প্রিয়াঙ্গন পর্ব-৬+৭+৮

0
16

#প্রিয়াঙ্গন❤️ [পর্ব-০৬]
~আফিয়া আফরিন

একটা অবিবাহিত মেয়ের জন্য টানা দুই রাত বাড়ির বাইরে কাটিয়ে ফিরে আসা আকাশ থেকে আগুন পড়ার মতোই ঘটনা। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে, যেখানে সামান্য ঘটনাও আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে। প্রশ্নের শেষ নেই, “সে কোথায় ছিল? কার সাথে ছিল? কেন গেল? কেমন অবস্থায় ফিরল?” উত্তর না পাওয়া প্রশ্নগুলো থেকে জন্ম নিল আরও কুৎসিত অনুমান, “নিশ্চয়ই বয়ফ্রেন্ড ছিল, পালিয়ে গিয়েছিল।”

নাবিলাও এসবের বাইরে থাকার সুযোগ পেল না। গ্রামগঞ্জে কোনো গল্প চাপা থাকে না। বরং যত গোপন করার চেষ্টা, ততই লোকের মুখে মুখে রসাল আকারে ছড়িয়ে পড়ে। ওদের ফেরার পর শুধু কানাঘুষো নয়, অনেকে সামনাসামনিই আজেবাজে মন্তব্য করছিল। লোকজনের কৌতূহল মেটাতে গিয়ে নাবিলা বুঝে গেল এখানে সত্যি বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না, মিথ্যে বললেও আড়ালে আঙুল তুলবেই। আর আশেপাশের মানুষের সেই মুখরোচক আলোচনা শুনে মনে হচ্ছে নতুন কোনো নাটকের কাহিনী হাতে পেয়েছে, যা তারা প্রতিদিন চর্চা করবেই। ফেরার পরপরই একজন দরজার ফাঁকে উঁকি দিয়ে বলল,
— “ওমা! দুটো রাত বাইরে কাটিয়ে মেয়ে ফিরে এলো। ওই ছেলেটার সাথে কোথায় ছিল দুই রাত? হোটেলে নাকি বাপু? আজকালকার মেয়ে-ছেলেগুলো কী যে হয়েছে না।”

নাবিলা কারো কোনো কথার জবাব দিল না। ওকে আরও নানান ভালোমন্দ কথা শুনতে হলো। এসব থেকে বাঁচানোর জন্যই তাড়াহুড়ো করে বিয়েটা দিয়ে দেওয়া হলো। চারদিকে গুঞ্জন, ফিসফাস আর কটাক্ষ চলতে থাকুক, অন্তত বিয়ে হয়ে গেলে কেউ সহজে আঙুল তুলতে পারবে না, এই ভেবেই বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠরা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন।
সামিরও চুপচাপ সব মেনে নিল। প্রথমে তার চোখে এটা ছিল বিরক্তিকর পরিস্থিতি। কিন্তু যখন দেখল নাবিলাকে বিনা কারণে, একতরফা দোষারোপ করা হচ্ছে তখন খারাপ লাগল। দোষের ভাগীদার সে নিজেও, অথচ লোকে তাকে দেখছে না । কেন সবসময় মেয়েদের চরিত্র নিয়েই প্রশ্ন তোলা হয়, এটা আজও সামিরের মাথায় ঠিকভাবে ঢোকে না। এই অন্যায়বোধই তাকে একবাক্যে রাজি করিয়ে দিল। অন্তত এই বিয়েটা হলে নাবিলাকে মিথ্যা অপবাদ সহ্য করতে হবে না। কথায় আছে না, কুকুরের লেজ কখনো সোজা হয় না ঠিক তেমনি কিছু মানুষের স্বভাবও কখনো পরিবর্তন হয় না। বিয়ের পরেও দূরে দাঁড়িয়ে অনেকে ফিসফিসিয়ে বলল,
— “দেখলি? প্রেমের কাহিনী বিয়েতে গিয়ে ঠেকল। বলেছিলাম না, এরা কাহিনী করে আসছে।”

নাবিলার জন্য ঘটনাটা সহজ ছিল না। হঠাৎ করে আকাশ ভেঙ্গে মাথায় পড়ার মতোই ছিল। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেও সে ছিল অবিবাহিত, নিজের মতো করে বোকা-বোকা প্ল্যান করা, তর্কে-ঝগড়ায় ভরা এক মেয়ে। রাতারাতি সবকিছু পাল্টে গেল। এখন সে বিবাহিত, নতুন এক পরিচয়ে বাঁধা পড়ে গেল, যেটার জন্য প্রস্তুত ছিল না। এসব তো সিনেমায় হয়। ওর জীবনও তবে সিনেমার সুর ধরেছে? মনে হচ্ছিল, জীবনের গতি কেউ হুট করে অন্য রেললাইনে তুলে দিয়েছে। পরবর্তী চিন্তা মাথায় মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল।
আচমকা সবকিছু ঘটে যাওয়ায় প্রথমে বাড়ির সবাই ভেতরে ভেতরে মনক্ষুণ্ণ ছিল, কেউ সরাসরি প্রকাশ না করলেও চোখে-মুখে চাপা হতাশার ছাপ ছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেই মনখারাপ কেটে গেল। এখন বাড়িতে এক নতুন উৎসবের আমেজ, নতুন সম্পর্কের উষ্ণতা চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে।
শ্রেষ্ঠা চুপচাপ এসে বসল নাবিলার পাশে। বিয়েটা এত তাড়াহুড়োয় হওয়ায় নাবিলার গায়ে একফোঁটা সাজসজ্জা নেই; না গয়না, না মেকআপ, না বিয়ের শাড়ি। তবুও মাথায় হালকা ঘোমটা টেনে বসে থাকার কারণে ওকে বেশ লাগছিল। শ্রেষ্ঠা ঠোঁটে মুচকি হাসি ফুটিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই নীতু এসে নাবিলাকে ডেকে নিয়ে গেল। তার কণ্ঠে একরকম আদেশ ছিল, হয়তো কিছু গুরুতর আলোচনা করবেন। নাবিলা চুপচাপ উঠে দাঁড়াল, ঘোমটার কোণটা ঠিক করল, তারপর মায়ের পিছু নিল। নীতু নাবিলাকে নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজাটা আলতো করে ভিজিয়ে দিলেন। একমুহূর্ত নীরব থেকে মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন। ওর চোখেমুখে একরকম ভয় আর অস্বস্তি মিশে আছে।
— “নাবিলা, তুই ঠিক আছিস তো মা? এই দুই রাত… আমি তো চোখের পাতা এক করিনি। বেঁচে আছি এটাই অনেক মনে হচ্ছে। চারিপাশে কত কথা হচ্ছে, জানিস তো?”

নাবিলা নিচু গলায় বলল,
— “জানি মা… আমি তো ইচ্ছে করে কিছু করিনি। সবটাই পরিস্থিতির স্বীকার।”

নীতু দীর্ঘশ্বাস ফেলল,
— “আমি জানি তুই কিছু করিস নাই। কিন্তু লোকে এসব বোঝে না। এখন তুই কাঠগোড়ায় দাঁড়ানো আসামির মত। তোর প্রতিটা কাজ এখন মানুষ দেখবে, বিচার করবে। বিয়েটা হলো, এটা নিয়েও কথার শেষ নেই।”
— “হুমমম…”
— “সামির কেমন? ঠিক আছে তো? ছেলে হিসেবে আমাদের কাছে ওকে খারাপ মনে হয় না। কথা হয়েছে? মেনে নিয়েছে সবটা?”

নাবিলা ধীরকণ্ঠে বলল,
— “ও… ঠিকই আছে। কোনো কথা হয় নাই তাই রাগ করে আছে কিনা বুঝতে পারছি না।”
— “ভালো কথা। ও এখন তোর স্বামী, তুই ওর সাথে বোঝাপড়া করে চলবি। যেহেতু অন্যরকম একটা পরিস্থিতিতে বিয়েটা হয়েছে, তাই ওকে সময় দে। সম্ভব হলে মুখোমুখি বসে কথা বল।”

নাবিলা বলল,
— “মা, আমি নিজের মুখোমুখিই হতে পারছি না। এই হঠাৎ বিয়ে…”

নীতু মেয়ের দু’হাত ধরে ভরসা দিল,
— “পারবি মা, ভাবিস না। সাহস রাখ, মাথা ঠান্ডা রেখে চল। মানুষের মুখ তো বন্ধ হবে না, কিন্তু তুই নিজের সম্মান নিজের হাতে রাখবি।”
—কিন্তু…”

নীতু মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
— “কোনো কিন্তু না। শোন, যা হয়েছে সেটার জন্য নিজেকে দোষ দিবি না। আমরা সবাই তোদের সাথে আছি।”
মায়ের সান্ত্বনামূলক কথায় নাবিলার ভেতরের সব অস্থিরতা ধীরে ধীরে থেমে গেল। অনেকক্ষণ পর ঠোঁটে একচিলতে হাসি ফুটল। জীবনটাকে যতটা ভয়ঙ্কর আর অদম্য ভেবেছিল, আসলে ততটা নয়। সহজভাবে নিলে সব সহজ।
.
সামিরের সিদ্ধান্তটা মোটেও হঠাৎ আবেগের বশে নেওয়া ছিল না। সবমিলিয়ে সে যথেষ্ট ভেবেচিন্তেই এই পথে পা বাড়িয়েছে।
ব্যঙ্গাত্মকভাবে বলতে গেলে, যে বিয়ে থেকে পালানোর জন্য সেই রাতে নাবিলাকে নিয়ে অজানার পথে বেরিয়ে পড়েছিল, ভাগ্য ঘুরপথে গিয়ে ওদের আবার একই সূত্রে বেঁধে দিল। সেই পালিয়ে যাওয়া আর ফিরতে না পারার মুহূর্তগুলোই তাদের বন্ধনের প্রথম ইট হয়ে রইল। সামির জানত, এ পথে গেলে কিছু দায়িত্ব তার ঘাড়ে চেপে বসবে। কিন্তু এও জানত, মেয়েটার ওপর মিথ্যে অপবাদ চেপে দেওয়া হলে তা তার কাছে সারা জীবনের ক্ষত হয়ে থাকবে। আর সামির ইয়াসির সেই ক্ষতর ভার সারাজীবন বহন করতে পারবে না।
সামির সেমিস্টারের জন্য আবেদন করেছিল, সেটা মঞ্জুর হওয়া নিশ্চিত। তারপরই ভিনদেশে পাড়ি জমাবে। সেখানে পড়াশোনা শেষ করে চাকরি-বাকরি করবে, নিজের মতো জীবন গড়ে তুলবে। বাংলাদেশে আর ফিরতে হবে না, ফেরার ইচ্ছেও তার নেই। তার দরকার কেবল মুক্তি। এই বিয়ে-শাদীর বাঁধন তার কস্মিনকালেও পছন্দ ছিল না। ব্যস, একবছর কষ্ট করে অপেক্ষা করতে হবে। দেখতে দেখতে বছরটা কেটে যাবে, তারপর এই জীবনের ইতি টেনে অন্য জীবন শুরু করতে হবে।

