#অসময় (১)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
বিয়ের তিন মাসের মাথায় স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া বেঁধে গেল। দিন দিন সেই ঝগড়া বেড়েই চলেছে। নতুন বিয়ে হয়েছে, এই সময়ে দাঁড়িয়ে বউ হিসাবে আমি তার থেকে একটু সময় চাইতে পারি না? এই সময়টাই তার থেকে পাই না। তার সব ঠিক। সব চলে। শুধু আমাকে সময় দেবার বেলায় সময়টা সে খুঁজে পায় না।
সকালে অফিসে চলে যায়, অফিস থেকে সন্ধ্যা বাড়ি ফিরে দশ মিনিটের মাথায় জামা-কাপড় বদলে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে চলে যায়। সেখান থেকে রাত দুইটা তিনটায় বাড়ি ফেরে। অতঃপর এসে ফোন চাপে। আর যখন নিজের চাহিদা পূরণ করা প্রয়োজন বলে মনে হয় তখন কাছে আসে। এভাবেই চলছে জীবন। এই জীবন আদৌ কোন মেয়ে চায়? অন্যরা চাইলেও আমি চাই না। এসব নিয়ে কথা বললেই ঝগড়া বেঁধে যায়। সে প্রচন্ড রেগে যায়।
সবসময় শুনে এসেছি বিয়ের প্রথম দুই তিন বছর স্বামীর সোহাগে, তার সঙ্গ পেয়ে খুব দ্রুত কেটে যায়। এই সময়টা কিভাবে কেটে গেল তার টের পাওয়া যায় না। সেখানে আমার বিয়ের এক মাসের পর থেকেই তার জীবনের এই একই রুটিন চলে যাচ্ছে। এই বিষয়টা নিয়ে প্রথম যেদিন পলাশের সঙ্গে কথা বলতে গেলাম। আমি মনমরা গলায় বললাম,“তুমি এত রাত করে বাড়ি ফেরো কেন?”
“স্যরি।
আমি একটু তাড়াতাড়িই ফিরতে চাই। কিন্তু ওরা এমনভাবে ধরে যে গল্প করতে করতে এতটা সময় কেটে যায়।তাই দেরি হয়ে যায়।”
পলাশের মুখে সেদিনই প্রথম স্যরি শুনছিলাম। আর সেটা শোনা যায়নি। আমি সেদিন অনেক আবেগ নিয়ে বলেছিলাম,“আমার এসব ভালো লাগে না পলাশ। তোমার সঙ্গে আমারও তো গল্প করতে ইচ্ছা করে। তুমি এমনভাবে যদি সব সময়টা বন্ধুদের দাও তাহলে আমার কি হবে? আমার সারাটা সময় খুব খারাপ যায় পলাশ। তুমি বাহিরে গেলে আমাকে একদম ভুলে যাও। আমার ফোনটা অব্দি ধরো না। এমন কেন করো?”
পলাশ আমার মুখে এসব কথা শুনে বিরক্ত হয়। সে ফোন টিপতে বসে যায়। আমি এটা দেখে তার গলা জড়িয়ে ধরে বলি,“কী হয়েছে তোমার?
আমার কোন আচরণে কষ্ট পেয়েছো?”
“না। কিন্তু তুমি একটু বেশি ভাবছো। আমি তোমাকে সময় দিচ্ছি তো। আমি কি বাড়ি না ফিরে অন্য কোথাও থাকছি?”
পলাশের মুখে এই কথা শুনে সেদিন নরম গলায় খুব বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম। তাকে বুঝিয়ে বলেছিলাম, সে আমাকে যে সময়টা দিচ্ছে সেটা আমার কাছে যথার্থ নয়। এমন জীবন আমি চাইনি। সে সেদিন কথা দিয়েছিলো, পরেরবার তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবে। কিন্তু কথা আর রাখেনি।
পরবর্তী দিন আবারও দেরি করে বাসায় ফেরে। সেদিন অভিমান করে কথা বলিনি।আমি তার উপর অভিমান করে আছি সেটা সে বুঝতেই পারেনি। সে উল্টো খুশি হয়ে বলে,“তুমি আজ ভদ্র মেয়ে হয়ে গেল যে বড়? কথা কম বলছো।”
এটা শুনে আমি রাগে বিছানায় বসে পড়লাম। এভাবে কয়েকদিন তার উপর অভিমান করে চুপ থাকলাম। কিন্তু সে সেটা বুঝলোই না। অতঃপর রাগ দেখিয়ে বললাম,“রোজ রোজ একটা ঢঙ শুরু করছো? যদি সমস্ত সময়টা বাহিরেই কাটাবে তাহলে বিয়ে কেন করছো?”
