মন আকাশে তুই পর্ব-০১

0
20

#মন_আকাশে_তুই
#সূচনা_পর্ব
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি

এত বছর যাবৎ যে পুরুষটিকে অহি ভালোবেসেছে,যে পুরুষটির জন্য অপেক্ষা করেছে তাকেই আজ তার প্রিয় বান্ধবী হৈমির বর হিসেবে দেখে অহি অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতেই চেয়ে থাকে। তার কি কষ্ট হচ্ছে? নিঃশ্বাস রোধ হয়ে আসছে কেন? নাকি বুকের ভেতর কেউ নিয়মিত চাকু বসাচ্ছে? এত যন্ত্রনা ! অহির বোধহয় শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে! হৃদয়ের ভেতর অদ্ভুত এক আঘাত যেন দুমড়ে মুঁছড়ে দিল তার সমস্ত জীবন।ক্রমাগত তীর চালিয়ে কেউ যেন খুব সযত্নে তার হৃদয়টা ক্ষতবিক্ষত করল। অহি না চাইলেও তার চোখ টলমল করে কেমন।কষ্টে, যন্ত্রনায় সে জামা মুঁছড়ে ধরে। শরীর গুলিয়ে আসছে কেমন। মুহুর্তের মধ্যেই বোধগম্য হলো চোখে ও ঝাপসা দেখছে। এমনকি সাদিদ এহসান, তার ভালোবাসার মানুষটিকেও সে অস্পষ্টই দেখতে পাচ্ছে চোখের সামনে। অহির টলমলে চোখের জ্বালা কমে না। বরং যুক্ত হলো তার সবসময়ের সঙ্গী শ্বাসকষ্টটাও। অহি এত এত ভীড়, এত এত হৈ চৈ এর মাঝে টিকে থাকতে পারল না। হাঁপাতে লাগল কি করুণ ভাবে। আর ঠিক তখনই পাশ থেকে কাছে এল হৃদি। আদুরে অহির এমন বেহাল দশা দেখে ওকে আগলে নিতে নিতে দ্রুত শুধাল,

“ কি হয়ছে তোর অহি? অহি রে? এমন করছিস কেন? ইনহেলারটা? আছে তোর সাথে? এই অহি…”

আকস্মিক সবার চোখের দৃষ্টি এসে পড়ল এবার অহির উপর। কেমন লুটিয়ে পড়েছে মেয়েটা।হৃদিকে আঁকড়ে ধরেছে বাচ্চাদের মতো কান্না করতে করতে। হাঁপাতে হাঁপাতে কিছু না বলতে পারলেও ছোট বাচ্চার মতো কেঁদে যাচ্ছে কেবল। হৃদির হাঁসফাস লাগল অহিটার এমন অবস্থা দেখে। আদুরে ভঙ্গিতে মেয়েটার পিঠে হাত বুলিয়ে বলতে লাগল,

“ বল না কি হয়েছে লক্ষীটি? কেউ কিছু বলেছে? আপুকে বল, আপু কথা শোনাব। বল না…”

অহি বাচ্চাদের মতোই কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতেই কোনরকমে অস্পষ্ট স্বরে কেবল বলল,

“ সা্ সাদ ভাইয়া হৃদি আপু….”

অস্পষ্ট স্বর, তার উপর এত লোক!এত সমাগম। আকদ অনুষ্ঠান হলেও হৈমীদের পুরো গোষ্ঠীতেই লোক হয়ে গেল অনেক। না জানি আনুষ্ঠানিক বিয়ের অনুষ্ঠানে কত লোক হয়! হৃদি চোখ ছোটছোট করে তাকাল। এত সমাগমে অহির বলা কথাটা সে শুনতেও পেল না। বুঝল ও না। অসহায় মুখে তাকিয়ে আবার ও অহির মুখে হাত রেখে অহিকে শুধাল,

“ কি বল? আরেকবার বল বুড়ি। ”

অহি আর কিচ্ছু বলল না। কেমন লুটিয়ে গেল। চোখমুখ নিভে এল যেন। অথচ অহি নিজেই জানে না বোধহয় ওর বুকের ভেতর কি ভীষণ যন্ত্রনা হচ্ছে৷ কি ভীষণ জ্বালা!হৃদি একা অহিকে আঁকড়ে ধরলেও রুমে নেওয়ার জন্য তাকে কয়েকজনের সাহায্য চাইতে হলো। কয়েকজন এগিয়ে অহিকে মাত্র ধরে উঠাবে ঠিক তখনই ওর আশপাশের মানুষগুলোকে পাশ কাঁটিয়ে সামনে এল লম্বা চওড়া একজন সুদর্শন পুরুষ। পরনে সুতিতে কাজ করা সাদা পাঞ্জাবী। একটু আগে অহির মতো করে এবারে হৃদিও চমকাল। চোখ ছোটছোট করে তাকিয়ে পুরুষটিকে অবলোকন করে৷ বিড়বিড় করে শুধাল,