বাড়ির রান্নাবান্না আর সাজসজ্জায় তৎপরতা লক্ষ্য করার মতো ছিল। বিয়ে হয়ে গেছে, সামির এখন নতুন নাতজামাই সেজন্য আয়োজনে কোনো ত্রুটি রাখা যাবে না। সবাই নিজেদের মতো করে কাজ করছিল, রান্নার স্বাদ-গন্ধ ঘরে ছড়াচ্ছিল।
বাসরঘরের দায়িত্ব ছিল নাদিম আর শ্রেষ্ঠার হাতে। কিন্তু ফুলের ব্যবস্থা করতেই যথেষ্ট সময় লাগল। তাও পছন্দমত ফুল পাওয়া গেল না। হাতের কাছে যা পেল তাই দিয়েই হ-য-ব-র-ল অস্থায়ী সাজসজ্জা করে ফেলল। ঘরটা দেখে মনে হচ্ছিল নাবিলা দেখলে নির্ঘাত একটা চটকানা মেরে বসবে। কিন্তু কী করার? এসব খুলে নতুন করে সাজাতে গেলে দু’দিন তো লেগেই যাবে। তাই শ্রেষ্ঠা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ঘরের আলো আর দরজা বন্ধ করে দিল, যেন এখনই কারো চোখে না পড়ে।
বর আর বউ আলাদা ছিল। সন্ধ্যার পর দুজনকে একসাথে করা হলো। তারা দুজনেই চুপচাপ, একে অপরের দিকে তাকালে চোখ সরিয়ে নিচ্ছিল। অজান্তে কোলাকুলি বা কথাবার্তা কিছুই ছিল না, শুধু এক ফাঁকে চোখাচোখি। যেখানে ভীষণ অস্বস্তি লুকিয়ে ছিল। সকলে ওদের কথা বলার সুযোগ দিয়ে বেরিয়ে গেল। ঘরটা তখন নিঃশব্দ একটা যুদ্ধক্ষেত্র। নাবিলা নড়েচড়ে বসে বলল। জিজ্ঞেস করল,
— “আপনি হুট করে বিয়ে করে নিলেন কেনো আমায়?”

সামির কটমট দৃষ্টিতে তাকাল। বুদ্ধ নাকি এই মেয়ে? কেনো বিয়ে করেছে, জানে না? নাবিলা ফের বলল,
— “এইভাবে আমার দিকে তাকিয়ে লাভ নেই। ভয় পাই না। লোকে দশ কথা বলবে দেখেই আপনাকে মানবতার ফেরিওয়ালা হতে হবে? খুব দয়া দেখিয়েছেন তাইনা? সবার কাছে ভালো সাজলেন। অথচ আপনি যে কী মিচকা শয়তান সেটা আমি ভালো করেই জানি।”

সামির গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,
— “নাবিলা, আমি যা করেছি তোমার ভালোর জন্যই করেছি।”
— “উদ্ধার করেছেন আমায়। আমি বলেছিলাম, আমার ভালো করুন?”
— “সেইমুহূর্তে নিজ দায়িত্বে আমার তাই মনে হয়েছিল।”
— “আপনার সাথে সারাজীবন একসাথে থাকা যায়?”
— “না থাকা গেলে আমি কি করব?”

নাবিলা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
— “অসহ্য, বিরক্ত। আপনাকে ইচ্ছে করছে লবণ মরিচ দিয়ে মাখিয়ে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে।”
— “আচ্ছা।” সামির নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল।
— “আচ্ছা মানে কী হুম? শুনুন, আমি কিন্তু আপনার সাথে এক ঘরে এক বিছানায় থাকতে পারব না। এসব আমার স্বভাব বিরুদ্ধ।”

সামির বলল,
— “আমি তো তোমাকে আমার সাথে থাকতে বলি নাই।”
— “কিন্তু বাড়ির মানুষ তো থাকতে বলবে।”
— “সেক্ষেত্রে আমার কি করার থাকতে পারে?”

নাবিলা তেড়ে এলো,
— “বোকা বোকা কথা বলবেন না। আপনার কিছু করার নেই মানে? আপনি আমার সাথে থাকতে পারবেন না মানে পারবেন না। আমি শান্তিতে থাকতে চাই, ঝামেলা মাথায় নিতে চাই না।”
কিন্তু তা বললে তো হবে না, তাইনা? কেউ মানবেও না। ঠিকসময় মত ওদেরকে ওদের জন্য বরাদ্দকৃত ঘরটাতে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। ঘরে ঢুকতেই চোখ পড়ল চারপাশের অগোছালো অবস্থায়। মেজাজটা আরোও খারাপ হলো। এটা ঘর না গোয়ালঘর সাজানো হয়েছে? গোলাপ আর রজনীগন্ধা পর্যন্ত ঠিক আছে কিন্তু মাঝেমাঝে মোরগ আর গাঁদা ফুলের কি দরকার ছিল? গৃহসজ্জার জিনিসপত্র সবমিলিয়ে এক হাস্যকর পরিবেশ তৈরি করেছে।
দরজা বাইরে থেকে শ্রেষ্ঠা বন্ধ করে দিয়েছে। নাবিলা নিজের মনে চিন্তা করতে লাগল, এই অবস্থা থেকে কী করে পার পাওয়া যায়? একটা ছেলেমানুষের সঙ্গে এক বিছানায় ঘুমানো তার জন্য অসম্ভব ব্যাপার। সে হোক স্বামী অথবা আসামি…
নাবিলা হঠাৎ বুদ্ধি খুঁজে পেল। জানালার পাশে রাখা চেয়ারের দিকে তাকিয়ে সামিরকে বলল,
— “আপনি একটু ওখানে গিয়ে বসুন, আমি বিছানা থেকে ফুলগুলো সরিয়ে নিই। তারপর আপনি এসে শুয়ে পড়বেন।”

সামির মেনে নিল। এতক্ষণ ঠিকঠাক ছিল কিন্তু এখন ক্লান্তি আর ঘুমের ওভারফ্লো তাকে ক্রমশ গ্রাস করতে শুরু করল। চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে সামির নিজেকে বিশ্রামে ডুবিয়ে দিল।
নাবিলা ধীরে ধীরে বিছানার ওপর থেকে ফুলগুলো সরাতে লাগল। কিন্তু তার মন ঠিক সেখানে ছিল না, সে সুযোগের জন্য অপেক্ষা করছিল। সামির যখন প্রায় ঘুমে মগ্ন তখন ও গুণে গুণে তিনটে ওড়না বের করল, এগুলোই তার পরিকল্পনার অংশ। নাবিলা সামিরের সামনে এসে দাঁড়াল, হাতের ওড়না দিয়ে দ্রুততার সঙ্গে সামিরকে চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে দিল। সামির তৎক্ষণাৎ তড়াক করে উঠল। চোখে অবিশ্বাস আর অবাক হওয়ার মিশ্রণ।
— “এটা কি হচ্ছে?”

নাবিলা জবাব দিল,
— “নিজের প্রোটেকশনের ব্যবস্থা করে নিলাম।”

সামির মুখ শক্ত করে জিজ্ঞেস করল,
— “আমাকে বেঁধে? আমি বাঘ না, ভাল্লুক!”

নাবিলা অবিচল থেকে উত্তর দিল,
— “কিছুই না। এই মুহূর্তে স্বামী নামক আসামি।” বলতে বলতেই তৃতীয় ওড়নাটা দিয়ে চেয়ারের একপ্রান্ত থেকে জানালার সঙ্গে শক্ত করে বাঁধল। সবকিছু সুশৃঙ্খল, ঝামেলাহীন। দেখেশুনে নিজের জায়গায় ফিরে এসে বিছানায় বসল, যেন কিছুই ঘটেনি।
সামির বেজায় রেগে গেল, গায়ে আগুন জ্বলে উঠল। এই মেয়েটা কি ভাবছে তাকে? পুরুষ মানুষ বলে কি সবসময় নিজের ইচ্ছা চালাবে? এর আগেও তো দু’রাত নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দিয়েছে। তখন এমনকিছু মনে হয় নাই? কেনো? খোলা আকাশের নিচে ছিল বলে? এখন চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি হয়ে আছে তাই স্বাধীনতা আর বিশ্বাসের ঘাটতি রয়েছে আর নাবিলাও একেবারেই ভিন্ন মানুষ হয়ে গেছে। এটা সামির ইয়াসিরের জন্য যে কত বড় অপমান, যদি নাবিলা অন্তরের গহীন থেকে সেটা একটাবার বুঝতে পারত…
নাবিলা বিছানায় আয়েশ করে হেলান দিয়ে বসে হালকা হাসি মুখে বলল,
— “চিন্তা করবেন না, সকালে ঠিক সময় খুলে দেব।”
— “শাট আপ।”

নাবিলা ভ্রু তুলে মুচকি হেসে জবাব দিল,
— “ধমক দিচ্ছেন? আচ্ছা দিন, সমস্যা নেই। অধিকার আছে। আর কিছু বলতে চান? বলতেই পারেন। আপনি বলুন, আমি বরং ঘুমাই। ঘুম ধরছে।”

সামির নীরব। কিন্তু তার ভেতরে ভেতরে রাগ ফুলেফেঁপে উঠছে। নাবিলা আবারও ঠাট্টা করে বলল,
— “পৃথিবীর ইতিহাসে বোধহয় এরকম বাসর প্রথম, তাই না?”

