প্রিয়াঙ্গন পর্ব-৩+৪+৫

0
17

#প্রিয়াঙ্গন❤️ [পর্ব-০৩]
~আফিয়া আফরিন

দুজনেই পড়ে গেছে মেঝেতে, একজনের গায়ের উপর আরেকজন। নিচে নাবিলা উপরে সামির। কোনোকিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘটে গেল ঘটনাটা। নাবিলা হাঁ করে তাকিয়ে রইল সামিরের মুখের দিকে, মুখে ভয় আর অস্বস্তির ছাপ। কী কী ঘটছে ওদেরকে কেন্দ্র করে! গতকালও পড়ে গেল, আর আজ তো কথাই নেই… ছিঃহহ লজ্জা লজ্জা! সামিরও মুহূর্তের জন্য স্থির। শরীরের ভর এখনও দিয়ে আছে নাবিলার উপর।
চারপাশে নিস্তব্ধতা। শুধু দুজনের চটকা খাওয়া নিঃশ্বাস একসাথে ধাক্কা দিচ্ছে বাতাসে।
সামির দ্রুত সরে পড়ল। মুখে বিস্ময়ের হালকা ছাপ স্পষ্ট। নাবিলাও উঠে বসল। ওড়নাটা এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল, টেনেটুনে ঠিক করল। মুখটা রাগ আর অস্বস্তিতে লাল হয়ে উঠেছে। একপলক তাকিয়ে সামিরকে দেখার চেষ্টা করল। তারপর উঠে দাঁড়াল, কিন্তু দু’পা এগোতেই আবার বিপত্তি। তেলের ওপর পা পড়তেই পিছলে গেল একেবারে। শেষমুহূর্তে দেয়ালঘেঁষা দরজার হাতল ধরে নিজেকে টেনে নিল। পড়ে যাওয়ার হাত থেকে কোনোমতে বাঁচল। বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল। মনে মনে নিজেকেই কথা শোনাল,
“শালার প্ল্যান করতে গিয়া নিজেই ধরা খাইছি।”

সামির নাবিলার সামনে এসে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল,
— “এসব কি?”
নাবিলা চুপ। কী বলবে, তাই মাথায় সাজিয়ে নিচ্ছে। সামির ফের বলল,
— “বারান্দার সামনে তেল, এগুলা তোমার কাজ তাইনা?”
সে ভ্রু একটুখানি তুলে তাকিয়ে থাকল। চোখেমুখে এমন একটা অভিব্যক্তি, যেন সব বুঝে ফেলেছে কিন্তু সরাসরি কিছু বলবে না।নাবিলার মুখ থেকেই সবটা শুনতে চাচ্ছে। সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নাবিলার দিকে। গায়ে তেলের ছিটে, মুখে বিরক্তি, কিন্তু চোখেমুখে লুকানো একধরনের সন্দেহ। নাবিলা নিজেও হাঁপিয়ে উঠেছে। কাপড়চোপড় তেলে ভিজে চিটচিটে লাগছে, মেজাজের তাপ তেলের মতোই জমে আছে চেহারায়।
— “আমি কীভাবে জানব? নিজেই তো পড়ে গেলাম।” নাবিলা বলল।

সামির ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করল,
— “এই ঘরে তুমি কি করছো? বর্তমানে এখানে তো আমি রয়েছি, তাই না?”

নাবিলা একটুও পিছু না হটে বলল,
— “ভুলে চলে এসেছি। আপনার কথা আমার মনে ছিল না।”

সামির চোখ তুলে বলল,
— “মানে? যাতা কথা বলবা না। এই যে মেঝেতে তেল, এটাও ভুল? সব ভুল?”

নাবিলা দাঁতে দাঁত চেপে রাগ সামলাল। তারপর গম্ভীর গলায় বলল,
— “আমি কীভাবে বলব? দেখি সরুন, আমাকে যেতে দিন। অভদ্রের মত আমার পথ আটকেছেন কেনো? এমনিতেই তেলে চিপচিপে হয়ে গেছে গায়ের কাপড়চোপড়। বিরক্ত লাগছে।”
সামির স্থির দৃষ্টিতে তাকাল। তারপর হয়তো কিছু বুঝতে পেরে, হয়তো তর্ক এড়াতে, অথবা হয়তো নাবিলার চেহারায় ছড়িয়ে থাকা অস্থিরতা দেখে, একপাশে সরে দাঁড়াল।
— “যাও। সাবধানে হাঁটো। দুইবার হয়ে গেছে অলরেডি, আরও একবার পড়লে সত্যি হাসপাতালে যেতে হতে পারে।” ওর কথায় ছিল ঠাট্টা, আর চোখে একচিলতে ব্যঙ্গ।
নাবিলা ওড়না টানতে টানতে মুখ ঘুরিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল। মুখে কিছু না বললেও, মনে মনে ঝলসে উঠছিল। এই ছেলেটা একদম অসহ্য।

সামিরের ঠোঁটের কোণে একটুকরো বাঁকা হাসি খেলে গেল। কেউ তাকে বলেনি, কিন্তু তবুও সব বুঝে গেল। এটা যে নাবিলার কাজ সেটা জানতে সাইন্টিস্ট হতে হয় না। আশেপাশে পর্যবেক্ষণ করলেই হয়ে যায়। কিন্তু সে কিছু বলল না। বলত, যদি শুধু সে-ই ভুক্তভোগী হতো। বলত, যদি তাকে কুপোকাত করে নাবিলা দাঁড়িয়ে হেসে উঠত। কিন্তু না, নাবিলাও ধপাস করে পড়ে গিয়েছিল এবং ব্যথাও বোধহয় তার চেয়ে বেশি পেয়েছে। সামির নিজের তেলে চিপচিপে শার্টের দিকে তাকাল আর একবার দরজার দিকে।
এই বাড়িতে আর থাকা যাচ্ছে না। চারপাশটা শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে উঠেছে। মায়ের শখ ছিল, বান্ধবীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে। সেটা তো হয়েই গেছে। কিন্তু এরপর? এই জায়গা তার জন্য নয় আর। তাই সিদ্ধান্তটা নেওয়া জরুরি হয়ে পড়ল। মা যতদিন খুশি থাকুক এখানে, তাতে কারো কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু তাকে চলে যেতেই হবে। আগামীকাল-ই। সকাল হলে ব্যাগ গোছাবে।
.
নাবিলা এমন বিপাকে কোনোদিন পড়েছিল কি? জীবনেও না। একটা ছেলের সামনে বারবার, নিজেরই কাণ্ডে মান-ইজ্জত প্রশ্নের মুখে পড়ছে।
আর সামির? না বলেও কিছু একটা বুঝিয়ে দিচ্ছে তার নীরব চাহনিতে। এইমাত্র, সামিরের ঘরে ঘটে যাওয়া সেই অপ্রত্যাশিত ঘটনা…
পিছলে পড়া, তার গায়ে গিয়ে পড়া এবং তার কটাক্ষ, সব মিলিয়ে মাটির নিচে লুকিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছিল। হাতদুটো কানে তুলে ফেলল অবলীলায়।
— “আল্লাহ, যথেষ্ট শিক্ষা হয়ে গেছে আমার। আর কোনোদিন, কারো পিছে লাগব না। কারো সাথে চালাকি করব না। কোনো ছেলের সঙ্গে এমন ফালতু কিছু করব না।”

মনটা কেমন ছোট হয়ে আসছিল। কে বলেছে, ছেলেরা বোকার মত পিছে ঘুরে বেড়ায় আর মেয়েরা চালাকি করে জিতে যায়? এই ছেলেটার সামনে তো সে বারবার পরাজিত। দুই পা টেনে টেনে হাঁটছিল নাবিলা, সাথে করে নিজের ভুলের ভারও ঘাড়ে করে নিয়ে যাচ্ছে। ব্যথা পেয়েছে বেশ ভালোই। পায়ে টান লাগছিল। নিজেকেই মনে হচ্ছিল নিজের সবচেয়ে বড় শত্রু।
শ্রেষ্ঠা বাড়ি ফিরতেই ওকে একে একে সব কাহিনী খুলে বলল। শ্রেষ্ঠা তো হেসেই কুলকিনারা খুঁজে পাচ্ছে না। নাবিলা গাল ফুলিয়ে বসে রইল। ওকে বলাই উচিত হয় নাই। এখন ফাজলামি শুরু করে দিবে। ভাবতে না ভাবতেই শ্রেষ্ঠা শুরু করে দিল,
— “কীগো! একেবারে দু-দুবার পড়ে গেলে? এটা কি নরমাল? তলে তলে কোনো কাহিনী চলছে না তো?”

নাবিলা চোখ রাঙিয়ে তাকাল,
— “মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোর? কী যে বলিস না!”

শ্রেষ্ঠা কেমন বাকা হেসে কাঁধ উঁচু করে বলল,
— “আমি কিছু বলিনি, বাপু। ঘটনাই সব বলে দিচ্ছে। অমন করে গায়ে গিয়ে পড়া, বারবার। তা তো কাকতালীয় বললে হয় না।”

নাবিলা তিরিক্ষি ভঙ্গিতে বলল,
— “আর বলিস না। এমন লজ্জা পেয়েছি… মনে হচ্ছিল, মাটির নিচে ঢুকে যাই।”

শ্রেষ্ঠা এবার হেসেই ফেলে,
— “তা ঢুকলে না কেন?”

