#সারা_জাহান
পর্ব,,,৩৬
মৌমো তিতলী
❤️
রাতের নরম বাতাসে শিকদার হাউস জুড়ে যেন একধরনের প্রশান্তি নেমে এসেছে। পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ। তৈমুরের সাথেই সায়ান আজ শ্বশুরবাড়ি ফিরেছে। আসলে তুলিকে না দেখলে মনটা অস্থির হয়ে থাকে তার।
চুপচাপ পায়ে পায়ে তুলির রুমে ঢোকে সায়ান। দরজাটা ভেতর থেকে খোলা। রুমের ভেতর ঢুকেই চোখে পড়ে,বিছানা জুড়ে বই খাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে মাঝখানে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়েছে তুলি। স্নিগ্ধ নিষ্পাপ মুখটা বিছানার পাশে রাখা খাতার উপর হেলে পড়েছে।
সায়ান হেসে ফেলে নিঃশব্দে।
:-এই মেয়ে এখনো পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যায়? এমন কিউট বউ পেয়ে আমি তো ধন্য রে ভাই…”
হালকা পায়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ একেবারে শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে আসে সায়ান। তারপর আবার এসে তুলির পাশে বসে। আদুরে কণ্ঠে ডাকে,,,
:-তুলা… উঠো না…এই তুলা।”
তুলি কেঁপে ওঠে একটু, চোখ আধবোজা করে উঠে বসে। সায়ান কে দেখে বিচলিত ভঙ্গিতে বলে,
:-একি! আমি কখন ঘুমিয়ে পড়লাম বুঝতেই পারিনি!
চোখ কচলাতে কচলাতে চুলগুলো গুছিয়ে নিতে নিতে বলে,
:-তুমি কখন এলে?ডাকবে তো আমায়!
সায়ান হালকা হেসে বলে,
;-এইতো কিছুক্ষণ আগে। দেখলাম তুমি ঘুমোচ্ছো তাই ডিস্টার্ব করিনি।
তুলি যেন একটু লজ্জা পায়। গলাটা নিচু করে প্রশ্ন করে,
:-তুমি ডিনার করবে তো! বসো আমি খাবার নিয়ে আসছি।
তুলি বেরোতে নিলে সায়ান তুলির কোমর জড়িয়ে ধরে থামিয়ে দেয়। এক হাতে তুলির গাল ছুঁয়ে বলে,,,
:-আমি খেয়ে এসেছি জান। এখন ঘুমানো দরকার, কিন্তু তার আগে…!!
তুলি চমকে তাকায়।
:-তা..তার আগে? কি?
সায়ান গভীর চোখে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে,
:-তার আগে তোমাকে দরকার!
তুলি লজ্জায় লাল হয়ে যায়। চোখ নামিয়ে ফেলে।
:-তুমি খুব নির্লজ্জ হয়ে যাচ্ছো।
সায়ান মুচকি হেসে হাত ধরে টেনে তাকে বুকে টেনে আনে।
:-“বউকে কাছে পেলে মানুষ এমনিতেই নির্লজ্জ হয়ে যায়। এই বউটার বুকে মাথা না রাখলে তো ঘুমই আসে না।”
তুলি হালকা ঠেলা দিয়ে বলে,,
:-উঁহু! এখন ঘুমাতে হবে…
সায়ান ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি টেনে বলে,,
:-ঠিক আছে, ঘুমাবো। কিন্তু আগে একটু ভালোবাসবো তারপর ঘুম।”
তুলির গাল গরম হয়ে যায়। চোখ বন্ধ করে ফেলে, তবু ঠোঁটে এক চিলতে লাজুক হাসি।
রাতটা ধীরে ধীরে প্রেমে মোড়ানো এক নিঃশব্দ সুরে গলে যায়।
ভালোবাসা, লাজ, আবেগের মিশেলে এক গভীর মিলনের পর সায়ান তুলিকে বুকে জড়িয়ে কপালে চুমু খেয়ে বলে,,,
:-তুমিও আমার তুলা… শুধু আমার।”
তারপর ভালোবাসায় মোড়া দুইটি শরীর পাশাপাশি, দু’টি হৃদয় এক ছন্দে ঘুমিয়ে পড়ে চাঁদের আলোয় ভিজে থাকা শান্ত সেই রাতে।
*********
নীরব ভোর পেরিয়ে ধীরে ধীরে চারদিকটা কালো আলোর রঙটা ধুয়ে যাচ্ছে। সেনানিবাসের অভ্যন্তরের সাজানো গোছানো ক্যাম্প কোয়ার্টারের এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে একটি স্নিগ্ধ, ছিমছাম বাড়ি। সেই বাড়ির ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ক্যামো প্রিন্টের টি-শার্ট ও ট্রাউজার পরা আলভী। হালকা বাতাসে ওর চুলগুলো এলোমেলো হচ্ছে। চোখে একধরনের নির্লিপ্ত প্রশান্তি, আবার কোথায় যেন এক গভীর শূন্যতা। ও দাঁড়িয়ে আছে একাকী।
দূরে আর্মি ক্যাম্পর স্কুলের ঘণ্টা বাজছে ধীরে ধীরে। বাড়ির ভেতর থেকে শোনা যায় শিশুসুলভ চিৎকার—
:-না আমি যাবো না স্কুলে! আম্মু, যাবো না বলেছি না!
সৃষ্টির শাসন সুলভ কন্ঠও শোনা যায়,,,
:-মহিদ! একদম দুষ্টুমি করবে না। স্কুলে যেতে হবে!”
:-না! আজ আমি যাবো না।
মহিদ দৌড়ে এসে বাবার পেছনে লুকিয়ে পড়ে। বাবার পেছনে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে,
:-বাবা দেখো না আম্মু আবার বকা দিলো। আমি স্কুলে যাবো না না না!
আলভী নিচু হয়ে ছেলেকে কোলে তুলে নেয়। মুচকি একটা হাসি ঠোঁটে ফুটে ওঠে। সেই হাসির আড়ালে কি যেন এক দমচাপা যন্ত্রণা।
:-আচ্ছা যেতে না চাইলে যেওনা, থাক আজকে। আলভীর কণ্ঠ শান্ত, ধীর, কোমল।
মহিদ খুশি হয়ে ছুটে যায় ভেতরে খেলতে। সে জানে বাবা যখন একবার বলেছে যেতে হবে না তারমানে আম্মু তাকে আর জোর করবে না।
মহিদ ভেতরে যেতেই আলভীর পেছনে এসে দাঁড়ায় সৃষ্টি। পাটভাঙা কাতান শাড়িতে লাজুক লাবন্যময়ী।
তবে মুখটা বিষণ্ণ। একটুও বাড়তি সাজ নেই, তবু অপূর্ব লাগছে তাকে। ঠিক ভোরের শিশিরের মতো।
কিন্তু আলভী একটিবারের জন্যও ঘুরে তাকায় না। এমনকি বাড়তি একটা কথাও বলেনা।
সৃষ্টি ধীরে বলে,,,
:-সকালটা খুব সুন্দর, তাই না?”
“হুম,” আলভী শুধু একটুখানি মাথা নাড়ে। আর কোনো শব্দ নয়।
সৃষ্টি ওর পাশে এসে ব্যালকনির রেলিং ছুঁয়ে দাঁড়ায়। ও চায়, আলভী ওর দিকে একবার তাকাক, কিছু বলুক, মৃদু এক হাসি ছুঁয়ে যাক ওর দিনটাকে। কিন্তু বাস্তবে এসব কিছুই হয় না।
আলভী জানে এই মেয়েটা তার শত্রু নয়, কিন্তু প্রেমের মানুষও নয়। ভালোবাসার মানুষটা তো তার করা প্রতারণায় ধরে গেছে। যার জন্য তার বুক আজও পোড়ে, সেই তো হারিয়ে গেছে সৃষ্টির বাবার চক্রান্তে। জোর করে মেয়েকে তার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে আলভীর জীবনের স্বপ্নটাই ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছে সেই লোকটা।
তবুও আলভী কখনো সৃষ্টি’র সঙ্গে রূঢ় ব্যবহার করে না। প্রয়োজনের বাইরে কোনো কথাও বলে না, ভালোবেসে কোনো স্পর্শ করে না, সৃষ্টির কোনো ভালোবাসায় বাধাও দেয় না। শুধু স্বামী হয়ে থেকে যায়—দায়িত্বের খাঁচায় বন্দি এক সম্পর্ক।
সৃষ্টির কষ্ট হয়। মাঝেমধ্যে মনে হয় আলভী কোন জীবিত মানুষ নয়। যেন শুধু দায়িত্ব কর্তব্য নিয়ে হেঁটে চলে বেড়ানো একজন রোবট। তাতে কোন প্রাণ নেই।
ও জানে, এই অবহেলা তার প্রাপ্য। বাবা তাকে বিয়ে দিয়ে আলভীর জীবনকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করেছিলেন।, তার কারন তো সে নিজেই। কিন্তু তবুও… তবুও এক ফোঁটা ভালোবাসা যদি একদিন জুটতো। সৃষ্টি ভাবে, আফসোস হয়—যদি সে আলভী কে বিয়ে না করতো, তাহলে কি তার জীবনটা একটু কম শূন্য হতো?
হাওয়াটা একটু বেড়েছে। দু’জন মানুষ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকলেও তাদের মাঝখানে এক আকাশ নিঃশব্দতা।
সকালের আলো ধীরে ধীরে গাঢ় হয়ে উঠছে,উদ্বিপ্ত রবি আস্তে আস্তে তার তেজ ঢেলে দিচ্ছে ধরণীর বুকে।
************
শুক্রবারের বিকেল। শান্ত দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে চারদিকে। শিকদার হাউসে তখন ছিলো এক চিলতে আনন্দঘন পরিবেশ। রেশমি, সারা, তুলির হাসির শব্দ ভেসে আসছিলো বারান্দা পেরিয়ে। এমন সময় হঠাৎই নিচতলার বসার ঘর থেকে এলো আলিফ শিকদারের আতঙ্কিত চিৎকার,,,,
:-সিমা! এই সিমা! আমার কথা শুনছো?!”
আলিফ সিকদারের গলা কাঁপছে। মুহূর্তের মধ্যেই সবাই হুড়পাড়িয়ে নিচে নেমে এলো। রেশমি তো এক দৌড়ে মায়ের ঘরে গিয়ে থামে। মায়ের দিকে তাকিয়ে আর্তনাদ করে ওঠে,,,
:-মা? মা কী হয়েছে? মা চোখ খোলো!”
সিমা শিকদার অচেতন প্রায়, ঠোঁট ফ্যাকাশে, সারা শরীর ঘামে ভিজে আছে। কেমন একটা খিঁচুনি হচ্ছে থেকে থেকে।
রিনা শিকদার ছুটে এলেন সিমার ঘরে। কিছুক্ষণ আগেই তো সব ঠিক ছিলো। কি হলো হঠাৎ।
আলিফ সিকদার প্রার্থনায় বিড়বিড় করেন—
:-আল্লাহ তুমি রহম করো। আমার সন্তানদের মায়ের কিছু যেন না হয়…”
শিকদার হাউস তখন আতঙ্কে একদম স্তব্ধ।
তৈমুর খবর পেয়েই দ্রুত লাইফ কেয়ার হসপিটালের এম্বুলেন্স কে কল করে । সাইফ শিকদার রিনা শিকদার কে প্রস্তুতি নিতে বলে। অ্যাম্বুলেন্স এলে সিমা শিকদারকে কোলে করে তুলে নেয় তৈমুর। রেশমি মায়ের হাত ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
যথাসম্ভব দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছাতেই ওটিতে ঢোকানো হয় সিমা শিকদার কে।
তৈমুর ওটিতে প্রবেশের আগে রেশমির মাথায় হাত রেখে বলে,,,
:-আমি আছি, কাকিয়ার কিছু হবে না। প্লিজ কাঁদিস না বোনু। দোয়া কর শুধু।”
সারা আর তুলিকে ইশারা করে রেশমি কে সামলাতে।
ওটির বাইরে দাঁড়িয়ে আলিফ সিকদারের ঠোঁট নড়ে, কিন্তু কোনো শব্দ বের হয় না। চোখে পানি, মুখে বিড়বিড় করে আল্লাহর দরবারে আর্জি জানায়।
রিনা শিকদার শক্ত হাতে ধরে রেখেছে স্বামী হাত। সাইফ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে, ঠাণ্ডা ঘাম কপালে।
অপারেশন থিয়েটারে টানটান উত্তেজনা।
তৈমুর জাহান নিজেই ওটি তত্ত্বাবধান আছে, সঙ্গে আছেন ডঃ শেহরীন সুলতানা—লাইফ কেয়ারের দক্ষ গাইনোকোলজিস্ট।
দ্রুত সিজার শুরু করা প্রয়োজন। সিমা শিকদারের কন্ডিশন স্থিতিশীল নেই, বারবার ব্লাড প্রেশার ড্রপ করছে।
চিকিৎসা পরিভাষায় এটা ছিলো ‘Eclampsia’ (এক্লেমসিয়া)এটা একটি জটিল গর্ভকালীন অবস্থা যা সাধারণত প্রেগন্যান্সির শেষ দিকে অথবা প্রসবের সময় দেখা দেয়। শুরুটা হয় ‘Pre-eclampsia’ দিয়ে—যেখানে উচ্চ রক্তচাপ, প্রোটিন ইউরিয়া, চোখ ঝাপসা দেখা, মাথা ব্যথা ইত্যাদি উপসর্গ থাকে। যদি তা নিয়ন্ত্রণ না করা হয়, তাহলে সেটা রূপ নেয় ‘Eclampsia’-তে, যার ফলে খিঁচুনি, অচেতনতা, এমনকি মা ও শিশুর জীবন সংকটে পড়ে।
এর কারণগুলো হয় গর্ভাবস্থায় হরমোনজনিত ভারসাম্যহীনতা। প্লাসেন্টা ঠিকভাবে কাজ না করা
,উচ্চ রক্তচাপ,আগে থেকেই কিডনি সমস্যা থাকলে,
গর্ভবতী নারীর অতিরিক্ত ওজন বা অনেকের প্রথম সন্তানের ক্ষেত্রেও এমন হতে পারে
এই সময় চিকিৎসা ও করণীয় হলো,অবিলম্বে হাসপাতালে ভর্তি করা।খিঁচুনি নিয়ন্ত্রণে ম্যাগনেসিয়াম সালফেট,রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ওষুধ ব্যবহার করা।
জরুরি ভিত্তিতে সিজারিয়ান প্রসব করানো। যদি মা বা শিশুর জীবন হুমকির মুখে পড়ে তো!
