#প্রিয়াঙ্গন❤️ [সূচনা পর্ব]
~আফিয়া আফরিন
নিশ্ছিদ্র দুপুরের অলসতা ছাদে ঢেউ খেলে যাচ্ছিল। রোদের ছায়ায় নাবিলা সবে ভেজা চুল খুলে রেলিংয়ের পাশে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ করেই নিচ থেকে ভেসে এল কলিংবেলের আওয়াজ, টিং টং!
এক লাফে ছাদ থেকে সিঁড়ি পেরিয়ে নেমে এল সে। দরজা খুলে তাকাতেই চোখ গেল ফাঁকা রাস্তায়। কেউ নেই! পাড়ার বাচ্চাগুলোই বোধহয় আবার দুষ্টুমি করছে। মুখটা কুঁচকে উঠল, ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে একঝলক চারপাশে তাকিয়ে নাবিলা ধপ করে দরজাটা বন্ধ করল। কিন্তু পা ঘরের দিকেই বাড়াতে না বাড়াতেই আবার টিং টং!
এইবার দাঁত চেপে গেল ওর, পাড়ার কয়েকটা বাচ্চা প্রায় সময় এমন করে। রাগে দুচোখে আগুন জ্বলে উঠল। ঝটকা দিয়ে দরজাটা খুলে দাঁড়িয়ে গেল। এবারও, শূন্য। রাস্তা ফাঁকা, বাতাসে কয়েকটা যানবাহনের সাঁই সাঁই শব্দ ছাড়া কিছুই নেই।
মুখটা গোমড়া করে দরজাটা আধখোলা রেখেই পাশে গিয়ে দাঁড়াল নাবিলা। এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে, চোর না ধরা পর্যন্ত। শেষ দেখে ছাড়বে এর, তারপর কানের নিচে এমন চপাং চপাং করে দিবে যে সারাজীবনেও ভুলবে না।
ঠিক এমন সময় আবার দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। এইতো, এইবার তো ধরা পড়বেই। এক পা দুই পা করে এগিয়ে এলো সামনে। কিন্তু তার আগেই দরজাটা খুলে গেল। নাবিলাকে থমকে দাঁড়াতে হলো। ও ঠিক বুঝতে পারেনি দরজার ওপাশে কেউ আছে আর আগুন্তকও বুঝতে পারে নাই এপাশে কেউ আছে।
দুজনে প্রায় একসঙ্গে এক কদম এগিয়ে এলো আর ঠিক তখনই,
ধাক্কা… এক ঝটকায় নাবিলা পেছনের দিকে হেলে পড়ল। শরীরের ভার সামলাতে না পেরে হাওয়ায় ভাসতে থাকা পাতার মতো পড়ে যাওয়াই নিশ্চিত ছিল।
কিন্তু তখনই আগুন্তক চটজলদি হাত বাড়িয়ে ওকে ধরে ফেলল। নাবিলা থেমে গেল মাঝপথে। খুব কাছ থেকে তাকিয়ে ও হঠাৎ থমকে গেল। ছেলেটা একেবারে চোখের সামনে। পাতলা দাড়ি-গোঁফের সামান্য ছায়া পড়েছে ছেলেটার মুখে। চোখ দুটো গভীর, স্থির। এক গোছা চুল নেমে এসেছে কপাল ছুঁয়ে। নাবিলা বিরক্তি আর অস্বস্তি নিয়ে বলল,
—“আপনি কে? আমাকে এভাবে ধরেছেন কেনো? ছাড়ুন।”
ছেলেটা তাকাল, চোখদুটো সোজা নাবিলার দিকে স্থির। তারপর ভ্রু কুঁচকে বলল,
—“ছাড়ব?”
ওর গলায় একরকম চ্যালেঞ্জ ছোঁয়া ছিল। নাবিলা অবাক। চোখ বড় বড় করে বলল,
—“তো? ধরে রাখবেন নাকি? আশ্চর্য!”
ছেলেটা ঠোঁটে সামান্য হাসি টেনে বলল,
—“ওকে।” বলেই হঠাৎ ওকে ছেড়ে দিল।
ধপাস… নাবিলা ভারসাম্য হারিয়ে নিচে পড়ে গেল। ঝটকা লাগল পিঠে, কোমড়ে, হাঁটুতে। ব্যথা কম, অপমানটা একটু বেশি।
—“ওপসস।” ছেলেটা ঠোঁটজোড়া গোল করে বলল, গলায় শ্লেষ।
নাবিলা রাগে, লজ্জায়, বিস্ময়ে একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে উঠল। দাঁড়িয়ে পড়েই ঝাঁজালো গলায় বলল,
—“আপনি কি মানুষ? আমাকে ফেলে দিলেন কেনো?”
—“ফেলে দিই নাই। ছেড়ে দিলাম।” ছেলেটা এমনভাবে কাঁধ ঝাঁকাল, যেন পুরো ব্যাপারটাই ওর কাছে সাধারণ বিষয়। চোখের নির্লিপ্ততা দেখে মনে হয়, কিচ্ছু ঘটে নাই। নাবিলার খারাপ মেজাজ চরম মাত্রায় পৌঁছাল। এই ছেলে এতক্ষণ দরজায় অযথা কলিংবেল বাজিয়ে রঙ্গ তামাশা করছিল, আর এখন ওকে ফেলে দিল? নাবিলা আর কিছু বলার আগেই ভেতর থেকে আহির, শ্রেষ্ঠা, আর নাদিম একযোগে ছুটে এলো।
—“আপু, উনাকে ভেতরে আসতে দাও। উনি সামির ভাইয়া।” শ্রেষ্ঠা তাড়াহুড়ো করে বলে উঠল।
নাবিলা মুখ ঘুরিয়ে একবার শ্রেষ্ঠার দিকে তাকাল, তারপর সামিরের দিকে। চোখ কুঁচকে গেল।
—“কোন সামির ভাইয়া? আর তাতে আমার কী? আমাকে ফেলে দিলো কেনো?”