“ফালতু বকো না তো।
সবসময় বাহিরে কাটালে এখানে কে রয়েছে?”
এটা বলে পলাশ আমার কাছাকাছি আসার চেষ্টা করে। আমি তাকে দূরে সরিয়ে দেই। কিছুটা রাগ দেখিয়ে বলি,“শুধু এই সময়ে বউকে প্রয়োজন। বাকি সময় বউকে চেনো না তাই না?”
“তোমার সমস্যাটা কি?
রোজ রোজ কি এক ঘ্যানঘ্যান শুরু করছো। তুমি এমনভাবে কথা বলছো যেন আমাকে বিয়ে করে তুমি খুব অসুখী আছো।”
“তো আমি সুখী আছি বুঝি?”
আমার এই কথা শুনে পলাশ কিছুটা অবাক হয়ে বলে,“তো? তুমি কোথা দিয়ে অসুখী আছো? তোমার হাতে টাকা পয়সা সব দেই। ঘরে ভালো বাজার সদাই করি। সময় করে তোমার সঙ্গে মিলিত হই। এখানে তোমার অসুখী থাকার কারণটাই তো বুঝলাম না? সবই তো পাচ্ছো। আর কী চাই?”
“পলাশ তুমি সত্যি কি বুঝতে পারো না?
একজন স্ত্রীকে ভালো খাবার, ভালো হাত খরচ দিলেই বুঝি সব হয়ে যায়। তার আর কোন চাওয়া পাওয়া নাই? তার নিজের স্বামীর সঙ্গে গল্প করতে মন চাইতে পারে না? সে তার স্বামীর থেকে কিছুটা সময় নিজের জন্য চাইতে পারে না?”
আমার কথা শুনে পলাশ হতবাক চোখে আমার দিকে তাকায়। সে কিছুটা রেগেই বলে,“শুধু সময়, সময় আর সময়। তোমাকে সময় দেই না। বাড়ি না ফিরে অন্যের বাড়ি থাকি? রাতে তোমার সঙ্গে না থেকে বুঝি আলাদা ঘরে থাকি? এসব সময় নয়?”
“পর্যাপ্ত সময় নয়।”
আমার এই কথা শুনে পলাশ গুরুত্ব না দিয়ে বলে,“ধুর। যাও তো।
বাড়িতে আসি শান্তির জন্য। সারাদিন তোমার ঘ্যানঘ্যান শোনার জন্য নয়।”
এটা বলে পলাশ অন্য ঘরে গিয়ে ফোন চালাতে শুরু করে। আমি তার কান্ড দেখে হতাশ হয়ে পড়ি। তার কাছে বিয়ে মানে শুধুমাত্র একসঙ্গে সময়মতো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলা। আর স্ত্রীর খাওয়া পড়া দেওয়া। এছাড়া কিছুই নয়। তার আমার সঙ্গে গল্প করতে মন চায় না। আমার সঙ্গে ছুটির দিনে একবার ঘুরতে যেতে মন চায় না। তার এসব কোন আগ্রহ নেই। তার সব আগ্রহ, ঘোরাফেরা, গল্প করা সব বন্ধুদের সঙ্গে। তার জীবনে তার বন্ধুরা যতটা না গুরুত্বপূর্ণ তার এক বিন্দু গুরুত্ব আমার নেই। এসব বুঝতে পেরে আমি প্রচুর হতাশ হয়ে যাই।
___
এভাবেই এক কথায় দুই কথায় দিনের পর দিন ঝগড়া হতে শুরু করে। এসব কথা আমি আমার এক বান্ধবীকে শেয়ার করলে সে বলে,“তোদের তো পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়েছে। একজন অন্যজনকে সেভাবে চিনিস না, তাই মন বুঝতে পারছিস না। তুই একটু তার সঙ্গে নিজ থেকে গল্প করা শুরু কর, সেধে সেধে রোমান্টিক হওয়ার চেষ্টা কর, তার সঙ্গে তোর ছোটবেলার গল্প কর। দেখবি সেও সাড়া দিবে। এরপর তোরা একে-অপরকে বুঝতে পারলে সবটা ঠিক হয়ে যাবে।”
“তার সঙ্গে যে এই সখ্যতা গড়ে তুলবো সে তো সেই সময়টাই দিচ্ছে না। আমাকে সেই সময়টা দিলে না আমি তার সঙ্গে সেধে সেধে গল্প করতাম।”
“এই সময়টা তার থেকে বের করে নিয়ে আসতে হবে। তোকে এটাই করতে হবে। দেখ একটানা কয়েক সপ্তাহ তুই একইভাবে তার সামনে সেজেগুজে ঘোরাঘুরি কর, গল্প কর, তাকে স্পেশাল ফিল করা। তারপর হঠাৎ করে এসব করা বন্ধ করে দে। দেখবি পরবর্তী দিন সে তোর এসব কান্ড মিস করবে। তারপর সে নিজে থেকেই সব শুরু করবে।”
আমার বান্ধবী এভাবেই আমাকে কিছু পরামর্শ দেয়। আমি সেই অনুযায়ী কাজ করা শুরু করি। সেদিন রাতে পলাশ বাড়ি ফিরে আমাকে শাড়ী পড়া অবস্থায় দেখে কিছুটা হকচকিয়ে যায়। পরক্ষণে নিজেকে সামলে বলে,“শাড়ী পড়লে যে?”