(Knowledge from Google)
********
ওটির বাইরে নিঃশব্দ যুদ্ধ।
রেশমি এক কোণে দাঁড়িয়ে, চোখে অশ্রু।
আলিফ বারবার নিজের বুকে হাত রেখে বিড়বিড় করে বলতে থাকেন,,
:-হে আল্লাহ! ও আমার সব! ওর কিছু হলে আমি বাঁচবো না…!!
হঠাৎ হাসপাতালের করিডোরে ভেসে এলো রিনরিনে সদ্যজাত শিশুর কান্নাজড়িত চিৎকার,,,,
কিছুক্ষণ পর একজন নার্স একটা ফুটফুটে ছেলে শিশু কে সাদা কাপড়ে জড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন।
হাসিমুখে সকলকে উদ্দেশ্য করে বলেন,,,
:-অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে!” মা ও সন্তান দুইজনই সেফ!
শিকদার পরিবারের সদস্যদের মাঝে যেন বিজয়ের উল্লাস ছেয়ে গেলো!
রেশমি দৌড়ে ওর বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কেঁদে দিলো। আলিফ সিকদার মেয়েকে বুকে জড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস ফেলেন। শান্তির নিশ্বাস।
ডক্টর শেহরীন সুলতানা আর তৈমুর একসাথে ক্লান্ত শরীরে বাইরে এলো। সাইফ শিকদার গিয়ে তৈমুর কে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। ছেলেকে নিয়ে গর্বে বুকটা ভরে আসে তার। তৈমুর বাবার পিঠে হাত রাখে। বলে,,
:-কৃতজ্ঞ হও আল্লাহর প্রতি। আর কিছুক্ষণ দেরি হলে বড় বিপদ হতে পারতো।
সবাই একসাথে মহান রাব্বুল আলামীনের দরবারে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেন। রিনা শিকদারের কোলে পিটপিট করে তাকাচ্ছে সদ্য জন্মানো শিকদার হাউসের দ্বিতীয় কর্ণধার। একদম সাদা ধবধবে। চোখদুটো কালো মণির। রক্তিম ঠোঁটজোড়া কাঁপছে হঠাত মায়ের উষ্ণ গর্ভ ছেড়ে আসা নতুন আবহাওয়ার প্রভাবে।
আলিফ সিকদার তৈমুর কে জিজ্ঞাসা করে সিমার সাথে দেখা করতে পারবে কিনা।
তৈমুর বলে,,,
:-কাকিয়ার কন্ডিশন ভালো ছিলো না চাচু। তারপরও এনাস্থেসিয়ার প্রভাবে কাকিয়ার এখন জ্ঞান নেই। কিছুক্ষণ পর কেবিনে লিফট করা হবে। তারপর জ্ঞান ফিরলে সবাই দেখা করতে পারবে।
সবাই একে একে বাচ্চাটাকে কোলে নেয়। সাইফ শিকদার সদ্যজাত বাচ্চাদের কোলে নিতে পারেন না। তিনি বাচ্চাটাকে গভীর চোখে দেখে বলেন,,,
:-রিনা দেখো তো আলিফের ছেলেটাকে দেখে মনে হচ্ছে না, একদম আমাদের ছোট তৈমুর! শুধু চোখের রঙটা আলাদা। দেখো !!
রিনা শিকদারও এবার ভালো করে লক্ষ্য করেন। উচ্ছাসিত গলায় বলেন,,,
:-একদম ঠিক বলেছো! ছোট শিকদার তো দেখতে একদম তার ভাইয়ের মতো হয়েছে। একে একে সকলেই দেখে বাচ্চাটাকে।
রিনা শিকদার তৈমুরের দিকে তাকিয়ে বলেন,,,
:-জাহান, ভাইয়ের নাম টা তুমি রেখো আব্বা!!
তৈমুর মায়ের কথায় হাসে। শিকদার বাড়ির সকলেই একমত হয়, তৈমুর কেই নাম রাখতে হবে।
তৈমুর জানায় সে ভেবে জানাবে।
কিছুক্ষণ পর সিমা শিকদার কে কেবিনে শিফট করা হয়। এখন কন্ডিশন অনেকটাই বেটার।
**********
হাসপাতালের উষ্ণ সকাল।
সকালটা ছিলো ব্যতিক্রমী এক অনুভূতির। রাতের শেষ প্রহরে সিমা শিকদারের জ্ঞান ফিরেছে। সদ্য সন্তান জন্ম দেওয়া একজন মার চোখে যেমন প্রশান্তি থাকে, সিমার চোখেও সেই প্রশান্তির ছায়া। আলিফ শিকদার ছেলেকে কোলে নিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে শুধু একটাই কথা বলেছিলেন,,,
:-আমাদের পরিবারটা আজ সম্পূর্ণ হলো।”
হাসপাতালের পরিবেশটা একটু একটু করে প্রাণবন্ত হতে লাগলো। এমন সময় সায়ান তার পরিবারসহ এসে হাজির। জরুরি সিজারের সময় সায়ান উপস্থিত থাকতে পারেনি, কিন্তু খবর পেয়েই বাবা-মা, ছোট বোন সুহানীকে নিয়ে ছুটে এসেছে হাসপাতালে। শ্বশুর-শাশুড়ি ননদ কে দেখে তুলির মুখে হাসি।
ওদিকে সারা আর রেশমী তৈমুরের সাথে ভোরে বাড়িতে গিয়ে সকালের খাবার নিয়ে এসেছে। হেল্পিং হ্যান্ড না থাকায় দুজন মিলে যা পেয়েছে রান্না করে নিয়ে এসেছে। গরম ভাত,ডাল, মুরগির মাংস আর ডিম,আলুর তরকারি, সাথে পায়েস। সিমা শিকদারের জন্য স্যুপ। রেশমীর মুখে খুশির ছায়া, চোখে-মুখে নতুন ভাইয়ের আগমনের আনন্দ।
এই ফাঁকেই রেশমীর ফোনে কল আসে। স্ক্রিনে ভেসে ওঠে—”Sir Talha❤️
রেশমীর ঠোঁটে লাজুক হাসি ফুটে ওঠে, কেবিন থেকে বেরিয়ে নিরিবিলি দেখে করিডরের শেষের দিকে গিয়ে ফোনটা কানে নিয়ে বলে,
:-হ্যালো!
ওপাশ থেকে তালহার মোহনীয় স্বর ভেসে আসে,,,,
:-কোথায় তুমি? ভার্সিটিতে আসো নি?
রেশমী আমতা আমতা করে জানায় সে আজ যাবেনা। কারন জানতে চাইলে সবটা খুলে বলে রেশমী।
সবকিছু শুনে তালহা দুষ্টুমি ভরা কন্ঠে বলে,,,
:-কি কপাল!! আমি এখনো আমার বউটাকেই কাছে পেলাম না। এদিকে বুড়ো বয়সে শশুর মশাই আবার ছক্কা হাঁকাচ্ছেন। লাইফ এনজয় তো আলিফ শিকদারই করছেন!! বাহ! কিয়া লাইফ হ্যাঁয়!
রেশমী ফিক করে হেসে ফেলে,,, রেশমীর হাসির শব্দ পেয়ে তালহা নরম গলায় বলে,
:-আর ক’টা দিন, তারপর তুমি আমার হবে রোশী। দুনিয়ার সব বাধা দুরে ঠেলে আমি তোমাকে আমার করে নেবো। আই প্রমিজ। তোমাকে ছেড়ে আর বেশিদিন দূরে থাকতে পারবো না আমি।
রেশমী চুপ করে হেসে যায়। ভালোবাসায় বুকের ভেতর উত্তাল ঢেউ বয়ে যায়। ,
#চলবে
#সারা_জাহান
পর্ব,,,৩৭
মৌমো তিতলী
❤️
নিশুতি রাত। আকাশে চাঁদ নেই, কেবল দূর আকাশে হালকা মেঘের আস্তরণে ঢাকা অন্ধকার। ঢাকার অভিজাত একটি এলাকায় আলিশান এক বাংলো। ঝকঝকে মার্বেলের ফ্লোর, ছাদজুড়ে ঝাড়বাতি, ভারী পর্দায় ঢাকা জানালা, আর সেই ঘরের এক কোণায় বসে আছে ভয়ংকর একজন মানুষ—এরশাদ হামিদ। প্রাক্তন সেনাপ্রধান, সমাজে যিনি আদর্শ আর দেশপ্রেমের প্রতীক বলে পরিচিত, বাস্তবে যে একজন কুৎসিত হৃদয়ের অধিকারী।
সামনের সেন্টার টেবিলের ওপরে একটা ফাইল রাখা আর কয়েকটা ছবি। সেদিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছেন তিনি, ঠোঁটে বাঁকা হাসি। মুখোমুখি বসে থাকা ছেলেটির নাম ফরহাদ—এরশাদের নিযুক্ত ছায়া গোয়েন্দা। গলায় স্বর নিচু, অথচ রুক্ষ!
:-স্যার, টার্গেটের সম্পর্কে পুরো ডিটেইলস এখানে আছে। এই মেয়েটাই তালহা এহমাদের গার্লফ্রেন্ড। নাম রেশমী শিকদার। স্বনামধন্য কার্ডিওলজিস্ট ডঃ তৈমুর জাহান শিকদারের ছোট চাচার মেয়ে। মেয়েটা তালহা এহমাদের ভার্সিটিরই ছাত্রী।
এক মুহূর্ত নিস্তব্ধতা। তারপর, যেন হিমালয় বরফ গলিয়ে আগুন ছড়িয়ে দিলেন এরশাদ হামিদ।
:-তালহা… রেশমী…!
চোখের পাতাও কাঁপলো না এরশাদ হামিদের। গলার স্বর যেন আরও বিষাক্ত হলো।
— “তাহলে তো এখনি শুরু করতে হবে, ফরহাদ। মেয়েটাকে সরাতে হবে। ভালোই ভালোই সরে গেলে তো মিটে গেলো আর যদি সোজা আঙ্গুলে ঘি না ওঠে তো!!!… তিনি ফরহাদ কে কিছু বললেন।
:-কি বললাম বুঝতে পেরেছো?
:-জ্বী বস! আপনি যেমন বলবেন।
এরশাদ হামিদ ফরহাদ কে কিছু ক্যাশ দিয়ে দিলেন ঋ ফরহাদ তার ন্যায্য মূল্য বুঝে নিয়ে প্রস্থান করলো।
ফরহাদ যেতেই সেই মুহূর্তেই এরশাদ হামিদ ফোন হাতে নিলেন। কল লাগালেন ডঃ জাহাঙ্গীর কবিরের কাছ। তার একমাত্র ছোট ভাই, তার অপরাধ জগতের সহযাত্রী। ফোন রিসিভ হতেই ওপাশ থেকে জবাব এলো,,,
:-হ্যাঁ ভাইজান বলো!