আহির এগিয়ে এলো। নাবিলার পাশে দাঁড়িয়ে ওকে একপাশে সরিয়ে দিয়ে সরাসরি সামিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
—“আসুন ভাইয়া, আপনার জন্যই তো অপেক্ষা করছিলাম। আন্টি সকালে বলেছিলেন আপনি আসবেন। এখন তো দুপুরও যাই যা করছে। যাইহোক…”
আহির নাবিলাকে একেবারেই পাত্তা দিল না, তার উপর সরিয়ে দিল। এখন আবার এই ছেলেটার সাথে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছে? ভাইয়া ডাকছে? নাবিলা স্থির দাঁড়িয়ে রইল। তার ভাই-বোন অন্যকাউকে এত গুরুত্ব দিচ্ছে? এত আপন করে নিচ্ছে? আর তাকে কিছু না বলে পাশে সরিয়ে রাখা হচ্ছে? এই আচরণটা সহজে হজম হলো না নাবিলার।
আহিরের কথার ফাঁকেই সে বুঝে গেল, সামিরের পরিচয়। তবুও পুরোপুরি নিশ্চিত হতে চাইল। মুখ শক্ত করে, চোখে সন্দেহ আর রাগ নিয়ে বলল,
—“নিজের পরিচয় দিন। দিনকাল ভালো না। কে না কে কখন কী পরিচয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকে সব লুট করে নিয়ে যায়, তা তো বলা যায় না।”
সামির একটু হেসে পেছন দিকে ফিরে শান্ত গলায় বলল,
—“আই’ম সামির ইয়াসির। ফ্রম ঢাকা, বাংলাদেশ…”
আহির মাঝপথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াল। নাবিলাকে ধমক দিয়ে বলল,
—“আহ, কী শুরু করলি? ফুপিকে ডাক দিব? বলব তোর কথা? এই নাদিম যা, ফুপিকে ডাক দে।”
—“যা যা ভেতরে যা আপাতত। তোকে আমি পরে দেখে নিচ্ছি শালা আহিরের বাচ্চা।” মায়ের কথা শুনে নাবিলা একটু চুপসে গেল।
সামির আহিরের উদ্দেশ্য বলল,
—“চলো, ভেতরে যাই? কারোর কারোর মাথায় বুদ্ধি একটু বেশিই থাকে… সেই বুদ্ধির জোরে কাকে যে কী মনে করে, আর কাকে যে কী বলে, নিজেরও বুঝে উঠতে সময় লাগে।”
আহির সামিরকে নিয়ে ভেতরে চলে গেল। দরজায় দাঁড়িয়ে রইল নাবিলা, শ্রেষ্ঠা আর নাদিম।
নাবিলা অনেকদিন পর নানাবাড়ি এসেছে। এইচএসসি পরীক্ষা শেষ, মাথায় পড়ার চাপ নেই, আর ছোট ভাই নাদিমেরও স্কুল ছুটি পড়েছে, এই সুযোগেই পুরো পরিবার মিলে শহরের কোলাহল ছেড়ে কিশোরগঞ্জের মফস্বলের মায়াভরা বাড়িটায় ক’দিনের জন্য বেড়াতে এসেছে।
এই বাড়িটা নাবিলার ছোটবেলার অনেক স্মৃতির ঠিকানা। ওর মা নীতু, প্রায় দুই বছর পর মায়ের বাড়ি এসেছে। অন্যান্যবারের চেয়ে এবারের আনন্দটা তার কাছে একটু বেশি। তার অবশ্য কারণ আছে… কয়েকদিন আগে, পুরোনো এক পরিচিতার মারফত রেশমার খোঁজ মেলে। রেশমা হচ্ছে তার ছোটবেলার বান্ধবী। একসাথে স্কুল কলেজ পার করল, কলেজে পড়াকালীন ওর বিয়ে হয়ে গেল। সেই যে বিয়ে হলো, কিশোরগঞ্জ ছাড়ল; আর খোঁজ নেই। ওর বাবা ছিল না, তেমন কোনো আত্মীয়-স্বজনও ছিল না, তাই শশুরবাড়ি পাড়ি জমানোর সময় মাকেও সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল। আর এখনকার মতো তখন তো যোগাযোগ ব্যবস্থা এত সচল ছিল না। সে কারণে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একটা ফারাক চলে এসেছিল।
রেশমার খোঁজ পাওয়ার পর নীতু আর দেরি করেনি, দু’দিন আগেই রেশমাকে ডেকে এনেছে। তারা দু’জন এই বয়সে এসেও দীর্ঘদিন পর একে অপরের মুখোমুখি হয়ে কৈশোরে ফিরে গেছে, অজস্র অসমাপ্ত কথার ভেতর ডুবে রয়েছে। রেশমা একাই এসেছে। নীতু যখন শুনেছে ওর একটা ছেলে আছে তখন থেকেই বারবার বলছিল,
—“তোর ছেলেটাকে নিয়ে এলি না কেন? এতবার বললাম। দেখতাম একটু! ছোটবেলায় তো দেখতেই পারিনি। বড় হয়েও কি দেখতে পারব না?”
—“আসবে বলেছে, দু’দিনের মধ্যে। পড়াশুনা প্লাস ওর বাবার কাজকর্ম নিয়ে একটু ব্যস্ত।”
সেই অপেক্ষারই শেষ হলো আজ। নাবিলা একটু আগে যাকে সন্দেহের চোখে দেখছিল সেই রেশমার একমাত্র ছেলে, সামির ইয়াসির।
নাবিলা ভেতরে পা রেখেই ঘুরে দাঁড়াল। শ্রেষ্ঠা তখনও পাশে দাঁড়িয়ে, পুরো ব্যাপারটাই স্বাভাবিকভাবে নিয়েছে সে। কিন্তু নাবিলা থেমে থাকল না।
—“শ্রেষ্ঠা, তোর ভাইয়ের কাণ্ড দেখলি? আমাকে কীভাবে ইগনোর করল। ওর সাহস দেখে আমি রীতিমতো অবাক।”
শ্রেষ্ঠা একেবারে গা-ছাড়া ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বলল,
—“আরে ধুর! তুমি তো আমার ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড না, বউও না। সো ইগনোর করলেও তোমার কী এসে যায়? চিল! চলো, ভেতরে যাই। দেখি ওরা কী করতেছে।”
নাবিলা থমকে গেল। চোখ বড় বড় করে শ্রেষ্ঠার দিকে তাকিয়ে বলল,
—“এই তুই আমাকে এই কথা বলিস কোন সাহসে? আমি তো ওর বোন, তাই না?”
