সারা জাহান পর্ব-২৭+২৮+২৯

0
19

#সারা_জাহান
পর্ব,,,২৭
মৌমো তিতলী
❤️❤️❤️❤️❤️

সন্ধ্যার দিকে তৈমুরের গাড়ি এসে থামে শিকদার হাউসের সামনের রোডে। গাড়ি বাড়ির বাইরে রেখেই একটা প্যাকেট হাতে নেমে আসে তৈমুর। সদর দরজায় কলিং বেল বাজাতেই তা খুলে দেন রিনা শিকদার। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসেন। মায়ের মুখের হাসিতে তৈমুরের অর্ধেক ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো যেন। হাসিমুখে মায়ের হাতে প্যাকেট টা ধরিয়ে দিয়ে বলে,,,

:-ফুসকা আছে! তোমার আদরের বোনের মেয়ে খেতে চেয়েছিলো। সবার জন্য আছে।
বলেই ওপরে চলে যেতে নিয়ে আবার থামে। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,,,

:-সায়ান বাইরে গাড়িতে বসে আছে। তুলিকে নিয়ে একটু বেরোতে চায়।

রিনা শিকদার বিচলিত হয়ে বললেন,,

:-সেকি! বাইরে কেন আব্বা? ভেতরে আসতে বললে না কেন?

:-বলেছিলাম। এখন আসবে না বললো। এখন বসলে ফিরতে লেইট হয়ে যাবে। বলেই দ্রুত ওপরে চলে গেল।

রিনা শিকদার মুচকি হেসে কিচেনে চলে যায়। ফুচকা গুলো প্লেটে সাজাতে সাজাতে ভাবেন “সারার সাথে তৈমুরের সম্পর্ক ভালোর দিকে যাচ্ছে। ছেলেটা মেয়েটাকে মানতে শুরু করেছে।এবার সবটা ঠিক হবে নিশ্চয়”
মনে মনে আল্লাহর দরবারে আর্জি জানান। তার একমাত্র ছেলের জীবন হাসিখুশিতে ভরে উঠুক।

তৈমুর ওপরে উঠতে সিঁড়িতেই দেখা মিললো তুলির। রেডি হয়ে নিচে নামছিলো তুলি। ভাইকে দেখে থেমে যায়। তৈমুরও বোনকে দেখে বলে,,

:-সায়ান বাইরে আছে। সাবধানে যাস।

তুলি মাথা নেড়ে সায় দেয়। বিয়ের আগে সবার সামনে এভাবে সায়ানের সাথে বের হতে বেশ লজ্জা লাগছে তুলির। প্রথমে যেতে না করেছিলো সে। কিন্তু নির্লজ্জ পুরুষ টা মানলে তো! জেদ ধরে বসে থাকলো,তার সাথে যেতেই হবে।

তৈমুর ওপরে গিয়ে নিজের রুমে না গিয়ে আগে সারার রুমে ঢুকে। সারাকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে দেখতে পায়। দরজা বন্ধ করতেই সারা চমকে উঠে তাকায়‌। তৈমুর কে দেখে হকচকিয়ে ওঠে। নিজের দিকে তাকিয়ে অপ্রস্তুত হয় সারা। ওড়না টা পড়ে আছে বিছানায়। দ্রুত সেদিকে যেতে নিলে বাঁধ সাধে তৈমুর। হাত ধরে টেনে পরম আবেশে জড়িয়ে ধরে বক্ষ পিঞ্জরে।
এভাবেই তৈমুরের সাথে লেপ্টে দাঁড়িয়ে থাকতে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে যায় সারা। তার মনের অস্থিরতা টের পায় তৈমুর। সারাকে আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে হাস্কি স্বরে বলে,,,

:-এতো নড়ছিস কেনো? চুপটি করে দাঁড়া না একটু। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। একটুখানি সুকুন নিতে দে! You know that my peace lies within you!!

তৈমুরের কথায় মুখটা রক্তিম হয়ে ওঠে সারার। এভাবে কেনো বলে এই মানুষটা। সে কি বোঝে না এসব কথায় সারার জান যায় যায় অবস্থা হয়। কোনমতে মিনমিন করে বলে ওঠে সারা,,,

:-আপনি সবসময় এমন করেন কেনো? রুমে নক করে আসেন না! আমার গায়ে ওড়….

:-শশশশ! তোকে সবরকম ভাবে দেখার অধিকার আমার আছে। So don’t talk too much and just stand there quietly….!

সারা আলতো করে তৈমুরের পিঠে হাত রাখে। আলতো স্বরে বলে,,

:-আপনার এই বেপরোয়া কাজের জন্য কোনদিন বিপদে পড়তে হবে! কেউ দেখে ফেললে কি হবে ভাবতে পারছেন? সবাই আমাকে ভুল বুঝবে!

:-সবাই তোকে কেন ভুল বুঝবে? এখানে কি তুই একা আছিস?

:-না, কিন্তু সবাই মেয়েদেরকেই ভুল বোঝে। আমি তো এই বাড়িতে আশ্রিত! সবাই ভাববে আমি এই বাড়ির ছেলেকে….

সারার কথা শেষ না হতেই ধমকে ওঠে তৈমুর।

:-just shut up Shara! 😡 মুখে যা আসছে তাই বলে যাচ্ছিস। কিছু বলি না দেখে সাহস বেড়ে গেছে না? এই বাড়ির কেউ তোকে ভুল বুঝবে না। এমনকি আমার সাথে চিপকে থাকতে দেখলেও ভুল বুঝবে না। যদি কেউ দেখে সেটা আমি সামলে নেবো। তোকে এত ভাবতে হবে না। Got it!!

তৈমুরের কথাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সারা। কি বলছে লোকটা? একটা প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকা দেখলে কেউ ভুল বুঝবে না?

সারাকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো তৈমুর। মেয়েটা উচ্চতায় তার থেকে একটু বেশিই ছোট। বুক বরাবর হবে হয়তো। সারা কে কাছে পেতে সব সময় তৈমুরকেই ঝুকতে হয়। তাছাড়া তৈমুরের বিশাল দেহের তুলনায় সারা পিপীলিকা সম যেন। এরপর সময় এলে এতোটুকু মেয়েটা তাকে সামলাবে কি করে তা ভেবেও হাসি পায় তৈমুরের। কিন্তু তার তো এই মেয়েটাকেই চাই। তার সমস্ত অনুভূতি,সমস্ত পাগলামি, সমস্ত আকাঙ্ক্ষা- উন্মাদনা এই মেয়েটাকে সামলাতে হবে। আর তা হতেই হবে।

তৈমুরকে অপলক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বুকে হাত রেখে ডাকে সারা,,,

:-কি ভাবছেন জাহান ভাইয়া?

সারার ডাকে সম্বিত ফিরে পায় তৈমুর

:-উমমম! নাথিং। নিচে যা। ফুচকা এনেছিলাম। মা হয়তো এতক্ষণে রেডি করেও ফেলেছে। রেশমিকে ডেকে নিয়ে যাস। বলেই সারার কপালে চুমু এঁকে দিয়ে দ্রুত রুম ত্যাগ করে তৈমুর। এই মুহূর্তে শাওয়ার নেয়া জরুরি।

ফুচকার কথা শুনেই খুশি হয়ে যায় সারা। চুলে হাত খোপা করতে করতেই নাচতে নাচতে রেশমিকে ডাকতে বেরিয়ে আসে রুম থেকে।

*********

মাঝ রাস্তা দিয়ে সাই সাই করে এগিয়ে চলছে ব্ল্যাক কালারের মার্সিডিজটা। দক্ষ হাতে ড্রাইভ করছে সায়ান। পাশেই তুলি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। বাতাসের ঝাপটায় চুল এলোমেলো হচ্ছে। তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই মেয়েটার। সে চোখ বন্ধ করে বাতাসের ঝাপটা উপভোগ করতে ব্যস্ত !
একটা নির্জন রাস্তায় হুট করে গাড়ি থামায় সায়ান। গাড়ি থেমে যেতেই সায়ানের দিকে তাকায় তুলি।

:-কি হলো গাড়ি থামালে কেন?

:-কি আর করবো। আমি শুধু ড্রাইভ করেই চলেছি। এ ছাড়া আমার দিকে তো কারো কোন মনোযোগই নেই!

সায়ানের কথায় মুচকি হাসে তুলি! বলে,,,

:-আচ্ছা দিলাম মনোযোগ! বলুন এবার কি করতে হবে?

সায়ান ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে থাকে তুলির হাসিমাখা মুখের দিকে। হুট করে তুলির হাত ধরে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসে। আচমকা টানে খেই হারিয়ে তুলিও সায়ানের দিকে হেলে যায়! সায়ান দুহাতে তুলির কোমর জড়িয়ে ধরে উঁচু করে দুপাশে পা দিয়ে নিজের কোলের উপর বসিয়ে দেয়। সায়ানের কাজে হতভম্ব তুলি। মুহুর্তেই লজ্জায় কান দিয়ে ধোঁয়া বের হয় যেনো! তুলি ছটফট করে উঠতে নিলে দুহাতে তুলির কোমর আঁকড়ে ধরে সায়ান। তুলি লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে বলে,,

:-What are you doing Shyan!! ছাড়ো আমাকে!

সায়ান ঢোক গিলে এলোমেলো চোখে তাকায় তুলির দিকে। বুকটা ধড়ফড় করছে সায়ানের। আড়ষ্ট হয়ে জড়ানো গলায় বলে,,

:-I wanna kiss you!

:-what!!!

:- please 🥺

:-no!

:- please একটা। শুধুই চুমু।

:-সায়ান আমাদের এখনো পর্যন্ত বিয়ে হয়নি। এটা ঠিক না।

:-I am your fiancé.! একটা চুমু খেলে নিশ্চয়ই মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না!

:-তাতে কি! বিয়ে তো হয়ে যায়নি।

:-Don’t you love me?

:-ভালোবাসলেই কি? আগে বিয়েটা হোক।

:-আমাকে বিশ্বাস করো না তাইতো?

:-বিষয়টা এখানে বিশ্বাস অবিশ্বাসের নয়।

:-ওকে ফাইন! You can go…!Don’t worry, I won’t touch you again without your permission.!!

