে বেরিয়ে এলো। নীলাদ্রির হাত এখনও ওর হাতে ধরা। এখানে এসে একবারের জন্যও ছাড়েনি। নীলাদ্রিকে গাড়িতে বসিয়ে নিজেও ড্রাইভিং সিটে বসল। অনেক কষ্ট করে রাগ কন্ট্রোল করে রেখেছে। রাগ ঝাড়তে পারছে না। যার কারণে মাথার ভেতর ব্লাস্ট হচ্ছে। নীলাদ্রি পলকহীন চোখে মানুষটার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুটা সময় নিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে হঠাৎ নীলাদ্রির দিকে ঝুঁকে এসে সিট বেল্ট লাগিয়ে দিল। উচ্ছ্বাস এতটা কাছে চলে এলে নীলাদ্রি খিঁচে চোখ বন্ধ করে নিল।

-তোমাকে কেউ কিছু বললেও আমাকে বলবে না। আমি তোমার কেউ না।

কথাটা কানে যেতেই নীলাদ্রি চোখ খুলে তাকাল। ততক্ষণে উচ্ছ্বাস তার সিটে ফিরে গেছে। নীলাদ্রি বুঝল, এই কথাটায় রাগ না থাকলেও চাপা অভিমান ছিল। এখানে আসার সময় ভয় লাগছিল। কিন্তু এখন ভয় লাগছে না। উল্টো সে বুঝতে পারছে এই লোকটা পাশে থাকলেই সে নিরাপদ।

বাড়ি এসেও উচ্ছ্বাস নীলাদ্রির সাথে ঠিকমতো কথা বলছে না। সে মানছে বিয়েটা নীলাদ্রির ইচ্ছেতে হয়নি। পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে বাধ্য হয়ে নীলাদ্রিকে এই বিয়েতে রাজি হতে হয়েছে। কিন্তু সে তো মেয়েটাকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য সবরকম সাহায্য করে যাচ্ছে। তারপরও কেন নীলাদ্রি তাকে ভরসা করতে পারছে না?

জেবা নীলাদ্রিকে ধরে সবকিছু জেনে নিল। তার দেবরটা এতটা পজেসিভ আগে জানত না তো। জবা টেনে টেনে বলল,

-মা গো মা! বউয়ের জন্য যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিতেও প্রস্তুত দেখা যাচ্ছে। কী খাইয়ে আমার দেবরটাকে এরকম পাগল বানালে বলো তো?

নীলাদ্রি আগেও যে উচ্ছ্বাসের সাথে খুব একটা কথা বলত এমন না। তখন উচ্ছ্বাস বলত, সে উত্তর দিত। এখন তো উচ্ছ্বাসও বলছে না। নীলাদ্রির কান্না পাচ্ছে। সে বুঝতে পারছে লোকটা তার উপর রেগে আছে। কিন্তু সে এখন কী করবে এটাই বুঝতে পারছে না। পুরোটা বিকেল নীলাদ্রি মনমরা হয়ে কাটাল। জেবা বিষয়টা ধরতে পেরে নীলাদ্রিকে একটু চাপ দিতেই নীলাদ্রি বলে দিল,

-উনি আমার সাথে কথা বলছেন না ভাবী। এমনকি আমার দিকে তাকাচ্ছেনও না।

এই কথা শুনে জেবা হেসে বলল,

-দূর! এত ছোট একটা বিষয় নিয়ে তুমি এত ভাবছো? বরের রাগ ভাঙানো বউয়ের বাঁ হাতের কাজ।

নীলাদ্রি চাপা স্বভাবের হলেও আজ নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করল,

-আমি কীভাবে উনার রাগ ভাঙাবো ভাবী?

মেয়েটাকে জেবার পছন্দ হয়েছে। ভীষণ চাপা স্বভাবের লাজুক একটা মেয়ে। খুব কম কথা বলে। তবুও তার কাছে আপন লাগে। জেবা দুষ্টুমি করে বলল,

-এ বাবা, বলে কী এই মেয়ে! বরের রাগ কীভাবে ভাঙাতে হয় এটাও জানো না?

নীলাদ্রি মুখ ছোট করে ফেলে বলল,

-সত্যিই জানি না ভাবী।

-আমি জানি। তোমাকে শিখিয়ে দেব?

নীলাদ্রি চুপ থাকল। জেবা নীরবতা সম্মতি ধরে নিয়ে বলল,

-শেখাতে পারি তবে কানে কানে।

জেবার মনের দুষ্টুমি নীলাদ্রি বুঝতে পারল না। সে সত্যি সত্যিই ভাবীর সাহায্য চাচ্ছে। কিন্তু জেবা কানে কানে যে কথা বলল তা শুনে নীলাদ্রি লজ্জায় লাল নীল হতে লাগল। ওকে এতটা লজ্জা পেতে দেখে জেবা উচ্চ শব্দে হেসে উঠল।

-এত লজ্জা কেন পাচ্ছ মেয়ে? তোমারই তো বর।

নীলাদ্রি জড়ানো গলায় ধীরে বলল,

-আমি পারব না ভাবী।

চলবে