এক মুহূর্ত নীরব থেকে শ্রেষ্ঠা হেসে বলল,
—“কিন্তু ভাইয়া তোমাকে বোনের মতো দেখে কিনা, সেটা নিয়ে আমি এখনই গ্যারান্টি দিতে পারছি না।”
—“মানে?” নাবিলা হতবাক।
শ্রেষ্ঠা আবারও হেসে বলে,
—“আরে সিরিয়াস কিছু না। গতকাল শফিক ভাইয়াকে তোমার পরিচয় দিল, ফুফাতো বোম বলে। তাই বললাম আর কী।”
—“বোম?”
নাবিলা মুখ ফিরিয়ে নিল। ঠোঁট শক্ত করে চেপে ধরেছে। মনের ভেতরে অভিমান আর অপমান গরম হয়ে ফুটছে, কিন্তু মুখে কিছু না বলে ভেতরের দিকে হেঁটে গেল।
ভেতরে গিয়ে ওরা আরো অবাক। এটা পুরাই অপ্রত্যাশিত ঘটনা। রেশমা আন্টি সোফায় বসে থাকা সামিরের মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় বলছে,
—“বাবু, একটু ফ্রেশ হয়ে নে আগে। সারাদেশ ঘুরে এলি, অনেক টায়ার্ড তো তাইনা?” তারপর পাশের সকলকে উদ্দেশ্য করে হেসে বললেন,
—“ছেলেটা অনেক ব্যস্ত থাকে তো… সারাদিন পড়াশোনা, কাজকর্ম, টিউশনি। চোখমুখ একদম শুকিয়ে গেছে বাবুটার।”
সামির যে মায়ের কথায় অস্বস্তিবোধ করছিল, তা ওর চেহারা দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছে। নাবিলার চোখ কপালে। শ্রেষ্ঠা চোখ মেলে হাসি চাপার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। ক্লাস ফাইভে পড়া নাদিমও পাশে দাঁড়িয়ে মুখ চেপে হাসছে আর ভাবছে, ওর মা শেষ কবে ওকে বাবু বলে ডেকেছিল? কিন্তু মনে পড়ল না। আহিরের দিকে তাকিয়ে দেখল, আহিরও মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসছে।
এই আদিখ্যেতা আর নেওয়া যাচ্ছিল না। এত বড় একটা ছেলে বাবু? আজ বিয়ে দিলে কাল নিজে বাবু জন্ম দিবে। আন্টি যে কী বলে, আল্লাহ! সবাই মিলে চুপিচুপি পেছন দিয়ে বেরিয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়াল।
— “সামির ভাইয়া কত বড়।” চোখ বড় বড় করে বলে উঠল শ্রেষ্ঠা।
— “উঁচু খাম্বার মতো ওই নাকি আবার বাবু? আল্লাহ, হাসি চাপতে গিয়ে পেট ফেটে যাবে আমার।” লম্বা একটা দম নিয়ে বলল নাবিলা।
ওদের কথা শুনে আহির গম্ভীর মুখে বলল,
— “মা–বাবার কাছে সন্তানেরা সবসময় ছোটোই হয়। তোরা কী বুঝবি? আহাম্মক কোথাকার!”
নাবিলা মুখ ঘুরিয়ে এক ঝলক তাকিয়ে বলল,
—“ওর হয়ে তুই এত কথা কবে থেকে বলতে শিখলি, হুম? থাকিস সারাদিন আমাদের সাথে আর এখানে দাঁড়িয়ে ওর ভক্তিগান গাইছিস?”
আহির বেশ কনফিডেন্টলি উত্তর দিল,
—“সামির ভাইয়া অনেক ভালো।”
—“ভালো? আরেব্বাস! তোকে তো বশ করে ফেলছে। এ তো ছেলে সুবিধার না। মাত্র দুই মিনিটের পরিচয়ে তুই ওকে অনেক ভালো বলে ফেললি? ভাই, আমাদের তো কোনদিন বললি না।” শেষের কথাটা নাবিলা বেশ দুঃখীদুঃখী চেহারায় বলল। আহির আর ওর কথার জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করল না। চলে গেল ভেতরের দিকে…
বাড়ির ভেতর সবাই নিজেদের মত ব্যস্ত। সেই সুযোগে নাবিলা আর শ্রেষ্ঠা বেরিয়ে পড়ল হাওয়া খেতে। ভরা দুপুরের কড়া রোদ নরম হয়ে এসেছে, আকাশে সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে।
নাবিলাদের বর্তমান বাসা নাটোরে। কিন্তু নানাবাড়ির প্রতিটা বেলার সাথে ওর আত্নীয়তার সম্পর্ক। তবে আগের মতো বারবার আসা হয় না, কেবল উৎসব বা বড় কোনো ছুটিতেই সম্ভব হয়। নাবিলার নানা গত হয়েছেন বছর দুয়েক হলো। সেই বছরই শেষবার এসেছিল এখানে। নানু এখনও বেঁচে আছেন। তিনিই নাতি-নাতনীদের দেখতে যান প্রায় সময়।
এ বাড়িতে এখন নাবিলার একমাত্র মামা তৌকির আহমেদ, তার স্ত্রী আর তাদের দুই সন্তান নিয়ে থাকছেন। শ্রেষ্ঠা আহির, দুই ভাইবোনই বড় হয়েছে এখানে। আহির সদ্য অনার্সে ভর্তি হয়েছে, ফার্স্ট ইয়ারে। ও ভেতরে একটু ভাবনার মানুষ, কিন্তু একসাথে থাকলে রসবোধে ভরপুর। শ্রেষ্ঠা তুলনায় একটু ফান-পাগল, গল্প করতে, ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসে। তিনজনই একরকম সমবয়সী তাই সবকিছুতেই ওদের জমে ভালো। শুধু একটাই পার্থক্য, নাবিলা এখানে মেহমান আর ওরা প্রতিদিনের অভ্যস্ত মানুষ। তবে ফান টাইমে এসব মাথায় থাকে না। কে বড়, কে ছোট, কে ছেলে, কে মেয়ে; সবকিছুর উর্ধ্বে গিয়ে ওরা একেকটা কাহিনী ঘটায়।
ওই সামিরকে পেয়ে এখন আহির বোধহয় দল পরিবর্তন করে ফেলল। ঠিক আছে, ও আর কয়দিন থাকবে? তারপর তো আবার ঠিকই এই দলে ফিরে আসতে হবে। প্রথম প্রথম ওকে নেওয়া হবে না। কিন্তু যেহেতু ভাই, তাই দয়া করে হলেও পরবর্তীতে নিবে।
.