সামির শুধু একটাই শব্দ ছুঁড়ে দিল,
— “চুপ…”
— “আচ্ছা, চুপ করলাম। আপনিও ঘুমান। গুড নাইট।”
বলেই নাবিলা বালিশ টেনে শুয়ে পড়ল, ঠোঁটের কোণে বিজয়ের হাসি। নাবিলা বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। সামির বহুকষ্টে নিজেকে সংবরণ করছে। মুখ শক্ত, চোয়াল চেপে রাখা, কথা বললেই বিস্ফোরণ হবে। মনে হচ্ছে, ইচ্ছে করলেই সব ছিঁড়ে ফেলে উঠে দাঁড়াতে পারে কিন্তু শুধু জেদেই বসে আছে। দেখতে চায় শেষ পর্যন্ত এই মেয়েটা কী কী করে?

সকালের আলো ঘরে ঢুকে পড়েছে। দরজার ওপাশ থেকে টকটক ধাক্কার শব্দ ক্রমশ জোরে শোনা যাচ্ছে। নাবিলা আধোঘুম চোখে তাড়াহুড়ো করে উঠে বসলো। সামিরের দিকে তাকাতেই ফিক করে হেসে ফেলল। চেয়ারে আধা হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে থাকা ছেলেটাকে দেখে বোধহয় মনে মনে একটু খারাপ লাগল। কিন্তু কী করার? ঘড়িতে চোখ পড়তেই চমকে উঠল, নয়টা পেরিয়ে গেছে। দরজা ধাক্কার শব্দ থামছে না। তাড়াতাড়ি গিয়ে সামিরের বাঁধন খুলতে লাগল। সামির তখনও ঘুমে ছিল কিন্তু হাতের ছোঁয়ায় চোখ মেলে তাকিয়ে কপালে ভাঁজ ফেলল।
— “সরো, তোমার প্রয়োজন নেই।” সামির তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল।

নাবিলা কাঁধ ঝাঁকিয়ে পাত্তা না দিয়ে দরজার দিকে গেল। দরজা খুলতেই দেখা গেল, শ্রেষ্ঠা দাঁড়িয়ে আছে কোমড়ে হাত রেখে। মুখে চওড়া হাসি।
— “এসো, আর কত ঘুমাবে? সারারাত ঘুমাও নাই নাকি?”

নাবিলা হাই তুলে হাত-পা টানল। মুখে ম্লান হাসি রেখে বলল,
— “সারারাত জব্বর ঘুমিয়েছি বলেই এখন ঘুম ভাঙতে দেরি হলো।”

শ্রেষ্ঠা ভুরু কুঁচকে হেসে বলল,
— “আরেব্বাস! ভাইয়া কোথায়?”

নাবিলা ঠোঁট কামড়ে পেছনদিকে তাকিয়ে উত্তর দিল,
— “আছে আছে… ভাইয়াও আছে।”

শ্রেষ্ঠা ভান করা গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ল,
— “তাকে নিয়ে বাইরে আসো।” এ কথা বলে শ্রেষ্ঠা প্রায় ঘুরেই যাচ্ছিল, কিন্তু নাবিলা পেছন থেকে ডাক দিল,
— “শোন…”
শ্রেষ্ঠা ফিরে তাকাতেই নাবিলা বলল,
— “ইতস্ততবোধ করতেছি… বাড়িতে সবাই আছে, তাই না?”

শ্রেষ্ঠা এবার খিলখিল করে হেসে উঠল। বলল,
— “হ্যাঁ আছে, সবাই আছে। অলরেডি তোমাকে নিয়ে একদফা হাসাহাসি হয়ে গেছে। তাতে কিছু হবে না, এসো। বিয়ের পর এসব একটু-আধটু হয়।”
নাবিলা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঘর থেকে বের হলো।
সামিরের মনে হলো, এখানে থাকার মতো তার আর কোনো কারণ নেই। থাকবেই না আর। এই বাড়িতে এসে জীবনের বারোটা বাজানোও কম ছিল, এখন তেরোটাও বেজে গেছে। আর কত?
ব্যাগপত্র টেনে এনে একে একে গোছাতে শুরু করল সে। জামাকাপড়, বই, নোটবুক, চার্জার, সব এমনভাবে ঠাসতে ঠাসতে রাখছিল যে মনে হচ্ছে, নিজের রাগটা এসবের উপর ঝেড়ে দিচ্ছে। রেশমা কয়েকবার এসে বোঝানোর চেষ্টা করলেন,
— “আমরাও তো শিগগিরই ফিরব, আর দু’টো দিন অপেক্ষা কর না? নাবিলার ব্যাপারে কথা বলি ওর বাবা-মায়ের সাথে। ঠিক করব, ও এখন যাবে নাকি পরে… শুনে যাস। তুই যদি আগে চলে যাস, কেমনে হবে বাবু?”
সামির কোনো কথাই পাত্তা দিচ্ছিল না। চোখে বিরক্তি, মুখে নিরাসক্তির ছাপ। চুলোয় যাক নাবিলা, চুলোয় যাক সব সিদ্ধান্ত। ওর ইচ্ছে হলে থাকবে, ইচ্ছে হলে যাবে। সেটা সামির ইয়াসিরের দেখার বিষয় নয়।

রেশমা বেশ অপ্রস্তুতবোধ করছিলেন, ছেলে হঠাৎ এমন করে চলে যাবে… কোনোরকম সকলকে বলল,
— “অনেকদিন হয়ে গেল সামির এসেছে… হঠাৎ একটু জরুরি কাজ পড়েছে, তাই আজকেই ফিরতে হচ্ছে।”
বাড়ির সবাই মেনে নিল। কাজের ডাক এলে জোর করে কাউকে ধরে রাখার তো কোনো মানেই হয় না।
সামির ফিরে যাচ্ছিল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে সটকে পড়বে ততই মঙ্গল। কিন্তু হঠাৎই পা থমকে গেল। পাশেই রান্নাঘর, সেখান থেকে ভেসে আসছে অচেনা কারো কথা। কণ্ঠস্বরে একটা তীক্ষ্ণতা।
শব্দগুলোও স্পষ্ট, টানটান ভাবটা সামিরের কান এড়াল না। পরিষ্কার শোনা যাচ্ছিল,
— “আহা, আমি তো আগে থেকেই বলছিলাম, মেয়েকে সামলাও। এই যে বাইরে রাত কাটিয়ে এসে হাজির। কার সঙ্গে ছিল, কি করছিল, সবাই জানে না মনে করো? গ্রাম তো ছোট জায়গা, খবর লাগতে সময় লাগে নাকি? কপাল পুড়ল বাপ-মায়ের আর ওই ছেলের, এখন তো বিয়ে দিয়ে ঢেকে ফেলেছ ব্যাপারটা।”

সামিরের এমনিতেই মেজাজ গরম ছিল এই কথাগুলো আরও বিষ ঢেলে দিল। ও রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখল, নাবিলাও সেখানে উপস্থিত। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে চুপচাপ এসব হজম করছে। সামির এগিয়ে এলো,
— “আপনাদের এত চুলকানি কীসের?”

মহিলা চমকে তাকাল। সামির নাবিলার দিকে তাকিয়ে নিজের ভেতরকার ঝাঁঝ উগ্রে দিল,
— “যে মেয়েকে নিয়ে এত কথা বলছেন, সে তো বিয়ে তাকেই করেছে যার সঙ্গে দু’টো রাত বাইরে কাটিয়েছে। আপনার ছেলেকে তো বিয়ে করে নাই, তাই আপনার ছেলের কপালও পোড়েনি। যার বা যাদের কপাল পুড়েছে, মলমটা তাদেরই লাগাতে দিন। অযথা অন্যের ব্যাপারে নাক গলিয়ে নিজের নাক বড় করার চেষ্টা করবেন না।”
.
.
.
চলবে….

#প্রিয়াঙ্গন❤️ [পর্ব-০৭]
~আফিয়া আফরিন

সামিরের কথা শুনে ঘরের ভেতরের বাতাসই বদলে গেল। ওই মহিলা থতমত খেয়ে হাঁ করে রইল। বারান্দায় বসে থাকা বড়রা চুপচাপ হলেও চোখে-মুখে একধরনের তৃপ্তির ছাপ ফুটে উঠল। এই অন্যায়টা মেনে নেওয়া যাচ্ছিল না। তারা কিছুতেই কাউকে থামাতে পারছে না। অনেক বুঝিয়েও কিছু মানুষকে বোঝানো যায় না। সামিরের এই জবাবটা দেওয়া দরকার ছিল। নানু ভীষণ খুশি হলেন নাতজামাইয়ের কর্মকান্ডে। তার আদরের নাতনির জন্য উপযুক্ত একজনকে পাওয়া গেছে, যে সব কিছু থেকে তাকে রক্ষা করবে।
ওই মহিলার হতভম্ব চেহারা দেখে শ্রেষ্ঠা ফিক করে হেসে ফেলল, নীতুও খুশিতে মাথা নাড়ল। রেশমার চোখে জল চলে এলো, গর্ব আর স্বস্তি মেশানো অনুভূতিতে। এই ছেলে তো বিয়েই করতে চাইল না অথচ এখন নাবিলার পক্ষ নিয়ে কথা বলছে? হয় হয় এমনটাই হয়। বিয়ে তো একপ্রকার যাদু!
সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছে নাবিলা, সামির ওর হয়ে কথা বলল? অথচ গতরাতে যা ঘটেছে, তাতে তো শোধ নেওয়ার কথা ছিল। নাহ… গতকাল রাতে সে মোটেও ঠিক করেনি। এক্ষুনি সরি বলা উচিত। কিন্তু সামির তো চলে যাচ্ছে। এই “আসামি”র সাথে আর কবে দেখা হবে বা আদৌ হবে কি না, কে জানে? সামির বিদায় নিয়ে বারান্দা পেরিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। নাবিলা বুক ধুকপুক করতে করতে পিছু পিছু দৌড়ে গেল। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ডাকল,
— “শুনুন।”