“ইচ্ছে হলো।”
এটা বলে আমি হাসি মুখে তার দিকে তাকালাম। পলাশ এক পলক আমার দিকে তাকিয়ে ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লো। সে ফোনটা বের করলো। আমি তার পাশে বসে নিজ থেকেই গল্প শুরু করলাম। সে সব কথায় শুধু ‘হুম’ ‘হুম’ করছিলো। তার অনবরত হুম হুম করায় বিরক্ত হয়ে এক পর্যায়ে আমি বললাম,“তোমার বন্ধুরা তোমার সঙ্গে কিসের গল্প করে? নিশ্চয় অন্য মেয়েদের নিয়ে গসিপ করে? সেসব খুব মজা লাগে। তখন কথা বের হয়। আমার সময় শুধু হুম হুম।”
“কী সমস্যা?
ফালতু বকছো কেন?”
পলাশও বিরক্তি নিয়ে বলে। আমি জবাবে বলি,“হ্যাঁ আমার কথা তো ফালতুই লাগবে। ভালো কথা তো বন্ধুরা বলে। তাদের সঙ্গে তাই রাত দুইটা অব্দি আড্ডা দিতে কষ্ট হয় না। আমার সঙ্গে কথা বলতে কষ্ট হয়। ঘরের বউ তো তাই ভালো লাগে না। বন্ধুরা তো পরের মেয়ে নিয়ে বলে।”
“চুপ। বেয়াদবের মতো আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলছো? একদম চুপ। থাবড়ে গাল লাল করে দিবো। যখনই সুযোগ পাও শুধু বাজে বকা।”
পলাশের কথা শুনে আমিও রেগে গেলাম। যার ফলে আমাদের মাঝে আবারও ঝগড়া বেঁধে গেল। এবার ঝগড়ায় পলাশ বিরক্ত হয়ে পাশের ঘরেই চলে গেল। আমি এই ঘরে বসে কান্নায় ভেঙে পড়লাম। বিয়ের আগে কত স্বপ্ন দেখেছিলাম। স্বামীর সঙ্গে কত কি করবো। অথচ কিছুই পূরণ হচ্ছে না। শুধু ঝগড়া ছাড়া। সারাদিন এই ঘরে একা ফেলে রেখে যায় আমাকে আর একটা খোঁজ নেয় না। এমন জীবন তো চাইনি। ঠিক এটা ভেবেই আমার কান্না পাচ্ছে। আমি এভাবে সারাটা রাত কান্না করেই কাটিয়ে দিলাম। আর সে পাশের ঘরে ঘুমিয়ে। হয়তো আমার কান্নার শব্দ তার কানে যাচ্ছে না। গেলেও সে শুনেও শুনছে না। যে উদাসীন মানুষ।
★
গতকাল রাতের মন খারাপ দূর হতে না হতে পলাশের কথা শুনে আজ আরও বেশি খারাপ লাগলো। তার কথা শুনে আমি পুরো হতবাক হয়ে গেলাম। মনেমনে গতকালের জন্য নিজেকে দোষারোপ করেছিলাম। নিজেকে বুঝিয়ে ছিলাম, এভাবে অল্পে রাগ করা যাবে না। আমাকে আরও ধৈর্য নিয়ে সবটা সামলাতে হবে। কিন্তু আজকেই সেটা আর পারলাম না। ধৈর্য ধরে রাখতে পারলাম না।
’
’
চলবে,