সামির ইয়াসির, মা-বাবার একমাত্র ছেলে। শান্তশিষ্ট, গম্ভীর স্বভাবের, একধরনের ভারিক্কি ভাব নিয়ে থাকে সবসময়। দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি রুচিশীল। লম্বা গড়ন, দৃষ্টিভঙ্গিতে স্থিরতা, কথা কম বলে, চেহারায় একটা বুঝার ভাব আছে। বয়স তেইশ-চব্বিশের মাঝামাঝি। অকারণে খুব একটা হাসতে দেখা যায় না, ওর হাসিটাও হিসেব করে ফুটে। বর্তমানে গার্লফ্রেন্ড আছে কিনা, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে তার সবচেয়ে কাছের বন্ধুটাও পায়নি। তবে একসময় কেউ ছিল। খুব গভীর কিছু ছিল না যে তার রেশ সারাজীবন বেঁধে রাখবে। সেই কেউ এখন তার চাচাতো ভাইয়ের স্ত্রী। সম্পর্কটা শেষ হয়েছিল চুপচাপ, শুরুটাও হয়েছিল ওইভাবেই। সামির ওসব নিয়ে মাথা ঘামায় না, যা গেছে তা নিজ ইচ্ছায় গেছে। কেউ যেতেও বলে নাই, কেউ ধরে বেঁধেও রাখে নাই।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পড়ছে, তৃতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা সদ্য শেষ হয়েছে। এখন কিছুটা ফাঁকা সময়, তাই মায়ের জোরাজুরিতে এখানে আসতে বাধ্য হয়েছে।
এখানকার মানুষজন ভালোই। অন্তত উপরে-উপরে তাই মনে হয়। হাসে, কথা বলে, খোঁজ নেয়। সামির একটু আগেই শুনেছিল নীতু আন্টির কাছে ওই মেয়েটা, মানে নাবিলা নাকি আন্টিরই মেয়ে। তাই সামির ছেড়ে দিয়েছে। নয়তো প্রথম দেখাতেই ওকে এইভাবে চোর উপাধি দেওয়া? সামির ইয়াসির দেখতে কি চোরের মত? শুধুমাত্র নীতু আন্টির মেয়ে বলেই নয়তো চোর অপবাদ দেওয়ার অপরাধে ওকে ছেড়ে দিত না।
তবে আহির ছেলেটা বেশ ভালো, ভদ্র, স্মার্টও। সহজে মিশতে পারে। সামির ওকেই খুঁজছিল। ও থাকলে বাইরে বের হওয়া যেত। সামির দরজায় উঁকি দিতেই আহিরের দেখা মিলল। ও এসে বলল,
—“ভাইয়া, আজ একটা দারুণ ফুটবল ম্যাচ আছে মাঠে। চলেন না, একসাথে দেখে আসি?”
লোভনীয় প্রস্তাব। সামির মাথা নাড়ল। ওর বাইরের যাওয়া দরকার ছিল আর সেটা যদি খেলা দেখতে যাওয়া হয় তবে কথাই থাকে না।
—“চলো।”
—“আমি এক মিনিটে আসছি। শুধু শার্টটা চেঞ্জ করব।”
—“আচ্ছা, আমি বাহিরে গিয়ে অপেক্ষা করছি।”
সামির গেট পেরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল। রোদ নরম হয়ে এসেছে, বাতাসে একটা বিকেলের গন্ধ। সে হাত ঘড়িতে একবার সময় দেখল, তারপর পকেটে হাত ঢুকিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকল। ঠিক তখনই হঠাৎ কোথা থেকে একটা নরম সিল্কের লাল ওড়না হাওয়ায় ভেসে এসে সামিরের মাথার ওপর পড়ল…
.
.
.
চলবে….
#প্রিয়াঙ্গন❤️ [পর্ব-০২]
~আফিয়া আফরিন
নাবিলা ছাদে দাঁড়িয়ে ছিল একা, ঠিক দাঁড়িয়ে ছিল বলা ভুল হবে; এমাথা ওমাথা ছুটে বেরাচ্ছিল। বাতাসেও তখন ছুটে চলা ভাব, বিকেলের নরম আলো পড়ে আছে চারপাশে। ওর হাতে একটা লাল ওড়না, সেটা মাথার উপর দিয়ে আকাশে ছুঁড়ছিল। নিজের মনেই… এই বয়সী একটা মেয়ে আপনমনে কতকিছু করে!
কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই হঠাৎ একটা হাওয়া এলো। ওড়নার এক প্রান্তটা ওর আঙুল থেকে ফসকে গেল। নাবিলা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তা বাতাসে ভেসে ছুটে নিচের দিকে নেমে গেল।
—“ওহ নো!”
নাবিলা রেলিংয়ে ঝুঁকে নিচের দিকে তাকাল। দেখেল, ওড়নাটা গিয়ে একজনের মাথায় পড়েছে। কার? সামির ইয়াসিরের। নাবিলার চোখ ছানাবড়া।
—“ওরে আল্লাহ… ওর গায়েই পড়তে হলো?”
