মনের আঙিনায় পর্ব-১৫

0
21

#মনের_আঙিনায়
#জেরিন_আক্তার_নিপা
১৫
মিসেস শর্মিলা বড় ছেলের বউয়ের আবদার রাখতে ছোট ছেলের বিয়েটা মেনে নিতে চাইলেও নীলাদ্রি নীলার বোন জানার পর থেকে একেবারেই বেঁকে বসলেন। কিছুতেই তিনি নীলাদ্রিকে মেনে নিবেন না। ইউসুফ খান স্ত্রীকে বোঝানোর চেষ্টা করলে মিসেস শর্মিলা কঠিন গলায় বললেন,

-তোমার যদি ছোট ছেলের বউয়ের প্রতি এতই দরদ থাকে তাহলে আমাকে বলে দাও। আমি এই বাড়ি থেকে চলে যাই। তুমি তোমার ছেলের বউ নিয়ে থাকো।

একথার পর আর ইউসুফ খান কিছু বলার সাহস পেলেন না। মিসেস শর্মিলা সকালে খাবার টেবিলেও এলেন না। উচ্ছ্বাস চেয়ার টেনে বসতে বসতে মাকে দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করল,

-মা কোথায়?

ইউসুফ খান একপলক ছোট বৌমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

-তোর মা একটু অসুস্থ বোধ করছে। পরে খাবে।

উচ্ছ্বাস বুঝে গেল মা’র খেতে না আসার কারণ। কাল নীলাদ্রির পরিবারের সাথে মা কথাও বলেনি। নীলাদ্রির দিকে তাকিয়ে উচ্ছ্বাস দেখল মেয়েটা কিছুই খাচ্ছে না। এত অল্প খেয়ে এই মেয়ে বেঁচে থাকে কীভাবে? উচ্ছ্বাস ব্রেডে বাটার লাগিয়ে নীলাদ্রির প্লেটে তুলে দিল। নীলাদ্রি বলে উঠল,

-আমাকে দিচ্ছেন কেন? আমার খাওয়া শেষ।

উচ্ছ্বাস চোখ রাঙিয়ে তাকাল। বলল,

-একটা কথাও না। নিজে না খেলে জোর করে খাওয়াব।

নীলাদ্রি গাল ফুলিয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইল। এদের কান্ড দেখে জেবা মিটিমিটি হাসছে। তখনই উৎসব তার মুখের সামনে সেদ্ধ ডিম ধরে বলল,

-খাও জান।

জেবা নাক কুঁচকে নিল। ইদানিং সে কিছুই খেতে পারছে না৷ পানিও গন্ধ লাগে। সেখানে ডিম দুধ তো যম। তারপরও উৎসব ওর কোন কথা শুনে না। জেবা খেতে না চাইলে উৎসব আহ্লাদী গলায় বলল,

-তুমি না খেয়ে থেকে আমার পুচকুটাকেও তো না খাইয়ে রাখছো। নিজের জন্য না খাও। আমার আণ্ডা বাচ্চাটার জন্য খাও জান।

এই কথা বলে দুধের গ্লাসও মুখের সামনে ধরল। জেবা অসহায় চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে আছে।
দুই ছেলে, ছেলের বউদের দিকে তাকিয়ে ইউসুফ খান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। ছেলেরা সুখী হোক এছাড়া আর উনার কোন চাওয়া নেই। শর্মিলাও তো এটাই চায়। তারপরও যে কেন ছেলেমানুষি জেদ করছে।
জাহানারা বেগম এদের গদগদ দেখে বিরক্ত কন্ঠে বললেন,

-এত ঢং করতে মন চাইলে ঘরে গিয়া কর। তোদের ঢং দেখে না আবার কানা হয়ে যাই।

উচ্ছ্বাস দাদীর কানের কাছে এসে হেসে বলল,

-এত হিংসা কেন করো বুড়ী? বুড়া কি তোমার সাথে ঢং করেনি?

জাহানারা বেগম মুখ বাঁকিয়ে বললেন,

-সে তোদের মতো এত রংঢং পারত না।

উচ্ছ্বাস মাথা নাড়িয়ে বিজ্ঞের মতো বলল,

-তা অবশ্য বোঝাই যায়। বুড়ো রংঢং পারলে তুমি এক ছেলের মা হতে না। সম্পদের ভাগ বসাতে আমার বাপের আরও তিন ভাই থাকত।

—–
উচ্ছ্বাস একটু পরেই বেরোবে। রুমে এসে তৈরি হয়ে নিচ্ছে সে৷ তার পেছন পেছনই নীলাদ্রিও ঘরে এসেছে। উচ্ছ্বাসকে তৈরি হতে দেখে ওর হাতঘড়ি, ওয়ালেট এগিয়ে দিচ্ছে। উচ্ছ্বাস নীরবে নীলাদ্রির বউ বউ কাজকর্ম উপভোগ করছে। বেরোবার আগে নীলাদ্রির সামনে এসে দাঁড়াল। নীলাদ্রি চোখ তুলে তাকালে জিজ্ঞেস করল,

-বাবার বাড়ি যাবে?