:-জাহাঙ্গীর, ছোট জামাইয়ের মাশুকার সন্ধান পাওয়া গেছে। নাম রেশমী শিকদার। সম্পর্কে কোন ডাক্তার তৈমুর জাহান শিকদারের বোন। তুই তো এই লাইনের লোক। চিনিস নাকি?
তৈমুরের নাম শুনতেই কিছুটা চমকে উঠলো জাহাঙ্গীর কবির।
:-ভাইজান কি নাম বললে?
:-কোন কার্ডিওলজিস্ট তৈমুর জাহান শিকদার।
:-ভাইজান তৈমুর জাহান শিকদার লাইফ কেয়ার হসপিটালের বর্তমান ডিন। পাকা হাতের সার্জন। কার্ডিওলজিস্ট হিসেবে শহরে টপ লেভেলের সুখ্যাতী আছে।
:-সে যায় হোক! সেটা দেখা আমার বিষয় না। মেয়েটাকে সরাতে হবে ব্যাস!
কিন্তু ওপাশ থেকে জাহাঙ্গীর গলা নামিয়ে বিড়বিড় করে বলল,,,
:-সব সময় খালি নিজের স্বার্থ হাসিলের ধান্দায়!!!
:-কিছু বললি?
:-না না ভাইজান, সে তুমি সরাও। কিন্তু এটাও মাথায় রেখো তৈমুর জাহান শিকদার কে কোন সিধে আদমী ভেবে হেলাফেলা করলে নিজের পায়েই কুড়াল মারবে।
সে যদি কোনভাবে টের পেয়ে যায় তাহলে তোমার যে হাল করে ছাড়বে তার জন্য তুমি নিজেই দায়ী থাকবে।
দাঁত কিড়মিড় করে উঠলেন এরশাদ হামিদ। ধমক দিয়ে বললেন,,
:-What do you mean? এসব ফালতু সতর্কবার্তা তুই তোর কাছে রাখ। এক তৈমুর জাহান শিকদার কেনো দুনিয়ার কারো ক্ষমতা নেই এই এরশাদ হামিদ কে টার্গেট করে! এসব তৈমুর-ফৈমুর আমার কাছে চুনোপুঁটির সমান! Got it.!!
জাহাঙ্গীর কবির তাচ্ছিল্য হেসে মনে মনে বললেন,,,
:-পিপিলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে!!
:- ভাইজান বলছিলাম যে, এদিকে তো আরেক সমস্যা তৈরি হয়েছে। আমার মনে হয় আগে এটা সটআউট করা উচিত! নয়তো আমাদের ভবিষ্যৎ খাতরে পড়তে পারে!
:-হুয়াট হ্যাপেন?
:-ভাইজান আমাদের চারপাশে কী হচ্ছে সেদিকেও একটু নজর দাও। গত একমাসে আমাদের পাঁচজন লোক হারিয়ে গেছে। যাদের দিয়ে আমরা ব্যবহার চালাতাম…আর অদ্ভুতভাবে তাদেরকে কেউ গভীর রাতে শহরের কোন এক সাধারণ ক্লিনিক বা হসপিটালে এডমিন করে রেখে যাচ্ছে। তাদের গার্ডিয়ান হিসেবে দেয়া হচ্ছে আমার হেল্থ হার্ট হসপিটালের নাম্বার। বুঝতে পারছো তুমি?
সবথেকে অবাক করা বিষয়,তাদের কে যখন পাওয়া যাচ্ছে আশ্চর্যজনক ভাবে কারো একটা কিডনি নেই,কারো একটা চোখ নেই, কারও লিভার নেই। কিন্তু কাউকে মৃত পাওয়া যায়নি। তাদের জ্ঞান ফিরলে জিজ্ঞাসা করলে কেউ কিছু বলতে পারছে না। অদৃশ্য
কেউ যেন আমাদের লোকদের টার্গেট করে তাদের অঙ্গগুলো কেটে নিচ্ছে, কিন্তু মেরে না ফেলে বাঁচিয়ে রেখে ফিরিয়ে দিচ্ছে। খুবই কদর্য ও ভয়ানক ভাবে উঠিয়ে নেয়া হচ্ছে তাদের। অপারেশনের ধরণ দেখে মনে হচ্ছে কোন প্রফেশনালের কাজ।
এরশাদ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,
— “তাতে কি?!”আমাদের ব্যবসা থামবে না। আগে মেয়েটাকে সরাও। সাবিকাকে আমি তালহার পাশে দেখতে চাই। ওর ভালোবাসার কাঁটা আমি নিজ হাতে উপড়ে ফেলবো। এরপর দেখা যাবে কে আমাদের পিছনে কলকাঠি নাড়ছে।”
জাহাঙ্গীর কবির একটু চুপ করে রইলেন। মনে মনে গর্জে উঠছে জাহাঙ্গীর কবির। বড়ভাই নামক লোকটাকে সে মন থেকে একেবারেই সম্মান করে না। শুধু মাত্র পৈতৃক সম্পত্তি এখনো বড়ভাইয়ের হাতে নিয়ন্ত্রিত দেখে মুখবুজে গোলামী খাটছে, সম্পত্তির হিসাব বুঝে নিতেই মুখে “থু” মেরে আসতে একবারও দ্বিধাবোধ করবে না সে। জোরে একটা শ্বাস ফেলে বললেন,,,
:-ভাইজান এই তৈমুরের প্রতি আমারো একটা পুরনো হিসাব বুঝে নেয়ার আছে, তৈমুরের প্রতি রাগটা আমার বেশ পুরোনো। ওর যা এটিটিউড! একেবারে হাই লেভেলের। আমি বিশেষ অনুরোধ করার পরেও হেল্থ হার্টে ও আর ওর বন্ধু ডঃ সায়ান মাহমুদ জয়েন করেনি। বাচ্চা চুরির কেসের পর তো আমিই তাদেরকে অফার করেছিলাম। আমাকে অপমান করেছিল ও। এবার যদি ওর বোন কে শেষ করা যায়… তাহলে প্রতিশোধও হবে, সাবিকাও পাবে ওর ভালোবাসার মানুষটাকে”
এরশাদ হামিদ সহোদরের কথা মন দিয়ে শুনলেন। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকালেন। গভীর অন্ধকার, কিন্তু তাঁর চোখে জ্বলছে আগুন।
:-তো কাজ শুরু কর জাহাঙ্গীর। এবার আমাদের ছায়া আরও গভীর হবে। হয়তো এবারও তোকে কোন রোড এক্সিডেন্টের রিপোর্ট তৈরি করতে হলো!! বলেই ক্রুড় হাসলেন তিনি।
রাতের নিস্তব্ধতা যেন থমকে দাঁড়ালো। বাতাসে বিষ ছড়িয়ে পড়লো যেন ধীরে ধীরে।,,
*********
সাতদিন পর হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ হলো সিমা শিকদার ও তার নবজাতক পুত্র। অ্যাম্বুলেন্স নয়, বরং নিজস্ব গাড়িতে করে পরিবারের সবাইকে নিয়ে তারা ফিরলো শিকদার হাউসে। বাড়ির মূল ফটকে লাল-সাদা বেলুন আর হাজারো ফুলে সাজানো,,,
সারা, রেশমী আর তুলি হাতে বরণ ডালা নিয়ে বরণ করে নিলো সিমা আর ছোট্ট বাচ্চাটাকে।
তৈমুর বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে একমনে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। গভীর মায়া আর ভালোবাসার চোখে,,,
তারপরই তৈমুর নিজের গম্ভীর অথচ স্নিগ্ধ কণ্ঠে বলল,
:- আমি আমার ভাইয়ের নাম আমি রাখছি, “তন্ময় জাহান শিকদার”। ‘তন্ময়’ মানে যে মনোযোগী, নিবিষ্ট। আমার ভাইয়ের জন্যই এ নাম। আশা করি, সবাই পছন্দ করবে।”
সবাই একসাথে বলে উঠলো,,,
:-দারুণ নাম! একেবারে মানানসই।”
সাইফ শিকদার হাসিমুখে দাঁড়িয়ে সকলের সামনে ঘোষণা করলেন,
:-আজ থেকে তন্ময় জাহান শিকদার হবে শিকদার হাউসের দ্বিতীয় কর্ণধার। তৈমুর যেমন আমাদের গর্ব, তেমন তন্ময় আমাদের ভবিষ্যৎ।”
চারপাশে তখন করতালি, হাসি, আনন্দের উচ্ছ্বাস। রিনা শিকদার চোখে জল নিয়ে বললেন,
— “আল্লাহ আমার মনের আশা পূরণ করো। বাড়িটায় ছোট্ট ছেলেটার হাসি, দুষ্টুমিতে ভরে উঠুক। জীবন মধুময় করুক।”
ড্রইং রুমে আরেক কোণে দাঁড়িয়ে সায়ান তুলির কানে কানে বলে,,,
:- ছোট শালা আমার হবে এক চিজ! হসপিটালে আমি যেই একটু কোলে নিয়েছি ওমনি শালা আমার গায়ে হিসু করে দিয়েছে!!
তুলি খিলখিল করে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে বললো,,,
:-বেশ হয়েছে! দেখতে হবে না কাদের ভাই!!
:-আআ,,,, শুধু ভাইকে নিয়েই ভাবলে হবে?? আমরাও তো একটা ডাউনলোড করতে পারি!!
:-ইশশ চুপ নির্লজ্জ! সবাই আছে এখানে!
সায়ান হাত নাড়িয়ে মাছি তাড়ানোর মতো করে বললো,,,
:- আরে ছাড়ো তো! তুমি বলো, আমাদের বাচ্চার নাম কী রাখবো?”
তুলি লাজুক হেসে পিঠে খোঁচা দিয়ে বললো,,,
:-আগে আসুক তো, তারপর দেখা যাবে!”
শিকদার হাউসের আঙিনায় তখন খুশির বৃষ্টি, যেন নতুন জীবন, নতুন আশার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে ছোট্ট তন্ময়ের আগমন।
***********
বিকেলের আলোটা জানালার কাঁচ গলে ঠিক যেন রেশমির গালের উপর এসে পড়ছে। সে মাথা নিচু করে বসে আছে। তালহা তার ঠিক সামনে। চোখে চশমা, মুখে হালকা এক অদ্ভুত প্রশান্তির ছায়া।
রেশমি গুনগুনিয়ে বলে,,,
:-আপনি জানেন, ভার্সিটি চলাকালে রেস্টুরেন্টে এভাবে আসাটা কতটা বিপজ্জনক! কেউ দেখে ফেললে কি হবে!
তালহা ঠোঁটে এক চঞ্চল হাসি মেখে বলল,,,
:-পেয়ার কিয়া তো ডারনা কিয়া মেরি জান। আর ভালোবাসলে একটু ঝুঁকি নিতেই হয়।
তালহার গলায় গভীর মোহময় এক উচ্ছাস,,,যেটা অনুভব করে রেশমির মুখে রক্তিম আভা ছড়িয়ে দিলো।
ওরা দুজনেই নিজেদের ছোট ছোট গল্প ভাগ করে নিচ্ছিলো। রেশমি কফির কাপে চুমুক দিতেই টেবিলের নিচে তালহার হাত ধীরে ধীরে এসে ছুঁয়ে দিলো রেশমির হাত। কিছু টা চমকে উঠলো রেশমী। অবাক হয়ে তাকালো তালহার দিকে।
তালহার ঠোঁট জুড়ে দুষ্টু হাসি খেলা করছে। ওদের দুজনের চোখেই তখন একটাই ভাষা,ভালোবাসা।
ঠিক তখনই রেস্টুরেন্টের দরজা ঠেলে প্রবেশ করলো সাবিকা। তার চোখে আগুন, ঠোঁট শক্তভাবে চেপে ধরেছে সে। চারদিকে চোখ বুলিয়ে রেশমিকে দেখেই মুখ বিকৃত করে ফেললো। সকালে সে বাবার কাছ থেকে রেশমির ছবি দেখেছে। ভার্সিটিতে এসেছিল রেশমির সাথে দেখা করতে ,মূলত তাকে থ্রেট দিতে। এসে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলো রেশমি এখানে এসেছে।
কিন্তু এসে যখন তালহাকে তার সাথে বসে থাকতে দেখলো, তখন যেন পুরো পৃথিবী তার চোখের সামনে ভেঙে পড়লো।
সাবিকা ওদের দিকে এগিয়ে গিয়ে হিংস্র গলায় বললো,,,
“তুইই তাহলে সেই মেয়ে? যার জন্য তালহা আমাকে রিজেক্ট করেছে!