“ সাদিদ এহসান! ”

অথচ পুরুষটির কপাল কুঁচকানো৷ অহিকে ওভাবে লুটিয়ে হাঁপাতে আর কাঁদতে দেখে সে গভীর ভাবেই এতোটা সময় চেয়েছিল দূর থেকে। এখন আরো গভীর ভাবে চাইল যেন মেয়েটার দিকে। চোখ নিভু নিভু।অথচ চোখের পাতা ভেজা থাকাতে মেয়েটাকে মিষ্টি লাগছে।সাদিদ মনোযোগ দিয়েই কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। চিনতে পেরেছে মেয়েটাকে সে? যে মেয়েটার জন্য এত পাগলামো, এত অস্থিরতা, এত ঝামেলা করে চলেছে এখন ও সে মেয়েটাকে কি এতবছর পর দেখে সাদিদ চিনতে পেরেছে? উত্তর পাওয়া যায় না। তবে সাদিদের চোখমুখ কুঁচকানো, কিছুটা রাগ যেন জমেছে চাহনিতে।তাকিয়ে দেখে মেয়েটার দৃষ্টিও তার দিকেই। সাদিদ অহির দৃষ্টিতে স্পষ্টভাবে দৃষ্টি রাখলেও মুখচোখ টানটান দেখাল।রাগ রাগ ভাব ।সেই রাগ রাগ ভাব নিয়ে মেয়েটার একটু কাছে যেতেই খুব মিষ্টি একটা সুভাস নাকে এসে লাগছে বোধ হয়। সে একবার চোখ বুঝল।নাসারন্ধ্রে সুভাসটা বেশ অনুভব করে পুণরায় চোখ খুলতেই দেখা মিলল অহির পাশে একটা ছেলের। অহির গালে হাত রেখে আগলে নিচ্ছে কেমন। ইনহেলারটাও এগিয়ে দেয় মুখে। সাদিদ ভ্রু কুঁচকেই তাকায় ছেলেটার দিকে। বোধহয় একটু বেশি রাগ লাগছে এখন।ফর্সা নাকটা ইতোমধ্যেই লাল হয়ে এসেছে। কেন এমন রাগ লাগছে? ছেলেটাকে ভ্রু কুঁচকে অবলোকন করেই সে শুধাল,

“ কি ব্রো? বাংলা সিনেমার মতো মুখে হাত দিয়ে দুটো প্রেমবাক্য শোনালেই সুস্থ হয়ে যাবে নাকি মেয়েটা? আশ্চর্য! ”

এটুকু বলেই ফের মুখ টানটান করে চোয়াল শক্ত করল। দৃঢ় আওয়াজে বলল,

“ ওভাবে গালে-মুখে হাত না দিয়ে ফ্রি ভাবে ইনহেলার নিতে দাও।স্পেস দাও। ”

ছেলেটা ভ্রু কুঁচকে তাকাল সাদিদের দিকে। বলল,

“ আপনি কে? ”

সাদিদের মনে মনে দুটো বিরক্তিকর শব্দ আসল। ছেলেটার প্রতি তার রাগ হচ্ছে। একটু বেশিই রাগ হচ্ছে। মেজাজ উত্তপ্ত ঠেকছে তার। তবুও নিজেকে সামলে ছেলেটাকে শুধাল,

“ তার আগে বলো, তুমি কে ব্রো ? ”

ছেলেটা উত্তর করল,

“ অহি জানে আমি কে। সো ওর যত্ন নেওয়ার অধিকারও আমার আছে। ”