সামির তখন আশেপাশে তাকাচ্ছে। ওড়নাটা কোথা থেকে উড়ে এসে পড়ল ঠিক বোঝা গেল না। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে সর্বশেষে উপরের দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেল নাবিলার সঙ্গে। নাবিলা নিচের দিকেই তাকিয়ে ছিল, হঠাৎ সামিরের চোখে চোখ পড়তেই খানিকটা বিব্রতবোধ করল। সামির জিজ্ঞেস করল,
—“এটা তোমার?”
নাবিলা উপর-নিচ মাথা নাড়ল। ইতস্ততভাবে কিছু বলতে গিয়েও চুপ।
সামির সামান্য হাসল, তারপর একটু নাটকীয় ভঙ্গিতে ওড়নাটা ছুঁড়ে ফেলার মতো ভঙ্গি করল।
—“ফেলে দিব?”
বাহ! কী সুন্দর করে জিজ্ঞেস করছে। নাবিলার তো ইচ্ছে করছে গিয়ে ওর মাথাটা ভেঙ্গে দিতে। কিন্তু আপাতত সেটা করা সম্ভব হলো না। হাসিমুখে বলল,
—“ফেলে দিবেন না। দুই মিনিট রাখুন, আমি আসছি।” গলায় তাড়াহুড়োর স্পষ্ট ছাপ। সামির কোনো উত্তর না দিয়ে ওড়নাটা হাতে ধরে দাঁড়িয়ে রইল।
নাবিলা ছাদ থেকে সিঁড়ি বেয়ে এক ঝটকায় নিচে নেমে এল। সময় হিসেব করলে এক মিনিট সতেরো সেকেন্ড লেগেছে মাত্র। ওর শ্বাস টেনে টেনে উঠছে। সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
—“দিন, এটা আমার। পড়ে গিয়েছিল।”
সামির ওড়নাটা হাতে ধরে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। ঠোঁটের কোণে একটুকরো বাঁকা হাসি টেনে বলল,
—“এটা তোমার, প্রমাণ কী?”
নাবিলা চোখ কুঁচকে তাকাল।
—“মানে?”
—“মানে হতেই তো পারে, কারো ওড়না তুমি নিজের বলে দাবি করছো?”
নাবিলা থমকে গেল। কয়েক সেকেন্ড পর হতভম্ব হয়ে বলল,
—“আমি অন্যের ওড়না নিজের বলে দাবী করব কেনো?”
সামির কাঁধ ঝাঁকাল।
—“দুনিয়াতে কত রকম মানুষ আছে। চেনা যায়?”
নাবিলা বিরক্ত হয়ে বলল,
—“আমার ওড়না নিশ্চয়ই আমি চুরি করব না?”
—“চুরির কথা তুমিই বললে। যদি তোমারই হয়, তাহলে উপযুক্ত প্রমাণ দাও এবং নিয়ে যাও।”
নাবিলার অবস্থা হলো খাবি খাওয়া মাছের মত।
—“আশ্চর্য! আমি বললাম তো, আমার। মুখের কথায় হচ্ছে না?”
সামির মাথা নাড়ল,
—“মুখের কথা গ্রহণযোগ্য নয়।”
নাবিলা ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আকাশ কাঁপিয়ে চেচাল,
—“আমি কি তোমার কাছে রেজিস্ট্রেশন করিয়ে রাখব নাকি, কোনটা আমার আর কোনটা না?”
সামির চোখ বন্ধ করে কানে হাত দিল। এই মেয়ে এইভাবে চেঁচায় কেন? উফফ, প্রমাণ চাওয়ার সাধ মিটে গেছে। এখন চেঁচাচ্ছে আর দুটো কথা বাড়ালে হয়ত মারামারিও শুরু করতে পারে। ওড়নাটার হাতবদল হলো। সামির বলল,
—“নাও। আমি ঝগড়াটে মানুষের জিনিস রাখি না খুব একটা।”
—“আমি ঝগড়াটে?”
ঝগড়া বোধহয় আরেকদফা হতো। তবে আহির এসে যাওয়াতে মাঝপথে বাঁধা পড়ল। সামির চটজলদি ওর সাথে বেরিয়ে পড়ল। বাপ্রে বাপ… মেয়ে না যে ছোটো সাইজের একটা ঝালে ভরপুর বোম্বাই মরিচ।
নাবিলা রান্নাঘরের দিকে এগোলো। রান্নাঘর আজ একটু বেশিই গরম। মাটির চুলায় আঁচ উঠছে, আর ঘরজুড়ে চালের গুঁড়া আর নারকেলের ঘ্রাণ। চারপাশে একধরনের বিশৃঙ্খলা। কেউ খুন্তি নেড়ে পিঠা তুলছে, কেউ নারকেল মিশ্রণ বানাচ্ছে, আবার কেউ বাটি নিয়ে বসে পিঠার খোল তৈরি করছে।
নাবিলা চুপচাপ রান্নাঘরে ঢুকে দরজা আগলে দাঁড়াল। মা, নানু, রেশমা আন্টি আর পাশের বাড়ির দুই-একজন পিঠা বানাতে ব্যস্ত। নাবিলাও ওদের সাথে গিয়ে হাত লাগাল। নানুর পাশে এসে বসতেই নানু বলল,
—“এইটা দেখ, খেজুর পাটালি আর নারকেল দিয়ে কী মিহি পুর বানাইছি। এই পুর দিয়ে ক্ষীর পুলি করবি। পারবি তো?”
নাবিলা মাথা নেড়ে বলল,
—“পারব না মানে? একশবার পারব। আমার হাতের পিঠা খেয়ে আশেপাশের সবাই প্রেমে পড়ে যাবে। তুমি খালি দেখো একবার? তারপর আমাকে তোমার কাছেই রেখে দিতে চাইবা?”
রান্নাঘরের কোণ থেকে পাশের এক খালাম্মা রসিকতা করে বলে উঠলেন,
—“ওরে বাবা, এই তোমাদের কারো ছেলে থাকলে ওকে বউ করে নিয়ে যাও। নয়ত তোমাদের ছেলেকে আনো, পিঠা খেয়ে প্রেমে পড়ে যাক।”
একমুহূর্তের জন্য রান্নাঘরটা হাসির ঝলকে জমে উঠল। রেশমা আন্টি পেছন থেকে বললেন,
—“তা প্রেমে পড়লে খারাপ কী?”