সামির দাঁড়াল, পেছন ফিরে তাকাল। নাবিলা দ্রুত বলে ফেলল,
— “গতরাতের জন্য আমি সরি। আমি অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি। তাও আপনি আমাকে প্রটেক্ট করলেন, আমার হয়ে দু’টো কথা বললেন…” নাবিলা নিজের মত করে বলে যাচ্ছিল কিন্তু সামির হঠাৎ মাঝপথেই থামিয়ে দিল। কাটকাট কণ্ঠে বলল,
— “ওই হ্যালো, আমি তোমার কথা ভেবে কিছু করিনি। ওখানে সবাই ছিল অর্থাৎ বড়রা। নিজের ইমেজ রাখার জন্য বলেছি। নাহলে তোমার হয়ে কথা বলতে আমার বয়েই গেছে।”

নাবিলা খাবি খাওয়া মাছের মতো থমকে গেল। হঠাৎ জোরে, অপ্রস্তুত একটা ধাক্কা খাওয়ার মত অনুভুতি হলো। একমুহূর্ত আগেও ভেতরে ভেতরে ভেবেছিল, সামির ইয়াসির আসলে ভালো মানুষ। কিন্তু না… ভুল ভেবেছে। এ মানুষটা আস্ত গোয়ার, অসভ্য, বর্বর, নিষ্ঠুর। নাবিলা অবিশ্বাস্য কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
— “ভালো সাজার জন্য নাটক করলেন?”
— “ইয়েস। কখনো কখনো করতে হয়।” সামির নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিল।
— “ওকে। গুডবাই।”

সামির হাসল আর কিছু না বলে দু’পা এগিয়ে গেল। কিন্তু হঠাৎ কিছু মনে পড়ল। থেমে পিছিয়ে এলো। গলার স্বর যথেষ্ট সংযত রাখল অথচ কথার ভিতরে চাপা নির্দেশের মতো সুর ছিল,
— “সবসময় তো অপ্রয়োজনীয় কথা বলো। প্রয়োজনে মাথা নিচু করে থাকো কেন? যেখানে কথা বলা উচিত, সেখানে চুপ থাকলে কথা বলার মূল্য কোথায়? এরপর থেকে চুপ থাকবে না। যেখানে অন্যায় করোনি, সেখানে তো একদমই না।”
নাবিলা অবাক হয়ে সামিরের দিকে তাকাল। দৃষ্টিতে কিছুটা রাগ, কিছুটা বিস্ময়, আর কোথাও খুব গভীরে লুকানো একরাশ কৃতজ্ঞতা। কিন্তু কিছু বলার আগেই সামির ঘুরে দাঁড়াল।
সে চলে গেল নীরবে, দৃঢ় পায়ে, কোনোদিকেই না তাকিয়ে। নাবিলা স্থির দাঁড়িয়ে রইল যতক্ষণ না সামির দৃষ্টির আড়াল হয়। তার বুকের ভেতর তখনো সামিরের কথাগুলো প্রতিধ্বনির মতো বাজছিল। নাবিলা ঘরে ফিরল। ঘরে ঢুকতেই কানে এলো সামিরের জয়ধ্বনি। কী যেন করেছে? বোধহয় একাই নাবিলাকে পৃথিবীর সব বিপদ থেকে উদ্ধার করে ফেলেছে! চারপাশের প্রশংসা, বিস্ময়… বাপরে বাপ, ঢংয়ের আর শেষ নাই।
কিন্তু নাবিলা তো জানে, সবটাই লোক দেখানো। ভেতরের আসল কাহিনি শুধু সেই জানে, যদি কাউকে বলে, কেউই বিশ্বাস করবে না। তাই বলাই বৃথা। ভালো হওয়ার নাটক সেও করতে পারে, মুখে মুখে দয়া আর উদারতার বুলি আওড়াতে পারে। কিন্তু করবে না। নাবিলা ইবনাত যা করে মন থেকে করে, নাটকের জন্য নয়। লোক দেখানো মহত্ত্ব? ওসব তার ধাতে একেবারেই নেই। ও নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে সকলের কথাবার্তা অবলোকন করল।
সেদিন বিকেলের হালকা রোদে রেশমা এসে নাবিলার পাশে বসলেন।
— “হ্যাঁ রে মা, আমার ছেলেটাকে কেমন মনে হলো?”
নাবিলা মনে মনে ঝটপট উত্তর দিল, “শয়তানের কারখানা!” কিন্তু ঠোঁটে মিষ্টি হাসি নিয়ে মুখে বলল,
— “ভালোই।”

রেশমা খুশিতে গদগদ হয়ে মাথা নাড়লেন,
— “হুম, ভালো আছে। মাথাটা একটু গরম, তবে মনটা ভালো। তুমি একটু মানিয়ে নিও মা…”

নাবিলা ভেতরে ভেতরে গজগজ করল, “ভাবতেই পারছি না ওর সাথে মানিয়ে নেওয়ার কথা। ওমন অসুরের সাথে মানিয়ে নেওয়া যায়? সাধারণ মানুষ হলে ভেবে দেখতাম।” ওর হাসিমুখের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হলো না, তাই ভেতরের কথাগুলোও বোঝা গেল না।
রেশমা আবার বললেন,
— “শোনো, তোমার বাবা-মা চাচ্ছে না এখনই তোমায় শ্বশুরবাড়ি পাঠাতে। আমাদের যদিও আপত্তি ছিল না। সমস্যা নাই, আমরা অপেক্ষা করব তোমার জন্য। তোমার কোনো আপত্তি নেই তো?”

মনে মনে নাবিলা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, “আলাদা থাকাই ভালো। একসাথে থাকতে গেলে আপনার গোয়ার ছেলেকে প্রতিরাতেই আমি নামক অশান্তি সহ্য করতে হতো। কিন্তু গলায় অনুগত সুর এনে বলল,
— “জি না, আপত্তি কীসের? আপনারা যা ভালো বুঝবেন তাই হবে।”

রেশমা স্নেহভরা চোখে তাকালেন,
— “এইতো লক্ষী মেয়ে।”
আরেকটু “লক্ষী” সাজার অভিনয় সম্পূর্ণ করতে নাবিলা হালকা কৌতূহল দেখাল। সামিরের খবর নিল। ও ঠিকঠাক সামির পৌঁছেছে তো? খাওয়া-দাওয়া করেছে তো?
রেশমার চোখ চকচক করে উঠল। আহা, ছেলেমেয়ে দু’জনই একে অপরকে আগলানোর চেষ্টা করছে। এত তাড়াতাড়ি! তার মনে আনন্দের ঢেউ উঠল। এটাই তো তিনি চেয়েছিলেন। মনে মনে ভাবলেন, সব ঠিকঠাক চললে খুব শিগগিরই এই সম্পর্ক আসল রঙ পাবে… আর এইভাবে বিয়ে দেওয়ার কারণে তাদেরও অনুশোচনা থাকবে না।
.
নাবিলার বিয়ের খবর পুরো আত্মীয়-মহল্লায় বজ্রপাতের মতো পড়ল।
যেই শুনছে, সেই অবিশ্বাসে চোখ বড় বড় করে বলছে,
— “ওমা, আমাদের নাবিলা? দু’দিন আগেই তো দেখলাম এলোমেলো চুলে গেঞ্জি আর হাফপ্যান্ট পরে দৌড়ে বেড়াচ্ছে।”

সবার চোখে নাবিলা এখনও সেই দুষ্টু, হাসিখুশি, বেখেয়ালি মেয়েই ছিল। আর হঠাৎ করেই সেই মেয়ের বিয়ে? ঘটনাটা যতটা অবাকের, ততটাই কৌতূহলের।
এদিকে নীতু বোধহয় “জামাই প্রশংসা কমিটি”-র প্রেসিডেন্ট হয়ে গেছে। যার সাথেই দেখা হচ্ছে, কথা হচ্ছে; সে মুখে একগাল হাসি টেনে শুরু করে দিচ্ছেন,
— “আমাদের জামাই কিন্তু দারুণ ভদ্র, দেখতে সুন্দর, নায়কের মতন, পড়াশোনায় একদম উস্তাদ। আর কী কাণ্ডজ্ঞান! কী সুন্দর করে কথা বলে! প্রথম দিনেই সবার মন জিতে নিয়েছে…” নীতুর প্রশংসার ঢল থামে না। কখনো জামাইয়ের পোশাক, কখনো তার কথাবার্তা, আবার কখনো হাসির ঢঙ, সবই একে একে গুণের খাতায় জমা হচ্ছে।