প্রশ্নটা শুনে নীলাদ্রির মন নেচে উঠলেও শাশুড়ি মা’র রাগের কথা ভেবে সে বলল,

-কাল তো সবার সাথে দেখা হয়েছে।

-কাল দেখা হয়েছে। আজ দেখতে মন চাইলে যাবে।

মন তো চাচ্ছে। তারপরও নীলাদ্রি মনকে শক্ত করে বলল,

-আজ যাব না। কাল বা পরশু নিয়ে গেলেই হবে।

উচ্ছ্বাস নিজেও বুঝতে পারছে নীলাদ্রি তার মা’র মন জয় করার জন্য এসব করছে। সে নীলাদ্রির হাত ধরে কাছে টেনে নিয়ে বলল,

-তোমার শাশুড়ি মা উপরে উপরেই যা রাগী। ভেতরের মনটা কিন্তু ভীষণ নরম।

নীলাদ্রি নতমুখে জবাব দিল।

-আমি জানি।

উচ্ছ্বাস হাসল। দু’হাতের মাঝে নীলাদ্রির মুখ ধরে উপরে তুলে বলল,

-মায়ের বউমা শাশুড়ি মা’র মন জয় করার জন্য এত কিছু করছে। অথচ তার ছেলের মনের পরোয়া করছে না।

উচ্ছ্বাসের একথা শুনে নীলাদ্রির মুখটা মিইয়ে গেল। প্রকাশ না করলেও লোকটা কি মনে মনে তার উপর রেগে আছে? নীলাদ্রির চেহারার রং পাল্টে যেতে দেখে উচ্ছ্বাস টুপ করে ওর কপালে চুমু খেয়ে বলল,

-আমি কিন্তু খুব বেশি সময় দিতে পারব না ম্যাডাম। আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাওয়ার আগে তাড়াতাড়ি নিজেকে প্রস্তুত করুন।

—-
বাকিটা দিন নীলাদ্রির আর কোন কাজ থাকে না। জেবারও রান্নাঘরে যাওয়া নিষেধ। তাই দুই জা মিলে গল্প করে সময় কাটায়। পেয়ারা মাখা খেতে খেতে জেবা নীলাদ্রির দিকে তাকিয়ে বলল,

-এত চিন্তা করো না তো। মা এমনিতে রাগ দেখালেও ছেলের বউদের ভীষণ ভালোবাসে। আমাকেই দেখো না। এবাড়িতে যখন এলাম প্রথম কয়েকমাস ভয়ে মা’র সামনেই পড়তাম না। তারপর আস্তে আস্তে মা’র রাগ কমলো। ছেলের বউ ভেবে না, মা আমাকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসা দিয়েছে। এখনও দিচ্ছে। তোমাকেও দিবে। তার জন্য একটু সময় লাগবে।

নীলাদ্রি জেবার সম্পর্কে তেমন কিছু জানে না। তাই জিজ্ঞেস করল,

-আপনার বাবার বাড়ি কোথায় ভাবী?

-গাজীপুর।

-আপনারা কয় ভাইবোন?

জেবা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

-আমি এতিম। বাবা মা দু’জনই ছোটবেলা মারা গেছে। ভাইবোন নেই। চাচার সংসারে মানুষ হয়েছি। তোমার ভাসুর আমার চাচাতো ভাইয়ের বন্ধু ছিল। মাঝে মাঝে চাচাতো ভাইয়ের সাথে আমাদের বাড়ি যেত। ওভাবেই আমাদের পরিচয়। তোমার ভাইয়া আমাকে পছন্দ করলেও আমি চাচা চাচীর ভয়ে কোনদিন ওসব জিনিস মাথাতেও আনিনি। একদিন হুট করেই চাচা বয়স্ক এক লোকের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করে। বিয়েতে আমি রাজি ছিলাম না। আবার বিয়ে থেকে বাঁচারও কোন উপায় ছিল না। তোমার ভাইয়া কীভাবে খবর পেলো কে জানে৷ সে আমাদের বাড়িতে হাজির হলো। আমাকে তার সাথে পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিল। আমি তো জানতাম আমি তার ও তার পরিবারের যোগ্য না। তাই নিজেও মনে মনে তাকে পছন্দ করলেও তার প্রস্তাবে রাজি হলাম না। সে তখন কী করেছে জানো? আমাকে অজ্ঞান করে বাড়ি থেকে তুলে এনেছে। আর এই কাজে তাকে কে সাহায্য করেছে শুনলে বিশ্বাস করতে চাইবে না। আমার আপনার চাচাতো ভাই নিজের বোনকে তুলে আনতে বন্ধুকে সাহায্য করেছে।

