#মনের_আঙিনায়
#জেরিন_আক্তার_নিপা
১৬
-আপনি আমাকে বিয়ে কেন করেছেন?
উচ্ছ্বাসের চোখে চোখ রেখে প্রশ্নটা করেছে নীলাদ্রি। উচ্ছ্বাস নীলাদ্রির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রশ্নটা শোনা মাত্রই তার ঠোঁটে হাসি দেখা দিয়েছে। যে মেয়ে তার সাথে একটা শব্দ বলতে গিয়ে গুটিয়ে থাকত আজ কেমন চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করছে! বউ হিসেবে ভালোই উন্নতি হয়েছে। উচ্ছ্বাস নীলাদ্রির কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,
-তোমার কী মনে হয়? কেন বিয়ে করেছি?
নীলাদ্রি নিজে থেকে কিছু মনে করতে, ভাবতে বা বুঝতে চায় না। সে তার প্রশ্নের উত্তর এই মানুষটার মুখ থেকে শুনতে চায়।
-আমি আপনার উত্তর জানতে চাই। কিছু মনে করতে চাই না।
উচ্ছ্বাস হাসল। তার লজ্জাবতী বউয়ের মুখে কথা ফুটেছে। বউ জানতে চেয়েছে, সে বলবে। সে তো অপেক্ষাই করছিল কবে নীলাদ্রি জানতে চাইবে। তবে উচ্ছ্বাস বলতে পারল না। এর আগেই তার ফোন বেজে উঠল। এই যন্ত্রটার উপর তার বিরক্তি এসে যাচ্ছে। হতচ্ছাড়ার কোন কমনসেন্স নেই। যখন তখন বেজে উঠলে। ফারদিন কল না দিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী কল দিলেও হয়তো উচ্ছ্বাস এখন কল ধরত না। তবে ফারদিনের হিসেব ভিন্ন। ছেলেটা তার যে উপকার করেছে এর জন্য যে রাত তিনটার সময়ও এই ছেলের কল তুলবে। কল কেটে যাওয়ার আগে উচ্ছ্বাস নীলাদ্রিকে বলল,
-ইম্পরট্যান্ট একটা কল। তুমি অনুমতি দিলে তুলব।
নীলাদ্রি অবাক হয়ে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল। বলছে ইম্পরট্যান্ট কল। আবার কল তোলার জন্য তার অনুমতি চাচ্ছে। যেন সে অনুমতি না দিলে কল তুলবে না। নীলাদ্রি অনুমতি দিল। ফোন কানে নিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে উচ্ছ্বাস বলল,
-ফিরে এসে আমরা কিন্তু এখান থেকেই শুরু করব।
উচ্ছ্বাস বাইরে এসে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে ফারদিন ডেকে উঠল,
-উচ্ছ্বাস ভাই।
উচ্ছ্বাস বরাবরের মতো জবাব দিল,
-হুম ভাই।
-দেশে ফিরেছি ভাই। কিন্তু বউ নিয়ে বাড়িতে ঢুকতে ভয় লাগছে। আমার হিটলার বাপ যা রাগী! একমাত্র ছেলে বলেও ছাড় দিবে না৷ নতুন বউয়ের সামনেই জুতা খুলে মারতে শুরু করবে। আপনি কি একটু আসবেন ভাই? অন্তত বউয়ের সামনে বাপের জুতার বারি খাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে হলেও আপনাকে লাগবে ভাই।
কথা বলা শেষ করে উচ্ছ্বাস রুমে এলো। নীলাদ্রি এখনও আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে। উচ্ছ্বাস নীলাদ্রির কাছে এসে ওর হাত ধরে কোমল গলায় বলল,
-এখন একটু বেরুতে হবে নীলাদ্রি। ফিরে এসে তোমার প্রশ্নের উত্তর দিলে হবে না?