রেশমি চমকে তাকায়। অপরিচিত মুখ, কিন্তু মেয়েটার দৃষ্টিটা তীক্ষ্ণ ,যেন পারলে রেশমীর গায়ে আগুন ছুঁড়ে মারবে ।
রেশমি থতমত খেয়ে তালহার দিকে তাকালো। তালহা চোখ মুখ কুঁচকে বসে আছে। রেশমী আবারো মেয়েটার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। বললো,,,
:-আপনি কে?”
সাবিকা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,,
:-তোকে এখন আমার পরিচয় দিতে হবে?। তোর মতো একটা ছোটলোক মেয়ে, ক্যারিয়ার নিশ্চিত করতে বড়লোক পুরুষদের ফাঁসাতে ভালোই শিখেছিস মনে হয়!”
তালহা এবার রেগে উঠে দাঁড়ায়,,
:-সাবিকা! মাইন্ড ইয়োর ল্যাংগুয়েজ। তুমি জানো না তুমি কার সঙ্গে কথা বলছো!”
সাবিকা তালহার দিকে তাকিয়ে, বিদ্রুপের হাসি হেঁসে বলে,,
:-তুমি তো জানো আমাদের বিয়ের কথা চলছে। ভালোবাসি আমি তোমাকে। আর তুমি কিনা এই ছোটলোক মেয়েটার জন্য আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছো! এর চেহারায় যতটা ভদ্রতা, চালচলনে তো বেশ্যামি ঝরে পড়ছে! শেষমেষ কিনা তারই ভার্সিটির টিচারের সাথে,,,, ছিঃ না জানি পরিক্ষায় নিজের র্যাঙ্ক বাড়ানোর জন্য আর কোন কোন টিচারের সাথে শুয়েছে।
রেশমির মুখ ফ্যাকাসে। চোখে জল চলে আসে অপমানের তীব্রতায়। কতটা জঘন্য চিন্তাভাবনা হলে একজন মেয়ে আরেকটা মেয়েকে এতো নিচু করে কথা বলতে পারে। এই তাহলে সেই “সাবিকা”
কান্না সংবরণ করতে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে রেশমী। শব্দ করতেও যেন ভুলে গেছে। কেউ যেন গলাটা চেপে ধরেছে রেশমীর।
তালহার মুখ লাল হয়ে যায় রাগে। তালহা কঠিন গলায় চিৎকার করে ধমকে ওঠে,,,
:-Enough! তোমার সাহস কি করে হয়! তুমি এখানে এসেছো ওকে থ্রেট দিতে এসব নোংরা কথা বলতে, ওকে ছোটলোক বলতে। আসলে ছোটলোক, ছ্যাঁচড়া তো তুমি।
রেশমীর বাহু ধরে হ্যাঁচকা টানে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে বলে,,,
:- জানতে চাও ও কে? তাহলে শোনো, হ্যাঁ রেশমি আমার ছাত্রী তো!! ও আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ আমার ভালোবাসা। তার অপমান মানে আমার অপমান। আর ওর সম্পর্কে একটা বাজে কথা আমি সহ্য করবো না।
তুমি একটা জঘন্য ম্যানার্সলেস মেয়ে। জঘন্য থেকে জঘন্যতর তোমার মনের ভেতরটা। তোমার সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি! আমি প্রেজেন্ট থাকা সত্ত্বেও তোমার সাহস কি করে হয়, ওকে এতগুলো বাজে কথা বলার?
সাবিকা চোখ রাঙ্গানো ভঙ্গিতে রেশমির দিকে তাকিয়ে বলে,,,
:-ভালোই তো হাত করেছিস। কিন্তু লাভ হবে না, তালহা আমার। তালহার সাথে আমার বিয়ে হবে। বুঝেছিস তুই?
বলেই রেশমির গালে চড় মারতে উদ্যত হয় সাবিকা। মুহূর্তেই সাবিকার হাত ধরে ফেলে তালহা। উল্টে সাবিকার গালে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে কষে একটা থাপ্পড় মেরে দেয়। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে,,,
:-তোমার সাহস তো কম নয়,আমার ভালোবাসার মানুষকে অপমান করলে, আবার তার গায়ে হাত তুলতে যাচ্ছো? তুমি কি ভেবেছো আমি চুপ করে থাকবো? না, এবার থেকে প্রতিটি সীমা ছাড়ালে আমিও তোমাকে সহ্য করবো না!”
তালহার থেকে থাপ্পড় পেতেই ক্রোধে রক্তিম চোখজোড়া তুলে তাকায় সাবিকা। রেশমীর দিকে তাকিয়ে বলে,,
:-ওকে বিয়ে করবি? তার আগেই তোর পরিবারের সন্মান ধূলিসাৎ হবে। ভার্সিটিতে পড়তে এসে সেই ভার্সিটির টিচারের সাথেই অবৈধ সম্পর্ক করলে কি হাল হয় তোর দেখবি এবার।
তালহার কণ্ঠে বজ্রগর্জন ঝড়ে পড়ে। সাবিকার কথায় মাথা গরম হয়ে গেছে তার। রাগে থরথর করে কাঁপছে তালহা,,,
:-যথেষ্ট হয়েছে সাবিকা । দিন দিন তোমার এই অসভ্যতা আর উগ্রতা অসহনীয় হয়ে উঠছে! আমি তোমাকে বিয়ে করবো না! ভালোবাসি না! এটাই চূড়ান্ত। আর তুমি যে রকম ছ্যাঁচড়ার মতো ব্যবহার করছো, তাতে আমার তোমাকে অপছন্দ করাটাই স্বাভাবিক!”
সাবিকা কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকলো চুপচাপ। তার ভেতরটা জ্বলছে, তার ইগো, তার হিংসা আর তার ব্যর্থতা… সব একসাথে যেন গলা চেপে ধরছে তাকে।
রেশমীর দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,,,
:-এখন না, পরে দেখা হবে তোর সাথে।হিসেব টা তোলা রইলো। তখন বুঝবি তুই কোন খেলায় পা দিয়েছিস।
তারপর সাবিকা ঝড়ের মতো রেস্টুরেন্ট ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।
রেস্টুরেন্টে টেবিলের চারপাশে চাপা উত্তেজনা। রেশমি স্তব্ধ। তালহা ধীরে ধীরে তার মাথাটা বুকের মাঝে ঝাপটে ধরে, সান্ত্বনার ছোঁয়ায়। কান্নার তোপে কেঁপে কেঁপে উঠছে রেশমীর নরম শরীরটা।
#চলবে
#সারা_জাহান
পর্ব,,,,৩৮
মৌমো তিতলী
❤️
সাবিকার চোখ টকটকে লাল, রাগে কাঁপছে। রেস্টুরেন্ট থেকে ফিরে সোজা বাড়িতে ফিরে তার বাবার ঘরে ঢুকে পড়লো। এরশাদ হামিদ সোফায় বসে খবর দেখছিলেন। মেয়েকে কাঁদতে দেখে তার ভ্রু কুঁচকে গেলো।সাবিকা এসেই বাবার পায়ের কাছে বসে কাঁদতে লাগলো। এরশাদ হামিদ মেয়ের কান্না দেখে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলেন,,
:- কী হয়েছে সাবিকা? তোমার এই অবস্থা কেনো?
সাবিকা কাঁদতে কাঁদতে ঝাঁপিয়ে পড়লো বাবার কোলে।
:- বাবা! তালহা… ওই ছোটলোক মেয়েটার জন্য… ওর জন্য তালহা আমাকে থাপ্পড় মেরেছে! আমার গায়ে হাত তুলেছে বাবা! তোমার মেয়ের গায়ে হাত তুলেছে!
এরশাদ হামিদের চোখে আগুন লাল হয়ে উঠলো।
:- কী বললি? আমার মেয়ের গায়ে হাত তুলেছে?! তালহা!
সাবিকা ফুঁপিয়ে বললো…
:-শুধু হাতই তোলেনি। আমাকে ছোটলোক বলেছে… আর ওই রেশমি… তার সাথে তালহার সম্পর্ক, রেস্টুরেন্টে বসে আদিখ্যেতা করছিলো… বাবা তুমি তো সব পারো… সরাও ওই মেয়েটাকে রাস্তা থেকে। আমি আর সহ্য করতে পারছি না!
এরশাদ হামিদ দাঁত কিড়মিড় করে উঠলেন।
এবার যা করার তিনি করবেন বলে সাবিকা কে বুঝিয়ে তার রুমে পাঠিয়ে দিলেন। ফোন টা হাতে নিয়ে কল লাগালেন আলভীকে। ফোন রিসিভ হতেই,,,
:- হ্যালো আলভী! তোমার ভাইয়ের সাহস কী করে হয় আমার মেয়ের গায়ে হাত তোলার?!
আলভী ফোনের ওপাশে থতমত খেয়ে গেলো। ভ্রু কুঁচকে বললো,,,
:-আপনি কিসের কথা বলছেন ঠিক বুঝলাম না !
:- কি বুঝলে না হ্যাঁ! তোমার ভাই তালহা সাবিকাকে অপমান করেছে, থাপ্পড় মেরেছে! How dare your brother? আমি এরশাদ হামিদ! তুমি কি ভুলে গেছো আমি কি করতে পারি?
:- না আমি এখনো বুঝতে পারছি না আপনি কি বলছেন…আমার ভাই সাবিকা কে কেনো মারতে যাবে?
এরশাদ হামিদ রেস্টুরেন্টে ঘটা সবকিছু আলভী কে জানিয়ে হুমকি দেন,,
:- তোমার ভাই যা করেছে তার জন্য আমি ওকে ছেড়ে দেবো না। আর ওই মেয়েটাকেও না। ওই মেয়েটার জন্য আমার মেয়েকে অপমান করেছে তালহা! রেশমী শিকদার বলে কেউ থাকবে না তালহার জীবনে। আমি যখন বলেছি তালহা কে আমার মেয়ে সাবিকা কেই বিয়ে করতে হবে। And this is the final!! তুমি তোমার ভাই কে বোঝাও। নয়তো এর পরিণাম ভালো হবে না। মনে রেখো!
এই রেশমী শিকদার নামটা শুনতেই থমকে গেলো আলভী।
:-আপনি কী নাম বললেন? রেশমি শিকদার?!
:-হ্যাঁ, কোন এক ডঃ তৈমুর জাহান শিকদারের বোন! তোমার ভাই কে রাজি করাও। নয়তো এই মেয়ের পরিনতিও তার মতো হবে। যেমন টা অনেক বছর আগে কারো হয়েছিলো! বলেই লাইন কেটে দিলেন এরশাদ হামিদ।
আলভীর শরীরে হীম শীতল শিহরণ বয়ে গেলো। গলার স্বর কেঁপে উঠলো। অস্ফুট স্বরে বিড়বিড় করে বললো,,,
মেয়েটা কি আমার বন্ধু তৈমুরের বোন? যদি এমনটা হয় তাহলে তো ঝড় আসতে চলেছে! তৈমুর কে জানাতে হবে,,, এখনই জানাতে হবে। তড়িঘড়ি ফোনে ডায়াল প্যাডে তৈমুরের ফোন নম্বর খুঁজতে লাগলো আলভী। উত্তেজনায় হাত কাঁপছে আলভীর,,
নাম্বার টা মিলতেই অবিলম্বে ফোন করলো তৈমুরকে।
ওপাশ থেকে কল রিসিভ হতেই হড়বড় করে বললো আলভী,,,
:-তৈমুর, তোর সঙ্গে জরুরি কথা আছে!
:-বল আলভী, কী হয়েছে!
:- বলছি তোর বোন আছে না রেশমি!!… সে কি তালহার ভার্সিটিতে আছে?
তৈমুর একটু থমকে যায়… মনে মনে কিছু যোগসূত্র মিলিয়ে নিয়ে বলে,,,
:-হ্যাঁ কেনো?
আলভী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,,,
:-Something is going to go wrong, Taimur, I think the girl,, Talha loves Resmi,,
:-হুয়াট!! Are you crazy?
:- No, no, you don’t understand, Taimur. কিছুক্ষণ আগেই আমার শশুর ফোন করেছিলেন।
:-তো!
আলভী সবকিছু খুলে বললো তৈমুর কে। সবকিছু শুনে তৈমুরের কপালে ভাঁজ দেখা দিলো! গম্ভীর স্বরে বললো,,,
:-Don’t worry, I’m talking to Reshmi….