বলেই তুলিকে উঠে যেতে দিলো সায়ান। সায়ান তুলিকে ছেড়ে দিতেই সায়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে একটু খারাপ লাগে তুলির। ছেলেটা নিশ্চয়ই কষ্ট পেয়েছে। সে কি একটু বাড়াবাড়ি করে ফেললো? তারা দুজন দুজনকে ভালোবাসে। এমনকি তারা এনগেইজ্ড। সেদিক থেকে সায়ানের চাওয়াটা খুব একটা অন্যায় নয়। ভালবাসলে তার প্রতি আলাদা টান থাকবে, চাহিদা থাকবে স্বাভাবিক। তুলি নিজেও তো সায়ানকে ভালোবাসে। তবুও সে কেন যেন ফ্রি হতে পারছে না।

তুলি উঠে নিজের জায়গায় বসে। কিছুক্ষণ পর পর সায়ানের দিকে তাকায়। সায়ান নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ড্রাইভ করছে। তার দিকে তাকাচ্ছে না। সারাক্ষণ কথা বলা, ফ্লার্ট করতে থাকা ছেলেটা হুট করে চুপ হয়ে গেলে বিষয়টা কেমন বিষাক্ত লাগে। তাও যদি হয় এমন একটা সিচুয়েশনে। কেনো যেনো নিজের কাজে বেশ অপরাধবোধ হয় তুলির।
হবু স্বামী সে‌। ভালোবাসে তাকে। শুধু তো একটা চুমুই খেতে চেয়েছিলো। সে কিনা এভাবে মুখের ওপর না করে দিলো! তার কাজেই হয়তো ছেলেটা বেশি কষ্ট পেয়েছে। সায়ান হয়তো এখন ভাববে তার প্রতি তুলির ভরসা নেই, ভালোবাসা নেই।
মাথা নিচু করে বসে থাকে তুলি। চোখ থেকে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে।

*********

বিকেলের দিকে ভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরে তালহা। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই সাত বছর বয়সের একটা বাচ্চা ছেলে দৌড়ে এসে চাচুউউউ বলে চিৎকার করে ঝাপটে ধরে তালহা কে।
তালহাও হেসে দুহাতে আগলে ধরে ভাতিজা মহিদ কে।

মহিদ এহমাদ। তালহার বড় ভাই আলভি এহমাদের একমাত্র ছেলে। আলভি এহমাদ একজন সেনাবাহিনীর মেজর। সে বর্তমানে কুমিল্লা জেলা ক্যান্টনমেন্টে পোস্টিং আছে। সেখানেই স্ত্রী সৃষ্টি এবং একমাত্র ছেলে মহিদ কে নিয়ে কোয়ার্টারে থাকে আলভি। ছুটি পেলেই স্ত্রী -সন্তান কে নিয়ে বাড়িতে বেড়াতে চলে আসে মা এবং ভাইয়ের কাছে।
আলভি, তালহার বাবা নেই। তিনি যখন গত হয়েছেন তখন তালহার বয়স মাত্র বারো। সেই বয়সে বাবার অবর্তমানে বড় ভাই হয়েছিলো তার এবং মায়ের অভিভাবক। বয়সেও তালহার থেকে আলভী অনেকটা বড়। ভাতিজা মহিদ তার দাদি আর চাচু কে ভীষণ ভালোবাসে। মুহিদও তাদের সবার চোখের মণি, অতি আদরের।
ভাতিজাকে কোলে তুলে ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করে তালহা। ‌ ড্রয়িং রুমে আসতেই তাদের দিকে লাজুক হাসি মুখে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এক সুন্দরী যুবতীকে। মেয়েটাকে দেখেই কেমন অদ্ভুত বিরক্তিতে ছেয়ে যায় তালহার মুখটা। মেয়েটা তার বড় ভাই আলভীর শালি,তার ভাবি সৃষ্টির একমাত্র বোন সাবিকা। মেয়েটাকে যখনি দেখে তালহা তখনই দেখে মেয়েটা তার দিকে তাকে কেমন লাজুক লাজুক হাসে। এই বিষয়টা ভীষণ বিরক্তিকর লাগে তালহার কাছে।

ড্রয়িং রুমে আসতেই সাবিকা মিন মিন করে বলে,,

:-কেমন আছেন ভাইয়া?

তালহা গম্ভীর মুখে জবাব দেয়,,,

:-আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি কেমন আছো?

:-জ্বী ভালো আছি।

আর দ্বিতীয় কোনো কথা বাড়ায় না তালহা। ভাতিজাকে কোলে নিয়েই নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। তালহা যেতেই সে দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে সাবিকা। মেয়েটা সেই কিশোরী বয়স থেকেই মন হারিয়েছে এই পুরুষটাতে। সাবিকা তালহা কে প্রথম দেখেছিলো তার বোনের বিয়েতে। এবার সে ভীষণ খুশি। কারণ তার প্রণয় পুরুষটা খুব তাড়াতাড়ি তার হতে চলেছে।
সাবিকা মেয়েটা একটু অন্যরকম। একটু বেশি জেদী।বাবার মতো । আলভীর শ্বশুর অর্থাৎ সৃষ্টি,সাবিকার বাবা এরশাদ হামিদ সেনাবাহিনীর একজন উচ্চতর পদের অফিসার। সেখান থেকেই মূলত আলভিকে তিনি পছন্দ করেছিলেন নিজের বড় মেয়ে সৃষ্টির জন্য।

তালহার জানামতে তার বড় ভাইয়ের প্রেম ছিল অন্য একটা মেয়ের সাথে। মেয়েটার নাম ছিল মায়া। মেয়েটা দেখতেও ছিল মায়াবতী।
কিন্তু হুট করেই আলভী বিয়ে করে বাড়িতে এনেছিলো তারই ক্যান্টনমেন্টের এক অফিসারের মেয়ে সৃষ্টি কে। ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড মায়া নামের মেয়েটা ভীষণই ভেঙে পড়েছিলো আলভির বিয়ের কথা শুনে। কান্নাকাটি করেছিলো আলভির পা জড়িয়ে ধরে। কিন্তু সেদিন আলভী নিশ্চুপ ছিলো। যেন এসবের মধ্যে কিছুই তার হাতে নেই।
সেদিনের কথা এখনো মনে আছে তালহার। শুনেছে মায়া সেই রাতেই আত্মহত্যা করেছিলো। এই একটা বিষয়ে এখনো আলভীকে দায়ী মনে করে তালহা। তার মনে হয় আলভী নিজের স্বার্থের জন্য সৃষ্টিকে বিয়ে করেছিলো। আর তার পরিণতি হিসেবে জীবন দিতে হয়েছিল মায়া নামের মেয়েটাকে।
আলভির শ্বশুর এরশাদ হামিদ লোকটা একটু অহংকারী টাইপের। বিশেষ করে সকলের ওপরে নিজের আধিপত্য জারি করতে ভীষণ পছন্দ করেন তিনি। তার দুটো মেয়েকেই তিনি ভীষণ ভালোবাসেন। মেয়েদের কোন চাওয়া পাওয়া কখনো অপূর্ণ রাখেন নি তিনি। ঠিক যেমন আট বছর আগে বড় মেয়ের পছন্দের ছেলের সাথে তাকে বিয়ে দিয়েছিলেন ,সেভাবেই ছোট মেয়েটার পছন্দ অনুযায়ী আলভীর কাছে সাবিকার জন্য তালহার সাথে বিয়ের প্রস্তাব রেখেছেন তিনি।
আলভী এবার মূলত সাবিকার সাথে তালহার বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে কথা বলতেই বাড়িতে এসেছে।

*******
রাতে তালহার পরিবারের সবাই একসাথে খাবার টেবিলে রাতের খাবার খেতে বসেছে। তালহার মা মনোয়ারা বেগম নিজ হাতে ছেলেদের জন্য রান্না করেছেন। তিনি সযত্নে বড় ছেলের প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছেন। সৃষ্টি উঠে শাশুড়িকে সবার সাথে বসতে বলে নিজে সার্ভ করা শুরু করলো।
তালহা এসে চেয়ার টেনে বসতেই সাবিকা আড়চোখে তালহা কে দেখে ‌আবারো লাজুক হেসে মাথা নিচু করে খেতে লাগলো। তালহার এসবে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সে তার মতো প্লেট তুলে নিয়ে খেতে লাগলো।

আলভী কিছুক্ষণ দোনামোনা করে তালহার দিকে তাকিয়ে বললো,,,

:-তুই কি ফ্রী আছিস আজকাল?

তালহা ভ্রু কুঁচকে তাকালো আলভীর দিকে।

:-কেনো?
আলভী মুখের খাবার টুকু গিলে। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,,

:-তোমাদের সাথে আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিলো।
তোমাদের কি একটু সময় হবে?

বড় ভাইয়ের কথায় তালহা মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে আলভি কে উদ্দেশ্য করে বলে,,,

:-কি বিষয়ে কথা বলবে? কনফিডেন্সিয়াল না হলে এখানে বলতে পারো।

আলভী জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো। একবার সৃষ্টির দিকে তাকায়। সৃষ্টির হাত থেমে আছে তরকারির বাটিতে। আড়চোখে একবার সাবিকার দিকেও তাকায়। মাথা নিচু করে বসে আছে মেয়েটা। খাওয়া থেমে আছে তার।
আলভী পরিস্থিতি বুঝে ধীরে সুস্থে বলে,,,

:- মা তালহার বিয়ের ব্যাপারে কিছু ভেবেছো? ওর তো বিয়ের বয়স হয়েছে।

হুট করে আলভীর মুখে এমন কথা শুনে মনোয়ারা বেগম থতমত খেলেন। ছোট ছেলের দিকে তাকালেন তিনি। তালহাও বড় ভাইয়ের দিকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে।

আলভী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,,,

:-দেখ তালহা তোর এবার বিয়ে করা উচিত। আমি সৃষ্টি কে নিয়ে বাইরে থাকি‌। তোর নিজের কাজ থাকে। বেশিরভাগ সময়টাই ভার্সিটিতে থাকিস। মা একা বাড়িতে থাকে। মায়ের তো এখন বয়স হচ্ছে। তার তো একটা সঙ্গির প্রয়োজন তাই না?

তালহা ভাইয়ের কথার অর্থ বুঝতে পারে। আলভী যে ইনডাইরেক্টলি কি বলতে চাইছে তা বুঝতে বাকি থাকে না তালহার। চোয়াল শক্ত করে গম্ভীর স্বরে বলে,,,

:-মাকে নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। তাছাড়া আমি যতক্ষণ বাসায় থাকি না ততক্ষণ মায়ের সঙ্গ দেয়ার জন্য মিতালী (মনোয়ারা বেগমের পরিচারিকা)আছে। যতক্ষণ আমি বাড়িতে থাকি না ততক্ষণ মিতালী মায়ের সাথে থাকে। এটাই ওর কাজ। তাই মায়ের নিঃসঙ্গ হওয়ার প্রশ্ন আসেনা।

:-দেখ আমি তা বলিনি। কাজের মেয়ে আর বাড়ির বউ কি এক হলো? তা ছাড়া…..