উচ্ছ্বাস না গেলে হয়তো ফারদিনের বাবা সত্যিই ছেলেকে জুতা খুলে মারতেন। তবে শেষ পর্যন্ত উচ্ছ্বাস পুরো ব্যাপারটা সামলে নিয়েছে। দু’জনের পরিবারের সমঝোতায় কাজী ডেকে আবার ওদের বিয়ে পড়ানো হয়েছে। উচ্ছ্বাসের ফেরার তাড়া থাকলেও সে যাওয়ার কথা বলতে পারল না। বললেও অবশ্য লাভ হতো না। ফারদিন তাকে যেতে দিবে না। সকল ঝামেলা মিটিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল। রুমে এসে দেখল তার বউ ঘুমিয়ে পড়েছে। উচ্ছ্বাস পকেট থেকে ফোন ওয়ালেট বের করে বেডসাইড টেবিলের উপর রেখে নীলাদ্রির সামনে এসে বসল। ঘুমন্ত মুখের উপর থেকে চুল সরিয়ে দিয়ে গালে হাত রাখল। ওভাবেই এক ধ্যানে অনেকটা সময় নীলাদ্রির মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ঝুঁকে এসে কপালে চুমু খেলো।
——-
সকালে নীলাদ্রি নিচে গেলে শাশুড়ির সাথে দেখা হয়। মিসেস শর্মিলা নীলাদ্রিকে দেখে চোখমুখ কুঁচকে ফেললেন। নীলাদ্রিও শাশুড়িকে দেখে গুটিয়ে গেল। তবে মিসেস শর্মিলা ছেলের বউকে কিছুই বললেন না। মুখ ফিরিয়ে চলে গেলেন। মা চলে গেলে নীলাদ্রি এতক্ষণ আটকে রাখা শ্বাস ছাড়ল। সকাল থেকে কয়েকবার বমি করে জেবা দুর্বল হয়ে পড়েছে। নীলাদ্রি জা’কে দেখতে এলো। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
-আসব ভাবী?
নীলাদ্রির কন্ঠ পেয়ে জেবা উঠে বসতে চাইল।
-অনুমতি কেন নিচ্ছ? এসো।
নীলাদ্রি ভেতরে এসে ভাবীর পাশে বসল। জেবার চোখমুখ শুকনো লাগছে দেখে জিজ্ঞেস করল,
-কিছু খাবেন ভাবী?
-না গো বোন। খাওয়ার নামও নিও না আমার সামনে। তোমার ভাইয়ার জোড়াজুড়িতে দুধ খেয়ে বমি করেছি। এখন আর কিছু খাবো না।
কতক্ষণ ভাবীর পাশে বসে থেকে নীলাদ্রি রুমে চলে এলো। বিয়ের পর একদিনও ভার্সিটিতে যায়নি। আজ যেতে ইচ্ছে করছে। তবে অনুমতি পাবে কি-না এটাও ভাবছে। উচ্ছ্বাস ওয়ার্ক আউট করে রুমে ফিরিয়ে। ঘামে গা ভিজে আছে তার। নীলাদ্রির দিকে একপলক তাকিয়ে মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। নীলাদ্রি ভাবছে, লোকটাকে বলবে? পড়াশোনাটা ছাড়তে পারবে না সে। কিছুতেই না। উচ্ছ্বাস কোমরে তোয়ালে পেঁচিয়ে খালি গায়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে নীলাদ্রিকে তার কাপড় বের করতে বলল। নীলাদ্রি ঘরে পরার কাপড় বের করলে উচ্ছ্বাস বলল,
-এগুলো না। আজ চাকরিতে জয়েনিং দিব।
নীলাদ্রি জানে না উচ্ছ্বাস কী কাজ করে। একসময় তো তার টিচার ছিল। তারপর মনে হয় দেশে ছিল না। ফিরলোই তো তাদের বিয়ের দিন। নীলাদ্রি ভাবনায় ডুবে ছিল মানুষটা কখন তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি। উচ্ছ্বাস নীলাদ্রির কানের কাছে বলল,
-পড়াশোনা কি ছেড়ে দিয়েছ? তোমার মুখে তো আমি একদিনও ভার্সিটি যাওয়ার কথা শুনলাম না।
হঠাৎ কানের কাছে কথা বলায় নীলাদ্রি ভয় পেয়ে গিয়েছে। আঁতকে উঠে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে ওর খালি গা দেখে লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিল। উচ্ছ্বাসের অবশ্য বউয়ের লজ্জা চোখ এড়াল না। নীলাদ্রি ভাবছে, মানুষটা কীভাবে সবসময় তার মনের কথা বুঝে যায়? সে তো এই বিষয়েই কথা বলতে চাচ্ছিল। উচ্ছ্বাস নীলাদ্রির লাজে রাঙা মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে কি সংসার করতে চাও?