নাবিলা পাশেই বসে, মুখে নিরপেক্ষ ভাব ধরে নিঃশ্বাস আটকে সব শুনে যাচ্ছে। মনে মনে ভাবছে, আহা এই প্রশংসাগুলো যদি মা সামিরের বাস্তব রূপ দেখে করত, তাহলে ও করতালি দিত। কিন্তু বাইরে থেকে বিন্দুমাত্র প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে, শুধু চুপচাপ হাসিটা আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কিচ্ছু বলবে না, বললেই সকলে তেড়ে আসবে। এখন তো সামির ইয়াসির তাদের আইডল!
নাবিলাদের ফেরার দিন-তারিখ অবশেষে ঠিক হয়ে গেল। আজকের দিনটা কাটিয়ে কালই তারা নাটোরের উদ্দেশ্যে রওনা হবে। রেশমাদের পরিকল্পনাও একই, কাল একসাথেই রওনা দিবে। দু’দিন পর নাবিলার রেজাল্ট বের হবে, তারপর ভর্তি পরীক্ষার কোচিং শুরু তাই সময় নষ্টের সুযোগ নেই, ফেরাটা জরুরি।
বাড়ির আড্ডা, হাসি-ঠাট্টা, বিদায়ের আয়োজনের ভেতরেই নেওয়াজ আহসান বললেন,
— “আমরা যেহেতু এখনও পুরোপুরি মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকজন সম্পর্কে জানি না তাই চেনাজানার জন্য কিছুদিন বাদে সবাই মিলে নাটোরে আসবেন। তাতে আপনাদের পরিবারের সকলের সাথেও ঠিকমতো পরিচয় হবে আর সম্পর্কও মজবুত হবে।” তার কথায় সবাই সায় দিল।
.
সন্ধ্যার আলো তখন লালবাগের সরু গলিগুলোয় নরম হলুদের মতো মেখে আছে। দিনভর ভ্রমণের ক্লান্তিতে সামির বিরক্ত হয়ে গেছে তবুও পরিচিত এলাকার গন্ধ আর গলির চায়ের দোকানের ধোঁয়া তাকে কিছুটা স্বস্তি দিল।
গলির মোড়ে ঢুকতেই সামনে থেকে আসতে দেখল সরফরাজ হোসেনকে। সামিরের একমাত্র চাচা, বাসা খানিকটা এগিয়ে। ভাগ্নেকে দেখেই এগিয়ে এলেন। হেসে বললেন,
— “আরে, ভাগ্নে। কখন এসেছিস? শুনলাম, বিয়ে একেবারে সেরে ফেলেছিস? তোর মা-বাবা বোধহয় ওখানেই তাইনা? কেমন আছিস বাবা? কেমন চলছে সব?”
সামির বিনয়ের সাথে কুশল বিনিময় করল। চাচা হাত বাড়িয়ে ওর কাঁধে চাপড় দিলেন।
— “শুনলাম বউটাও বেশ শান্ত-শিষ্ট মেয়ে। বাড়ির বউ কবে বাড়িতে আসবে, হুম? আমাদের তো দেখার সৌভাগ্য হলো না। থাক, সময় হলে দেখাসাক্ষাৎ হবে।”
সামির হেসে মাথা নাড়ল, কিন্তু ভিতরে ভিতরে নাবিলার প্রসঙ্গ আসায় খানিক অস্বস্তি অনুভব করল। নাবিলাকে আবার বউ সম্বোধন করল, শান্ত-শিষ্ট, তাহলেই হয়েছে… তারপর চাচা বললেন,
— “চল, আগে বাড়ি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে। তারপর বসে ভালোমতো গল্প করব।”
সামির আসলে নিজের বাড়িতেই সোজা ফিরতে চেয়েছিল। অনেকগুলো দিন বাইরে থাকার কারণে নিজের ঘরটা মিস করছিল। কিন্তু সরফরাজ চাচা সেটা হতে দিলেন না। তিনি বললেন,
— “এই সময়ে বাসায় গিয়ে একা একা বসে কী করবি? বাড়ি তো খালি পড়ে আছে। চল, আগে আমাদের বাসায় আয়। খাবি-দাবি, গল্প করবি, তারপর যা খুশি করিস। এই সময় সবাই বাড়িতেই আছে।”

কথাটা তিনি এমন ভঙ্গিতে বললেন যে, সামির আর আপত্তি জানাতে পারল না। মনে মনে ভাবল, ঠিকই তো ফাঁকা বাড়িতে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকার চেয়ে চাচাদের বাসায় কিছু প্রাণবন্ত সময় কাটানোই ভালো। কিন্তু ওই বাড়িতে সে পারতপক্ষে যেতে চায় না রায়হান ভাইয়ের বিয়ের পর। তার অবশ্যই একটা কারণ আছে…
সরু গলি পেরিয়ে দু’জন যখন বাড়ির দিকে হাঁটছিল, তখন রাস্তায় যারা যাচ্ছে, সামিরকে যারা চেনে তারা সবাই বলে উঠল,
— “ভাই একসাথে বড় হলাম। আর তুমি বিয়া কইরা ফেললা। একটাবার জানতেও পারলাম না। আমি তো আয়ানের কাছ থেকে আজকে সকালে জানলাম।”

হাঁটতে হাঁটতে শাহিদ ভাইয়ের সাথেও দেখা হলো। তিনি হাতের কর গুণে গুণে বললে,
— “আরে ব্যাটা, আমি তোর থেকে ছয় বছরের বড়। আমার আগেই কাম সেরে ফেললি। বড় ভাইদের জন্য লজ্জার বিষয়।”

চাচা হেসে বললেন,
— “দেখলি? খবর এখন লালবাগের বাতাসেও ভাসছে।”
সামির আর কী বলবে? সে চাচ্ছিল না, কাউকে জানাতে। অথচ খবর বাতাসের আগে রটে গেছে। এরপর তার বন্ধু-বান্ধবেরা জানবে, খোঁচাবে, ফাজলামি করবে; আর সামিরকে চুপচাপ তা হজম করতে হবে।
সামির চাচাদের বাড়িতে পা রাখতেই ছোটখাটো এক উৎসবের আবহ পড়ে গেল। বসার ঘরে ঢুকতেই রায়হান, আয়ান আর অন্বেষা লাফিয়ে উঠে তাকে ঘিরে ফেলল। আয়ান হাত কচলাতে কচলাতে বলল,
— “ভাই, আমি তো তোর থেকে বড়। এবার তুই বাবার কাছে কথা বলবি আমার বিয়ের জন্য। ছোটোভাই হয়ে তুই বিয়ে করে ফেললি। তোর তো লজ্জা হওয়া উচিত। কীভাবে পারলি ভাই? রোমিও স্টাইলের পালিয়ে গেলি, ফিরে এসে বিয়ে করে ফেললি। তোরই রাজকপাল!”

সামির কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
— “আমার সুপারিশে বিয়ে হবে? তুই কি আমার এমপি সিটের ভোটার?”
— “ভোটার না আমি এখন পাত্র।”

অন্বেষা পাশে দাঁড়িয়ে হেসে উঠল। সামিরের সমবয়সী এই কাজিন আফসোসের সুরে বলল,
— “দেখ, আমরা তো একসাথে বড় হলাম, একই স্কুল, একই কলেজ। কিন্তু তুই আগে বিয়ে করে ফেললি। আমি এখনও স্টার্টিং লাইনেই দাঁড়াতে পারলাম না। আমারে কেউ পাত্তাই দিচ্ছে না।”

ওর কথা শুনে রায়হান মজার ভঙ্গিতে যোগ করল,
— “এইজন্যই তো বলে জীবনে দৌড়ের স্পিড না, টাইমিং-ই আসল। সামিরের টাইমিংটা একদম ফার্স্ট ক্লাস! কী বলিস?”
সকলে হেসে উঠল। সামিরের মনে হলো, টাইমিং না ছাই। সে যে কোন মাইনকার চিপায় ফেঁসে গেছে! এমন মেয়ে বিয়ে করল, যে তাকে বাসররাতে হাত-পা বেঁধে রেখে দেয়। ছ্যাহহহ, একদম মানসম্মানের প্রশ্ন। হতাশাজনক কান্ড, মুখ দেখানোর মতো অবস্থা নেই। ওদের হাসিঠাট্টার মাঝেই দরজা ঠেলে কামিনী ঘরে ঢুকল, হাতে ধোঁয়া ওঠা চায়ের ট্রে। তাকে দেখেই সামিরের চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গেল। বরাবরের মত অসহ্যকর এক অস্বস্তি ভর করল। কামিনী, রায়হান ভাইয়ের স্ত্রী। কিন্তু একসময় সামিরের জীবনে অন্য পরিচয়ে ছিল। খুব বেশিদিন নয়, জাস্ট কয়েকদিনের জন্য প্রেমের মায়াজালে বাঁধা পড়েছিল তারা।
— “তুমি নাকি বিয়ে করেছো? হঠাৎ করে করলে?” চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে কামিনী গম্ভীর দৃষ্টিতে সামিরের দিকে তাকিয়ে বলল।

সামির সংক্ষেপে বলল,
— “হুম।”

কামিনী চোখ সরিয়ে নিয়ে আবার জিজ্ঞেস করল,
— “বউ কোথায়?”
— “নাই।”
— “নাই মানে কি?” কামিনী অবাক হয়ে প্রশ্ন করল।
— “নাই মানে নাই। সাথে থাকলে তো দেখতেই পারতে।” সামির বিরক্ত হয়ে জবাব দিল। ওর সাথে কথা বলার ইচ্ছে নাই। কিন্তু যেহেতু বড় ভাইয়ের বউ তাই সকলের সামনে এড়িয়ে যাওয়া যায় না।
কামিনী ফের জিজ্ঞেস করল,
— “হঠাৎ বিয়ে করলে যে? তুমি এখনও স্টাবলিশ নও। চাকরি-বাকরি কিছুই করো না।”

সামির কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে কড়া ভাবেই জবাব দিল,
— “আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই করেছি। এনি প্রবলেম?”
সেই কথা শুনে কামিনী আর কিছু বলল না, কারণ ঘরে সবাই ছিল। কিন্তু ওর হয়ত আরও কিছু বলার ছিল। কখনো সামিরকে একা পেলে অবশ্যই জিজ্ঞেস করবে, “যতই বাপের ব্যবসায় হাত থাকুক, চাকরি-বাকরি করে না এমন ছেলের কাছে কোনো অভিভাবক মেয়ে কেনো দিল? কাহিনী কী? কি করেছো তোমরা?”
ওদের সম্পর্ক এই বাড়িতে অন্বেষা ছাড়া কেউ জানে না, তাই অন্যদের জন্য এই আলোচনা প্রহর ছিল। সামির উঠে দাঁড়াল। চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে সোজা আয়ানের ঘরে চলে এলো। তক্ষুনি মা ফোন দিল, সামিরের খবর নিল। জানাল, তারা আগামীকাল ফিরে আসছে। অবশেষে সামিরকে নাবিলার সঙ্গে কথা বলতে বলল।
— “যাওয়ার পর নাবিলার সাথে তোর কথা হয় নাই তাইনা? ওকে ফোন দে, কথা বল। মেয়েটা তোর জন্য চিন্তায় আছে।”
— “পারবো না মা, কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।”