বাহ! কি সুন্দর উত্তর! কোথাকার কোন ছেলে এসে বলছে কিনা এই মেয়ের যত্ন নেওয়ার অধিকার তার আছে।সূক্ষ্ম এক জেদ চিরচির করে উঠে যেন সাদিদের চোখেমুখে। অহির দিকে এমনভাবে ভ্রু বাঁকিয়ে তাকিয়ে থাকল যেন এই অপরাধে সে সুযোগ ফেলেই অহিকে গলা টি’পে মা’রবে। নাকের অগ্রভাগ ইতোমধ্যেই লাল টকটকে হয়ে আসে রাগে। অহি ততক্ষনে চোখ বুঝে এলিয়ে দিল শরীর। বোধহয় জ্ঞান হারিয়েছে। সাদিদ এবারও ভ্রু বাঁকিয়ে কার্যকলাপ পরখ করছিল। ছেলেটা যখনই অহিকে কোলে তুলতে নিবে ঠিক তখনই সাদিদ এগিয়ে ঝুঁকল। হাত দিয়ে আগলে কোলে তুলল অহিকে। গম্ভীর একরোখা স্বরে বলে উঠল,

“ মনে হচ্ছে না তুমি তাকে কোলে নিতে পারবে ব্রো।বড্ড ছোট তো তুমি। বরং আমিই কোলে করে নিয়ে যাচ্ছি।তোমার সুবিধাই হবে বলো? ”

এটুকু বলেই ফের উপস্থিত সবার উদ্দেশ্যে একরোখা স্বরে বলল,

“ সবাই মিলে এভাবে ভীড় না করে একটা ফাঁকা রুম দেখিয়ে দিন। আমি ও কে ওখানে নিয়ে যাচ্ছি বরং! ”

উপস্থিত সবাই সাদিদের এমন কথা শুনে সরে গেল। বাসার ফাঁকা একটা রুম দেখিয়ে দিল হৈমির বড়বোন। সাদিদ ও সেই মোতাবেক অহিকে নিয়ে গেল সে রুমটায়। বিছানায় শুঁইয়ে দিয়ে ফ্যান অন করল। অতঃপর গাঢ় দৃষ্টি ফেলে মেয়েটার ক্লান্ত মুখশ্রী, অশ্রুভেজা চোখের পাঁপড়ি, থুতনিতে থাকা তিলটা পরখ করে।খুব মনোযোগ দিয়েই পরখ করে। পরপর নজর সরিয়ে পানির বোতলটা হাতে নিয়ে কিছুটা পানি ছিটাতে লাগল অহির মুখে। ঠিক তখনই পাশ থেকে কেউ বলে উঠল দ্রুত,

“ আপনি সাদিদ এহসান না? ইন্স্ট্রাতে আপনার ফলোয়ার আমি। ”

হৃদি এতক্ষন যাবৎই সাদিদকে খেয়াল করে যাচ্ছিল। সাদিদের কপাল কুচকানো, অহির প্রতি রাগ রাগ ভাব নিয়ে তাকানো সবটাই।অথচ বুঝে উঠে না অসুস্থ একটা মানুষের দিকে এভাবে রেগে তাকানোর কি আছে।হৃদি ঠোঁট চেপেই তাকায় সাদিদের উত্তর পাওয়ার আশায়। সাদিদ ও প্রশ্ন শুনে পাশ ফিরে তাকায়। এটা কোন পরিচয়ের ধরণ? ইন্স্ট্রাগ্রামে তার ফলোয়ার বলে কি সে এখন মেয়েটাকে বিশেষ চোখে দেখবে? নাকি আতিথেয়তা দেখাবে ?একরোখা স্বরে বলে উঠল সে,

“ ইন্স্ট্রাগ্রাম ফলোয়ার হলে কি আপনাকে এখন আমি মাথায় তুলব? ফ্রেন্ডের এই অবস্থায় এসব মাথায় আনেন কিভাবে?”

যদিও অহি হৃদির ফ্রেন্ড নয়। বোন! আপন বোনের মতোই স্নেহ করে সে। হৃদির পছন্দ হলো না উত্তরটা। বলল,

“ বেশি বকবক করবেন না। আমি ভুল না হলে ওর এই অবস্থাও আপনারই জন্য ভাই। কোথথেকে টপকে পড়েছেন এই দেশে? ”

সাদিদ ভ্রু বাঁকিয়েই বলল,

“ হোয়াট? ”

হৃদি কোমড়ে হাত রেখে বলল,

“আগে বলুন, আপনিই সাদিদ এহসান রাইট? বলুন উত্তরটা। ”

সাদিদ ভ্রু কুঁচকে তাকাল। পুণরায় একবার বিছানায় পড়ে থাকা অহির দিকে চেয়ে বলল,

“ আপনার ফ্রেন্ড তো অসুস্থ। আমি কে তা না জেনে ফ্রেন্ডের পাশে থাকুন বরং। ”