জেবা হাসছে। প্রাণোচ্ছল হাসি।
সেই সময়টা কঠিন গেলেও এখন ওসব কথা মনে করে জেবা হাসে।নীলাদ্রি অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। উৎসব ভাইয়াকে দেখে একটুও মনে হয় না তিনি এমন কাজ করতে পারেন। উৎসব ভাইয়ার পক্ষে তার বর তো তেমন কিছুই করেনি। নীলাদ্রির মনে হঠাৎ একটা ভাবনা এলো। উৎসব ভাইয়া ভাবীকে পছন্দ করত বলে তুলে এনে বিয়ে করেছে। কিন্তু ওই মানুষটা তাকে কেন বিয়ে করতে রাজি হয়েছে? তার বর আসছিল না বলে বিয়ের দিন অপমানিত হওয়া থেকে বাঁচাতে? এসব ভেবে কেনই যেন নীলাদ্রির ভীষণ মন খারাপ হলো। মানুষটা তো তাকে পছন্দ করত না।

——
তিনটার দিকে উচ্ছ্বাস বাড়ি ফিরেছে। রুমে এসেই নীলাদ্রিকে খুঁজলো সে। মেয়েটা রুমে নেই। ওয়াশরুমে দেখল। ওখানেও নেই। গরমে ঘেমে ফিরেছে উচ্ছ্বাস। তাই আগে শাওয়ার নিতে ঢুকে গেল। নীলাদ্রিকে পরে খুঁজে নিবে৷ গোসল সেরে বেরিয়ে ভেজা চুল না মুছেই নীলাদ্রির খুঁজে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। ভাবীর রুমের সামনে এসে ভেতর থেকে নীলাদ্রির কন্ঠ শুনতে পেলো।

-নীলাদ্রি।

উচ্ছ্বাসের গলা পেয়ে জেবা নীলাদ্রিকে বলল,

-তোমার সাহেব এসেছে। ডাকছে যাও।

নীলাদ্রি ভাবীর ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। উচ্ছ্বাস ওকে দেখে একগাল হাসল। মেয়েটাকে দেখলেই তার মন শান্ত হয়ে যায়। নীলাদ্রি অবশ্য উচ্ছ্বাসের দিকে তাকাতে পারছে না। একটা প্রশ্ন তার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে।

-ক্ষিধে পেয়েছে নীলাদ্রি।

একথা শুনে নীলাদ্রি উচ্ছ্বাসের দিকে তাকাল। এত বেলা হয়ে গেছে এখনও লোকটা খায়নি?

উচ্ছ্বাস খাচ্ছে নীলাদ্রি পাশে বসে আছে। লোকটার খাওয়ার ধরন সুন্দর। দেখতে ভালো লাগছে। খেতে খেতে উচ্ছ্বাস জিজ্ঞেস করল,

-তুমি খেয়েছ?

-হুম।

নীলাদ্রি খেয়েছে জানালেও উচ্ছ্বাস ভাতের লোকমা ওর মুখের সামনে ধরে বলল,

-বরের সাথে আরেক বার খাও।

নীলাদ্রি ড্যাবড্যাব করে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে আছে। মা, আপুকে ছাড়া জীবনে অন্য কারো হাতে খায়নি সে। উচ্ছ্বাস তখনও হাত ধরে আছে। নীলাদ্রি সংকোচ কাটিয়ে নিঃশব্দে খেয়ে নিল।
মানুষটার হাত থেকে খেতে অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে। লজ্জা তো লাগছেই সাথে যেন ভালো লাগাও কাজ করছে। উচ্ছ্বাস নিজে খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে নীলাদ্রিকে খাইয়ে দিয়েছে। খাওয়া শেষে উচ্ছ্বাস রুমে চলে আসার একটু পরে নীলাদ্রি এলো। পেছন থেকে নীলাদ্রিকে জড়িয়ে ধরে উচ্ছ্বাস জিজ্ঞেস করল,

-মা তোমাকে কিছু বলেছে?

-না তো।

উচ্ছ্বাস নীলাদ্রির কাঁধে থুতনি রেখে বলল,

-তাহলে মুড অফ কেন? বাড়ির কথা মনে পড়ছে?

নীলাদ্রি আশ্চর্য হলো। লোকটা কীভাবে বুঝে গেল তার মন খারাপ? সে তো মন খারাপ ভাব লুকানোর যথেষ্ট চেষ্টা করেছে।

-বাড়ি যেতে চাইলে তৈরি হও।

-না।

উচ্ছ্বাস নীলাদ্রিকে নিজের দিকে ফিরিয়ে জানতে চাইল,

-যাবে না?

-আজ যাব না।

উচ্ছ্বাস এখনও ভাবছে নীলাদ্রি হয়তো বাড়ি যাওয়ার জন্যই মন খারাপ করে আছে। মা’র অনুমতির জন্য বলতে পারছে না।

-মা কিছু বলবে না। আমি ম্যানেজ করে নিব।

-আপনি আমাকে বিয়ে কেন করেছেন?

চলবে