মা একটু অনুরোধের সুরে বলল,
— “পারবি না মানে কী? উল্টো কথা বলিস না তো, বাবু। নাবিলা একটু আগে তোর খোঁজ নিচ্ছিল। তোরও উচিত ওর খবর নেওয়া। ও আশায় আছে, তোর ফোনের।”

সামির একটু ঠাট্টার ছলে বিড়বিড় করে বলল, “খোঁজ নিচ্ছিল? বাব্বাহ, নতুন রূপ!” তবে নির্বিকার ভঙ্গিতে মাকে বলল,
— “পরে কথা বলে নিব।”

রেশমা একটু কঠোর স্বরে বললেন,
— “বাবু, তুই তো যথেষ্ট বড় হয়ে গেছিস। তোকে কি আমরা বড়রা প্রেম করার পাঠ দেব? নিজের দায়িত্ব নিজেই বুঝে কর। একবার ভেবে দেখ, তোর বয়সী ছেলেমেয়েরা পাচ্ছে না আর তুই পেয়েও হেলাফেলা করছিস? এখনি ওকে ফোন দে, কথা বল।”
সামির ফোন রেখে দিল। নাবিলার সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছে তার মনে বেঁচে নেই। মনে হচ্ছে, এই মুহূর্তে তাদের মধ্যে যোগাযোগের কোনো খুঁটিনাটি বা সম্পর্কের টানাপোড়েনের অবকাশ নেই; থাকতেই পারে না। নাবিলার নামটা শুনলেই সামিরের মনে গতরাতের ঘটনাটা স্পষ্ট ভেসে উঠছে। কীভাবে সে এত সাহস দেখালো, সামিরের চোখের সামনেই ওকে অপমান করল! সামির কখনোই এটা ভুলবে না। একটা দিন ঠিক করে সে শোধ নেবে, তখন বুঝবে সত্যিকারের ঠেলা কেমন লাগে। নাবিলা এখনও সামির ইয়াসিরকে প্রকৃত চিনতে পারে নাই। চিনতে পারলে তবে বুঝবে… সামির ঠোঁটের কোণে একটুকরো হাসি ধরে রেখে বলল,
— “তুমি যদি পাতায় পাতায় চলো তবে আমি মোটেও ঢালে ঢালে চলব না। সোজা বর্ষাকালের ঝড় উঁহু… কালবৈশাখী হয়ে আছড়ে পড়ব, সেটার জন্য প্রস্তুত থাকো।” কিন্তু সামির এটা বুঝল না, ঝড়ের সাথেই তো বর্ষার আর কালবৈশাখীর আসল মজা। একটু মিলেমিশে চললে বিষয়টা মন্দ হয় না।

শ্রেষ্ঠা আর আহিরকে ছেড়ে যেতে হবে ভেবেই নাবিলার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে উঠল। ওরা শুধু কাজিনই নয় বরং জীবনের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। এতদিন নানা ঝামেলার মাঝে মনমতো দুষ্টুমি করার সুযোগ হয়নি, তাই সবাই একটু ম্লান, একটু বিষণ্ণ। কিন্তু ফিরে তো যেতেই হবে। রেশমা আন্টিরাও একসাথে বের হবে। সবাই বিদায় নিলো, বিদায়ের সময় মনটা আরও বেশি ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। রেশমা আন্টি নাবিলাকে বললেন,
— “তোমার সাথে খুব শীঘ্রই দেখা হবে।”

নাবিলা মৃদু হাসল। মনে মনে বলল,
— “আপনারা যথেষ্ট ভালো মানুষ। আপনাদের সাথে আবার দেখা হোক কিন্তু ওই অসুরটার সাথে যেন আর কখনো দেখা না হয়।”
বাসস্ট্যান্ডে এসে নাবিলার মনে পড়ে গেল সেই রাতের কথা। সেই পথ, যেটা অজান্তেই ওর জীবনে এক অচেনা মোড় এনেছিল। না চাইতেও এই পথঘাট সবটাই তার চেনা, সামিরের সাথে এই পথেই তো পা বাড়িয়েছিল।
বাসে উঠে বসেও নাবিলার মনটা ভারাক্রান্ত থাকল। কেন এমন হচ্ছে বুঝতে পারছিল না, এতটা মন খারাপ আগে কখনো হয়নি। ওহ আচ্ছা, হবে কী করে? তখন তো সামির ছিল না জীবনে। ওই একগাদা স্মৃতি আর বেদনার ভার বুকে ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছিল। নাবিলা ওইমুহূর্তে বসে থেকে ওর জীবনের সকল দুঃখ-কষ্টের জন্য সামির ইয়াসিরকেই দোষী সাব্যস্ত করল।
.
.
.
চলবে….

#প্রিয়াঙ্গন❤️ [পর্ব-০৮]
~আফিয়া আফরিন

রেশমা আর নেওয়াজ আহসান ড্রইংরুমে বসে ছেলেকে নিয়ে গল্প করছিলেন। সামির এতক্ষণ এখানেই উপস্থিত ছিল। মা-বাবার কথার প্রসঙ্গ যখন ঘুরেফিরে ওর বিয়ের দিকে যাচ্ছিল, তখন উঠে নিজের ঘরে চলে এসেছে। এমন সময় কলিংবেলের টুংটাং শব্দে রেশমা উঠে দরজার দিকে গেলেন। দরজা খুলতেই সামনে পরিচিত কয়েকটা মুখ; নিহাদ, সাগর, সাকিব, ইশরাক। এরা সামিরের খুব কাছের বন্ধু এবং স্কুলে পড়ার সময় থেকে পরিচিত। রেশমা ওদের দেখে বেশ খুশি হলেন। বললেন,
— “আহা তোমরা? কতদিন পর দেখা! এসো, এসো ভেতরে। কী খবর তোমাদের?”

ওরা ভেতরে ঢুকেই আন্টির সাথে কথাবার্তা বলল, কিন্তু মূল প্রসঙ্গ ঘুরে গেল সামিরের দিকে। ইশরাক একটু ভুরু কুঁচকে বলল,
— “আন্টি, সামির ফিরেছে অথচ আমাদের সাথে একবারও দেখা করল না? এমনকি ওই আসছে, তাও বলে নাই। আমরা অন্যের মুখে খবর পেয়েছি। ফোন দিলাম, কোনো রেসপন্স নাই। তাই সোজা চলে এলাম।”

রেশমা মৃদু হেসে মাথা নাড়লেন,
— “বেশ করেছো। যাও, ভেতরে যাও। সামিরকে রুমেই পাওয়া যাবে।”
চার বন্ধু এগিয়ে এলো। সামিরের ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। করিডোরে দাঁড়িয়েই নিহাদ দরজায় জোরে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল,
— “এই শালা, দরজা খোল!”

তার সাথে সাগর, সাকিব আর ইশরাকও সুর মিলিয়ে হট্টগোল শুরু করল,
— “আরে ভাই আমরা এসেছি। কোন শোকে দরজায় খিল দিয়েছিস?”
— “দরজা না খুললে ভেঙে ফেলব কিন্তু।”
ওরা একদম বাচ্চাদের মতো শুরু করে দিল। সামিরের মন-মেজাজ ঠিক ছিল না। ওরা অনেকবার ফোন করেছিল। ইচ্ছাকৃত ফোন ধরে নাই সে। এখন বাড়ি অবধি চলে এসেছে। আবার দরজার উপর আক্রমণ চালাচ্ছে। এরা আর বড় হলো না… সামির উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল। তার মুখে অগোছালো এক বিরক্তির ছাপ। কিন্তু ইশরাক তোয়াক্কা না করেই তাকে পাশ কাটিয়ে সোজা ঘরে ঢুকে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়ল।
— “কী হে ভাই?” ইশরাক ভ্রু তুলে তাকাল, “সমস্যা কী? মুড অফ রাখছোস ক্যান? বিরহে ভুগোস নাকি? ফোন ধরলি না, দেখা করলি না। এইসব কি শুরু করছিস?”

নিহাদও পেছন থেকে এগিয়ে এসে হাত গুটিয়ে দাঁড়াল। খোঁচা মেরে সেও জিজ্ঞেস করল,
— “কাহিনী কী মাম্মা?”

স্বামীর নির্বিকার ভঙ্গিতে উত্তর দিল,
— “কোনো কাহিনী নাই।”
— “হুদাই ভং ধরছোস? এক্স গার্লফ্রেন্ডের বিয়ের দিনও তো চিল ছিলি। হঠাৎ কি হয়েছে বল? আমাদের বল, আমরা শুনি একটু। তোর চেহারার মধ্যে একটা চোর চোর ভাব আইতেছে। ঝেড়ে কাশ…”

সামির কয়েকমুহূর্ত ওদের চোখমুখ দেখে বোঝার চেষ্টা করল, মা কি কিছু বলেছে নাকি? ঘটনার ইতিবৃত্ত ওরা জেনেছে? কিন্তু না, মনে হলো ওরা কিছুই জানে না। তখনই মুখের সেই আঁধার ভাবটাকে সরিয়ে দিল।
— “মুড ঠিক আছে। শরীরটাই একটু খারাপ লাগছিল। এখন ঠিক আছি। তোদের সাথে কাল দেখা করতাম। আজ একটু ব্যস্ত…”

— “কই ব্যস্ত? কী নিয়ে ব্যস্ত?” নিহাদ ভুরু কুঁচকে বলল।

— “কিসের ব্যস্ততা দেখাস আমাদের? নাকি কোনো সিক্রেট মিটিং? ভাই ভাবসাব ভালো ঠেকতেছে না।” ইশরাক ঠাট্টা করল।

— “কিছু লুকাচ্ছিস মনে হচ্ছে।” সাগরও যোগ করল। এমন সময় রেশমা হাতে ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। ট্রে ভর্তি গরম চা, কেক আর নাস্তা। সাগরের শেষ কথাটা কানে যেতেই হেসে উঠলেন। বললেন,
— “তোমাদের তো এখনো ঘটনা বলাই হয়নি।”

সামির ভ্রু কুঁচকে দ্রুত হাতের ইশারায় মাকে চুপ করতে বলল। কিন্তু রেশমা পাত্তা দিলেন না। উল্টো সকলের উদ্দেশ্যে বললেন,
— “সামিরের বিয়ে দিয়েছি… তা জানো?”