:-ওয়েট! তুমি কি বলতে চাইছো? আমি কাউকে বিয়ে করবো শুধুমাত্র মায়ের সঙ্গ দিবে বলে?

:-আমি সেটা বলতে চাইনি। বাড়িতে অনন্ত একটা নিজের মানুষ হবে। মায়ের কথা বলার জন্য মায়ের দেখাশোনা করার জন্য সবকিছু কি পরিচারিকার ভরসায় ফেলে রেখে দিলে চলে?

:-ওকে ফাইন! প্রসঙ্গটা যদি মায়ের নিঃসঙ্গতার হয়, তাহলে তুমি মাকে সাথে নিয়ে যাচ্ছো না কেননা ?? তুমি মাকে সাথে নিয়ে গেলেই তো প্রবলেম সলভ হয়ে যায়। সেখানে মহিদ থাকবে। মায়ের তো নাতির সাথে হেসে খেলে দিন পার হয়ে যাবে। তোমার আর মাকে নিয়ে টেনশনও থাকবে না।

:-দেখ তুই কিন্তু…..

দুই ছেলের তর্কাতর্কি দেখে মনক্ষুন্ন হন মনোয়ারা বেগম। আলভীর কথার মাঝখানেই তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন,,,

:-উফফফ তোরা দুটো থামবি? আর হ্যাঁরে আলভী তুই হঠাৎ তালহার বিয়ের কথা জিজ্ঞাসা করছিস কেন? মেয়ে দেখছিস নাকি?

আলভী খাওয়া থামিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,,

:- আসলে মা! সৃষ্টির বাবা সাবিকার সাথে তালহার বিয়ের প্রস্তাব রেখেছেন আমার কাছে। সাবিকা এবার মাস্টার্স শেষ করেছে। শিক্ষিত মেয়ে। তাছাড়া সে তালহাকে পছন্দও করে। প্রস্তাবটা সব দিক থেকে আমার কাছে পারফেক্ট মনে হয়েছে। সেটাই তোমাদেরকে বলতে চাইছিলাম।

তালহা বড় ভাইয়ের কথাই স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। এতক্ষণে বিষয়টা বোধগম্য হয় তালহার। সরাসরি নজর যায় কর্ণারে বসে থাকা সাবিকার দিকে। মাথা নিচু করে বসে আছে। ঠোঁটে তার লাজুক হাসি। বিরক্তিতে কপাল গুটিয়ে এলো তালহার। দম ফেলে তাচ্ছিল্য হেসে বললো,,

:-আমার বিয়ের বিষয়ে কাউকে ভাবতে হবে না। সময় হলে আমি নিজেই বিয়ে করে নেবো। তাছাড়া তোমার শ্বশুর প্রস্তাব রাখতেই পারে, সেটা তোমার পারফেক্ট মনে হতেই পারে। কিন্তু জীবনটা আমার। এখানে অন্যের পারফেক্টেশন দিয়ে জীবন চালাতে চাইলে তো হবে না। তাছাড়া সেখানে আমার মত থাকাটাও জরুরী নয় কি??

তালহার কথাই সাবিকার মুখটা এতক্ষণে মলিন হয়ে গেছে। তালহা কি তাকে বিয়ে করতে রাজি না? সে তো সেই কিশোরী বয়স থেকে ভালোবাসে লোকটাকে। তালহা ছাড়া কারো কথা সে ভাবতেই পারে না। কি বলতে চাইছে তালহা? অদৃশ্য এক ভীতিতে গলা শুকিয়ে আসে সাবিকার।

আলভী তালহার দিকে তাকিয়ে বলে,,,

:-তার মানে কি বলতে চাইছিস তুই? সাবিকা তোর জন্য পারফেক্ট নয়? কোন দিক থেকে কমতি আছে ওর?সাবিকা যথেষ্ট শিক্ষিত, যথেষ্ট সুন্দরী।

তালহা নির্বিকার ভাবে বলে,,,

:-তোমার শালী শিক্ষিত, সুন্দরী হতেই পারে! কিন্তু আমি তাকে অন্য কোন নজরে দেখিনি কখনো।

:-হ্যাঁ! তাতে কি? সাবিকা তো তোকে পছন্দ করে।আর বিয়ে হয়ে গেলে এসব আর ম্যাটার করবে না! তখন এমনি সম্পর্কের প্রতি টান ভালোবাসা চলে আসবে!

ভাইয়ের কথাই আবারো তাচ্ছিল্য হাসে তালহা। ব্যঙ্গাত্মক সুরে বলে,,

:- হ্যাঁ যেমনটা তোমার এসেছে।

:-তালহাআ!!

:-একদম চিৎকার করবে না ভাইয়া। আর রইল তোমার শালিকে বিয়ে করার কথা সেটা আমি জীবনেও করবো না। কারণ আমার পছন্দের ব্যক্তিগত মানুষ আছে।

তালহার এক বাক্যে সাবিকার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। সৃষ্টি এতক্ষণ চুপচাপ দু ভাইয়ের তর্কাতর্কি শুনলেও এখন অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে বোনের দিকে। মেয়েটা যে বড্ড ভালোবাসে তালহা কে। সেটা তো জানে সৃষ্টি। কিন্তু সৃষ্টি এটাও জানে, তালহাকে যতটুকু চিনেছে সে এক কথার মানুষ। সে যখন একবার না বলেছে তাকে আর হ্যাঁ বলানোর শক্তি কারো নেই। তাছাড়া যেই ভুল সে করেছে সেই একই ভুল করে তার বোনটা সারা জীবন মাশুল দিক এটা সে চায় না।

সৃষ্টি মেয়েটা ভালো। আট বছর পূর্বে আলভিকে সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে প্রথমবার দেখেছিলো সে। প্রথম দেখায় আলভি কে ভালো লেগেছিল সৃষ্টির।
বাবা আর্মির বড় অফিসার হওয়ার সুবাদে সৃষ্টিরা কোয়ার্টারে থাকতো সেই সময়।
নতুন আর্মিদের অনেকে মাঝেমধ্যে ট্রেনিংয়ে আসতো। তার মধ্যে আলভী কে ভীষণ ভালো লাগতো তার। তার এই ভালোলাগা একদিন ভালোবাসায় পরিণত হয়। এভাবেই যখন বাড়িতে বিয়ের কথা উঠে তখন সে নির্দ্বিধায় তার বাবাকে আলভীর কথা জানাই।
এর পরবর্তী সময়ে তার বাবা আলভীর সাথে কথা বলার পর হুট করে একদিন আলভী এসে দেখা করেছিলো সৃষ্টির সাথে। জানিয়েছিল তার পছন্দের মানুষটার কথা। বলেছিলো সে তাকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করতে পারবে না। সৃষ্টির কষ্ট হয়েছিলো ভীষণ,কিন্তু সে তখন নিজেকে সামলে নেয়। আলভীকে কথা দেয় সে আর তাকে ডিস্টার্ব করবে না।
কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভেঙ্গে পড়ে মেয়েটা। বাড়িতে ফিরে সব সময় মন খারাপ করে থাকতো,খাওয়া, ঘুম ছেড়ে মলিন মুখে উদাস হয়ে বসে থাকতো। পড়াশোনায় ঠিকমতো মনোযোগ দিতে পারতো না। এরপর হুট করে একদিন বাবা এসে বললো আলভী নাকি তাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেছে। তারপর হুট করেই বিয়েটা হয়ে গেলো।
বিয়ের আগে সৃষ্টির আর আলভীকে জিজ্ঞাসা করার সুযোগ হয়নি কি কারনে আলভি হুট করে বিয়ে করতে রাজি হলো।
পরবর্তীতে আলভীর প্রাক্তন মায়ার আত্মহত্যার কথা শুনে নিজেকে কেমন অপরাধী মনে হয়েছিল সৃষ্টির। কিন্তু এখানে তারই বাকি দোষ! সে তো নিয়তি মেনেই নিয়েছিলো।
এরপর তাদের সংসার শুরু হয়। ৮ বছরের সংসারে আলভীর প্রতি কোন অভিযোগ করেনি সৃষ্টি। আলভীও সেই সুযোগ দেয়নি। আর পাঁচটা সাধারণ স্বাভাবিক দম্পতির মতোই তাদের সংসার।

:-পছন্দ আছে মানে? কে সেই মেয়ে?

আলভীর প্রশ্নে সুদূর অতীতের ভাবনা থেকে ফিরে আসে সৃষ্টি।

তালহা হাত ধুতে ধুতে বলে,,,

:-পছন্দ আছে মানে বোঝো না? আমার গার্লফ্রেন্ড আছে। আর বিয়ে আমি ওকেই করবো।

:-দেখ তালহা আমার শ্বশুর যখন মুখ ফুটে প্রস্তাব রেখেছেন। তখন এভাবে ফিরিয়ে দিলে তাকে অসম্মান করা হবে। তাছাড়া তুই কাকে পছন্দ করিস, সে তোর জন্য পারফেক্ট কিনা তাও আমরা কেউ জানিনা। কিন্তু সাবিকাকে তো আমরা ছোট থেকে চিনি। সে তোর জন্য পারফেক্ট। তাছাড়া সাবিকা তোকে ভালবাসে।

তালহা মুখ গম্ভীর রেখেই বলে,,,

:- কে আমাকে ভালবাসে এসব আমার দেখার বিষয় না। আমি অন্যদের মত নই যে নিজের স্বার্থের জন্য নিজের গার্লফ্রেন্ডকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করবো। যাকে আমি ভালোবাসি, আমি তাকেই বিয়ে করবো। পারফেক্টেশন দিয়ে আমি কাউকে বিচার করি না সে আমার জন্য পারফেক্ট কিনা সেটা আমি বুঝে নেব। এটাই আমার শেষ সিদ্ধান্ত। কিছুক্ষণ থেমে আবার বলে,,

:-তাছাড়া তোমার শ্বশুরের সম্মান রাখার দায়িত্ব তোমার, আমার নয়। এই বিষয়ে দ্বিতীয় আর কোন কথা আমি শুনতে চাই না।
বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে গটগট পায়ে উপরে চলে গেল তালহা।
তালহা চলে যেতেই সাবিকাও উঠে দৌড়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। বিছানায় পড়ে বালিশে মুখ গুজে কাঁদতে লাগলো সে। সৃষ্টি বোনের রুমের দরজায় করাঘাত করে তাকে ডাকতে থাকে। ভীষণ খারাপ লাগছে তার বোনটার জন্য।