:-হুম। ফোন রাখে আলভী।
তৈমুর নিজের রুম থেকে বেরিয়ে রেশমীর রুমে ঢোকে। রেশমী বিছানায় বসে ফোনে স্ক্রল করছিলো। হঠাৎ ভাই কে দেখে হকচকিয়ে যায়। তৈমুর সচারচর বোনেদের কামরায় আসে না। এভাবে হুট করে তৈমুর কে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে গেলো রেশমী। তৈমুরের মুখের দিকে তাকিয়ে ভয়ে ঢোক গিলতে লাগলো। মনে হচ্ছে রেগে আছে তৈমুর। রেশমী মিনমিন করে বলে,,
:-কি হয়েছে ভাইয়া?
তৈমুর সরাসরি রেশমির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে…
:- একটা কথা জিজ্ঞাসা করছি। সত্যিটা বলবি। তোর কি তোর ভার্সিটির স্যার তালহার সঙ্গে কোনো সম্পর্কে আছে?
রেশমি তৈমুরের মুখ দেখে মিথ্যা বলার সাহস হলো না। অশান্তভাবে মাথা নিচু করে বললো…
:-হ্যাঁ ভাইয়া। আমি ওকে ভালোবাসি।
আর তালহা?
:-সেও আমাকে ভালোবাসে।
তৈমুর একটু চুপ করে যায়। চোখের দৃষ্টিটা কঠিন হয়। পরমুহূর্তেই বলে,,,
— ওকে বলে আমার সাথে দেখা করতে। আমি তার সাথে কথা বলতে চাই। আর হ্যাঁ বাড়ির কাউকে এখন কিছু বলার দরকার নেই। বলে হনহন করে বেরিয়ে গেলো তৈমুর।
তৈমুর বেরিয়ে যেতেই হাফ ছেড়ে ধপ করে বসে পড়লো রেশমী,,, মাথায় চিন্তার ঝড়,,, তৈমুর ভাইয়া কি করে জানলো ,,,আর কি এমন হয়েছে যে হুট করে তালহার সাথে কথা বলতে চাইছে,,,
ঠোঁট উল্টে বিড়বিড় করে রেশমী। অগত্যা তালহা কে ফোন করে জানায় তৈমুরের কথা!
**********
শহরের বুক চিরে ধীরে ধীরে নেমে এসেছে সন্ধ্যা । পশ্চিম আকাশের শেষ সূর্যের আভা ম্লান হয়ে সোনালি থেকে রূপালি হয়ে উঠছে। দূরের দালানগুলোর মাথায় আবছা আলো লেগে এখনো। চারপাশে গাড়ির হেডলাইট জ্বলে উঠেছে, ট্রাফিক সিগন্যালে আলো বদলাচ্ছে লাল, সবুজ, হলুদ—যেন শহরের নিজস্ব ভাষায় সন্ধ্যার আগমনী সুর।
পাশের মসজিদ থেকে ভেসে আসছে মাগরিবের আজান—নরম, হৃদয় ছোঁয়া। একটুখানি বিষণ্ণতা, একটুখানি শান্তি—এই সন্ধ্যা যেন এক পলক চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে শহরের মুখোমুখি।
তালহা মাগরিবের নামাজ আদায় করেই হসপিটালে আসে। তার চোখে গম্ভীরতা, ভিতরে উত্তেজনা ও দ্বিধা। তৈমুর জাহানের ব্যক্তিত্ব সে ভালো করেই জানে—শান্ত, তীক্ষ্ণ এবং ভয়ংকর রকম প্রভাবশালী তৈমুর জাহান শিকদার। রেশমীর বিষয়ে কথা বলতেই যে আজ তাকে তলব করা হয়েছে তা সে জানে। সত্যি বলতে তৈমুরের সামনে যেতে একটু নার্ভাস লাগছে তালহার। মনের ভেতরে অদ্ভুত ভয় দানা বাঁধছে,, ডঃ শিকদার মেনে নিবে তো তাদের সম্পর্ক!
হসপিটালের চেম্বারে প্রবেশ করে সে। তৈমুর একটি ক্লিনিক্যাল রিপোর্ট হাতে নিয়ে বসে ছিলো তখন। তালহা সালাম দিলে তালহার উপস্থিতি অনুভব করে মাথা তোলে তৈমুর।
তৈমুর সালামের জবাব দিলো। চোখের দৃষ্টি স্থির রেখে তালহা কে বলে,,,,
:- এসো তালহা। বসো।
তালহা সম্মান জানিয়ে বসে পড়ে।
:- তুমি করেই বলছি! যেহেতু তুমি আমাদের বন্ধু তালহার ছোট ভাই,সেদিক থেকে আমারও ভাইয়ের মতো। আলভীর ভাই হওয়ার সুবাদে তোমাকে অনেক আগেই চিনতাম। কিন্তু আজ প্রথমবার তোমাকে ব্যক্তিগতভাবে ডাকতে হলো। কারণটা তুমি বুঝতে পারছো নিশ্চয়ই?
তৈমুরের সাবলীল ব্যবহারে কিছুটা সুস্থির হয় তালহা। মাথা নাড়িয়ে সরাসরি বলে,,
:-হ্যাঁ ভাইয়া। আপনি জানতে পেরেছেন আমি রেশমীকে ভালোবাসি।
তৈমুর গলা শক্ত করে বলে,,
:- শুধুই ভালোবাসো?—ওর সঙ্গে তোমার সম্পর্ক আছে, ওর জীবনে সবচেয়ে বড় উপস্থিতি তুমি… অথচ আমি কিছুই জানতাম না। কতদিনের সম্পর্ক তোমাদের?
তালহা শান্ত গলায় বললো,,
:-ভাইয়া আমাদের সম্পর্ক লুকিয়ে রাখার কারণ ছিলো রেশমীর সম্মান, যদিও আমাদের সম্পর্ক খুব বেশি সময় হয়নি। কিন্তু আমি ওকে সম্মান করি, অনেক আগে থেকেই ভালোবাসি। আমার কোন ভুল উদ্দেশ্য নেই।
তৈমুর কিছুক্ষণ চুপ থাকে। তারপর গলা নিচু করে বলে,,,
:-রেশমী আমার বোন। মেয়েটাকে কেউ চোখের জল ফেলালে আমার রক্ত জ্বলে যাবে স্বাভাবিক। রেশমী আমার কাজিন হলেও তুলি আর রেশমী আমার কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ।
তালহা নিচু মাথায় শুনে।
তৈমুর সোজা হয়ে বসে। আবারো বলে,,
:- তুমি ওকে ভালোবাসো, ঠিক আছে। কিন্তু রেশমীর জীবনে তোমার এই উপস্থিতি এখন বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তালহা ভ্রু কুঁচকে তাকায়,,,
:-কী রকম বিপদ?
তৈমুর সামনে কাঁচের টেবিলের ওপর আঙ্গুল দিয়ে ঠকঠক আওয়াজ করে। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলে,,,
:-এরশাদ হামিদ। তোমার বড় ভাইয়ের শশুর। এই লোকটা তার ছোট মেয়ে কে তোমার সাথে বিয়ে দিতে চাই!
তুমি রেশমীর কারণে তাকে রিজেক্ট করেছো। তাতে হুমকি দিয়েছে এরশাদ হামিদ। তিনি যা বলেছেন, আমি হালকাভাবে নিইনি। ওনার ক্ষমতা আছে, সাহসও আছে নোংরা পথে নামার। তোমাদের সম্পর্ক নিয়ে সে ভবিষ্যতে সমস্যা সৃষ্টি করবে। সরাসরি হুমকি দিয়েছে সে।
তালহার চোখদুটো রক্তিম হলো মুহুর্তেই। রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,,,
:-ও আমার রেশমীকে কিছু করতে পারবে না, তৈমুর ভাইয়া। আমি থাকতে…
তৈমুর কঠিন চোখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো তালহার দিকে,,,
:-কথা নয়, কাজে করে দেখানোর সময় এখন। তুমি যদি সত্যিই রেশমীর পাশে থাকতে চাও, তাহলে আগে নিজেকে প্রস্তুত করো—ওকে রক্ষা করার জন্য, সম্মানের সাথে তোকে ওকে আগলে রাখতে হবে।
তালহা দৃঢ় কণ্ঠে বললো,,
:-আমি প্রতিজ্ঞা করছি, ওকে কেউ আঘাত করতে পারবে না। আমি থাকব, সব সময়, রেশমীর জন্য।
তৈমুর একটু নিঃশ্বাস ছেড়ে হালকা মাথা নাড়ে।
:-আমি তোমাকে বিশ্বাস করছি তালহা। কিন্তু মনে রাখো, যদি রেশমীর চোখে একফোঁটা কান্নাও দেখেছি তো…
তালহা সোজা তৈমুরের দিকে তাকিয়ে বলে ,,
:-আমি চ্যালেঞ্জ নিচ্ছি, সে মুহূর্ত কখনো আসবে না।
দুজনের মাঝে এক গভীর নীরবতা নেমে এলো। কিন্তু সেই নীরবতার ভেতরে জন্ম নিলো সম্মান,ভরসা, দৃঢ়তা। দুই পুরুষ—একজন ভাই, একজন প্রেমিক। একটি মেয়ে যাকে, দু’জনেই রক্ষা করতে চায়।
********
রিনা শিকদার বসে আছেন ড্রইংরুমে পাশেই সিমা শিকদারের কোলে ছোট্ট তন্ময়। তাকে নিয়ে দুই জা আদরে মাখামাখি সময় পার করছেন। তুলি, রেশমী,সারা তিনজনই ভার্সিটিতে। সিমা শিকদারের প্রেগন্যান্সির পুরোটা সময় আলিফ শিকদার বাড়িতে কাটিয়েছেন। অনেক দিন খামার বাড়ির কাজ নিজ হাতে করতে পারেননি তাই সাইফ শিকদার কে সাথে নিয়ে আলিফ শিকদার গেছেন তার শখের খামার বাড়িতে। এই সময় তৈমুরও বাড়িতে থাকে না। শিকদার হাউস মূলতো এই সময় ফাঁকায় থাকে। কিন্তু কোন কারনে তৈমুর কিছুক্ষণ আগে বাড়িতে এসেছে। কোন গুরুত্বপূর্ণ ফাইল নিতে। সাথে সায়ানও আছে। দুজনেই তৈমুরের রুমে বর্তমান।
ঠিক এমন সময় শিকদার হাউসের সদর দরজায় দেখা দিলো একটা পরিচিত মুখ। লুবানা ।
অনেকদিন পর লুবানা কে দেখে রিনা শিকদার ,সিমা শিকদার দুজনেই বেশ বিস্মিত হন। রিনা শিকদার হাসিমুখে বলেন,,,
:-আরে লুবানা! কেমন আছো মা? বহুদিন পর!
লুবানা হালকা হাসি দিয়ে বলে,,,
:-ভালোই আছি আন্টি। আসলে আমি একটু বিজি ছিলাম তাই সিমা আন্টির বেবির কথা শুনেও আসতে পারিনি। এখন সময় পেয়ে চলে এলাম।
লুবানা হাসিমুখে কথাগুলো বললেও তার আসল উদ্দেশ্য ভিন্ন। লুবানা শিকদার হাউজে অবস্থানকালে এটা নোটিশ করেছিলো, এই সময় সিকদার হাউজের পুরুষেরা প্রায় কেউ বাড়িতে থাকে না। এই সুযোগটা কাজে লাগাতেই লুবানা নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যেই এসেছে।
লুবানা হাসিমুখে তন্ময় কে দেখে। তাতে গিফটও দেয়। রিনা শিকদার, সীমা শিকদার দুজনেই লুবানাকে বেশ ভালো মেয়ে বলেই জানে। তাই তারা বিষয়টা খুবই স্বাভাবিক ভেবে খুশি হন।
কিছুক্ষণ পর লুবানা রিনা শিকদারের পাশে বসে নিচু গলায় বলে,,,
:-আসলে আন্টি আমি আপনাকে একটা জিনিস দেখাতে এসেছি।
রিনা অবাক হন। ভ্রু কুঁচকে তাকায় লুবানার দিকে। সিমা শিকদারের চোখেও প্রশ্ন। লুবানা চতুর দৃষ্টিতে দুজনকে পরখ করে নিলো। তারপর নিজের পার্স থেকে মোবাইল বের করে কিছু ছবি দেখাতে শুরু করে রিনা শিকদার কে।
ছবিতে সারা আর আব্রর কিছু ছবি,যেগুলোতে দেখা যাচ্ছে সারা কলেজের সিনিয়র আব্রর সাথে কথা বলছে, হাসছে, একটা-দুটা ঘনিষ্ঠ মূহূর্তও লেন্সে ধরা পড়েছে।
লুবানা গলা নিচু করে বলে,,
:-আন্টি, আপনি তো সারাকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসেন। আমি জানি সে এখন শুধু আপনার বোনের মেয়েই না। সে এখন তৈমুরের ওয়াইফ। কিন্তু সে কি আসলেই আপনাদের আর আপনার ছেলের ভালোবাসার যোগ্য?