প্রথমে ইশরাক স্থির চোখে একবার আন্টির দিকে তাকাল, তারপর সামিরের দিকে ফিরল। নিহাদও হাঁ করে তাকিয়ে রইল। তারপর সাকিব আর সাগর প্রায় একইসাথে বলে উঠল,
— “কি? বিয়ে?”
চারজনের মুখে একই রকম অবিশ্বাস। ওরা একবার আন্টির দিকে, আরেকবার বন্ধুর দিকে তাকাচ্ছিল। রেশমা ট্রে নামিয়ে রেখে হেসে বললেন,
— “হ্যাঁ, বিয়ে দিয়ে দিলাম। মেয়েটা খুব ভালো, বুঝলা। হঠাৎ করেই যেহেতু বিয়ে হয়ে গেল, তাই তোমাদের জানানোর সুযোগ হলো না। সমস্যা নাই, বউ তুলে আনার সময় তখন বন্ধুর বিয়ে খাবা।”

চারজন তখন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছিল। মস্তিষ্কে প্রসেসিং চলছে, কিন্তু সিস্টেম শূণ্য। সামির বিয়ে করেছে? ইশরাক হেলান দিয়ে বসে, ঠোঁট কামড়ে সামিরের দিকে তাকাল। একটু সন্দেহ, একটু কৌতূহলের দৃষ্টিতে। নিহাদ ভ্রু তুলে বলল,
—“মানে কেমনে কি?”
সাকিব নিজের চশমা ঠিক করল। সাগর তো একদম চুপ। মুখে এমন একটা এক্সপ্রেশন যে বোঝার চেষ্টা করছে, এটা কি আসলেই ঘটছে নাকি আমি স্বপ্ন দেখতেছি? মানুষ তো বিয়ে করতেই পারে। স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু সামির? আর হঠাৎ করেই? ওরা মেনেই নিতে পারছে না। চারজনে একসাথে সামিরের দিকে তাকাল। সামির একদম কিছুই হয়নি টাইপ নির্বিকার চাহনি নিক্ষেপ করল। বিয়ের খবরে ওদের প্রতিক্রিয়ার সাথে তার কোনো সম্পর্কই নেই।
.
নাবিলা বিয়ের খবরটা বান্ধবীদের কাউকে জানাল না। কেনই বা জানাবে? স্বামী নেই, সংসার নেই, কাগজে-কলমে একটা নাম বদলানো ছাড়া আর কিছুই ঘটেনি। বাড়ি ফিরেই আগের মতই সবার সাথে ধুমসে আড্ডা, হাসি-ঠাট্টা, হৈ-হুল্লোড় শুরু করে দিল। ওকে দেখে কে বলবে, জীবনে এত বড় পরিবর্তন এসেছে! নীতু অবশ্য মেয়েকে থামাতে গিয়ে বলেই ফেললেন,
— “একটু সমঝে চলাফেরা কর মা। আগে যা করেছিস, ভুলে যা। এখন তোর একটা আলাদা জীবন আছে, তাই না? একটু স্থির হ।”

নাবিলা কথাটা কানে তুলল না। তার যুক্তি একটাই; একটাই জীবন, ডিপ্রেশনে ভুগে রোগী হয়ে থাকার কোনো মানেই হয় না।
আগামীকাল নাবিলার রেজাল্ট দিবে। কিন্তু ওর মধ্যে একদমই টেনশনের ছাপ নেই। বরং পুরোটা দিনটা একধরনের ছুটির মত কাটাচ্ছে। আরামসে খাচ্ছে, গল্প করছে, দৌড়াচ্ছে, লাফাচ্ছে। ওর মুখে হাসি, চোখে স্বচ্ছতা সবসময়ের মত। এই রাতের ঘুমও ভালো হয়েছে, নিদ্রায় পূর্ণ প্রফুল্লতা। সকালে ঘুম থেকে উঠে বাবার সঙ্গে বসে স্বাভাবিকভাবেই কথা শুরু করল। পরীক্ষার প্রস্তুতি, কতটুকু ভালো হয়েছে, পরীক্ষায় কী কী হয়েছে… এসব। ওর ভাবনায় একটুও চিন্তা নেই। ও জানে ভালোই করেছে, তাই মন শান্ত।
ঘড়ির কাঁটা এগারোটা বাজিয়ে দিল, রেজাল্ট ঘোষণার সময়। ফোনে খবর পাওয়ার সাথে সাথেই ওর মুখে ফুটে উঠল সেই অপ্রতিদ্বন্দ্বিত হাসি—“এ প্লাস”। এখন তো শ্বশুরবাড়ি থেকেও ফোন করেও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করল সবাই। তারা সবাই গর্বিত, খুশি ওর সফলতা নিয়ে।

তৎক্ষণাৎ বাবা গিয়ে একগাদা মিষ্টি নিয়ে এলেন। বাড়ির পরিবেশে একটা খুশি খুশি আমেজ বিরাজ করছে। নীতু হঠাৎ বলল,
— “সামির তো শুনেছে, তাইনা রে নাবিল? ও নিশ্চয়ই খুব খুশি হয়েছে।”
বাড়ির সবাই জানে, সামিরের সাথে রোজ নাবিলার কথা হয়… হচ্ছে। নাবিলা এই সম্পর্কে কাউকে কিছু বলে নাই। তবে এইমুহূর্তে একটু বিরক্তি নিয়ে বলল,
— “ও কেন খুশি হবে? কী আশ্চর্য ব্যাপার।”
— “বউয়ের সফলতায় স্বামীই প্রথম খুশি হয়, বুঝবি না তুই এখনো। সময় গেলে আস্তে আস্তে বুঝতে পারবি।”
নাবিলা মায়ের দিকে তাকাল। মাকে তো কোনো কথা বলাই বেকার। সামির ইয়াসির একটা জাদু করে রেখেছে, কেউ ওর খারাপ রূপ দেখতেই পায় না।
নাবিলার মুখ ভেংচানি দেখে নীতুর চেহারায় একটু দুঃখ আর হতাশার মিশ্রিত ভাব ফুটে উঠল, কিন্তু কিছু বলল না। নাবিলার মনে হয়, এই ছোট্ট দুঃখটা তাকে একেবারেই জানানো উচিত নয়। মা-বাবাসহ সকলে পজেটিভ ভাবছে, তারা নিজেদের মত ভাবুক। কারো ভাবনায় ব্যাগ্রা দেওয়ার ইচ্ছে একদম নেই। সামিরের ভালোটাই দেখুক সকলে, খারাপটা বরং ওর জন্যই তোলা থাক।

সামির অবশ্য নাবিলার রেজাল্টের কথা শুনে “জাতে মাতাল তালে ঠিক” উপাধি দিয়ে দিল। তাছাড়া আর কী দিবে? ওকে দেখে মনে হয় না, পড়াশোনা আদৌ করে। সারাদিন মাথার মধ্যে আরেকজনকে কীভাবে ঠোকাবে সেই চিন্তা ঘুরঘুর করে। পরদিন রেশমা ঘোষণা করলেন,
— “আমরা সবাই নাটোর যাব। নাবিলাকে দেখে আসব, ওর জন্য খুব মন টানছে। তাছাড়া ওকে শুভেচ্ছা জানানোর একটা বিষয় আছে। ফোনে কিছু বলা আর সরাসরি গিয়ে আদর করা তো এক না।”

সামির মুহূর্তেই বিরক্ত হয়ে উঠল। বিড়বিড় করে বলল
— “ইশশশ, ন্যাকা। কিন্তু মুখে মাকে বলল, “এই বয়সে এত ঘোরাঘুরি ঠিক না মা। মানুষ হাসাহাসি করবে।”

রেশমা ক্ষেপে গেলে। তার হাঁটুর বয়সী ছেলে তাকেই বয়সের খোঁচা দিচ্ছে। দু’দিন আগেই জন্মালো। কেঁদেকেটে সারা বাড়ি এক করে দিচ্ছিল। তিনি বললেন,
— “তুই কিন্তু দিনদিন খুব বেয়াদবি শিখেছিস। মানুষ হাসলে হাসুক, আমার কি তাতে? তুইও যাবি আমাদের সাথে। এইবার আমরা সবাই মিলে যাব। তুই গেলে নাবিলার সাথে একটু ভালোভাবে কথা বলবি। নতুন বউ, মন রাখতে হয়।”
— “মা, মন রাখার মত বউ হলে মনও রাখতাম আর মানও।”

রেশমা চোখ রাঙ্গাল,
— “আবার বেয়াদবি? এইসব উল্টোপাল্টা কথা বলবি না। বিয়ে মানে দুইজনের সমঝোতা। তুই যদি না বুঝিস, তাহলে কিভাবে চলবে?”
— “মা, জোর করে সমঝোতা হয় না।”

রেশমা ধমকের সুরে বললেন,
— “থাপড়ে চেহারার নকশা বদলে দিব। আমি চাই না তোরা ঝগড়া কর। ব্যবহার ভালো করবি। নীতু, নেওয়াজ ভাই তোকে যথেষ্ট ভালোবাসে। তাদের ভালোবাসার মূল্য দিস। নাবিলা বাচ্চা মানুষ, ওকে বুঝিস। আমার যতটুকু বলার ছিল বললাম, বাকিটা তোর ইচ্ছে।”
রেশমা উঠে গেলেন। সামির ফের ভুরু কুঁচকাল। মা সবকিছু নিজের মত বলল, নিজের ইচ্ছেগুলোও ঘাড়ে চাপিয়ে দিল। তারপর বলল, বাকিটা তোর ইচ্ছে। কোনো মানে হয় এসবের? এভাবে সবকিছু চাপিয়ে দিলে কীভাবে হবে? ও তো যাবেই না। দরকার হলে আত্মগোপনে চলে যাবে তাও শ্বশুরবাড়ি নয়।
সামির বাহিরে বের হলো। এসব কথা ভেবে মাথা গরম করার চেয়ে মাঠে গিয়ে ক্রিকেটে আউট হয়ে মেজাজ গরম করা ভালো। গলির মোড়ে এসে কামিনীকে দেখতে পেল। ওর সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছে নেই। পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল, কিন্তু কামিনী এগিয়ে এসে রাস্তা আটকাল। ওর মুখে সেই এক কথা,
— “তুমি তো বলেছিলে, বিয়েই নাকি করবে না। তো বিয়ে করলে কেনো?”
— “তার কৈফিয়ত আমি তোমাকে দিব?”
— “আলবৎ দিবে, দিতে বাধ্য। কারণ তুমি আমাকেই বলেছিলে, তুমি বিয়েই করবে না।”

সামির নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল,
— “তুমি তো বলেছিলে, আর কথাই নাকি বলবে না আমার সাথে। এখন এখানে দাঁড়িয়ে ইন্টারভিউ নিচ্ছো কেনো?”