আলভীও অসহায়। মুখে যতই বলুক কিন্তু সে তো জানে ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণা কতখানি। তালহা যে তাকে মায়ার আত্মহত্যার জন্য দায়ী ভাবে, আলভী সেটা ভালো করেই জানে। আলভী নিজেও তার জন্য অনুতপ্ত। কিন্তু তালহা কে, কে বোঝাবে কেনো সেদিন আলভী সৃষ্টিকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলো। আলভির শ্বশুর এরশাদ হামিদ প্রচন্ড স্বার্থপর আর egotistical পার্সন। তিনি নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য সবকিছু করতে পারেন।
সেই সময় আলভী সদ্য আর্মিতে জয়েন করেছে। বাবা নেই। মা আর ভাইকে নিয়েই তার পরিবার। মা আর ছোট ভাইয়ের দেখাশোনা করার দায়িত্ব বাবা তো তাকেই দিয়েছে।
আলভির স্বপ্ন ছিল আর্মিতে জব করার। সেই জবটা যখন সে পেলো সবথেকে বেশি খুশি হয়েছিল সে। চোখ জুড়ে তখন শুধু তার স্বপ্ন পূরণের আকাঙ্ক্ষা।
সেদিন মায়াকে নিয়ে অনেক ঘুরেছিলো ছেলেটা। আনন্দ করেছিলো অনেক। মায়ার অফুরন্ত খিলখিল হাসিতে মুগ্ধ হয়েছিল আবার। মায়াকে কথা দিয়েছিল তাকে বিয়ে করবে। তাদের একটা সুখের সংসার হবে।
কিন্তু কোন এক অদৃশ্য ঝড়ের ঝাপটায় সবকিছু উলট-পালট হয়ে গেলো।
আর্মি অফিসার ইনচার্জ জেনারেল এরশাদ হামিদ একদিন তাকে ডেকে পাঠালেন অফিসে। তিনি আলভী কে জানালেন তার মেয়ের পছন্দের কথা। বললেন তাকে তার মেয়েকে বিয়ে করতে হবে।
আলভি তার মেয়েকে বিয়ে করলে তার পজিশনও তিনি চেঞ্জ করে দেবেন। সে সাধারণ সৈনিক থেকে মেজর পদে ট্রান্সফার হবে। কিন্তু তখন আলভী রাজি হয়নি। সে ভালোবাসতো মায়াকে। পরবর্তীতে সেটা সৃষ্টি কে জানিয়েছিলো আলভী। সৃষ্টিও মেনে নিয়েছিলো। কিন্তু কয়েক মাস পরেই হঠাৎ একদিন আবারো তাকে ডেকে পাঠালেন এরশাদ হামিদ এবং জানালেন যদি সে সৃষ্টিকে বিয়ে না করে তাহলে তাকে এই চাকরি থেকে বরখাস্ত করে দেবেন। আর এমন কোন অপবাদে ফাঁসিয়ে দেবেন যাতে ভবিষ্যতে তার কোথাও চাকরি না হয়।
আলভী ভয় পেয়েছিলো। কারণ এই চাকরিটা হারালে তাকে তার পরিবার নিয়ে পথে বসতে হবে। মা আর ভাইয়ের পড়াশোনা, তার ভবিষ্যৎ এই সব কিছু ভেবে তখন আলভীর দিশেহারা অবস্থা। তার যদি উপায় থাকতো তাহলে সে চাকরিটা ছেড়ে দিতো। কিন্তু এরশাদ হামিদ যে ধরনের লোক, তাতে সত্যিই যদি কোথাও চাকরি করার উপায় না থাকে, তাহলে কি করবে? সবদিক থেকে ভেবে সৃষ্টিকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো আলভী।
কিন্তু এই বিয়েটার কারণেই তার জীবন থেকে ভালোবাসা হারিয়ে গেছিলো। মায়ার কান্নায় সেদিন বুকে পাথর চেপে দাঁড়িয়ে ছিলো সে। পরের দিনই মায়ার আত্মহত্যার খবর পেয়েছিলো। কেউ জানে না সেদিন আলভী কতটা অসহায় ছিলো! কেউ জানে না সেদিন ফাঁকা মাঠের মাঝে বুক উজাড় করে চিৎকার করে কেঁদেছিলো আলভী। নিজের ভালোবাসার কাছে করুন আর্তনাদে বার বার ক্ষমা চেয়েছিলো সে। নিজের দু হাত মাটিতে আছড়ে আছড়ে রক্তাক্ত করেছিলো সে।কেউ জানে না। কেউ না। সে সারাজীবন অপরাধী হয়ে রইলো তার কনিষ্ঠ সহোদরের চোখে।

চলবে,,,,

#সারা_জাহান
পর্ব,,,,২৮
মৌমো তিতলী
❤️❤️❤️❤️❤️❤️

নিজের রুমে পড়ছিলো রেশমী। আজকাল তার ভাবনায় একজনের অবাধ বিচরণ শুরু হয়েছে। পড়ায় মন দিতে পারে না রেশমী। একদিকে প্রথম প্রেমে পড়ার মিষ্টি অনুভূতি তো অন্যদিকে সমাজের ভয়। আচ্ছা সবাই যদি জানতে পারে তার আর স্যার তালহার মধ্যে প্রণয়নের সম্পর্ক আছে,সবাই কি মেনে নেবে তাদের? নাকি সমাজের তথাকথিত কুপ্রথার তলে পিষ্ট হয়ে যাবে তাদের ভালোবাসা!! আজব আজব খেয়াল আসে রেশমীর। এই কয়দিনে সে বুঝতে পেরেছে সেও স্যার তালহা এহমাদ কে ভালোবেসে ফেলেছে। ভাবনার মাঝেই ফোন বেজে ওঠে রেশমীর। ফোনটা হাতে নিতেই কলারের নামটা দেখে ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে।

কাঁপা হাতে ফোনটা রিসিভ করে চুপ করে থাকে রেশমী,,,

তালহা কিছুক্ষণ শোনে সেই নিরবতায় প্রেয়সীর শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ। তাতে কিছুক্ষণ আগে ডাইনিং টেবিলে ঘটে যাওয়া ঘটনার রাগটা হুট করেই কমে আসে। রেশমী কে চুপ থাকতে দেখে তালহা নরম গলায় বলে,,,

:-এতো চুপচাপ আছো কেন? ঘুমিয়ে পড়ো নি তো?

রেশমি নিঃশব্দে হাসে। অদ্ভুত লাগছে তার। সেদিনের পর এই প্রথম সরাসরি ফোনে কল করেছে তালহা। এই কয়দিন শুরু মেসেজের মাধ্যমে কথা হয়েছে। তাই কলে কথা বলতে একটু লজ্জা পাচ্ছে রেশমী। তালহার কথায় ভাবনা ছেড়ে বলে,,,

:-ঘুম আসছে না স্যার… মনটা অস্থির লাগছে।

রেশমীর কথায় ভ্রু কুঁচকে আসে তালহার।

:-মনটা কেন অস্থির, বলবে আমাকে? Are you okay, Roshi?

তালহার মুখে এই নামটা শুনলেই শরীরে শিহরণ বয়ে যায় রেশমীর। ইসস কতটা আবেগ ছিলো সেই ডাকে।রেশমি মিনমিন করে বলে,,

:- এমনিই! যদি তৈমুর ভাইয়া জানতে পারে, আমাদের এই সম্পর্কের কথা… জানি না, মেনে নেবেন কিনা।

তালহা চুপ থাকে কিছুক্ষণ, তার পরিবারও যে বিষয়টা কিভাবে নিবে সেটা নিয়েও কিছুটা চিন্তিত তালহা। বলে তো দিয়েছে সে তার রিলেশনের কথা। বাকিটা সে সামলে নিবে। মা কে নিয়ে তার চিন্তা নেই। আর আলভীর শালি সাবিকা কে বিয়ে করার তো প্রশ্নই আসছে না। কিছু একটা ভেবে তালহা মৃদুস্বরে বলে,,,

:-তৈমুর জাহান শিকদার তোমার ভাই। শহরের নামী মানুষদের একজন। আমি জানি ওনার মতের মূল্য কতটা। কিন্তু আমার মনে হয় উনি আমাদের বিষয়টা বুঝবেন। তুমি অহেতুক চিন্তা করো না।

রেশমি শোনে তালহার কথাটা। অস্ফুট স্বরে বলে,,,

:-আপনি তো এখন আমার কাছে শুধু স্যারের মতো নন, আমার কাছে, আপনি তো… শব্দ আটকে যায় রেশমীর গলায়। লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে এভাবে তালহার কাছে অনুভুতি ব্যাক্ত করায় লজ্জাও পায় বেশ।

তালহা নরম হাসে রেশমী অসম্পূর্ণ কথায়। বলে,,

:-আমি তো তোমার তালহা… ক্লাসের বাইরের একান্ত তুমি আর আমি। রেশমি, আমি কখনোই তোমাকে ঝুঁকিতে ফেলতে চাই না। কিন্তু প্লিজ তুমি আমাকে এটা বলো না যে তুমি কখনো আমাকে ছেড়ে যাবে। সেটা আমি মানতে নারাজ।

রেশমি আবারো বলে,,,

:-কিন্তু আমাদের সমাজটা তো সহজ নয় স্যার। আপনি শিক্ষক, আমি ছাত্রী… আপনার-আমার পরিবার যদি ভাবে আমরা ভুল পথে হাঁটছি?

তালহা দৃঢ় গলায় বলে,,,

:- আমি শুধু একটা পথ জানি—যে পথে তুমি থাকবে আমার পাশে। বাকিটা আমি সামলাবো।
আর রোশি, আমি ভালোবাসি তোমাকে। তাহলে দায়িত্বটাও আমার। ভয় পেয়ো না।

রেশমি চোখটা বন্ধ করে নেয়। বুকটা তিরতির করে কাঁপছে। এতো ভালোবাসে তালহা তাকে! রেশমী কাঁপা কণ্ঠে বলে,,,

:-কিন্তু তৈমুর ভাইয়া অনেক কড়া… তার চোখ ফাঁকি দেয়া অসম্ভব। ভাইয়া যদি জানতে পারে….