রিনা শিকদার চোখ বড় বড় করে ছবিগুলো দেখতে থাকে। নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না তিনি। বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে লুবানার দিকে তাকিয়ে বলেন ,,,
:-তুমি কী বলতে চাও?
লুবানা চোখে ক্রুড় হাসি। কিন্তু মুখটা যারপরনাই মলিন করে বলে,,,
:-দেখুন আন্টি আমি এগুলো আপনাদের বলতে চাইনি। কিন্তু আমি তৈমুরকে অনেক আগে থেকেই ভালোবাসি, এটা তৈমুর নিজেও জানে। কিন্তু তৈমুর যেহেতু সারা কে ভালোবাসে তাই আমি ওদের মাঝে কখনো বাধা হয়নি। আমি তো শুধু নিজের ভালোবাসা ভুলে ওকে সুখি দেখতে চেয়েছিলাম।
কিন্তু আন্টি সারার ভোলাভালা নিষ্পাপ চরিত্রের পেছনে যে এমন একটা রুপ আছে সেটা জানার পর আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না। কারণ আমি চাই না তৈমুর ঠকে যাক। সারার সঙ্গে এই ছেলেটির সম্পর্ক একেবারে স্বাভাবিক নয়। দেখুন না নিজেই ছবিগুলো…
ঠিক তখনই পেছন থেকে গর্জে ওঠে তৈমুরের হুঙ্কার!!
সায়ানও ফাইল হাতে থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে সিঁড়িতে। আসলে তৈমুর আর সায়ান ফাইল নিয়ে নিচেই আসছিলো। কিন্তু ড্রইং রুমে পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে দাঁড়িয়ে পড়েছিলো তৈমুর। ফলশ্রুতিতে লুবানার বলা প্রত্যেকটা কথা তৈমুর আর সায়ানের কর্ণগোচর হয়েছে।
রাগে থরথর করে কাঁপছে তৈমুর। চোখ দুটোতে যেন আগ্নেয়গিরির লাভা বের হচ্ছে। সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে হুঙ্কার দেয় তৈমুর,,,
:- আমার সারার নামে আর একটা বাজে শব্দ উচ্চারণ করলে গলা চিরে ফেলবো, লুবানা!
লুবানা স্তব্ধ। মোবাইল প্রায় হাত থেকে পড়ে যাওয়ার উপক্রম। ভয়ে তটস্থ হয়ে চোখ বড়বড় করে তৈমুরের দিকে তাকিয়ে আছে লুবানা। এই মুহূর্তে তৈমুর কে সে দুঃস্বপ্নেও আশা করেনি তা তার দৃষ্টিতেই স্পষ্ট!
সায়ান দৌড়ে এসে দাঁড়ায় তৈমুরের পাশে। তার মুখ টাও থমথমে।
রিনা শিকদার,সীমা সিকদার দু’জনেই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে।
তৈমুর অগ্নিমূর্তি হয়ে রুমানার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। একপ্রকার থাবা দিয়ে লুবানার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে ছবিগুলো দেখতে থাকে। চোখদুটো রক্তিম বর্ন ধারন করেছে। কঠোরতায় চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তৈমুরের।
লুবানার দিকে ক্রোধানিত্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,,,
:-এই বালের ছবি? এই বাজে ভুয়া ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল দিয়ে তুই প্রমাণ করতে চাস আমার সারা খারাপ? তুই জানিস, ওর একেকটা হাসি, একেকটা চাহনি কতটা পবিত্র? ও আমার চোখের সামনে বড় হয়েছে। ওকে আমি শুধু ভালোবাসি না, ওকে ওর থেকে বেশি আমি জানি,ও আমার রক্তে মিশে আছে। সারা একমাত্র মেয়ে যার প্রতি আমার বিশ্বাস আসমান-জমিন ভর্তি। আর তুই কিনা তাকেই কলঙ্কিত করতে চাস? How dare you?
লুবানা তৈমুরের ক্রোধ দেখে ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড ভয়ে তটস্থ হয়ে আছে। কোনমতে ঢোক গিলে কাঁপা গলায় বলে,,,
:-আমি তো শুধু…..
তৈমুর আঙুল তুলে থামিয়ে দেয় লুবানাকে,,,
:-তুই কিছুই করতে পারবি না! তোর এই লো ক্লাসের চাল এখানে খাটবে না। আরে যে ভালোবাসার সম্মানটুকু কখনো বুঝতে পারে না সে অন্য কাউকে কি করে ভালোবাসবে? আমি তোকে পাত্তা দিইনি, তাই এখন আমার স্ত্রীর নামে,আমার সারার নামে মিথ্যা কথা বলে প্রতিশোধ নিতে এসেছিস?
সায়ান অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে লুবানার দিকে। লুবানা যতই হোক তাদের বন্ধু। তৈমুর কে এতো বিরক্ত করলেও সায়ান কখনো লুবানাকে এতো জঘন্য ভাবেনি। অথচ সেই কিনা আজ…..
সায়ান লুবানার দিকে তাকিয়ে ধীর স্বরে বলে,,,
:-তোমার এতো জঘন্য দুঃসাহস কী করে হলো লুবানা ?শিকদার হাউসে ঢুকে এসব নোংরামি করার কথা তুমি ভাবলে কি করে? তুমি কি ভুলে গেছো কোথায় দাঁড়িয়ে কার সম্পর্কে কালি ছেটাতে এসেছো? আমাদের বন্ধুত্বের এই মান রাখলে তুমি?
তৈমুর সায়ান কে দেখে শান্তস্বরে বললো,,,
:-সায়ান,এই মেয়েটাকে এখনই বের হয়ে যেতে বল। নয়তো আমার হাত উঠে যাবে। ওকে বলে দে আজ থেকে এই বাড়িতে ওর প্রবেশ নিষেধ। এই মুহূর্ত থেকে তৈমুর জাহান শিকদারের জীবনে লুবানা নামের কোন বন্ধুর অস্তিত্ব নেই।
সায়ান লুবানার দিকে তাকিয়ে বলে,,,
:-এখানে দাঁড়িয়ে থেকো না। চলে যাও। সায়ান মনে মনে ভয়ে ঢোক গিলছে। তৈমুরের সারার প্রতি অবসেশনের কথা তার অজানা নয়। আর তৈমুরের রাগ সম্পর্কে তার থেকে ভালো আর কে জানে। তৈমুর আদতে যে কতটা ভয়ংকর তা সায়ানের থেকে হয়তো কারো বেশি জানা নেই।
লুবানা আর কিছু বলার সাহস করলো না। মুখ কালো করে বেরিয়ে গেলো শিকদার হাউস থেকে। পেছন ফিরে তাকাতেও সাহস হলোনা তার।
রিনা শিকদার কাঁপা গলায় বললেন,,
:-এসব কি হচ্ছে জাহান! আমি তো কিছুই বুঝতে পারলাম না। লুবানা হঠাৎ এসে সারার নামে এগুলো কেনো বললো? আর এসব ছবি …মানে হচ্ছে টা কি এগুলো?
তৈমুর সায়ানের দিকে তাকিয়ে ইশারা করতেই সায়ান রিনা শিকদারের পাশে গিয়ে রিনা শিকদার কে সোফায় বসিয়ে দিলো। ডাইনিং টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি এনে রিনা শিকদারের হাতে দিয়ে বলল,,,
:- কিছু হয়নি আন্টি। লুবানা ভুল বুঝেছে। সাথে তোমাদেরকেও ভুল বুঝানোর চেষ্টা করেছে। ছেড়ে দাও। তুমি বরং ছোট আন্টিকে নিয়ে ঘরে যাও। দেখো ছোটভাই এসব দেখে ভয় পেয়েছে!
রিনা শিকদার পাশ ফিরে সিমার কোলে পিটপিট করে তাকানো তন্ময়ের দিকে তাকালেন। সিমাও হাঁ করে তাকিয়ে আছে সবার দিকে। রিনা গিয়ে তন্ময় কে কোলে তুলে নিয়ে সিমাকেও একহাতে উঠতে সাহায্য করলেন। তারপর আস্তে আস্তে সিমার রুমের দিকে এগিয়ে গেলেন। রিনা শিকদার যেতেই তৈমুর চোয়াল শক্ত করে বললো,,,
:-আমার সারার নামে কলঙ্ক লেপন করার চেষ্টা করেছে লুবানা,,,এর শাস্তি ওকে পেতে হবে সায়ান… আমার হৃদস্পন্দন সারা, ওকে নিয়ে কেউ কিছু বললে আমি ভুলে যাবো সমাজের চোখে আমি কোন জেন্টলম্যান। ডঃ তৈমুর জাহান শিকদারের ভয়ঙ্কর রুপ দেখবে তখন সে।
সায়ান ঢোক গিলে। তৈমুরের কাঁধে হাত রেখে শান্ত করার চেষ্টা করে!
#সারা_জাহান
পর্ব,,,৩৯
#মৌমো_তিতলী
❤️
রাত তখন গভীর। চারদিক নিস্তব্ধ।
শুধু তৈমুরের হাত শক্ত করে ধরে আছে স্টিয়ারিং হুইল। একমনে ড্রাইভ করছে তৈমুর। পাশেই সায়ান অস্থির হয়ে কাউকে ফোন ট্রাই করছে!
কিছুক্ষণ আগে থানা থেকে জানিয়েছে মুকুল জেল থেকে পালিয়েছে। নিউজ টা জানার পর থেকে মেজাজ খারাপ তৈমুরের। দুপুরে লুবানার করা নাটকে এমনিতেই পুরোটা দিন জুড়ে রেগে আগুন হয়ে ছিলো তৈমুর। এবার যেন সেই আগুনে কেউ পেট্রোল ঢেলে দিয়েছে।
বেশ কিছুক্ষণ পরে কাঙ্খিত নাম্বারে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয় সায়ান। এতক্ষন ফোন রিসিভ না করাতে শুরুতেই কিছু বাংলা গালি ছুড়লো সায়ান।
:-ওই শালার খা*কির পোলা! কোন শাউ*ওই ঢুকে বসে থাকিস ফোন রেখে?
:-বস বস ভুল হইয়া গেছে। বাথরুমে আছিলাম বস ক্ষমা করে দিন এবারের মতো।
আরো বেশি মেজাজ খারাপ হয় সায়ানের।
:-তোর ফা*কিং বাথরুম সারতে কয় ঘন্টা লাগে রে?ভুগোল বুঝাস বা*ল আমার! হাতের কাছে পেলে না ভুগোল তোর নিতম্বে ভরে দেবো। শ্লা অকর্মা সব!
ওপাশ থেকে বার বার ক্ষমা চাইতে দেখে সায়ান কিছুটা শান্ত হয়ে জানায় মুকুল কে যে করেই হোক খুঁজে বার করতে। এটা TJS এর অর্ডার।
কাজ বুঝিয়ে দিয়ে ফোন কাটে সায়ান। তৈমুরের দিকে তাকিয়ে তৈমুরের হাবভাব বোঝার চেষ্টা করে। আল্লাহই জানেন কি চলছে তৈমুরের মনে।
সায়ান কে ড্রপ করে দিয়ে শিকদার হাউসে পৌঁছে ঘড়ি দেখে তৈমুর। রাত ১:২৩।
এতো রাতে কারো জেগে থাকার কথা না। তৈমুর কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা নিজের রুমে চলে গেল। রুমে প্রবেশ করতেই কপাল কুঁচকে এলো তৈমুরের। সুইচ বোর্ডে হাত চালিয়ে লাইট জ্বালাতেই এতক্ষণের চাপা রাগটা যেন দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো।
সারা নেই ঘরে।
আসলে বিকেলে ভার্সিটি থেকে ফিরে রিনা শিকদারের কাছ থেকে দুপুরের ঘটনা শুনে সেই থেকে আতঙ্কে আছে মেয়েটা। তৈমুরের রাগ কে সে এমনিতেই ভয় পায়। আরো সে তৈমুর কে না জানিয়েই আব্রর সাথে কথা বলেছে। আবার পরেও সেটা তৈমুর কে জানায়নি। আর এইটা নিয়ে এতো বড় ব্লান্ডার হয়েছে জেনে তৈমুরের ভয়ে সিটিয়ে আছে সারা। সেই ভয়ে বিয়ের আগের নিজের বরাদ্দকৃত রুমে ঢুকে বসে আছে সারা। আজ সে কোনভাবেই তৈমুরের সামনে যাবে না। যা হয়ে যায় যাক!