হৃদির এই ছেলেকে পছন্দ হলো না। এমন ঘাড়ত্যাড়া, একরোখা ছেলের হাতে সে নিজের বাচ্চামতো বোনকে কখনোই দিত না। দিবেও না। এত রুক্ষ একটা মানুষের কাছে অহির মতো সফট হার্টের মানুষ থাকলে বেঁচে থাকবে? দিনের মধ্যে হাজারবার কষ্ট পাবে তার বোনটা। হৃদি ছোটশ্বাস ফেলে অহির দিকে গেল। মুখেচোখে জলের ছিটে দিল। তারপর কিছুটা সময় পর অহির জ্ঞান ফিরতেই হৃদি ফোঁস করে শ্বাস তুলল। বলল,

“ একটা ছেলেকে এত বছর এত দূর থেকে ভালোবেসে, অপেক্ষা করে লাভ কি হলো? ছেলেটার কথাবার্তা কেমন জানি অহি। তুই এই ছেলেকে কি করে ভালোবাসতে পারলি? আমি চোখ বুঝেই বলে দিতে পারি এই ছেলে রগচটা। তুই ঐ ছেলের কাছে জীবনেও ভালো থাকবি না। উঠতে বসতে রাগ ঝারবে এই ছেলে। আর তুই কিনা এসেই ঐ ব্যাটাকে দেখে এমন হ্যাং হয়ে গেলি অহি। ছিঃ! ”

অহি সেসবে কান দিল না।অনেকটা সময় সে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে চুপ থাকল। প্রায় আধঘন্টা কি একঘন্টা সে কোন কথাই বলল না। উঠে বসে জানালার ধারে তাকিয়ে থাকল। হৃদি দুয়েকবার কথা বললেও অহি উত্তর করল না। একদমই চুপ থাকল। হৃদি কিছুটা সময় তার সাথে থাকলেও অনেকটা সময় পর সে বাইরে গেল। হৈমির আকদ অনুষ্ঠান দেখতে। অতঃপর আবার ফিরে এসে শুধাল,

“ হৈমির বরটাকে তো আমি দেখতেই পেলাম না রে অহি। তার আগেই আকদ অনুষ্ঠান কম্প্লিট! এটা কেমন কথা বল তো? বড় আপুকে ফেলে ঐ মেয়ে আকদ সেরে ফেলল? ”

অন্য সময় হলে অহি হাসত।তাদের আস্ত বিনোদন হৃদি আপুকে উপভোগ করত। কিন্তু আজ হলো না। জানালার বাইরে তাকিয়ে বলল,

“ হৈমির বিয়েটা হয়ে গেল হৃদি আপু? ”

“ শুনলাম তো হয়ে গেল, কিন্তু আমাদের খাওয়া হলো না রে অহি। পেটের ভেতর ইঁদুর দৌড়াচ্ছে।বিকালের মধ্যে বাসায় পৌঁছাতে হবে আবার আমাদের। ”

হৃদি এত গুরুত্বপূর্ণ কথা বলল অথচ পাত্তা দিল না অহি।হৃদি এই নিয়ে বিরক্ত চোখে তাকাতেই তার কোন একটা কথা মনে পড়ল যেন। দ্রুতই বলল,

“আমাদের তো হৈমির আকদে এসে হৈমির দেবর ভাসুর কাউকে পটানোর কথা ছিল রে অহি। স্নিগ্ধ ভাই এর পিছু ঘুরে লাভের লাভ কিছুই হচ্ছে না। বেচারা আমাকে পাত্তা দিচ্ছে না। আমার উচিত এখন একটা ছেলে পটিয়ে ঐ ব্যাটার নাকের সামনে দিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখানো। বোঝানো যে, দেখ বেয়াদব, আমার ও বয়ফ্রেন্ড আছে। ”

অহি একটু হাসল এবারে। বলল,

“ হৈমির হাজব্যান্ডের টুইন ব্রাদার তো বিবাহিত।পাটবেই বা কাকে? ”

হৃদি ভ্রু কুঁচকেই বলল,

“ টুইন ব্রাদার? তোদের সবার কি টুইন ব্রাদারদেরই পছন্দ হয় নাকি? বুঝলাম না। কিন্তু তুই কি করে জানলি যে হৈমির হাজব্যান্ডের টুইন ব্রাদার আছে। ”