তালহা রেশমী কে থামিয়ে দিয়ে বলে,,,

:-আমি তাকে শ্রদ্ধা করি। একদিন তার চোখে আমিও “রেশমির জন্য সঠিক মানুষ” হতে চাই। কিন্তু… তোমার হাতটা আমি ছাড়ব না, যতই কঠিন হোক। তুমি চাইলে আমি তৈমুর জাহান শিকদারের সাথে কথা বলতে পারি।

তালহার কথায় আঁতকে ওঠে রেশমী। এইতো সবে শুরু হলো তাদের প্রণয়। এখনি কেউ জানুক তা চায়না রেশমী। বলে,,

:- স্যার আমি চায়না এখনি আমাদের মাঝে কোন বাধা আসুক। পরে যা হবে দেখা যাবে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,ভালোবাসা এতো সুন্দর হয় স্যার, তবু এতো ভয় লাগে কেনো?

তালহা মৃদু হেসে বলে,,

:-কারণ, এই ভালোবাসা শুধু তোমার না, আমার সাহসেরও পরীক্ষা নিচ্ছে। তুমি পাশে থাকো, বাকিটা আমায় করতে দাও। তা ছাড়া আমি বাড়িতে আজ জানিয়েছি আমাদের সম্পর্কের কথা। কারন,,,
কিছুটা থামে তালহা। এখনই রেশমীকে এসব কথা জানানো উচিত হবে কিনা ভাবতে থাকে।

তালহাকে কিছু একটা বলতে গিয়ে চুপ করে যেতে দেখে উদ্বিগ্ন হয় রেশমী।

:-কারণ!! কি হয়েছে স্যার?

:-তেমন কিছু নয়! তুমি চিন্তা করো না। আমি সবটা সামলে নেবো।

রেশমি আরো চিন্তিত হয়ে যায়। বলে,,,

:-স্যার প্লিজ, আমার কাছে কিছু লুকাবেন না! কি হয়েছে আমাকে বলুন।

রেশমি জোর করাতে আর লুকাই না তালহা। আজকের ঘটে যাওয়া সব কিছু খুলে বলে রেশমিকে।

রেশমির চোখ ভিজে আসে। নিজের প্রথম প্রণয়ের পুরুষ কে অন্য কেউ ভালোবাসে, বিয়ে করতে চাই। এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারে না রেশমি। কাঁপা গলায় বলে,,,

:-স্যার যদি আপনার পরিবার জোর করে!!

:-বললাম তো! দুনিয়া উলটপালট হয়ে গেলেও তালহার জীবনে রেশমি ছাড়া কারো জায়গা নেই। শুধু তুমি আমার পাশে থেকো!

:-আচ্ছা… আমি পাশে আছি আর থাকবো। যেকোনো পরিস্থিতিতে। কিন্তু প্লিজ, আপনি যদি কখনো অনুভব করেন, আমার জন্য ঝুঁকি অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে, তাহলে…

তালহা রেশমীর কথায় বাধ সাধে,,,

:-তাহলে আমি আরও শক্তভাবে তোমার হাত ধরবো।

!

কয়েকদিন পরে,,,

হসপিটালের রিসেপশনে বসে আছে আলিফ শিকদার। পাশেই সিমা শিকদার। রুটিন চেকাপ করতে এসেছেন তারা। ছোট চাচীর এই অসময়ে প্রেগন্যান্সির কারনে নিয়মিত চেকআপে রাখে তৈমুর।
আল্ট্রাসনো রুমে সবকিছু ঠিকঠাক করে বেরিয়ে আসে তৈমুর। লাইফ কেয়ারের বেস্ট ফিমেল Gynecologist ডক্টর শেহরীন সুলতানার আন্ডারে দেয়া হয়েছে সিমা শিকদার কে।
তৈমুর রিসেপশনে এসে ছোট চাচির হাত ধরে আল্ট্রাসনো রুমে দিয়ে আসে। আলিফ সিকদার বেশ টেনশনে আছে। আজ জানা যাবে সিমার গর্ভে মেয়ে সন্তান নাকি ছেলে। আল্লাহ যায় দিক তার ঘরে তাতে আলিফ শিকদারের কোন আপত্তি নেই কিন্তু সবকিছুর উর্ধ্বে তিনি চাইছেন যেন তার স্ত্রী -সন্তান সুস্থ থাকে। সবটা যেন ঠিকঠাক হয়। অদ্ভুত অস্থিরতায় ছটফট করছেন আলিফ শিকদার।

ঠিক সেই সময় কোথা থেকে হাজির হয় সায়ান। আলিফ শিকদার কে দেখেই দাঁত বের করে হাসে। সায়ানকে দেখে মনে মনে প্রমাদ গুণলেন আলিফ শিকদার। এই ছেলেটা তাদের বাড়ির জামাই হতে চলেছে, অথচ এতটুকু লেহাজ করে না আলিফ শিকদার কে। যদিও তাদের মধ্যে একটা ভালো সম্পর্ক আগে থেকেই ছিলো, কিন্তু এখন তো সম্পর্ক বদলাতে চলেছে! এখন তো একটু সামলে কথা বললে হয়, কিন্তু না!! এই বাত্তামিজ,বাঁচাল ছেলেটা তার ধার ধারে না। যবে থেকে সে আলিফ শিকদারের নতুন করে বাবা হওয়ার খবরটা শুনেছে তবে থেকেই সুযোগ পেলেই হবু চাচা শ্বশুরের টাং খিচতে একটা সুযোগও হাতছাড়া করে না সে!!

সায়ান এসেই আলিফ শিকদার কে দেখে চেঁচিয়ে বলে,,,

:-কি চাচু!! আপনি নাকি খুব টেনশনে আছেন শুনলাম। আরে চাচু! টেনশন লেনেকা নেহি!! চিল!!

আলিফ শিকদার সায়ানের কথায় একটু বিব্রত হন। চারদিকে চোখ বুলিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলেন,,,

:-এইটা কি হসপিটাল না সার্কাস? ডাক্তার হয়ে রিসেপশনে এসে এভাবে চেঁচাচ্ছো।

সায়ান হাসতে হাসতে সামনে এসে দাঁড়ায়।আবারো দাঁত কেলিয়ে বলে,,,

:-হবু চাচা শ্বশুর যদি এই বয়সে আমাকে শালা-শালী উপহার দিতে পারে তাহলে আমিও স্থান,কাল, পাত্র ভুলে আনন্দ প্রকাশ করতে পারি! আফটার অল আপনি এই হসপিটালের VIP গেস্ট এখন।

আলিফ শিকদার চোখ সরু করে তাকায় সায়ানের দিকে।

:-তোমার হাতে কি একটুও কাজ নাই এখন ? নাকি রাউন্ড বাদ দিয়ে শুধু আমার টাং খিচতে এসেছো?

সায়ান আলিফ শিকদারের পাশে বসে ফিসফিস করে বলে,,

:-একটা সিক্রেট বলি হবু চাচা শশুর আব্বু??
আমার রোগীরা তো আমাকে দেখেই অর্ধেক সুস্থ হয়ে যায়! আর বাকি অর্ধেক আপনার অবদান।

:-কি বলতে চাইলো তুমি?

:-দেখুন! মানুষ অসুস্থ হলে অনেক সময় বাঁচার আশা ছেড়ে দেয়! আর আমাদের ডাক্তারদের কাজ কি? রোগীদের মাঝে বাঁচার ইচ্ছা জাগিয়ে তোলা। তাদের ট্রিটমেন্ট করে সুস্থ করে তোলা। কিন্তু যখন দেখি তারা নিজেরাই বাঁচার ইচ্ছা ছেড়ে দেয়, তখন আমি আপনার কথা বলি আর অদ্ভুত!! তারা সুস্থ হয়ে যায়,,, তাই এই মুহূর্তে আপনি আমার আইডল আমার inspiration !!

সায়ানের কথায় সন্দেহের চোখে তাকান আলিফ শিকদার। এই ছেলেটাকে দিয়ে বিশ্বাস নেই। কোথায়, কখন, কিভাবে যে তার ইজ্জতের ফালুদা বানিয়ে দেবে তার কোন গ্যারান্টি নেই।
সায়ানের দিকে তাকিয়ে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন আলিফ শিকদার ,,,

:-মানে আমার কথা কি বলো তুমি! যে রোগী সুস্থ হয়ে যায়?

সায়ান দাঁত বের করে হেসে বলে,,
:-বেশি কিছু না। এই ধরেন রোগীদের মাঝে মাঝে আপনার গল্প শোনায়, আর বলি; এই লোকটা যদি এই বয়সে বাবা হতে পারে, তাহলে তোমাদেরও বাঁচার আশা আছে! সো জাগো রোগীরা জাগো! জিন্দেগী জিনেকে লিয়ে সুস্থ হয়ে হসপিটাল থেকে ভাগো!!!

সায়ানের কথায় চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছেন আলিফ শিকদার। কত্ত বড় বেত্তমিজ!! ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশ দেখে, চাপা গলায় বলেন,,,

বেয়াদব! কথা একটু ছোট করে বলো! লোকজন কী ভাববে?

সায়ান মুচকি হেসে ভ্রু নাচিয়ে বলে,,,

:-ভাববে আপনার স্পার্ম রিপোর্ট বেস্ট ইন টাউন!
এক্সট্রা অ্যাক্টিভ! 😎

আলিফ শিকদার চোখ পাকিয়ে বলেন,,

:-এই বেয়াদব তুমি একটু থামবে?!

সায়ান ভীষণ মেকি সিরিয়াস মুখে বলে,,,

:-আমি তো ভাবছিলাম, “ হবু চাচা শ্বশুর মশাইয়ের হসপিটালে এখন VIP লেবারে জয়েন করা উচিৎ! মানে, যাকে বলে… Special Case of Late Fatherhood 😜

আলিফ শিকদার এবার বিরক্ত চোখে তাকায়।

:-তুমা আর একটাও ফালতু কথা বললে, বড় ভাইজান কে বলে,তোমার বিয়ের তারিখ একবছর পিছিয়ে দেব!

আলিফ শিকদারের কথা শুনে সায়ান মুখে আঙ্গুল চেপে, নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে,,,

:-নাহ্… চাচা শ্বশুর আব্বু প্লিজ না! আমি তো ইতিমধ্যেই লেট হয়ে গেছি…আপনি এমন করতে পারেন না। আচ্ছা আমি চুপ যাচ্ছি। এখন যদি আপনি কাইন্ডলি একটা ‘শশুরজি ডিসকাউন্ট’ দেন, আমার বিয়ের জন্য তাহলে আমি আমার নিউ শালা-শালীর জন্য একটা লাল ছাতা কিনে দেব! Promise!

আলিফ শিকদার সায়ানের কথায় থামতে না পেরে হেসে ফেলেন।

:-তুমি একটা অসভ্য! তোমাকে জামাই বানানো জীবনের সবচেয়ে বড় রিস্ক!