নাবিলা হেসে বলল,
—“প্রেমে পড়া বারণ, মা কড়াভাবে মানা করে দিয়েছে। আমি মায়ের কথা শুনেই চলি। মায়ের বাধ্য মেয়ে বলে কথা।”
নীতু মেয়ের কথা শুনে হাসলেন। সবাই হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। নানু ধমক দিয়ে বলল,
—“হইছে হইছে, এখন পিঠা বানাও। কথা কইতে কইতে কাজের দফারফা হয়ে যাবে।”
নানুর কথায় কেউ অবশ্য খুব একটা গা করল না। হেসে-খেলে, ঠাট্টা-মশকরায় সবাই মিলে পাটিসাপটা, চিতই, নারকেলের ভাজা পুলি, সেমাই পিঠা বানিয়ে ফেলল। নাবিলা বানালো পাটিসাপটা, ওর মতোই মিষ্টি হয়েছে; যে খাবে একেবারে প্রেমে পড়ে প্রেম সাগরে হাবুডুবু খেতে শুরু করবে।
.
রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর ওরা বসেছে লুডু খেলতে। নাদিমও পাশে এসে বসল। চুপচাপ তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর নিজের থেকেই একটা গুটি তুলে নিল।
—“আরে তুই সর এখান থেকে। তোর এখনও খেলার বয়স হয়নি। ক্লাসে অঙ্ক পারে না আর এখানে এসেছে লুডু খেলতে। ভাগ।” নাবিলা ওকে কষে ধমক দিল।
—“আপু আমি তোমাদের সাথে খেলতে চাই।” নাদিমের গলা নরম হয়ে গেল।
—“একদম না। তোর বুঝতেই বছর লেগে যাবে। তোর সাথে খেললে শুধু যুদ্ধ লাগে। যা, গিয়ে কার্টুন দেখ।” নাবিলা সাফ বলে দিল।
—“তবে চারজন হলে খেলাটা জমে কিন্তু। তিনজনে মজা পাওয়া যায় না।” শ্রেষ্ঠা বলল।
—“হুমমম।” নাবিলাও সায় দিল।
আর কাউকে জোগাড় করা গেলে জমে যেত খেলা। কিন্তু কে খেলবে? বড়রা সবাই নিজেদের আড্ডায় ব্যস্ত। আড্ডা ছেড়ে জীবনেও কেউ আসবে না। হঠাৎ নাবিলার মাথায় খেলে গেল সামিরের কথা। আহিরকে বলল,
—“আহির, যা না, তোর সামির ভাইকে ডেকে আন। চারজন হলে খেলা জমবে।”
আহির মুখ বেঁকিয়ে বলল,
—“পারব না। তুই যা।”
আসলে আহিরের মন একেবারেই খারাপ হয়ে আছে। ওর সাপোর্ট করা ফুটবল টিম আজকে ম্যাচে হেরে গেছে। তখন থেকেই ছেলেটা বাসায় এসে বাংলার পাঁচের মতো মুখ বানিয়ে বসে আছে। কেউ কিছু বললে উত্তর দিচ্ছে না, মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। প্রথম কিছুক্ষণ ওরা এই ব্যপারটা নিয়ে মজা করেছিল তারপর যখন দেখল, আহিরের মন আসলেই খারাপ তখন ছেড়ে দিছে।
তবে খেলার লোভে তো চুপ থাকা চলে না। অগত্যা নাবিলাই উঠে গেল সামিরকে ডাকতে। গিয়ে দেখল, সামির বারান্দায় চেয়ারে বসে ফোন স্ক্রল করছে। চাঁদের আলো গায়ে পড়ে ওকে একটু অন্যরকম লাগছে।
—“একটু আসবেন? লুডু খেলছি। একটা খেলোয়াড় কম।”
সামির চোখ তুলে তাকালও না।
—“না।” মাথা নিচু, কণ্ঠ সোজাসাপ্টা। এমনভাবে বলল, যে তাকে দ্বিতীয়বার অনুরোধও করা যায় না। এতটাই কড়া ছিল গলার ভাষা। নাবিলা চুপচাপ ফিরে এলো। সত্যি বলতে, একটু অপমানিতবোধ করল। আসবে না, খেলবে না, ভালো কথা। ওকে তো কেউ জোর করত না। এমনভাবে না শুনতে ভালো লাগে না। ওর ইগো হার্ট হলো প্রচুর। মনে মনে বলল,
—“বেয়াদবটার নাকের ডগায় ইগো, মাথার চুল ভর্তি রাগ, মুখ ভর্তি মেজাজ। চুলোয় যাও তুমি সামির ইয়াসির।”
নাবিলার ডাকে সামির না এলেও আহির যখন ডাকতে এলো তখন একবাক্যে রাজি হয়ে গেল। নাবিলার ভেতরটা জাস্ট জ্বলে গেল। কত্ত বড় নচ্ছার হলে মানুষ এইরকম কাজ করে! দাঁতে দাঁত চেপে চুপচাপ গুটি গোনার অভিনয় করে খেলায় মন দিল। সত্যি কথা বলতে কী, খেলায় মন আসছিল না আর। এই মন না বসার কারণেই সামির ওকে পরপর তিনবার হারিয়ে দিলো। এমনিতেই সামিরকে সহ্য হচ্ছিল না, তার উপর এসব? নাবিলার ভেতর যে কী হয়ে যাচ্ছে, তা একমাত্র ও জানে। নিজের রাগ, জেদ সামলাতে না পেরে লুডুর গুটিগুলোর উপর তেজ দেখাল। ওগুলো সব ঘরের এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছাড় মারল। নাবিলা রাগে ছক্কার গুটিও ছুঁড়ে ফেলল।
—“আমি আর খেলছি না।”
সামির হেসে বলল,
—“এত সহজে হার মানতে নেই, মিস নাবিলা।”
নাবিলা দাঁড়াল। লুডু কোর্টটাও ফেলে দিল। এতক্ষণ যাবত ওর কাছে এগুলো ছিল সামির ইয়াসির। ও এতক্ষণ সামিরের দফারফা করল, ওকেই ছুঁড়ে ফেলল, আছাড় মারল, ১৪ গুষ্টি উদ্ধার করল।
.