কামিনী বিরক্ত স্বরে বলল,
— “বিষয়টা সিরিয়াস।”
— “আমার জীবন নিয়ে আমি যথেষ্ট সিরিয়াস, কিন্তু তোমার প্রশ্ন নিয়ে না।”

কামিনী মৃদু হেসে বলল,
— “তুমি একদম বদলাওনি, আগের মতই আছো। এত ইগো ঠিক?”

সামির কাঁধ ঝাঁকাল,
— “কিন্তু তুমি বদলেছ। তখন অন্তত একটু কিউট লাগত কিন্তু এখন… হাহ।”
— “তুমি এমন কেনো?”
— “তুমি যেরকম চাও ঠিক সেরকম না হওয়ার জন্য।” একবাক্যে উত্তর দিয়ে হাসতে হাসতে হাঁটা দিল সামির, কামিনী রাগে ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে রইল। সামিরের সাথে কামিনীর সম্পর্কটা শেষ হয়েছিল একেবারে হুট করেই। একদিন ছোট্ট একটা ভুল বোঝাবুঝি নিয়ে শুরু হওয়া ঝগড়া। কামিনীর অন্যকারো প্রতি বেশি গুরুত্ব ছিল। কামিনী সহ্য করতে পারেনি সামিরের অতি-নিয়ন্ত্রণ আর ত্যাড়া মেজাজ। বিষয়টা দু’জনের ইগোতে লাগে; ফলাফল, সম্পর্কটা ভেঙে গেল। তারপর কীভাবে যেনো বড় ভাইয়ের বউ হয়ে এলো।

পরদিন সকালটা বেশ ব্যস্ততায় কাটল। রেশমারা নাটোরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন তবে একা নন, তার সাথে আয়ান আর অন্বেষাও ছিল। আয়ান তো আনন্দে গুনগুন করে গান ধরেছে, আর অন্বেষা ব্যাগ গোছানোর ফাঁকে ফাঁকে খোঁচাচ্ছিল সামিরকে।
— “না না, বুঝে নিচ্ছি তোর খেলাটা। আমাদের সঙ্গে বউয়ের কাছে যাবি না বলে যে যাচ্ছিস না, এটা বোঝার বুদ্ধি আমাদের আছে। আচ্ছা থাক, আর জোর করব না। কাবাব মে হাড্ডি হওয়ার শখ নাই ভাই। পরে গিয়ে চুটিয়ে প্রেম করে আসিস।”

রায়হান অফিসে ছুটি না পাওয়ায় যেতে পারল না, আর রায়হান যাবে না শুনে কামিনীও যাবে না। অকারণেই রায়হানের সাথে একধাপ ঝগড়া করল। সামিরের মনে হলো, রায়হানের সঙ্গে ওই একধাপ ঝগড়াটা করে কামিনী আসলে ওর ওপর ক্ষোভ ঝাড়ছে। বেচারা বড় ভাই… বউয়ের ফ্রাস্ট্রেশনের স্বীকার হতে হতেই জীবন যাবে।
.
রেশমা নাবিলার জন্য একের পর এক ইচ্ছেমতো জিনিসপত্র কিনলেন। নতুন জামা, পছন্দের বই, মিষ্টি-স্ন্যাকস, সবই নাবিলার মুখে হাসি ফোটানোর মতো। ওরা এসে পৌঁছেছে বিকাল নাগাদ। সবাই বেশ খুশি তবে নেওয়াজ আহসান একটু মনক্ষুণ্ণ হলেন। জামাই এলো না… সামিরের খোঁজ নিলেন বারবার। একটু জোরাজুরি করে ওর কথা জানতে চাচ্ছেন। সামির কি কোনো কারণে অসন্তুষ্ট কিংবা রেগে আছে। অবশ্য সেটা হলেও অস্বাভাবিক না, বিয়েটা তো হয়েছিল ওইভাবেই।
রেশমা প্রতিবারই মুখে অপ্রস্তুতভাব নিয়ে অর্ধেক কথা বললেন। তার মনে চিন্তার ঢেউ, “এই বেয়াদব ছেলেটা একদম কথা শোনে না। কী মুসিবতে ফেললো আমাদের।”

নাবিলা সামিরের অনুপস্থিতিতে স্বস্তি পেল। ওর চেহারা দেখতে না পেয়ে ভালোই লাগছে। ওকে দেখলেই এমন ক্ষোভ জাগে যে ঘুষি দিয়ে ওর মুখের নকশা বদলে দিতে ইচ্ছে করে।
আয়ান আর অন্বেষার সঙ্গে নাবিলার বেশ ভাব হলো। বয়সে বড় হলেও, নাবিলার সাথে ওরা ওর মতো করেই মিশলো। অন্বেষা বারবার হাসতে হাসতে বলল,
— “আমার বুড়ো ভাই এত সুন্দর মেয়ে পেল কীভাবে? ইশশশ, কত মিষ্টি! আমারই টুপ করে ধরে খেয়ে ফেলতে মন চাইছে।”
নাবিলা ঠোঁট টিপে হাসল। সামিরের হাজারো বদনাম করতে পারলেও ওকে ‘বুড়ো’ বলতে পারবে না। এটা সামিরের সাথে মোটেও মানায় না। মন মানতে না চাইলেও নাবিলা অজান্তেই স্বীকার করল, সামির সত্যিই বেশ সুদর্শন। বিশেষ করে ওর চুলের কাটিংটা একেবারে জোস। হালকা ঝাঁকড়া, কাঁধের দিকে ঢলে নামা এবং কপালের কাছে একটু এলিগ্যান্ট। এই স্টাইলটা ওর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মানায়, ওকে প্রাণবন্ত করে তোলে। সামিরের গায়ের রঙও রেশমা আন্টির মতো সুন্দর আর দীপ্তিময়, লম্বাচওড়া গড়ন তার উপরে আরেকটা মাধুর্য যোগ করে।
সবমিলিয়ে নাবিলা নিজের কাছে গোপনে মেনে নিল, সেই রাতের বাসস্ট্যান্ডে বসে আড়চোখে তাকে অনেকবার দেখছিল। সামিরের সেই উপস্থিতি ওর মনে অন্যরকম ছিল, যদিও তা স্বীকার করতে মন চায় না।

সামির বাড়ির লাউঞ্জে বসে ফেসবুক স্ক্রল করছিল। হঠাৎ নিউজফিডে Annesha Tasnim-এর আইডিটা দেখল। সে আইডি থেকে অসংখ্য ছবি পোস্ট করা হয়েছে। সবই নাবিলাকে নিয়ে, হাসছে বত্রিশটা দাঁত বের করে। ক্যাপশনে লেখা, “বিয়া যে কত মজা গো, খালি খাওন আর খাওন।”
সামিরের সহ্য হলো না। ও বলল,
— “মানুষের জীবন তেজপাতা বানিয়ে খুব খিলখিল করা হচ্ছে।” এমন সময় সামিরের ফোনটা বেজে উঠল। আননোন নাম্বার। রিসিভ করতেই ধাক্কা খেল। শ্বশুরমশাই… সামির থমকে গেল। নাটোর যাওয়ার কোনো ইচ্ছেই নেই কিন্তু তিনি এমনভাবে বললেন যে মুখের উপর না বলাটা অভদ্রতামি হবে। সামিরর মুখে অনিচ্ছার ছাপ, কিন্তু উপায় নেই। অগত্যা রাজি হতে হলো। আবারও নাবিলাকে সহ্য করতে হবে, আবারও ওই পথে পা বাড়াতে হবে। সামির অবশ্য শান্তনা দিল এই বলে যে,
— “যা ভাই, যা। গিয়ে বরং ভালো জামাই হয়ে সাজার চেষ্টা করে জামাই আদর খেয়ে আয়। নাবিলার সাথে কথা বলতে হবে না।”

সামির যে আসবে, সেটা নেওয়াজ আহসান কাউকে জানাননি। তিনি মাঝেমধ্যে এমন চমক দিতে ভালোবাসেন। তাই বাড়ির সবাই যখন সামিরকে দেখল তারা একমুহূর্তের জন্য সবাই হতভম্ব হয়ে গেল। কেউ অবাক, কেউ হতচকিত। নাবিলা ওখানে উপস্থিত ছিল না। দুপুরের পর ঘুমিয়েছিল, এখনও ঘুমে। অন্বেষা সামিরকে নিয়ে এলো। সামির ভেতরে এসে এক সাইডে দাঁড়াল। অন্বেষা গিয়ে নাবিলাকে ডাকল,
— “এই নাবিলা, উঠো। সামির মানে তোমার স্বামী এসেছে।”

নাবিলা ঘুমের ঘোরে বলল,
— “সামির? হু ইজ সামির? হু ইজ হাজব্যান্ড? আই ডোন্ট নো এনিওয়ান নেমড সামির।”
সামির চুপ করে থেকেও ক্ষুব্ধ হলো। কী সাহস! এখন এই মেয়ে তাকে চিনতেও পারছে না? একখানা বিয়ে করে তাকে আর কী কী দেখতে হবে?
.
.
.
চলবে….