সায়ান হাসতে হাসতে পেছন দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলে,,,

:-আর কোন অপশন নেই হবু চাচা শ্বশুর আব্বু!! তবে আপনাকে এখন থেকে “ফাদার ইন চিফ” বলে ডাকবো।

আলিফ শিকদার কপালে করাঘাত করে বিড়বিড় করে বলেন,,,

:-এই ছেলে জীবনেও শুধরাবে না।

_____________

আল্ট্রাসনোগ্রাফি তে জানা গেছে শিকদার হাউসে আরেকজন উত্তরাধিকারী আসতে চলেছে। এই খবরে আনন্দে ঝলমল করছে পুরো শিকদার হাউস।
সাইফ শিকদার কলোনিতে প্রত্যেকটা বাসায় মিষ্টি বিতরণ করেছেন। মসজিদে দান করেছেন কয়েক লক্ষ টাকা। রিনা শিকদার ছোট জা কে ধরে বসে আছেন। তার মুখ থেকে হাসি ফুরাতেই চাইছে না। সকলে ভীষণ খুশি।

_______________

দেখতে দেখতে তুলির বিয়ের দিন এগিয়ে আসতে লাগলো। আর মাত্র দশদিন বাকি আছে। এখন থেকেই বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। বাড়ি সাজানো থেকে শপিং সবটা সামলে উঠতে পাঁচ ছয়দিন লেগে যাবে। তারপর সঙ্গীত,মেহেন্দী,গায়ে হলুদ,বিয়ে। অনেক কাজ বাকি!!
আজ সকাল থেকেই শিকদার হাউসে এগুলো নিয়েই হুলুস্থলু ব্যাপার!!
রিনা শিকদার সকলকে তাড়া দিচ্ছেন। শপিংয়ে যেতে হবে। রিনা শিকদার, আলিফ শিকদার, তৈমুর,তুলি, রেশমি,সারা এবাড়ি থেকে এই কয়জনই যাবে। সাইফ শিকদার বাড়ি ডেকোরেশনের কাজ দেখছেন। সিমা শিকদার এই সময়ে এগুলোতে যোগ দেয়ার পরিস্থিতিতে নেই। তিনি ফুল বেড রেস্টে।

সায়ানের পরিবার তাদের সাথে মিলবে শপিং মলে। সবাই গাড়িতে উঠে বসতেই গাড়ি স্টার্ট দিলো তৈমুর। মনোযোগ সহকারে ড্রাইভ করতে থাকে। মাঝেমধ্যে মিরর ভিউয়ে পেছনে বসা প্রেয়সীকে দেখতে ভোলে না।
__________
তুলি একটু অস্বস্তিতে আছে। সেদিনের পর থেকে সায়ান খুব বেশি একটা কথা বলেনি তুলির সাথে। যে ছেলেটা সবসময়ই কথা বলে মুখে খই ফোটায়, সেই ছেলেটাই তুলির সাথে প্রয়োজনের বেশি কথা বলছে না ।এটা নিয়ে তুলির মনে অশান্তির শেষ নেই। মনে মনে ভীষণ অনুতপ্ত বোধ করছে মেয়েটা।

*****

চলবে,,,,,,

#সারা_জাহান
পর্ব,,,২৯
মৌমো তিতলী
❤️❤️❤️❤️❤️

সায়ানের গাড়ি এসে থামে শপিং মলের সামনে। গাড়ির পেছনের সারি থেকে নেমে আসে সরোয়ার মাহমুদ, সোহিনী মাহমুদ। সুহানা সামনে বসেছিলো ভাইয়ের কাছে। সে গাড়ি থেকে নামতেই সামনে শিকদার ফ্যামিলি কে দেখতে পেলো। সারা আর রেশমী কে দেখা মাত্রই সে ছুটে গেলো তাদের কাছে। তৈমুর রা এতক্ষণ সায়ানের ফ্যামিলির জন্য অপেক্ষা করছিলো। সবাই এক জায়গায় হয়ে কুশল বিনিময় করে। তারপর সবাই একসাথে শপিং মলের ভেতরে যায়। মেহেন্দী, হলুদদের ফাংশন এবং বিয়ে সবকিছুর শপিং করতে হবে। অনেক চাপ! তৈমুর সকলকে বুঝিয়ে দেয় মলৈ গিয়ে যার যার নিজ পছন্দে যা নেয়ার নিয়ে নিতে। এতৈ ঝামেলা কম হবে‌। সব শেষে একসাথে পেমেন্ট করে দিলে সময় বাঁচবে।
—বসুন্ধরা সিটি,
সবাই শপিংয়ে ব্যাস্ত। তুলির শপিংয়ে তেমন মন নেই। রিনা শিকদার আর হবু শাশুড়ি যা যা পছন্দ করছে তুলি শুধু ঘাড় নেড়ে সায় দিচ্ছে। তুলির মনটা পড়ে আছে সায়ানের দিকে। ছেলেটা সবার সাথে স্বভাবজাত ভাবে হেসে হেসে কথা বলছে, শুধু তুলির সাথেই স্বাভাবিক ভাবে ফর্মালিটি অনুযায়ী কথা বলছে।

মানুষ স্বভাবগতভাবেই অ্যাটেনশন চায়। আর যেই ছেলেটা প্রথম থেকেই তাকে একটা অ্যাটেনশন দেয় হুট করে এমন নির্লিপ্ত আচরণ করলে সেটা মেনে নিতে একটু অসুবিধাই হয় বৈকি। তুলির অবস্থাও তাই। সায়ানের এই নির্লিপ্ত আচরণ তার সহ্য হচ্ছে না। ভেতরে ভেতরে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে মেয়েটা।

সোহিনী মাহমুদ তুলি কে ডেকে বলেন,,

:-তুলি মা! তোমার লেহাঙ্গার সাথে মিলিয়ে দোপাট্টা টা বেছে নাও! দেখো কোনটা পছন্দ হয়।

তুলি আনমনে দেখতে থাকে। মেরুন কালারের লেহাঙ্গা নেয়া হয়েছে তুলির বিয়ের জন্য। কয়েকটা দোপাট্টা দেখে দুটো পছন্দ হয়। দুটোই পছন্দ হচ্ছে কিন্তু কোনটা রেখে কোনটা নিবে কনফিউজড হয়ে তুলি।

সায়ান তুলির সাথে কথা না বললেও খেয়াল রেখেছে বিস্তর। এতক্ষন সে আড়চোখে তুলিকেই দেখছিলো। দুটো দোপাট্টা হাতে নিয়ে কনফিউজড হয়ে বসে থাকতে দেখে সারাকে ইশারা করে কিছু বোঝায় সায়ান। সারা সায়ানের ইশারা বুঝতে পেরে হেসে, তুলির পাশে এসে বসে। বলে,,,

তুলি আপু এক কাজ করো, এই হালকা হালকা মিররওয়ালা ওয়ালা এই দোপাট্টা টা নাও। এটাই তোমাকে সুন্দর লাগবে।

সারার কথায় হাসে তুলি। সায়ানের দিকে একবার আড়চোখে তাকায়। একমনে ফোনে স্ক্রল করছে সায়ান। যেনো দুনিয়ার সব থেকে ইম্পর্ট্যান্ট কাজ করছে সে।মন খারাপ করে সারার পছন্দ করা দোপাট্টা টায় নিয়ে নেয়। সে চাইছিলো তার বিয়ের সব কেনাকাটা সায়ানের পছন্দ মতো করবে কিন্তু সায়ান তো কথায় বলছে না। ভীষণ কষ্ট হয় তুলির।

অন্যদিকে… তৈমুর একটা সোনালী সুতার কাজের কালো লেহাঙ্গা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সারার দিকে তাকিয়ে—চোখে অদ্ভুত এক প্রশ্রয়।

সায়ান তা দেখে তৈমুরের কানে কানে ফিসফিস করে,,,

:-ছোট্ট ভাবিকে নিয়ে মনে মনে এতো গভীর প্রেম করো মিয়া। আর এদিকে আমি! একটু ছুঁয়ে দিলেও রিজেক্টেড!

সায়ানের কথায় তৈমুর চোখ না তুলেই বলে,,

:-তোর সবসময় ভুল সময়ে ভুলভাল কথা বলা পাল্টাবে না তাইনা? চুপ থাক নয়তো ভাগ!!

:-হাহঃ আজকাল মনের দুঃখ কাউকে বলতে নেই! তুইও আমার কষ্টটা বুঝলি না! এই দুনিয়ায় কেউ কারো কষ্ট বোঝে না! সবকিছু একাই করতে হয় সব সময়! 🤧

:- ড্রামাবাজ!!

রেশমী আর সুহানী পাশে বসে লেহেঙ্গা দেখছে। সুহানী হাতে একটা লেহাঙ্গা নিয়ে রেশমী কে দেখায়।

:-দেখো রেশমী আপু! এই হলুদ আর সবুজ মিশেলের লেহাঙ্গাটা কি সুন্দর ! এর ওপর যদি একটু ঝালর দিতো না, তাহলে এটা পরলে একদম রাজকন্যার মতো লাগত!

সুহানীর কথায় রেশমী হেসে বলে,,

:-তুমি তো এমনিই রাজকন্যা! এটা তুমি নিয়ে নাও। হলুদে পরলে তোমাকে মারাত্মক সুন্দর লাগবে।

রেশমীর কথায় মনটা খুশি হয়ে যায় সুহানীর। সে লেহাঙ্গাটা নিয়ে নেয়। রেশমী অনেক পছন্দ করে নীল রঙের ওপর সোনালী সুতার কাজ করা একটা লেহাঙ্গা নিয়ে নেয়‌।

সারা সকলের সাথে এটা সেটা দেখতে ব্যস্ত। কথার ফাঁকে হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। তৈমুর মোহনীয় দৃষ্টিতে সেদিকেই তাকিয়ে আছে। একফোঁটা নজর এদিকে ওদিক করছে না!
তৈমুরের গম্ভীর চেহারার আড়ালে যে গভীর ভালোবাসা, আর সারার জন্য নিঃশব্দ আবেগ—এ যেন টুকরো নরম মিষ্টি প্রেমের কবিতা।
——

কিছুক্ষণ পর সারা একটা সালোয়ার স্যুট হাতে ট্রায়াল রুমে গিয়ে ট্রাই করতে থাকে। হুট করেই কাউকে ট্রায়াল রুমে ঢুকে পড়তে দেখে আঁতকে ওঠে। পেছনে তাকিয়ে তৈমুর কে দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তড়িঘড়ি করে এগিয়ে যায়।

তৈমুর হাতে একটা প্যাকেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সারার দিকে তাকিয়ে। সারা কাছে এসে গলা নিচু করে বলে

:- জাহান ভাইয়া আপনি এখানে কেনো আসলেন ?? এটা মেয়েদের ট্রায়াল রুম। বাইরে লেখা আছে দেখেননি?,,,

সারার কথায় ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে তৈমুর।
বলে,,

:-এটা লেডিস ট্রায়াল রুম আই তো দ্যাট! বাট রুমে এই মুহূর্তে যে লেডিস টা দাঁড়িয়ে আছে সেটা একান্তই এই তৈমুর জাহান শিকদারের।

তৈমুরের কথায় থতমত খেয়ে চমকে তাকায় সারা।

:- আপনি এখানে এসেছেন কেউ দেখলে কী ভাববে? সায়ান ভাইয়ার পরিবার উপস্থিত আছে ভুলে গেলেন?

