মনের আঙিনায় পর্ব-১৭

0
19

#মনের_আঙিনায়
#জেরিন_আক্তার_নিপা
১৭
নীলাদ্রি গাড়িতে উচ্ছ্বাসের পাশে বসে আছে। বাড়ি ফিরছে তারা। ক্লাসে উচ্ছ্বাসকে দেখার পর থেকে এখন পর্যন্ত নীলাদ্রি বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে পারছে না। তবে সে কিছু জিজ্ঞেসও করছে না। ড্রাইভ করতে করতে উচ্ছ্বাস নীলাদ্রিকে দেখে হালকা হেসে বলল,

-শকে আছো নাকি শোকে?

-দু’টোই।

উচ্ছ্বাস ঠোঁটে হাসি নিয়েই জানতে চাইল,

-কেন?

নীলাদ্রি এবার নড়ে বসল। উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে বলল,

-এখন থেকে কি রোজ আপনি আমাদের ক্লাস নিবেন?

-হুম। কেন, কোন সমস্যা?

সমস্যাই তো। আর যা-ই হোক এই লোকের ক্লাসে সে মন দিতে পারবে না। যেমন আজকে পারেনি।

-তোমার তো সমস্যা হবার কথা না। আগেও তো তুমি আমার ক্লাস করেছ।

-হুম কিন্তু তখন আপনি শুধুই স্যার ছিলেন। বর তো ছিলেন না।

নীলাদ্রির কথা শুনে উচ্ছ্বাস হাসতে লাগল। ওকে হাসতে দেখে নীলাদ্রি গাল ফোলাল। উচ্ছ্বাস নীলাদ্রির দিকে এগিয়ে এসে বলল,

-বরের ক্লাসে তোমার সব মনোযোগ বরের উপর থাকবে এজন্য অভিযোগ করছ?

নীলাদ্রি চোখ উলটিয়ে সাথে সাথে বলল,

-মোটেও না।

উচ্ছ্বাস হেসেই চলল। ক্লাসে দেখেছে সে। নীলাদ্রি ক্লাস চলাকালীন পুরোটা সময় তাকেই দেখে গেছে। সে অন্য মেয়েদের সাথে কথা বললে মুখ কালো করে নিয়েছে। নীলাদ্রি অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে আছে। উচ্ছ্বাস হঠাৎ গাড়ি থামালে ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

-কী হলো?

-ওয়েট।

উচ্ছ্বাস ফোন বের করে ভাবীকে কল করল।

-ভাবী আমরা বাড়ি ফিরছি। তোমার কি কিছু খেতে মন চাচ্ছে? কী আনব তোমার জন্য?

নীলাদ্রি গালে হাত দিয়ে মুগ্ধ চোখে মানুষটাকে দেখছে। একটা মানুষ সবদিক দিয়ে এতটা পারফেক্ট কীভাবে হতে পারে?

——-
পরের দিনও নীলাদ্রি উচ্ছ্বাসের সাথেই ভার্সিটিতে এসেছে। তবে আজ গাড়ি থেকে নেমে আগে চলে না গিয়ে উচ্ছ্বাসের জন্য দাঁড়িয়ে ছিল। উচ্ছ্বাস বুঝতে না পেরে বলল,

-তুমি যাও৷ আমি গাড়ি পার্ক করে আসছি।

নীলাদ্রি মুখ কালো করে নিয়ে ভাবল, লোকটা কি তার সাথে যেতে চাচ্ছে না? অন্য ছাত্রীরা দেখে নিবে এই ভয় পাচ্ছে! দেখলে দেখুক। তারা তো স্বামী স্ত্রী-ই।

আজ ক্লাসে উচ্ছ্বাস ইচ্ছে করেই এক কাজ করল৷ নীলাদ্রি হাঁ করে তাকে দেখার সময় গমগমে গলায় ডেকে উঠল,

-মিস নীলাদ্রি।

নীলাদ্রি তাড়াহুড়ো করে চোখ সরিয়ে নিল। তবে ওর পাশের মেয়েটা বলল,

-স্যার নীলাদ্রি মিস না, মিসেস। ওর বিয়ে হয়ে গেছে।

উচ্ছ্বাস স্বাভাবিক কন্ঠেই বলল,

-ওহ।

সকালের ওই ঘটনা নিয়ে নীলাদ্রি লোকটার উপর একটু রেগে ছিল। কিন্তু মাত্রই উচ্ছ্বাস যে কাজটা করল তাতে রাগ তিনগুণ হলো। মনে মনে বলে চলল,