পরদিন পিঠা খেতে গিয়েও একই অবস্থা। নাবিলা বানিয়েছে শুনে সামির বলল,
—“এই পিঠা খেয়ে মানুষ প্রেমে পড়বে না। উল্টো ডায়াবেটিস ধরবে। এত মিষ্টি।”
রেশমা এসে ছেলের পিঠে চাপড় দিয়ে থামালেন,
—“দেখ বাবু, কেউ শখ করে বানালে এত কথা বলতে নেই।”
সামির বলল,
—“আর মানুষ যে শখ করে ডায়াবেটিস ধরাচ্ছে? পিঠা খাওয়াচ্ছে না উল্টো হাসপাতালের টিকেট হাতে ধরাচ্ছে।”
রেশমা বিরক্ত হয়ে বললেন,
—“দুই একটা পিঠা খেলে আবার ডায়াবেটিস হয়? পাগল কোথাকার।”
ওখানে নাবিলা উপস্থিত ছিল না। তাই সামিরের কথাবার্তা তার শোনার কথাও না। তবে তার গুপ্তচর ছোটভাই ওখানেই ছিল। সে দৌড়ে এসে নাবিলাকে সবটা বলে দিল। নাবিলা আবার ভয়ঙ্কর রেগে গেল। তারই নানা বাড়িতে দাঁড়িয়ে তাকেই এভাবে অপমান করা হচ্ছে প্রত্যিটা পদে পদে? নাহ, এই সামির ইয়াসিরকে এইবার দেখতে হবে। এত বাড়াবাড়ি আর সহ্য করা যাচ্ছে না। কিছু একটা ভাবতে হবে… কিন্তু তৎক্ষণাৎ ভাবার অবকাশ পেল না। নাবিলার বাবা নেওয়াজ আহসান ওকে নিয়ে বাহিরে বের হলেন। বাবার সাথে ঘুরতে বেরিয়ে নাবিলার মনটা হালকা হলো। সদরের এইদিকে উনার কিছু কাজ ছিল, কাজ শেষ করে মেয়েকে নিয়ে বাহিরে খাওয়া-দাওয়া করলেন। বাবার সাথে নাবিলার সম্পর্ক বরাবরই বেশ ভালো। বাবার সান্নিধ্যে থাকলে ও একটা অন্য মানুষ হয়ে যায়। ঝগড়াটে মনটাও নরম হয়ে যায়। ফেরার পথে রাস্তার এককোণে আখের রস দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন। মেয়ের হাতে এক গ্লাস আখের রস ধরিয়ে বললেন,
—“এখানে এসে কেমন লাগছে মা?”
—“অনেক ভালো।”
—“তোমার মা আমাকে একটা কথা বলল। তোমার বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত নিতে চাইছে। আমিও ভেবে দেখলাম তা খারাপ না।” উনি ধীরে সুস্থে কথাটা বললেন।
নাবিলা খানিকটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
—“সিদ্ধান্ত? সেটা কীরকম বাবা?”
—“সবকিছু ঠিকঠাক হলে তোমাকে জানানো হবে। তবে তোমাকে একটা কথা বলে রাখি, আমরা তোমার জন্য যে সিদ্ধান্ত নিই তা কিন্তু খারাপের জন্য না। তাতে তোমার ভালই হবে। জীবনটা অনেক বড় মা। আশা করি তুমি মন খারাপ করবে না।”
নাবিলা কি বুঝলো বা কতটুকু বুঝলো কে জানে? হেসে মাথা নেড়ে বলল,
—“আচ্ছা। তুমি আর মা হচ্ছো, আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। তোমাদের কথা আমি ফেলেছি কখনো? আর আমি তো আমার ভালোমন্দের সিদ্ধান্ত নিজে কখনো নিই নাই। তোমরা যা বুঝেছ, করেছ। তাতে কখনোই আমার খারাপ হয় নাই।”
মেয়ের কথা শুনে বাবা হাসলেন। আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তিনি মূলত মেয়েকে নিয়ে বেরিয়েছিলেন কিছু কথা বলতেই। যদিও পুরোপুরি সবটা বলতে পারেন নাই, কিন্তু অলক্ষ্যে মেয়ের মতামত ঠিকই নিয়েছেন। খাওয়া এবং কথাবার্তা শেষে নাবিলাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন।
ফিরে এসে নাবিলা ভাবতে লাগল, কি করে কাউকে কাত করা যায়? আসার সময় দেখেছে, সামির আহিরের সাথে বাহিরে বের হয়েছে। নাবিলা ধীর পায়ে চোরের মত পা টিপে টিপে সামির সে ঘরটায় থাকছে, সেখানে এলো। ঘরের ভেতর ঢুকেই একধরনের আলাদা পরিবেশ টের পেল। মানুষ বেশ পরিপাটি আছে, যাওয়ার আগে সব ঠিকঠাক করে রেখে গেছে। ভালোই! নাবিলা আশেপাশে তাকাল। সারা ঘরজুড়ে সুন্দর একটা ঘ্রাণ বিচরণ করছে। নরম কিন্তু তীক্ষ্ণ পুরুষালি ঘ্রাণ। পারফিউম আর পুরুষের গায়ের চিরচেনা উষ্ণতার মিশেল। নাবিলা দাঁড়িয়ে রইল একমুহূর্ত। চোখ ঘুরিয়ে তাকাল, একটা তোয়ালে চেয়ারে ঝুলছে। বাতাস এসে বিছানার কোণ কিছুটা অগোছালো করে দিচ্ছে বারবার। বারান্দা থেকে আসা আলো বিছানার সাদা চাদরে হালকা সোনালি আভার সৃষ্টি করেছে।
আরে ধুর, সে তো এসেছে অভিযান চালাতে। এতকিছু কেনো দেখতে হবে? ধ্যাত্তেরিকি… নিজের মাথায় চাপড় মারল নাবিলা। এই ঘরেই একটা কারসাজি করে রাখতে হবে। একটা ফাঁদ পাততে হবে, যেখানে সামির ইয়াসির ইচ্ছাকৃতভাবে পা দিবে।
নাবিলা অনেক ভেবেচিন্তে, মুখে একটা কূটকূটে হাসি চেপে, রান্নাঘর থেকে সরিষার তেলের ছোট বোতলটা তুলে নিল। তার চোখেমুখে তখন একটা রহস্যময় উদ্দীপনা। ঠিক তখনই পেছনে নানুর কণ্ঠ ভেসে এলো,
— “এই যে নানু, তেলের বোতলটা নিলা যে? কী করবা?”