নাবিলা একখানা বালিশ তুলে শ্রেষ্ঠার দিকে ছুঁড়ে মারল,
— “চুপ কর। তোকে বলেই ভুল করেছি।”

শ্রেষ্ঠা বালিশটা জড়িয়ে ধরে বলল,
— “একটা কথা বলি? সামির ভাইয়া কিন্তু খারাপ না। ভেবে দেখতে পারো। মানাবে ভালোই মনে হচ্ছে। আর হুটহাট তো কিছুনা তাইনা? যেহেতু কয়েকবার তোমাদের ইয়ে মানে, চোখাচোখি হয়েছে তাহলে এতক্ষণে কেমিস্ট্রি হয়েই গেছে। তলে তলে টেম্পু না চালিয়ে রাস্তায় চালিয়ে আমাদের দেখার সুযোগ করে দাও আপু, প্লিইইইইইজ।” শেষের কথাটুকু টেনে বলল শ্রেষ্ঠা। নাবিলা উঠে ওর পেছনে ধাওয়া করল। শ্রেষ্ঠা পালিয়ে বাঁচল।

ওরা দু’জনেই নিজেদের ছোট্ট দুনিয়ায় ব্যস্ত ছিল; ঝগড়া, খুনসুটি আর মান-অভিমান নিয়ে। ওদের ধারণা, এসব শুধু সাময়িক মজা আর কাকতালীয় ঘটনা মাত্র। কিন্তু বাড়ির বাকি লোকজন ভাবনাটা ভাবছিল একদম ভিন্নভাবে।
কয়েকদিন আগে যখন এক পক্ষের তরফ থেকে প্রস্তাব রাখা হয়, তখন থেকেই সকলে মনে মনে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে শুরু করে। একেকজন একেকভাবে বিশ্লেষণ করতে থাকে। স্বভাব, মানসিকতা, পরিবার, ঘরানার মিল-অমিল সবকিছু। অবশেষে প্রাথমিক মতামতে সবাই হ্যাঁ জানিয়েছে। তবে বিষয়টা একেবারে হালকাভাবে নেওয়া যায় না। নেওয়াজ আহসান তাড়াহুড়ো করতে চাচ্ছেন না। তিনি আরেকটু ভেবে সিদ্ধান্ত জানাবেন বলেছেন। কারণ, নাবিলা তার একমাত্র মেয়ে। মেয়ের ব্যপারে তিনি একদম হঠকারিতা করবেন না। বলেছিলেন,
— “আমি একটু ভাবি, বুঝেশুনে বলি।” এই “বুঝেশুনে বলা” কথাটাই সবাইকে অপেক্ষায় রেখেছে।

আজ সন্ধ্যায়ও, প্রতিদিনের মতো চায়ের কাপে পারিবারিক আড্ডা বসেছে। গল্প জমে উঠেছে। ঠিক তখনই নেওয়াজ আহসান তার মতামতটা জানালেন,
— “আমি ভেবেছি। অনেক দিক দেখেছি এবং আমার দিক থেকে, হ্যাঁ।”
শব্দটা নিঃসৃত হতেই সবার চোখেমুখে আনন্দের রেখা দেখা গেল, বিশেষ করে রেশমার। তিনি বললেন,
— “আপনি মেয়েকে নিয়ে চিন্তা করবেন না ভাই। আপনার মেয়ে আমার কাছে খারাপ থাকবে না।”

নেওয়াজ আহসান হেসে জবাব দিলেন,
— “আমার মেয়ে আপনার ঘরে গেলে, আমার আর দুশ্চিন্তা কীসের?”

পাশে বসে থাকা নীতু মাথা নাড়লেন। হাসিমুখে বললেন,
— “হ্যাঁ, নিজেদের মানুষ বলেই তো রাজি হয়েছি। এখন আমরা কি ওদের সঙ্গে কথা বলব?”

রেশমা বলল,
— “সামিরের আব্বুকে আসতে বলেছি। তিনি আসুক আগে। ছেলের সঙ্গে ওর বাবা নিজে কথা বলবে। তারপর নাবিলাকে জানালেই হবে। মেয়ে তো লক্ষ্মী, মনে হয় না অমত করবে।”
— “নাবিলা কখনো আমাদের সিদ্ধান্তের বাইরে যায়নি।” নীতু বলল।

সকলের কথার মাঝখানে মামা খানিক চিন্তিত স্বরে বললেন,
— “তবুও, ওদের না জানিয়ে আমরা আগেই এত কিছু ঠিক করে ফেলছি, এটা কি ঠিক হচ্ছে? যদি ওদের আগে থেকেই কোনো পছন্দ-অপছন্দ থাকে?”

রেশমা বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে বললেন,
— “সামিরের যে নেই, তা আমি নিশ্চিত। ছেলেকে চিনি তো। ইনিয়ে-বিনিয়ে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি। কেউ থাকলে অন্তত আমি জানতাম।”

নীতু পাশে বসে মাথা হেলাল,
— “নাবিলারও নেই। আমি ওর মা। সেরকম কিছু হলে আমার চোখ এড়াবে না।”
সিদ্ধান্ত সেটাই রইল। আগেই ওদেরকে কিছু জানানো হবে না। কারণ উপস্থিত সবাই জানত, ওদের এখন কিছু না বললেও চলবে। কারণ সময় আপনাআপনিই অনেক কিছু গুছিয়ে ফেলার ক্ষমতা রাখে।
.
সামির বাড়ি যাওয়ার কথাটা মাকে বলল। মা তো এত সহজে যেতে দেবে না তাই অযুহাত হিসেবেও বাড়িয়ে বাড়িয়ে কিছু বলল। ভার্সিটিতে কিছু কাজ আছে, পড়াশোনারও চাপ আছে, বাবা ওদিকে একলা সবকিছু সামলাচ্ছে; বাবাকে সাহায্য করতে ছেলের যেতে হবে। সব শুনে রেশমা হেসে বললেন,
— “তুই আমাকে কাজের দোহাই দেখাচ্ছিস? তোর বাবার কথা যে ভাবছিস, সে তো আসছে কাল।”

সামির অবাক হলো। বাবা কেনো আসতে যাবে? আশ্চর্য! এরপর তো দেখা যাবে ওর ১৪ গুষ্টি একে একে আসতে শুরু করে দিয়েছে।
— “বাবা আসছে? হঠাৎ?”
— “না, হঠাৎ না। দুইদিন আগেই সে বলেছিল, আসবে। একটা দরকারি কথা আছে।”
— “কি দরকারি কথা? আর কার সাথে?” সামির সত্যিই অবাক।

রেশমা সামান্য হেসে বললেন,
— “তুই থাক, কাল সব জানবি। এখন শুধু বলছি, যাওয়ার চিন্তা বাদ দে। তোর বাবা তোকে কিছু বলবে।”
— “আমাকে? ফোনে কেনো বলছে না, আমাকে ডাকছে না সরাসরি নিজে আসছে? এটা কেমন হলো? মা, তুমি কি আমাকে বলবে কী হচ্ছে? এমন লুকোচুরি করলে আমি কিন্তু সত্যিই ফিরে যাবো।”
— “তোদের বাপ-ব্যাটার কথা আমি কী জানি?” রেশমা আর কথা বাড়ালেন না। ছেলেকে তিনি ভালোভাবেই চেনেন। বেশি কিছু বললে নির্ঘাত ধরে ফেলবে।
সামির কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। মায়ের চোখে একটা গোপনীয়তা টের পাচ্ছিল। কী হতে যাচ্ছে, বুঝতে পারছিল না। মুহূর্তেই অজানা অস্বস্তি বুকের ভেতর জায়গা নিল।

নাবিলা ইচ্ছাকৃতভাবে আর সামিরের সামনে পড়তে চাইছিল না। সবমিলিয়ে পরিস্থিতিটা এখন রীতিমতো লজ্জার। যতবার চোখে চোখ পড়েছে ততবারই মনে হয়েছে, সামিরের দৃষ্টিতে ঠাট্টা লুকিয়ে আছে। আর কোনো বিব্রতকর কিছু হোক সেটা সে চায় না। নিজে থেকেই একটা সময় খুঁজে সামিরকে সোজা সরি বলে দেবে। তবে এখন নয়। ভেতরের লজ্জাটা যাক আর সাহসটা আরেকটু দৃঢ় হোক। দেখা করবে না দেখা করবে না করেও, খাওয়ার টেবিলে এসে নাবিলা ঠিকই সামিরের সামনে পড়ে গেল। যদিও চোখে চোখ পড়েনি, কিন্তু আশেপাশের হাওয়ায় চাপা একটা অস্বস্তি ছিল। এমনিতেই বাজে একটা পরিস্থিতি তারমধ্যে হঠাৎ নানু জিজ্ঞেস করলেন,
— “কিগো নানু, তেলের বোতলটা কই? তখন তো তুমি নিলা।”

নাবিলা জোরে একটা বিষম খেল। হাঁচির মত কাশি জটলা পাকাল গলায়। নিজেকে কোনোমতে সামলে নিয়ে বলল,
— “আমি কি জানি?”

নানু কপালে ভাঁজ ফেললেন,
— “তুমি না তখন রান্নাঘর থেকে নিলা?”

নাবিলা এবার ঠোঁট শক্ত করে জবাব দিল,
— “আমি নিই নাই।”

চারপাশটা হঠাৎ নিস্তব্ধ হয়ে গেল। সামির নিঃশব্দে খাচ্ছে। মুখে রা নেই। কিন্তু তার নীরবতাই জেরা করছিল নাবিলাকে। পরিস্থিতি সামলাতে শ্রেষ্ঠা দ্রুত এগিয়ে এল। বলল,
— “দাদু, ওটা আমি নিতে বলেছিলাম। রান্নাঘরে রেখে এসেছি একটু আগে।”
— “ঠিক আছে, পরে দেখব। খাও খাও। আমি একটু আগে খুঁজছিলাম তো।”
নাবিলা মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। যাক, আপাতত বাঁচা গেল।
কিন্তু সামিরের নিঃশব্দ হাসি কি সে ভুল করে দেখল?