অহি শীতল ভঙ্গিতে তাকাল। আজ তার বান্ধবী হৈমির আকদ অনুষ্ঠান ছিল। তারই প্রিয় বান্ধবীর আকদ অনুষ্ঠান। অথচ এসেই যে এমন একটা চমক পাবে কে জানত? সাদিদ এহসান, ওরফে তার সাদ ভাইয়াকে সে আজ কতবছর পর দেখেছে! কতগুলো বছর অপেক্ষা করেছে এই রগছটা সাদিদ এহসানের জন্য। অথচ তার সাদ ভাইয়া হয়তো তাকে মনেই রাখেনি৷ সেই কবে কোন ছোটকালে শেষ দেখা। এত বছর মনে রাখার কথাও না। অহির কষ্ট হয়। যে পুরুষটিকে সে এত বছর নিরবে ভালোবেসেছে, অপেক্ষা করেছে সাক্ষাৎ হওয়ার জন্য সে পুরুষটির সাথে এভাবে সাক্ষাৎ হবে সে স্বপ্নেও ভাবেনি। এখন তো কিছুই করার নেই। হয়তো এখন অনুভূতি প্রকাশ করেও কিচ্ছু হবে না। সাদ ভাইয়া বিয়েতে রাজি না হয়ে তো এমনি এমনি বিয়ে করতে আসেনি। আর অহিকেও এত বছর পর মনে আছে কিনা সন্দেহ! অহি তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসল। হৃদির দিকে চেয়ে বলল,

“ আকদ অনুষ্ঠান শেষ না আপু? ”

“ হ্যাঁ, শেষই তো। এতক্ষন যাবৎ কি আর আকদ আটকে থাকবে তোর আমার জন্য?আমরা কি ভি আইপি পার্সন? কিন্তু হৈমিটার এই অকাল মৃত্যুতে আমি শোকাহত! বেচারীকে আমরা চেয়েও ওর মৃত্যুদন্ড থেকে বাঁচাতে পারলাম না রে অহি… ”

হৃদি হাসলেও এবারে অহি হাসে না। শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল,

“ তুমি জানো হৈমির বর কে? ”

“ কে? ”

অহির স্বর আটকে আসে যেন। কন্ঠ বসে আসে। আবারও কান্না পাচ্ছে তার। তবুও বলল,

“ সাদিদ এহসান। সাদ ভাইয়া হৈমির বর হৃদি আপু। ”

হৃদি দুয়েক সেকেন্ড চুপই থাকে। বিশ্বাস করতে পারে না। শুধায়,

“ হু? সাদিদ এহসান? ”

“ হ্যাঁ! ”

হৃদি এবারে শান্ত চাহনিতেই তাকায়। কখনো সে শান্ত বুঝদার, আবার কখনো চঞ্চল! অহির দিকে চেয়ে ওর টলমলে আঁখি বুঝে উঠেই হৃদি ঠোঁট চেপে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অহির দিকে চেয়ে দ্রুত বলল,

“কাঁদবি না, আবার শ্বাসকষ্ট…”

অহি কাঁদে না। কান্না আটকায় ঠোঁট কাঁমড়ে। তারপর বলে,

“ আমারই ভুল। আমি যদি ছোটবেলায় সাদ ভাইয়ার কথামতো কেবল তার সাথেই মিশতাম, তার সাথেই থাকতাম তাহলে সাদ ভাইয়া দূরে যেতেন না৷ অতো দূরে কখনোই যেতেন না বলো? তবুও যখন চলেই গেলেন তখন মাঝপথে এসে আমি কেন সাদ ভাইয়ার প্রতি আকৃষ্ট হলাম হৃদি আপু? কেন কিশোরী বয়সে তার ছোটকালের পাগলামো গুলো মায়ের থেকে শুনে শুনে মানুষটাকে নিয়ে ভাবতে বসলাম? কেন এত বেশি ভাবলাম আমি তাকে কল্পনায় রেখে?যেখানে নিশ্চায়তা ছিল না, এক আকাশ দূরত্ব, পরিচয় ছিল না তারপরও কেন আমি তার প্রতি আকৃষ্ট হলাম? আমি তার আশা ধরে বাঁচলাম কেন হৃদি আপু? কেন কিশোরী বয়সের পর আমি তার জন্য এতোটা পাগল হলাম? আমারই ভুল,আমারই! আমি তো জানতাম এটা অনিশ্চিত। কিছুই হওয়ার ছিল না যেখানে সেখানে সে বিয়ে করলেও আমার কি? আমি কেন মানতে পারছি না? আমার কেন কষ্ট হচ্ছে হৃদি আপু? ”

এত কেনর উত্তর হৃদির কাছে নেই। সত্যিই নেই। তবে অহির মাথায় হাত বুলিয়ে সে আদুরে ভঙ্গিতে বলল,