নীলাদ্রি নতমুখেই জবাব দিল,
-না।
-তাহলে ক্লাস কামাই দিচ্ছ কেন? তোমার জন্য নিশ্চয় স্যাররা পড়া আটকিয়ে রাখছে না। তুমি যে পিছিয়ে পড়ছো সেই খেয়াল আছে?
নীলাদ্রি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। উচ্ছ্বাস নীলাদ্রির ওড়না টেনে নিয়ে চুল মুছতে মুছতে বলল,
-তাহলে তৈরি হয়ে নাও৷ আমার সাথে ক্লাসে যাবে তুমি।
কথাটা শুনে নীলাদ্রি চট করে উচ্ছ্বাসের মুখের দিকে তাকাল। তার অবিশ্বাস্য দৃষ্টি দেখে উচ্ছ্বাস হেসে বলল,
-আমার বউকে অন্তত গ্রাজুয়েট পাস হতে হবে।
নীলাদ্রি মানুষটার দিকে তাকিয়েই রইল। সে তো আরও অনুমতি পাওয়ার কথা ভাবছিল। এখন মনে হচ্ছে সে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে চাইলেও এই লোক তাকে ছাড়তে দিবে না। উচ্ছ্বাস নীলাদ্রির নাক টেনে দিয়ে নিজেই কাপড় বের করে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল।
স্বামী স্ত্রী বের হবার সময় দাদীর সামনে পড়ল। জাহানারা বেগম প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-বউ নিয়া কই যাস?
উচ্ছ্বাস জবাব দিল।
-বউয়ের ভার্সিটিতে।
-কেন?
উচ্ছ্বাস দাদীকে খোঁচা দিয়ে বলল,
-আমার বউ তোমার মতো ওয়ান পাস না। ভার্সিটিতে পড়ে।
জাহানারা বেগম মুখ বাঁকিয়ে বললেন,
-বিয়া হইয়া গেছে এহন আর কিসের লেখাপড়া? বাড়িত থাকব। সংসার করব। কয়দিন পর পোলাপান হইলে পোলাপান মানুষ করব। এত লেখাপড়া কইরা কাম কী? বউরে কি চান্দে পাঠাবি?
উচ্ছ্বাস দাদীর গাল টেনে দিয়ে বলল,
-বউ যদি যেতে চায় অবশ্যই পাঠাব। যেন তুমি আমার বউকে চাঁদে যেতে দেখে হিংসায় জ্বলেপুড়ে মরে যাও।
দাদী ঝাড়া দিয়ে গাল থেকে উচ্ছ্বাসের হাত সরিয়ে দিয়ে বললেন,
-তোর বাপটা কি কম আছিল যে, তুইও বউয়ের গোলাম হইছস? অবশ্য শিখছস তো বাপের থেকেই। সে-ও তো সারাদিন বউয়ের আঁচল ধরে ঘুরে।
দাদী নাতির কথাবার্তা শুনে নীলাদ্রির হাসি পেলেও হাসতে পারছে না। বের হওয়ার আগে উচ্ছ্বাস মায়ের সাথে দেখা করতে গেল। নীলাদ্রি মানুষটাকে যত দেখে ততই মুগ্ধ হয়। সবার প্রতি উনার খেয়াল আছে। মানুষটা একজন আদর্শ ছেলে, আদর্শ ভাই, আদর্শ দেবর, আদর্শ নাতি। সে সুযোগ দিলে হয়তো একজন আদর্শ স্বামী হয়েও দেখাবে। নীলাদ্রি ভাবে, উনার কাছে সময় চেয়ে কি সে মানুষটার সাথে অন্যায় করছে? তবে তখন তো মানুষটার সম্পর্কে তেমন একটা জানত না। এখন পুরোপুরি না জানলেও যতটুকু জেনেছে তাতে নীলাদ্রি একটা বিষয় উপলব্ধি করেছে। নিঃসন্দেহে উনার সাথে জীবনটা কাটাতে পারবে। তার স্বামী একজন চমৎকার মনের মানুষ।