নিশুতি রাত, বাড়ির সব আলো নিভে গেছে। জানালার পর্দা খানিকটা সরানো, চাঁদের আলো ঘরে উঁকি মারছিল। নাবিলা জানালার পাশে বসে তাকিয়ে ছিল বাইরে। চারদিক এত শান্ত, অথচ ওর ভেতরটা কেমন তোলপাড় করছে।
উঠে দাঁড়াল, আয়নার দিকে চোখ গেল। একটু ঝুঁকে নিজের মুখটা দেখল। কপালের চুলগুলো এলোমেলো। নিজের প্রতিচ্ছবিকে দেখতে দেখতে ফিসফিস করে বলল,
— “আমি এতটা বাজে হয়ে গেলাম কবে? সত্যি কি অনেক বাজে কাজ করে ফেলেছি?”
পুরো ঘটনাগুলো এক এক করে ভেসে উঠছিল। কোনোভাবেই কিছু মাথা থেকে সরাতে পারছে না। বিশেষ করে, সামিরের দৃষ্টিভঙ্গি। ও নিশ্চয়ই নাবিলাকে খুব বাজে ভাবছে। ভাবতেই পারে… স্বাভাবিক। কিন্তু নাবিলা কি আসলেই এত বাজে? খাওয়ার সময় তার চোখের দিকে তাকিয়ে যে দৃষ্টিটা পেয়েছিল, ঠোঁটের কোণে যে হাসি ফুটে উঠেছিল সেটা কি ঠাট্টা? বিদ্রুপ? অপমান? নাবিলা কপাল চেপে ধরল। মনে মনে বলল,
— “এটা আমি কী করলাম? শায়েস্তা করতে গিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু এখন তো নিজেই গুবলেট খেয়ে বসে আছি।”
কেমন করে নিজের নিয়ন্ত্রণটা হারিয়ে ফেলেছে ও। সেই নাবিলা, যে কারো সামনে বুক ফুলিয়ে কথা বলতে পারে, আজ হঠাৎ একটা ছেলের সামনে বারবার মুখ থুবড়ে পড়ছে। নিজেকে ছোটো লাগছে, অচেনা লাগছে। অথচ কাউকে কিছু বলতেও পারছে না। চুপচাপ জানালার পাশে হেলান দিয়ে বসে রইল। বাইরে একটা কুকুরের ডাক ভেসে এল দূর থেকে। বাতাস একটু ঠান্ডা হয়ে গেছে। নাবিলা চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। চাঁদের আলো জানালার গ্লাসে ঠেকে ছোট্ট একটা ছায়া ফেলল ওর মুখে। সেই আলোতেই স্পষ্ট হলো নাবিলার অস্পষ্ট অপরাধবোধে মোড়ানো মুখ।
.
সকালে বাড়ির উঠানে চা-চক্র চলছে। পাতানো চাটাইয়ের ওপর সবাই বসে আছে। এমন সময় পরিপাটি পোশাকে সাখাওয়াত হোসেন উপস্থিত হলেন। ইনি সামিরের বাবা। সকলে কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে এলো। এটা তার শশুরবাড়ি এলাকা হলেও বিয়ের পর কখনো আসা হয় নাই, তাই তেমন চেনাজানাও নাই। তবে রেশমা সকলের কথা বলেছিল। চেহারায় না চিনলেও নামে অনেককেই চেনেন তিনি। সামির বাবাকে দেখে এগিয়ে এলো। বাবা হঠাৎ এলো কেন, এই প্রশ্ন মাথায় ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। সাখাওয়াত হোসেন হাত বাড়িয়ে হালকা করে ছেলের পিঠে চাপড় দিলেন।
— “তোমার জন্যই চলে এলাম, বাবা। কী খবর?”

সামির তেমন কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ করল না। একটা ধোঁয়াশার মধ্যে থেকেও গলা স্বাভাবিক রেখে বাবার প্রশ্নের জবাব দিল। সামির ওখানে অনেকক্ষণ উপস্থিত ছিল। তেমন কোনো কথাবার্তা হয় নাই কারো মধ্যে। অনেকদিন পর হঠাৎ বন্ধু-বান্ধব কিংবা পরিচিতজনের মধ্যে দেখা হলে যেরকম কুশল বিনিময় হয় ঠিক সেরকমই। তবে সে বোধহয় বাড়াবাড়ি কিছু ভাবছে? হতে পারে। সামির ইয়াসির নিজেকেই ঠুনকোলো।
সেদিন সন্ধ্যায় বাড়িতে আরেকজন মেহমান আসবে। উনি নেওয়াজ আহসানের পরিচিত। কিশোরগঞ্জেই আছেন, তাই দেখা করতে আসবেন। অতিথি আপ্যায়নে বিকেল থেকেই ঘরে ব্যস্ততা। নাবিলা একবার রান্নাঘরে, একবার বারান্দায় আবার ঘুরে এসে ডাইনিং টেবিল ঠিক করছিল। শ্রেষ্ঠাও ওর সাথেই ছিল। সামির আসার পর তো আহিরের পাত্তা নেই, তার সাথে সাথেই থাকছে।
সন্ধ্যায় বসার ঘরেই সকলে উপস্থিত ছিল। তখনি একজন অচেনা উপস্থিত হলেন। নেওয়াজ আহসান সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে গেলেন।
— “আরে, আবিদ ভাই! কতদিন পরে দেখা। কী অবস্থা আপনার?”

নেওয়াজ আহসান নতুন মেহমানের সাথে একে একে বাড়ির সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সামিরের কাছে এসে থমকে গেলেন। ও তো এখন শুধু সামির ইয়াসির নয়, অন্য একটা পরিচয় হতে চলেছে খুব শীঘ্রই। তাই নেওয়াজ আহসান পরিচয় করিয়ে দিলেন,
— “ও হচ্ছে সামির, আমাদের হবু জামাতা। খুব ভালো ছেলে। খুব নম্র আর মার্জিত।”
.
.
চলবে….

#প্রিয়াঙ্গন❤️ [পর্ব-০৪]
~আফিয়া আফরিন

নেওয়াজ আহসানের কথাটা বোমা ফাটার মতোই ছিল পুরো ঘরের মধ্যে। রেশমা মুখ টিপে হেসে নাবিলার পাশে দাঁড়ালেন। নানু হেসে বললেন,
— “নাত জামাই তো চুপচাপ টাইপের দেখি। কিন্তু চোখেমুখে বুদ্ধি আছে। কী বলো?”
শ্রেষ্ঠা, আহিরের চোখ কপালে। ওরা একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। এই কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। সাখাওয়াত হোসেন ছেলের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে নিজের সিদ্ধান্তকে আরও একবার মুঠো করে ধরলেন। সামির এমন বজ্রাঘাতে আহত হলো। কণ্ঠ শুকিয়ে গেল। কিছুক্ষণের জন্য নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারল না। তারপর একটা ঘোলাটে শব্দ বের হলো তার গলা থেকে,
— “হোয়াট?” শব্দটা এতটাই ক্ষীণ ছিল যে ও ছাড়া আর কেউ শুনতে পেল না।
এই মুহূর্তে নাবিলা কোনো কথা বলল না। কথাটা বুঝতে তার যথেষ্ট সময় লেগেছে। জামাতা মানে কি? তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারে নাই, নানুর নাত জামাই শুনে যা বোঝার বুঝে গেছে। সে এই ঘর থেকে পিছু হটল, মাথা নিচু। চোখে জল এসে গেছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না, তবে মুখের অভিব্যক্তি পরিষ্কার। এই মুহূর্তে সে আর এখানে থাকতে পারবে না। ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের রুমে ঢুকে দরজাটা লাগিয়ে দিল।
শ্রেষ্ঠা পেছন পেছন যাবে কিন্তু আহির হাত ধরে বলল,
— “আপাতত ওকে একা থাকতে দে। ওর নিজের সিদ্ধান্ত ওকে নিতে দে।”
সবাই উপস্থিত মেহমানকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সামির কিছু বলার সুযোগ পেল না। বাসায় যেহেতু একজন অতিথি আছেন, তার সামনে তো বেয়াদবি করা যায় না। কিন্তু একি সিদ্ধান্ত নিল মা-বাবা? কতদূর গড়িয়েছে তারা? কিছুই তো জানে না। আর জানতেও চায় না, বিস্তারিত জানার আগ্রহ একদম নেই। তাকে ঢাকা ফিরে যেতে হবে। মা-বাবা ভালো কথায় যেতে দিলে দিবে, নাহয় সে রাতের অন্ধকারে কাউকে কিছু না জানিয়েই চলে যাবে।

নাবিলা নিজের ঘরে এসেই দরজাটা একটু শব্দ করেই বন্ধ করে দিল। আচমকা চুপচাপ ঘরটার নীরবতা তাকে চেপে ধরল। সে ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল। দু’হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরল। মনে হচ্ছিল, মাথার ভেতর কেউ ঢোল পেটাচ্ছে। এটা কি বলল বাবা? কীভাবে বলল? কেনো বলল? নিজেকেই জিজ্ঞেস করছিল কিন্তু উত্তর দেওয়ার মত কেউ নেই। মনে পড়ছিল সামিরের মুখটা। ওর বিস্ময়, ওর রাগ, ওর অপমান… সব চোখের সামনে ভেসে উঠছিল বারবার। পরিস্থিতির প্রতি একরাশ অভিমানে বুকের ভেতর একটা গুমোট কান্না জমে উঠছে। নাবিলা বিছানার পাশের বালিশটা টেনে নিলো কোলে। মনে মনে বলল,
— “এই কথা আমাকে একবার বলাও প্রয়োজন মনে করল না? আমি কি এতটাই অপ্রাসঙ্গিক?”

সামিরও ঘরে এসে দরজাটা একটু জোর দিয়েই বন্ধ করল। মনে হলো, কোনোকিছু থেকে পালিয়ে বাঁচার একটা চেষ্টা। তারপর ছেলেমানুষের মতো চেয়ারটা টেনে বসে পড়ল। বুকের ভেতরে একরাশ ধোঁয়া জমে আছে, মাথার ভেতর শব্দ নেই, শুধু কনফিউশনের এক মেঘলা বৃষ্টি।
— “আমাদের হবু জামাতা?”
আংকেলের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার মুহূর্তটা বারবার ঘুরেফিরে আসছিল মনে। আশপাশের ফিসফাস, তাদের হাসিমুখ, নাবিলার দৌড়ে চলে যাওয়া সবকিছু একসাথে এসে পাথরের মতো বসে গেছে বুকের ওপর। নাবিলার সাথে একবার কথা বলতে হবে… সামির তাই করল। দরজার সামনে এসে থেমে গেল সে। কিছুক্ষণ ইতস্তত করল, তারপর নক করল। দরজা খুলে গেল। নাবিলা সামনে দাঁড়িয়ে। চোখেমুখে স্পষ্ট অস্বস্তি। জিজ্ঞেস করল,
— “আপনি?”
— “কিছু কথা ছিল।” সামির স্পষ্ট ভঙ্গিতেই বলল।

— “আসুন।” নাবিলা দরজা থেকে সরে দাঁড়াল। সামির ঘরে ঢুকে একটু দাঁড়িয়ে রইল। চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে ধীরে বলল, — “একটু আগে আংকেল যেটা বললেন, তুমি শুনেছ নিশ্চয়ই?”