সারা কে রুমে অনুপস্থিত দেখে যা বোঝার বুঝে গেছে তৈমুর। রাগে মাথাটা দপদপ করছে। এই মেয়েটাকে আজকে উচিত শিক্ষা দিয়ে ছাড়বে সে। হাতের ব্যাগটা ফ্লোরে আছাড় মেরে গটগট পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে সারার রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় তৈমুর। হাত দিয়ে দরজায় পুশ করতেই বুঝতে পারে দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। মেজাজের পারদ ছাড়ালো মুহুর্তেই।
সর্বশক্তি দিয়ে ধড়াম ধড়াম করে দরজায় বাড়ি দেয় তৈমুর।
এদিকে রুমের ভেতরে সারা বিছানায় শুয়ে আছে। ভয় আর আতঙ্কে টেনশন করতে করতে কখন যে চোখ লেগে এসেছে বুঝতে পারেনি। আচমকা দরজা ধাক্কানোর শব্দে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলো সারা। বাইরে থেকে কেউ সমানে দরজা ধাক্কে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি দরজা না খুললে দরজা ভেঙেই ক্ষান্ত হবে ও পাশের মানুষ টা। ঘুম থেকে ওঠার ফলে মাথাও হ্যাং হয়ে আছে সারার। বেশি কিছু না ভেবে দ্রুত পায়ে হেঁটে গিয়ে দরজাটা খুলে দিল সারা।
দরজা খুলতেই আচমকা কষে একটা থাপ্পড় পড়লো সারার গালে।
এক চড়েই ঘুম উধাও। ব্রেইনের মেমোরিও ব্যাক করলো সেকেন্ডের মাঝেই। সারা গালে হাত রেখে ঠোঁট চেপে ছলছল চোখে তাকালো তৈমুরের দিকে।
তৈমুরের চোখ থেকে যেন আগুন ঝরছে। রাগের চোটে চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। রক্তিম চোখে তাকিয়ে আছে সারার দিকে। আচমকা বজ্রপাতের ন্যায় হুঙ্কার দিয়ে ওঠে তৈমুর,,,,
:-অন্য কারো কোলে গিয়ে বসতে মন চায় তোর? অন্যের কোলে বসে কফি খেতে ইচ্ছে করে? নায়িকা সাজো তুমি নায়িকা???
সারা তখন ওড়নার কোণে হাত গুঁজে চুপচাপ দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলছে। মাথাটা বুকের সঙ্গে লেপ্টে গেছে যেন। চোখ তুলে তৈমুরের দিকে তাকানোর সাহস হয়না।
তৈমুর আরো রেগে যায়। দুহাতে সারার গলা চেপে ধরে ঠাণ্ডা হিসহিসে গলায় বলে,,
:-কেনো গিয়েছিলি বল? একটা দিয়ে পোষায় না? ১২ টা লাগবে তোর? লোকে সুযোগ পায় ক্যান বল? এই চুপ করে থাকবি না বল!!
তৈমুরের কথায় লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা করছে সারার
। কোনমতে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,,
:-আমি… আমি বুঝতে পারিনি… আব্র ভাইয়া শুধু…শুধু মন রাখতেই….
গলায় হাতের চাপ বাড়িয়ে দেয় তৈমুর। রাগে সর্বাঙ্গে জ্বলে যাচ্ছে তার!
:-তোর কোন নাঙ ডাকলো আর তুই দিলদরিয়া হয়ে মন রাখতে চলে গেলি? শুতে বললে মন রাখতে সেটাও করতিস? তোর কিসের এতো দায় বল?
চোখে রীতিমতো আগুন ঝরছে তৈমুরের।
:-তোর সব ছেড়ে এখন কি আব্র খুব আপনজন হয়ে গেছে? ওই বাস্টার্ড তোর কাছে এলো আর তুইও নায়িকা সেজে রেস্টুরেন্টে চলে গেলি হ্যাঁ? এই তোর মুখ নেই? সাফ না করে দিতে পারিসনি? তোকে কি কোলে তুলে নিয়ে গেছিলো? তোর যে একটা ভাতার আছে,মনে ছিলো না? এই আমার সম্মানের কথা মনে হয়নি তোর একবারও? বল! তুই জানতিস না ওই শাউয়োর নাতী তোকে কোন চোখে দেখে? বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল জানতিস না? তারপরও গেলি কোন আক্কেলে? আশিক দেখে মনে ফুর্তি জেগেছিলো? তাই নাঙের মন রাখতে গেছিলি?
সারা অবাক। এমন কথা? এমন অভিযোগ? চোখ থেকে অঝোরে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। জীবন প্রথমবার তৈমুরের এমন কঠোর রুপ দেখে হতভম্ব সারা। হিচকি তুলে ভাঙ্গা গলায় কোনমতে বলার চেষ্টা করে,,,
:-বিশ্বাস করুন,,আমি এমন না…আমি…আমি একাও যায়নি। সামিরাও আমার সাথে ছিলো। আমি শুধু আপনাকে……
সারার কথাটা সম্পূর্ণ করতে দিলো না তৈমুর। তাচ্ছিল্য হেসে বললো,,,
:-বিশ্বাস! তোর এই সো কল্ড ফা*কিং বিশ্বাসের ফলেই আজ লুবানা আমাকে তোর ছবি দেখিয়ে বলেছে—‘তোমার স্ত্রী চরিত্রহীন’। বুঝতে পারছিস তুই? এই তুই এই কথার মানে বুঝিস? আমার শরীরে আগুন জ্বলছে তুই বুঝতে পারছিস? তৈমুর দুহাতে নিজের চুল খামচে ধরে চিৎকার করে ওঠে,,,
:-আহহহহ Fucking faith!!
সারার চোখ বিস্ফারিত।লুবানা আপু এতো খারাপ তার জানা ছিলো না। দুহাতে মুখ ঢেকে হিচকি তুলে কাঁদছে সারা।
:-আমি এমন কিছু করিনি বিশ্বাস করুন…আমি তো বুঝতেও পারিনি কিছু কেউ ছবি তুলছে…”
চোয়াল শক্ত করে রক্তিম চোখে তাকায় তৈমুর,,,
:-তোর মতো মেয়েদের বোঝাতে হয় না সারা, তোরা নিজেরাই সুযোগ তৈরি করে দিস! তৈমুরের কণ্ঠে কেমন অবজ্ঞা। কঠোর গলায় বলে,,,
:-তুই আসলে কখনো বুঝিসইনি আমাকে। তুই শুধু আমার স্ত্রী,নামেই। কিন্তু মন-মানসিকতা এখনো সেটা ধারণ করতেই পারিনি। আসলে কি বলতো! আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল,তোর মতো ইমম্যাচিউর মেয়েকে নিজের জীবনের সাথে জড়ানো।
সারা ভীষণভাবে কেঁপে ওঠে। গলা আটকে আসে,বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় সারা,,,
:-কি বললেন আপনি? আপনি এমন একটা কথা বলতে পারলেন?
:-পারলাম বলতে। সত্যিই এখন আমার মনে হচ্ছে, হয়তো ভুলটা আমিই করেছি। তোর মতো এমন ছোট বয়সের মেয়েকে ভালোবাসা উচিত হয়নি আমার। যে আমার সম্মান, অসম্মান বোঝে না। তার আমার স্ত্রী হওয়ার কোন যোগ্যতা নেই!
তৈমুরের চোখে একটা কঠোর নির্মমতা।
সারার বুকের ভেতর যেন কিছু একটা ভেঙে পড়ে।
সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। সেখানেই ধপ করে বসে পড়ে। মুখটা ঘুরিয়ে ফেলে কিছুটা,,
:-আপনি যেভাবে কথাটা বললেন… আমার ভালোবাসার মূল্য যদি এতটাই তুচ্ছ হয়… তাহলে চুপ করে থাকা ছাড়া কিছুই করার নেই আমার…”
চোখ থেকে জলের ধারা নেমে আসে।
তৈমুর মুখ ফিরিয়ে নেয়, কিন্তু হৃদয়ের কোণে কী যেন টলটল করে ওঠে…তবু রাগের মাত্রা এতোটাই ভারি যে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েছে সে। বুঝলো না কি বলতে কি বলে ফেলেছে সে রাগের মাথায়।তার এক একটা কথার তীরের আঘাতে একটা ছোট্ট হৃদয় রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত হয়ে দুমড়ে মুচড়ে পড়েছে।
তৈমুর পাশের একটা চেয়ারে লাত্থি মেরে ধপধপ করে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। তৈমুর বেরিয়ে যেতেই সারা দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে দিয়ে বিছানায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে কাঁদতে লাগলো।
***********
আজকের সকালটা ছিল অদ্ভুত রকমের শান্ত। যেন শিকদার হাউসের দেয়ালেও জমে উঠেছে এক ধরণের গুমোট নিঃশব্দতা। পাখিরা ডাকছে ঠিকই, কিন্তু যেন খুব নিচু স্বরে। কারও মন খারাপে যেন আশপাশের শব্দও স্তব্ধ হয়ে আছে!
ফজরের নামাজ শেষ করে উঠে দাড়ালো সারা। কাল রাতে একফোঁটা ঘুম হয়নি সারার। সারাটা রাত কেঁদেছে মেয়েটা। চোখ ফুলে লাল হয়ে আছে। মুখটাও শুকনো। প্রভু রাব্বুল আলামীনের দরবারে মাথা ঠেকিয়ে কিছুটা হালকা লাগছে এখন।
সারা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে জায়নামাজ টা ভাঁজ করে রেখে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুপচাপ কিছুক্ষণ নিজের প্রতিবিম্বর দিকে তাকিয়ে থাকলো। চোখের নিচে কালি, মুখটা বিবর্ণ। কাল রাতের কথাগুলো এখনো তার কানে বাজছে। তৈমুরের কঠোর কণ্ঠ, রক্তিম চোখ, বিষাক্ত কথাগুলো যেন প্রতিটি শিরায় বিষের মতো ছড়িয়ে আছে।
ভার্সিটির জন্য পরিপাটি হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো সারা। তৈমুর ওঠার আগেই বেরিয়ে যাওয়ার নিয়ত। শুধু চুপচাপ রেশমির রুমে গিয়ে বললো,,
:-আপু চলো, আজকে একটু আগে বের হই।
ডাইনিং টেবিলে বসেও একটুও খেতে ইচ্ছা করলো না সারার। নাস্তা রেডি শুনেও সে খাওয়া এড়িয়ে গেল।
রেশমি সারার মন খারাপ কিছুটা বুঝতে পারলেও কিছু জিজ্ঞেস করলো না। রিনার চোখেও ব্যপারটা ধরা পড়লো, সারার মন খারাপ।
রেশমী কোনরকম খেয়ে সারাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো।
_____
রুম থেকে যখন বেরিয়ে আসলো তৈমুর, তখন সকাল ৮ টা পার হয়ে গেছে। একবারে পরিপাটি হয়ে হসপিটালের জন্য রেডি হয়েই নিচে নামলো তৈমুর। ডাইনিং টেবিল খালি। মায়ের মুখের দিকে তাকালে রিনা শিকদার থমথমে গলায় জানালো,,
:-সারা রেশমির সাথে ভার্সিটির জন্য বেরিয়ে গেছে… কিছু খায়নি।”
তৈমুর এক মুহূর্ত থেমে গেল। মনে পড়লো কালকের সেই কথাগুলো, মনে পড়ে গেল তার আদরের চোখের টলটলে জল।একটা চিনচিনে ব্যথা বুকের মাঝে ঘুরে বেড়াতে লাগলো, কিন্তু মুখে কিছু বললো না। আচমকা প্লেট ঠেলে দিয়ে উঠে দাড়ালো,,,
:-আমি পরে খেয়ে নেবো…হসপিটালে কিছু ইমার্জেন্সি কাজ আছে। বলেই বাইরে বেরিয়ে গেল তৈমুর।
রিনা শিকদার যেন বুঝে গেলেন ঘরের বাতাসটা আজ ভারি, তা শুধু আবহাওয়ার না,সেটা তৈমুর আর সারার মধ্যেকার নিরব এক মান-অভিমানের ফল।
এই দুজনের এই নিঃশব্দ দূরত্বে তার নিজের মনেও কষ্টের রেখা টেনে দিলো। কিছু বললেন না, শুধু নীরব চাহনিতে দমিয়ে রাখলেন নিজের উদ্বেগ।
*********”
আঙ্গুলের ফাকে Cigar ধরে মাঝে মাঝে ঠোঁটের মাঝে রেখে টান দিচ্ছে এরশাদ হামিদ, তার বিশ্বস্ত লোকটা বসে আছে পাশের সোফায় কিছুটা উদ্বেগ নিয়ে। এরশাদ হামিদের চোখে ঠান্ডা এক নির্মমতা।
:- আজ একটা এক্সিডেন্ট হবে। একদম ন্যাচারাল, যাতে কেউ সন্দেহ না করে। যেন ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ঝরে গেল একটা তাজা প্রাণ!