সারার কথায় কোন হেলদোল দেখালো না তৈমুর। হাতের শপিং ব্যাগ টা সারার দিকে এগিয়ে দিলো শুধু।

সারা শপিং ব্যাগ টা হাতে নিয়ে আশ্চর্য হয়ে তাকায় তৈমুরের দিকে। অবাক হয়ে বলে উচ্ছাসিত গলায় বলে,,

:-আমার জন্য?

তৈমুর সারার দিক থেকে চোখ না সরিয়েই মাথা নাড়ায়।
সারার আবেগে গলা ভার হয়ে আসে,,

:-আপনি… আপনি সত্যিই আমার জন্য… নিজে খুঁজে কিনলেন?

তৈমুর এগিয়ে যায় সারার দিকে। এক হাতে কোমর জড়িয়ে ধরে আস্তে হেসে হাস্কি স্বরে বলে,,

:-হুঁ। খুলে দেখ কেমন হয়েছে।

সারা চোখ নামিয়ে নেয় লজ্জায়। ঠোঁট চেপে ধরে বলে,,,
:- যেমনি হোক,আমি এটাই নেবো।

তৈমুর গভীর কিন্তু নরম চোখে মোহাবিষ্টের ন্যায় তাকিয়ে থাকে সারার দিকে।

তৈমুরের এহেন দৃষ্টিতে সারার চোখ বুঁজে আসে, তবুও ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে তৈমুরের গা ঘেঁষে।

তৈমুর ঢোঁক গিলে ঘোর লাগা স্বরে বলে,,,

:-আমার সবকিছুতেই তোকে চাই সারা। তোর এই হাসিমুখ টা আমাকে পাগল করে দেয়। ছিন্নভিন্ন করে দেয় অন্তর। আমাকে প্রতি মুহূর্তে খুন করিস তুই!!

তৈমুর আরো এক পা এগিয়ে এসে মিশিয়ে নেয়‌ সামান্য দুরত্বটুকু। ধীর গলায় বলে,,,

:-তুলির বিয়ের রাতে এটা পরিস।… তাহলে সেটা হবে আমার জন্য বেস্ট মুহূর্ত।

সারা ঠোঁটে চেপে লজ্জায় মাথা নিচু করে,,,ধীরে বলে,,

:-আপনি.. এমন করে কথা বলবেন না জাহান ভাইয়া আমার র… আমার.. কেমন লাগে..!

তৈমুর বাঁকা হেসে একটু ঝুঁকে, ফিসফিসিয়ে বলে,,

:-কেমন লাগে?

সারা পারেনা মাটি ফাক করে ভূতলে ঢুকে যেতে। তাহলে হয়তো লজ্জা টা লুকাতে পারতো। চোখ তুলে তৈমুরের দিকে তাকায়।

:-আপনি,,, আপনি কিন্তু দিন দিন কেমন নির্লজ্জ হয়ে যাচ্ছেন। তা বুঝতে পারছেন?

তৈমুর গা দুলিয়ে হাসে, কিন্তু চোখে তীব্র আবেগ নিয়ে বলে,,
:-জানি। তবে তোর থেকে নির্লজ্জ ট্যাগটা যখন পেয়েই গেলাম তখন আরেকটু নির্লজ্জ না হয় হলাম।বলেই সারার ঠোঁট দুটো আঁকড়ে ধরলো। সারার কোমর জড়িয়ে তার অধরজোড়া আঁকড়ে ধরে সমস্ত পাগলামি, আবেগ,অনুভূতি মিশিয়ে শুষে নিতে থাকে তৈমুর জাহান শিকদার। তৈমুর কে দুর্বল হাতে আঁকড়ে ধরে থরথর করে কাঁপতে থাকে সারা। ভেসে যেতে থাকে ভালোবাসার অতল গহ্বরে,,,-

_______

সবার শপিং প্রায় শেষের দিকে, সায়ান কিছুটা চুপচাপ। তুলি জানে ওর মন খারাপ, কিন্তু এখন আর মুখে কিছু বলছে না সে। মনে মনে ঠিক করে যেভাবেই হোক রায়ানের সাথে কথা বলতে হবে। তাই তুলি নিজেই একটা ছোট্ট নাটক সাজায়, সায়ানের অভিমান ভাঙাতে।

হুট করে উসখুস করে ওঠে তুলি। সোহিনী মাহমুদ তুলির এমন উসখুস করতে দেখে জিজ্ঞাসা করে,,

:-তুলি কি হয়েছে তোমার? এমন অস্থির দেখাচ্ছে।

:-আসলে আন্টি আমার একটু ওয়াশ রুমে যাওয়ার ছিলো! অনেক্ষণ ধরে চেপে বসে আছি তো তাই….

:-আরে এটা আগে বলবে না? এভাবে কষ্ট পাচ্ছো।

বলেই তিনি এদিকে ওদিক তাকিয়ে সায়ানকে খুঁজতে থাকেন। এতো বড় শপিং মলে একা তো ছাড়া যায়না তাই সায়ানকে দেখতে পেতেই ডাক দেন সোহিনী মাহমুদ।

সায়ান মায়ের ডাকে ভ্রু কুঁচকে, নিরাসক্ত গলায় বলে,,

:-কী হলো?

:-তুলি ওয়াশ রুমে যাবে। ওকে সাথে নিয়ে যা।

তুলি উঠতেই হাঁটতে শুরু করে সায়ান।

দুমিনিট পর লেডিস ওয়াশ রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তুলিকে যেতে বলে উল্টো ঘুরে আসতে নিলেই সায়ান কে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে তুলি।

তুলির জড়িয়ে ধরার দরুন দু’পা এগিয়ে যায়। তুলি তাকে জড়িয়ে ধরে আছে বোধগম্য হতেই ঝটকা খায় সায়ান। শরীরে উষ্ণ এক স্রোত বয়ে যায় শিরদাঁড়া বেয়ে।

সায়ানকে জড়িয়ে ধরেই কেঁদে দেয় তুলি! কাঁদতে কাঁদতে হিচকি উঠে যাওয়ার উপক্রম। কোনমতে বলে,,

:-সায়ান প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি জানি আমার সেদিনের করা আচরণের কারণে তুমি আমার ওপর রেগে আছো। আই’ম সরি সায়ান। আই’ম রিয়্যালি ভেরি সরি। তোমার আমাকে এমন ইগনোর করা,কথা না বলাটা আমি আর মেনে নিতে পারছি না। কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে আগের মতো হয়ে যাও। প্লিজ সায়ান,,,

:-গলা শুকিয়ে কাঠ কাঠ সায়ানের। একদিকে পেছনে ক্রন্দনরত প্রেয়সীর আবেগী আত্মসমর্পণ অপরদিকে তার এভাবে জড়িয়ে ধরায় অনুভূতির জোয়ার বইছে শরীর জুড়ে।

সায়ান ফট করে ঘুরে দাড়াতেই তুলি হামলে পড়ে সায়ানের বুকের মাঝে। হিচকি তুলে কেঁদে ওঠে তুলি।
প্রেয়সীর কান্না সহ্য হয়না প্রেমিক পুরুষের। দুহাতে তুলির ক্রন্দনরত মুখটা তুলে ধরে বলে,,,

:-ইসসস কে বলেছে আমি রেগে আছি? তুমি তো পছন্দ করোনা আমি তোমার কাছে আসি। তাই বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত দুরত্ব বজায় রেখে চলেছি। এটাতেও দোষ? তাহলে আমি যাবো কোনদিকে?

:-না না না। তুমি রাগ করেছো আমি জানি। আমার উচিত হয়নি সেদিন তোমাকে ওভাবে বাঁধা দেওয়া। ভুল হয়ে গেছে আমার। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও।

মুখ উঁচু করে জোরে শ্বাস নেয় সায়ান। দুহাতে তুলিকে বুকের মাঝে লেপ্টে নেয়। পিঠে হাত বুলিয়ে শান্তনা দেয়। বলে,,,

:-শশশশ কাঁদে না আর। আমি রেগে নেই। দেখো আমি একটুও রেগে নেই। আর কাঁদতে হবে না।

তুলি তবুও কাঁদতে লাগলো। সায়ান এবার তুলিকে নিজের থেকে আলগা করে দুহাতে মুখটা তুলে ধরে বলে,,,

:-আল্লাহ!!! এই, কেঁদে কেটে মুখটার কা অবস্থা করেছো দেখি!! এখন সবাই দেখলে কি ভাববে? তোমার ভাই কিন্তু আমাকে ওয়ার্নিং দিয়ে রেখেছে তার বোনকে কাঁদাতে দেখলে আমার অটি ছাড়ায় ওপেন হার্ট সার্জারি করে দিবে!!
সায়ানের কথায় কান্না ভুলে ফিক করে হেসে ফেললো তুলি!!
সায়ান মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখে সেই হাসি। মুহুর্তেই আদুরে স্পর্শ ছুঁয়ে দেয় তুলির কপালে। তুলি চোখ বন্ধ করে শুষে নেয় সায়ানের দেয়া সেই আদুরে স্পর্শের অনুভূতি টুকু।

তখনই পেছনে থেকে সুহানী এসে ডাক দেয়:

“;-ভাইয়া, ভাবি! তোমাদের কাজ শেষ হলো??সবাই শপিং শেষ করে ক্যাফেতে চলে গেছে! এখনই না গ
গেলে কিন্তু তোমরা পাস্তা খেতে পারবা না!”

সুহানীর অস্তিত্ব টের পেতেই দুজন ছিটকে দুদিকে সরে যায়। তুলির তখনও চোখে জল, মুখে হাসি।
সুহানী এসে দুজনকে এমন দুদিকে ফিরে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এসে বলে,,

:-একি তোমরা এখানে দাঁড়িয়ে কি করছো?