— “জি। আমি কালা নই।” নাবিলার ঠোঁটের কোণে তীব্র বিদ্রুপ।

সামির ওর দিকে সরাসরি চোখ তুলে তাকাল,
— “না, আমি তোমাকে কালা মিন করতে চাইনি। বলতে চাইছিলাম, এই ব্যাপারে… তোমার মতামত কী?”

নাবিলা হাসল,
— “আপনার কি মনে হয়, আমি আনন্দে নাচতে নাচতে আপনাকে বিয়ে করতে রাজি হব? আপনার মতো কাউকে? কখনোই না। আমার বিয়ের প্রসঙ্গ উঠলে আপনি প্রথমেই বাদ।”
সামির কিছুক্ষণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকল। তার পেছনে যে মেয়েদের মায়েরা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে মুখিয়ে থাকে, সে তালিকা লম্বা। তাই নিঃসন্দেহে নাবিলার কথাগুলো ছুরি হয়ে সামির ইয়াসিরের আত্মমর্যাদায় বিঁধে গেল। এই একরত্তি মেয়ে তাকে একঝটকায় রিজেক্ট করে দিচ্ছে? ওহ নো। সামির মাথা ঠান্ডা রেখে বলল,
— “তোমার মতামত বুঝলাম। সত্যি বলতে, আমি নিজেও এমন কিছু চাচ্ছিনা। তবে তোমার কথা শুনে মনে হলো ভীষণ মুখফাট্টা। নিজের ছাড়া কারো মতামতের দাম দিতে জানো না।”

নাবিলা চোখ গরম করে তাকাল,
— “আপনি যে একটা অসহ্যকর মানুষ, তা জানেন?”
— “জেনে নিলাম।”
— “আপনাকে তো আমি কখনোই বিয়ে করব না, প্রশ্নই আসে না।”
— “ধন্যবাদ।” সামির ছোট্ট করে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করল।
সামির ঠিক এমনটাই শুনতে চেয়েছিল নাবিলার কাছ থেকে। স্পষ্ট, সোজাসাপটা উত্তর। নাবিলার কথা শুনে তার রাগান্বিত হওয়া, অপমানবোধ করা উচিত ছিল কিন্তু তার বদলে সামির নিশ্চিতবোধ করল।
তবে সে জানে, মা-বাবা সহজে এই ব্যাপার থেকে সরে আসবেন না। বিশেষ করে মা। উনি একবার মনস্থির করলে পেছাতে জানেন না।
আর বাবা? তিনি হয়তো একটু চিন্তাভাবনা করবেন, কিন্তু শেষমেশ মায়ের সুরেই হাঁটবেন। তাই আগে থেকেই নিজেকে তৈরি করে রাখতে হবে। মা-বাবা যদি এসে এই বিষয়ে কথা তোলে ওদের অনুভূতিতে কষ্ট না দিয়ে, নিজের অবস্থানও স্পষ্ট রেখে জবাব দিতে হবে।
সামিরের ভেতরে নানা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল। হঠাৎ করেই দরজায় হালকা টোকা দিয়ে রেশমা ঢুকলেন। তিনি সোজা ছেলের পাশে এসে বসলেন। ভণিতা ছাড়াই বললেন,
— “ঘটনা তো শুনেছ। আমরা খুব শীঘ্রই তোমাদের বিয়ে দিতে চাচ্ছি।”

— “বিয়ে?” সামির এমনভাবে শব্দটা উচ্চারণ করল যেন এর থেকে জঘন্য শব্দ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টা নেই।

রেশমা খুব শান্ত কণ্ঠে বললেন,
— “হ্যাঁ।”

সামির গলা কিছুটা শক্ত করে বলল,
— “কিন্তু মা, আমি এখন পড়াশোনা করছি। এটা তো আমার বিয়ের বয়স না। সামনে আমার ক্যারিয়ার…”

রেশমা ছেলের কথা মাঝপথেই থামিয়ে দিলেন,
— “আমি কি তোমার জন্য কোন ছোটো বাচ্চা মেয়ে বউ করে আনছি যে পড়াশোনায় বাঁধা দেবে? বই-খাতা ছিঁড়ে ফেলবে? নাবিলা যথেষ্ট ম্যাচিওর। সেও তো তোমার মতই পড়াশোনায় আছে। দু’জন একসাথেই এগিয়ে যাবে। শুধু বিয়েটা দিয়ে রাখছি, এতে সমস্যা কী?”

— “মানে কী মা? তুমি বোঝার চেষ্টা করো…” সামিরের কণ্ঠে অসহায়তা।

রেশমা সোজাসাপটা বললেন,
— “তুই বরং বোঝার চেষ্টা কর। তোকে এখন কেউ সংসার করতে বলছে না। কেউ বলছে না দায়-দায়িত্ব নে। বিয়েটা পরিয়ে রাখছি। পড়াশোনা শেষ কর, চাকরি-বাকরি, তারপর আমরা নাবিলাকে তুলে আনব।”
সামির কিছু বলার জন্য মুখ খুলল, কিন্তু আবার চুপ করে গেল। তার ভেতরের দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হচ্ছে। নিজেকে প্রকাশ করার মত সময়টা কম মনে হচ্ছে। বাবার সাথে একবার কথা বলতে হবে। মাকে বোঝানো তার কাম্য নয়। বাবা যদি ভালো কথায় মেনে নেয় তো নিবে, নাহলে সে নিজেই গা-ঢাকা দিবে।
.
নাবিলার মনটা অস্থির। ঠিক তখনই নীতু এসে পাশে বসলেন। একটু পর নেওয়াজ আহসানও যোগ দিলেন। মা সরাসরি বলল,
— “নাবিলা, আজ একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা। সামিরের সাথে তোমার বিয়ের প্রস্তাবটা পরিবারের সবাই মেনে নিয়েছে।”

নাবিলা চমকে তাকাল।
— “কী বললে মা? আমি তো কিছুই জানিনা।”

বাবা বেশ শান্ত গলায় বললেন,
— “এটা হঠাৎ করে বলা ঠিক না, জানি। কিন্তু আমরা ভেবেচিন্তেই বলছি। সামিরকে তো তুমি চেনো, জানো, সে ভালো ছেলে। পড়াশোনা করছে, ভবিষ্যত আছে। পরিবারও চেনা-পরিচিত। আমাদের মনে হয়েছে, এই সম্পর্ক হলে তোমার ভবিষ্যত নিরাপদ থাকবে।”

নাবিলা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। চোখ নামিয়ে বলল,
— “আমি ওকে চিনি, ঠিক আছে। কিন্তু এজন্য বিয়ে করতে হবে? আমি এখনো পড়াশোনা করছি। আমার স্বপ্ন আছে। আমি প্রস্তুত না।”

নীতু মুখে মৃদু হাসি এনে বলল,
— “আমরা কি তোমার স্বপ্ন ভাঙতে চাই? তুমি তোমার মত করে পড়াশোনা করবে, ক্যারিয়ার গড়বে। আমরা শুধু চাচ্ছি, বিয়েটা হোক। পরে যা হবার হবে।”

নাবিলা একটু জোর গলায় বলে উঠল,
— “মানে? এটা কি কোনো ছেলেখেলা? তোমরা সবাই সব নিজেদের মত ঠিক করে ফেললে, আমাকে কিছু বললে না। একবারও জিজ্ঞেস করলে না, আমি কি চাই।”

নেওয়াজ আহসান এবার একটু গম্ভীর গলায় বললেন,
— “তোমার ভালোর জন্যই বলছি, নাবিলা। আমরা তোমার বাবা-মা, শত্রু না। তোমায় জোর করা হচ্ছে না এখানে।”

নীতুও নরম হয়ে বললেন,
— “ভেবে দেখো মা। সামির খারাপ ছেলে না। জীবনসঙ্গী হওয়ার জন্য পারফেক্ট।”
মায়ের কথা শুনে নাবিলা মুখটা বিষিয়ে ফেলল। বলতে ইচ্ছে করল, “তো এতোই পারফেক্ট মনে হলে তুমিই বিয়ে করে নাও না, আমার মাথা খাচ্ছো কেনো?” কিন্তু এটা মাকে কিছুতেই বলা যাবে। মুখ থেকে কথা বেরোতে দেরি কিন্তু গালে দুখানা চটকানা পড়তে একমুহুর্তও দেরি হবে না। নাবিলা আপাতত বিষয়টা এড়ানোর জন্য বলল,
— “আচ্ছা সময় দাও, আমি ভেবে দেখি।”