-আমি মিস নাকি মিসেস যেন জানে না! এমন ঢং করছে যেন নিজের বউকে চিনে না। চিনবেই বা কী করে? ক্লাসের মেয়েদের সামনে নিজেকে তো সিঙ্গেল প্রমাণ করতে হবে। তবেই তো মেয়েরা পাগল হবে।

বাড়ি ফেরার সময় নীলাদ্রি একটা কথাও বলল না। উচ্ছ্বাস অবশ্য ঠিকই বুঝতে পেরেছে তার বউ রেগে আছে। কোন ব্যাপারে রেগে আছে এটাও জানে। সে তো প্রথম দিনই সবার সাথে নীলাদ্রিকে তার স্ত্রী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিত। তবে নীলাদ্রির আচরণ দেখে মনে হয়েছে সে এরকমটা চায় না৷ তাই তো উচ্ছ্বাস এখন ওকে জ্বালানোর জন্যই ক্লাসে ওই কাজ করেছে। বাড়ি এসেও নীলাদ্রি উচ্ছ্বাসের সাথে কথা বলেনি। উচ্ছ্বাস রুমে থাকলেও নীলাদ্রি পুরো বিকেল ভাবী, দাদীর সাথে কাটিয়েছে। সন্ধ্যার দিকে উচ্ছ্বাস বেরিয়েছিল। রাতে ফিরেও নীলাদ্রিকে রুমে না পেয়ে ডাকতে এল। নীলাদ্রি দাদীর মাথা টিপে দিচ্ছিল। উচ্ছ্বাস ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,

-আমার বউকে দিয়ে তুমি কেন সেবা নিচ্ছ বুড়ী?

দাদী মুখ বাঁকিয়ে বলল,

-তোর বউ দেখে খালি তোর সেবা করব নাকি?

-আমার সেবা করার জন্যই তো এনেছিলাম।

দাদী নাতি কথা বললেও নীলাদ্রি ওদের কথা শুনছে না। অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে আছে। কতক্ষণ দাদীর সাথে খোঁচাখুঁচি করে উচ্ছ্বাস নীলাদ্রিকে বলল,

-রুমে এসো।

নীলাদ্রি শুনেও বসে রইল। ভাবসাব এমন যেন, আজ দাদীর সাথেই থাকবে সে। উচ্ছ্বাস বুঝল। বুঝে বলল,

-দাদী তোমার নাতবউ মনে হয় আমার কোলে উঠে রুমে যেতে চাচ্ছে। তুমি একটু চোখ বন্ধ করো তো আমি ওকে কোলে নেই৷ তোমার নাতবউয়ের আবার লজ্জা বেশি৷ তুমি তাকিয়ে থাকলে লজ্জা পাবে।

নীলাদ্রি তখনই উঠে রুমে চলে এলো। উচ্ছ্বাসও পেছনে এসেছে। রুমে এসে পেছন থেকে নীলাদ্রিকে জড়িয়ে ধরলে নীলাদ্রি বলল,

-ছাড়ুন।

ছাড়ার বদলে উচ্ছ্বাস আরও শক্ত করে ধরল। নীলাদ্রির কাঁধে থুতনি রেখে বলল,

-রেগে আছো কেন?

নীলাদ্রি জবাব দিল না। উচ্ছ্বাস নীলাদ্রির কাঁধে ছোট্ট একটা চুমু খেয়ে বলল,

-মিসেসের রাগ ভাঙাতে আমাকে কী করতে হবে?

নীলাদ্রি জমে গিয়েছিল। তবে কথাটা শুনে কটাক্ষ করে বলল,

-কার মিসেস আমি? আমি তো মিস।

উচ্ছ্বাস নিঃশব্দে হাসল। নীলাদ্রিকে নিজের দিকে ফিরিয়ে নাকে নাক ঘষে দিয়ে বলল,

-আপনি আমার মিসেস। এই কথাটা আমি পুরো পৃথিবীতে জানাতে চাই। আপনিও কি এমনটা চান?