আচমকা কথাটা বলেই শয়তানী অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো এরশাদ হামিদ।
ঘুরে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে একটা ছবি বের করে সেন্টার টেবিলের উপর রাখলেন তিনি। ক্রুড় হেসে বললেন,,,
:-বুঝলে মুকুল! পথের কাঁটা এড়িয়ে যেতে নেই, নয়তো ফেরার পথেও সেটা পায়ে বিধতে পারে। তাই শুরুতেই সেটা উপরে ফেলা উচিত! কি বলো!!
সেন্টার টেবিল থেকে ছবিটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ উল্টেপাল্টে দেখলো মুকুল। তারপর নিঃশব্দে মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো। এরশাদ হামিদ কয়েকটা টাকার বান্ডিল মুকুলের সামনে রেখে বললেন,,,
:-দায়িত্বটা আমি তোমাকে দিলাম। যথাযথ পালন করতে পারলে ডাবল পাবে।
টাকার বান্ডিল দেখেই চোখ চকচক করে উঠলো মুকুলের। টাকাগুলো গুছিয়ে নিয়েই উঠে দাড়ালো। ছবিটা পকেটে রেখে বললো,,,
:-ভাববেন না বস। কাজ হয়ে যাবে। সন্ধ্যার আগেই গুড নিউজ আপনার কানে পৌঁছে যাবে। বলে বেরিয়ে গেল মুকুল।
:-আমার মেয়েদের খুশির জন্য আমি সব করতে পারি! ইভেন খুনও,,,,বলেই চুরুটে একটা লম্বা টান দিলেন এরশাদ।
—
🛣️
বিকেলের আলো তখন ম্লান হতে শুরু করেছে। সারা আর রেশমি ভার্সিটির গেট থেকে হাঁটতে হাঁটতে বের হলো।সারার মুখটা এখনো থমথমে।
রেশমি কালকের লুবানার ঘটনা জানে। সারা কে মন খারাপ করে থাকতে দেখে ভাবলো হয়তো তৈমুর ভাইয়া অনেক বকেছে। এই জন্যই মন খারাপ মেয়েটার। রেশমী সারার কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলে,,,
:-সারা, তোকে কাল রাতে খুব ভাইয়া খুব বকেছে তাই না?…
চুপ করে থাকে সারা।
:-দেখ ভাইয়া আসলে রাগি ঠিকই, কিন্তু তোকে খুব ভালোবাসে…
রেশমীর কথায় সারা মাথা নিচু করে মলিন হেসে বললো,,
:-আমি জানি আপু। মনের মাঝে অপরিসীম ভালোবাসা না থাকলে তার নামে খারাপ কথা শুনে কেউ এতটা রেগে যায় না… কিন্তু কখনো কখনো এমন কিছু কথার আঘাত থাকে যা শোনার জন্য তৈরি থাকে না মানুষ। আমিও তেমন নিজেকে তৈরি রাখিনি, রেশমি আপু…
বলেই সারা সামনে এগিয়ে যাওয়া রেশমীর দিকে তাকায়। হঠাৎ দেখতে পায় সামনে থেকে একটা চলন্ত ট্রাক বাঁদিক ঘেঁষে দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছে রেশমির দিকে! চোখ বড়বড় হয়ে গেলো সারার! হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে চিৎকার করে উঠলো সারা!
:-রেশমি আপুউউ!!!”
সারা চিৎকার করেই ঝাঁপিয়ে পড়লো রেশমীর দিকে। রেশমিকে ধাক্কা দিয়ে একপাশে সরিয়ে দিলো।
সেকেন্ডের মধ্যে সারা নিজেই ট্রাকের সামনে চলে গেলো…
আর ঠিক তারপরেই ধামমম করে একটা বিকট শব্দ, একটা দেহ ছিটকে পড়লো রাস্তায়। মুহুর্তেই রক্তে ভিজে গেলো রাস্তা।
চারপাশে লোকজনের ছুটোছুটি শুরু হয়ে গেল।
কেউ কেউ দৌড়ে এলো। লোকজনের ছুটোছুটি, চেঁচামেচি কিছুই যেন কানে পৌঁছালো না রেশমীর। তার চোখ স্থির হয়ে আছে কয়েক হাত দূরে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা সারার দিকে। মুহুর্তেই কি ঘটলো যেন বোধগম্য হচ্ছে না তার।
সারা নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে রাস্তার মাঝে। নাক, কান দিয়ে গলগলিয়ে রক্তের ধারা বয়ে যাচ্ছে। মাথার দিকে রাস্তা গাঢ় কালচে রক্তে ছড়িয়ে ভিজে উঠেছে। নিথর সারার চোখদুটো খোলা অবস্থায় গড়িয়ে পড়লো এক ফোঁটা জল!
আচমকা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলো রেশমী,,
:-সারাআআআআ!!!!
_______
কয়েকজন লোক দৌড়ে এসে সারাকে ধরে নাকে হাত রেখে চেইক করলো। একজন চিৎকার করে বললো,,,
:-বেঁচে আছে ভাই বেঁচে আছে!! এখনি হসপিটালে নিয়ে গেলে হয়তো বেঁচে যাবে!!
রেশমী চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বললো,,
:-আরে কেউ সাহায্য করুন!! ওকে হসপিটালে নিয়ে যেতে সাহায্য করুন কেউ!!
কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে কেউ এগিয়ে আসছে না। এক্সিডেন্ট কেস!! যদি পুলিশ কেস হয়!! সেই ভয়ে কেউ সাহস করে এগিয়ে এলো না। রেশমী সারার রক্তাক্ত শরীরটা কোলের উপর টেনে নিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।
:-আপনারা কি মানুষ!! একটা মেয়ে মরতে বসেছে আর আপনারা তামাশা দেখছেন!! কেউ তো একটু সাহায্য করুন!!
রেশমীর দুহাত রক্তে ভিজে উঠেছে। থরথর করে কাঁপছে রেশমী। অসহায়ের মতো চারপাশে তাকায় একটু সাহায্যের আশায়।
ভার্সিটি ছুটির পর নিজের গাড়ি নিয়ে ভার্সিটির গেট দিয়ে মাত্রই বেরিয়েছে তালহা। কিছুটা এগিয়ে যেতেই মানুষের ভিড় জমা দেখে কপালে ভাঁজ পড়ে! কি ঘটেছে বুঝতে না পেরে রাস্তার একপাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে নেমে এলো তালহা। একজন লোককে জিজ্ঞাসা করতেই জানালো একটা মেয়ের এক্সিডেন্ট হয়েছে। আরেকটা মেয়ে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য সাহায্য চাইছে।
কথাটা শুনেই মাথা গরম হয়ে গেল তালহার। আজব! মানুষের মনুষ্যত্ব কোথায় গিয়ে দাড়িয়েছে আজকাল!! কারো জীবনেরও কোন দাম নেই কারো কাছে। সবাই মনুষ্যত্বহীন যেন। বিড়বিড় করতে করতেই ভিড় ঠেলে এগিয়ে যায় তালহা!!
ঘটনা স্থলে পৌঁছাতেই মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো তালহার। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো রেশমীর কোলঘেঁষে।
:-রোশি!! কি করে হলো!! এভাবে বসে আছো কেনো? এক্ষুনি সারাকে হসপিটালে নিতে হবে। ওঠো!!
তালহা কে দেখে ঠোঁট ভেঙে বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো রেশমী। তালহা সারাকে পাঁজা কোলা করে তুলে নিলো। রেশমী কে সারার ব্যাগ নিতে বলে দ্রুত ছুটলো গাড়ির নিকট। কাঁপা হাতে গাড়ির দরজা খুলে দিলো রেশমী। নিজে আগে বসলে রেশমীর কোলের উপর সারার মাথাটা রেখে ঠিক ভাবে শুইয়ে দিলো তালহা! তারপর দ্রুত ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লো। দ্রুত ছুটলো গাড়ি।
এদিকে সারার রক্তাক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে হিচকি তুলে কাঁদছে রেশমী। বিড়বিড় করে বলছে,,,
:-আমাকে বাঁচাতে গিয়ে……আমাকে বাঁচাতে গিয়ে আজ সারার এই অবস্থা!!!
তালহা সামনের দিকে দৃষ্টি রেখেই জিজ্ঞাসা করল,,,
:- কাউকে ইনফর্ম করেছো? তৈমুর ভাইয়াকে বলো। তার হসপিটালেই নিয়ে যাচ্ছি।
এতক্ষণে হুশ হলো রেশমীর। তাইতো তৈমুর ভাইয়াকে এখনই ফোন করা দরকার। ফোনটা বের করে। হাত কাঁপছে রেশমির। কোনোরকমে ফোন করলো তৈমুরকে। রিসিভ হতেই ফুঁপিয়ে ওঠে রেশমী,,,
:-ভাই… ভাইয়া… সারা… সারা এক্সিডেন্ট… ট্রাক… রক্ত… ভাইয়া প্লিজ… ভাইয়া…ঠিকঠাক ভাবে কথা বলতে পারলো না রেশমী।
যেটুকু শুনেছে তাতেই তৈমুরের শরীরে বিদ্যুৎ তরঙ্গ বয়ে গেলো। ফোন ধরা হাতটা থরথর করে কাঁপতে লাগলো। মাথায় যেন বাজ পড়লো তৈমুরের। মুহূর্তেই সারার ছলছলে চোখদুটো ভেসে উঠলো তৈমুরের অক্ষিপটে। সর্বাঙ্গ অসাড় হয়ে এলো তৈমুরের। থরথর করে কাঁপছে পুরো শরীর।
সেই মুহূর্তেই সায়ান তৈমুরের কেবিনে এলো একটা ফাইল হাতে করে। কেবিনে ঢুকতেই তৈমুর কে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে কাঁপতে দেখে চিৎকার করে তৈমুর কে ঝাপটে ধরলো সায়ান। “প্যানিক অ্যাটাক” হয়েছে তৈমুরের। সায়ানের বন্ধুত্বের জীবনে দুবার তৈমুর কে প্যানিক অ্যাটাক হতে দেখেছে সে। দু’বারই কারণটা ছিলো সারা! এবারও কি সারার কিছু হলো!!
সায়ান চিৎকার করে ডাকলো তৈমুর কে!
:-What happened, Taimur? Why are you doing this? কি হয়েছে বল?
তৈমুর মুখে কিছু বলতে পারলো না। অস্ফুট স্বরে বিড়বিড় করতে লাগলো,,,
:-সা…রা সা….রা
শরীরটা যেন অসাড় হয়ে গেল তৈমুরের।
চোখের ওপরে যেন আকাশ নেমে এলো, বুকের মধ্যে ভূমিকম্প। তার নিজের পৃথিবীটাই যেন চোখের সামনে ভেঙে পড়লো। সায়ানের বাহুডোরেই অচেতন হয়ে ঢলে পড়লো তৈমুর!
সায়ান অসহায় বোধ করলো ভীষণ! তৈমুরের মতো দামড়া ষাঁড়কে এখন কি করে উঠিয়ে নিয়ে যাবে সেই চিন্তায় কপালে ঘাম দেখা দিলো তার। বিড়বিড় করলো সায়ান,,,
:- যে এতো স্ট্রং পারসোনালিটির ভয়ংকর একজন নেমেসিস, যে নিজ হাতেই কত লোক কে কেটেকুটে সমাজের জঞ্জাল সাফ করে,সেই এত বড় শরীরের একজন পুরুষ মানুষ তার ওপর এত বড় ডাক্তার সেই কিনা একটা মেয়ের সামান্য আঘাতেও এমন হুসজ্ঞান খুইয়ে মুচড়ে পড়ে। ঠিক কতোটা ভালবাসলে তা সম্ভব!!
কিন্তু সারার আবার কি হলো!!! কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো সায়ানের
#চলবে–