নাবিলা ভেবে দেখার কথা বললেও সামির সরাসরি মানা করে দিল। বাবার সামনে সামির জোর দিয়ে না বলার সাহস পেল না। তবে যতটুকু বলল, তার সারমর্ম হচ্ছে; বিয়ে-শাদী নিয়ে আমি এখন কিছু ভাবছিই না। যদি আরও পরে কখনো ভাবতে ইচ্ছে হয়, তখন তোমাদের জানাব। সাখাওয়াত হোসেন বললেন,
— “দেখো সামির, বিয়ের মতো ব্যাপারে বাবা-মা প্রস্তাব রাখতে পারে, কিন্তু শেষ কথা তোমার। যদি মন থেকে রাজি না হও, তাহলে…” উনি পুরো কথাটা শেষ করলেন না। ইচ্ছে আছে ছেলেকে রাজি করানোর। তাই পুনরায় বললেন,
— “তবে একটা কথা মনে রেখো, আমরা যা বলেছি সেটা হুট করে নয়। নাবিলা ভালো মেয়ে, ওর পরিবারের সাথে আমাদের একটা জানাশোনা আছে। তুমি যদি শুধু সময় চাও, সেটা বলো কিন্তু ‘না’ বলার আগে ভালো করে ভেবে দেখো।”
— “বাবা, আমি জানি তোমরা আমার ভালোর জন্যই ভেবেছ। আমার মাথায় শুধু পড়াশোনা আর ক্যারিয়ার নিয়ে পরিকল্পনা আছে। আর বিয়ে কোনো পার্কিং করে রাখার বিষয় তো না। তাড়াহুড়ো থেকে কিছু করতে চাচ্ছি না।”
সামির নিজের দিকটা পরিষ্কার করে দিল। বাবা-মা আর কেউ কিছু বলল না।
সব হয়েছে ওই মেয়েটার জন্যই। ওর জন্যই হঠাৎ করে মা-বাবার মাথায় বিয়ের ভূত চড়ল। ওর সাথে দেখা না হলে এমন কিছুই হতো না। সামির ধুর ছাই, ধুর ছাই করছিল। কিন্তু ভাগ্যও বোধহয় নাবিলার পক্ষেই ছিল। সেইমুহূর্তে দরজার কাছে পায়ের শব্দ। নাবিলা…
দুজনের চোখে চোখ পড়তেই সামির মনে মনে বলল, — “বাহ, ভিলেন নিজেই এসে হাজির।”
নাবিলা ভাবতেও পারে নাই, তার পরিবার এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারে। দুদিনের পরিচয়ে চিরশত্রুতে পরিণত হওয়া সেই ছেলেটার সাথে বিয়ে? মাই গড! মাথার ভেতর সেকেন্ডে সেকেন্ডে বাজ পড়ছে। শত্রুর সাথে হাত মিলিয়ে শান্তি চুক্তি করা যায়, কিন্তু শত্রুর সাথে বিয়ে? এটা তো ইতিহাসেও নেই।
চোখ বন্ধ করলেই চোখের সামনে ভেসে উঠছে সামিরের কটাক্ষ দৃষ্টি, তেল কাণ্ডের ধপাস ধপাস স্মৃতি। এই ছেলেটা? সারাজীবন? না, তারচেয়ে সন্ন্যাস জীবন ভালো। সবকিছু বাদ দিয়ে যদি বিয়ে করেও নেয় তাহলে হানিমুনে গিয়ে নাবিলা পিছলে সমুদ্রে পড়ে যায়, তখন কে বাঁচাবে? সামির ইয়াসির তো প্রথমে হেসে মরবে। এই ছেলেটার সাথে বিয়ে হলে প্রথমদিনেই খবরের শিরোনাম হতে হবে, ‘নতুন দম্পতির জীবন কাটছে হাসপাতাল ও ব্যান্ডেজে।’ না না, ওকে কিছুতেই বিয়ে করা যাবে না। ওকে বিয়ে করলে রোমান্টিকতার বদলে প্রত্যেকটাদিন হবে কমেডি সিরিজ। নাবিলা ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। দরজায় টোকা দিয়ে বলল,
— “ভেতরে আসবো?”
— “এসেই তো পড়েছ।” সামির ভুরু কুঁচকাল।
— “ফর্মালিটিজ।”
— “ওটা তোমাকে মানায় না।” সামির খোঁচা মারতে ভুলল না।

নাবিলা বলল,
— “তর্ক বাদ দিন। আপনার সাথে কিছু কথা বলতে এসেছি।”
— “কথা বলবে কী? তোমার জন্যই সব হয়েছে।”
— “আমার জন্য? আমি কি আপনার মা-বাবার কানে ফিসফিস করে বলেছি, বিয়ের কথা?”
— “না কিন্তু তুমি যদি আমার জীবনে না আসতে, মানে তোমার সাথে আমার দেখা না হওয়াটাই বেটার ছিল।”
— “হুম, দেখা না হলে দু-দুবার ধাক্কা খেয়ে আমার কোমর ভাঙ্গত না।” নাবিলাও নাক সিঁটকালো।

— “মজা করছ? আমি সিরিয়াস।”
— “আমিও সিরিয়াস। আমি তো নিজেও এই বিয়ের ধাক্কায় কাবাব হয়ে যাচ্ছি।”

সামির ভুরু কুঁচকায়,
— “কাবাব?”
— “হ্যাঁ, দুইদিক থেকে চাপ দিতে দিতে চ্যাপ্টা করে ফেলেছে।”

সামির হাসি চেপে বলল,
—“কিন্তু একটা জিনিস ঠিক, আমরা দু’জনই চাই না এই বিয়েটা হোক।”
— “হুমম। আমি আরও আগেই চাই না। আপনার মত অসুরকে কে বিয়ে করবে?”
সামির আবারও নাবিলার অসহ্যকর কথাবার্তা হজম করে নিল চুপচাপ। বলল,
— “ভাবছি, এই বিয়েটা ঠেকানোর জন্য একটু সাবধানে প্ল্যান করতে হবে। সরাসরি বিরোধিতা করলে তো কেউ মানছে না।”

এই প্রথম কোনো বিষয়ে নাবিলাও ওর সাথে সায় দিল,
— “একদম ঠিক। আমাদের নিজেদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করতে হবে, যাতে সবাই মনে করে আমরা একে অপরের জন্য ঠিকমতো মানানসই নই।”
— “হুমম… অতিরঞ্জিত না করে ছোটখাটো জিনিস নিয়ে আলাদা মতামত দেখাতে পারি। তাহলে সবাই বুঝতে পারবে আমরা একসাথে থাকার জন্য তৈরি নই। আরেকটা ব্যাপার, দুজনকেই এই চেষ্টাটা করতে হবে।”

নাবিলা বলল,
— “এটাও বুঝিয়ে দেওয়া জরুরি যে আমরা একে অপরের জীবনধারা ও লক্ষ্য সম্পর্কে মিল পাই না। আমরা দু’জন দু’মেরুর মানুষ। মতের মিল নাই, জীবনের মিল নাই; মানে কোনোকিছুর’ই মিল নাই।”
— “এটা তো সাচ্চা সত্য।”

নাবিলা মুখে শক্ত করে জবাব দিল,
— “কিন্তু এখন এটা প্ল্যানের অংশ।”
সামির আর নাবিলা যখন নিজেদের বিয়ে ঠেকানোর পরিকল্পনা সাজাচ্ছিল, ঠিক তখন আহির আর শ্রেষ্ঠা এসে ব্যগ্রা দিল। ওদের ভাষ্যমতে, বাড়ির লোকেরা একবার সিদ্ধান্ত দিলে তা বদলানো কঠিন। তারা বলবে, “তোমাদের বিয়ে দিয়ে দিই। বিয়ের পর যত খুশি ঝগড়া করো, সেটা তোমাদের ব্যাপার। কিন্তু বিয়ের আগে এত চুলোচুলি কেনো?” ওদের কথা সত্য।
সামির আর নাবিলা একে অন্যের দিকে তাকাল, কিছু বলল না। সামির ভাবল, কপালের দোষ দিবে নাকি নিজের? নাকি নাবিলার? ওর দোষ দিয়ে আর কী হবে? ও নিজেও ঝামেলার মধ্যে আটকে গেছে। এত ঝামেলা মাথায় উঠেছে যে কিছু বুঝে ওঠা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছে না। সামির মনে মনে কটাক্ষ করল,
— “আরে ভাই ঝামেলা, আসবি তো আসবি একটু আগেই জানিয়ে আসলেই পারতি। আমরা একটু প্রস্তুতি নিয়ে নিতে পারতাম। এভাবে হঠাৎ করেই সব ঝাঁপিয়ে পড়লে কেমন করে হয়? বেয়াক্কেল কোথাকার।” সে একদম হতবাক, সবদিক থেকে বিপদ এসে ঘেরাও করেছে।
সবাই যখন চিন্তার গভীরে ডুবে অস্থির হয়ে উঠছিল, তখন হঠাৎ নাবিলার মাথায় একটা চমৎকার বুদ্ধি ঝলমল করে উঠল। সে সামিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
— “চলেন পালাই?”

সামির অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
— “মানে?”

নাবিলা বেশ হাসি হাসি মুখ করে বলল,
— “মানে আবার কী? দেখুন, আমরা যদি দুদিনের জন্য কোথাও বের হয়ে দুদিন পর ফিরে আসি; তখন আমাদের অনুপস্থিতিতে বাড়ির সবাই এতটাই ব্যস্ত হয়ে যাবে যে, বিয়ের কথা ভুলেই যাবে।”

সামির একটু ভেবে বলল,
— “কিন্তু আমরা মানে? তুমি আমার সঙ্গে যাবে? আমি তোমাকে নিয়ে কোথায় যাব?”

নাবিলা একটু ভাব নিয়েই বলল,
— “আমাকে নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না। নাবিলা ইবনাত নিজের দায়িত্ব নিজেই নিতে পারে। আমি শুধু আপনার সঙ্গে বের হবো। শ্রেষ্ঠার একটা বন্ধুর বাসা আছে, যে আমারও পরিচিত। আপনি শুধু সদরে গিয়ে আমাকে ওদের বাসায় বাসায় পৌঁছে দেবেন। বাকিটা আমি সামলাব।”

সামিরের মনে আলোর ঝলক ভেসে উঠল। এমন বুদ্ধি তার মাথায় আগে আসেনি। নাবিলার এই পরিকল্পনা তার বেশ লাগল। এই প্রথম এই মাথামোটা মেয়ের মাথা থেকে একটা ভালো বুদ্ধি বেরিয়েছে। সামির বলল,
— “ঠিক আছে, তবে আজ রাতেই…”
.
.
.
চলবে….