নাবিলা দাঁড়িয়ে পড়ল। গলা নামিয়ে বেশ গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল,
— “একটু লাগবে।”
নানু কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন,
— “কি কাজে?”
নাবিলা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য হেসে বলল,
— “খাবো। ঠান্ডা লাগছে, সরিষার তেল খাইলে আরাম লাগে। ছোটোবেলা থেকেই খাই।”
নানু তখন চোখ সরু করে তাকালেন। ছোটবেলা থেকে নাবিলা কখন কখন ঠান্ডা লাগলে সরিষার তেল খেয়েছে সেটা মনে করার চেষ্টা করলেন।
— “এই মেয়ে, এমনে কেউ তেল খায় নাকি? কই, তোমাকে তো কোনোদিন দেখলাম না এরকম করতে?”
নাবিলা তখন মুখে জোর করে হাসি টেনে কয়েকবার খুকখুক করে কেশে বলল,
— “তুমি হয়তো খেয়াল করোনি। আমি এমনিই খাই, মাঝে মাঝে।”
তারপর আর কোনো কথা না বলে তেলের বোতল বগলদাবা করে রান্নাঘর থেকে চট করে বেরিয়ে গেল।
নানু একটু অবাক হলেন। চেহারাটা ভাবনায় ডুবে গেল,
— “ছোটো থেকে বড় করলাম। কত কিছু খাইতে দেখলাম। কিন্তু এমনে তেল খাইতে দেখিনি। এই মাইয়া দিনকে দিন বেজায় চালাক হইতেছে। আল্লাহই জানে, এর মাথায় কীসের ভূত চাপছে।”
এদিকে নাবিলা দূরে সরে গিয়ে হেসে কুটিকুটি। মিশন সরিষার তেল, সফল। এইবার স্লিপ অ্যান্ড ফল তো ঠিকই হবে, হতেই হবে। তবে শ্রেষ্ঠা থাকলে ভালো হতো, প্রাইভেটে গেছে। একা হাতে এতকিছু করা মুশকিল। ও থাকলে সবকিছু গুছিয়ে করা যেতো। তাও সমস্যা নেই, নাবিলার যথেষ্ট মনের জোর রয়েছে। সে একাই পারবে।
নাবিলা তেলটা বারান্দার দরজার সামনের মেঝেতে একটানা ছড়িয়ে দিল। তারপর পাপোশটা এমনভাবে বিছিয়ে দিল, যাতে বোঝা না যায়।
নিজেই পা রাখল, একটুখানি পিছলে গেল। হ্যাঁ, ঠিক আছে। কাজে দেবে। খুশিতে ডগমগ করে ঘর থেকে বেরোতেই বাঁধল বিপত্তি। সামির… দরজায় দাঁড়িয়ে আছে, ফোনে কথা বলছে কার সাথে। একটা হাত পকেটে, আরেকটা কানে। হঠাৎই নাবিলার দৃষ্টি আটকে গেল ওর ঘাড়ের উপর পড়ে থাকা চুলগুলোয়। এমনকি ওর দাঁড়িয়ে থাকার স্টাইলটাও কী অসহ্য রকমের সুন্দর। ও থমকে গেল। মরণের মাঝামাঝিতে দাঁড়িয়ে কী ভাবছে এসব? নাবিলা দৌড়ে গিয়ে বারান্দায় লুকিয়ে পড়ল। মুখে হাত চেপে হাসি আটকানোর চেষ্টা করল।
সামির ঘরে এলো। দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিল। কাপড় চেঞ্জ করল। নাবিলা অবশ্য কিছুই দেখল না। সে যথেষ্ট ভদ্র। ও মাথা বারান্দার দেয়ালে ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে খানিকটা বিরক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
কিছুক্ষণ পরে চোখ খুলে আবার একবার উঁকি দিল। ভুরু কুঁচকে বলল,
— “এত কষ্ট করে প্ল্যান করলাম। ওই একটুখানি তেলের জন্য রান্নাঘর থেকে শুরু করে নানুর নজরদারি পর্যন্ত সহ্য করলাম। এখন যদি ও পাপোশে পা না রাখে, তাহলে তো সব গেছে।”
নাবিলা উঁকি দিয়ে দেখল, সামির আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে হাত চালাচ্ছে। তারপর শার্টের হাতা গুটিয়ে… আরে! সে পাপোশের ঠিক পাশ দিয়ে হেঁটে গেল। নাবিলা মনে মনে ফোঁস করে উঠল। অধৈর্য হয়ে যাচ্ছিল ও। ঠিক এমন সময়, নাবিলা এগিয়ে আসে। ওকেও তো ঘর থেকে বেরোতে হবে, তাই না?
কিন্তু যেভাবে ভেবেছিল, ব্যাপারটা ততটা সহজ হলো না। সামির তখনই বারান্দার দিকে পা বাড়াল। পাপোশের উপর পা রাখতেই ঘটে গেল বিপত্তি। এক সেকেন্ড! মাত্র এক সেকেন্ডের মধ্যেই সামির সামনের দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ল, আর পড়ল তো পড়ল গিয়ে নাবিলার উপর। নাবিলার মুখে চাপা চিৎকার,
— “আউচ!”
সামিরের মুখে থতমত ভাব।
.
.
.
চলবে….