“কাঁদে না বাচ্চা, তোরটা তো একপাক্ষিক অনুভূতি ছিল বুড়ি। সে জানেই না। হয়তো ও দেশে গিয়ে এতবছরে ছোট্ট অহিবুড়িকে ভুলেই গিয়েছে সে। এটা স্বাভাবিক। ছোটকালের কথা নিয়ে কি কেউ পড়ে থাকে বল? আর তার ছোটকালের জ্বেলাসন্যাস যে বড় হয়ে তোর প্রতি কোন অনুভূতিতে পরিণত হবে এমনটাও বলা নেই। ছোটবেলায় তো সব বাচ্চারাই জেদী থাকে। জেদ দেখায় অল্পতেই। সেও হয়তো তেমন জেদী ছিল। তাছাড়া তুইও কিন্তু ছোটকাল নিয়ে পড়ে ছিলি না অহি।তোর সাদ ভাইয়া, আদ ভাইয়াকে মনে রাখলেও তাদের নিয়েই তো তোর সর্বক্ষন চলে নি। হয়তো কিশোরী বয়সের পর তুই তাকে গুরুত্ব দিয়েছিস একটু বেশিই! তার গল্প শুনে তাকে ভাবতে ভাবতেই অনুভূতিটা তৈরি করে ফেলেছিস। একটু বেশিই অনুভূতিপ্রবণ হয়েছিস তার প্রতি। তোর মনে হয়েছে ছোটকালের সেই নিষেধ, সেই রাগ, সেই জেদ, সেই অধিকার বোধ সে আবার ও প্রয়োগ করবে কখনো। তারপর ভার্চুয়ালি তাকে ফলো করা, ফেইক আইডি দিয়ে কথা বলে ব্লক খাওয়া এসবের পর আরো বেশি বাড়ল তোর অনুভূতি। অথচ ওদিক থেকে অনুভূতি তো ছিলই না। সে তোকে চেনেও না এখনো। আদৌ ছোট্ট অহিকেও মনে রেখেছে কিনা কে জানি! আমরা তো জানতাম তা অহি,তাই না? ”

অহি মাথা নেড়ে বলে,

“ হ্যাঁ, জানতাম।অনুভূতিটা একতরফা জানতাম তা হৃদি আপু। তাও মানতে পারছি না।একটু সময় লাগবে হয়তো, মানিয়ে নিব। কিন্তু হৈমিকে কিছু বলো না আপু।এই মানুষটাই যে সে সাদিদ এহসান বলো না। ”

হৃদি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

“ হৈমির সাথে আকদটা আটকানো গেলে তাও ভাবা যেত!এখন ভুলে যা। স্রেফ ভুলে যা তাকে অহি। ভেবে নে সে কোন সেলিব্রিটি ক্রাশ তোর, যাদের অহরহ অন্যের হতে দেখি আমরা। তাই না? ”

হৃদি আপু যতোটা সহজে বলল ভুলে যেতে ততোটা সহজে হয়তো অহি ভুলতে পারবে না।কিংবা, সাদিদ এহসান তার সেলিব্রিটি ক্রাশ ও নয়। সাদিদ এহসান তার কোন ক্রাশই নয়। একটা পাগলামো, কিশোরী বয়সে হঠাৎ উড়ে আসা ভালো লাগা, উড়ে আসা প্রেম, উড়ে আসা অনুভূতি!এত বছর যাবৎ যা অহি হৃদয়ে আগলে এসেছে,আড়াল হতে অনুভূতি পুষেছে সে অনুভূতি ভোলা এতই সহজ? অহি এসব ভেবেই ছোটশ্বাস ফেলে। তখনই কানে এল হাস্যোজ্জ্বল পুরুষালি স্বর,

“ এই যে ভাবীর বান্ধবী,আমাদের সাথে মিট করার আগেই এভাবে সেন্সলেস হয়ে গেলেন?”

অহি তাকায় দরজায়। কয়েকটা ছেলেপেলে।তাদের মধ্য থেকেই কেউ বলেছে। তবে তার নজর যাতে আটকাল তা হলো দরজার বাইরে থেকে ভ্রু কুঁচকে থমথমে মুখ নিয়ে তাকানো সাদিদের দিকে। দেখেই মনে হচ্ছে সে চরম বিরক্ত! অহির বুকের ভেতর কেমন যেন করে। একটু আগেকার টলমলে আবেগ আরো ভারী হয়ে উঠে যেন।

চলবে……