#প্রিয়াঙ্গন❤️ [পর্ব-০৫]
~আফিয়া আফরিন

সেদিন রাতটা বোধহয় ওদের জন্যই এত বেশি নিস্তব্ধ ছিল। চারদিক অন্ধকারে ঢেকে আছে, শুধু দূরে কোথাও কুকুরের হালকা ডাক আর মাঝে মাঝে পাতার মর্মর শব্দ। বাড়ির সবাই তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
সামির একেবারে রেডি হয়ে এলো। পিঠে ছোট্ট ব্যাগ, চোখে সতর্কতা। আজকের মিশন স্পষ্ট। অর্ধেক রাস্তা পর্যন্ত নাবিলাকে নিয়ে যেতে হবে, তারপর মুক্তি। সামির মনে মনে ভাবল, ব্যস অর্ধেক রাস্তা… তারপর হাঁফ ছেড়ে বাঁচব।
নাবিলাও ইতোমধ্যেই প্রস্তুত ছিল। ওড়নাটা ভালোভাবে গায়ে জড়িয়ে নিল, হাতে ছোট্ট ব্যাকপ্যাক। সে একদম ফিসফিস করে বলল,
— “চলুন, বেশি সময় নষ্ট করা যাবে না।”

সরাসরি মেইন গেট দিয়ে বের হওয়া মানে আত্মহত্যার সমান, সবার ঘর পেরিয়ে যেতে হবে। যেটা এইমুহূর্তে বিপদজ্জনক। কেউ ভুলবশত জেগে গেলেই দফারফা… এ নিয়ে ওদের মধ্যে একদমই দ্বিমত ছিল না। কোনোভাবেই রিস্ক নেওয়া যাবে না। তাই পরিকল্পনা বদলে গেল। গন্তব্য হলো দুইতলার জানালা। সেখান থেকে ঝুলে থাকা লোহার পাইপ যেটা সাধারণত বৃষ্টির পানি নামানোর জন্য ব্যবহার হয়, আজ সেটা হবে তাদের পালানোর সিঁড়ি।
আহির আর শ্রেষ্ঠা পুরো অপারেশনের সহযোগী। আহির সর্বপ্রথম দাঁড়িয়ে যেন কোনো অ্যাকশন মুভির দৃশ্য, যেকোনো পরিস্থিতি সামাল দিতে সে প্রস্তুত। শ্রেষ্ঠা নাবিলার ব্যাগ ধরে রেখেছে, যাতে বাড়তি ওজন নিয়ে বিপদ না হয়। প্রথমে সামির নামল। চটপট, কোনো ঝামেলা ছাড়াই, একদম ট্রেনিংপ্রাপ্ত চোরের মতো। পা মাটিতে পড়তেই সে ইশারা দিল।
— “সব ঠিক আছে, নামো।”
নাবিলার বেলা এলেই ঝামেলা শুরু হলো। সে পাইপ আঁকড়ে ধরল ঠিকই কিন্তু নিচে নামতে গিয়ে কনুই দেওয়ালে ধাক্কা খেল। চাপা চিৎকার দিয়ে ফেলল। পরক্ষণেই চুপ করে গেল, মুখ বিকৃত হয়ে গেল যন্ত্রণায়। হাতের ওই অংশটুকু সামান্য কেটে গেছে, লালচে হয়ে উঠেছে চামড়া। মাটিতে নামতেই নাবিলা সামিরের দিকে বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকাল, — “আপনার জন্যই এত কাণ্ড। মেইন গেট দিয়ে বের হলে এত খাটুনি পোহাতে হতো না।”

সামির গম্ভীর মুখে বলল,
— “হুঁ, তারপর কেউ যদি দেখে ফেলত তবে সব শেষ।”

নাবিলা হাত কোমরে রেখে জবাব দিল,
— “সবাই আপনার মতো বোকা না। ঘুম বাদ দিয়ে কেউ আমাদের পাহারা দেবে নাকি? বুদ্ধ কোথাকার!”

সামির বিরক্ত হয়ে বলল,
— “বেশি বোঝা লাগবে না, সামনে এগোও। যতসব ঝামেলা কাঁধে নিয়েছি…”
মুখ ভার করে সামির এগিয়ে গেল, নাবিলা ঠোঁট বাঁকিয়ে পিছনে এলো। আহির আর শ্রেষ্ঠা নিচু গলায় “গুড লাক” বলে হাত নাড়ল। চারজনের চোখাচোখি হলো একমুহূর্তের জন্য। অতঃপর তারা বিদায় নিল। সামির আর নাবিলা ধীরে ধীরে অন্ধকার রাস্তায় পা বাড়াল, পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেল রাতের নীরবতায় আর তাদের পেছনে রয়ে গেল দুইজন গোপন সহযোগীর চাপা হাসি।
অন্ধকার গলিপথ ধরে হাঁটছিল তারা দু’জন। নাবিলার হাতে আঁকাবাঁকা এক টুকরো কাগজ, শ্রেষ্ঠার দেওয়া ঠিকানা লেখা। হঠাৎই মাথায় বিদ্যুৎ চমকালো। ওই বাসার মানুষকে তো আগে কিছুই জানানো হয়নি। এ রাতদুপুরে যদি তারা দরজা না খোলে? আর দরজা খুললেও অজস্র প্রশ্ন থাকবে তাদের। তখন কি জবাব দিবে? সকাল হলে নাহয় ঘুরতে এসেছে বলা যেত, কিন্তু রাতের বেলা কি বাহানা খাটবে? ভাবনাটা আসতেই নাবিলা আচমকা থেমে গেল। সামির তখনো তালে তালে এগিয়ে চলেছে, পা ফেলছে এমন ভঙ্গিতে যেন এই মুহূর্তেই সীমান্ত পেরোতে হবে। কিন্তু পেছন থেকে কোনো শব্দ না আসায় সে খেয়াল করল, মেয়েটা একেবারে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সামির বিরক্তি মিশ্রিত কৌতূহল নিয়ে ফিরে এল।
— “দাঁড়িয়ে পড়লে কেন?”

চাঁদের ম্লান আলোয় দেখা গেল, নাবিলার মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে সবটা বলল। সামির শুনে ভ্রু কুঁচকালো।
— “আশ্চর্য রকমের পাগল তো তুমি। আগে জানাও নাই কেন?”

নাবিলা মাথা নিচু করে বলল,
— “আসলেই খেয়াল ছিল না।”
— “কি খেয়াল থাকে তোমার, আল্লাহই ভালো জানে। এখন কি করবে?”

নাবিলা কোনো রকম দায়িত্ব নিতেই রাজি নয়। দায়সারা ভঙ্গিতে উত্তর দিল,
— “আমি কি জানি? আপনি আমায় নিয়ে আসছেন। সমস্ত দায় আপনার। আমি কিছু জানি না।”

সামির গভীর শ্বাস নিয়ে রাগটা গিলে ফেলল। ঠান্ডা মাথায় বলল,
— “তাহলে চলো, বাড়ি পৌঁছে দিই।”

নাবিলা তীব্র আপত্তি তুলল। চোখ বড় বড় করে,
— “অ্যাই না! পরিকল্পনা তো এমন ছিল না।”

সামির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল,
— “পরিকল্পনা যেমন ছিল, তা হচ্ছে কোথায়? তুমি তো সমস্ত কিছু গুবলেট পাকিয়ে বসে আছো।” কণ্ঠে ব্যঙ্গ।
নাবিলা ভেবে পেল না, ও কী করবে? বাড়ি ফিরে যাবে? কিন্তু কীভাবে? পাইপ বেয়ে নামতে গিয়ে যে অবস্থা হয়েছে, উঠতে গেলে তো আর কথাই নেই। অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো, ওরা ওই ঠিকানায় গিয়ে ওখানে কোথাও সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। সকাল হলে দু’জনের রাস্তা দু’দিকে।
ওই মেয়েটার নাম অথৈ। অথৈয়ের বাসার সামনে এসে নাবিলা থমকে দাঁড়াল। চোখ গিয়ে আটকাল দরজার দিকে, মস্ত বড় তালা ঝুলছে। ঠান্ডা রাতে সামির ইয়াসিরের মত সেই ধাতব সেই তালাও ওর দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গ করে হাসছে। মুহূর্তেই নাবিলার মুখের রঙ পাল্টে গেল। মনে হলো, মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়ছে। ঠোঁট শুকিয়ে আসছে, বুকের ভেতর ধকধক শব্দ। এখন কোথায় যাবে? কাকে বলবে? অথৈকে আগে না জানানোটা যে কত বড় ভুল ছিল, সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেল।
সামির কিছুই বলল না। কেবল হাত গুটিয়ে দাঁড়িয়ে রইল, ঠান্ডা দৃষ্টিতে ওর সমস্ত কর্মকাণ্ড দেখছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার শরীরের প্রতিটি স্নায়ুতে আগুন জ্বলছে। সেই রাগ নিয়ে যদি এখন মুখ খোলে, তবে মুখ থেকে বের হওয়া কথাগুলো হয়তো রাতের অন্ধকারকেও চিরে ফেলবে।

নাবিলা দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। শেষ পর্যন্ত নিঃশব্দে পা টেনে এগিয়ে এসে বসে পড়ল রাস্তার ধারের এক পুরনো পাটাতনের মতো কাঠের বেঞ্চে। আবেগের বশে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসাটা তখন খুব সাহসী সিদ্ধান্ত মনে হয়েছিল কিন্তু এখন চারপাশের অন্ধকার, নিঃসঙ্গতা আর এই অচেনা পরিস্থিতি তাকে একের পর এক বিপদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। সামিরকে এখন ফেস করার সাহস নেই। ও জানে, সামিরের চোখে নিশ্চয়ই সেই কটাক্ষ ঝিলিক দিচ্ছে। শালা তো সবসময় খোঁচা দেওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকে। পান থেকে চুন খসলেই শুরু করে দেয় বিশ্ববিখ্যাত ডায়লগ, আমি তো বলেছিলাম… উফফ বিরক্তিকর! নির্বিঘ্নে একটু নিঃশ্বাস ফেলার জন্য তাই নাবিলা ইচ্ছে করেই ওর থেকে কয়েক হাত দূরে বসেছে।

নিশুতি রাত। থেকে থেকে দু’একটা গাড়ি যাচ্ছে আসছে। মানুষজনের আনাগোনা নেই বললেই চলে। যেহেতু গ্রামীণ এলাকা, তাই সবাই আরামে ঘুম দিচ্ছে। সামির দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখল, একটা রিকশা এসে নাবিলার সামনে থামল। রিকশাওয়ালা কিছু একটা বলছে ওকে। কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে সামির এগিয়ে গেল। কাছে যেতেই শুনল রিকশাওয়ালার প্রশ্ন,
— “এই রাইতে এনে মাইয়া মানুষ বইসা আছেন ক্যান? যাইবেন কই?”

নাবিলা তিরিক্ষি মেজাজে লাফিয়ে উঠল,
— “শ্বশুড়বাড়ি যাব। যাবেন?”