উচ্ছ্বাস ড্রাইভ করছে। নীলাদ্রি পাশে বসে আড়চোখে উচ্ছ্বাসকে দেখছে। উচ্ছ্বাস তাকালে সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নিচ্ছে। উচ্ছ্বাস অবশ্য ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছে৷ তবুও সে কিছুই বলল না। বউ তাকে চুরি করে দেখতে চাচ্ছে যখন দেখুক। ভার্সিটি এসে নীলাদ্রি গাড়ি থেকে নামার আগে বলল,
-আপনি তো বলেছিলেন আজকে আপনার জয়েনিং।
-হুম।
উচ্ছ্বাসের দেরি হয়ে যাবে ভেবে নীলাদ্রি বলল,
-আমাকে তো পৌছে দিয়েছেন। এবার তাহলে চলে যান।
উচ্ছ্বাস ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
-চলে যেতে বলছো?
-হুম।
-তোমার স্বামীকে বান্ধবীদের সাথে পরিচয় করাবে না?
নীলাদ্রির কোন বান্ধবী নেই। কলেজে মুন, নেহা, রাফা ছিল। ভার্সিটিতে তেমন কেউ নেই। নীলাদ্রি ভাবল এখন যদি মানুষটা জানে তার কোন বান্ধবী নেই, তাহলে নিশ্চয় তাকে অসামাজিক ভাববে। তাই নীলাদ্রি বলল,
-আপনার দেরি হয়ে যাবে।
বলেই সে যাওয়া ধরল। যদিও এই মেয়ের সব কাজই এমন অদ্ভুত। তবে নীলাদ্রির এই কাজে উচ্ছ্বাস ভাবছে, নীলাদ্রি কি তাকে স্বামী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে চায় না?
ক্লাসের অনেকেই জানত নীলাদ্রির বিয়ে হবে। আজ ওকে দেখে মেয়েরা কেউ কেউ কথা বলতে এলো। ওদের সমস্ত প্রশ্ন তার বর ও শ্বশুরবাড়ি নিয়ে। তার বর কী করে, দেখতে কেমন, ছবি আছে কি-না। মেয়েগুলোর আগ্রহ দেখে নীলাদ্রি মনে মনে একটু বিরক্তও হলো। ওদের এতকিছু কেন জানতে হবে? প্রথম ক্লাসটা ভালো ভাবেই কেটেছে। অনেকদিন পর ক্লাসে করতে পেরে নীলাদ্রির ভালো লাগছে। একটা মেয়ে নীলাদ্রিকে ডাকলে নীলাদ্রি পেছনে ফিরল। মেয়েটা ওকে জিজ্ঞেস করছে ওর শ্বশুরবাড়ি কোথায়? বর কী করে? নীলাদ্রি উত্তর দিতে পারল না। তার আগেই নীলাদ্রির পাশে বসা মেয়েটা ওকে টেনে বলল,
-এই, স্যার এসেছে।
মেয়েটার কথা শুনে সামনের দিকে তাকিয়ে নীলাদ্রি থমকে গেল। এই লোক এখানে কী করছে? উচ্ছ্বাস নীলাদ্রির দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেও নীলাদ্রি অবিশ্বাস্য চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। ততক্ষণে উচ্ছ্বাসকে আন্তরিক গলায় বলতে শোনা গেল,
“Hi everyone! I’m Ucchhash Yusuf Khan, your new Accounting lecturer.
চলবে