নীলাদ্রির রাগ আস্তে আস্তে পড়ে গেল। উচ্ছ্বাসের চোখে চোখ রেখে সম্মতি দিল। উচ্ছ্বাস নীলাদ্রিকে কোলে বসিয়ে ফোন হাতে নিল। এতদিন ফেসবুকে তার রিলেশনশীপ স্ট্যাটাস ম্যারিড দেওয়া ছিল। তবে এবার নীলাদ্রির আইডি ট্যাগ করে ম্যারিড স্ট্যাটাস পোস্ট করল। ফোন রেখে দিয়ে নীলাদ্রির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

-এখনও রাগ আছে?

নীলাদ্রি দু’পাশে মাথা নাড়ল। সকাল হতে হতে এই স্ট্যাটাস অনেকেই দেখে ফেলেছে। ক্লাসের মেয়েরা নীলাদ্রিকে মেসেজ দিচ্ছে। নীলাদ্রি কারোর মেসেজের জবাবই দিল না। তবে ভার্সিটি এসে সবার কৌতূহল থামাতে সত্য জানাল। তারা আগে থেকেই বিবাহিত। পারিবারিক ভাবেই বিয়েটা হয়েছে। নীলাদ্রি উচ্ছ্বাস স্যারের বউ জেনে ক্লাসের অনেক মেয়েরাই হিংসা করছে৷ আবার অনেকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। এখন আর মেয়েগুলো ক্লাসে উচ্ছ্বাসকে নিয়ে অতিমাত্রায় আদিখ্যেতা দেখাচ্ছে না। নীলাদ্রি মনে মনে খুশি হলো৷ কারণ সে এমনটাই চেয়েছিল। তার বরকে নিয়ে অন্য মেয়েরা কেন আদিখ্যেতা দেখাবে? কেন তার বরের উপর ক্রাশ খাবে৷ তোদের উচ্ছ্বাস স্যার বিবাহিত এটা জেনে এবার ক্রাশ খা।

—-
নীলাদ্রি ভেবেছিল এ সপ্তাহে ছুটির দিনটাতে বাড়িতে যাবে। কিন্তু উচ্ছ্বাস জানাল আজ তার বিশেষ একজন গেস্ট আসবে। তাই নীলাদ্রি ঠিক করল পরের সপ্তাহে বাড়ি যাবে। জেবা অসুস্থ। তারপরও উচ্ছ্বাসের গেস্ট আসবে শুনে রান্নাঘরে এসেছে। তবে নীলাদ্রি ভাবীকে কোন কাজ করতে দেয়নি। ভাবীকে দাঁড় করিয়ে রেখে বলল,

-কীভাবে কী করতে হবে আপনি শুধু বলে যান, আমি করে যাই।

জেবা হেসে বলল,

-বাবাহ বরের গেস্টের খাতিরের জন্য এত কষ্ট করবে!

কয়েকটা আইটেম শুধু নীলাদ্রি রেঁধেছে। যেগুলো ও ভালো পারে। বাকি রান্না কাজের লোক করেছে৷ রান্নাবান্না শেষ করে রুমে এসে গোসল করে নীলাদ্রি আজ শাড়ি পরল। বিয়ের রিসিপশনের পর থেকে সে আর শাড়ি পরে না। শাড়ি জিনিসটা ঝামেলার। সামলাতে কষ্ট হয়। তবে আজ নিজে থেকে ইচ্ছে করেই পরল।

গেস্ট আসার অপেক্ষাতেই ছিল ওরা। উচ্ছ্বাস ওদের এগিয়ে আনতে গিয়েছিল। নীলাদ্রি গেস্ট বলতে উচ্ছ্বাসের কোন বন্ধুকে ভেবেছিল। কিন্তু উচ্ছ্বাসের পেছনে আসা ফারদিনকে দেখে নীলাদ্রি থমকে গেল। এই লোকটা এখানে কীভাবে এসেছে? নীলাদ্রি কিছু ভাবতে পারল না। তার হাত-পা কাঁপতে লাগল। এই লোকের সাথেই তো তার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। উচ্ছ্বাস দূর থেকে নীলাদ্রিকে দেখে ওর কাছে এলো। নীলাদ্রির চুপসানো মুখটা দেখে ওর হাত ধরে বলল,

-রিল্যাক্স। ফারদিনকে আমি চিনি। আর আমি এটাও জানি ওর সাথে তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল।

নীলাদ্রি অবিশ্বাস্য চোখে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকালে উচ্ছ্বাস বলল,

-তুমি আমাকে একটা প্রশ্ন করেছিলে। আমি তোমাকে কেন বিয়ে করেছি। আজ তোমার সেই প্রশ্নের উত্তর পাবে।

চলবে