রিকশাওয়ালা সহজভাবেই জবাব দিল,
— “হ ঠিকানা কন, নিয়া যাইতাছি।”

সামির তখন সামনে গিয়ে শান্ত গলায় বলল,
— “মামা, আপনি নিজের গন্তব্যে যান। ও কোথাও যাবে না। আপনি যান প্লিজ, বিরক্ত করবেন না।”
রিকশাওয়ালা দু’জনের দিকে কেমন এক দৃষ্টিতে তাকাল। তারপর একটু নাক সিটকিয়ে বলল,
— “এই বয়সী পোলাপানরে আমি চিনি। মাথায় যত কুবুদ্ধি, ধান্ধা খারাপ দিকে যায়। মাঝরাতে মাইয়া মানুষ লইয়া বের হইছেন, কাহিনিটা ভালা না মামা… যাহোক, আপনারা জানেন যা করছেন। কিন্তু রাইতে রাস্তায় থাকন ভালা না। বিপদ আপদ অনেক।” এ কথা শুনে নাবিলা চোখ উল্টে সামিরের দিকে তাকাল, আর সামির ঠোঁট কামড়ে রাগ গিলে ফেলল। তারপরের সময়টুকু কেউ কোনো কথা বলল না। সামির নিঃশব্দে নাবিলার পাশেই বসে রইল।
.
আহির আর শ্রেষ্ঠা ছিল সবচেয়ে বিপদে। আগেই ঠিক করে রেখেছে, সকাল হলে কেউ যদি সামির বা নাবিলার কথা জানতে চায়, কিছুই বলবে না। উল্টো কিছুই জানে না, সেই অভিনয়ে ব্যস্ত থাকবে।
সকালবেলা… সকাল হলো একেবারে প্রতিদিনের মতো। কেউ বুঝতেই পারল না যে আগের রাতে কী ঘটে গেছে। প্রথমেই খবর এলো, সামির নেই। ঘরে, বারান্দায়, উঠোনে, কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। ফোনটাও বন্ধ। প্রথমে সবাই ভাবল হয়তো কোথাও গেছে কিন্তু ঘন্টাখানেকের মধ্যে যখন খোঁজ করেও কোনো সাড়া পাওয়া গেল না, তখন হালকা উৎকণ্ঠা শুরু হলো।
তারপর জানা গেল, নাবিলাও নেই। ঘর খালি, বিছানা গুছানো। এবার বাড়ির সবার মাথায় হাত। চিন্তার ভাঁজ একসাথে গভীর হয়ে উঠল। সামিরের উধাও হওয়ার রহস্য সকলে বুঝতে পেরেছে। কিন্তু নাবিলা? ও কোথায় গেল? কীভাবে গেল? বাড়ির ভেতর হঠাৎ এক অস্থিরতার ঢেউ বয়ে গেল। বাড়ির অস্থিরতা ধীরে ধীরে উত্তেজনার রূপ নিল। সকলে মিলে এবার শ্রেষ্ঠাকে ঘিরে ধরল কারণ নাবিলার সাথে ওর সবচেয়ে বেশি ভাব। সন্দেহের তীর তাই প্রথমেই তার দিকে গেল। একেকজন একেকভাবে প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে,
— “তুই কিছু জানিস না?”
— “নাবিলা কোথায় গেছে বল?”
— “রাতের বেলা বের হলো কিভাবে?”

তোপের মুখে পড়ে শ্রেষ্ঠা যথাসম্ভব নাটক চালিয়ে গেল। মুখে বিস্ময়, চোখে অবুঝ ভাব আর কণ্ঠে অজানা আতঙ্কের রঙ। কিন্তু কয়েক মিনিটের চাপা গলায় জেরা আর কটমট চোখের দৃষ্টি সহ্য করা সহজ ছিল না। অবশেষে মুখ খুলেই ফেলল,
— “নাবিলা আর সামির ভাইয়া বিয়ে করবে না বলে একসাথে পালিয়েছে।”

খবরটা শুনে মুহূর্তের জন্য বাড়ি নিস্তব্ধ হয়ে গেল। সকলের শ্বাস আটকে গেছে। পরের পরের প্রশ্ন,
— “কোথায় গেছে?”
সামিরের গন্তব্য ওরা জানত না। তবে নাবিলার ব্যাপারে শ্রেষ্ঠা বলে দিল। সঙ্গে সঙ্গেই সেই জায়গায় ফোন করা হলো। ফোন ধরল অদিতি। কিন্তু অদিতির কণ্ঠের প্রথম বাক্যই মাটি টেনে নিল সবার পায়ের নিচ থেকে। ও বলল,
— “আন্টি আমরা তো বাড়িতেই নেই।”
বাড়ির কার কী অবস্থা জানা নেই তবে শ্রেষ্ঠার গলা শুকিয়ে এলো। অদিতিকে না পেয়ে নাবিলা কোথায় গেছে? সামিরের সাথে চলে গেছে? একই প্রশ্ন সমান তালে আহিরের মাথায়ও ঘুরঘুর করতে লাগল।

নাবিলার মুখে ঘুমের ছাপ। ভেতরে ভেতরে বিরক্তি ফুটে আছে কারণ অদিতিকে না পেয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও শেষমেশ সামিরের সাথেই যেতে হচ্ছে। দু’জনের মধ্যে তেমন কথা নেই কেবল প্রয়োজনীয় নির্দেশ এবং প্রশ্ন বিনিময় হচ্ছে। রাস্তায় এক ছোট্ট চায়ের দোকানের সামনে সামির থামল। দু’কাপ গরম ধোঁয়া ওঠা চা খেয়ে ঘুমটা তাড়িয়ে নিল। চা শেষ হতেই তারা আবার পথ ধরল। সরাসরি বাসস্ট্যান্ডে এসে পৌঁছাল। নাবিলা বাসের সিঁড়িতে পা রাখল, সামির পেছনে পেছনে। এই বাস ভৈরব যাচ্ছে, ওটাই এখন তাদের গন্তব্য। কেন যাচ্ছে, নিজেরাও জানে না…
নাবিলার ঘুম এসে গিয়েছিল। ঘুমের ঘোরে মাথাটা আরও গভীরভাবে সামিরের কাঁধে গেঁথে দিল। সামির ঠোঁট কামড়ে বিরক্তি চেপে রাখল। এই মেয়ের সাহস কত! চারপাশে যাত্রীরা আর সে দিব্যি তাকে বালিশ বানিয়ে ঘুমাচ্ছে। একবার ভেবেছিল কাঁধ ঝাঁকিয়ে সরিয়ে দেবে কিন্তু পরক্ষণেই কী মনে করে, ওর ঘুমটা ভাঙাতে ইচ্ছে হলো না। শুধু মনে মনে প্রহর গুনছিল, কতক্ষণে এই ঝামেলা শেষ হবে।
ভৈরবের বাসস্ট্যান্ডে নেমে চারপাশে তাকাল দু’জনেই। গরমে আর ভিড়ে বাতাস ভারী হয়ে আছে। হাঁটতে হাঁটতে নাবিলা বিরক্ত হয়ে গেছে। আর একটু হলেই ধপ করে বসে পড়বে। ও প্রশ্ন ছুড়ে দিল,
— “আমরা কোথায় উঠব? আপনার চেনা কেউ আছে এখানে?”

সামির মাথা নাড়ল,
— “উঁহু।”
— “তাহলে? আমি তো এক পা-ও হাঁটতে পারব না। মনে হচ্ছে যদি একটু ঘুমিয়ে নিতে পারতাম…” বলেই নাবিলা হাই তুলল।

সামির চোখ রাঙাল,
— “ঘুম? আগে বসার জায়গা পাও কিনা সেটা ভাবো। তোমাকে নিয়ে তো কোনো হোটেলেও উঠতে পারব না। কী মুসিবতে ফেলেছ।”
— “তাহলে কী করবেন?”

সামির ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
— “নাচব। দেখবে?”
— “নাচুন।”
— “রাতে পালিয়ে এসে এখন বড় বড় কথা? বাসের মধ্যে তো আমার কাঁধে ভর দিয়েই ছিলে, তখন ঘুম হয়নি? আর এদিকে আমার হাড্ডির দফারফা হয়ে গেছে। এখনও তোমায় সাথে নিয়ে ঘুরছি, কেনো ঘুরছি সেটাই অবাক করার মতো বিষয়।”

নাবিলা ঠোঁট ফোলাল,
— “বেশি কথা বলবেন না, আগে কোথাও বসতে দিন।”

সামির চারপাশ দেখে বলল,
— “ঠিক আছে, চলো ওই চায়ের দোকানে বসি। তবে সাবধান, আবার ঘুমিয়ে পড়ো না। এরপর ঘুমালে আমি রেখে চলে যাব।”
নাবিলা উত্তর দিল না। এমনিতেই টায়ার্ড, কথা বলার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে।
.
বাড়িতে কাহিনী হচ্ছে। পুরুষ মানুষ যারা ছিলেন তারার পুলিশ স্টেশনে গেলেন। ওখানে বিস্তারিত বলার পর অফিসার বললেন, যেহেতু ছেলে-মেয়ে স্ব-ইচ্ছায় গেছে সেক্ষেত্রে তাদের কী করার থাকতে পারে? কথা সত্যি, কিন্তু এইভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকা যায় না। মামার পরিচিত অফিসারকে বিষয়টা আলাদাভাবে দেখার জন্য বলা হলো। এছাড়াও তারা নিজেদের মত খোঁজ তো করবেই। দু’পরিবার থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, ওরা যেহেতু এখনই মানছে না তাই আপাতত বিয়ের ব্যপারটা চাপা থাকুক। আরেকটু বড় হোক, তারপর সব হবে ক্ষণ। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল শুধু ওদের রাতে জানানো হয় নাই। এক রাতে আর কি হতো? সকালে জানাবে ভেবেছিল। ওরা কি আর সকাল হওয়ার অপেক্ষা রাখল? কোথায় গেছে কে জানে? সাখাওয়াত হোসেন সম্ভাব্য সব আত্নীয়-স্বজনের কাছে খোঁজ নিয়েছেন, কোথাও খোঁজ মিলে নাই। সারাটা দিন কেটে গেল, খবর পাওয়া গেল না… সকলে নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে নিঃশ্বাস চেপে বসে রইলেন।

ওদিকে সন্ধ্যা নামছে। অচেনা জায়গায় অনেকক্ষণ কাটিয়ে দিয়েছে। আর থাকা যাচ্ছে না। চেনা-পরিচিত হলে তাও কোনো না কোনোভাবে রাতটাও কাটিয়ে দেওয়া যেত। সামির জিজ্ঞেস করল,
— “কি করা যায় এখন?”