সায়ান নিজেকে সামলে নিয়ে গলা ঝেড়ে বোনের দিকে এগিয়ে গেল। সুহানীর মাথায় গাট্টা মেরে বলে,,,

:-আমরা এখানে দাঁড়িয়ে সার্কাস দেখছি!!
বলেই সেখান থেকে চলে আসে। সায়ানের কথায় ঠোঁট টিপে হাসে তুলি। সেও আর কথা না বাড়িয়ে সুহানীর হাত ধরে সায়ানের পিছনে পা বাড়ায়।
সুহানী কিছু বুঝতে না পেরে বিড়বিড় করে বলে,,

:-এখানে শপিং মলে সার্কাস হচ্ছে নাকি? কি আমি তো দেখতে পেলাম না কোথাও!!

__________

শপিং থেকে ফিরতে সন্ধ্যা হয়। তৈমুর রুমে এসে আগে শাওয়ার নেয়। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হেয়ার ড্রাই দিয়ে চুল শুকিয়ে নেয়। বিছানায় বিদ্যমান ফোনে বন্ধুদের মেসেজের ঝড়। সন্ধ্যার পর সবাই একসাথে দেখা করার প্ল্যান রয়েছে। সেটা নিয়েই বন্ধুদের গ্রুপে নানান কথা হয়।
তৈমুর হাত বাড়িয়ে ফোনটা টেনে নেয়। ফোনের উপরে টাইপিংয়ে দ্রুত আঙুল চালায়। জানিয়ে দেয় ঘন্টাখানেকের মধ্যে উপস্থিত হবে পূর্ব পরিকল্পিত জায়গায়। বন্ধুরা একে একে সিন করে। ফোনটা উল্টে রেখে তৈরি হয় তৈমুর। কালো প্যান্টের সাথে সাদা টিশার্ট গায়ে জড়ায়‌। চুলগুলো সেট করে ফোনটা নিয়ে বেরিয়ে আসে রুম থেকে। মাকে জানিয়ে দিয়ে নেমে আসে পার্কিং লটে। গাড়ি ছেড়ে বাইক বেছে নেয়। বাইকে চাবি ঘুরিয়ে এক টানে বেরিয়ে আসে শিকদার হাউস থেকে।

_______

সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতের কোলে ঢাকার অভিমুখে হাতিরঝিল যেন বদলে যায় এক জীবন্ত চিত্রকর্মে।
চারপাশে ধরা পড়ে অসংখ্য আলো– হালকা বেগুনি, নীলচে, আর সোনালি রঙে সাজানো সুসজ্জিত সেতুগুলো পানির ওপরে এমনভাবে আলো ফেলে, যেন জলের গায়ে তারা আলপনা এঁকে দিচ্ছে।

জলের ঢেউ গুলো আলোর প্রতিফলনে চিকচিক করে ওঠে। কিছু কিছু জায়গায় জল এতটাই স্থির থাকে যে, রাতের আকাশ, সেতুর নকশা আর আলোর রঙ মিলে যায় তার গায়ে—একটা নিঃশব্দ, নরম জাদু যেন ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে।

সড়কপাশে সাঁজানো সারি সারি গাছ, আলোয় ধুয়ে যাওয়া হাঁটার পথ, আর দূরে ফ্লাইওভারের নিচে কাচের ক্যাফেগুলোর জানালা থেকে ভেসে আসে নরম গান।
মাঝে মাঝে একটা হালকা বাতাস এসে চুলগুলো এলোমেলো করে দেয়, আর তার সাথে ভেসে আসে পানির ঘ্রাণ মেশানো শহুরে মৃদু গন্ধ।

চারপাশের কোলাহল যেন এই জায়গায় এসে স্তব্ধ হয়ে যায়।
কেউ কেউ জোড়ায় জোড়ায় বসে, কেউ একা হেঁটে চলে, কেউ দূর থেকে শুধু হাত ধরে চুপচাপ তাকিয়ে থাকে দূরের রোদের মতো সোনালি সেতুর দিকে।
এই সময়টা হাতিরঝিলের দৃশ্যটা দেখলে মনে হয় যেন শহরের কোলাহলের মধ্যে একটা নির্জন প্রেমের দ্বীপ।

সেখানেই একটা নিরিবিলি ক্যাফেতে গোল হয়ে বসে আছে ছয় সাতজন সুদর্শন যুবক-যুবতী। নানা রকম গল্পে মশগুল তারা। মাঝেমধ্যে চলছে একে অপরকে জড়িয়ে ঠাট্টা আর অবিরাম হাসাহাসি।
বন্ধুদের মধ্যে সায়ান আর রাফি আর তিশা একটু বেশিই ফটফটে। হাসিঠাট্টা করতে এদের তিনজন কেজনকে জুড়ি মেলা ভার। এক সময় এই কজনকে প্রায় সব সময় এক সাথেই দেখা যেত। সময়ের কালক্রমে এখন সবাই যে যার মতো ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত। তবে তাদের মধ্যে আরো একজন ছিলো। ফুটফুটে প্রাণোচ্ছল চঞ্চল এক ষোড়শী। অতীতে সে কোন এক অভিমানে ইহলোকে ছেড়েছিলো।

বর্তমানে*****

বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র বিবাহিত সুদর্শন পুরুষ টা একটু আনমনা হয়ে বসে আছে তৈমুরের পাশের চেয়ারে। সবার কথাই বাসস হ্যাঁ হু যে জবাব দিচ্ছে সে। তৈমুর সেটা খেয়াল করে।
পাশে বসা বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে বলে,,,

:-What happened Alvi?? Are you worried for some reason?

তৈমুরের প্রশ্নে এবার বন্ধুরা তাদের দিকে মনোযোগ দেয়। তৈমুরের কথায় ভাবনাচ্ছেদ ঘটে আলভীর। হালকা হেসে বলে,,

:-No, I’m fine.

:-তোকে দেখে সেটা লাগছে না। মনে হচ্ছে তুই কোন কারণে চিন্তিত। দেখ কোন সমস্যা হলে বলতে পারিস। We will all try to solve it together.!!

লুবানা আলভীর দিকে তাকিয়ে বলে,,

:-কি হয়েছে তোর?

আলভী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,,,

:-আচছা তোরাও কি আমাকে মায়ার মৃত্যুর জন্য দায়ী মনে করিস?

আলভীর প্রশ্নে সবার মধ্যে একটা থমথমে ভাব হলো। তৈমুর জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,,,

:-তোর হঠাৎ এই কথা মনে হলো কেনো? Did something happen?

:-একচুয়ালি বিষয়টা তোদের কিভাবে বলি!! আমার ভাই! আমার ছোট্ ভাই তালহার মতে মায়ার আত্মহত্যার জন্য আমি দায়ী। তালহা আমাকে মায়ার খুনি ভাবে।
আলভী কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলে,,

:-তোরাও কি তাই মনে করিস?

সায়ান আলভীর দিকে ঘুরে তাকালো। বললো,,

:-দেখ আমার কিন্তু তা মনে হয় না। Maya’s suicide was her own opinion. It was just an accident.!!

তৈমুর আলভী কে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে বলে,,,

:-আলভী কিছু তো একটা হয়েছে। তুই আমাদের কে শেয়ার করতে পারিস।

আলভী একে একে সবটা খুলে বলে বন্ধুদের কে। তার বিয়ে থেকে শুরু করে তার শশুর এরশাদ হামিদের করা অন্যায় তার ভাইয়ের অভিমান আর এখন নতুন সমস্যা তার শালী সাবিকার সাথে তালহার বিয়ের কথা বার্তা সবটাই খুলে বলে।

সবটা শুনে রাফি বলে,,

:-তোর শশুর সেনাবাহিনীর লোক হয়ে এতো ক্রিমিনাল মাইন্ডের কি করে সম্ভব?? শালা যে এক নম্বরের ক্রিটিক্যাল কেস।

আলভী মৌন হয়ে বসে রয়। তৈমুর বলে,,,

:-কিন্তু তোর ভাইয়ের যদি অন্য কোথাও সম্পর্ক থাকে সেটা তোর শ্বশুরকে জানিয়ে দে। সিম্পল!!

আলভী বলে,,,

:-সমস্যাটা তো এখানেই। আমার শ্বশুর প্রচন্ড স্বার্থপর মানুষ উনার স্বার্থের জন্য করতে পারেনা এমন কোন কাজ নেই। আমাকে তো তার হাতের পুতুল বানিয়েছেই। এখন আমাকে টপকে আমার ভাইয়ের জীবনেও দখলদারি করতে চাইছে। আমার ওয়াইফ সৃষ্টি ভালো মেয়ে। এই বিয়েতে ওর কোন দোষ ছিল না। সেটা আমি মেনে নিয়েছি। কিন্তু সাবিকা মোটেও ওর বোনের মতো নয়। ও প্রচন্ড জেদি আর একরোখা মেয়ে। ও যখন তালহাকে পছন্দ করেছে, তখন ওকে বিয়ে করতে যা ইচ্ছে করতে পারে। আর আমার শশুর, উনি তো আরো এককাঠি উপরে। আমি যদি এই সম্বন্ধ রিজেক্ট করে দিই তাহলে উনি কি করবেন নো আইডিয়া। কিন্তু উনি আমার জীবনটা যেভাবে ধ্বংস করেছেন সেভাবে আমার ভাইয়ের জীবন ধ্বংস করতে দিবো না। ওর জীবন ওর। সেখানে অন্য কারো জোর চলবে না।

তৈমুর কিছু একটা ভেবে বলে,,,

:-তাহলে তোর ভাইকে তার পছন্দের মেয়ে কে বিয়ে করে নিতে বল। একবার বিয়ে হয়ে গেলে নিশ্চয় তোর শশুর মশায়ের আর কিছু করার থাকবে না।

:-বুঝতে পারছি না আমার কি করা উচিত। আমার ভাই তো ভার্সিটিতে প্রফেসর। আর সে বলেছে তার বিয়ে করতে আরো একবছর সময় লাগবে। কিন্তু বিয়ে সে তার গার্লফ্রেন্ডকেই করবে।

সায়ান ঠোঁট গোল করে শ্বাস ফেলে বলে,,,

:-এতো ভাই পুরোই ল্যারাব্যারা সিচুয়েশন।

তিশা বলে,,,

:-আচছা দেখা যাক কি হয়। আলভী তুই আমাদের কে আপডেট দিতে থাকিস। আমরা তো আছি নাকি তোর সাথে। যা হবে আমরা একসাথে হ্যান্ডেল করে নোবো। সো চিল! ব্রো!!

সবাই তিশার কথায় একমত হয়।

-চলবে–