নাবিলা হাঁটা থামিয়ে ওর দিকে তাকাল,
— “আমাকে জিজ্ঞেস করছেন? আমার পরামর্শ পছন্দ হবে?”
— “বলো, বলো। বিপদে পড়লে কত পরামর্শ শুনতে হয়, মেনে নিতে হয়।”

নাবিলা বলল,
— “তাহলে চলুন ফিরে যাই।”
হঠাৎ করে সামিরের কাছেও কথাটা খুব যুক্তির মনে হলো। তৎক্ষণাৎ ফিরতি বাস পাওয়া গেল না। লাস্ট যেটা আসবে, সেটা রাত দশটা নাগাদ। ততক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। নাবিলা ভাবছিল, বাড়ির মানুষের কথা। ওরা নিশ্চয়ই চিন্তা করছে। মা-বাবা? আয়হায় এটা কি করে ফেলল সে? একবারও তাদের কথা ভাবল না। নাবিলার হঠাৎ করে খুব কান্না পেল। নিজেকে পাগল বলে ভর্ৎসনা দিল। সামির ওকে কাঁদতে দেখে অবাক হলো। এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল,
— “কোনো সমস্যা?”
নাবিলা উত্তর দিল না। ফুঁপিয়ে কেঁদেই যাচ্ছে। এইমুহূর্তে বসে তার মনে হচ্ছে, মস্ত বড় ভুল করেছে। এটা করা উচিত হয় নাই। জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করে ফেলেছে। অথচ এমন ভুল করার বয়স কিন্তু তার নয়। যথেষ্ট বড় হয়েছে, মাথায় যথেষ্ট বুদ্ধিও রয়েছে। তবে? সামির বোঝার চেষ্টা করছে, এতক্ষণ হম্বিতম্বি করে এই মেয়ের কান্নার পেছনের রহস্য কী? ফের জিজ্ঞেস করল,
— “বাড়ির জন্য মন খারাপ করছে? আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো। সব ঠিক থাকলে মোটামুটি বারোটার মধ্যে আমরা পৌঁছে যাব।”

নাবিলা চোখ মুছে উত্তর দিল,
— “ভাবতেছি, বাড়ি গেলে আমাদের ঢুকতে দিবে?”
— “না দিলে তখন অন্য উপায় খুঁজতে হবে।”
— “সেটা কী?”
— “যখনকার ব্যপার তখন দেখা যাবে।”

নাবিলা একমুহুর্ত চুপ থেকে ঠোঁট উল্টে বলল,
— “সরি।”
— “কেনো?”
— “আমার জন্য আপনাকে অনেক ঝামেলায় পড়তে হলো যে।”

সামির হো হো করে হেসে উঠল,
— “ওয়াও, তুমি সরি বলতে জানো?” নাবিলা সেইমুহূর্তে শুধু পারল না সামিরকে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে।
বাস এলো ঠিকঠাক, ছাড়লও ঠিকঠাক। তবে বিপত্তি বাঁধল মাঝপথে এসে। হঠাৎ করেই বাসের ভেতর চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল। সামনে কিছু লোক উঠে দাঁড়িয়ে অস্ত্র উঁচিয়ে বলছে, যা আছে বের করো। নাবিলার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল। একমুহূর্ত দেরি না করে সামির পেছনের দরজার দিকে তাকাল, ইশারায় নাবিলাকে দাঁড়াতে বলল।
অভিজ্ঞতার বাইরে এই ঘটনায় দুজনেরই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেছে, তবুও ঝামেলা এড়াতে হবে। বাসের পেছনের দরজা খানিকটা খোলা ছিল। সামির নাবিলার হাত শক্ত করে চেপে ধরল, — “চলো।”
মুহূর্তের মধ্যে দুজনেই লাফিয়ে উল্টোদিকের রাস্তা ধরে দৌড়াতে শুরু করল। চারপাশে অন্ধকার, কেবল দূরের লাইটপোস্টের আলো চোখে লাগছে। শ্বাস কেটে যাচ্ছে, গলা শুকিয়ে কাঠ তবুও পেছন ফিরে তাকানোর সাহস নেই।
দৌড়াতে দৌড়াতে কাঁপা কাঁপা হাতে নাবিলা সামিরকে আঁকড়ে ধরছিল বারবার। মনে হচ্ছিল, হাতটা ছাড়লেই বিপদ এসে পড়বে। অনেকটা পথ পেরিয়ে, অবশেষে একটা নির্জন মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে থামল তারা। দুজনেই হাঁপাচ্ছে, বুকের ভেতর হৃদস্পন্দন ধাক্কা মারছে। নাবিলার মনে হলো, ও সত্যিই এক জীবন্ত দুঃস্বপ্নের ভেতর এসে পড়েছে। সামিরের দিকে তাকাল, বোঝা যাচ্ছে না ওর ভাবনা-চিন্তা। তখনই সামির গভীর শ্বাস নিয়ে চারপাশে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলল,
— “অনেক দূর চলে এসেছি বোধহয়।”

নাবিলা ঠোঁট কামড়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল,
— “আমাদের কি আর বাড়ি ফেরা হবে না?”

সামির কণ্ঠ শান্ত রাখল,
— “কুল নাবিলা। আপাতত একটা বিপদ যে কাটাতে পেরেছি, সেটাই ভাবো। বেঁচে থাকলে আজ না হোক কাল, বাড়ি ফিরতেই পারব।”
— “কিন্তু আপনি তো বলেছিলেন, আমরা বারোটার মধ্যে বাড়ি পৌঁছে যাব।”
সামির উত্তর দিল না। তার দৃষ্টিতে সিদ্ধান্তহীনতা। হঠাৎ সামনে রাস্তার ধারে একটা পুরনো দোকানের খালি বারান্দা চোখে পড়ল। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল, নাবিলাকেও হাতের ইশারায় ডাকল।
— “অপেক্ষা করো… একটু জিরিয়ে নিই। তারপর দেখি, কী ব্যবস্থা করা যায়।”
দুজনেই খালি জায়গায় গিয়ে বসে পড়ল। দোকানদার তখন দোকানের ভেতরে হিসাব মেলাচ্ছিল। বাইরে খসখস শব্দ পেয়ে দরজা খুলে তাকাতেই দেখল, একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। দুজনেই ক্লান্ত, হাঁপাচ্ছে। সন্দেহ ভরা চোখে লোকটা ওদেরকে পরিচয় জিজ্ঞেস করল।
সামির একমুহূর্তের জন্য থমকালো। এই পরিস্থিতিতে সত্যি কিছু বললে হাজার প্রশ্ন আসবে, বিপদ বাড়বে। তাই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে নিজেদের স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিল। তারপর বিস্তারিত ঘটনা জানাল। ডাকাতির ঘটনা শুনে দোকানদারের চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল। মাথা নেড়ে বলল,
— “এখনই ফেরার উপায় আছে। এখান থেকে অল্প দূরেই চৌরাস্তা। ভোরের বাজারে মাল নিয়ে ট্রাক যাতায়াত করে। সেখানে গিয়ে বললেই ওরা পোঁছে দিবে।”

ওরা দেরি করল না। ধুলোমাখা রাস্তায় হেঁটে চৌরাস্তার মোড়ে পৌঁছাল। চারদিক নিস্তব্ধ। কিছুক্ষণ দাঁড়াতেই হেডলাইটের আলো ফুটে উঠল দূরে, একটা মালবোঝাই ট্রাক গড়িয়ে আসছে। সামির হাত তুলে সিগন্যাল দিল। ট্রাক থামল, চালক কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল গন্তব্য। ওরা সবকিছু খুলে বলতেই ব্যবস্থা হয়ে গেল। ইঞ্জিন গর্জে উঠল, মালবোঝাই গাড়ি অন্ধকার রাস্তা চিরে এগোতে লাগল। ঘড়িতে তখন ভোর চারটা বাজে… নাবিলা একটা দুঃস্বপ্নের ঘোরে।

রাস্তাঘাট জমজমাট। এরমধ্যে সামির আর নাবিলা এসে দাঁড়াল বাড়ির গেটের সামনে। ঘড়িতে তখন ছয়টা পেরিয়ে গেছে। সামির ইতস্তত করছিল। এতসব ঝামেলার পর এই দরজার ওপারে কী অপেক্ষা করছে, কে জানে? অবশেষে কলিংবেল চাপল।
তখনই নাবিলা চুপিসারে সামিরের পেছনে সরে গেল। ওর চোখেমুখে রাতভর দৌড়ঝাঁপ আর অস্থিরতার ছাপ স্পষ্ট। ও শার্টের পেছনটা মুঠো করে শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে রইল।
সারারাত কেউ ঘুমাতে পারেনি। কলিংবেলের ধ্বনি বাজতেই দরজা খুললেন স্বয়ং নেওয়াজ আহসান। ঠান্ডা চেহারা, কিন্তু কোনও বকাঝকা করলেন না।
নাবিলা বাবাকে দেখে স্বভাবতই ভয়ে সঙ্কুচিত হয়ে সামিরের শার্ট দলাইমোচরাই করল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, তিনি কিছু বললেন না। শুধু নীরবে পাশ কাটিয়ে ভেতরে যেতে ইঙ্গিত করলেন। ভেতরে ঢুকে দেখল সবার রাগ বা কান্নার বদলে একধরনের নিস্তব্ধ দৃঢ়তা। নাবিলা ভেবেছিল কান্নাকাটি, অভিযোগ, হয়তো হট্টগোল শুরু হবে। কিন্তু না, তার বদলে যা ঘটল তা পৃথিবীর নবম আশ্চর্য বললেও কম বলা হবে। সকাল ঠিক নয়টা নাগাদ কাজি ডেকে আনা হলো এবং দশটার মধ্যেই ওদের বিয়ে পড়ানো হলো। কোনোপ্রকার জোরজবরদস্তি বা তর্ক নয়, সামির ইয়াসির স্ব-ইচ্ছায় মাথা নত করল। কারণ…
.
.
.
চলবে….